Sunday, October 11, 2020

শ্রীজাত

অপেক্ষা – শ্রীজাত

ভ্রু পল্লবে ডাক দিয়েছ, বেশ।
আমার কিন্তু পুরনো অভ্যেস
মিনিট দশেক দেরীতে পৌঁছনো

তোমার ঘড়ি একটু জোরেই ছোটে
আস্তে করে কামড় দিচ্ছ ঠোঁটে
ঠোঁটের নীচে থমকে আছে ব্রণ

কুড়ি মিনিট? বড্ড বাড়াবাড়ি!
দৌড়ে ধরছ ফিরতিপথের গাড়ি
ফিরতিপথেই ভুল হল সময়—

আমারও সব বন্ধুরা গোলমেলে
বুঝিয়েদেবে তোমায় কাছে পেলে
কেমন করে গল্প শুরু হয়!

খোলাচুলের সংজ্ঞা দিতে দিতে
সন্ধে নেমে আসবে বস্তিতে
ভাবছ তোমার অপেক্ষা সার্থক?

জানবেও না আমি ততক্ষনে
অন্ধকার চন্দনের বনে
ঘুরে মরছি, কলকাতার লোক…

 

বর্ষার চিঠি – শ্রীজাত

সোনা, তোমায় সাহস করে লিখছি। জানি বকবে
প্রিপারেশন হয়নি কিচ্ছু। বসছি না পার্ট টুতে
মাথার মধ্যে হাজারখানেক লাইন ঘুরছে, লাইন
এক্ষুনি খুব ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে শুতে

চুল কেটে ফেলেছ? নাকি লম্বা বিনুনিটাই
এপাশ ওপাশ সময় জানায় পেন্ডুলামের মতো
দেখতে পাচ্ছি স্কুলের পথে রেলওয়ে ক্রসিং-এ
ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছ শান্ত, অবনত

এখানে ঝড় হয়ে গেল কাল। জানলার কাচ ভেঙে
ছড়িয়ে পড়েছিল সবার নোংরা বিছানায়
তুলতে গিয়ে হাত কেটেছে। আমার না, অঞ্জনের
একেকজনের রক্ত আসে একেক ঝাপটায়

সবাই বলছে আজও নাকি দেদার হাঙ্গামা
বাসে আগুন, টিয়ার গ্যাস, দোকান ভাঙচুর
কিন্তু আমি কোনও আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না
বৃষ্টি এসে টিনের ছাদে বাজাচ্ছে সন্তুর…

ঝালা চলছে। ঘোড়া যেমন সমুদ্রে দৌড়য়
ভেতর-ভেতর পাগল, কিন্তু সংলাপে পোশাকি…
তুমিই উড়ান দিও, আমার ওড়ার গল্প শেষ
পালক বেচি, আমিও এখন এই শহরের পাখি

 

প্রিয় চড়াই – শ্রীজাত

 

জাপটে ধরে বলব, ‘আমায় চাই?
বৃষ্টি তখন উল্টো ডাঙার মোড়ে
নরম গালে মাখিয়ে দেবো ছাই।
জানিস না তুই, পাখিরা রােজ ওড়ে?

ডানার ভাঁজে মুখ ঘষে, বেশ।
ভিড় করে সব দেখবে কেমন যা তা!
লজ্জা উধাও, ওড়না যখন শেষ…
এক মুহূর্ত থমকে কলকাতা।

পাখির নীড়ের মত না, তাদের চোখ।
আমি বরং বলে, ‘ছিলি কোথায়?
আজকে একটা হেস্তনেস্ত হোক
দিস না বাধা, আমার অসভ্যতায়।

ঠোটের গায়ে ঠোটের গরম ফু…
বৃষ্টি ভেজা শরীর দেখে সবাই
মন কখনও দেখতে পারে,
ধর তারে দেখি, আয় তোকে আজ সবাই

জাপটে ধরে থাকব বহুক্ষণ
রাত নামছে উল্টোডাঙা মোড়ে
অন্ধ আকাশ, বন্ধ টেলিফোন…
দুটো মানুষ জলের ভাষায় পােড়ে।

‘কি হচ্ছে কি?’ বললে খাবি চড়।
আদর খেয়ে চুপ হে, প্রিয় চড়াই
দুটো পাখির ঠোটেই এখন খড়…
চল না, তাদের আবার প্রেমে পড়াই?


প্রস্তাব – শ্রীজাত

ঠিক যেরকম আজকে তোমার মুখের উপর পড়ন্ত রোদ্দুর।
আমারও খুব ইচ্ছে পাঁচিল শ্যাওলা ধরা, সন্ধ্যা ভেঙ্গে চুর

ঠিক যে রকম কাঁদলে তোমার অফিস ফেরত রুমাল জানে সব
আমারও বেশ মেঘ করেছে, ব্যালকনিতে আষাঢ়ে বিপ্লব।

ঠিক যে রকম বারুদের তোমার বন্ধু না তাও আগুন চেয়েছ।
আমারও আজ ফুলকি দেখে আর না-পেরে ঠিকরে পড়ে চোখ

ঠিক যে রকম মেসেজ লিখে ডিলিট আবার ওপাশ ফিরে শুই
আমারও রোজ ভাল লাগে না, বিরক্তিকর সামান্য তর্ক।

ঠিক যেরকম তোমার মুখে এলাচ সুবাস, গলার কাছে ঘাম।
আমারও সব ভুল পথে যায়। সঙ্গে কেবল পুরনাে ডাকনাম।

ঠিক যেরকম মেট্রোতে রােজ মুখ বুজে সব ভুলতে চাওয়ার ছল
আমারও দিন ব্যর্থ তা পায়, সন্ধে বুকে ক্লান্ত মফস্বল….

ঠিক যেরকম ঝাপসা দেখা, বারান্দায় কাটতে থাকে রাত
তাকিয়ে দ্যাখো, নীচে আমি ফুটপাতে ঠায় দাড়িয়ে আছি।
ঠিক করে নাও, ধরবে আমার হাত?

 

বিকেল বেলার ভাঙা ঘুমে পর

এক কাপ চা, ধোঁয়ায় ঢাকা ঘর,

দুপুরে খুব বৃষ্টি হয়ে ঝিম
দূরে যত বাড়ি টিম টিম

কেমন একটা ভিজে মত মন
মুখ থুবড়ে বন্ধ আছে ফোন।

পাড়ার মোড়ে মাথার গিজগিজ
গাড়ি টানায় পিছল ওভার ব্রিজ

ভাঁজফতুয়া ঘুমপাজামার বেশ
বৃষ্টি থেকে উঠেই এ কোন দেশ?

ঠান্ডা হাওয়ায় মনে পড়ার ছল।
কোথাও কোথাও দাড়িয়ে গেছে জল…

রিক্সার ভেঁপু মন কেমনের সুর।
কলেজ ফেরত মেয়েরা চুরমুর

জানলা খুলে এমনি বসে। চুপ।
থমকে থাকা মেঘেরা বিদ্রুপ

যা গেছে তা গেছে জানি, যাও।
এমন বিকেল অনন্ত হয়। তাও

চোখের কোণে যেটুকু চিকচিক…
তুমি এলেই সরিয়ে দিতে, ঠিক।।

 

 

বিশু পাগলের কবিতা – শ্রীজাত

 

বিপদ আবার ডাক দিয়েছে, দমকা বাতাস… আলগা বোতাম…
বসন্তকে সাক্ষী রেখে আজ যদি ফের সঙ্গী হতাম?

একখানা দিন ওলোট পালট, একখানা বেশ ঝাপটা বিকেল
পাগল হওয়া বিশুই কেবল সামলে রাখে নন্দিনীকে।

যা ইচ্ছে তাই বলুক লোকে, নিন্দুকে আর কী না রটায়
অনামী সেই বাস স্টপেজে দেখা হবেই পৌনে ছ’টায়।

একটু হাঁটা, একটু চলা, একটু বসা পাড়ার রোয়াক…
মিথ্যে একটা আঙুল তোমার কপালে আজ সত্যি ছোঁয়াক।

এই দেখা তো মুহূর্ত নয়, অন্যরকম অনন্তকাল
মাথার মধ্যে গুমরে মরে পাগলা হাওয়ার একলা পোকা।

ফিরবে তুমি ভিড় বাসে আর আমার ফেরা চুপবালিশে
চোখের পাতা কমল কি না, কে আর অত রাখছে হিসেব…

কেবল তোমার ফুলের মালা, রাজার দিকে সপাট জেহাদ –
যুগ পেরিয়ে আরেকটিবার আমার হাতে দিও সে হাত…

হাতের রেখায় থাকবে জানি মাইলফলক, সরাইখানা…
কৃষ্ণচূড়ার ছোট্ট চিঠি, রাধাচূড়ার বলতে মানা

বিপদ আসুক, লাগুক বাতাস, ছুটুক সময় তোমার দিকে
পাগল হওয়া বিশুই জেনো আগলে রাখে নন্দিনীকে!

 

 

বর্ষাতিমন

– শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

বর্ষাতিমন, তােমার সঙ্গে ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়া
শুকনাে পায়ের ফুটপাথিয়া কোনদিকে যায় দেখতে হবে
দিনের শেষে লােকাল ট্রেনে মুখ গুজেছে একলা চড়াই
পৌঁছতে তার অনেক দেরি, পৌনে ছ’টা বাজছে সবে।

বর্ষাতিমন, তােমার সঙ্গে দেখা হলেই ঝক্তি বাড়ে।
বেশ তাে ছিলাম ফিরতি ট্রামের জানলা ঘেঁষে বাদামবিলাস
কিন্তু সে আজ ভিড়ের মধ্যে কী যাচ্ছেতাই নজর কাড়ে
বই পড়ছে। মুখটি নিচু। তাকাক তবু, চাই অছিলা…

বাড়ি গিয়েই চা চাপাবে, পােশাক বদল, ফুলঝুরি চান
তপ্ত জলের স্ফুলিঙ্গ সব ছড়িয়ে পড়বে এদিক ওদিক…
একদিন সে বলেছিল, ‘সত্যি বলুন, আপনি কী চান?
বর্ষাতিমন, সে-আক্ষেপ তাে রয়েই গেল আজ অবধি।

মুড়ির বাটি, মেয়ের পড়া, স্বামীর কোনও খবর কোথাও..
স্কুলের খাতা উঁই হয়েছে। রাত জাগা আজ। চোখের বালি।
কালকে আবার লােকাল ট্রেনে মুখ বুজে সব অসভ্যতাও…
বর্ষাতিমন, আজ্ঞা করাে, মেঘগুলাে সব উপড়ে ঢালি?

ফোন করে সব… কিংবা দেখা? দু’কাপ কফি, হালকা গরম?
পাতলা আঙুল হাতের মুঠোয় ধরেই আমার সমস্তটা…
অথবা এক চিঠির ভাষায়… বর্ষাতিমন, আজ্ঞা করাে
তােমার কাজ তাে মুছিয়ে দেওয়া চোখের নীচের একটা ফোঁটা।

কিন্তু আমার দৌড় এটুকুই। ফিরতি ট্রামের বাদামবিলাস।
এই লাইনে ট্রেন চলে না। কেবল দেখি অনেক দূরে।
একলা চড়াই উড়তে উড়তে পেরিয়ে যাচ্ছে পাথরটিলা
ক্লান্ত একটা ডানার ছায়া; মফসসলের সন্ধে জুড়ে…

 

 ঞ্জিনীকে লেখা আমার চিঠি

 শ্রীজাত 

 

 

রঞ্জু সােনা,
তােমার ই-মেল পড়ি না আর। এই অসীমে
হপ্তাপিছু দশ টাকা যায় ট্যাঁক থেকে
ইংলিশ বাদ। বাংলা চালু। শহরে সব রাস্তা চালু
গড়াই, আবার ফিরেও আসি এক ঠেকে
আকাশ ভরা সূর্য তারা, হাওয়ার তখন কী আস্কারা
বুঝিনি, তাও এগিয়ে গেছি চোখ বুজে
ঠেকতে ঠেকতে এখন জানি, দুধ কা দুধ-পানি কা পানি
জীবনে সব স্টেপ নিতে হয় লােক বুঝে।
যে কোন চুলােয় ঘাপটি মেরে কার কফিনে ঠুকছে পেরেক
কে কার ঘাড়ে নল রেখেছে বন্দুকের….
তবু তাে প্রেম সর্বনাশী, পুজোর চাঁদা তুলতে আসি
সাহস পেতে সঙ্গে রাখি বন্ধুকে।
অসীম কালের যে-হিল্লোলে তােমার বাবা দরজা খােলে
দেখেই আমার প্রাণ উবে যায়, রঞ্জিনী
বিকেল করে ঘুরতে বেরােই, স্টিমার চেপে গঙ্গা পেরােই
আমি..তুমি..দাশকেবিন আর মঞ্জিনিস
বেকার ছেলে প্রেম করে আর পদ্য লেখে হাজার হাজার
এমন প্রবাদ হেব্বি প্রাচীন অরণ্যে
কিন্তু তার আড়ালের খবর? জবরদখল? দখলজবর?
হাজারবার মরার আগে মরণ নেই।
কান পেতেছি চোখ মেলেছি যা দেখেছি চমকে গেছি
থমকে গেছি পাড়ার মােড়ে রাতদুপুর
ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডানা পাখি পায় দৈনিক চারানা
কাপড় কিনলে হয় না মুখের ভাতটুকু
প্রাতঃকৃত্য করছি বসে, এই সময় কে জমিয়ে কবে
লাথ ঝেড়েছে কাজলকালাে পশ্চাতে
একেই দু-দিন হয় না, শক্ত, তার ওপরে চোটে র রক্ত-

খুব লেগেছে। কিন্তু আমি, বস, তাতে
রাগ করিনি।ক্ষমাই ধর্ম। শঙ্খ ঘােষের ‘কবির ধর্ম’
গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরেছি কলকাতায়
ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছি…হাত-পা দিয়ে ঘুম তাড়াচ্ছি…
বেঁচে ফিরছি, সেটাই তাে আসল কথা
টাকা খুঁজছি নােংরা হাতে, ঠাণ্ডাঘরে, কারখানাতে
তুমি হতাশ, আমিও শালা বিরক্ত
দেয়াল দেখে খিস্তি করি…কোলবালিশ জড়িয়ে ধরি…
কান্না আসে। এ কোনদেশি বীরত্ব?
বাড়ির লােকের উত্তেজনা-‘কেন কিছু একটা করছ না?”
যেন আজো বেকার আছি শখ করে।
তবু এমন দেশপ্রেম, যে এমপ্লয়মেন্ট -এক্সচেঞ্জে
নাম লিখেছি সােনাবরণ অক্ষরে
তুমি বরং সেটল করাে-গঙ্গারামকে পাত্র ধরাে
ফরেন কাটো। দুঃখ পাব, সামান্যই…
আমায় নিয়ে খেলছে সবাই, সুযােগ পেলেই মুরগি জবাই
তুমি তােমার। আমি তাে আর আমার নই
ঢপের আকাশ, সূর্য, তারা…স্বপ্নগুলাে বাস্তুহারা
এবার থেকে নৌকো বুঝে পাল তুলাে
আজ এটুকুই। সামলে থেকো, আমায় ছাড়াই বাঁচতে শেখাে
আদর নিও-
ইতি
                                                                                     তোমার
                                                                                  ফালতু লােক
 
 
 
 
 
সহযাত্রিণী
– শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
 
উল্টোদিকের সিট পেয়েছ হুডুমধাক্কা ভিড়ের মধ্যে
ঠিক তোমাকে দেখতে পেলাম, সেই ভোলাচুল, হাতের মুঠোয়
মোটকা একটা ইংরিজি বই, মাঝের পাতায় ক্লিপ আটকানো
ইস্তিরিপাট একটা শাড়ি, আগে এমন হালকা সবুজ
পরতে না তো? কিন্তু তোমায় মানাচ্ছে বেশ। বসতে পেয়েই
কী একটা বেশ মেসেজ না কি দেখছ ফোনে, হঠাৎ এদিক…
নাহ, বাঁচালে। এগিয়ে যাব? একটা দুটো কথা… উহু
অন্যদিন কী বিরক্তি আজ এই ভিড় আমার আশীর্বাদী
কেবলধাক্কা ভিড়ের মধ্যে মনে পড়ছে বৃষ্টির সেই
কী যাচ্ছেতাই বিকেলবেলা সুটকেস আর ব্যাগ গোছানো ,
কত না বার বোঝাচ্ছি আর হাত ছাড়িয়ে তুমিও তেমন
একের পর এক চিঠির বাক্স, জন্মদিনের সব উপহার
ছুড়ে ফেলছ মেঝের ওপর, দেখতে দেখতে মেঝেয় ফাটল
থাকব না আর তোমার সঙ্গে, তোমার সঙ্গে থাকা যায় না।
এক পা চলার লোক না তুমি… এসব কথা বলতে বলতে
দড়াম করে দরজা টেনে… একটা ট্যাক্সি, পেছন পেছন
দৌড়ে এসে আমি তখন কালো ধোঁয়ায় মুখ ঢাকছি,
হঠাৎ কেমন মনে পড়ল এই এতদিন পরে আবার
আবার যখন মেট্রোতে আজ ভিড়ের মধ্যে হালকা সবুজ…
আগে এমন পরতে না তো? চাইলে তুমি কেমন কঠিন।
কয়েকশো ফোন কলের আমার জবাব দাওনি, দশটা ই-মেল
পাড়ায় গেছি, বাইরে তালা, ‘ওরা এখন কেউ থাকে না…’
কেউ থাকে না কেউ থাকে না আমার মতো লোকের সঙ্গে
এক পা চলার লোক না আমি… রেলের ভেতর ভিড় কমছে..
রবীন্দ্র সরোবর, নাকি নেতাজি ভবনে নামবে?
অফিস যাচ্ছ? না আজ ছুটি? তৃণার বাড়ি, না অন্য কেউ…
অন্ধকার টানেল পেরিয়ে ছুটেছে ট্রেন পাগলা ঘোড়া
একই দিকে যাচ্ছি কিন্তু কেউ কারও আর কক্ষনও না।
এই কি তবে সঙ্গে যাওয়া?
 
 
 
 
 
 
 
 
ভুল বসন্তের কবিতা - শ্রীজাত
 
তিনটে চারটে ভুল বসন্ত
হাওয়ার ঝাপটা... পুরুষ মন তো,
আঁচল থেকে জমির দিকে উড়ান দিচ্ছে
মন জানানোর ব্যর্থ ছন্দ,
মাথার মধ্যে ঠোঁটের গন্ধ।
চুমুর চেয়েও রোমাঞ্চকর চুমুর ইচ্ছে।
শান্তশিষ্ট কলেজকন্যা,
দেখতে শুনতে শ্যারন স্টোন না।
কিন্তু সে রোজ রোদের কাছে তালিম নিচ্ছে।
রং ছড়াচ্ছে কমনরুমটি
বুকের ভেতর ট্রামের গুমটি...
চুমুর চেয়েও অনেক গোপন চুমুর ইচ্ছে।
যে-নিশ্বাসের গরম ঝড়কে
যায় না বাঁধা নরম তর্কে...
জিভ ছাড়া তো সে-নিশ্বাসের নেই চিকিচ্ছে
কিন্তু সে-জিভ জড়িয়ে চুপটি
লিপস্টিকের নেই বিলুপ্তি
চুমুর চেয়েও পর্দানসীন চুমুর ইচ্ছে।
তিনটে চারটে ভুল বাসন্তী
ঘুমের মধ্যে পাগলা ঘন্টি!
না-পাওয়া সেই গন্ধস্বাদের কাব্য লিখছে...
বেশির ভাগই এক শালিখ তো,
মেলে না তাই মাত্রাবৃত্ত।
চুমুর চেয়েও অসম্পূর্ণ চুমুর ইচ্ছে।
এখন বৃষ্টি নাছোড়বান্দা
ভাগ করে নেয় ঘর-বারান্দা।
হয়তো সে আজ অন্য কারও সঙ্গে ভিজছে...
ঠোঁটের বয়স বাড়তে বাড়তে
রাখছে আদর স্মৃতির স্বার্থে
চুমুর চেয়েও অতীতগামী চুমুর ইচ্ছে।
 
 
 
 
 
 
আগুনরূপাকে
কবি শ্রীজাত 
 
তুমি টিনেজ নদী, কিছু পাগলপারা
আমি প্রাচীন দেয়াল ,ঝুরো পলেস্তরা
তুমি কাচের বিষাদ , মিহি বাতাস ঝালর
আমি বেমক্কা হাত , ভাঙি ব্যথার আলো
তুমি অসম্ভবা । চিরসুপার লোটো ।
আমি বাদলদিনে একা দেবব্রত।
তুমি সফল পথের ধারে পরাগধানী
আমি সামান্য লোক, দুটো ম্যাজিক জানি ।
তাতে আধেক জোটে ,থাকে আধেক দেনা
এক পাঁকাল হাতে লেখা দাঁড়াচ্ছেনা ।
তবু লেখাই দাঁড়ায়, ছোটে কী জোর হাওয়া --
জিয়া ধড়ক ধড়ক -- যেন ট্রেনের আওয়াজ ।
আমি নতুন মাতাল। জমে দু'পেগ হেবি।
যদি প্রসাদ না পাই তুমি কিসের দেবী ?
তুমি কিসের মহৎ তুমি কিসের উদার
যদি সাপের কামড় খেয়ে মেটাই ক্ষুধা ।
যদি বিষের পায়েস খেয়ে হজম করি
তবে প্রসাদ পাব? তবে কভার স্টোরি ?
এসো খেলাও আমায়। আমি সুরের আদল
দেখি সাহস কত, দুটো কথায় বাঁধো --
দ্যাখো বাঁধন ছিঁড়ে ওড়ে লেখার খাতা
মাথা আকাশ ছোঁয়া, নীচে ,হ্যাঁ, কলকাতা
তারও পাড়ায় -পাড়ায় কত পাগল ছেলে
গেল নিরুদ্দেশে ... তুমি আরাম পেলে
জানি আমার প্রিয় , তুমি আগুনরূপা
রাতে চিতার মতো জ্বলে তোমার দু'পাশ
জ্বলে দেমার শিখা। তবু সজাগ থেকো
হাতে সময় ঢালাও । তুমি যতই পালাও
তুমি যতই জ্বালাও
আমি আগুন খেকো।

 
 
 

দহন – শ্রীজাত

সন্ধে নামছে তখন তোমার মুখে,
আকাশে দূরের তারা চেনাচ্ছ তুমি…
আমরা দেখছি আগুনের বন্ধুকে।
জীবন ধ্রুবক। মৃত্যুই মরসুমি।

একজীবনের এতগুলো সংলাপ
সব ঠিকঠাক আদায়ের পর ছুটি।
আমরা দেখছি শ্রান্ত পায়ের ছাপ,
ভালবাসা তবু দেখায়নি বিচ্যুতি।

সন্ধে নামছে আবার তোমার কাছে।
এবার তোমাকে নিয়ে যাবে ব’লে আসা।
ক’জন মানুষ প্রবাহের মতো বাঁচে?
চিনিয়ে দিচ্ছ দূরের তারার ভাষা।

দাহ মুছে যাক। দহন জাগুক দাগে।
মহীরুহ গেলে নতজানু হয় ঝড়ও।
ছাই উড়ে যেতে এক মুহূর্ত লাগে।
তোমার আগুন, আকাশের চেয়ে বড়…

 
 
 

সাবধানে যেও – শ্রীজাত

শেষ দেখা পানপাত্র হাতে।
বলেছিলে, ‘সাবধানে যেও’।
শীত ছিল। আলখাল্লা গান…
তোমার তো সুরই পরিধেয়।

শেষ আড্ডা সারিগান নিয়ে।
তুমি কথা বলছিলে মাটির –
তোমারই ভাষায় জল পেল
কত খেতে-না-পাওয়া ফকির…

শেষ হাত রাখা ছিল কাঁধে।
বলেছিলে, ‘সাবধানে যেও’।
করিম শাহের সমাধিতে
রোজ ফুল দিতে আসে, কে ও?

তুমি বড় অসময়ে গেলে।
এখন এই ধুলোঢাকা দেশে
তোমাকেই প্রয়োজন ছিল
বাউল জাগানো দরবেশে…

শেষ ঠোঁট ভিজেছিল গানে।
বলেছিলে, ‘সাবধানে যেও’।
আজ ভাবি, এ অসাবধানে
তোমাকেও ভুলে যাওয়া শ্রেয়…

 
 
 

সে আর আমি – শ্রীজাত

তার যেরকম তছনছিয়া স্বভাব
ঝড়ের পিঠে সওয়ার হয়ে আসে,

আমিও তেমন অজ পাড়াগাঁর নবাব
সন্ধেবেলা মুক্তো ছড়াই ঘাসে

তার যেরকম বিরুদ্ধতার মেজাজ
হঠাত্ করে উল্টোদিকে ছোটে

আমিও তেমন আগুনজলে ভেজা
সময় বুঝে ঠোঁট বসাব ঠোঁটে

তার যেরকম উল্টোপাল্টা খুশি
হালকা রঙের বাতাসে চুল বাঁধে

আমিও তেমন সিঁদুরে মেঘ পুষি
কেমন একটা গন্ধ ছড়ায় ছাদে ..

তার যেরকম মন খারাপের বাতিক
সন্ধে হলে ভাল্লাগে না কিছু,

আমিও তেমন জলের ধারে হাঁটি
বুঝতে পারি আকাশ কত নিচু

তার যেরকম জাপটে ধরে সোহাগ
আমায় ছাড়া চলে না একদিনও,

আমিও তেমন দু-চার লাইন দোহা
লেখার ওপর ছড়িয়ে থাকা তৃণ ….

 

 

যদি কেউ বলত
__ রুদ্র গোস্বামী।
এই বর্ষায় হাতে কদম দিয়ে
যদি কেউ ভালোবাসি বলত
কেউ যদি দেখে জ্বলে? তবে তার ইচ্ছে,
সে জ্বলত।
যদি হাওয়া আসত, উড়িয়ে দিত চুল
চুলের গোছায় জড়িয়ে, যদি কেউ বেঁধে দিত ফুল
মুখ বাঁকিয়ে কেউ আদিখ্যেতা বলত? তবে বলত।
যদি জ্বলে? জ্বলত।
যদি মুখের উপরে উপচে পড়ত রোদ
কেউ আড়াল দিয়ে বলত, ইস পুড়িয়ে দিল নির্বোধ।
কেউ চোখ টেরিয়ে যদি ঢঙ বলতই, তবে বলত।
যদি জ্বলে? জ্বলত।
যদি হাঁটার সময় হোঁচট লাগত পায়
কেউ এসে, ভয় নেই বলতো
গায়ের ওজন কুড়িয়ে নিয়ে, আমার সাথে চলত
মুখ ঘুরিয়ে কেউ যদি মরে যাক বলতই, তবে বলত।
যদি তার ইচ্ছেতেই সে জ্বলে, তবে জ্বলত।
যদি মেঘের সঙ্গে মেঘ এসে আকাশ জুড়ে নাচত
যদি আমার মনের শুকনো জমি বৃষ্টি পেয়ে বাঁচত
কেউ যদি বলত, শুধু তোর সাথেই ভিজব
তোর দুঃখগুলো ভাগিয়ে দিয়ে তোর কান্না গুলো মুছব। বলত।
কেউ শুনে জ্বললে? জ্বলত।
যদি কেউ জানত, কতদিন ধরে আমি মরছি
ভালোবাসার আগুনে আমি পুড়ছি
যদি কাছে এসে এই বর্ষায় কেউ মুখ খুলত
যদি ভালোবাসি বলত!

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...