হুদহুদ পাখির কৈফিয়ত / আল মাহমুদ
ও রাজা সোলেমান,
কেন আমার একটু এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানোতে আপনি এমন তিতিবিরক্ত?
আল্লাহ আপনাকে মানুষের, জিন ও হাওয়ানদের রাজা বানিয়েছেন।
ও বাতাসকে হুকুম করার মালিক,
সহস্র প্রাণের উপর দয়া দেখানোর জন্যই তো নবী-রসুলগণ আসেন
পৃথিবীকে নরম করতে।
আপনি পিঁপড়ে থেকে শুরু করে আমার মত হুদহুদ পাখিরও ভাষা বোঝেন।
বোঝেন প্রতিটি অশ্রুসিক্ত নয়নের অনুনয়। আর পাখির স্বভাবই
যেহেতেু অনুসন্ধিৎসা এবং কবির মতো ডানা মেলে ভেসে বেড়ানো
তার বেয়াদপীর প্রতি কে আর অতো খেয়াল রাখে?
উড়াল ও আড়ালে থাকাই পাখিদের জন্য কল্যাণকর।
ও নবী সোলায়মান আলায়হিসসালাম,
আমার ক্ষণ-অনুপস্থিতি ক্ষমার্হ, কারণ আমি আপনার বিস্ময়বোধকে
উদ্রিক্ত করার মশাল নিয়ে এসেছি, এনেছি এক অদ্ভুত দেশের মানচিত্র।
ও পিঁপড়েদের কথা অনুধাবনকারী,
আমি কি আমার পালকের চেয়েও অধিক আনন্দ সংবাদ
এনে রাজকীয় পুলকের উৎসমুখ খুলে দিইনি?
আপনার আজ্ঞায় বাতাস আমাকে ভাসিয়ে নেয় দূরে দূরান্তরে
জিনেরা অজানা দেশের পাকা মেওয়া এনে রাখে আমার ক্ষুধাতূ চঞ্চুর সামনে।
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আপনার সোহবতে থেকে আমি
দুনিয়ার সাদাকালো হলুদ সকল আদম জাতির ভাষা এখন বুঝতে পারি।
আহা মানুষের ভাষা যদি আমার জন্য দুর্বোধ্য হতো কতই না ভাল ছিল।
হে নবীমহামতি,
আমার বাচালতা মার্জনা করুন। মানুষ যা কিছু বলে এর অর্ধেকই
মিথ্যে প্রতিশ্রুতি যা কক্ষনোও রক্ষিত হয় না।
আর মানুষের মেয়েরা তারা যত সুন্দরীই হোক তারা
মিথ্যার ব্যাপারে একেবারে শেবার সর্বোচ্চ মন্দিরতুল্য। সোনাদানায় সাজানো।
আমার ক্ষণ-অনুপস্থিতি আনার তীক্ষ্ন দৃষ্টির রাজকীয় মর্যাদাকে উদ্বিগ্ন না করুক।
কারণ আমি নিয়ে এসেছি পুর্বদিগন্ত থেকে এক নারীশাসিত উর্বর ভূমির খবর। যে দেশ
আল্লাহর ব্যাপারে নিরাসক্ত কিন্তু উপাসনা ধরেছে উদিত সূর্য ও পৌত্তলিকতার।
ও সহস্র রথের মালিক মহারথী রাজা সোলেমান,
আমি নিয়ে এসেছি সেই পতাকা ও পুজোর রাজ্য
শেবার সেই দিগভ্রান্ত রাজ্ঞীর খবর। যিনি কোটি মানুষের আনুগত্যের
বিনিময়ে চাপিয়ে দিয়েছেন এক স্বৈর সিংহাসন, দুর্ভার, পাষাণ।
আপনি তো জানেন রাজা
রাজ্ঞীর শাসন মানেই তো দেশ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া। নদী শূন্য
খরা, কুয়াশা ও মুকুল ঝরে যাওয়া।
পুরুষের অনুপস্থিতি হলো স্বাধীনতা ও সীমান্ত সংকোচিত হয়ে আসার আলামত।
আক্ষেপ সেই দেশের জন্য
যেখানে সহস্র পুরুষের বাহু পেশীবহুল কিন্তু তীরন্দাজ হয়ে আছে নারী।
রাজপুরুষ, জ্ঞানী অধ্যাপক, কবি-বিদূষক এবং সেনাপতিগণ নির্বাক
মাথা নত করে থাকে রাজপুরুষেরা এক অহংকারী,নির্বোধ রাণীর স্বেচ্ছানর্তন ও
হিংস্র খেয়ালের কাছে।
কে না জানে রাণীদের ঠোঁটে ও অন্তর্বাসে কোনো টেরচা সেলাই থাকে না।
মাতৃরূপ ত্যাগ করলে নারীর চেহারায় আর নেকড়েনীর মুখের পার্থক্য ঘুচে যায়।
পৃথিবীর মৃত্তিকায় শান্তির প্রতিশ্রুতি দানকারী
ও পয়গম্বর রাজা সোলেমান,
কয়েক লহমার জন্য আমার অনুপস্থিতি ক্ষমা করুন। আর পূর্বদেশের
সেই নারীরাজ্যের মহারাজ্ঞীর প্রতি এক হেদায়েতের বার্তা লিখে
আমার গলায় ঝুলিয়ে দিন।
আমি তা পৌঁছে দিতে
আমার পাখা মেলে আছি।
দেশ মাতৃকার জন্য / আল মাহমুদ
একজন কবি আর কি দিতে পারে? এই নাও আমার পরিস্রুত ভাষা
নাও কবিতা-
আমার রক্ত। কলমের কালির চেয়েও মহার্ঘ। নাও আমার অশ্রুজল
দ্যাখো এতে যদি তোমার মরে যাওয়া স্রোতগুলো
নদীকে বিহ্বল করে ঘোলা পানির তোড় নিয়ে
সমুদ্রের দিকে ধাবমান হয়।
নাও অক্ষিগোলক। যদি এতে তোমার ভবিষ্যৎদৃষ্টি একবিংশ শতাব্দীকে
দুটি তীক্ষ্ন তীরের মত গেঁথে ফেলে। আমার চামড়া দিয়ে তোমার
রাঙা পায়ের জুতো বানিয়ে দিলাম। পরো।
আর হেঁটে যাও আগামী দিনের দিগবলয়ের দিকে।
পৃথিবী দেখুক আমার সমস্ত গান পাখি হয়ে তোমার শরীরে বাসা বেঁধেছে
আমার শব্দ তোমার শাড়ির পাড়ে মাছের আকৃতি নিয়ে
ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে, তোমার ঘোমটায়।
দেখুক আমার ছন্দ তোমার কণ্ঠহার হয়ে দুলছে। আর
আমার উপমা?
তুমি তো জানো তোমার সাথে তুলনা দিই এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।
চির দুঃখিনী মা আমার
তোমার ঐশ্বর্যই তোমার শত্রু। যেমন আপন আপন মাংসে
হরিণী বৈরী।
চারদিকে শকুনীর উড়াউড়ি দেখে ভাবি তোমার শ্যামল প্রান্তর
হিংস্র মাংসাশী পাখির বিষ্ঠায় আকীর্ণ বটবৃক্ষের মত কেন?
আমরা কি তোমাকে রক্ষা করতে পারব? অযোগ্য সন্তান আমরা।
তবুও তো তোমার শস্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
তোমার রুদ্ধ নদীগুলোর ইশারায় আমরা কাঁপছি।
তোমার পর্বত যেন মাতৃস্তনের মত ভালোবাসার গহিনে
আমাদের জন্য আহ্বান।
তোমার প্রান্তর যেন রেখায়িত মাতৃ উদরের মত। যেখানে আমাদের উদ্ভব।
কে বলে পরাজিত তুমি? চির বিজয়িনী তুমি কোটি কোটি
ঈমানদার মানুষের ধাত্রী।
তোমার জন্য তোমার সন্তানদের অদেয় কি কিছু আছে? অথচ নামগোত্রহীন
ডাইনিরা তোমাকে নিয়ে পাশাখেলায় মত্ত। তারা বাজি রাখে
তোমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের
তারা তোমাকে চির ক্রীতদাসী বানিয়ে তোমার অঙ্গে পরিয়ে দিতে চায়
দাসত্বের বল্কল।
কিন্তু তোমার সন্তানেরা জানে, ও আমাদের তৌহিদবাদিনী
অবগুণ্ঠিতা জননী জাগ্রতা
পৌত্তলিক ধুম্রকুণ্ডলী থেকে তুমি একদিন বেরিয়ে আসবেই।
তোমার নদীগুলো আবার সমুদ্রের দিকে ধাবমান হবে। চিম্বুক পাহাড়
হবে তোমার স্তনাগ্রচূড়ার মত মাতৃত্বের গৌরব।
ডাইনিদের পাশার ঘুটি একদিন ইতিহাসের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হলে
স্বাধীনতার গান গাইবে তোমার কিষাণ-কিষাণীরা।
আমরা এভাবেই তোমার আশাকে জাগিয়ে তুলি। আশাইতো
তোমার ভবিষ্যত ও ভরসা। প্রন্তরে তোমার চরণেরা
দ্যাখো ভবিষ্যতের গান ধরেছে। আল্লাহর প্রশংসার গান।
আগামীর আনন্দের গান। এই গানে তোমার শস্যক্ষেত্রগুলো কি
শ্যামল হয়ে উঠবে না?
প্রার্থনার ভাষা / আল মাহমুদ
একটু জানান দাও হে প্রভূ, তুমি হাল ধরে আছো আমার মত এক
টলটলায়মান দিগভ্রান্ত নৌকোর।
জানান দাও
তুমি আছ এক ছেঁড়াখোড়া আর সাত তালিমারা পালের ফুলে ওঠা
অদৃশ্য বাতাস হয়ে।
আমি পাড়ি দিয়ে এসেছি পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গের উল্টো দিক থেকে
সময়ের উল্টো দিক থেকে আমার যাত্রা।
আমি পেওছুব তোমার নির্ধারিত কিনারে। তোমার নির্বাচিত উপত্যকায়।
আমার আয়োজন
তুমি তো জানোই কেমন অকিঞ্চিতকর। আর তোমার ছায়া কত
দিগন্ত বিস্তারী।
আমি পেরিয়ে এসেছি ঢেউয়ে ঢেউয়ে অপেক্ষমান শত সহস্র ঝাঁক বাঁধা
অতিকায় হাঙরের মুখ। তারা বার বার কামড়ে কামড়ে বিক্ষত করেছে
আমার পাটাতন। আমি দুহাতে লোনা পানির স্রোত ঠেকিয়ে
মেরামত করেছি আমার অমার অর্ধমগ্ন তলদেশ।
তোমার কাছে পৌছার অদম্য ইচ্ছা আমাকে দিয়েছে
সব ছিদ্র বন্ধ করার নিগূঢ় শক্তি।
আমাকে খুবলে খেতে চেয়েছিল যে দরিয়ার দাঁতাল দানবেরা
ভুস ভুস শব্দে তাদের ব্যর্থ নিঃশ্বাসের পানিতে আমার
সর্বাঙ্গ সিক্ত করে তারা হারিয়ে গেছে
অথৈ লবনের সায়রে।
এখন দ্যাখো বিজয়ীর মত আমার মাস্তুল ভেসে উঠেছে।
প্রতিটি সর্বগ্রাসী তুফানের অন্তিম আঘাতের পর। আমি বোবা হয়ে গেলেও
কথা বলার মিনতিতে আমার বক্ষস্থল স্ফীত।
এলাহি, আমাকে ভাষা দাও প্রভু। মিনতি করার ভাষা।
ক্ষমা প্রার্থনা এবং পাপ মোচনের শব্দ এখনও আমার অনায়ত্ত
আমার চাই প্রার্থনার ভাষা, যা কাব্য বা কান্না নয়। বরং
আত্মনিবেদনের মানবিক অনুতাপ। যেমন হযরত আদম তার
শরীরছেড়াঁ সঙ্গিনীকে নিয়ে অপরাধী কপাল বেহেশতের ধূলিতে
স্থাপন করে বলেছিলেন ক্ষমা প্রভু
একটিবারের মত ক্ষমা।
তিনি মেনে নিয়েছিলেন নির্বাসন। মেনে নিয়েছিলেন পৃথিবী
মেনে নিয়েছিলেন, শ্রম ঘাম কাম সন্তান সংসার, রোগ এবং পুত্রশোক।
কিন্তু আমি সেই আদি পিতা-মাতার অবহেলার পুত্র
আমার কাছে পৃথিবী দুঃসহ
প্রতিটি গ্রহ, তারকা, উদয়াস্ত দুঃসহ।
দুঃসহ মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি।
মানুষের আগ্রহ যেখানে-সেখানে পাড়ি জমাতে সক্ষম, সর্বত্র।
মানুষের নভোযান, খেয়া আর প্রযুক্তি তাড়িত বিশাল যান্ত্রিক উৎক্ষেপ
সবি নিরর্থক স্বপ্নের জ্বালানিতে ব্যর্থতার সমুদ্রে সাঁতার মাত্র।
আমি চাই অন্য কিছু।
আমার গতি তুমি তো জানো প্রভু কোন দিকে ধাবমান!
আমার রক্তে-মাংসে সেই ফেলে আসা চুম্বকের টান।
যেখান থেকে আমাদের পিতা-মাতা
কেবল জ্ঞানের লোভে, অমরতা ও আত্মতৃপ্তির আকাংখায়
একদা কানাকড়ি মূল্যে হেলায় হারিয়েছিলেন বেহেশত। সেই
মহাউদ্যানের টান আমার রক্তে, আমার মাংসে ও মজ্জায়।
দাও তাকে ফিরিয়ে আমায়।
প্রার্থনার ভাষা দাও প্রভু, নির্জ্ঞান আত্মসমর্পণের
সহজতা।
আমি কি পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি না হাঙরসংকুল সমুদ্রের চেয়ে দুরুহ
যে আয়ু?
সেই দিন এবং রাত্রি?িউদয় আর অস্ত।
আঁধার এবং আলো। না
আলো আর অন্ধকার আর না। জ্বলুক তোমার নূরের দীপ্তি
যা ভেদ করে যায় পৃথিবীর উদবে লুকানো সমস্ত গলিত ধাতুর
সাতপরত পর্দা।
পৌঁছুতে চাই প্রভু তোমার সান্নিধ্যে
তোমার সিংহাসনের নীচে একটি ফুরফুরে প্রজাপতি হয়ে।
যার পাখায় আঁকা অনাদিকালের অনন্ত রহস্য।
গন্তব্যের কাছাকাছি এসে / আল মাহমুদ
নদীটা পেরিয়েই মনে হল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সব শব্দ আমাকে ছেড়ে গেছে।
ঢেউ, বৈঠা আর পানির ছলছলানির সাথে
এতক্ষণ নিরুদ্দেশ যাত্রার যে প্রতিবাদ উঠেছিল। আশ্চর্য
নৈশব্দের মধ্যে কখন সব তলিয়ে গেল।
শত্রুতাও কি এখন এমন সবুজ মাঠ? যতদূর চোখ যায়
বিদ্বেষ হয়ে গেছে পাকা ধানের দুলুনি?
আমার পরিশ্রম দেখে যারা একদা বলত, আর একটি মাত্র নদী
আর একটা খেয়াঘাট পেরুলেই আমি গন্তব্যে পৌঁছুব। এখন তারা
কোথায়? এই সোনার ধানের একটা মীমাংসা কি দরকার নয়?
আমার না হয় কোনো বন্ধু ছিল না।
কিন্তু যে বৈরিতার ঘূর্ণিতে আমি বার বার দিশেহারা
তারা এসেও কি এই সীমাহীন শস্যের একটা সিদ্ধান্ত দেবে না?
লুটে নেবে না আমার সোনার ধান? আমি সব রকম রাহাজানির
জন্য প্রস্তুত। অন্তত মানুষের কণ্ঠস্বরে বেজে উঠুক
রাগ, দ্বেষ, হিংসা-
যদি গুলির শব্দ আমাকে বিদ্ধ নাও করে।
সত্যি যদি গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গিয়ে থাকি তাহলে
তোমার সেই মুখ
সেই প্রত্যাখ্যানের পুরনো ভঙ্গী কেন দেখব না? কেন শত্রুতার বদলে
এই চিরহরিৎ শোভা?
বাতাসে ধানের দোলা অথচ ফসল তোলার কোনো আয়োজন নেই।
আমার জন্য শত্রু বা বন্ধু কেউ তো থাকুক?
কেউ বলুক বা না বলুক জানি আমি শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি।
এখানে কোনোদিন কোনো মানুষের কৃতির হিসেব হবে না এ কেমন কথা?
অন্তত তিরস্কার করার মত কেউ কি নেই?
ভূমিহীনদের দীর্ঘশ্বাসের মত এই সীমাহীন সবুজ আমার কোন্ কাজে লাগবে?
নিরাপদ ধানের গন্ধে আমার সারা জীবনের ভুখ তিয়াসা
পেটের ভিতর গুলিয়ে উঠেছে।
এখন কে আমাকে ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে বলবে, খাও!
আমি না বুঝে জিততে চেয়েছিলাম বলে কি আমার মাঠ ঘাট প্রান্তর
প্রাচুর্যের নরক হয়ে যাবে?
অন্ধের ভূমিকা / আল মাহমুদ
ছিলাম তো মুখ ফিরিয়ে। ভেবেছিলাম উদয়াস্তে আমার কি ভূমিকা?
আলোর আভায় ও বিকিরণে আমি স্তস্তিত পাথরের পাথরের জমাটবাঁধা অন্ধকার মাত্র।
দায় ও দায়িত্ব থেকে দূরে দিন আর রাতের
নিয়মগুলেঅ আবর্তিত হোক। আমি জানবো না কারা পৃথিবীতে এল গেল।
আর অন্ধের ধর্ম তো স্থকিরতা। চোখ মেলে আছি অথচ দেখছি না কিছুই।
এ ছাড়া আমার অন্ধত্বকে আমি ঠিক অন্ধকারও বলি না। দেখিনা
বলেই কি কিছু থাকতে নেই? আমার বোধশক্তি এ চিন্তায়
অধোবদন। নইলে তো অনেক আগেই বলততাম, অন্ধকারের অর্থ কিছু নেই।
নেই যদি আমার চোখের মধ্যে এত ব্যাকুলতার পানি কোত্থেকে এল?
কেবল কি বাতাসের আনাগোনায় আমার স্নায়ু সুখ পায়?
যার চলাচলের জন্য আমার এই প্রতিক্ষা
কেন মনে হয় সে এলে আমি ঠিক টের পাব। ঐ টের অন্ধের আন্দাজ নয়।
সচলতার প্রতি অনুভবের উত্তর।না দেখার আফসোসের বদলে
অন্য শব্দ তখন আমার প্রাপ্য হবে। অন্তত না দেখার জন্য
আমাকে কেউ অন্ধ বলবে না। বরং অন্ধের সামনে সকলেই
তাদের লজ্জা আর অনাবরণ ঢেকে ফেলবে। আর আমি
তোমাদের বসনের শব্দে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাসব।
সকলের উদয়কালের আলো যখন জড় জগৎকে অতিক্রম করে
আর আমি নিমীলিত আঁখি, কেন মনে হয় আমার চোখের কোনো দরকারই ছিল না।
প্রয়োজন ছিল না কোনো স্পর্শানুভূতির। চোখ কান নাক বা
ত্বকের আবরণ আমাকে একটা মেশিন বানিয়ে ফেলেছে। আমি
দেখতে শুনতে শুঁকতে চাইনি। চাই না
এই তো অন্ধের আকাশে এক্ষুণি একটা চাঁদ উঠলো।
আর জোছনার শিরশিরানিতে ইন্দ্রিয়সমূহের ভেতর দিয়ে ছুঁচের মত
পার হচ্ছে এক আকারহীন অস্তিত্বের ঘোষণা।
হায় আমার অন্ধত্ব কি এতটাই স্বাধীন?
মুখ ও মুখোশ থেকে বেরিয়ে / আল মাহমুদ
কতবার তোমাকে বলেছি যে দেখো আমার কোনো প্রতিযোগী নেই
আমার পরাজয়ের সম্ভাবনা যেখানে ষোল আনা সেখানে আমি
কার সাথে দৌড়াবো?
তাছাড়া আমার গতি সুনির্দিষ্ট কিন্তু আমার গন্তব্য অনিশ্চিত
কে জানে সেখানে কি আছে, পুরস্কার না তিরস্কার?
তবে সকলেই জানে আমার আরম্ভের কথা। মায়ের ওম থেকে বেরিয়েই আমার শুরু।
এ কোনো খেলা নয়, আমার পিতৃপুরুষেরাই আমাকে সতর্ক করেছিলেন।
বলেছিলেন তোমার সেখানে না পৌঁছুনের সম্ভাবনাই বেশি। তবে এ পরিশ্রম অনুল্লেখিত থাকে না।
কেউ এই পথ নারীর ভেতর রচনা করে নিয়েছে। নারী আবার
দীপ্তিমান পুরুষের ভেতর। কিন্তু আমি বেছে নিয়েছি দেশ, নিসর্গ ও প্রকৃতির ভেতর।
আমার যাত্রার উদ্যোগ মুহূর্তে যেহেতু এক নারী-
যাকে আমি মহামাতা বলে সম্বোধন করার সুযোগও পেলাম না
আমাকে আমার যাত্রাপথের রোমান্স সম্বন্ধে বলেছিলেন।
আসলে লিপ্ত হওয়ার যে পুলক তা তুমি দিন ও রাত্রির উত্থানপতনে,
বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার দাপটে, শীতে ও গ্রীষ্মের দাবদাহে
আস্বাদন করে নিও।
তুমি যখন পুলকিত হওয়ার পথে পা বাড়াওনি তখন ধীর
অনুভব, চেতনাচেতনের আলো অন্ধকার পার হও।
এ পথে কোনো পদচিহ্ন নেই কিন্ত চতুর্দিকে বিস্ময়ের মত স্তব্ধতা।
এমনকি, একটা পাখি নিয়ে ভাবলেও এর হরিৎ পালক,
লার পা ধূসর চঞ্চুর কার্যকারণ তোমাকে তোমার গন্তব্যের
অন্ধকার অজানায় আলো ফেলবে।
পাখি বা পতঙ্গ, পত্র-পল্লব শোভিত অরণ্য, অজানা বন্য আতাফলের মাংসের
ঐশ্বর্যে খোঁজো। খোঁজো স্বচ্ছতোয়া সরোবর বা পানির ভেতরে
সচল মাছ এবং তীরের বালু ওপর চিহ্ন রেখে যাওয়া শামুকের গায়ে আঁকা উন্মুক্ত কিতাবে।
প্রকৃতির ভেতর অসংখ্য স্তনের উষ্ণতায়। শিশুর প্রসববেদনার আলোড়নে আর
প্রেমিকার দৃঢ় অঙ্গীকারে সংযুক্ত থাকার শীৎকারে তাকে
যারা পায়। তার ভাষা কি করে শেখা যায়?
আমি চলে এসেছি ষাটটি বালুচর পেরিয়ে। ঐতো সামনে নদী। চখাচখী উড়ছে।
এর বেশি আমি আর কোথায় যাব? অথচ গন্তব্যের একটি চিত্র কে আমার হৃদয়ের ওপর
রক্তের শিরার মত লিখে দিয়েছে।
আর সেই মানচিত্রে আছে কেবল এক মহা আননের সীমাহীন আভাস
আমি তো আকৃতি কল্পনা করে অভ্যস্ত, কারণ আমার দৃশ্যমান
বিষয় একদা ছিল এক অনিন্দ্যসুন্দর মানুষীর শরীর। শরীর ছাড়া
আমরা কি কিছু ভবতে পারি? কিন্তু আমি এখন যেখানে বা যে গন্তব্যে পারদের মত জমে
আছি, একে এখানে কেউ কি থাকা বলে?
এ জগতে কেবল মিশে যায় যে সেই থাকে। একেই থাকা বলে আর সবি না থাকা।
আমি একটি মুখের আকারে আর কোনো কিছু ভাবতে পারি না। কারণ
যিনি সৃজন করেন তিনি নিজের কোনো মুখ, শরীর বা হাত-পায়ের
প্রয়োজনবোধ করেন না। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছার আগে আমার কেন একটা
পরিপাটি মুখ থাকবে? কেনো থাকবে ছয় অক্ষরের এতবড় একটা নাম। কেন থাকবে
দামেশকের দর্জির তৈরি চুমকির কাজ করা
এই বিশাল আলখেল্লা। এই পাগড়ি?
আমি মুখ ও মুখোশ থেকে দ্যাখো বেরিয়ে পড়েছি।
শুধু চোখ আর পায়ের পিস্টন / আল মাহমুদ
যদি কবির কাজ হয় আশাকে জাগিয়ে তোলা তাহলে হে কীর্তিনাশিনী নদী
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নেমে এসো আমার স্রোতস্বিনী কররেখা হয়ে।
আমার হাতের ভেতর নাচুক ইলিশের ঝাঁক। হৌমাছের দীর্ঘ
নিঃশ্বাসে খুলে যাক আমার বাতায়ন। আর তুমি,
ওগো অনন্তকালের তুমি, তুমি হয়ে যাও দিগন্তে দাঁড়ানো
একটি নগ্ন তালগাছ।
যার পাতায় দোলানো বাবুইয়ের বাসা তোমার কলরব পূর্ণ স্তনযুগল
নেমে আসুক আমার পড়ার টেবিলে বেহেস্তের ফল।
কবির কাজ যদি হয় আশা। কেন তবে আমার শত মন্ত্র ও তুকতাকে
নদী হয়ে যায় একটি রেখায়িত দীর্ঘশ্বাস? ইলিশের নাওগুলো
হয়ে যাচ্ছে ছদ্মবেশী জল-ডাকাতের কুঞ্চিত ভ্রুরেখা?
সূর্যাস্তের রঙিন পানিতে কেন আর ভেসে ওঠে না কালো
শালুকের মত হৌমাছের ঝলমলে স্তন?
কেন আমার সমস্ত কররেখা জুড়ে ঘূর্ণিবায়ুর উড়ন্ত মৌতাত?
না, আর কোনো প্রতিশ্রুতি নয়। হাজার বছরের ওগো
খুল্লনা লহনা দেওয়ানা মদিনারা, কেন পথচারী কবির পথে
সুখের সমাধি ভেঙে হাহাকারে কবর ফাটাও।
তোমাদের দীর্ঘশ্বাস আর কোনো শপথবাক্য উচ্চারণে
আমাকে প্রলুব্ধ না করুক।
একদা আমি উচ্চারণ করতাম বটে একটি দেশের নাম। আসলে
সেটা ছিল আমাকে গর্ভধারণে সফল এক যন্ত্রণাবিদ্ধ যুবতীর
অশ্রুসিক্ত মুখচ্ছবি মাত্র।
তার শাদা কদলীকান্ডের মত উরুযুগল আঁকড়ে আমি শুনতাম
নগরবিনাশী নদীর কল্লোল।
কে এখন নদীর নাম বলে, কে জিজ্ঞাসে আমার উদ্ভবের
ভিটেমাটির আদি ঠিকানা?
না নদী, না কোনো দেশ। আমি পৃথিবীর কবি নিস্পৃহ
কালের পথিক।
২
আজ বুঝি কবির কাজ নয় আশা। না কোনো দেশ, না কোনো পাখির কূজন।
শুধু চলা ধাবমান মেঘের ভেলায়। হতে পারে নারী এক ছায়াতরু
সকালে বা সায়াহ্নবেলায়।
আয়ু হোক স্মৃতির দর্পণ।
আমি হাঁটি, আর স্মৃতিতে চমকিত দেখি ভবিষ্যৎ। বই,
সেখানে তো কোনো মানচিত্র বা দেশকে
দেখি না!
দেখি, পঙ্গপালের মত গ্রহচারী ক্ষুধার্ত মানুষ।
মানুষেরা খেয়ে ফেলে ঊর্ধ্বলোক, শেষহীন সমস্ত শূন্যতা।
ধর্মহীন, কর্মহীন, মাংসভুক হে মহামানব, কে জাগাবে
আশা?
না আর কোনো প্রতিশ্রুতি নয় কবি চলে কবির নিয়মে
শুধু খোলা চোখ দুটি আর দুটি পায়ের পিস্টন।
যাবনা তোমার সাথে, হে দেশজননী / আল মাহমুদ
আমি আর যাবনা তোমার সাথে, হে আমার দেশজননী, আর না।
কারণ তোমার যাত্রা উদ্দেশ্যবিহীন কিন্তু আমার কলম আমার
নিশান হয়ে দুলে উঠে লিখছে, না না না।
ও রক্তাম্বর পরিহিতা স্বৈরিণী স্বদেশ, তোমার দিগ্বলয়ে কেবল
হা হুতাশ আর স্বজন হারানোর বিলাপ। তোমার স্তনাগ্রচূড়ায়
মানবশিশুর জন্যে তিক্ত নিম মাখানো প্রত্যাখ্যানের কৃষ্ণবলয়।
আমি আর না। ছেড়ে দাও আমার হাত। আমি দেশহীন
শেষ দশার কবির মত আকাশের দিকে আজান হেঁকে
বাতাসে বিলীন হয়ে যাই।
কে বলে কবির একটা দেশ না হলে চলে না? বলো, কে বলে?
কে বলে কবির একটা অন্তত নদী চাই, পাশে থাকবে তার শৈশব
আর জন্মগ্রাম, কে বলে?
কারা বলে মাছ, পাখি, নাও, নারী আর তরঙ্গের দোলার কথা,
কারা বলে? ও জোনাকজ্বলা বর্ষার রাত্রি, কারা বলে?
তোমার আঙুল দেখে ছ’টি দশক হাঁটার স্মৃতি মুছে যাক
অথচ লক্ষ লক্ষ গুলির শব্দে আমি কানে আঙুল দিয়ে আছি।
আমি কি শুনেছি কোনো পাখির গান? দেখেছি কি
পাল দোলানো নাওয়ের পৈঠায় মাছের চোখ। লবনবতী
নারীরা গাঁয়ের গৃহস্থালী ছেড়ে এখন উধাও। তারা তোমার
প্রতিটি রাজনৈতিক ঠমকের মূল্য শোধ করবে দেহ বিকিয়ে
আর সীমান্ত পাচারের লেনদেনে? কে বলে কবিদের একটা
দেশ না হলে চলে না? তার মুখে চপেটাঘাত!
না আর যাবনা তোমার সাথে। যাবনা, যতক্ষণ ঐ রক্তাম্বর
তোমার অঙ্গশোভা। পেছনে গুলির শব্দ ও হত্যার গুঞ্জন।
আমি আকাশে আজান হেঁকে বাতাসে বিলীন হয়ে যাওয়া
একটা পংক্তি মাত্র।
হোক দেশ, কাল ও সমসাময়িক তোমার নামাঙ্কিত মানচিত্রের
কাছে তা দুর্বোধ্য।
অদম্য চলার ইতিহাস / আল মাহমুদ
যারা আমাকে এ অদম্য চলার পথে নিয়ে এসেছে
তারা তো সবাই জানে আমার পা পাথর,
দৃষ্টি শক্তি স্বপ্নের কুয়াশায় আচ্ছন্ন।
তবু মানুষের মন বলে একটা কথা আছে। আছে না কি?
হ্যাঁ, মন বলছে এখনও আমার দিগন্তে পৌছার
খানিকটা পথ বাকি।
মানুষের কান্না, শিশুর কলরব, নারীর হা-হুতাশ-
আমি তো পার হয়ে এসেছি। কিন্তু কিছু মুখ
আকাশের নীলিমায় নবমির চাঁদ হয়ে
জোছনা ছড়াচ্ছে। কে বলে কবির কোনো
পিছু টান নেই? কে বলে কবির হাতে কোনো নিশান
থাকে না? কে বলে মানুষের চোখের পানির চেয়ে
অমরতাই কবির কাম্য। কেউ বিশ্বাস
করুক বা না করুক- এই মরজগতে মৃত্যুই সুন্দর।
সব অমরতার গল্পই কীটদ্রষ্ট কাগজমাত্র।
আমি শুরু করেছিলাম রাতের অন্ধকারে
উদয় কালে যাত্রা। আমি পৌছাতে
পারিনি বলে, আমার পা ভারি পাথর
হয়ে এসেছে বলে আমার সঙ্গিরা
সেখানে পৌছবে না, তা কে বলতে পারে?
তাদের গতির শব্দ আমাকে পেছনে রেখে
আফসোসের কফিনে মর্যাদার সাথে
শুইয়ে দিয়ে উদয় দিগন্তের ছবি আঁকা
পতাকা বাতাসে বাজাতে বাজাতে এগিয়ে যাচ্ছে।
তাদের বিজয়ের ধ্বনি আমি মৃত্যুমগ্ন
কর্ণকুহরে ধারণ করে আল্লার শুকরিয়া
করি। আশা যিনি আমার শ্রবণেন্দ্রিয়
দিয়েছেন তিনি কতই না মহান। আমি থাকবো
না বলে যারা বিলাপ করে এবং একই সাথে
যারা আনন্দ করে তারা সমান মুর্খ।
আল্লার করুণা প্রার্থনা করি তাদের জন্য-
আমি থাকবো না, এর চেয়ে আনন্দের
সংবাদ আর কি হতে পারে। পৃথিবীটাতো
না থাকারই জায়গা। যারা ছিলেন
তারা তো মাত্র একটি শতাব্দীর মধ্যে ইতিহাসে
মিলিয়ে গেছেন। ইতিহাস? আমার হাসি পায়!
রোদনের উৎস / আল মাহমুদ
আমার জন্যে যাদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না, ভাবত অকাজের কাজী লোকটা
আল্লা মালুম কোথায় হুমড়ি খেয়ে মরবে। কথা শোনে না, সাহায্যের
হাত বাড়ালেও ধরে না; একাকী শূন্যে হাতড়ে বেরিয়ে যায়। মনে হয়
যেনো বাতাসের পালক শক্ত করে ধরে আছে। অথচ দেখ, এই শহরে
কত খানাখন্দ! ম্যানহোলের ঢাকনাহীন পথের প্রতিটি বাঁকেমৃত্যু
হা করে আছে! কে তাকে ফেরাবে?
এই হাহাকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, উদয়াস্ত আত্মীয়তা অতিক্রম করে আমি, সেই
লোকটা বাতাসের পালক টেনে ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছি। স্বপ্ন থেকে
স্বপ্নে। আশা থেকে অধিকতর আশায়। ভাষা থেকে ভাসমান প্রতীকের
গম্বুজে। আমি আনতে চলেছি ও মায়াবী ঢাকা শহর, তোমার জন্যে
স্বপ্ন,স্বস্তি, প্রেম এবং সুখনিদ্রা। আমাদের নিয়ে এত দুশ্চিন্তা কেন?
কেউ কি স্বপ্নাহারি কবির দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলে? সবাই তো ভাবে
কবির আবার ক্ষুৎ পিপাসা কী? আশ্রয় বা আস্তানা কী দরকার?
আমি তোমাদের কোনো প্রশ্নেরই জওয়াব দিতে অস্বস্তিবোধ করি না। তবু
আমার জন্যে কাঁদা অন্তত দুটি চোখ আমি পুঁতে রেখে এসেছি
পদ্মার এক চরে। সেই দুটি চোখ থেকে বেড়ে উঠেছে দুটি অদ্ভুত
উদ্ভিদ। তারা হাওয়ার দোলায় ফুটিয়েছে অশ্রুজল, কান্নার গুঞ্জন।
তা না হলে পৃথিবীতে বোধহয় রোদনধ্বনি লুপ্ত হয়ে যেতো।
আমি যদি স্বপ্নের বীজ থেকে কোনো অশত্থের ডাল-পালা
মেলে দিতে নাও পারি, আমার উমে যদি না ফোটাতে পারি হরিয়ালদের
লালখাদ্য, অশত্থের লাল ফল, তাহলে কান্নার বীজ থেকে কেনো
আমি কান্না ঝরিয়ে দেব না?
এই পতাকার সূর্য সাক্ষী / আল মাহমুদ
দ্যাখো আজ পতাকা দেখারই দিন।
কলরব করে ওঠো, উচ্চারণ কর
মুক্তির ভাষা। আমিও তোমাদের সাথে দেখতে থাকি।
তোমাদের সাথে আমার অপরিচ্ছন্ন দৃষ্টির অশ্রুসজল
চোখ দু’টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকি। কী লাল, সবুজ
পতাকার মধ্যে গোল হয়ে বসে আছে,
মনে হয় যেন পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের
রক্তের লোহিত কণায় অঙ্কিত হয়েছে এ সূর্য।
আমার ভেতরে কলরব করে ওঠে কত মুখ
কত আকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টি। যারা আর
ফিরে আসেনি।
একজনের কথা মনে পড়ছে। মনতলা স্টেশনের
পাশ দিয়ে বামটিয়া বাজারের দিকে চলে গেছে যে পথ
সেখানে ছিল তার ক্যাম্প। ট্রেনিং নিতে গিয়ে
তার কুনুই থেকে রক্ত ঝরে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল।
ফেরেনি সে। তার মাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা বা শব্দ
বাংলা ভাষার অবিধানে ছিল না। কিন্তু তার মার
সামনে দাঁড়িয়ে আমি যে ইংগিতে কথা বলেছিলাম
তাতে মহিলা শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে
ওই গোল সূর্যের মধ্যে তার পূত্রকে দেখেছিল,
অশ্রুসজল চোখে।
আরো একজনকে জানতাম- সে কুমিল্লা থেকে
বেরিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের দিকে। গুলিটা লেগেছিল
তার কোমরে। আগরতলা হাসপাতালে আমি তাকে
দেখতে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বিষাক্ত শিশার টুকরো
নিখুঁতভাবে বের করতে পারলেও সে আর হাঁটতে পারেনি।
তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম
মুক্তির উৎসবে। ওই পতাকার লাল অংশে তার খানিকটা
রক্ত আছে। আমি সব সময় দেখি আর তার কথা ভাবি।
কী অবলীলায় তার নাম বাদ দিয়ে লেখা হয়ে যায়
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস! সে ছিল কুমিল্লার একটি
হিন্দু পরিবারের মেয়ে। তার পিতার উপজীব্য ছিল
সংগীত। আমি সাক্ষ্য দেই যে, পতাকার ঐ লাল অংশে
তার রক্তের লোহিত কণিকা মিশ্রিত আছে।
হে ইতিহাস, লেখো তার নাম।
কুষ্টিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছেলেটি।
কুষ্টিয়ার কাস্টম কলোনির পাশে, সে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল শত্রুদের জিপকে উড়িয়ে দিতে।
খন্ড খন্ড হয়ে উড়ে গিয়েছিল তার বাহু, উরু ও
পিঠের কিছু অংশ। হাসিবুল ইসলাম
আল্লাহু আকবার বলে সে আক্রমণ করেছিল।
তার বুক থেকে কলজে উড়ে গিয়ে ওই
পতাকায় লেগে আছে।
লেখো তার শেষ উচ্চারণ আল্লাহু আকবার।
কলরবমুখর হে ঢাকা মহানগরী
তোমাকে লিখতে হবে ওই রক্ত গোলকে
আসাধারণ বিবরণ। দেখতে হবে ইতিহাস নির্মাণ
করে কারা? আর কারা কেড়ে নেয় বীরত্বের পদকচিহ্ন!
দ্যাখো আজ পতাকা দেখারই দিন
কলরব করে ওঠো, উচ্চারণ কর-
মুক্তির ভাষা। আমিও তোমাদের সাথে দেখতে থাকি।
অগ্রহায়ণ / আল মাহমুদ
আমি এই মধ্য অগ্রহায়ণের আকাশে মেঘের গম্বুজ ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি
কেউ তো আমার মতো অকাজের কারিগর নয়
যে মাটির উপর বিছানো মানবিক শত সমস্যা
মেলে রেখে আকাশের দিকে তাকাবে? ও অগ্রহায়ণের আকাশ
ঝরাও বৃষ্টি, এখন ঘরে ঘরে নবান্ন চলছে
মাঠগুলোতে উদগমের কাজ অবসন্ন কিন্তু আমার এখন বৃষ্টি দরকার
উদ্ভেদ ও উদগম দরকার।
যে নারী আমাকে পরিশ্রান্ত ভেবে, যার মাতৃদ্বার
রুদ্ধ করে দিয়েছিলো, তার মুখে প্রসন্নতা ছিটিয়ে দিয়ে
বর্ষাও বৃষ্টি কিংবা নামিয়ে দাও
মেঘের ভেতর থেকে মানব বা দানবের অংকুর। আমি,
হে অগ্রহায়ণের আকাশ
সত্তর বছরের এক পুরনো পানসিতে বৈঠা বেঁধেছি
নাওয়ের গলুইয়ের নিচে অংকিত করেছি
আমার প্রিয়তমা নারীর আয়ত দু’টি চোখ।
ঝরাও বৃষ্টি-অনবরত, অবিশ্রান্ত; অবিরাম।
হে অগ্রহায়ণের আকাশ, বাংলাদেশের মেয়েরা যখন
মানব না দানব জন্ম দেবার ভয়ে-মাতৃদ্বার
হাত দিয়ে চেপে ধরেছে তখন তাদের কানে এই বার্তা
পৌঁছে দাও এক কবির, এক অব্যর্থ কথার কারিগরের-
হে ব্যর্থস্তনী জননীরা আমার, তোমরা না হয়
গাছেরই জন্ম দাও, শত শত বনস্পতি-
ডালপালা মেলে দিক বাংলার আকাশে। কিন্তু
জন্ম বন্ধ করে দিও না, নিষ্ফলা করে দিও না
মাতৃত্বের বৈভকে। গাছ চাই। বৃক্ষের
ডালপালায় আচ্ছাদিত হোক মাটি ও মাতৃজঠর।
আমি ইচ্ছে পুরণের মাটি নই / আল মাহমুদ
যারা আমাকে পরামর্শ দিতো মানুষ একা থাকতে
পারে না। তারা হয়তো সত্যিই বলতো। কিন্তু আমি
ছিলাম অনমনীয়। ছিলাম একটা পোড়ামাটির
পাত্রের মতো। কারো ক্রোধ হলে পাত্রটিকে
পাথরে আছড়িয়ে চূর্ণ করতে পারবে। কিন্তু
দুমড়ে মুচড়ে আবার কাদার মতো ইচ্ছে
পুরণের মাটিতে পরিবর্তন করতে পারবে না।
প্রকৃত পক্ষে আমি অর্ধেক মানুষ আর বাকি
অর্ধেক তো কবিতা। সম্পূর্ণ মানুষ বলেতো
কখনও গণ্য হইনি, কেউ মানে নি।
বলো, এজন্যই কি আমি এতো একা?
ইতিহাসের তীর্যক গতির মধ্যে যারা এই
বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে চেয়ে দেখি
তাদের বয়স খুবই কম। তারা জানেও না
পতাকার ওই সূর্য কাদের রক্তে ভিজে
আছে। তারা লাল রঙটা দেখে আর
খলখলিয়ে হাসে। কিন্তু আমি তো জানি
সেখানে জমাট বেঁধে আছে মানুষের
রক্ত। যারা যোদ্ধা ছিলো।
যাদের নাম শহীদের তালিকায় নেই।
অথচ আমি তাদের নাম জানি।
কেউ জিজ্ঞাসা করুক? আমি তাদের নাম
একের পর এক বলে দিতে পারি। তোমরা
তাদের নামের পরে কোনো যতি চিহ্ন
ব্যবহার কোরো না। না কমা, না দাড়ি।
তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা নিয়ে মাথা
ঘামায়নি। কারণ তাদের চেতনার চেয়ে তাদের রক্তই
ওই পতাকায় জমাট বেঁধে আছে বেশী। অসহ্য
লালে রঞ্জিত। আমি কি উচ্চারণ করবো
তাদের নাম?
আমি জানি কেউ তাদের নাম শ্রবণেন্দ্রিয়ে
ধারণ করতে পারবে না। তাদের সব পর্দা ফেটে
যাবে। তারা পালাবে লেজ গুটিয়ে। যেমন চির
পরাজিতেরা গর্তে লুকোয়। তেমনি।
সাবধান আমার প্রতিটি কাব্যে বাক্যে উপমায়
অলংকারে আমি লুকিয়ে রেখেছি তাদের নাম।
এক একটা শতাব্দী এসে সে সব নাম উচ্চারণ
করতেই থাকবে।
পালাও হারামজাদারা। কোথায় পালাবে?
এক একটি শতাব্দীতে এক একটি নামের
পৃষ্ঠা বাতাসে উল্টে যাবে। পালাও
হারামজাদারা। কোথায় পালাবে?
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি / আল মাহমুদ
কিছুকাল যাবত কিছু একটা পঁচে যাওয়া দুর্গন্ধ
আমাকে কেবলি তাড়না করে ফিরছে। গন্ধটা কোথা থেকে আসছে
তা বুঝতে না পারলেও এটা আন্দাজ করতে পারছি কাছেই
কী একটা যেন মরে পচে এ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
আমি প্রতিটি নদীর পানি নাকের কাছে এনে
শুঁকে দেখেছি। না, মেঘনা যমুনা পদ্মা এই সব
স্রোতস্বিনী মাঝে মাঝে শুকিয়ে তলপেট বের করে দিলেও
পচা গন্ধটা নদী থেকে আসছে না।
পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষরাজি, নাও-নদী সব কিছু আমি
শুঁকতে শুঁকতে হয়রান।
একদা গাঁয়ের বাড়িতে কোথাও ইঁদুর মরে গেলে
যেমন দুর্গন্ধ ছড়াতো আর তা দ্রুত অপসৃত করার জন্য
যেমন আমরা সবাই সবকিছু ফেলে ওই দুর্গন্ধের কারণ
উৎপাটন করতাম, এখন আমার নাকের কাছে
তীব্র পচা গন্ধটা আমাকে, আমার পরিবারকে, আমার
প্রতিবেশিদের মুহ্যমান করে ফেললেও আমরা নাচার।
খুঁজে পাচ্ছি না। ধরতে পারছি না। দেখতে পারছি না।
অথচ বিনিদ্র রজনী নিঃশব্দে কাটিয়ে দিয়ে
বারবার জেগে উঠছি।
আমি প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি। তারাও
আমার সাথে একমত। হ্যাঁ, একটা পচা গন্ধ আছে বটে।
কিন্তু তারা তা অসহনীয় মনে করছে না। তাদের ধারণা কত কিছুই তো
সময়ের সংঘাতে মরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাতে কেউ তো আর
দেশান্তরী হয়ে যাচ্ছে না। প্রাত্যহিক সূর্যের খরতাপে এই
বাসি গন্ধটাও থাকবে না। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু এটা তো আমার জন্য কোন প্রবোধ নয়
শেষ পর্যন্ত আমিও যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি
ঠিক সে সময় আমার ভিতরের একটা প্রকোষ্ঠ,
যা হৃদয়ের বাঁ পাশে থাকে, এর অদৃশ্য
ডালা খুলে দিল। বুঝলাম এখানেই হয়ত
কিছু একটা মরে হেজে গেছে। গন্ধটা সেখান থেকেই।
অথচ লালনের গান থেকে আমি এ প্রকোষ্ঠের
নামকরণ করেছিলাম মনুষ্যত্ব। তবে কি আমার
কলজের পাশে সেই অচিন কুঠুরিতে মরে গেছে
কলরব মুখর পাখির ছটফটানি?
অনামাঙ্কিত হৃদয় / আল মাহমুদ
আমার জীবনতরী দুলছে। যাকে বলি মরণপয়োধি
এখন তার উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে পাল নামিয়ে ফেলেছি।
গন্তব্যে পৌছার আগেই খসে যাচ্ছে মেধা, মনন, যৌবন
ও স্মৃতি। এমনকি তোমার মুখও মনে পড়ে না।
কেবল ভাঙাচোরা কিছু বিষয় মঝেমধ্যে আকাশ ফাটা
বিদ্যুতের চমকে আমি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দেখতে পাই।
ভাসছে আমার দুটি চোখ, ভাসছে আমার মগজের কিছু অংশ।
আর ঘাউড়া মাছের ঝাঁক ঠুকরে নিয়ে যাচ্ছে
ঐসব হলুদ পদার্থ পাতালে।
আমি আমার বাসনার পাত্রটিও ভাসিয়ে দিলাম। পাত্রের
ভেতর থেকে একটা সাপ ফণা গুটিয়ে তরঙ্গে মিলিয়ে গেল।
আমি এর নাম দিয়েছিলাম নফ্স।
কী আর অবশিষ্ট রইলো এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু আমি যেখান থেকে এসেছিলাম তারা ভিড় করে তীরে দাঁড়িয়ে
আমার শেষ দশার দশানন দেখে গালমন্দ করছে। এ সবি
আমার প্রাপ্য বৈকি।
আমি দাঁড়িপাল্লার সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু ওজন করার
কোনো কিছুই তো আমার নেই। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে
আমার আত্মাকে বুক থেকে খুলে হাত বাড়িয়ে ঐ মানদন্ডের
ওপর রাখলাম। একটি পাখির বাচ্চার মতো মুখ খুলে
কেঁদে উঠলো আমার প্রাণ। আমি শুধু বোঝাতে চাইলাম
আমার নির্মাতাকে আমার এই কোমল ডানাওয়ালা আত্মা
উৎসর্গ করতে এসেছি। আমার কোনো ওজন নেই
না-পাপের, না-পূণ্যের। তবে জগতের অন্যতম বিলাপ
আমার কান্না। এই নাও কান্না।
পৃথিবীর উঁচু এভারেস্টের মতো দুঃখের পর্বত আমি নিয়ে এসেছি
সাহারা মরুভূমির চেয়েও বিস্তৃত আমার অনুতাপ।
আর আমার প্রেমের পরিধি হলো সীমাহীন শূন্যতার
মধ্যে ভাসমান ঐ নীহারিকাপুঞ্জ।
নারী বলতে আমি একটি মুখই স্মরণ করতে পারি;
শান্তি বলতে একটি মুখ, সহবাস বলতে সেও তো
একটি মাত্র মুখ। এমন লোকের প্রাপ্য কে নির্ধারণ করবে?
যেখানে দোজখের আগুনও আমাকে খেতে চাইছে না।
ও কৃষ্ণ গহ্বর আমাকে খেয়ে ফেল।
আমি পরিণামের একটি স্তর মাত্র।
এখন কোনো প্রশ্ন বা প্রতিভার কথা কেউ বলে না।
কিন্তু এখানে তো আমার শেষ নয়, আমার কোনো বিলয়
ঘটছে না। তাহলে আমি থাকছি কেন? আমি মাটি,
পাথর বা ছোঁয়া যায় এমন কোনো বস্তুকণা তখনও যেমন
ছিলাম না, এখনও তো নই। তাহলে আমি আছি কেন?
আমি কেন আশা করি আমি থাকবো? ভালো বা মন্দের
ব্যাপার নয়, কারণ আমি ভালো বা মন্দ কিছুই নই। তাহলে
আমি কী? আমি যতদিন তোমাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন
আমি স্বপ্নের কথা বলেছি, নারীর কথা বলেছি, নিসর্গ ও
নিয়মের কথা বলেছি, সর্বোপরি আমার প্রতিপালকের
কথা বলেছি।
কিন্তু আমার মত নির্মাণের অর্থের কথা তো বলিনি।
আসলে আমি জানি না আমি কী। তবে সব সময় আমি
ক্ষমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছি। না দেখেও উবুড় হয়ে
পড়ে থেকেছি। এখন আমাকে নিয়ে আমার কোনো বেদনা
অনুভূত হচ্ছে না। চিমটি কেটে বা ছিদ্রের উপর ছিদ্র করে
আমি আর এগুবার মতো কোনো রন্ধ্র খুঁজে পাই না।
এবার আমার সমাপ্তির কথা ভাবতেই হয়।
কিন্তু সি*ড়ি খুঁজে পাচ্ছি না। হাতল খুঁজে পাচ্ছি না।
দিন ও রাতের আবর্তন বা উদয়াস্ত খুঁজে পাচ্ছি না।
অমরতার আক্ষেপ / আল মাহমুদ
কতবার ভেবেছি কবির আংরাখা আমি খুলে ফেলি কিন্তু জগতের সবগুলো
চোখ আমার নগ্নতা অবলোকনে উদগ্রীব। তুমি তো জানো কবির কোনো বন্ধু হয় না।
যেমন রাজার কোনো বন্ধু থাকে না। আমি আমার পোশাক তোমার পালঙ্ক
স্পর্শ করে খুলে ফেলতে চাই। চুমকির কাজ করা এই পিরহান, দামেস্কের
দর্জির তৈরি এই কোট, রেশমের ঝলকানো এই পাজামা, একলক্ষ মুক্তো
বসানো অজগরের চামড়ার এই কটিবন্ধ আমি তোমার বিছানায় শিথিল করে
তোমার পাশে শুয়ে পড়বো। একটা জগৎ দেখার যে ক্লান্তি তা আমার নয়নে
এতদিন জমা ছিল এখন ঘুমুতে চাই।
এসো আমরা পরিত্যক্ত পৃথিবীর কথা আলোচনা করি। তুমি এখানে এই
দুঃখহীন অনুতাপহীন অভাবহীন বাসস্থানে কীভাবে থাকবে? এখানে তো কোনো
মৃত্যু বা বিনাশ নেই। অশ্রুজল বা দীর্ঘশ্বাস নেই। যেখানে শোক নেই হাহাকার নেই
ক্ষুধা বা উপোস নেই সেখানে সুখের স্বাদ আসলে কেমন তা আমি চাখতে এসেছি।
আমার কেন পৃথিবীর কথা এত মনে পড়ে। কেন মানুষের রোদন ও আক্ষেপের
দুনিয়া যা আমরা ফেলে এসেছি অনেক দূরে একটা ভেজা মাটির বিশাল
গোলাকার গ্রহে যা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে একটি তারা হয়ে জ্বলছে। তার কথা ভুলতে পারি না।
আমি কেন নেবু ফুলের গন্ধেভারী বাতাসের কথা আমার স্মৃতি থেকে মুছে
ফেলতে পারি না? নদীর তীরে জোনাকি ভরা সেই গ্রাম খড়োঘরের একটি
চালার নিচে তোমাকে প্রথম চুম্বনের সেই স্মৃতি কেন অনন্ত সুখের মধ্যে এসেও
আমাকে অশ্রুসিক্ত করতে চায়? কে জানে? আমরা তো অনন্তকালের উপযোগী
দেহাবয়ব পেয়েছি। কিন্তু কেন সেই রোগ জরজর মশা-মাছির গুঞ্জনের মধ্যে
তোমার মরদেহের ক্লান্তি স্পর্শ করার পার্থিব বাসনা এখনো আমার অমরত্বের
শরীরের নিচে গুমরিয়ে মরছে।তবে কি তুমি সেই তুমি নও?
ও বিশালাক্ষি, কাঞ্চনকান্তি, অমরযৌবনা, কেন মৃত্যুময় পৃথিবীর স্মৃতি আমাকে
এত আকুল করে রেখেছে? আমি কবি এই কি অপরাধ? ও নেবু ফুলের গন্ধ,
ও নদী তরঙ্গের ভেঙে পড়া চাঁদের স্মৃতি, ও বিলুপ্ত পৃথিবীর হাওয়া, আমার
কবিত্বকে আমার প্রিয়ার পালঙ্কে আর আমাকে তোমাদের আঁচলের হাওয়ায়
কেন ঘুম পাড়িয়ে দাও না?
নাবিক / আল মাহমুদ
দেখো আমার মুখের দিকে।
মনে হবে নোনা তরঙ্গের উপর ডানা মেলে দিয়েছে এক গাঙচিল।
মনে হবে ফেনার আলোড়নের মধ্যে আমার জন্ম
মনে হবে মাটি নয় তরঙ্গই আমার আবাস।
আমি জানি ঢেউয়ের ভেতর শুয়ে আছে
আমার কত পূর্বসূরি
ঢেউয়ের ভেতর আমি তাদের চোখ, চোখের মণি
মুক্তা হয়ে যেতে দেখেছি
তাদের হাড়গোড় এখন প্রবাল
তাদের কত স্বাদ ছিল, স্বপ্ন ছিল
কত বন্দরে তারা প্রেমের নোঙর ফেলেছিল
এখন তাদের হাড় প্রবাল হয়েছে নুনের মধ্যে
বলো নাবিকের উত্তরাধিকার কী? স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়।
নাবিকের লাশ মাটি পায় না
তরঙ্গে ভেসে যায় তার অবশেষ
কোনো অবসন্নতা নেই যেমন সমুদ্র ঘুমায় না।
উদয় ও অস্তের দৃশ্য দেখার জন্য
তীরের মানুষেরা সমুদ্রের কাছে আসে।
কী তারা দেখতে পায়? অনিঃশেষ লবণ
ফেনিল তরঙ্গ তুলে অনন্তকাল ধরে নাচছে।
সমুদ্র হলো এই পৃথিবীর একটি পরম সত্য
মানুষ যখনই ক্ষুধার্ত হয়
পৃথিবী যখন আর তার আহার যোগাতে পারে না
তখন সাগর তার পেট খুলে দেয়।
কত প্রলোভন একজন নাবিককে ডাকে
ক্ষণস্থায়ী আনন্দ বন্দরে বন্দরে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে
কিন্তু একটি বিশাল দীর্ঘশ্বাস নোঙর তুলে নিয়ে আবার ভেসে পড়ে
কারণ দরিয়া কোনো দিগন্ত মানে না
কে এই আদি হাতছানির আদি স্রষ্টা
শুধু অসীমের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া
এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
অতৃপ্ত প্রেম নিয়ে বন্দরে বন্দরে আমরা রেখে আসি আমাদের অশ্রুজল
যা সমুদ্রের মতোই নোনা এবং অদৃষ্টের মতোই সীমাহীন।
গতিই আমার নিয়তি / আল মাহমুদ
সবার মধ্যেই দেখেতে পাচ্ছি আমাকে নিয়ে উদ্বেগ। আমার দিকে তীর্যক চোখের দৃষ্টি।
ফিসফিসিয়ে কথা। এই তুমি লাইন ভেঙে এগুচ্ছো কেন? দেখছ না আমরা আছি?
আমরা তোমার মুরব্বী। বয়সে তো বড়?
আমি বুঝলাম না, আমার একটা পা একটু আগ বাড়ানো বটে। কিন্তু আমি তো লাইন ভেঙে যাইনি।
আমি তো নড়িনি। কেন সবাই ভাবছে আমি তাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি?
আমার চেহারাটাও আমি যতদূর জানি বেয়াদবের মতো নয়। তাছাড়া আমি
অদৃশ্য পাখা কোথায় পাবো? আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন
মানুষ ভাবে আমি তাদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছি? ভেতর দিয়ে
চলে যাচ্ছি? ভেদ করে যাচ্ছি, প্রভেদ করে যাচ্ছি?
হায় আল্লাহ! প্রভু আমার আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেন গতির সৃষ্টি হয়।
আমি স্থানু। কিন্তু অন্যের বিবেচনায় অশ্বারহী। যদি আমার নিয়তি আমাকে
এমনভাবে আকাশ ফাটানো বিদ্যুতের ঝিলিকে ছড়িয়ে দেয়, আমার কী করার আছে?
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সবাই আমার চেনা, আমার আত্মীয়, পরম কুটুম্বের মুখোশে ঢাকা
ওইসব প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখোশ টেনে ছেঁড়ার দায়িত্ব তো আমার নয়, আর আমি দাঁড়িয়েও
থাকতে চাই না। লাইন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার যে নেই, এমন তো নয়।
আমি তো প্রকৃতপক্ষে সব সীমা ছাড়িয়ে উপচিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আমি
বিবেকহীন নই, ধর্মহীন নই, মানুষ্যত্বহীন নই। যারা আমার পোশাক টেনে ধরেছে
তারা জানে আমাকে আটকে রাখার ক্ষমতা তাদের আর নেই। আমাকে পরাভূত
বানাতে পারে যারা, তারা তো কেউ এ লাইনে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়ায়নি অবশ্য
তাদের অনুকম্পার জন্যে, ভালবাসার জন্যে। এ প্রতিযোগিতায় সেই নারীকেও
দেখছি না, যার ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে আমি ভষ্ম হয়ে যাই এই ভয়ে পৃথিবীতে সারা
জীবন আমি পালিয়ে বেড়ালাম। গাছের আড়ালে, পর্বত ও গিরি-শৃঙ্গের
পেছনে মুখ লুকিয়ে থাকলাম।
কিন্তু তবু আমার লাইনের অগ্রগামীরা ভাবছে আমি তাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি। মাড়িয়ে
যাচ্ছি কিংবা সবাইকে হারিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছি।
আমার আত্মার ভেতরে এক গোপন প্রেরণার শিখা দেখতে পাচ্ছি বটে। কিন্তু আমি তো
তা নিজে জ্বালাইনি। আমার প্রভুর দিকে বার বার সিজদা দিতে দিতে
অকস্মাৎ মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কী যেন একটা ঘটে গেছে। আমার
সুরত আগের মতোই ঠান্ডা, চোখে বিদ্যুতের বিভা। কেউ না জানলেও
আমি তো জানি আমার পিঠে অগ্রভেদী দু’টি ডানার নিক্কণ। আমি
ছাড়িয়ে যাবো এটা কোনো ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো, যারা আমার দাঁড়িয়ে
থাকাতেও গতির বিদ্যুৎ দেখতে পায় তারা ঈর্ষাকাতর। মৃত্যুর স্তব্ধতায় তারা স্থবির।
যারা নিঃশ্বব্দ গতির ধাবমানতাকে নিজেদের মাথা দিয়ে মাপে তারা বামন।
আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের ছাড়িয়ে যাই।
অন্তিম বাসনার মতো / আল মাহমুদ
আরেকটু এগোতে চাই। বান্ধবহীন এ মহাযাত্রায়
আর কয়েক পা। দেখো
সমাপ্তির কাছে এসে পায়ের মাংস ফুলে উঠেছে,
হাঁটুতে বিদ্যুৎ। ভর রাখার জন্য টলটলায়মান মাংসপেশী।
যারা কাঁধ বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের মধ্যে
বন্ধুত্বের বিচার করা আমার আর সাজে না।
ভর রাখতে চাই এখন যে-কোনো শত্রুর কাঁধে
যদি তার আস্তিনে লুকানো থাকে বাঁকা ছুরি,
তবে তা আমূল বসিয়ে দিক আমার বুকে।
আমার বক্ষস্থল যে-কোনো অস্ত্রাঘাতের বেদনায় চেয়ে
তোমরা বৃহত্তরই পাবে।
আমাকে শুধু এইটুকু পথ অতিক্রম করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে দাও।
আমার অন্তরাত্মা সীমান্ত ছাড়িয়ে এখন স্বপ্নের মধ্যে পাখি হয়ে উড়ছে।
আমি কি আর কোনো মিত্র খুঁজতে পারি?
যার কাঁধে ভর রেখেছি, ও নির্ভরতা তুমি কি নারী?
শাড়ি পরা?
আমার স্পর্শে তোমাকে আমি পুরুষ বানিয়ে দিতে পারি
কিন্তু এর বিনিময়ে আমাকে উপচে উঠতে দাও;
পেছনে যেতে দাও।
শুধু সীমার ওপারে একটা পুরু পা না হোক
নখের কিছু অংশ মাটি খামছে ধরুক এখন।
আমি শত্রু বা মিত্র কারও চেহারার দিকে
তাকাবার অবস্থায় নেই। যদি কোনো দুশমন
মুচকি হেসে বলে আমিই তো তোমাকে
এত দূর আনলাম
তাহলে তাকেই সালাম।
স্বপ্নের মধ্যে এখন আমি পাখি হয়ে গেছি
উড়ছি, ঘুরছি নখ আঁচড়ে। মেঘের ভেতর
নিজের সমাধি ফলক বসিয়ে দিয়েছি।
ভেঙে যেয়ো না মা আমার / আল মাহমুদ
যেসব শিশুদের আমি একদা হাসতে খেলতে এবং হাঁটতে শিখিয়েছিলাম
এখন তারা আমার পঙ্গুত্ব চোখের নিষ্প্রভতা এবং
নিশ্চল নৈরশ্য নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছে।
আড়ালে নয় আমার সামনে। আমি ভাবি এটাই জগতের নিয়ম কিনা
আমি অবশ্য এতে কোনো চাঞ্চল্য অনুভব করি না, না-বেদনা না-দুঃখ।
কারণ আমি কালকে অতিক্রম করে আসা একটি নিভে যাওয়া
ধুমকেতু মাত্র, যেন তেজ হারিয়ে একটা শিলাপাথর। পৃথিবীর
গ্রানিটে শব্দ করে নিস্তব্ধতায় মগ্ন।
শুধু মানুষের শিশুদের যে হাঁটতে শেখাতে হয় এটা একটা
আশ্চর্য ব্যাপার। আর সব প্রাণী সয়ম্ভর, গর্ভ থেকে
নেমেই অনায়াস কর্ম-চঞ্চল। সাপের শিশু মায়ের মতো ফণা ধরছে
মায়ের মতোই বীষ সঞ্চারিণী, বাঘের শিশু হিংস্র, ঈগলের
বাচ্চা টেনে ছিঁড়ে কেড়ে রক্তাক্ত উড়ালে উড়ে যায়।
পেছনে লুটায় জগৎ।
কিন্তু আমার শিশুরা প্রথম আমার আঙুল ধরে অতি কষ্টে
দাঁড়িয়েছিল। আমার হাঁটু আঁকড়ে মুখ তুলে দেখেছিল
পিতাকে। তারপর কোমর, তারপর বুক। এখন এদের মাথা
আমার সমান। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
হুইল চেয়ারে এঁটে বসছে কোমর, যা একদা শক্ত চামড়ার
বেল্টে বাঁধা থেকে হিমালয় ডিঙাতে চাইতো।
আমি কী দেবে যাচ্ছি?
আমি কী বলব ধরণী দ্বিধা হও? না। এবং
আমি দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীকে আমার কম্পমান হাত দিয়ে
বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই। বলতে চাই ভেঙো না ।
ভেঙে যেয়ো না মা আমার।
শুধু মানুষের বাচ্চাকেই হাঁটাতে হয়। মুখের ভেতর পুরে
দিতে হয় মাতৃস্তন, যতক্ষণ সে মাংসাশী না হয়ে ওঠে।
স্বপ্নের ভেতর দর্জি মেয়েটি / আল মাহমুদ
রাতভর বৃষ্টি। আর সেলাই কলের শব্দ। কে এই যুবতী?
ক্রমাগত সেলাই করে চলেছে ভাসমান মেঘের সাদা থানগুলো
সে কি সেলাই করছে আমার জন্য কাফন? তার মুখ আমি
বিদ্যুতের ঝলকের মধ্যে একবার মাত্র ঝলসে উঠতে দেখেছি।
অচেনা ঘর্মাক্ত চেহারা। নাকের নাকফুলটিতে একটিমাত্র জোনাকি।
খাটের উপর উপচে পড়ছে এক প্রবল পুরুষের নগ্নতা।
মেয়েটি আমার চেনা নয়। কিন্তু তাকে অচেনা বলার সাহস
আমি
সর্বত্র হাতড়ে বেড়িয়েছি। যতবার
হাত বাড়িয়েছি নীলিমায় ততবারই আমার নখের ভেতর
উঠে এসেছে চূর্ণ নক্ষত্রের গুঁড়ো।
ঠিক ওই মেয়েটির নাকে ঝুলানো নাকফুলের বিন্দু।
সবই তো চেনা। সেলাইয়ের মেশিন এখন জোড়া লাগাচ্ছে
সবগুলো মেঘস্তরকে। সেলাই বিহীন কাফন কে দেবে আমাকে?
মেয়েটির মুখ একবার আমার দিকে ফিরল
সে কি এখন একজন কবির নগ্নতা মাপার ফিতে বের করবে?
এই অক্লান্ত, অলৌকিক দর্জি মেয়েটির জন্য আমি আরও একবার
পাশ ফিরে শুতে চাই। সে আমাকেই মাপুক যাতে তার
কাটা কাফনের পিরহান আমার সাথে খাপ খেয়ে যায়।
সারারাত এই বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে দর্জি মেয়েটি
জোড়া দিয়েছে মেঘস্তর। তার গাল বেয়ে নেমে এসেছে
ঘামের বিন্দু। আমি তার জন্য পাশ ফিরে শুয়েছি
সংবরণ করেছি পৌরুষ।
নখ থেকে ঝেড়ে ফেলেছি নক্ষত্রের চমক।
আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাক ওই সেলাই কলের শব্দে।
কেন যে দর্জি মেয়েটি মেঘের পর মেঘস্তর জোড়া লাগিয়েে
আমাকে ঢাকার আয়োজন করছে তা সেই জানে।
আজ আমি তার জন্য বারবার পাশ ফিরে শুয়েছি
বালিশ ভিজিয়ে দিয়েছি চোখের জলে
বৃষ্টি ও অশ্রুজলের নদী আমার পালংক ছাপিয়ে
পৃথিবীর পেটের ভিতর আছড়ে পড়েছে।
কিন্তু সেলাই কলের শব্দ সব কিছু ছাপিয়ে এখন আমার
রক্ত মাংসের উপর এসে ঝিমঝিম করে বেজে চলেছে
আর সেলাইয়ের সুতোয় বাঁধা পড়ে যাচ্ছে আমার দীর্ঘ আয়ুষ্কাল।
পৌরুষ ও প্রবৃত্তি। কে এই অচেনা দর্জি? তার নাকফুলে
আমার আত্মা জ্বলছে।
বসন্তবৈরী / আল মাহমুদ
এবারই প্রথম। ব্যর্থ কোকিলের ঝাঁক বাংলার বিমর্ষ সবুজকে বিদীর্ণ
করে দিয়ে ভাঙা গলায় কুহু ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে প্রান্তরে
মিলিয়ে গেল। তুমি যখন উঠোন পেরুলে তখন কোনো সম্ভাষণ নেই।
না-প্রকৃতির না-ঋতুচক্রের। আমি ইচ্ছে করলে আমার ক্যাসেটে বন্দি
নকল পাখির ডাক তোমাকে শুনিয়ে দিতে পারি। একেবারে নির্ভুল
কুহুধ্বনি। যদিও গাছে কোনো ফুল ফোটাতে আমি পারব না। তুমি তো
বসন্তে বসরাই গোলাপ চাও, কাঁটা ও সৌরভের মধ্যে নাক উঁচু করে
থাকতে চাও। কিন্তু আমার বাগানে ফুটেছে নির্গন্ধ ব্লাকপ্রিন্স। আর
আমার পড়ার ঘরের শিক বেয়ে উপচে পড়ছে অপরাজিতা। তুমি যে
ফুলের উপমা হতে পারতে অথচ কী আশ্চর্য দেখ তুমি ওই নীল ও
হলুদের ছোপ লাগা ময়ূরের পালকের ডিজাইন চুরি করা অপরাজিতা
নাম শুনতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যাও। কেন, মানুষীর কি পরাজয় মানতে নেই?
আমি তো এখন আর বিজয়ের কথা ভাবি না।আমার পোশাকও দেখ
ঘরে ফেরার। দিগ্বিজয়ীর বেশবাস এখন নেপথলিনের গন্ধের মধ্যে
পচে যাচ্ছে। এমনকি দিগ্বিজয়ীদের ইতিহাসও আমার আর ভালো লাগে
না। মনে হয়, দিগ্বিজয়ীর প্রতিমূর্তি মূলত কণিষ্কের কবন্ধের মতো।
অথচ আমার তো একটা মাথা দরকার।আমি হাত দিয়ে আমার
মস্তক স্পর্শ করে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই।
তুমি কোকিলের কুহুধ্বনি ও নির্গন্ধ গোলাপগুচ্ছের পাপড়ি ঝরে
যাওয়ার উঠোন পেরিয়ে এলে এতেই আমি খুশি। তোমার পায়ের
ছাপ আমার উঠোনকে মুখরিত করে তুলুক। অপরাজিতার নীল চোখ
আমি টাওয়েল দিয়ে ঢেকে রাখব।
জনশূন্য আমার বিবেক / আল মাহমুদ
ধানের বাতিকগ্রস্ত ভূমিহীন কৃষাণ যেমন
বসে থাকে ধান কাটা শূন্য মাঠে ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
তেমনি আমিও চেয়ে দেখি আকাশের নীল প্লেটে
একগুচ্ছ মেঘের কুন্তল। যেন-বা আমার মায়ের হাতে
বেড়ে দেওয়া ঈদের পোলাও। আর-
ঝালের রেকাবী থেকে গুঞ্জরিত হিংয়ের গন্ধের মতো
কিছু তাপ ঢুকে যায় আমার দেহেও।
অতীত কিছুই নেই; সবি বর্তমান। আজ নেই, কালও বুঝি নেই
তবে কি অনন্ত নামে মহা সেই বাসুকির ফণা
গ্রাস করে সময়ের সব সারাৎসার।
কেন দীর্ঘশ্বাস আর? কেন অন্ধকার, কেন খুঁজি আলোর আহার
জীবন তো পাড় হওয়া, মার খাওয়া, ধার করা নিঃশ্বাসের বায়ু
হৃদয়ের কোণ থেকে অম্লরস ভেদ করা কি কৃপণ আয়ু-
একে বলে বেঁচে থাকা? এই তবে মানব জীবন?
কবিতা তো দৃশ্যকল্প কেবল তোমার সাথে আসঙ্গলিপ্সার কিছু অকপট ছবি-
আর শুধু অপেক্ষায় থাকা, কখন বিলীন হবে অস্তিত্ব আমার
কিংবা ভবে কখনো ছিল না কেউ সবি স্বপ্ন, সবি শূন্য মাঠে
ভূমিহীন কৃষাণের অফুরন্ত নিঃশ্বাসের হাওয়া।
ধান কাটা হয়ে গেছে আমি শুনি সহস্র ইঁদুর এসে
হুটোপুটি করে যায় হেমন্তের শূন্য মাঠে
জনশূন্য আমার বিবেক।
শূন্যতাকে মানি না / আল মাহমুদ
শুধু চোখের দৃষ্টি কমে এসেছে এমন নয়। বিচরণের ক্ষমতাও এখন ক্লান্ত। অথচ
নিত্য বিচরণের ক্ষেত্র হে আমার পৃথিবী, হে আমার মহাদেশ, হে আমার
দেশ, আমার গ্রাম ও আমাদের শহর আমার পা আর উঠতে চায় না। আমার
দেহের সবচেয়ে ব্যবহৃত অঙ্গ-প্রতঙ্গের মধ্যে এ প্রাচীন পদদ্বয়
আমাকে জানান দিচ্ছে গাছের মতো কিছুকাল স্থানু হয়ে থাকতে।
বৃক্ষের স্বভাব আমি বুঝতে পারি। কিন্তু গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে
অন্তর্হিত হওয়ার বাসনাই আমার প্রবল। আমি থাকব না- এর চেয়ে
যৌক্তিক বার্তা এখন আমার মধ্যে কাজ করে না। যখন ভাবি থাকব না তখন
আড়চোখে তোমাকে দেখি। সহসা মনে হয় তুমি যেন সেই
লালগ্রহটি যা আজ সকালে সঙবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ‘স্পিরিট’ নামক
রোবট ক্রমাগত পাঠিয়ে চলেছে মঙ্গলের ছবি। রক্তিম আভাযুক্ত
ধূসর প্রান্তর। মাঝে মাঝে নীলাভ শিলার স্তূপ।
কোমল ও কঠনে মিলিয়ে যেন হুবহু তুমি।
আকাশের কথা ভাবলে মানুষের দৃষ্টি ফিরে আসে। কিন্তু মানুষের
জ্ঞানের ধাবমানতা কোনো-না-কোনো ধূসর কংকরময় পানি শূন্য
গ্রহে গিয়ে কেন আছড়ে পড়ে? আসলে মানুষের জ্ঞান
শূন্যে ভেসে বেড়াতে চায় না। অন্তহীনতায় লুপ্ত হতে চায় না।
জ্ঞান মাত্রই আশ্রয় যাচে। ভর রেখে দাঁড়াতে চায়। যেমন
সংসারের শূন্যতার মধ্যে আমি তোমাকে ধরে আছি। তুমি
শুক্র বা মঙ্গল নও। কিন্তু কবিতার ভর রাখার এক
মায়াবী উপগ্রহ তুমি। তুমি কিংবা আস্ত একটি গ্রহ।
ঊর্ধ্বলোকের চিন্তা স্বভাবতই আমাকে ঘিরে আছে। তুমি তো
জান আমি নিঃশেষ হওয়ার , লুপ্ত হওয়ার বা মিলিয়ে যাওয়ার
যুক্তিকে অগ্রাহ্য করি। আমার আধ্যাত্মিক চেতনা আমার
অনিঃশেষ হওয়ার বিশ্বাসকে এমন দৃঢ়তর করে তুলেছে যে মাঝে মাঝে
ভাবি বুঝি বা তোমার উপর ভর না রাখলেও আমার চলে।
আমি কোনো শূন্যতাকেই মানি না। বিলুপ্তিকে মানি না। কারণ আমি
চোখের সামনে আমার অনন্তের আবাসস্থল দেখতে পাচ্ছি। সেখানে
তোমাকে ফিরে পাওয়ার বাসনাই তো আমার প্রেমের মূলশক্তি।
তুমি একটি পালংকে হেলান দিয়ে বসেছ। এই দৃশ্যের-
আর শেষ হয় না।
মানুষের দীর্ঘশ্বাস / আল মাহমুদ
দেখত দেখতে বহুদূর চলে এসেছি। পথে পথে ধসে পড়েছে
ইন্দ্রিয়ের ছলাকলা। এক নদীর পাড়ে খুলে পড়ে গিয়েছিল
আমার চোখের আলো। কত খুঁজলাম, কিন্তু সন্ধ্যার
আবছা একটা চশমার মতবসে গেল আমার নয়নে।
তারপর প্রান্তর পেরুতে গিয়ে ধসে পড়েছে আমার
শ্রবণ ইন্দ্রিয়। এখন কলরবমুখর কত নগর পেরিয়ে যাই
শুনতে পাই না। মানুষের কান্না না শুনতে পারা কত যে
দুঃখের সেটা আমি গুলির শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে বুঝতে
চেষ্টা করলাম। বোমা ফাটছে, ক্ষেপনাস্ত্র এসে আঘাত
করছে মুহ্যমান মহানগরীর মাঝখানে। আমি কানে
আঙুল না দিয়ে হেঁটে যেতে পারি। কিন্তু কেউ প্রশ্ন
করে না আমি কোথায় যাব। আমারও জানা নেই।
আমার কানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে গুল্মলতা।
আর অন্ধদৃষ্টির ভেতরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। সমুদ্রের
লবণাক্ত পানি ঢুকে যাচ্ছে আমার মগজের ভেতর।
আমি কবি বলে গালি দিলেও, যেমন অতীতে কারো
দিকে ফিরে তাকাইনি, আজও তেমনি কুৎসার মেঘ
কুন্ডলী পাকাচ্ছে আমার শত্রুর ভেতর। দাড়ি বেয়ে রক্ত
গড়িয়ে পড়ছে। বল, আমি কী না বলেছি? আমিও তো
মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম, এক নারী আমাকে হাঁটতে
বলেছিল বলে আমি একজন দিগন্তচারী সর্বভেদী স্বপ্নের মতো
শান্তির অন্বেষণ করেছি। আসলে সবাই ভাবে কবরের
নিঃস্তব্ধতাই হলো শান্তি, আমি তা ভাবিনি।
কলরবমুখর নগরগুলোই ছিল আমার গন্তব্য। বেবিলন
থেকে আমার শুরু, তারপর ক্রমাগত ধ্বংসের মধ্যে এখন
আমি যে শহরে এসে দাঁড়িয়েছি, তার নাম ঢাকা মহানগরী
আমি এখানে আর কোনো শব্দ শুনতে পাই না। কত বোমা ছিন্ন-ভিন্ন
করে দিচ্ছে মানুষের রক্ত-মাংস। কিন্তু আমার কানে
গজিয়ে উঠেছে লতাপাতা। যেন সাচী পানের লতা আমার
কানকে এক সুরভিযুক্ত পানের বরজ করে রেখেছে। যুদ্ধ, ধ্বংস,
বোমার স্প্লিন্টার গ্রেনেড সবকিছু আমার নিরাসক্তির অরণ্যে তলিয়ে
যাচ্ছে। আমি সবসময় ভাবতাম নৈঃশব্দই হলো কবির
শেষ ঠিকানা। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে আমি ফুঁ দিলে
বিনাশপ্রাপ্ত। ও অবলুপ্ত মহানগরীগুলোর ভেতর থেকে মানুষের
হা-হুতাশ বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শান্তি ছাড়া
আমরা কি আর কোথাও মনুষ্য জীবনের জন্য আক্ষেপ করার চাতাল
খুঁজে পাবো?
ভুলের দিগন্তে / আল মাহমুদ
যদি ভুল পথে এসে থাকি তবে জেনো ভ্রান্তিই আমার ধ্রুব। এখন
গাছ সাক্ষী আমি আর ফিরব না। নদী সাক্ষী আমি আর ফিরব না।
মেঘ, পাখি আর পাল তোলা নাওয়ের কসম, যে পায়ের ছাপ
আমার পেছনে রেখে এলাম তা মৃত্যুর দিগন্তে গিয়ে
একবার নিঃশ্বাস ফেলবে। ভুলের পুরস্কার যদি মৃত্যু, তবে তাই হোক।
অথচ আমার যৌবনে আমাকে কেনা সমর্থন করেছে। সবাই
বলেছে, যাও যাও। বাঁশবনের আড়ালে দাঁড়িয়ে মার্জারীর মত
ধূর্ত এক নারী তার কাঁকন বাজিয়ে বলেছিল, যাও।
এখন মনে হয় একশ বছর আমি কেবল হেঁটেছি
দ্যাখো আরও শত বছরের জন্য আমার চরণ প্রস্তুত। এখন
কেন আকাশের ধ্রুবতারাকে আমি ভুলের দিশারী
বলব? তোমাদের একবিংশ শতাব্দীতে আমার ভুলের
দিগবিজয়।
মানুষের সকল সফরই যদি শেষ পর্যন্ত এক মহাসমাপ্তির দিকে
তাহলে কেন আমাকে নিয়ে মরুভূমিতেও এমন
বালুর তরঙ্গ। হোক মরীচিকা, আমার তিয়াস
মেটাবার স্বপ্নের পিছু ধাওয়া ছাড়ব কেন?
আমার সামনে ঐতো সরোবর। মাছের তোলপাড় আমি
শুনতে পাচ্ছি। এ বাঁশবনের হারিয়ে যাওয়া সোনার কাঁকন
আমি ভুলের শেষবিন্দুতে তোমাকে খুঁজি।
এখানেও আমার দেহের সাথে তুলনা দেয়ার জন্য আছে
ঝাউয়ের সারি। তোমার চোখের উপমার মত দিঘি। খুঁজলে
তোমার বক্ষের তুলনাও কোথাও আছে। কিন্তু বারবার তুলনা খোঁজার সাহস
আমি কোথায় পাবো?
কবিতার কথা / আল মাহমুদ
আমার মেয়ে খাঁচায় একটা ময়না পুষতো। আদরে আব্দারে
কিভাবে যেন পাখিটার নাম দাঁড়িয়ে গেল কবিতা।
বাইরে থেকে কেউ ঘরে এলেই ‘কবিতা, কবিতা’ বলে পাখিটাকে
তোয়াজ করতো।
এমন কি আমিও যে কিনা জন্তু-জানোয়ার পোষার ঘোর বিরোধী।
মাঝে মধ্যে পাখিটার চকচকে কালো পালক ও হলদে ঝুটি দেখে
হঠাৎ বলে ফেলেছি, কি রে কবিতা? আমার ডাকে পাখিটা
সহসা চমকে গিয়ে থমকে বলতো, ভালোবাসি, ভালোবাসি…
আমার কলেজে পড়ুয়া মেয়েটি সম্ভবত কবিতাকে এসব বুলি শিখিয়েছে।
এ দেশের কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা এর বেশি কি ই-বা জানে?
ফলে পাখিটার নিত্য ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঐ ‘ভালোবাসা’।
সহসা একদিন আমার মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল। ভালোবাসারই বিয়ে।
যাওয়ার সময় আমার পায়ে হাত রেখে কাঁদল, বাবা কবিতাকে খেতে দিও।
কবিতা তোমার কাছেই থাকল।
আমি মুখ ফুটে বলতে পারলাম না, এ আপদ সাথে করেই নিয়ে যা না!
কে এটাকে দানাপানি জুগিয়ে বাজে কথা শুনবে। তোর মা থাকলেও না হয়
কবিতার যত্ন নিতে পারত। আমি একা মানুষ!
কিন্তু সুখের আশায় রোরুদ্যমান আমার কন্যার বেনারসীর
রঙিন বাহারের কাছে আর সব বাপের মতই আমিও নির্বাক থেকে
মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিলাম।
কিছুদিন পরেই শশুরবাড়ি থেকে লিখে পাঠিয়েছে, বাবা
কবিতাকে খাঁচা খুলে উড়িয়ে দিও। সে কি এখনও ভালোবাসি
বলে ডাকে?
এখানে বসে বুঝেছি তোমার মত ব্যস্ত মানুষের পক্ষে কবিতার আহার
জোগানো কতটা মুস্কিল।
পাখিটা না খেতে পেয়ে মরার আগেই ছেড়ে দিও বাবা,
দোহাই তোমার।
বুঝলাম বিয়ের পানি মেয়েটাকে বুদ্ধিসুদ্ধি দিচ্ছে।
কিন্ত কবিতাকে বিদেয় করতে গিয়ে আমি তো অবাক।
খাঁচা খুলে পাখিটাকে যতই উড়ে যেতে বলি ততই সে
খাঁচার ভেতর ওড়িউড়ি করে বলে,‘ভালোবাসি’।
খাঁচা খোলা রেখেই ঘুমুতে যাই। কিন্তু কবিতা পালায় না।
তার ঐ এক কথা, ভালোবাসি।
আমি এখন এই খাঁচার দাসী
কবিতাকে নিয়ে কী করব?
স্বপ্নের উৎপাত / আল মাহমুদ
সারা জীবন আমি উদ্ভট স্বপ্নের মধ্যেই পাশ ফিরে শুয়েছি। দুঃস্বপ্নের
উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে বালিশের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে সান্ত¦না খুঁজেছি।
ভেবেছি, ওটা ছিল স্বপ্ন। সম্ভবত আমি ঘুমকাতুরে লোক বলে
খোয়াবের জ্বীন আমার পিছু ছাড়তে চায় না, ঘুমের শুরুতেই
অস্বাভাবিক একটা শিরশিরানি আমার হৃৎপিন্ড থেকে নিঃসৃত হয়ে
মস্তিষ্কের সব স্বপ্নের খুপড়িতে ফোকাস ফেলে। আমি দেখি
গাছগুলো স্থান ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে।
আর আমার পরিচিত সব মানুষ গাছের মতো স্থানু হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। এ ধরনের স্বপ্নে দ্রুত ঘুম টুটে যায়।
আমি বলে উঠি, এ তো স্বপ্ন। মিথ্যা প্রবোধে চৈতন্যের
ডালপালা কয়েকটা হলুদ পাতা ঝরিয়ে দেয় বটে। কিন্তু
আমি বিছানায় উঠে ঠায় বসে থাকি।
এখন এই সত্তর বছর বয়সে যেখানে ঘুমের কোনো বালাই
আমাকে আর ছুঁতে চায় না, তখন এসব কী দেখছি! এ তো কোনো
স্বপ্ন নয়। পশু, প্রকৃতি, বৃক্ষরাজি ও নদ-নদীর মাছের ঝাঁকেরা
আমার কাছে আমার কানে নাঁকিসুরে কাঁদছে কেনো?
আমি এখন আর বঞ্চিতা বুক চাপড়ানো নারীর কান্নার সাথে
প্রকৃতির রোদনধ্বনিকে আলাদা করতে পারিনা। আমি কোনো কিছুরই
প্রতিপালক তো নই। আশ্রয় বা প্রশ্রয়দাতা নই। তবু
মানুষ ও প্রকৃতির বিলাপ আমাকে দেয়াল ফুটো করার
যন্ত্রের মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে কেনো?
আমি শৈশবে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। সে-জন্য আমার মা আমার
বাজুতে চেপ্টা কবজ বেঁধে দিয়েছিলেন।
সে-সব তো ছিলো স্বপ্নের ব্যাপার, ঘুমের প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু দেখো, আমি দু’চোখ মেলে আছি। যা কিছু চোখে
পড়ছে সবই তো উদ্ভট আর কানফাটা বিস্ফোরকের শব্দ।
রক্তের ফোয়ারা, ছিন্ন-ভিন্ন মানুষের পিন্ড। বিশ্বাস করো,
আমি তো জেগেই আছি। স্বপ্নের ঘুন আমি আমার লাল
কলজে থেকে নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে দূরে ফেলে দিয়েছি। আমাকে
এই জাগ্রত পীড়ন থেকে আবার নিদ্রাচ্ছন্ন করে দেয়ার কোনো
ঘুমের বড়ি কি কেউ বাজারে ছাড়তে পারেন না? কিংবা
কোনো রুপোর মাদুলি, যা গলায় ঝুলিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকবো?
সোনালী কাবিন / আল মাহমুদ
এক.
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।
দুই.
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তার চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।
এ কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ,
মনে হয় ডাক দিলে সে-তিমিরে ঝাঁপ দিতে পারি
আচঁল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।
বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন ?
শরমিন্দা হলে তুমি ক্ষান্তিহীন সজল চুম্বনে
মুছে দেবো আদ্যক্ষর রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালী কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।
তিন.
ঘুরিয়ে গলার বাঁক ওঠো বুনো হংসিনী আমার
পালক উদাম করে দাও উষ্ণ অঙ্গের আরাম,
নিসর্গ নমিত করে যায় দিন, পুলকের দ্বার
মুক্ত করে দেবে এই শব্দবিদ কোবিদের নাম।
কক্কর শব্দের শর আরণ্যক আত্মার আদেশ
আঠারোটি ডাক দেয় কান পেতে শোনো অষ্টাদশী,
আঙুলে লুলিত করো বন্ধবেণী, সাপিনী বিশেষ
সুনীল চাদরে এসো দুই তৃষ্ণা নগ্ন হয়ে বসি।
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দু’টি জলের আওয়াজে-
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়,
চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ
উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,
ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ
দ্রুত ডুবে যাই এসো ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়।
চার.
এ-তীর্থে আসবে যদি ধীরে অতি পা ফেলো সুন্দরী,
মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
ছিন্ন তালপত্র ধরে এসো সেই গ্রন্থ পাঠ করি
কত অশ্রু লেগে আছে এই জীর্ণ তালের পাতায়।
কবির কামনা হয়ে আসবে কি, হে বন্য বালিকা
অভাবে অজগর জেনো তবে আমার টোটেম,
সতেজ খুনের মতো এঁকে দেবো হিঙ্গুলের টিকা
তোমার কপালে লাল, আর দীন-দরিদ্রের প্রেম।
সে-কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ
করে এই ঘরে তুলি ? আমার তো কপিলে বিশ্বাস,
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ ?
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস।
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।
পাঁচ.
আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল ?
গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রলোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে ?
প্রকৃতির ছদ্মবেশ যে-মন্ত্রেই খুলে দেন খনা
একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে।
নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, আশৈশব শিখেছি এ-পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল,
চিরস্থায়ী লোকালয় কোনো যুগে হয়নি তো গড়া
পারেনি ঈজিপ্ট, গ্রীস, সেরাসিন শিল্পির আঙুল।
কালের রেঁদার টানে সর্বশিল্প করে থর থর
কষ্টকর তার চেয়ে নয় মেয়ে কবির অধর।
ছয়.
মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,
কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক
শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের ‘পরে।
পূর্ব পুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল – রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।
এর চেয়ে ভলো নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল ?
আরশি নগরে খোঁজা বাস করে পড়শী যে জন
আমার মাথায় আজ চূড়ো করে বেঁধে দাও চুল
তুমি হও একতারা, আমি এক তরুণ লালন,
অবাঞ্ছিত ভক্তিরসে এ যাবৎ করেছি যে ভুল
সব শুদ্ধ করে নিয়ে তুলি নব্য কথার কূজন।
সাত.
হারিয়ে কানের সোনা এ-বিপাকে কাঁদো কি কাতরা ?
বাইরে দারুণ ঝড়ে নুয়ে পড়ে আনাজের ডাল,
তস্করের হাত থেকে জেয়র কি পাওয়া যায় ত্বরা-
সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল !
পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।
ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার কাজ ?
ভেঙো না হাতের চুড়ি, ভরে দেবো কানের ছেঁদুর
এখনো আমার ঘরে পাওয়া যাবে চন্দনের শলা,
ধ্রুপদের আলাপনে অকস্মাৎ ধরেছি খেউড়
ক্ষমা করো হে অবলা, ক্ষিপ্ত এই কোকিলের গলা।
তোমার দুধের বাটি খেয়ে যাবে সোনার মেকুর
না দেখার ভান করে কতকাল দেখবে, চঞ্চলা ?
আট.
অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো দেখবো কি নতুন সকাল ?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার,
প্রবল বাহুতে বেঁধে এ-গতর ধরো, সতী ধরো,
তোমার ভাসানে শোবে দেবদ্রোহী ভাটির কুমার।
কুটিল কালের বিষে প্রাণ যদি শেষ হয়ে আসে,
কুন্তল এলিয়ে কন্যা শুরু করো রোদন পরম।
মৃত্যুর পিঞ্জর ভেঙে প্রাণপাখি ফিরুক তরাসে
জীবনের স্পর্ধা দেখে নত হোক প্রাণাহরী যম্,
বসন বিদায় করে নেচে ওঠো মরণের পাশে
নিটোল তোমার মুদ্রা পাল্টে দিক বাঁচার নিয়ম।
নয়.
যে বংশের ধারা বেয়ে শ্যাম শোভা ধরেছো, মনিনী
একদা তারাই জেনো গড়েছিলো পুণ্ড্রের নগর
মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জনিনি
কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।
আমারও আবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টীকেরা পুরীর গৌরব,
রাক্ষসী গুল্মের ঢেউ সবকিছু গ্রাস করে এসে
ঝিঁঝির চিৎকারে বাজে অমিতাভ গৌতমের স্তব।
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন
করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর,
তাদের ঘরের ভিতে ধরেছে কি কৌটিল্যের ঘুণ ?
ললিত সাম্যের ধ্বনি ব্যর্থ হয়ে যায় বার বার :
বর্গীরা লুটছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড়ো হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।
দশ.
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ,
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ,
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ।
এগার.
আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ,
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ণ বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ ?
কী করে মানবো বলো, শ্রীজ্ঞানের জন্মভুমি এই
শীলভদ্র নিয়েছিলো নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস,
অতীতকে বাদ দিলে আজ তার কোনো কিছু নেই
বিদ্যালয়ে কেশে ওঠে গুটিকয় সিনানথ্রোপাস।
প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উল্লাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো, কোন ঝোপে লুকোবে বিহ্বলা ?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও শরীরে বিরাজে
যখন আড়াল থেকে ছুটে আসে পাথরের ফলা,
আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
বার.
নদীর সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,
হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও
যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার।
অন্ধ আতঙ্কের রাতে ধরো ভদ্রে, আমার এ-হাত
তোমার শরীরে যদি থেকে থাকে শস্যের সুবাস,
খোরাকির শত্রু আনে যত হিংস্র লোভের আঘাত
আমরা ফিরাবো সেই খাদ্যলোভী রাহুর তরাস।
নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ
যেমন প্রতিষ্ঠা করে বাজখাই অধিকার তার,
তোমার মস্তকে তেমনি তুলে আছি ন্যায়ের নিশান
দয়া ও দাবিতে দৃঢ় দীপ্তবর্ণ পতাকা আমার ;
ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান
ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমি কার ?
তের.
লোবানের গন্ধে লাল চোখ দুটি খোলো রূপবতী
আমার নিঃশ্বাসে কাঁপে নক্শাকাটা বস্ত্রের দুকূল ?
শরমে আনত কবে হয়েছিল বনে কপোতী ?
যেন বা কাঁপছো আজ ঝড়ে পাওয়া বেতসের মূল ?
বাতাসে ভেঙেছে খোঁপা, মুখ তোলো হে দেখনহাসি
তোমার টিক্লি হয়ে হৃদপিণ্ড নড়ে দুরু দুরু
মঙ্গলকুলোয় ধান্য ধরে আছে সারা গ্রামবাসী
উঠোনে বিন্নীর খই, বিছানায় আতর, অগুরু।
শুভ এই ধানদূর্বা শিরোধার্য করে মহিয়সী
আবরু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক
বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।
চৌদ্দ.
বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,
এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লান
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।
No comments:
Post a Comment