Thursday, December 31, 2020

হুমায়ূন আজাদ

 

আমাকে ভালোবাসার পর 
– হুমায়ুন আজাদ
 
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।
যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।
আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।
না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।
তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।
শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

 

আমাকে ছেড়ে যাবার পর 
– হুমায়ূন আজাদ
 
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল, তা নয়।
তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর।
কারো কষ্টের কথা এখানে চাপা থাকে না।
শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে তোমার।
পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম
সৃষ্টি করেছিলাম।
যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম।
তুমি কি জানো না গাধারা কখনো অগ্নিগিরিতে চড়ে না?
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যুৎ আছে,
তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যুতে দপ ক’রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যুৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলে
সে নাকি ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না।
আমি জানি তোমার কতোটা দরকার শারীরিক তাপ।
গাধারা জানে না।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু’টি ভয়ংকর ত্রিভুজ।
সে- খবর পায় নি গাধাটা।
গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।
তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক।
তুমি যেখানে নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না।
গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!
তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে?
ভেবেছিলে গাড়ি, আর পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে,
আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?
শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্তু কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।
 
 
 
 
 
আমাদের মা
হুমায়ুন আজাদ
 
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।
 
 
 
 
 আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে 
– হুমায়ুন আজাদ
 
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
আমার খাদ্যে ছিলো অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিলো অন্যদের জীবাণু,
আমার নিশ্বাসে ছিলো অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম, আমি বেড়ে উঠেছিলাম,
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মত দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মত চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুঁজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মত বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি হাঁটতে চেয়েছিলাম নিজস্ব ভঙ্গিতে,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারণ করতে চেয়েছিলাম আমার আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মোলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ কখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয় নি।
আমি ভুল মেঘে ভেসে বেরিয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আমার আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলাপড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মত ময়লাধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম.
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মত মাথা নিচু ক’রে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে ভাবতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবতো গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলঙ্কার।
আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম।
এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোন অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মত চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বিশাল বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্যে পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্যে নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে, তাকে জড়িয়ে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জড়িয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে-পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে-পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচেছিলাম
অন্যদের সময়ে।

 
 
 
ভালো থেকো
- হুমায়ুন আজাদ---

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।

ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
 
 
 
 
 
 
ফুলেরা জানতো যদি
- হুমায়ুন আজাদ--

মুলঃ হেনরিক হাইনে

ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়
ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,
অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি ।

নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি
আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,
তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে
আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর ।

সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ,
তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে
জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ ।

তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা-
একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো;
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে
ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত ।
 
 
 
 
 
 
তোমার দিকে আসছি
- হুমায়ুন আজাদ---

অজস্র জন্ম ধরে
আমি তোমার দিকে আসছি
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।
তোমার দিকে আসতে আসতে
আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়
পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত।

আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো
শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,
এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার দুঃখ,
তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে
আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।

আরেক জন্মে
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম তোমার উদ্দেশ্য।
পথে বেরিয়েই আমি পলি মাটির উপর আকাঁ দেখি
তোমার পায়ের দাগ
তার প্রতিটি রেখা
আমাকে পাগল করে তোলে।
ঐ আলতার দাগ,আমার চোখ,আর বুক আর স্বপ্নকে
এতো লাল করে তুলে,
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ন ভুলে যাই
ঐ রঙ্গীন পায়ের দাগ প্রদক্ষীন করতে করতে
আমার ঐ জন্মটা কেটে যায়।
আমার দুঃখ !
মাত্র একটি জন্ম
আমি পেয়েছিলাম
সুন্দর কে প্রদক্ষীন করার।
আরেক জন্মে
তোমার কথা ভাবতেই-
আমার বুকের ভিতর থেকে সবচে দীর্ঘ
আর কোমল,আর ঠাণ্ডা নদীর মত
কি যেন প্রবাহিত হতে শুরু করে।
সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে
আমি একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে
কাটিয়ে দেই সম্পুর্ন জন্মটা।
আমার দুঃখ ,আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিল
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ
আমার ষোঁড়শ জন্মে
একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে,
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি-
উঁচুতে ! উঁচুতে !! আরো উঁচুতে !!!
আর এক সময় ঝড়ে যাই চৈত্রের বাতাসে।

আমার দু:খ মাত্র একটি জন্ম
আমি গোলাপের পাপঁড়ি হয়ে
তোমার উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পরতে পেরেছিলাম।

এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে
টলমল করছে একটি অশ্রু বিন্দু।

ঐ অশ্রু বিন্দু পেরিয়ে এ জন্মে হয়তো
আমি তোমার কাছে পৌঁছুতে পারবনা;
তাহলে ,আগামী জন্ম গুলো আমি কার দিকে আসবো ?
 
 
 
 
 
 
 
 
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...