Saturday, December 12, 2020

ফুয়াদ স্বনমের কবিতা

 

'আমি, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলছি
 
আমার বেশ মনে আছে,
বাবা খুব ভোরে বেড়ুতেন আর ফিরতেন
সবার ঘুমাবার পর।
নাহ প্রতিদিনই নয়,
এই ধরুন, মাসের দশ থেকে একুশ-বাইশ
তারিখ অবধি।
বাড়িওয়ালার সামনে পড়াটা এড়াতেই
এই ভোর পাঁচটা-বারোটা অফিস।
বাবা বেশ রাগী ছিলেন,
আমরা বাবাকে ভয়ে কিছু প্রশ্ন করতে
পারতাম না। পারলে,
নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতাম, "বাবা, তুমি রোজ অফিসের আগে, 
ছুটির পরে সংসদ ভবনের
পাম ট্রিগুলোর নীচে অন্ধকারে স্যাঁতস্যাঁতে
রাস্তায় বসে মাথা হেঁট করে কি ভাবো?
কে তোমায় সকালের নাস্তা বানিয়ে দেয় বাবা?
কোনো কোনো দিন লাঞ্চ কি করো কখনো?"
বাড়ি ভাড়া দেবার তারিখ উত্তীর্ণ হলেই,
আমরা দু'ভাই গিয়ে দাঁড়াতাম বাড়িওয়ালার সামনে করুণ মুখ করে,
উনি গলে যেতেন। এই হঠাৎ করুণ মুখ করার ব্যাপারটা 
আমরা বেশ ভালোই রপ্ত করে ফেলেছিলাম সে বয়সেই।
মটর বাইক পাশ কেটে বের হলেই,
আমি হাঁ করে চেয়ে থাকতাম।
একদিন বাবা বলেছিলেন, "শুনো আব্বা, 
নিম্ন মধ্যবিত্তদের স্বপ্ন দেখবারও একটা
লিমিট থাকে রে বোকা।"
জবাবে বাবা কে সেদিন চমকে দিয়ে বলেছিলাম, "বাবা, 
জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলির অপূরণের আক্ষেপ থেকে 
জন্ম নেয়া সুপ্ত বাসনাগুলি যদি হঠাৎই ঘুম ভেঙে লাফ দিয়ে 
জেগে উঠে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে চায়? সেও কি নিম্নমধ্যবিত্ত
 হিসেবে অন্যায়ের সামিল হবে?
নাকি সে বিত্তশালী হয়ে উঠবার ধৃষ্টতা?"
বলেই ভাবলাম, কি যে সব ভুলভাল বকে ফেললাম বাবার সামনে?
বেশী বলে ফেললাম না তো?
আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে,
শিক্ষা, সততা আর আদর্শই যাদের
একমাত্র সম্বল,
তাদের অন্তত বাবার মুখের ওপর এমন বাগ্মিতা মানায় না।
গলির মুখে তিন রাস্তার মোড়ে কার্তিক বাবুর মুদির দোকান।
তোমাকে ভয়ে কোনদিন বলিনি বাবা,
ভীষণ হাস্যোজ্জ্বল লোকটির মুখ, আষাঢ়ের আকাশের মতো 
গোমড়া হয়ে যেতো আমাদের বাকির স্লিপ ধরা হাতগুলো দেখলে।
একটা লজেন্সও কোনদিনও চাইতে পারিনি বাকির খাতার কারণে।
বাকিতে মৌলিক চাহিদা মেটাতে মেটাতে
শৈশব যে কোথায় ছুটে পালিয়েছিল,
তা টের পেতে পেতে, তখন আমিও এক বাবা।
চালের, ময়দার ঠোঙাগুলোকে কেটে কেটে সেলাই করে খাতা বানাতাম,
বছর শেষে আবার তাদের বিক্রি করে
নতুন ক্লাসের সেকেন্ডহ্যান্ড বই কেনা।
নতুন বই কেনার কথা তো কস্মিনকালেও
ভাবতে পারিনি।
আমীষ বিহীন পেঁপে ভাজি, আলুর ঝোল,
বেগুন ভর্তা খেয়ে খেয়ে কতো
দিন-রাত পার করেছি,
অন্য কিছুর চড়া আঁচে আমাদের
বাজারের ব্যাগ জ্বলে যেত সেসময়।
অন্য কিছুর সামর্থ্য ছিলো না বলে।
ঈদে পরবে কদাচিৎ জুটেছে দুপেয়ে
ফার্মের মুরগী।
আমাদের পিঠাপিঠি দু-ভাইয়ের জন্য
একটিই শখের জিন্স প্যান্ট কিনতে পেরেছিলাম
তিনশত টাকা খরচা করে।
তাও, একমাসের একটি টিউশুনির বেতন দিয়ে।
মা সেটা আলমারিতে তুলে তুলে রাখতেন।
যদি কোথাও দাওয়াত পড়ত,
আমরা ভাগ করে নিতাম কে গায়ে হলুদে যাবে সেটা পড়ে?
আর বরযাত্রী কে হবে?
এমন কোনো অনুষ্ঠান ছিলো না যে,
আমরা দু'ভাই একসাথে এ্যাটেন্ড করেছি।
উপহার কেনার সামর্থ্য কোনদিনই আমাদের ছিলো না।
তাই, আমরা শুধু বরযাত্রী বা গায়ে হলুদেই যেতাম।
আমি একজন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
যাদের, কোনো চাহিদা থাকতে নেই।
আমাদের মা তবু খুব সুখী ছিলেন,
কারণ ক্ষুধা লাগলে, আমরা ভাতের মাড় লবণ ছিটিয়ে খেতে পারতাম।
তখনও, মাছের কাঁটা বেছে খেতে শিখিনি।
মা-ও সেকথা জানতেন, দুষতেন দারিদ্রতা কে।
আমি দিব্যি পটলের তরকারি দিয়ে আয়েশ করে 
খেয়ে ওঠার ভান করাটা শিখে নিয়েছিলাম।
স্কুলের টিফিনের জন্য জেদ করেছি কিনা
ঢের সন্দেহ আছে!
স্কুলের মাইনে দেবার সাত তারিখ পার হলেই
ঝন্টু স্যার দাঁড় করিয়ে রাখতেন
এক পিরিয়ড প্রতিদিন,
জানলে বাবা যদি কষ্ট পায়!
তাই বলা হয়নি সেকথা কোনদিনই।
প্রায়ই হাঁটু ছিলে দগদগে ক্ষত নিয়ে ফিরতাম ফুটবল খেলে।
গভীর রাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লে,
বাবা এসে কেরোসিন লাগিয়ে দিতেন আন্টিসেপটিক হিসেবে।
ঝরঝর করে পানি পড়তো তখন তার চোখ বেয়ে।
কেন বাবা! কেন ফেলতে?
আমার হাঁটুর ক্ষত, এই যে রক্তাক্ত চামড়া ছেঁড়া, 
 কেন যে তার চোখের পুকুরটাকে আন্দোলিত করে যেত,
 সে সময় বুঝতে পারিনি।
অন্যদের দেয়া সেকেন্ড হ্যান্ড জামাতেই নিজেদের মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম।
তবে, আমাদের মাঝে ছিলো পদ্ম পুকুরের মতো ভীষণ লজ্জা।
কলেজে, ক্যাম্পাসে বা আত্মীয় স্বজনদের কাছে 
আমাদের অবস্থান ছিলো সুদৃঢ় ও মর্যদা সম্পন্ন।
বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিলো না আমাদের ভেতরের দৈন্য দশা।
কারণ, শিশুবেলা থেকেই আমাদের দুটো
শিক্ষা দেয়া হয়-
এক, আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
আর দুই, আমরা সম্ভ্রান্ত পরিবারকে ধারণ করি।
আমাদের বুক, পেট, তল পেট, উদর, বৃহদান্ত্র, 
ক্ষুদ্রান্ত্র সব ক্ষুধার তাড়নায় ফেটে
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও,
আমাদের মুখে সবসময় চাঁদের হাসি
লেপ্টে থাকবে।
আমাদের মুখে সবসময়ই চাঁদের হাসি লেপ্টে থাকতো।। 
 
 
 
 
 
'ছেলে হলে, কাঁদতে নেই'
 
মা যেদিন মারা গেলো,
তোরা সবাই কান্নায় গড়াগড়ি খেলি,
দূরদুরান্ত থেকে আত্মীয়পরিজন ছুটে এলেন, 
কয়েকজনের সাথে তো সেদিনই প্রথম পরিচয়।
তোদের বুকফাটা কান্নার রোলে ভারী
হয়ে উঠলো বাতাস।
বিশ্বাস কর, সেদিনও কাঁদতে পারিনি এতোটুকু।
ভাই হয়ে তোদের মায়ের মমতার আশ্বাস দিতে
গিয়ে ভিজিয়েছি জামার আস্তিন আর বুক।
তোরা যখন কাঁদছিলি আমি তখন মাইকিং এর ছেলেপুলে, 
কবর খোঁড়ার স্পেশাল দলের
চা-নাস্তার টাকার জোগান, সাদা টেট্রনের কাপড়, চাটাই, বাঁশ, 
 কীলক, কর্পূর, আতর কেনা,
হুজুর ঠিক করা, সকলের সুবিধেমত জানাজার
সময় নির্ধারণ নিয়ে ব্যস্ত।
সর্বশেষে শেয়াল তাড়াতে খেজুর কাঁটা বিছিয়ে
দেবার পরে খেয়াল করলাম জীবনে আরো
একবার কাঁদতে পারলাম না রে।
বাবা স্বল্প মাইনের নিম্ন কর্মচারী ছিলেন।
নামডাক তেমন ছিলো না বললেই চলে।
চার চারটে ফার্স্ট ক্লাশ নিয়েও যখন
দ্বারেদ্বারে ভিক্ষে করে বেড়িয়েছি এক খানা
চলার মতো বেতনের চাকুরির জন্য, 
পড়শিদের টিপ্পনীর লাঞ্ছনা গঞ্জ্যনা শুনে যখন মরে
যাওয়াও শ্রেয় মনে হতো,
ভেতর ভেতর দুমড়েছিলাম ঠিকই
তবু সেদিনও কারো সম্মুখে ফেলতে পারিনি
এক ফোঁটাও চখের জল।
ক্লাশ এইটের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট ছিলো সেদিন।
গার্ডিয়ানদের ভীড়। কেউবা রেজাল্ট কার্ড হাতে উৎফুল্ল কেউবা মন মরা।
অথচ এই আমি ফার্স্ট হয়েও হেডমিস্ট্রেসের
রুমে বসে আগামী মাসের পূর্বেই সমস্ত
টিউশন ফিস জমা দিয়ে রেজাল্ট কার্ড হাতে নেবার অঙ্গীকারনামা লিখতে ব্যস্ত।
চোখ ফেটে অবিরল ধারায় জলরাশি বের হয়ে
আসতে চাইলেও, পেরেছি কই কাঁদতে?
মুদির দোকানে গেলেই পাড়াত অন্যসব খদ্দেরদের 
সামনেই গেলো মাসের বাকির টাকা চেয়ে
খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠতো বিহারী ঝুনঝুনি মামা। লজ্জায়,
 ক্রোধে ঝর্ণার মতো দুচোখ বেয়ে নেমে আসতে চাইতো পানি।
কিন্তু নিজেকে আশ্চর্য করে দিয়ে কিভাবে যেন
ঠেকিয়ে রাখতে শিখে গিয়েছিলাম সেই বয়সেই।
ছেলেবেলা থেকেই ছোটকাকু ছাড়া কিসসু বুঝিনি। 
স্কুলের ভর্তি থেকে শুরু করে নিয়ে যাওয়া
আসাটা পর্যন্ত তার কাঁধেচাপানো ছিলো।
আমাদের যতো ছোট ছোট আবদার তার
কাছেই জমা পড়তো।
সেই প্রাণের কাকুটাকে বিয়ের পর
কাকী যখন আলাদা করে নিলেন, ভাড়া বাসাতে
 শিফটের দিনে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
থাকতে পেরেছিলাম তার চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে।
অশ্রু কি জিনিস ছেলেরা তা জানেনা।
বহুবছরের প্রেমিকা চন্দ্রা হাতে পুরোনো সকল
উপহাস আর আমার দেয়া উপহারগুলি তুলে
দিয়ে বাবামায়ের দোহাই আর ভালোবাসার
কসম দিয়ে চলে গেলো স্টাবলিশ আরেক
ছেলের হাত ধরে।
বিয়ের কার্ড হাতে নিলেও যাওয়া হয়নি শেষাবধি।
কি এক দুঃখ ঘোড়ে কেটেছে কয়েকটা বছর,
আমাকে বোঝার মতো সেই একজনই ছিলো।
তবু মুখ থেকে হাসির সাইনবোর্ডটা নামিয়ে
নেইনি একমুহুর্তের জন্যেও।
মা চলে যাবার কদিন বাদেই শোকে সঙ্গীহারা বাবা স্ট্রোক করলেন। 
 বাবা এখন পঙ্গুত্বের হাত ধরে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু পথে এগুচ্ছেন।
 তার অনেক শখের হজ্জ অপূর্ণই রয়ে গেলো। 
 তবুও আমার মতই তার চোখের সীমানা পেরিয়ে দেখিনি 
এক ফোঁটা জল বাইরের উঠোনে বেড়িয়েছে।
এখন আমি আমার দশ বছর বয়সী ছেলেকে শেখাচ্ছি-
"আরে বাবা! তুমি না ছেলেমানুষ!
ছিঃ ছিঃ ছিঃ বাবা, ছেলেদের কাঁদতে আছে!
পাথুরে ঠুকে ভেঙে যাওয়া বুক কাউকে
কি দেখাতে আছে! ছেলে হলে উদার হতে হয়, 
বিপদেআপদে পরিবাবারের সবার ভরসা হতে হয়। 
ছেলেদের মন পাখির পালকের মতো নরম হলে চলে!
 কান্না ছেলেদের জন্য নয় রে বাবা।
তুমি শুধুই একবার চিৎকার করে কাঁদতে পারবে,
তাও হাসপাতালের লেবার রুমে জন্মের পরপরই।।"
 
 
 
'আমাদের অদেখা কতোদিন?
 
কতোদিন দেখা হয়নি বল, কতো কতোদিন?
এভাবে না দেখা হওয়াতে বেশ মিলিয়ে
গেছিস মন থেকে।
আমিও হয়তবা মুছে গেছি তোর মন থেকে।
আসলে, সব কিছু আর কই মনে রাখতে চাই
আমরা নিজে?
ফেলে আসা দিন মনে করে শুধু
যাতনারই চাষাবাদ করা হবে, এই ভেবে ভেবে
মেরে ফেলেছি ওদের।
বেদিতে ফুলের তোড়া দেবার উৎসাহর কমতি নেই কারো।
ফুলের ব্যবহার ততটুকুই। কেউ জানেনা,
খোঁজ নেয়না, ছাপেনি কোনদিনই দেবতাকে
নিবেদিত ফুলের ডাস্টবিনে এককোণে
ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর গল্প।
ফুলের প্রসঙ্গ আজ থাক।
কতোদিন দেখা হয়নি বল তো?
কতোদিন ধমকে ওঠা হয়নি তোর
আনমনে দাঁত দিয়ে নখ কাটা নিয়ে?
খয়েরি লিপস্টিকে খুব রুড লাগে তোকে,
এমন কথা আর কেউ কী এখন বলে?
এ শহরে চায়ের টেবিল, রেস্তোরা, ফাংশন,
বিয়ের শানাই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে যানজট,
নবজাতকের কান্নার আওয়াজ,
মসজিদের আযান, মেঘেদের গর্জন
সব তেমনিই আছে, রোজকার বিষয়।
শুধু তোর সাথে দেখা হয়নি আর কোনদিন।
মানুষ রাগলে কী এতটাই রুক্ষ হয়ে পড়ে যে
মাটির গহীনের শেকড় বাকড় সমেত
উপড়ে নিয়ে যেতে পারে?
যেবার পানি খেতে খেতে হাসতে গিয়ে বিষম খেলি,
দম আটকে কী এক কান্ড ঘটালি!
ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম আমি।
তারপর থেকে খাবার সময়টাতে তোর চোখের
দিকে সরাসরি তাকায়নি কোনদিন।
এ যাবত কোন বন্ধুর কাছেও শুনিনি
খোঁজ নিয়েছিস আমার কোনদিন।
কেউ কথা পাড়লেও ব্যক্তিগত ব্যাপার
বলে এড়িয়ে গিয়েছিস তাদের।
কিন্তু কী আশ্চর্য! আমাকে ব্যক্তিগত কথাটা
ছাড় দেয়নি এতটুকু।
তবে, আমিও তোর মতোই বেশ আছি সুখে।
মনে পড়লেই মন কে বোঝাই, মন শোন,
যে ছিলো মিলিয়ে গেছে অতলে গহীনে
গহীনে ততোটা গহীনে যেখান থেকে
কারোর ফিরবার উপায় জানা নেই,
শেখা নেই। ততোটাই গহীনে।।
 
 
 
 
'আধুনিকতায় অবকাঠামো
 
এই যে আঁকা বাঁকা মেঠো পথ,
পাকা ধানি জমি আর কাঁচা আইল,
পথের ধারের থোকায় থোকায় কাশ ফুল,
নির্মল বায়ুর শিস কেটে যাওয়া,
মোরেগের ডাকে ভোরের ঘুম ভাঙা,
দেয়ালে দেয়ালে মখমলি সবুজাভ শ্যাওলা।
বিছাতুর পাতার নীচে শামুকের খেলা,
পুকুর ভর্তি কই আর লাইলনটিকার দাপাদাপি,
দুপুরে ধার ঘেঁষে কঞ্চি আর ছিপের লাইন,
বড়নানীর গলা খেঁকড়ানি আর খিস্তী।
সাঁঝের ঘরে উলুধ্বনি,
শেষ হতেই আযান আসে ভেসে,
সন্ধ্যের আগেই কিশোর দলের ঘরে ফেরা,
'আমাদের গ্রামটি' রচনা মুখস্থের গুণগুণানি,
টিমটিমে আলোয় পাড়াত কাকাবাবুদের
চায়ের স্টলের আড্ডা,
বউদি, কাকীমাদের পাড়া বেড়ানি আর হৈচৈ,
বাড়ির উঠানে বেলের গাছ, সদ্য স্নান সেরে ওঠা পড়শিদের বেল পাতা সংগ্রহ,
বর্ষীয়ান তাল গাছে জ্বিনের ভয়,
যেন আমাদের কেউ না নীচে যায়।
শৈশবটা জাহাজি হুইসেল দিচ্ছে
পেয়ারা গাছের ডালে, এখনো ক্যাপ্টেন হতে বলে।
রাতে গা ছমছমে ভুতুড়ে কলাগাছ
তার পাতার ছায়ায় তৈরী নানারকম আকার,
দলবেধে যেতাম শৌচাগার।
ভোরের আগেই আসতো জমাদার,
কাঠের দরজার কড়া নাড়া ঠক ঠক শব্দ।
তারপর, ছুটে যেতাম মেইন রোডে,
দেখতে মালগাড়ির হলদে পরিশ্রম।
ফজলা পাগলাকে সামনে পেলেই ক্ষ্যাপানো,
পাড়াত সুবোধ ছেলেটি কে বাবুভোঁদাই বলে টিজ,
চন্ডি কাকুদের পূজোর নারকেল নাড়ু,
কলাপাতায় হিঙের ল্যাবড়া আর দই, লুচি।
বাদাম আর ঘি দিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই খেতে
কাকুরাও হাজির হতেন ঈদের সকালে।
লজ্জা ছিলো, ভীষণ বেপরোয়া রকমের।
প্রচন্ড ইচ্ছে ছিলো, অভিকর্ষ শক্তির মতই টান ছিলো, 
তবু সরাসরি চোখের দিকে তাকাতে পারিনি কোনদিন পাড়াত মেয়েদের আমরা কেউ।
খুব ঈর্ষে হতো, যদি সামনে কেউ অন্য কাউকে ভালো মানুষ আখ্যা দিতো।
আমায়, আমাদের ধোকা দিয়েছে সময়,
আমার চুরি যাওয়া বয়স,
আমাদের বন্ধুভাবাপন্ন বিজ্ঞান।
মফস্বলের উপরে চেপেছে আধুনিকতা।
তথাকথিত আধুনিকতায় ধর্ষিত হয়েছে
মফস্বল শহর।
ঝলমলে নিয়ন আর এল ই ডির আলোয়
ছিনিয়েছে মফস্বলের রাতের নিস্তব্ধতা,
গা ছমছমে ভাব,
ধর্মের ঠিকাদারেরা তুলেছে ভেদাভেদের
সুউচ্চ পাথুরে দেয়াল।
সেই রাত জমানো আড্ডা নেই,
যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্তত্রস্ত,
বিপদগুলিও এখন সবার একার, তেমনই সফলতাগুলিও।
কর্মগুণে নয় বরঞ্চ প্রতিশ্রুতির লিস্টি দেখে
নেতা নির্বাচিত হয় এখন।
একেকটা মন এখন একেকটা সমাজ,
সমাজের ভেতর আর মন কই?
তা হ্যাঁ গো বিজ্ঞান? সত্যিই কী সমগ্র দুনিয়া
এখন আমাদের হাতের মুঠোয়?
নাকি, একটা একাকিনী, মানবত্বহীন,
অসাড় মনের জীবন্ত লাশের হাতের মুঠোয়?
এখন কেবল, স্বপ্নেই সেই হারানো মফস্বলের
ছবি আঁকি, ছবি আঁকি।।


'ছেঁড়া এ্যাঙ্কলেট'
 
তখন বছরে প্রায় ছয়টি মাস বৃষ্টি বাদল
লেগেই থাকতো।
মফস্বল শরেরর বুকজুড়ে বৃষ্টি, অদ্ভুত তার প্রকৃতি।
গাছের পাতা হতে গড়িয়ে পড়া নান্দনিক বৃষ্টি, অদ্ভুত তার প্রকৃতি।
টিনের চালায় ঝুমুরঝুমুর তালের বৃষ্টি,
স্কুলের বই, নিউজপ্রিন্টের খাতা,
খাঁকি প্যান্ট, সাদা জামা ভেজানো বৃষ্টি
অদ্ভুত সে প্রকৃতি।
মাঠের ঘন ঘাসের ডগা অবধি ডোবানো বৃষ্টি, 
তাতে পা ডোবানো বৃষ্টি, অদ্ভুত তার প্রকৃতি।
বৃষ্টির হলকম্পে একটু ঠাণ্ডা লাগতেই
পুকুরে ডুব দিয়ে গরম জলের উচ্ছ্বাস,
অদ্ভুত সে প্রকৃতি।
প্রবল সে বৃষ্টির ঘর্ষণজনিত কারণে
বেরিয়ে পড়তো ইট বিছানো পথের হাড়গোড়।
সেসব বৃষ্টির রাতে আর ঘুম আসতো কই?
সারারাত জেগে ভোরের আলোর প্রতীক্ষা।
রাত পেরুতেই, সাইকেলের প্যাডেল মেরে
পৌঁছে যাওয়া বন্ধুদের বাসায়, পা টিপেটিপে নীচুস্বরে ঘুম ভাঙানো,
বলছি, মনোজ আমার প্রিয় বন্ধুটির কথা।
লেখাপড়ায় কিছুটা দূর্বল হলেও, ফুটবলে তার ভীষণ ঝোঁক।
জাদু ছিলো ওর পায়ে।
একবার কোনমতে ঠেলে ঠুলে তার পা পর্যন্ত
বল পৌঁছে দিতে পারলেই কেল্লাফতে।
ও'বলের একটাই আস্তানা, অপজিশনের গোল পোস্টের জাল।
মিকাশা ছিলো তার প্রিয় বল।
বলের জন্য চোদ্দ মুল্লুক দূর হেটে গিয়েও
এক্লাব ওক্লাব থেকে বল চেয়ে নিয়ে ফিরত।
আকাশে মেঘেরডাক দিলেই তার প্রাণ নেচে উঠত।
ফুটবল ছিলো তার জীবন।
আমাদের যখন সেলফ ভর্তি থাকত গাদা গাদা
বই আর নোট পত্রে,
তার ঘরময় এদিক ওদিকে পড়ে থাকত
অসংখ্য ক্রেস্ট, মেডেল, 'এ' ডিভিশন, 
জেলা পর্যায়ের ম্যান অব দি ম্যাচ হবার বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন।
টেবিলের উপর পেপার কাটিং এর মেলার এ্যালবাম।
ন্যাশনাল টীমের ডাকের আশায় থাকতো সে।
ক্যাপ্টেনের লাল ব্যাচ পড়তে চেয়েছিল সে হাতে।
সত্যি বলতে, মাঝে মধ্যে বেশ ঈর্ষা হতো ওর জনপ্রিয়তাকে।
ওর প্রতি উঠতি বয়সী মেয়েদের আকৃষ্ট হওয়াকে খুব হিংসে করতাম। 
পাশ কাটিয়ে যেতে পারিনি সেটাকে।
আমরা যখন চা-সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে রিং বানাবার 
কায়দা রপ্ততে উঠেপড়ে লেগেছি,
মনোজ তখন লক্ষী ছেলেটির মতো চায়ের স্টলে
দুধের মিকচার খায় রোজ সকাল বিকেল।
তারপর একদিন এলো সেই দিনটি, রাজধানী শহরের 
সাথে আমাদের জেলা স্টেডিয়ামে খেলা। 
সাপোর্টারস গ্যালারিতে বসে গোল পাবার উন্মাদনায়
 সমানে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি আমরা ক'জনা।
ছুটছে মনোজ প্রাণপণে, পায়ে বল। হাতে মাত্র দেড়
 মিনিট বাকি শেষ হুইসেলের। সামনে ফাইনালের হাতছানি।
ছুটছে মনোজ, ছুটছে উল্কা,
ছুটছে মেট্রো রাজ। ছুটছে ট্রাম,
ছুটছে সময়। ছুটছে মনোজ পাগলা ঘোড়া।
ছুটছে ডি-বক্স, ছুটছে বিশ গজ গোল পোস্টের,
ছুটছে মফস্বলের পতাকা, ছুটছে ন্যাশনাল টীম। 
ন্যাশনাল টীমের ক্যাপ্টেন খোচিত লাল ব্যাচ।
হঠাৎ অপজিশনের কোচের ইশারা, চারজন ডিফেন্ডারের 
মনোজের হাঁটু তাক করে ঝাঁপিয়ে পরা।
অস্ফুট গোঙরানো মনোজের, ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠা।
যখন মনোজ সম্বিতে ফিরলো, হাসপাতালের বেডে স্যালাইন চলছে। 
উঠে বসতে চাইলো। পারলো না।
দূর্বল তো। আসলে দূর্বল ঠিক না,
একটা পা নেই ওর আজ।
সমস্ত রগগুলি ছিঁড়ে যাওয়ায় ভেতরের পঁচন ধরা রক্ষার্থে 
অগত্যা কেটে ফেলতে হয়েছে থাই অবধি।
থেমে গেছে আজ মনোজ, মনোজের স্বপ্ন।
মনোজের ক্যাপ্টেন ব্যাচ। বল নিয়ে শত্রু এলাকার বক্ষ 
ভেদ করে ঈগলের মতো ছোঁ মেরে গোল তুলে আনা।
 থেমে গেছে বাঁ পায়ের রক্ত চলাচল। 
ওদের স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ পড়েছে।
থেমেছে উঠতি কিশোরী, যুবতীদের মনোজ পাগলামি।
থেমেছে সেই ক্রেজ। একটা জীবন।
সময়ের তালে তালে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। 
অতীতে ডুবেছে ফুটবলের জাদুকর মনোজ।
মনোজের সেই বন্ধ জানালায় আর কোনদিন
কেউ টোকা দেয়নি। মনোজেরও আর কোনদিন মিকচার খাবার প্রয়োজন পড়েনি।
এখনো বৃষ্টি আসে মুষলধারে, এখনো ওরা বৃক্ষের পাতায় গড়িয়ে পড়ে।
মফস্বল শব্দটি আজও বেঁচে আছে।
শুধু ফুটবল এখন আমি দুচোখে দেখতে পারিনা।
একটা ফোভিয়া কাজ করে। মফস্বলের বৃষ্টির কথা মনে করিয়ে দেয়। 
বৃষ্টি শব্দে জেগে থাকা রাতগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়।
মনোজের অসহায়ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ওর কেটে ফেলা হাঁটুর কথা,
ছেঁড়া এঙ্কলেটগুলি হাতে নিয়ে
আকাশকে নাড়া দেওয়া ওর আর্তনাদের কথা
মনে করিয়ে দেয়।
একটা ঝুলে যাওয়া জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আর হ্যাঁ, সেদিন ওর কেটে ফেলা হাঁটুর বদৌলতে
আমাদের প্যানাল্টিতে পাওয়া জয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।।
 
 
 
 
'একজন সতীর্থ- বিমল ঘোষ 
 
বিমল ঘোষ নামে ক্লাসে আমার
একজন সতীর্থ ছিলো।
স্কুল এবং কলেজের বারান্দায় আমাদের একত্রে
পদচারণা ছিলো।
সেই অতি অল্প বয়স থেকেই তার ভীষণ
আত্মমর্যাদাবোধ ছিলো।
আমাদের বাবা-মা'রা যখন আমাদের
সরকারি আমলা কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার
হবার স্বপ্ন চোখে বুনে দিয়েছিলেন
প্রাচীন অশ্বত্থের মতো,
ওর স্বপ্ন ছিলো লিডার হবার,
নেতৃত্বের প্রতি সে বেশ দূর্বল ছিলো।
ওর বাবা-মা ছিলো না।
বুকের দুধ ছাড়ার আগেই মা-বাবা ছেড়ে যায় তাকে।
 নিজেরা সেপারেশন নিয়ে নিজেদের জীবন কে
উপভোগ করতে থাকে।
তাই ও'ঠাকুরমার কাছে মানুষ।
সেদিন বুঝেছিলাম এই নামটির সাথে
সমাজ কেন ঠাকুর শব্দটি জুড়ে দিয়েছে।
তাকে অজানা কারণে দেখতাম ঝাঁপিয়ে পড়তো
পড়শীদের বিপদেআপদে।
পড়ে গিয়ে কেউ হাত-পা কিংবা কোমর ভেঙেছে,
একটা বালিশ আর তোষকে শুইয়ে দিয়ে
দৌড়েছে সে হাতে টানা ভ্যানগাড়ি নিয়ে মহকুমার হাসপাতালে।
 ঝড়ে চাল উড়েছে দরিদ্র চাষা রহীম চাচার,
বন্ধুদের একত্রে করে উঠেপড়ে লেগে গেছে
সেই চাল ঠিক করতে।
মহল্লায় কেউ মারা গেলেও মাইকিং এর জন্য
পড়ত তারই হাঁক।
পাড়াত দিদির বিয়ে, বাজার সদাই আর
বিয়ের মন্ডপ সাজাতে কলা গাছ
কাঁধে ছুটছে সে বিয়েবাড়ির দিকে।
আমাদের মতো তার কাছে জীবনের মানে বইখাতা
আর অর্থ বানাবার প্রতিযোগিতা ছিলো না।
বৃদ্ধা ঠাকুরমা গত হয়ে গেলে পাড়ার দু-চারজনের 
কাছে অনুনয় বিনয় করে হাতপেতে কোনমতে
ডিগ্রির সিঁড়িটা পার করে সে।
খুবই যেন সেকেলে ব্যাকডেটেড চিন্তাচেতনায়
বাঁচত সে।
এই যৎসামান্য ডিগ্রি নিয়েই সে ভাবত কিছু একটা 
ঠিকঠাক চাকরি সে ঠিকিই জোগাড় করে ফেলবে।
 চাকরি পেতে গেলে যে বাবা-মা'র
আত্মীয় পরিজন লাগে,
লাগে কাঁড়িকাঁড়ি পয়সা,
তা সে কোনমতেই মানতে নারাজ।
তাই সে আমাদের মতো সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত
হতে পারেনি।
জুটেনি তার বড় বড় ডিগ্রি, দামী গাড়ি কিংবা
টাইলস ফিটিংস বাড়ি।
এখনো আধাসের চাল জোগাড়ে তাকে কায়িক
পরিশ্রম করে ফিরতে হয়।
বহুকাল পরে দেশে ফিরে তার সাথে দেখা,
হঠাৎই রিক্সা ধরতে গিয়ে।
ভীষণ ইতস্ততবোধ হচ্ছিল তার রিক্সায় চড়তে গিয়ে। 
পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
তারপর কি মনে করে যেন চড়ে বসলাম।
উসকো খুসকো কাঁচা পাকা চুল।
চোখের কালো ফ্রেমের জরাজীর্ণ চশমার
একটা ডান্ঠি খাতা সেলাইয়ের লাল সুতোয় বাঁধা।
গাল ভর্তি খোঁচাখোঁচা ধুসর দাড়ি।
হাতে রিক্সার হ্যান্ডেল।
পায়ে টিনের তার দিয়ে কোনমতে আটকানো স্পঞ্জ।
না থাকাই বলা চলে।
আলাপচারিতা হলো। হলো কুশল বিনিময়।
বললো সে, মহাসুখেই আছে।
মহল্লা, থানা আর আমাদের উন্নতিতে সে
ভীষণ আনন্দিত। যারপরনাই খুশী।
এদেশ শহরময় তাকে এখন সবাই ডিগ্রিপাস
রিক্সা মামা নামে ডাকে।
এতেও সে ভীষণ গর্বিত।
চা খেতে সাধলাম। কিন্তু সে বারণ করলে বারংবার। 
পুনশ্চঃ সেই হঠাৎ রিক্সা থামিয়ে দুকাপ চা খাওয়ালে।
 হাসতে হাসতে বলল, "বন্ধু আমার ঘাম ঝড়া হালাল 
পয়সার এক কাপ চা খেয়ে যাও।
You will have a better sleep tonight.....
দেখবে চোখের নীচের কালিটাও আর নেই।"
আমি স্তম্ভিত।
তার চোখ দিয়ে অদ্ভুত এক সূর্য কিরণ ঠিকরে পড়ে
আমার যুগযুগান্তরের পাপ আর অপরাধগুলিকে 
পুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো সে সময়।।
বিমল ঘোষকে সেদিনও আমি বুকে জড়িয়ে
ধরতে পারিনি।
আমার মিথ্যে প্রতিপত্তি, অর্থ-বিত্তেরা, সামাজিক শ্রেণীবিভাজন, 
জাতপাতের বিভেদ আমায় দেয়নি ওকে বুকে জড়িয়ে নিতে।
শুধু তার সেই ঠিকরে পড়া তেজদীপ্ত সূর্য কিরণ
আমি বুক পেতে নিয়েছিলাম,
মাথা নত করে নিয়েছিলাম।।
 
 
 
'এখন সবই বিলাপ
 
সেই কবে এসেছিলে? বসেছিলে?
মনে পড়ে, তবে ভীষণ আবছা।
টিকালো নাক কী ছিল? হাসিতে গালে টোল
পড়ত কিনা? টিপ পড়েছিলে কী কখনো?
এসব তেমন একটা মনে নেই।
শুধু মনে আছে, সাদা জবা আমার ভীষণ প্রিয় ফুল, 
যবে থেকে তোমার কালো মেঘমালার খোপায় সেজেছিল।
কেমন জামা ছিল, গায়ের গড়ন একহারা ছিল কী?
এসব ভুলে খেয়েছি কাজের চাপে।
শুধু মনে আছে, শীতের সকাল, কুয়াশার চাদরে
মোড়া নদীর ধার, বাবলার বনের ফাঁক গলে
কিরণের ছটা।
সিমেন্টের বেঞ্চি, তাতে দুটি ছায়া
চারটে হাত এক করা। বাতাসে বসন্তের আগমনী গান।
তোমার ঘেমে ওঠা হাত থেকে
চেক কাটা রুমালখানা নিতে আমার মরার জেদ।
তুমি রেগে অস্থির, কিছুতেই দিবেনা।
রুমাল দিলে নাকি ঝগিড়া হয়, ছাড়াছাড়ি হয়।
শুনে যত্তসব কুসংস্কার বলে আমার ধমকে ওঠা।
আজ বুঝি, কতটা ঠিক ছিলে তুমি?
তোমার কিছুই মনে নেই আমার, কিন্তু কী আশ্চর্য জানো?
 অদ্ভুত একটা টান অনুভব করি আজও সেই গলিটার পাশ কেটে গেলে।
মন বলে, ছুটে যাই। ঠক ঠক করে কড়া নাড়ি।
তোমার কিচ্ছু মনে নেই, বিশ্বাস করো।
শুধু মনে আছে-
কাঠের দরজার কালো আলকাতরা
লাগানো কাঠের খিল, যা তুমি টেনে দিতে
আমি ঘরে পা ফেলতেই।
কি জানো? সেই থেকে আজাবধি
আলকাতরার ঘ্রাণ আমার নাকে লেগে আছে।
তোমাকে মনে পড়ে কম, শুধু কুসংস্কার আর আলকাতরার ঘ্রাণেরা বেঁচে আছে।।
 
 
 
 
 
 
 
ছাপোষা মানুষ 
ফুয়াদ স্বনম

কেটে পড়ো, নইলে শনি আছে কপালে।
দিব্যি দিয়ে বলুন তো দাদা,
আজ্ঞে হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকে, মানে আপনাদেরকেই বলছি।
কতবার শুনেছেন কথাটা, বলুন তো?
সামনে থেকে শুনেছেন যতবার,
ভেতর থেকে লক্ষাধিকবার তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
নইলে, রোজ ন্যুব্জ চিত্তে এমন করে ঘরে ফেরা কেন!
আপনি তো ফিরবেন বীরবেশে ঢাক ঢোল সানাই বাজিয়ে।।
এই যে ধরুন, রাস্তায় সেদিন হুপিংকাশির রুগীটা দম ছাড়লো,
ভাবলেন, কেটে পড়ো, নইলে শনি আছে কপালে।
আর কেনই বা যাবেন সৎকার করতে,
দেশে কি আঞ্জুমান মুফিদুল নাই,
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তাহলে কই যায়!
আচ্ছা ধরুন, আনতে বলেছে পাকা পেঁপে
বাঙ্গি তুলে এনেছেন বাজার ঘেঁটে
গিন্নী গিয়েছে চটে ভীষণ তেলেবেগুনে
আপনার রাগটি তুলছে অনাথ কাজের মেয়েটার গায়ে,
কি ভাবছেন মশাই, কেটে পড়ো, নইলে শনি আছে কপালে।
আর কেনই বা যাবেন তাকে বাঁচাতে, বলুন তো
কোনোদিন, কখনো তো জানতেই পারেন নি যে,
আপনার মধ্যে মেয়েটি নিজের বাবাকে খুঁজে ফিরে!
চড়েছেন বাসে, শত ভীড়ের ঠেলাঠেলিতে নিজ পকেট টা কে
 রেখেছেন আগলে বাঁচিয়ে পকেটমার হতে,
দেখছেন, হ্যাঁ দাদা, ঠিকই দেখেছেন,
কয়টি ছেলে ঘিরে ধরে তরুণীটিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে
এখানে সেখানে, নিজের বাপের মাল মনে করে,
মুহুর্তে টগবগিয়ে ওঠা রক্তচাপ টাকে বুঝালেন
কেটে পড়ো, নইলে শনি আছে কপালে।
আর কেনই বা নিজেকে জড়াতে যাবেন ঝামেলায়
ছেলেবেলার সব ভুলে খেলেও,
বাবার সেই কথাটা ঠিকই মনে মনে পুষে রেখেছেন
বুদ্ধু সেই, যে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যায়।
দেখছেন, বৃদ্ধ কাকুর পায়ের চটি ক্ষয়ে গেছে-
দপ্তরে দপ্তরে ধাক্কা খেতে খেতে,
পেনশন পেয়ে কুমারী কন্যার
বিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখত যে চশমার গ্লাস দুটি,
ঘুষের অভাবে আজ ভেস্তে গেছে সেসব।
ধুলি পড়া ঘোলা গ্লাসের ফাঁক দিয়ে নোনা জলে
থৈ থৈ করে ওঠা চোখ দুটি আপনার নজর এড়ায়নি কিছুতেই।
বার কয়েক ভেবেছেন বৈকি,
বড় বাবুকে অনুরোধ করে ফাইল ছাড়াবার,
কিন্ত ওই যে, ঠোঁট কামড়ে ভাবছেন-
কেটে পড়ো, নইলে শনি আছে কপালে।
আপনার কাদা মাটির নরম মনটিকে
শক্তপোক্ত বানিয়েছেন মেডিটেশন করে করে।।
না না দাদা, ও ভুল করবেন না দাদা!
বসে থাকুন চুপটি করে, হাতে হাত গুটিয়ে
হেলিয়ে যান শুধু মাথা ক্যাবলা কান্তা হয়ে-
ক্ষমতাসীনদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে-
হাসপাতালের ছাদের আস্তরণ খুলে
বাঁশেরগাঁট যতই চেয়ে চেয়ে হাসুক,
মসজিদ উন্নয়নের কথা বলে, কমিটি যতই চাঁদা উঠাক
ওদিকে মাদ্রাসার এতীমেরা খাবার অভাবে উপোষ রাত কাটাক,
দশ বছর বয়সী ছেলে ইউটিউবে পর্ণ চালাক,
ছেলে আমার দিনকে দিন হচ্ছে স্মার্ট, বলে চালান হাঁকডাক।
মায়ের ওষুধ ভুলবেন আনতে,
কিন্তু বউয়ের সোনার বালা ভুললে চলবে!
গেস্টের সামনে বাবা এলেই, হয়ে যায় যতো মাথা হেঁট
ওদিকে শ্যালকের প্রশংসায় আপনি পঞ্চমুখ,
চালায় যে সে জাম্বো জেট।
চলুক না জাল ভোটের কারবার, আপনার কিসের দেন দরবার!
কে এলো কে গেলো, আপনার তাতে কি এসে গেলো!
ব্যাঙ্কের পর ব্যাঙ্ক ফাঁকা হলো, বিদেশীদের পকেট ভরলো,
প্লাজার পর প্লাজা ধ্বসে পড়ে,
বাতাস ভারী হয় শ্রমিকের মৃত্যু মাতমে,
আপনি বাপু ছাপোষা মানুষ,
যাকগে গোল্লায় এ দেশ এ সমাজ,
কি লাভ এসব শুনে, আপনার হাতে কতো কাজ!
ঠিক করেছেন দাদা, একদম মুখ খুলবেন না
ভুলেও ফেবু তে ছবি গুলি ট্যাগাবেন না।
মনের খায়েশ মনেতেই মেটান,
মনকে আর বিপদের মুখে ঠেলবেন না।
ভুলে যেয়েন না,
একবার এক ধর্ষিতা রমণীকে বাঁচাতে দৌড়েছিলেন,
ছোঁরা উঁচিয়ে ওরা বলেছিল -
কেটে পড়ো, নইলে শনি আছে কপালে।
সেই থেকেই রক্ত হিমাগারে রেখেছেন পুরে।।
 
 
 
 
প্রিয় প্রতীক্ষা 
হয়তোবা, অফিসে ফাইলের ভারে পরিশ্রান্ত তুমি,
সব দিক সামাল দিতে গিয়ে লাঞ্চ আওয়ারটাই
খেয়ে বসে আছ কাজের চাপে! তবু একটু সময় করে কালো 
ফ্রেমের চশমাটা মুছতে মুছতে, পুরোনো কোন মীমাংসিত 
ফাইলের কাগজ ছিঁড়ে ছোট্ট করে লিখে দিও "ভালবাসি লক্ষীটি"।।
হয়তোবা, বৈদ্যুতিক গোলযোগে চেনা লিফট গেছে বন্ধ হয়ে,
তুমি আটতলা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামায় দম নিচ্ছ থেমে থেমে,
মনে কোরো, আমি মাঝ সিঁড়িতে জল হাতে রয়েছি দাঁড়ায়ে।
তুমি উপর পানে চেয়ে, হাত দুটি বাড়িয়ে একবার বলে ওঠো "ভালবাসি লক্ষীটি"।।
হয়তোবা, জমিজমার সমস্যা মেটাতে গিয়ে, 
উপচে পড়া মানুষের ভিড়ে, আদালতের করিডরে, 
হাজিরায় ক্ষয়ে গেছে স্যান্ডেল। কাঠগরায় নতজানু তুমি ঘৃণা, 
ক্ষোভ, লজ্জায় হয়ে গেছ লাল। 
তবু, জানালার গারদের দিকে চেয়ে একবার "ভালবাসি লক্ষীটি"
 বোলো বিড়বিড়ি করে।।
হয়তোবা, মাথামোটা বসের তাচ্ছিল্যে ভরা কটুক্তি শুনছ তুমি।
 রাগে উল্টো করে একশ থেকে এক গুনছ তুমি।
অপমানে অজান্তে কান লাল হয়ে উঠেছে তোমার।
এমন সময়, তোমার পকেটে আমার রিংটোনে যদি ঘর যায় ভরে,
 তুমি কি বিরক্ত হবে! নাকি ছোট্ট করে বার্তা পাঠাবে 'ভালবাসি লক্ষীটি'।
ধরো, আজ তোমার জন্মদিন, দুজনে মিলে গিয়েছি
 কোন চাইনিজ রেস্তোরাঁয় দারুণ রোমান্টিক মুড নিয়ে,
ওয়েটারদের সাথে খামোখায় তর্কে জড়িয়ে, বিরক্ত হয়ে আমি যদি বের হতে চাই ছুটে!
তুমি কি বসে রবে আমায় ছোট করে!
নাকি আমার পথ আগলে বলবে 'ভালবাসি লক্ষীটি আমায় কে নিয়ে যাবে!'
আচ্ছা, মনেকর, তুমি সারাদিনের ধকল শেষে ফিরছ ট্রেনে,
শেষ হুইসেলটাও দেয়া সারা, সিঁড়ির হাতলটা তোমার হাতে,
সবে পা দিয়েছ ট্রেনের সিঁড়িতে, অমনি পড়লো মনে আমার 
দুপুরের বায়নার কথাটা, 'চীজ পাফ টা আনতে হবে'।
তুমি কি আরেকটা পা'ও সিঁড়িতে তুলবে! নাকি মনেমনে 
'ভালবাসি লক্ষীটি' বলে অফিস পাড়ায় ফেরত যাবে!
ধরো, ড্রইং রুমে টিভির সামনে আমরা।
খেলা চলছে ব্রাজিল আর্জেন্টিনায়। হাড্ডি হাড্ডি লড়াই।
আমি মেসি, আর তুমি নেইমারের অন্ধ সাপোর্টার।
খেলা শেষে আমি হারলাম দুই এক গোলে।
হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছি আমি। তুমি কি 'কচি খুকী' বলে চিবুক টেনে তাচ্ছিল্য করবে!
নাকি 'ভালবাসি লক্ষীটি' বলে বুকের মাঝে আমার মাথাটা চেপে ধরবে!
হয়তোবা, বাজারের ব্যাগ হাতে হেঁটে হেঁটে ফিরছ তুমি।
হঠাৎই তোমার নজরে পড়লো এক লাশের মিছিল।
কেউ একজন সাদা কাপড় পড়ে, মরণ পালকী চেপে,
চার বেহারার কাঁধে চেপে মিলিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে।
তুমি কি এড়িয়ে রাস্তার অপাশ দিয়ে হাঁটবে!
নাকি ধপ্পাস করে ব্যাগগুলি ফেলে, আমার প্রস্থান ভেবে, 
ডুকরে উঠে বলবে 'ভালবাসি লক্ষীটি লক্ষীটি, আমায় যেয়োনা ফেলে, 
একা এই মায়ার সংসারে। তুমি ছাড়া এই রঙিন জীবন, ফিকা মনেহয় সারাক্ষণ'।।।
হাজার দশেক ব্যস্ততার ভীরে
একলা আমি, বসে শীতল নীড়ে
বৃষ্টির মতো পড়ছ তুমি মনে
ইচ্ছে করে, মেঘের দলে ভেসে
লক্ষীটি লক্ষীটি আসুক উড়ে উড়ে
আমি দীপ জ্বেলে রই, তারই প্রতীক্ষাতে।।
 
 
 
'আশাহীন মানুষের শহর
 
এ শহরে, আমি ওদেরকে বুকের মাঝে
আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম।
কই? পারিনি তো।
কিই বা এমন চেয়েছিলাম?
ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে
খেলে বেড়াবে নরম দুব্বা ঘাসে,
সেখানে ঘাসের ডগায় খেলবে রংবেরঙের ফড়িঙ।
পা কাটলে গাঁদা ফুলের রস লাগিয়ে দিবে পিতামহরা।
কিন্তু এ কি?
আজ এখানে শিশুরা বই নামের,
স্ট্যাটাস নামের স্ট্যানগান বুকে তাক করে
দাঁড়িয়ে আছে একে অপরের দিকে!
আমি চেয়েছিলাম,
বৃদ্ধরা ফুসফুস ভালো রাখার কায়দাটা
রপ্ত করুক হাসিতে হাসিতে গগন ফাটিয়ে।
তাদের উল্লাসে ভরা শীতেও
গজিয়ে উঠুক গাছেদের পত্র পল্লব।
অথচ, এখানে পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠেছে কারাগারসম বৃদ্ধাশ্রম।
জানালার পাশে জোড়ায় জোড়ায় করুণ চোখের ফ্যাল ফ্যাল করা চাহুনি!
এ কি, সবই আমার ভুল চাওয়া ছিল?
আমি তো ওদেরকে ঘিরেই বাঁচতে চেয়েছিলাম। 
এ শহরে আমি সহজ সরল কলমিলতার পুকুর চেয়েছিলাম।
সেখানে কইয়ের সাথে ভ্রমরের সাথে খেলা করে বেড়াবে রাজহাঁসের দল।
সেটাও কি আমার ভুল ছিল? বলো?
অথচ আমায় রোড সাইডে নির্মীত নর্দমা দেয়া হলো,
পাকা ব্যবস্হা করা ইট কংক্রিটের সুনিপুণ সরওয়েজ লাইন দেয়া হলো।
এ সবই কি আমার প্রাপ্তি?
আমি চেয়েছিলাম সন্ধ্যা হলে মাঝেমধ্যে ব্ল্যাকআউট হয়ে পড়ুক শহুরে রাজপথ।
জোনাকিদের সাথে দল দল কিশোরী, তরুণী, 
নারী নেমে পড়ুক রাজপথ অলিতে-গলিতে খালি পায়ে।
তোমরা হয়তো ভাবছ, এসবই এক পাগলের প্রলাপ।
অথচ, সত্যি বলছি,
আমি ওদের বুকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু ওরা দেয়নি।
ওরা ল্যাম্পপোস্টের নীচে, নিয়নের আলোতে লোভ,
 জিঘাংসার, কামুকতার জিভ দিয়ে চেটে চেটে নষ্ট করেছে
 সোনার মেয়েদের ইজ্জত! বুঝিয়ে দিয়েছে ঝাঁঝালো লিঙ্গের তেজ কাকে বলে?
বলো, আমি কেন বাঁচব?
আমি এ শহরে রাতের পাহাড়ের নিস্তব্ধতা নিয়ে বেড়ে উঠতে চেয়েছিলাম,
থেকে থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার উৎফুল্লতার গান,
এর পুরোটাই কি আমার ভুল ছিল?
অথচ, এখানে রাতের আঁধারে কাচের মতো
হৃদয় ভাঙ্গার গান।
মসজিদে, গীর্জায়, মন্দিরে হ্যান্ডগ্রেনেডের আঘাতে মানুষের ছিন্ন হাত, 
কাটা পা আর উপড়ে যাওয়া চোখের আর্তনাদ!
আমি একটি নিষ্পাপ ফুলের জন্য বাঁচতে চেয়েছিলাম,
ফুলের পাপড়ি আমায় ভালো রাখবার কথা দিয়েছিল,
আমি পানকৌড়িদের ভীরে বাঁচতে চেয়ে শেষে দেখি এ কোন শকুনের দেশে এসে পড়েছি!
বলো, বলে দাও আমায় এভাবে হাতের উপর হাত গুটিয়ে গোলামের জীবন কে বাঁচতে চায়?
তোমরা হতে পারো, আমি অন্তত নই।।
 
 
 
 
এখন ও আমি-তুমি
 
এখন তুমি- ভিন্ন রমণী অন্য কোন খানে
আমি এখন- রাত্রি কাটাই নিদ্রা বির্সজনে
এখন তুমি- অচীন সুরে না-শোনা এক গান
আমি এখন- সূর্য ডোবা, অনল নদের স্নান।
এখন তুমি- অচেনা বাতাস অন্য ঘরে অনুরাগী
আমি এখন- মেঠো পথে কানাই, ক্ষ্যাপা বৈরাগী
এখন তুমি- অচ্ছুৎ, চোখ পাকানো সমাজ বারণ
আমি এখন- পড়লে মনে, যন্ত্রণারই এক কারণ।
এখন তুমি- চোখ ফেরানো যে কোন নারী
আমি এখন- নিষিদ্ধ, সেই শহরে কার্ফু জারি
এখন তুমি- অন্য মেঝের আলতা রাঙা চরণ
আমি এখন- তোমার মনের গহীন বনে রাবণ।
এখন তুমি- কান্না চেপে প্রাণ খুলে বেশ হাসো
আমি এখন- মুদলে নয়ন তুমিই শুধু আসো
এখন তুমি- স্পাত কঠিন দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর
আমি এখন- ফিনকি রক্তক্ষরণ বুকে বেঁধা তীর।
এখন তুমি- মত্ত ভীষণ লোক দেখানো খুশীতে
আমি এখন- দুলছি ভীষণ অপ্রাপ্তির দোলনাতে
এখন তুমি- দোলনচাঁপা গুঁজছ রোজ খোঁপাতে
আমি এখন- হাঁপিয়ে উঠছি তোমার অঙ্ক মেলাতে।
এখন তুমি- ভীড়ের মাঝে অন্য লোকের ছায়া
আমি এখন- প্রাক্তন নামের পুরোনো কোন মায়া
এখন তুমি- রোজ হেঁটে যাও আমার মনের ভেতর
আমি এখনও- অপেক্ষায়, তোমার স্বপ্নে বিভোর।।
 
 
 
 
 
'তুই এখন কেমন থাকিস?

তোর চোখ এখনো কী তেমন, ঘুম ঘুম রহস্যে ঘেরা?
যেন জনশূন্য উপত্যকার মাঝে গহীন গিরিখাতেরা?
এখনো কী নিঃশ্বাসে দ্বিপ্রহরিক নির্জনতা?
থেমে থেমে পড়ছে?
আদর মাঝে ঘটছে বিরোধ! অনীহাটা অনবরত লড়ছে?
এখনো কী তেমনিই মনমরা তুই, বিচ্ছেদে বিবর্ণ?
জেদ ভাঙলে কোমল, যেমন উচ্চতাপে গলা স্বর্ণ?
তোর রাত কী এখনো ঘুটঘুটে কালো? দীপ জ্বালিয়ে আসে?
দুঃস্বপ্নে হঠাৎ ভাঙলে ঘুম, খুঁজিস আমায় তখন কোলের পাশে?
পুকুর দেখে আলতা রঙা পা ডুবিয়ে বসিস, সবুজ জলে?
এখনো কী ভীষণ একাকী তুই? দাঁড়িয়ে পড়ে জীবন, কোলাহলে?
তর্কে জেতা আজও ভালোবাসিস? বিপক্ষে দাঁড়ান
কে এখন?
ভুলগুলি সব শুধরে দেবার পরে জড়িয়ে ধরে কেউ কী আমার মতন?
কাজল টাজল দিস নাকি এখন চোখে
যেন মাঝ দরিয়ায় ছোট্ট ডিঙ রয় ভেসে?
কথায় কথায় ডিভোর্সের ভয় এখন দিস কাকে?
কেইবা অমন তোকে আঁকড়ে শক্ত করে বাঁচে?
কতো কতো লোক দেখি চারপাশ জুড়ে রাস্তা ঘাটে
তবু সেই চেনা মুখ তো কই আর দেখিনা এ তল্লাটে!
তুই কী এখনো আগের মতই আছিস, আগের মতই ভীষণ ঘরকোণা?
এখন নিশ্চয় অনিচ্ছাতে বসত নেই কারো সাথে?
নেই জোরপূর্বক বনিবনা?
এখনো কী খুব উঁচুতে উড়ার শখ? আমার ছিলো উচ্চে যাবার ফোবিয়া,
ভুলের মাশুল গুনতে হলো নিজেই, অমিলগুলিই বিচ্ছেদে ছিলো মরিয়া।
এখন হয়তো অন্য বাহু তোর গায়ে, অন্য বুকে
রাখিস এখন মাথা,
জানিনা সে কেমন তোরে রাখে? আমার কেন সে ভাবনায় বাড়ে ব্যাথা?
বলতে পারিস, কেন বুকের ভেতর ব্যাথা?
কেন গুমরে মরে না বলা এক কথা?
বিচ্ছেদের এ কেমন একপেশে প্রথা??
 
 
 

অন্তর্মুখী অভিযাত্রা 
 
একদিন সময় করে এসো, প্রিয়তমা
এসে বোসো ভিতরে।
দূর হতে সবটুকু বুঝে পাওয়া যায় না।
ভিতরে এলে দেখবে, কেমন সাইবেরিয়
বিচ্ছিরি শীতলতা নিয়ে জেগে আছি
দিনের পর দিন রাতের পর রাত।
এখানে পাখির পালকের মতই কোমল
হৃদয়ের দেয়ালগুলি আজ কেমন
শক্ত জমাট বাধা বরফের মতো নিরেট ও কঠিন
হয়ে গেছে আঘাতে আঘাতে।
প্রতিটা অবহেলা আর বঞ্চনার স্পর্শে
লজ্জাবতীর পাতার মতই অন্তর্মুখী হয়ে গেছে তারা।
একদিন সময় করে এসো, প্রিয়তমা
এসে বোসো ভিতরে।
বাহিরটুকু দেখেই শুকনো মুখে ফেরত যেও না।
পারলে, আরেকটু এগিয়ে যাও
হৃদয়ের গহীনের পথে।
দেখবে একটা মনমরা ঝিল
ঝিলের মধ্যে হাটুজলে নামলে দেখবে
তাতে এক কালো মেঘের আকাশ
কালো মেঘের সাথে মিশে রয়েছে
এক ক্লান্ত নিঃসঙ্গ চীলের উড়ে চলার গল্প।
গল্পের প্রতি লাইনে পাবে এ মাটির
নিষ্ঠুর লোকেদের শ্বাসরুদ্ধকর একেকটা
ধোঁকাবাজির ইতিহাস।
একদিন সময় করে এসো, প্রিয়তমা
এসে বোসো ভিতরে।
শুধু উপরটুকু দেখেই ফেরত যেও না।
আরো কয়েক কদম এগোলেই কোন
এককালের ফরেস্ট জোন।
ফরেস্টে দাবানল, তাপাদহ,
বাতাসে চামড়া পোড়ার উৎকট গন্ধ।
এখানে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে
জ্বালানো হয়েছে বিবেক, মায়া, মমতা,
ভ্রাতৃত্ব, স্নেহ আর দেশাত্মবোধ।
একদিন সময় করে এসো, প্রিয়তমা
এসে বোসো ভিতরে।
বাহিরের প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া
দেখেই ফেরত যেও না।
একদম গহীনে নামলেই দেখবে
এখানে একটি জীর্ণদেহী কাগজ
এখানে বৃষ্টি বারোমাস।
সবুজাভ দুর্বাঘাসের জমীন
জমীনের উপরে কাগজে চলছে লেখা
লিখছে ঝাঁকড়া চুলের এক দুর্নিবার কিশোর।
বৃষ্টি তার জলের ঝাপটায় মুছে দিচ্ছে সেসব।
পুনরায় পুরোনো ধাঁচে চলছে লেখা,
চলছে লেখা ও মুছার খেলা অবিরত।
এখানে এসে সবাই তাদের অমরত্ব চাইছে।
তুমি এসো, তোমার বোঝাপড়া সারো,
অজানা এক কালিতে লিখে যাও নাম
যে নাম মুছবে না কোনদিন,
যদিও এখানে বৃষ্টি ঝরে অবিরাম।। 
 
 
 
 
 
 
এমনি বর্ষায় ভরসা আসে যদি!
 
একটা অপূর্ণতাকে ছোঁব বলে
যদি গ্রাস করে প্রেম, মনের জমিন
অধিগ্রহণ করে ভালোবাসায়,
ক্ষতি কী খুব, বলো?
যদি খুব করে কেউ জেদ ধরে?
বাগানের আগাছা খ্যাত উদ্ভিদের কাছে
জানতে চায় যদি প্রিয় ফুলের কথা!
হুইল চেয়ারে বসে থাকা পঙ্গুত্বের হাত ধরে
যদি নিতে চায় বৃষ্টির অবিরল ধারায়!
ঘুঙরু পায়ে নাচতে বলে ধানক্ষেতময় বৃষ্টির শোভায়!
পুনশ্চ, পাঙশা হয়ে ভিজে উঠে এলে
ভেজা চুল শুকোনোর বাহানায়
তেলেবেগুনে যায় ক্ষেপে!
যদি খুব করে রাতের পর রাত জেগে
প্রতিটি লাইন, পৃষ্ঠা উলটে পালটে পড়তে চায়
আমার একান্তের অনুচ্চারিত নিষিদ্ধ ডায়েরি,
তখন তার চোখ দুটি বর্ষার কলমিলতার পুকুর,
থৈ থৈ করে ওঠা জলে পাড়ের সব
দুঃখ বেদনা ধুয়ে নিতে চায়!
শতাব্দীর কুঁকড়ে যাওয়া মাকড়শার জাল ছিঁড়ে
টেনেহিঁচড়ে বের করে আনতে চায় আমাকে!
কেড়ে নিতে চায় আমাকে আমার নিজস্ব নিরেট
দেয়াল ভেদ করে!
খুব কী ক্ষতি হয়ে যাবে? বলোনা গো?
অবহেলায় মানুষ হওয়া এই যন্ত্রটিকে অনবরত
যদি পানাহারের তাগাদায় ত্যক্ত করতে থাকে কেউ?
কেউ যদি হঠাৎই উদ্বিগ্নতা শব্দটার সাথে
পরিচিতি ঘটায়?
প্রত্যন্ত পাহাড়ের গায়ে সারি সারি রাবার বাগান হয়ে
মুছে নিতে চায়, যুগ যুগান্তরের চোখের নীচের কালী?
বলোনা গো, তাতে কী পক্ষান্তরে সত্যিই আমার
আঁচলে লাগবে দাগ?
তারপর, তারপর হঠাৎই যদি বলে বসে!
"জারুলের পাতায় পাতায় এমন জোছনা লেপটানো রাতে বাইরে এসো না প্লিজ, 
তোমার মুখশ্রীর ঠিকরে পড়া রোদ্দুরে চাঁদেরকণারা লজ্জায় লুকোতেও পারে"
যদি কেউ নাম দেয় পৃথিবীর ঝাড়বাতি?
ডাকে নূর জাহান বলে?
তারপর একটানে খুলে দেয় চুলের কাঁটা,
ব্যস্ত হয়ে পড়ে কপাল হতে একফালি চুল সরাতে!
উন্মুক্ত করে দেয় পাহাড়ী ঝর্ণাধারা! পাথরের বুকে ঢালে পানি!
কিংবা প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়
মোহনার সঙ্গমে!
কিংবা ধরো, এই আমায় নিয়ে লিখতে চায় কাব্য?
পড়তে চায় কাজলাবৃত এ চোখের কবিতা?
যদি আমি 'আ' বলি বুঝে নেয় 'আকুন্ঠ',
'প' বলতেই 'পরিত্রাণ',
'ম' বলতেই পায়রার মত মুক্ত করে বেদনা!
'ভ' বলতেই জড়িয়ে ধরে বুকের গহীনে কর্পুরের 
মতই উড়িয়ে দেয় যত ভ্রম আর লোকলজ্জার ভয়!
যদি, 'ঘ' বলতেই বুঝতে পারে উল্টোটা!
যদি বুঝে নেয় কতোটা ভালোবাসি!
ভালোবাসতে ভালোবাসি!
বলোনা গো কার, কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?
এমনি করে এই বারিষ দিনে,
একটা অপূর্ণতাকে ছোঁব বলে
যদি গ্রাস করে প্রেম, মনের জমিন
অধিগ্রহণ করে ভালোবাসায়,
ক্ষতি কী খুব হবে, বলোনা গো?
 
 
 
সেই মেয়েটার গল্প শোনো
 
সেই মেয়েটার খোঁজ জানো কেউ?
-কোন মেয়েটা? নদী না ঢেউ?
কেন! সেই যে সেই মেয়েটা!
রাত্রি হলো, জোনাক হলো।
দিনের আলোয় মিলিয়ে গেলো।
সেই মেয়েটা একলা আঁধার
কাঁদতো বসে ঘরের কোণে,
তিনকূলে তার সবাই ছিলো
তবু দুঃখ তাহার সঙ্গোপনে।
সবাই শুধু ওপর দেখে
ভেতরটা তার কেউ বোঝেনা,
জীবনটা তার কলের গাড়ি
কর্ম ছাড়া অন্ন জোটেনা।
যদিওবা সে ঘরের লক্ষী
কিন্তু সেটা মানতো ক'জন?
দেহের মূল্যে পাল্লা ভারী
মনের বেলায় শুণ্য ওজন।
অত্যাচার আর অনাচারে
কাটছে যে দিন রাত,
ক্ষত বাড়ছে, ফের শুকোচ্ছে
সকাল আসে, আসেনা সুপ্রভাত।
হঠাৎ সেদিন ফেরার পথে
ভিন্ন কিছু ঘটলো,
চওড়া ছাতির মস্ত পাহাড়
পথ আগলে ধরলো।
বাড়ির পেছনে সরু নদী
তার পেছনে পাহাড়,
সামলে উঠে আঁচলখানি
বললে, কী দেখছ? আমি আহার?
বসলো পাহাড় গেঁড়ে হাঁটু
প্রেমিক ভঙ্গি তখন,
তোমার কষ্ট আমায় দিবে?
করবো ভীষণ যতন।
দিনের বেলায় সূর্য আসে
চূড়ায় ঠিকরে পড়ে আলো,
আলোয় আলোয় খুশীর বন্যা
পাহাড় হাসছে ঝলোমলো।
রাত্রি বাড়ে চুপিসারে
সাথে নিকোষ আঁধার কালো,
সোনার মেয়ে, যাবে তুমি?
চলো জোনাক হয়ে জ্বলো।
একেই পাহাড় প্রেমিক পুরুষ
সুঠাম গড়নপিটন,
উপোষী মেয়ে শোনেনি আগে
এমন প্রেমের কথন।
আচ্ছা, এমন করে ডাকে, বলোতো কেউ?
বুকের মাঝে এভাবে তোলপাড় করে ঢেউ?
এমনি করে কেউ সাধে যদি
ঘরে থাকা যায়?
নিন্দে ছুঁড়বে পাড়াপড়শি
কে নেবে তার দায়?
বলবে না কী! ছিঃ ছিঃ ছিঃ
গৃ্হস্থালী বউ, এমন কাজ কেউ করে?
সমাজ সংসারে চুনকালি মেখে
নিরুদ্দেশ হলি কার হাতটি ধরে?
ও পাহাড়, প্রেমিক পুরুষ
আমার না হয় ক্লান্ত দেহ, অবসন্ন মন
তোমার কিসের কমতি বলো?
পাশে থাকোনা, হয়ে সাত রাজার ধন।
ও'পাহাড় সুঠাম দেহী প্রেমিক পুরুষ
লক্ষীটি, আমায় ডেকোনা আর,
কলঙ্কিনী বলবে সবে
পারবো না বইতে গো সে ভার।
তারচেয়ে ভালো পাহাড়, বেশ তো আছি
ভিন্ন সংসার তবুও হৃদয়ের কাছাকাছি।
পাহাড়, ওহে প্রেমিক পুরুষ
এইতো, তোমার বুকের মাঝেই রই,
দিনে বেলায় প্রথার ঘরে উনুন ঠেলি
রাতে তোমার আলোর রাণী জোনাক হই।।
 
 
 
 
'অবুঝ এক মেয়ে
 
কাচের অর্থ বোঝেনি মেয়েটি কখনই।
তাই তার ক্ষুরধার আর্তনাদধ্বনিতে
গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তো
প্রাসাদের সমস্ত রঙিন কাচ।
কখনোবা পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে সে নিজেই ভেঙে
ফেলতো সমস্ত কাচ।
দম বন্ধ হয়ে আসতো তার এই কাচ প্রাসাদে।
ভাবতো, বুঝি এসবই তার নিয়তি, এক বন্দীশালা।
মেয়েটি আসলে সুরক্ষা বুঝতো না,
বোঝেনি ছেলেটির ভালোবাসা,
তার দেয়া ঝিনুকতুল্য উপহার।
এদিকে, ছেলেটি তাকে দুর্লভ মতি
ভেবে ভেবে দিশেহারা।
মেয়েটি কখনো জানেনি, ফুলের বাগানে কীটের উপদ্রব।
পাপড়ি খেয়ে ফেলে কিভাবে সেই ফুলপরী কে
উলঙ্গ করে রেখে যায় কীট।
আর সম্ভ্রম হারানো, সর্বস্ব খোয়ানো ফুলটি,
বীভৎস এক মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত
থাকে প্রতিনিয়ত।
ভিন্ন ভিন্ন পাখিদের রঙ, ফেরিওয়ালা বিহঙ্গদের
হরেক রকমের ডাক মেয়েটিকে
ভীষণ আকৃষ্ট করতো।
কখনো ভাবেনি- এ বিশ্বের বিচক্ষণেরা
শকুনকূলেরও নাম রেখেছে পাখি।
ছেলেটিও, বুঝিয়ে বলতে অক্ষম ছিলো
তার স্নিগ্ধ ভালোবাসা, হারাবার ভয়।
ভেবেছিলো, মেয়েটি হবে তার একান্তের জলাধার,
যেখানে সে ছাড়া অন্যকারো প্রতিবিম্ব ভাসবে না কখনো।
কিন্তু মেয়েটা, আকাশের মতো সীমানাহীন
হতে চাইতো।
বোকা মেয়ে বুঝতো না যে, আকাশে সকলেরই
সমঅধিকার লিপিবদ্ধ থাকে।
আকাশ কখনই কারোর একলার নয়,
তার নিজস্ব কোন সংসার নেই,
আকাশ হতে হলে নিজেকে বিলিয়ে দিতে
হয় সবার মাঝে।
তাই অবুঝ মেয়েটি প্রাসাদের সকল রঙিন কাচ
ভেঙে ফেলে,
অজানায় পথ বাড়ালো পক্ষী সদৃশ এক শকুনের ডানায় চেপে,
 নিজ সংসার পেছনে ফেলে ।
সেদিন থেকেই সে সকলের আকাশ
সেদিন, ছেলেটি বলে বসলো -
"চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঝরে যাওয়া ওগুলি আসলে
কাচ নয় প্রিয়, ছিলো আমার হৃদয়।
সেখানেই ঠাঁই দিয়েছিলাম।
সেখানেই ঘর বেঁধেছিলাম।।"
আর যাবার সময় মেয়েটি বললে -
"শোন, তুমি এখন থেকে বৃক্ষ হয়ে থেকো
অনন্তকালের অপেক্ষায়।
ভীষণ যদি দুঃখ পাই কখনো,
ফিরে আসবো বৃষ্টি নিয়ে, দুঃখের কথা নিয়ে
ঝমঝমিয়ে ঝরে পড়বো তোমার মাথায় ও বুকে।
কী নেবে না আমায় সেদিন? কথাটি দাও-"
 
 
 
'কতোটা ছুঁলে আসবে তুমি
 
আর কতোটা ছুঁলে, ভাঙবে পাথর তোমার?
আর কতোটা এগুলে, রইবে না তুমি অসাড়?
আর কতোটা ভরসা জয়ে, ভীরুতা খসে
ও'চোখে পড়বে বিস্ময়ের পর্দা?
আর কতোটা অগ্নি ভেতরে পুরলে, তুমিও উষ্ণ হবে, 
বলবেনা "ইসসস কী স্পর্ধা"?
আর কতোটা পান করলে সুরা, নিজেকে
ঘোষণা করবে উন্মুক্ত?
আর কতোটা বসন্তের চারা রোপণে ও'আঙিনায়,
খুলবে সকল ফটক, দুয়োর, রইবেনা আর নির্লিপ্ত?
আর কতোটা উড়নচণ্ডী মেঘ এসে নাড়লে কড়া,
ডানা মেলবে তোমার গাম্ভীর্যতার জানালা?
আর কতোটা ডিনামাইট বিস্ফোরণে, ধ্বসে পড়বে তোমার 
ব্যক্তিত্ব নামক অনড় পাহাড়িয়া পাহারা?
আর কতোটা বাজালে বাঁশি, খসে পড়বে
তোমার মৌনতার বার্লিন প্রাচীর?
আর কতোটা বাইলে দাঁড়, আমি, মাঝি
দেখা পাবো পাড়ের, তোমাতে পাবো নীড়?
আর কতোটা ডুবোলে পা, এ নদী জড়তা ছেড়ে
উঠে আসবে আমার কোলে?
আর কতোটা খাজনা দানে এ জমি হবে একান্তই আমার, 
ঊষা হতে অস্তাচলে?
আর কতোটা শাব্দিক হলে, 
একটা বিপ্লব ঘটে যাবে আর তুমি হবে বিদ্রোহ,
 জিঞ্জির ছেঁড়া কয়েদি?
বলোনা গো,
আর কতোটা ছান্দিক হলে, 
তুমিও ভালোবাসার একটি সদ্য ভূমিষ্ঠা কবিতা হবে, 
শোনেনি যা কেউ
আজ অবধি?




কবি
__________________________________________
এই যে দাদা, কোথা ছুটছেন অমন হনহন করে!
বলি, ঘরসংসার কি ছিকোয় তুলেছেন!
গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি,
চোখে মোটা কালো চশমার ফ্রেম,
কাঁধে ঝোলানো পাটের ব্যাগ,
অগোছালো লম্বা চুলে নদীর ঢেউ
বেশ কবি কবি ভাব তো দাদা!
শুনেছি, আপনি নাকি নারী জাগরণের কথা বলেন?
সে কি গো দাদা! নারী হয়ে থাকবে রাঁধা,
যার জীবন যৌবন হেঁসেলের উনুনে সাত পাকেতে বাঁধা
কেন খামোখা চান সমাজ পরিবর্তন!
কেন চান ভাঙতে প্রকৃতির লীলাখেলা?
আচ্ছা, সে দিন আবৃত্তির নামে কি যেন
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলেন?
নিজের চাল চুলোর নাই খবর,
শিশুশ্রম বন্ধ করতে চলেছিলেন!
ধম্ম কম্ম তো কবে ভুলে খেয়েছেন
শুনেছি রাম, রহীম, ঈশ্বর কে
এক ঐক্যতানে বেঁধেছিলেন!
ভাগ্যদেবীর ইশারায় যে হয়েছে অনাথ,
খোলা আকাশের নীচে, স্টেশনে, ফুটপাতে কাটে যার রাত,
তাদের জন্য কবিমন পায় কেন আঘাত!
জন্মের পরপরই যাকে ছুঁড়েছিল
স্তুপকৃত আবর্জনায় কুমারী মা,
নাই বা চড়লো তার গায়ে জামা,
কাজ করে দুবেলা দুমুঠো অন্ন যোগাচ্ছে,
এরপরও বলছেন! এ দায়ভার সমাজের ঘাড়েই বর্তাচ্ছে!
আঁজ্ঞে আপনারা, মানে কবিরা, পারেনও বটে
নিজের বাসার ছাদের আস্তরণ পড়ছে খুলে খুলে,
ফুটো হওয়া ছাদ দিয়ে চন্দ্রিমা উঁকি মারে
রোজ রাতে তিন সুতোর রড গোলে গোলে।
এরপরেও বলেন, দারিদ্র্য নাকি আপনাদের অনুপ্রেরণার মূলে!
তিন ফিতার চটির বল্টু গুলি রবার পালটে
হয়ে গেছে জি আই তার,
ওদিকে রুদ্র বাণী হেনেই চলেছেন, লক্ষ্য পতনে সরকার।
অধিক জীবন তো জেলেই কাটালেন,
জেলের দেয়াল জুড়ে বিদ্রোহী রথ ছোটালেন।
বলতে পারেন, সমাজ গঠনে কোনদিন
কোনো ভূমিকা কি রেখেছেন?
অস্ত্রবিদ না হলে, পঙক্তি দিয়ে কিভাবে স্বৈরাচারী ঘুচাবেন?
স্বপ্ন দেখান হিমালয়, গ্রহ, তারা ছোঁবার কথা,
চক্রসুদে খোদ নিজ ভিটামাটি করলেন হাতছাড়া
শুনেছি কবিদের নাকি থাকে আকাশপ্রমাণ এক জানালা!
চাকুরি একটা পারেননি জুটাতে, প্রেমিকা বন্দীনী অন্যের ঘরে
তার লেখনীতে এতো প্রেম আসে কোত্থেকে!
কবিতা কি পারে তারে ফিরাতে?
এরথেকে ভালো স্টেশনে দুবেলা কামলা দিতেন,
বউ, ঘর, চুলো সব সুখই পেতেন।
কবিতায় কি পেট চলে দাদা?
কি লাভ বলুন ত, এভাবে রাত জেগে জেগে বই ছাপিয়ে
আজকাল সবাই ভাবে, এসব ছাইপাঁশ কোন শালা পড়ে?
নয়ত তা কোন বিজ্ঞের সেগুন আলমিরার শোভা বাড়াবে।
তাই বলছি দাদা-
কবি সে তো সমাজ বোঝা,
কবি মানে বৌদিদের মুখ টিপেটিপে হাসা,
কবি মানে অবহেলিত হাসপাতালের বেডহীন বারান্দা
কবি মানে পাত্র খারাপ, পকেটের অবস্থা মন্দা।।
 
 
 
 
'টুঙ্গিপাড়ার তিনটে সাদা শাড়ী
 
আমাদের বর্তমান নিবাস গোপালগঞ্জ
জেলার টুঙ্গিপাড়া।
খবরটা পৌঁছানো মাত্রই আমরা তিনটে
সাদা রঙা শাড়ী, তিনটে বোন ক্রোধে
ফেটে পড়লাম, "না না না এ হতে পারে না।"
আমরা নারীর লজ্জা স্থান ঢাকবার বহু
প্রাচীনতম গর্বের আদি বস্ত্র!
আর আমাদের কিনা কাফনের কাপড়
হিসেবে জড়ানো হবে এক পুরুষ মানুষের
নিথর, নির্জীব অঙ্গে!
এমন তাচ্ছিল্য কে'ও কি মেনে নেয়া
সম্ভব মুখ বুঁজে?
কিন্তু হায়! কার কথা কে শোনে?
আমরা যে রিলিফের মাল।
মহাপরাক্রমশালী মানুষের ইচ্ছেতেই
তথাস্তু বলতে হয় আমাদের।
অতঃপর অনতিবিলম্বে আমাদের হাজিরা।
লাশ ধোয়ানো শেষ, ৫৭০ লন্ড্রি সাবান,
তিন বালতি পানি আর অল্প কিছু মানুষের
চোখের নোনা জলে।
হঠাৎই, চোখ ঝলসে গেলো আমাদের
তিন বোনের! এ তো লাশ নয়!
একটা রুদ্র মূর্তি সূর্য যেন শুয়ে আছে সেখানে।
ঠোঁটের কোণের হাসিটি খসে পড়েনি তখনও।
কি আছে ও'হাসিতে? কেন এমন অস্বস্তি লাগছে?
নাহ, এ হাসি তো আনন্দের নয়!
মহা তাচ্ছিল্যের।
পড়াবার উদ্দেশ্যে আরও কাছে নিতেই,
আরও অবাক হয়ে দেখলাম-
যাকে আমরা সূর্য ভাবছিলাম সেটা আসলে বাংলাদেশের মানচিত্র।
 এদেশের লাল সবুজের পতাকা!
ঘৃণা, লাঞ্চনা, গঞ্জনার অভিমানে লাল
গনগনে সূর্যবরণ মুখমণ্ডল।
অথচ, বুকের কাছটা মখমলের মতন
মোলায়েম সবুজাভ দূর্বাঘাসে পরিপূর্ণ।
উনিই এ জাতির পিতা এ মা-মাটির
শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
হায়রে হতভাগা বাঙালি!
যার হাত ধরে চলতে শিখলি!
মাথা উঁচু করে দাড়ানোটা, রাষ্ট্র নামক শব্দটার
অর্থটা যে কি, তা জানলি!
তোদের স্বাধীন করতে করতে যে মানুষটা
তার যৌবন বিলিয়ে দিয়েছেন
পরাধীনতার কারাগারে!
নিজ সন্তান, পিতা-মাতা, পরিবার বলতে
যে সাত কোটি জনগণকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলেন!
তার কপালে একটুকরো কাফনের কাপড় জোটেনা?
শেষ গোসলে জোটেনি দুটো সুগন্ধি সাবান?
বীর বাঙালীদের বয়ে বেড়ানো পাঁজরের হাড়ের জায়গায় 
ঠাঁই পেয়েছে তোদের ছুঁড়ে দেয়া অগণিত বুলেট নামের কীলক!
পরাধীনতা কে শাসান তর্জনীটাও ছিন্ন হয়েছে স্বাধীনতার শিকড় সমেত!
এ লজ্জা আমরা লুকবো কোথায়?
এ লজ্জা আমরা লুকবো কোথায়?
 
 
 
কতোটা এড়ানো যাবে?
 
যখন যখন তুমি আসো,
এমন করে ভাঙে ঘুম!
যেন জানালা দিয়ে শ্রাবণের ছাঁট
ওষ্ঠে মাখায় চুম।
এইতো আসলে তুমি, বসেছ পাশে,
কপালে রাখছ হাত,
টের পেয়ে রেগেছে থার্মো-মিটার,
দেহ জুড়ে বজ্রপাত।
চোখ খুলিনা, জানালা খুলি,
মন দিয়ে সব দেখি,
দেখি দুটি বিচলিত আঁখি
প্রশ্ন করছে "জ্বর? সেকি!!"
একটা অহং, একটুকরো দম্ভ
লেগে আছে ঠোঁটের কোণে,
তুমি ভাবছ হাসছি আমি!
আসলে ভালোবাসা লেগেছে শিরস্ত্রাণে।
হঠাৎই যদি শরৎ আসে,
হাতে শিউলি গাঁথা মালা!
ভরা বর্ষায় গাঙে নামে জোছনা,
হাতে রুপোর থালা!
গাঙের জলে ভাসছে নৌকো,
নাওয়ের উঠোন বোঝাই স্বপ্ন,
তুমি আমি বসে বুনছি মালা
করে রাজপাট ভগ্ন।
এসময় কোন হাসনাহেনা যদি
ছুঁয়ে যায় ওর ললাট,
স্বপ্ন আমার সৌরভে ভাসে,
প্রজাপতি হয় ডায়েরির মলাট।
স্বপ্নে আমি প্রায় ছুটে যাই
তোমার হাতটি ধরে,
পেরোয় শর্ষেক্ষেত, হিজলের বন,
সাঁতড়ে বেড়ায় কচুরিপানা সরিয়ে।
অন্য কিছুতো চাইনি কখনো,
বলোনা, এও কী কেড়ে নিবে?
বলোনা গো, এ স্বপ্নটুকুও কেড়ে নিবে?



'এমন হলে, কেমন হবে?
 
কেমন হবে আমিও যদি তোমার মতো হই?
আদর শেষে আমিও যদি মুখ ফিরিয়ে শোই❓
কেমন হবে প্রেমটা যদি আতরদানি হয়?
বিলিয়ে দিয়ে সুগন্ধিটা কোণায় পড়ে রয়❓
ঝগড়া শেষে আমিও যদি চুপটি করে রই?
রাতবেরাতে উপোষ পেটে ড্রইংরুমে শোই❓
কেমন হবে রাত্রি যদি একলা তোমার আসে?
বালিশ খোলের তুলোগুলি কষ্ট জলে ভাসে❓
যদি ব্যস্ততার অজুহাতে কথা না হয় দিন সাতেক?
যদি বলি, ইচ্ছে হলে বাঁচ নয়তো মৃত্যু নিচ্ছে নিক❓
কেমন হবে যদি বদলেই যায় গহীনে আদর শেষে?
যদি ঘেন্না এখন জাপটে ধরে ওর দিকে তাকালে❓
কেমন হবে আমিও যদি ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন চাপিয়ে দেই?
রৌদ্র হয়ে রঙ আর প্রণয়ের ছলে হাসি ছিনিয়ে নেই❓
কেমন হবে আমিও যদি তোমার কন্ঠ করি অবরুদ্ধ?
যদি কুড়িয়ে আসি পাপ, বাহিরের প্রেমে হই ঋদ্ধ❓
ফুল জানে ঢলে পড়তেই হবে তাকে,
তবুও কেন সে ডালে লতায় সানন্দে ফোটে?
আলগা মানুষের গন্ধ ও'দেহে মাখা,
তবু তার প্রতি রোজ কেন এতো প্রেম জেগে ওঠে❓





'একটা কেউ আসুক
 
কেউ কখনোই ভালবাসেনি আমায়,
উপহাস কুড়িয়েছি শুধু, ভরসার পাইনি কোন হাত।
এমন একটা হাত যেটা ছটফট করবেনা
নারীর নগ্নতাকে ছুঁতে, বরঞ্চ যে হাতটা মাথার নীচে
টেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়া যাবে।
আশার দোলা দিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেছে
কৃষ্ণচূড়ার ফাগুন।
বেজে উঠতে চেয়েও স্তব্ধ থেকেছে মোহন বাঁশি,
আজ সে শুধুই রণক্ষেত্রর সাইরেন।
মন ছোঁবার বাহানায় বারবার গা ঘেঁষে,
কোল ঘেঁষে বসতে চেয়েছে সবে।
ভালোবাসা কী কখনো এমনটা হয়, বলো?
বুকের গহীনে আদর পৌঁছাবেনা কেউ, এমন
উপর উপর মধু প্রেম বিছানো?
কাজলের প্রতি বিমুগ্ধতা নয়,
নাবিকের চোখ আজ সওদাগরী,
সে চোখে শুধুই কাম-বাসনা।
আসছি বলেও আসেনি শান্তির দূত
অথচ, চারটে দেয়াল আমারও ছিলো,
ছিলো মাথা গোঁজার ছাদ, খয়ের দেয়া পান-রসের মতো
 টকটকে লাল বেনারসি,
পাকা ধান রঙা সোনালী জরির ওড়না।
আর দশের মতো আবেশিত হয়েছিলাম,
প্রবেশও করেছিলাম।
কিন্তু, কই গৃহে প্রবেশ আর মনের ঘর
কী এক হলো, বলো?
সে গৃহে রয়েছে শুধু লালসা, রাতের বিছানা,
দায়িত্ব আর কারখানার লোহা পিটানোর আওয়াজ।
নারীর জন্য গৃহ নয়, দেয়াল নয়, ছাদ নয়,
পুরুষের মনের বাগানটিই তো সংসার।
তাই প্রকৃতই সে পুরুষ নয়, খুঁজে একটুকরো হৃদয়।
আমি চাই, কেউ আসুক।
একান্তে নিয়ে বসুক আমাকে।
বলুক- "কী ব্যাপার বলোতো, মুখটা ওমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? 
চোখের নীচে কালি!
গ্রীবার তিলে এ কিসের শোকের ছায়া?
কী হয়েছে খুলে বলবে একটু?"
কেউ আসুক, মন দিয়ে শুনতে চাক নির্ঘুম
বালিশের নীচে চাপা পড়া আমার
সহস্র সহস্র জমে থাকা নালিশ।
সমাধান না দিক, শুধু বলে দিক সে আছে
এখন থেকে সবকিছুতে।
এমন কেউ আসুক, কান্না শুনে বুঝে নিক আমার
অভিযোগ আর অনুযোগের তফাৎ।
এমন কেউ আসুক, যার হাত ধরে হাঁটি আমি
রাস্তার বাম দিকে।
খোঁপায় কাঠ গোলাপ সরিয়ে পড়িয়ে দিক
সাদা জবা।তখন তার হাতে বকুলের মালা।
দাগ লাগুক শাড়ির আঁচলে। 
লাগুক সে দাগ কচি ডাবের পানির কিংবা কাঁচা লঙ্কা মাখা জামের।
তবু সে আসুক, হাঁটুক কিছুদূর পাশাপাশি।
বিপদ দেখলেই পাশ থেকে এক পা এগিয়ে
সামনে দাঁড়াক,
বুক দিয়ে আগলে নিক ফাগুনের সবটুকু অবহেলা।
জল নয় দুঃখ কেড়ে নিক নদীর
সারা তল্লাট জানুক এক ফেরিওয়ালা
হাঁক ছেড়ে নিয়ে গেছে ঘুণে খাওয়া ভাঙ্গা আসবাব
 আর জং ধরা টিনের মতো আমার জমানো আনাচেকানাচের সকল মান,
 অবহেলা, ক্ষোভ, অভিযোগ।
পক্ষান্তরে দিয়ে গেছে অভিমান, অনুরাগ,
অনুযোগ আর ভালোবাসার শ্লোক।
মন বলে, সত্যিকার এমন একটা কেউ আসুক।।




সম্মানে দিদি Srija Ghosh
প্রত্যুত্তর -'বছর চারেক পর'
________________________________________
দেখা হল বছর চারেক পর,
বেশ বলেছিস-
এখন আমি অন্য কারোর ঘর,
অন্য কারোর বর।
দেখা হল শত মানুষের ভীড়ে
শান্ত পায়ে ফিরছিস বুঝি নীড়ে,
একপলকের একটু খানিক দেখা
ভীড়ের মাঝেও লাগলো ভীষণ একা।
পরনে এখন ভারী তাঁতের শাড়ি,
সেদিনের সেই তুই,
আজ পুরোদস্তুর নারী।
বাহ! এইতো কেমন ঠোঁট রেঙেছিস লিপিস্টকে!
বেলা শেষের ছায়া নেমেছে কাজলহীন দুচোখে।
ছটফটে সাগরটা, আজ এক শান্ত দিঘী যেন,
আচ্ছা, আগের মতো আর চঞ্চলা নস কেন?
দেখা পেলাম বছর চারেক পর,
বছর চারেক বৃষ্টিহীন এ শহর।
ভীষণ খরায় রাস্তাগুলোও কর্কশ খটখটে,
আজকে যেন ভিজিয়ে দিলি কাঙ্খিত বর্ষাতে।
কপাল জুড়ে টিপ কি এখন রোজই পড়িস?
পাহাড় চূড়ার সূর্যটাকে মুঠোর মাঝে ভরিস?
চুলগুলো কী রোজ আকাশ খোলাই থাকে?
নাকি আগের মতোই পাহাড়ি খোপা সাজে?
আচ্ছা, তোর ওই অভ্যাসটা আজও আছে?
পছন্দের জিনিস আজও ছেড়ে আসিস?
নাকি, নতুন কারো ইচ্ছেজোরে বদলেছিস?
মিথ্যে শুনে এখনও উঠিস নাকি ক্ষেপে?
চোখ পাকিয়ে এখন, শাসন করিস কাকে?
খুব রাগেতে এখনো বুঝি, চোখ দু'টো যায় ভিজে?
এখন তোকে চিঠি লিখতে বলে কে রোজ?
হয়ত লিখিস, শুধু ঠিকানার নেই খোঁজ।
আচ্ছা, আগের মতো আর বৃষ্টি চাস না কেন?
তারার মাঝে উল্কা হয়ে হারিয়ে গেছিস যেন।
আমার প্রিয় আলতাটা আর পড়িস?
নাকি নতুন কারোর ইচ্ছেতেই চলিস?
এখন, কোন ঘরেতে সাঁঝের প্রদীপ জ্বালাস?
উলুর সাথে বিকেলের গা'য় সন্ধ্যেটাকে নামাস?
আমার প্রিয় হেমন্ত বাবুকে আজও শুনিস?
নাকি আজও মন কাড়ে বিলেতি এলভিস?
এখন বুঝি খুব গুছানো তুই?
অগোছালো নস মোটেই?
এ্যালার্জিটা কী আজও খুব জালায়?
বারণ ভেঙ্গে যাস নাকি, আর ধুলোয়?
ছুঁচিবায়ুর বাতিক টা নিশ্চয়ই আর নেই,
ভাল্লাগে আর দস্যিপনা ছেলেমানুষী সেই?
নতুন নিয়ে বের হলে, থামাস রিক্সা?
ব্রীজের ধারে ফুচকা চোখে এলে?
বাদল দিনে হঠাৎ কোথাও শব্দ হলে মেঘের,
গা' জড়িয়ে ধরিস হঠাতই তোর নতুনের?
তোর নতুনও কী আমার মতো,
কথায় কথায় রাগে?
খামচে ধরে শার্টের কলার,
চুমুতে ভরাস, রাগ নামাতে?
এখনো কি আকাশ মেঘলা হলে,
খুঁজিস এ বুক! মুখ গুঁজবি বলে?
রোদের দিনে ছাতা হয় কে তোর?
কেইবা অমন জড়িয়ে আদর করে?
একটা কিছু বলতে যাবার ছুঁতোয়
কেউ কি অমন ঠোঁট কামড়ে ধরে?
দেরী করে আজও আসিস নাকি?
নতুনও কি দাঁড়ায় প্রতীক্ষাতে?
এখনো কি হাই এ্যাম্বিসাস তুই?
বিদেশ ঘোরার শখটা আজও আছে?
সঙ্গোপনে অঙ্ক মেলাস জীবনটাকেে নিয়ে?
যার সামনে রিলেশনটা হেরে বসেছিল শেষে।
বছর চারেক আগলে বেঁচে থাকা,
একি বাঁচা? নাকি?
চিতার কাঠে রোজ নিজেকে সঁপা?
একটা তুইয়ের হারিয়ে যাবার শোকে,
আলো ছেড়ে হারিয়েছি আঁধারে।
আজও আমার শুণ্য ঘরে একলা থাকার বাতিক,
সাগরতটে বালির ফ্রেমে, একটা তুই বন্দী থাকিস।
দেখা হল শত মানুষের ভীড়ে,
অবাক হয়ে দেখলাম হারানো আগুনটিরে।
বলতে পারিস?
বুকের ভেতর, অক্ষি কোটর কার জন্য জ্বলে?
বছর চারেক বসে আছি ঠায়,
কারইবা অপেক্ষাতে!
দেখা হল বছর চারেক পর,
সেদিনের সেই আমি
এখনো তোর একার বর,
তোর একলার ঘর।।



'অনাকাঙ্ক্ষিত যদি'
 
ধরো, হঠাৎ যদি সাগর এসে দীঘির নরম শরীর
জাপটে ধরে?
এতো প্রেম সে রাখবে কী গো!
নাকি উথলে উঠে গৃ্হস্থালীর পাড় ডোবাবে?
সবাই তো আর চাঁদমুখী নয়, সূর্য রাখে মুঠোয় পুরে।।
হঠাৎ যদি একশো বাতাস ঝাউয়ের পাতায়
হল্লা করে?
এতো সুখ ধরবে কী গো কচি পাতায়!
নাকি ধুপ করে গাছ চালের উপর পড়বে ভেঙে ?
সবাই তো আর রেলগাড়ি নয়, হাজার বোঝা
তুলবে কাঁধে।।
হঠাৎ ধরো ছোট্ট রাস্তা, মিছিল এলো মেলা বড় দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে
এতো ক্ষোভ কী আঁটবে গো পথে!
নাকি, সেই সে অনল দু'ধারটুকু কুড়িয়ে নিয়ে রাজপ্রাসাদে বসবে গিয়ে,
সবাই তো আর পাথরবাঁধা তীর-কূল নয়, চওড়া নদী সামলে নিবে।।
হঠাৎ যদি হাজার খানেক রোগবালাই ছোট্ট দেহে
বাসা বাঁধে?
এতো বেদনা সে সইবে কী গো!
নাকি, অস্ত যাওয়া সূর্য হয়ে ছোট্ট দেহ পড়বে ঢলে?
সবাই তো আর তীর্থজল নয়, সকল পাপই দিবে ধুয়ে।।
অবহেলিত মন, ব্যস্ত জীবন, বিষাদ মরু শরীর জুড়ে
হঠাৎ যদি সামনে আসে প্রেম, রাস্তাটুকু আগলে ধরে?
একটানে হাত ছিনিয়ে নিয়ে ছুটতে থাকে আকাশ পানে
স্বপ্ন আঁকে ফাগুন ডেকে, স্বপ্ন আঁকে চোখের কোণে!
এতো বারিষ কী ধরবে গো দুটি আঁখি?
নাকি উপচে উঠে কাজল রেখা, ধানক্ষেত সারা
ভেজায় শেষে?
সবাই তো আর অশ্বত্থ নয়, রোদ্রটাকে নিংড়ে নিবে!
তবু ভালোবাসবে, শুধু ভালোবাসবে।।




'চিঠি-প্রিয় গঙ্গা কে
 
প্রিয় গঙ্গা,
চিঠি নয়, যেন বিরহের একটুকরো
রুমাল পেয়েছি তোমার।
তোমার হিমালয় এখন কেমন আছে,
জানতে ব্যাকুল তুমি।
আসলে, অনেক দিন হয়ে গেছে লেখা ছেড়েছি।
কলম ধরা হাতটি গুটিয়েছে বহু আগেই
বন্ধু সূর্যর প্রখরতায়।
এখন বেঁচে যাওয়া কমজোরি বাম হাতটি দিয়েই 'না করলেই না' 
এমন কাজগুলি চালিয়ে নিচ্ছি।
আর সূর্যকেই বা কি দুষবো বলো?
আমাদের সকলের মনিব, বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানী মানুষেরা যদি তাদের ভালোটা না বুঝে?
নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে যদি না জ্বালাত
সবুজের বেষ্টনী?
যদি বনের পর বন উজার করে কেড়ে না নিয়ে যেতো নিজেদের প্রাণ?
চারটে চাকার পেছন দিয়ে যদি না বেরুতো দাম্ভিকতার কালো কুৎসিত ধোঁয়া?
কলকারখানার বর্জ্যগুলি এসিডের মতো
যদি না নিক্ষেপ করতো অসহায় নদীর মুখে,
ঝলসে না দিতো নদীর খাঁজ কাটা চিবুক,
রুপালী বুকের চামড়াটা যদি আমাজনের পশ্চাদের গহীনের মতো অন্ধকার কুচকুচে
কালো না হয়ে যেতো?
হয়তো বন্ধু সূর্য এতোটা নীচে নেমে এসে
আমায় তার তীব্র উত্তাপে কিংবা তাপে,
পিতলের তাওয়ায় বাদাম ভাজার মতো
ভেজে ফেলতো না।
আচ্ছা, বলোতো? আমি কি তাপ নিয়ে উত্তাপ বিলাচ্ছি সারা পৃথিবীময়?
সে বোধটাও ইদানীং ভীষণ ঘোলাটে মনে হয়।
বলি বলি করেও তোমায় বলা হয়নি গঙ্গা,
ইদানীং জ্বরটা বারো মাসই গিলে খাচ্ছে আমায়।
নিজেকে, এখন আর হিমালয় বলে পরিচিত করাতে লজ্জা বোধ করি।
অনেকেই প্রশ্ন করে, "কি বলো! তুমিই কি সেই? সেই সুউচ্চ হিমালয়?
 যার উচ্চতার অভিযোগ তুলে মেঘের রাজাও বলতেন যে, 
আকাশের পর্দা ভেদ করে হিমালয় প্রায়ই উঁকি মারত তার অন্দরমহলে।
কিন্তু এ খর্বাকৃতি নিয়ে তা কি করে সম্ভব?"
আচ্ছা! আমি কি করে বলি বলতো যে, প্রতি মুহুর্তে 
একটু একটু করে মানুষ নামের অমানুষেরা লুটে নিয়ে যাচ্ছে আমার দম্ভ, আমার উচ্চতা।
পুড়ে যাওয়া মোমের মতোই গলে গলে পড়ছি আমি প্রতিনিয়ত।
আর সভা-সমিতিতে সুযোগ পেলেই বিজ্ঞ মানুষেরা হাঁকছে বড় বড় বুলি।
আমার উপর পরীক্ষা নীরিক্ষা চালিয়ে হাতিয়ে নিয়ে গেলো কতোজনে কতো ডক্টরেট ডিগ্রি!
অথচ দিন শেষে আমি মিটিংয়ে সমাবেশে চাপড়ানো হাততালি। কিংবা,
নিন্দের টেবিলের কুকিজ বিস্কুট সেজেই থেকে গেলাম।
যাক স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই বলে চলেছি।
তবে, তোমার খোঁজ যে একেবারেই রাখিনা, তা নয়।
সময়ের সাথে সাথে বয়স্কা হয়েছ তুমি,
গায়ের রঙ চটেছে।
চোখের মণির নীলাভ ছটায় কালচে
ছানি পড়েছে আজ।
ইদানীং একেবারেই ঠান্ডা সহ্য করতে পারো না তুমি।
অল্পতেই সর্দিকাশি বাধিয়ে বসছ।
কেমন যেন ভীষণ রোগাটে হয়ে গেছ,
পাঁজরের হাড় বেরিয়ে এসেছে চামড়ার উপর।
স্রোতস্বিনী তেজদীপ্ত ছিপছিপে তরুণীটি মলিন হয়েছে কালের আবর্তনে।
এখন সেই তারুণ্যতাকে জোর করে প্রাসাদ বন্দিনী করেছে ওরা।
মানুষের ঘরের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাচ্ছে তা।
তার উপর আবার, তোমার বুকের বিস্তর জায়গা জুড়ে চর, মানুষের অবহেলা,
আর তোমার শাড়ির পাড় ঘেঁষে ঘরবাড়ি তুলবার কথা থাকলেও, 
ওরা তোমার কোমর পর্যন্ত চালিয়েছে দখলদারিত্বের আগ্রাসন।
হাঁপানির থুরথুরে বৃদ্ধার মতোই বিছানাগত তুমি।
এ দৃশ্য কি চোখে দেখা যায়?
কি করে মেনে নেব এ দুর্দশা তোমার?
দায়ী কে বা কারা এর জন্য?
কার উপর তোমার এ অভিমান?
মানুষ? এ পৃথিবীতে কি আজ মানুষের মাঝে কোন মানুষ দেখতে পাওয়া যায়?
সত্যিই কি এ প্রজাতিটি বেঁচে আছে?
নাকি ওরাও আমাদেরই মতো ধ্বংস
অপেক্ষাতে মগ্ন?
ইতি-
তোমার পুরোনো হিমালয়।। 
 
 
 
'অবেলার ফাগুন
 
ভুলই তো, বলো এসব কী ভুল নয়!
শ্যাওলার শামুককে কেউ যদি তুলে এনে
ইরানী কার্পেটে মোড়া আর পারস্যের দামী
ঝাড়বাতিতে ঝলমলে বসার ঘরের
সোকেসে সাজিয়ে রাখে,
সম্মান দেয়! সে কী ভুল নয়! ভুলই তো।
অর্ধেক জীবন পার করে আসা এক কঙ্কালসার,
রুগ্ন, জীর্ণ, শীর্ণকায় বেলুনপীড়া যদি কভু জানতে পারে যে, 
সোলায়মানের গুপ্তধনের মতই লোভনীয়
সে, কোন এক দুর্ধর্ষ জলদস্যুর নিকট?
যদি তাকে ছিনিয়ে নিতে গৃহস্থের সাথে বেজে
ওঠে যুদ্ধের দামামা?
যদি তাতে অকাতরে প্রাণ দিতে না নিতে
পিছুপা না হয় সেই জলদস্যু?
আজীবন অবহেলায় পোড়া মানুষের কী এসব আদিখ্যেতা মানায়?
এসব, এতোসব কিছু কী তার বিশ্বাস হবে?
এ কী অবেলার ফাগুন নয় বলো, তার কাছে?
কেন আজ তার ঘরের আয়না অন্যরকম লাগে?
কেন কেউ পেছন হতে এসে ফিসফিস করে
কানে ঢেলে দেয়-
"সূচনা, টিপ পড় টিপ পড়। বড় সুন্দর লাগবে।
কাজল আঁক, শান বাঁধাও দুই পদ্ম ঝিলে।
চেয়ে দেখ আকাশের ছায়া নেমেছে তাতে।
ঠোঁটে ঘষ রক্ত জবা। তারপর ঘুড়ে দাঁড়াও
মুখোমুখি হয়ে।।"
 


মেঘের উপরে মেঘ'
 
তোমার চিঠিতে-
তুমি আজ ফের আকাশের নিকট হতে
মেঘ ছিঁড়ে আনবার ফরমায়েশ করেছ।
মন খারাপ হলেই তুমি এই জিদটা ধরো।
আমি দু'ডানায় ভর দিয়ে
উঠলাম আকাশ তরে।
এতো রকমের মেঘের মাঝে বাছাই করা দুরুহ
সবচে' পছন্দসই মেঘটার কাছে যেতেই দেখি,
আমায় দেখে অক্টোপাসের মতো কালো কালি
ছুঁড়ে রঙ বদলেছে সে,
নতুন, অপরিচিত কেউ এখন,
যেন কোন এক জামাইকান কিশোরীর
সিঁথিহীন কোঁকড়ান কেশ সুদূরে ছড়ানো রয়েছে।
অন্য আরেকটা প্রতিবেশী মেরুন বর্ণা উৎসুক মেঘ
নতুন অতিথি ভেবে দেখতে এলো আমায়।
তার সমস্ত গা থেকে ঠিকরে পড়ছে
ভোরের প্রথম সূর্য কিরণ,
মনেহলো, যেন শীতের রাণী দোপাটি
লালচে গোলাপী মিশ্রিত একটা আভা ছড়ায়ে।
আর সেটা ছিল আকাশের উপরে আরেক আকাশে।
মেঘের উপরে আরেক মেঘ।
এ যেন বিশ্ব বিখ্যাত কবিদের কবিতারা,
লাইব্রেরীর বিভিন্ন সেলফ জুড়ে একটার উপর আরেকটা সাজানো রয়েছে।
কি অনাবিল সুন্দর!
কি অপার মুগ্ধতা!
অসীমের এ সৌন্দর্যতা মহাসমুদ্রের প্রাণী
বৈচিত্রকেও হার মানায় যেন।।
আমি বললাম,
"তোমরা কারা? কি পরিচয়?"
ওরা হেসেই খুন। বলে, "আরে চিনতে পারলে না?
দূর থেকে আজ কাছে এলে, তাই হয়তোবা
অপরিচিত মনে করছ। আমরা দুটি বোন।
একজন আকাশের গায়ে লেপটে থেকে
কবির মনের ক্ষুধা মেটায়।
আরেকজন, মাটিতে আছড়ে পড়ে
অন্নপূর্ণা প্রস্তুতে ব্যস্ত সদায়।।"





'ব্রেক-আপ
 
হুটহাট করেই চলে যেতে পারতে।
কোন কিছু না বলে, হঠাৎ ভুলে গেলেও
বিশেষ অবাক হতাম না।
আজকাল এ সবেরই চলন।
অভ্যাস হয়ে গেছে দেখে দেখে।
তবে, তুমি আর দশজনের মতো নও,
ধীরে ধীরেই মুছে ফেলেছ আমায়।
তোমার ছুঁড়ে দেয়া ব্রেকাপটাও
বেশ জাঁকিয়ে পাইথনের মতই
একটু একটু করেই গিলে খেয়েছে আমায়।
এখন আজ আমি নগ্ন পায়ের এক প্রাক্তন।
এই তো, আমাদের ব্রেকাপের বেশ কিছুদিন আগেই 
তুমি বিরক্ত হতে শুরু করেছিলে
আমার ম্যাসেজগুলো পড়ে।
দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকতো ওরা
তোমার অবহেলার বারান্দায়।
অথচ তুমি জানতে, কী ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ি আমি, 
তোমার প্রতি মুহুর্তের খবর না পেলে।
খুঁজে না পাওয়া সিরিঞ্জের জন্য পেথেড্রিনে আসক্তের 
সারা ঘর উলট পালট করে হন্যে হয়ে খোঁজার মতই সে অস্থিরতা।
মুখের ওপর দরজা হয়তো তুমি লাগাও নি,
তবে রোজ ছবি দেয়াটা বন্ধ করেছিলে আরও আগেই।
অথচ, তুমি ভালো করেই জানতে যে
বেলা গড়ানোর প্রান্তে সূর্যের রঙের বদলের
সাথে সাথে তার প্রতিচ্ছবি তোমার চেহারায় দেখাটা অভ্যাস আমার।
তোমার সাথে রাত জাগাটা তোমারই শেখানো ছিলো,
কোনদিন কি আমি একবারও বলেছি যে, সারাদিন ক্যাম্পাস 
আর টিউশনির বোঝা মাথায় নিয়ে আমি ক্লান্ত, বড্ড পরিশ্রান্ত।
অথচ, আজ যখন আমার সূর্যর মুখ দর্শন না করে ঘুম আসেনা,
তোমার বাপির বকা, পরীক্ষার পড়া, মাথা ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি
 কতো কতো বাহানা আমায় উপেক্ষা করবার।
আর আমিও কি যে বোকা ছিলাম, জেদ ধরে বসতাম অবুঝের মতো।
এখন সবই বুঝি, আসলে এগুলো হচ্ছে ব্রেকাপের পূর্ব লক্ষ্মণ।
সেদিন তো মুখের ওপরে বলেই ফেললে
সোনা, জান, বাবু ডাকগুলি বড্ড ন্যাকা ন্যাকা
মনে হয় ইদানীং তোমার।
অথচ একসময় তুমি শুধু আমার 'এইইইইই' শব্দতটাতেই 
সুনীলের প্রেমময় কাব্য খুঁজে পেতে।
এসব কী আমি বলেছিলাম? আমার কথা?
এইতো সেদিন, দেখেও না দেখার ভান করলে,
স্পষ্টতই এড়িয়ে গেলে।
আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, অথচ তুমি!
নির্লজ্জের মতো অন্যদের সাথে হাত নেড়ে নেড়ে
 কথা বলতে বলতে দূর হতে সুদূর চলে গেলে।
কথায় কথায় গান পাঠানো,
কিছু কেনাকাটার আগে ছবি দেখিয়ে আমার পছন্দকে প্রাধাণ্য দেয়া,
বৃষ্টি এলেই রিক্সার খোলা হুডে ঘুরে বেড়ানোর জেদ,
সিনেপ্লেক্সের আঁধারে হাত জড়িয়ে ধরে বসে থাকা,
ক্যাম্পাসে ঘন্টার পর ঘন্টা আমার ক্লাস শেষ হবার জন্য অপেক্ষা,
প্রতি মর্ণিং এ সুপ্রভাত উইশ, নাইটে শুভ রাত্রির বাধ্যতামূলক অভিবাদন,
তোমার পরিবারে ঘটে যাওয়া যেকোনো খবর আমায় জানানো,
পুরনো সব ভালো লাগাই আজ অচেনা হয়েছে।
এখন এগুলো বড্ড গা ঘিনঘিনে তোমার কাছে।
আর হবেই বা না কেন?
ব্রেকাপের ভাইরাসে ধরেছে যে তোমাকে।
তা না হলে, কি করে পারলে বলতে যে,
এটা তোমার পরিবার?
এগুলো তোমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার?
এক ধাক্কায় বের করে দিলে তুমি আমায়,
তোমার পরিবারের সদস্য লিস্টি থেকে!
আমি পাশে থাকতেও, কি করে তুমি আড় চোখে দেখলে অন্য কাউকে?
কি করে আমার মুখের উপর আরেকজনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলে তুমি?
আজকাল আর নোট চাইতেও আসো না তুমি।
এখন তোমার চারপাশে ব্রিলিয়ান্টদের আনাগোনা।
ব্রেকাপের শুরুর দিকেও, অন্তত এ বাহানাতে দেখা পেতাম তোমার।
একবার রিক্সায় যেতে যেতে কি যে হলো তোমার, 
কবরস্থান দেখিয়ে অতি আবেগী হয়ে বলে উঠলে,
আমাদের কবর যেন এক কবরেই হয়,
আমায় ছাড়া এক মুহুর্তও নাকি তুমি থাকতে পারো না, 
এমনকি পরোপারেও না।
আমি তো হেসে কুটিকুটি।
আদরে জড়িয়ে নিয়ে বললাম, "আচ্ছা বাবা তাই হবে। 
 মরার পরেও হাড় মাস জ্বালিয়ে খেও।"
মানুষ কি এতটা কথার ছলে কথা বলতে পারে?
ইদানীং এ কথাগুলো বড় জ্বালায়।
কেন বলতো? ব্রেক-আপ তো সেই কবেই হয়ে গেছে।
আমাদের গল্পটা অমীমাংসিত রেখেই
নটে গাছটিও মুড়ে গেছে।
তবু, ব্রেক-আপ শব্দটা কি সব স্মৃতি
মুছে দিতে পারে?
তাহলে, তোমায় মুছে দেখাক
আমার জীবন থেকে।।






'বাবা নামের বটবৃক্ষ 
 
সনঃ ১৯শে অক্টোবর, ২০১৭ ইং
,
ছুটে নীচে নেমেছিলাম সেদিন
বন্ধু জুনিয়র হেনরি উইলিয়ামের ডাকে
নিছক পানশালার উছিলা ভেবে।
ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি ও'আমায় নিয়ে যাবে,
ওয়েস্ট হ্যাম্পশায়ারের প্রাচীনতম গ্রেভ ইয়ার্ডে!
ঝড় সমাপ্তির পরে মেঘলা আকাশের মতো
থমথমে নীরবতা ছিলো সারি সারি টোম্বগুলোতে।
আকাশ ভেঙে হামাগুড়ি দিয়ে ঝরতে চাইছিল
মেঘের জল ফোঁটা।
পেছনের ইউক্যালিপটাস আর উইলোর বন থেকে 
ভেসে আসছিল মিষ্টি একটা মৃত্যুঞ্জয়ী গন্ধ।
চেনা চঞ্চল হেনরিকে দেখলাম অচেনার
গাম্ভীর্যে সেদিন।
ব্যাকব্রাশ চুলে পরিপাটি জেল,
মিশমিশে স্লেট কালো ফুনেরাল স্যুট,
বুক পকেটে সাদা চৈনিক গোলাপে ঈর্ষা জাগানীয়া 
হ্যান্ডসাম হেনরি আর আমি হাঁটতে হাঁটতে
সিমেট্রির একটা টোম্বের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
এপিটাফে লেখা ছিলো "এখানে চির নিদ্রায়
শান্তির সাথে শায়িত আছেন স্যার জন উইলিয়ামস"
অর্কিড আর টিউলিপের বুকেটটা টোম্বের
বুকে রাখলো হেনরি।
জিজ্ঞেস করলাম "উনি?"
অফিশিয়াল পত্রের জবাব এলো যেন,
"লেট স্যার জন উইলিয়ামস, আমায় দশ বছর
বয়সে পিতৃহারা করা আমার বাবা।"
তারপর নিঃশব্দে পাঁচ মিনিট মনে মনে প্রার্থনা করে গেলো একনাগাড়ে।
অঝোর ধারায় ঝরতে লাগলো তার চোখের পানি সমেত 
বুকফাটা আর্তনাদ, হাহাকার।
বিমুগ্ধ হয়ে অবলোকন করতে থাকলাম,
সেই শাশ্বত বিরল অশ্রুধারার সৌন্দর্যতা।
বুঝলাম, আধুনিকতার প্যাকেটে মোড়া এ সমাজে,
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা মানুষ,
ধর্ম, জাত,পাত, দেশ, ক্লিষ্টি, সংস্কৃতি ভেদে
'বাবা' নামক সেই আবেগের জায়গাটা
আদতে অবিকল একই রকম।
এর কোন ক্ষেত্র বিশেষ নেই।
হেনরির সেই বাঁধ ভাঙা কান্নার জলে জ্বলে উঠলো আমার
 ভেতর অন্য এক আমি সেদিন।
নিজের প্রতি ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠলো মন,
"হায়!! এ আমি কি করেছি! কি হারিয়েছি!
এতোদিন আমি?"
এক ছুটে বের হয়ে আসলাম সিমেট্রি থেকে।
পকেট হাতড়ে বের করলাম সেল ফোন।
"হ্যালো? হ্যালো? বাবা? বাবা?"
ওপাশ থেকে রোজকার মতো মায়ের গলা
ভেসে আসতেই বললাম,
"মা। নাহ, আজ আমি সবার আগে বাবার সাথে
কথা বলতে চাই। একটু দিবে?
আমার একটু খোঁজ খবর পাবার আশায়
কতকাল উনি টেলিফোনের পাশে রেশন
লাইনের মতো সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়েছে!
অথচ এই আমি! সময় আর খরচার অজুহাত
তুলে শুধু অবহেলায় করে গেছি।"
শৈশবের, কৈশোরের হাজারো এ্যালবামগুলি,
আজ অবজ্ঞার গুহ্বর থেকে
মাকড়সার জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে।
কন কনে শীতের রাত, মেঝেতে মাদুর পাতা।
মাদুরের উপরে শুতে তুমি ,
আর আমাদের রাখতে জাজিম তোষকের চৌকিতে।
রাতভোর এপাশ ওপাশ করে কাটাতে।
জিজ্ঞেস করলেই বলতে "বাবা তোদের ঠান্ডা
লাগছে না তো? এ চিন্তায় ঘুমোতে দেয় না রে বাবা।"
বারবার উঠে এসে এসে আমাদের গায়ে লেপ, কাঁথা ঠিক করে দিতে।
অথচ, সেই আজ আমি দামী ম্যট্রেসে শুয়ে,
আর শুধুই রুগ্ন মেঝের স্বান্তনা বাবা পেয়েছ।।
ভীষণ রাগী ছিলে তুমি বাবা,
তোমার মনে মনে আছে বাবা?
রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া টাকায় আইসক্রিম কিনে
খেয়েছিলাম বলে, তুমি চড় মেরে চোখের
কোণায় রক্ত জমিয়ে দিয়েছিলে?
তারপর আবার বুকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না তোমার, 
এ হাসপাতাল ও'হাসপাতাল করতে করতে একশেষ।
অথচ, আমি তোমার সেই কান্না, আহাজারি আর আমার
 কৃত ভুলকে বেমালুম ভুলে গিয়ে চড়টাকেই বুকে আগলে বেড়ে উঠেছি।
ঠিক যেমন, বেলকনির পাশের স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় 
মানিপ্ল্যান্টটির বুকভরা আলো-বাতাস কমতির অভিযোগের অঙ্গুলি গৃহস্থের দিকে।
অথচ, সে কোনদিনও হয়তো জানতেও পারবে না স্যাঁতস্যাঁতে 
পরিবেশটাই তার বেড়ে ওঠার মূলে।।
আজ, আমিও এক বাবা হয়ে বুঝি,
বাবা হতে হয় কতোটা বলিদান কতোটা
আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে।
আমাদের গায়ে নতুন জামা চড়াতে গিয়ে, কোন ঈদ পরোবে
 নিজের জন্য কিচ্ছু কিনতে পারোনি।
চাঁদ রাত এলেই মা কে দেখতাম, তোমার পুরনো পাঞ্জাবির 
ছিঁড়ে যাওয়া অংশগুলি রিপু করতে। ইয়ার্কির ছলে বলতাম, "কি মা?
 তোমার অপারেশন স্টার্ট হয়ে গেছে?" লজ্জায় মাথা নীচু করতে তুমি।
দেশে তখন দিন বদলের হাওয়া বইছে।
মানুষ্য দক্ষতার উপর নির্ভরতা কমিয়ে
সকলে ঝুঁকছে মেশিনারিজ আর
কম্পিউটারের উপর। তোমাকে কাজ দিবে কে?
রোদে পুড়ে, আষাঢ়ের বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে
পরিবারের মুখে দু'বেলা অন্ন জোগাতে গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে 
হুপিংকাশি বাঁধিয়ে ফেললে সেবার।
সামান্য কিছু টাকার অভাবে দীর্ঘদিন
ঝোপঝাড়ের জরিবুটি খেয়ে পার করেছ
অজস্র না ঘুমানো কষ্টকর রাত।
অথচ,
একবেলা মাছ, মুরগী তরকারির লিস্ট থেকে ছুটলেই, 
'অকর্মণ্য অলস' বলে কতো অশ্রাব্য ব্যবহার করেছি তোমার সাথে।
পাওনাদাররা বাসায় উঠে এলেই, বকা ঝকা করেছি কতো তোমায়!
অথচ এসব ঋণের সিংহভাগই আমাদের উদ্দেশ্যেই করেছিলে।
যখন তোমার ব্যবসার চরম দূর্দিন,
পরিবারটার একচিলতে সুখের জন্য,
একটু হাসি হাসি মুখ দেখবে বলে,
দিনের পর দিন লুকিয়ে লুকিয়ে ব্লাড ব্যাংকে
রক্ত বেচে বেড়িয়েছ।
অথচ সেই আমরাই ঘৃণা করে বলেছি কতোবার
"জন্ম দিয়েছ, আর ভাত-কাপড়,
আরাম-আয়েসের জীবন দিতে পারো না?
কেন জন্ম দিয়েছিলে তাহলে?"
ছিঃ! এ আমি কি করেছি?
সেসময় হয়তো তোমার মরে যেতে ইচ্ছে হতো বাবা!
তবুও আশ্চর্যভাবে আমাদেরকে হাসি মুখে বুঝাতে
সব কিছু।
মায়ের মুখে শুনলাম,
সুগার কন্ট্রোল না করতে পেরে তুৃমি ইদানীং হাঁটাচলা বন্ধ করে দিয়েছ বাবা, 
পায়ের ব্যাথায়।
ছ'মাস পরপর দামী গাড়ির মডেল চেন্জ করা
এন আর বি এই আমি, সামান্য কিছু টাকা ভিক্ষের মতো ছিটিয়ে দিয়ে বলেছি,
"বাবা কে কাছে পিঠে কোন কম দামী ডাক্তার দেখিয়ে নিও মা, 
বয়স হয়েছে, রোগবালাই তো হবেই, ও'এমনিতেই সেরে যাবে।"
এখন মনে হচ্ছে বাবা,
হাঁটুর নীচ থেকে নিজের পাদু’টো কেটে তোমার পায়ে জোড়া 
লাগিয়ে দিলেও তোমার হাত ধরে হাঁটা শেখানোর সে ঋণই শোধ করতে
পারবো না কোনদিনই।
মাথায় ভূত চাপলো, বার-এট-লয়ের।
তুমি বললে, "আমার পাগলা ব্যাটা যখন ইচ্ছে করেছে, জরুর মিলেগা"।
বাপ-দাদার ভিটে মাটি বিক্রির সমস্ত টাকা তুলে দিয়েছিলে আমার হাতে।
আমার মাথার উপর ছাদ গড়তে নিজেদের গৃহহীন করতেও এতোটুকু কুন্ঠা বোধ করোনি।
আজ, এইযে বাবা, তোমার ছেলে লন্ডনের বড় বড় কর্পোরেট ক্লায়েন্টের মালিক,
অর্থ আর মিথ্যে জৌলুসে ধরা কে সরা জ্ঞান
করে ফিরছি, এ জীবনটাও তোমারই দেয়া।
অথচ, কি অকপটে তোমায় দিনের পর দিন
ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছি এতোদিন!
কোনদিনই তোমাকে, তোমার আবেগ, কষ্ট,
শারিরীক অক্ষমতাগুলিকে বুঝতে পারিনি।
আর সেই তুমি, ক্ষমার পর ক্ষমা করে গেছ অযোগ্যদের।
বাবা? বাবা হতে গেলেই কি এমন ক্ষমা করে
যেতে হবে আজীবন?
আর এমনই মুখ বুঁজে কী সয়ে যেতে হবে
গায়ের মাংস কেটে, রক্ত পানি করে,
হাড়ভাঙা পরিশ্রমের দ্বারা বড় করে তোলা বেঈমান সন্তানদের সমস্ত অন্যায়, 
অবিচার, অবহেলা?
কেন বাবা নামের বটবৃক্ষর ছায়ায় বেড়ে ওঠা
মানুষ নামের জানোয়ারেরা উদ্যত হয় সেই
বটবৃক্ষকে তাদের হিংস্র থাবায় চিরতরে শান্ত
করে দেবার জন্য?
কেন তারা ভুলে যায়, আজকের এই শিশুই
আগামীর বাবা?
আগামীতে বাবা কিংবা বটবৃক্ষ?
হায় মানুষ, যদি তুমি তোমার ভবিষ্যৎ দেখতে পেতে?
দেখতে পেতে তোমার সন্তানের হাতে কি
নির্মমভাবে তুমি অবহেলিত হচ্ছ!
নির্মমভাবে প্রতিক্ষণে ক্ষণে তুমি
মৃত্যু বরণ করছ।।



আরেকবার, বিচ্ছেদের পরে
 
তুই কেমন করে এমন হলি?
কেমন করে এতো রাগ জমালি আমার ওপর?
একবারও কী পড়েনা মনে তোর?
কিভাবে আমার দিন কেটে যায়? রাত্রি পোড়ে?
কেমনে আমার সুখের বুকে পাথর চাপা, দুঃখ উড়ে?
কেমন করে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ বুকে পুরে জেগে আছে এক নির্জনতা?
ঘুণে খাওয়ার আশায় কতোটা সমুচিত এভাবে
ফেলে যাওয়াটা?
এখন আর সারপ্রাইজ দিস না কাওকে?
অমুক ডে তমুক ডে'র বাহানায় দিস না কাউকে
খুশী করে?
আচমকা চমকে দিতে পারিস না একবার ফিরে এসে?
প্রথম দিকে টেলিফোন বাজলেই ছোঁ মেরে
তুলতাম এসব ভেবে।
"হ্যালো হ্যালো ওহ না রঙ নাম্বার" বলে বলে রেখে দেই।
দু'চোখের তারার ছানি জানে সদর দুয়োরে নজর টিকিয়ে 
বসে থাকাটা কতোটা হতাশাব্যঞ্জক।
কুয়াশায় অরণ্যের ঘোলাটে চোখ, জৈষ্ঠ্যের শুকনো ঠোঁট নিয়ে ধুঁকে মরছি।
প্রতীক্ষায় বসে থাকতে থাকতে বেতের সোফা আর 
মেঝের টাইলস ভেদ করে আমার শেকড় গিয়ে ঠেকেছে পাতালপুরীর নরকে।
হাজার বছর ধরে এক ভুতুড়ে জাহাজ আমি
অপেক্ষার সমুদ্রে ভেসেই চলেছি এমাথা থেকে ওমাথা।
হায় ঈশ্বর! বিচ্ছেদ কী এতোই যন্ত্রণাদায়ক হয়?
তুমিই বলো, এভাবে রোমহর্ষক রক্তচোষার ধুকেধুকে 
মৃত্যুর চে' কী এক পলকের প্রাণনাশ অনেক আরামদায়ক নয়?
কয়েক টুকরো কাগজের কী এতোটাই তাণ্ডব?
আমাদের কাটানো সহস্র সহস্র রজনী
কী এতোটাই ব্যর্থ?
তুই কেমন করে এমন হলি, বল?
এখন কী আমার বিপির অস্থিরতা, হাই সুগার
চিন্তার রেখাপাত করেনা তোর কপালে?
বুবলি আর বাবুন সোনারা এখন কেমন আছে?
এখনও রাত জাগালে কাকে খুঁজিস তুই ঘুমের ঘোরে?
ওদের বাবাকে খোঁজে না ওরা কখনো?
এখন ঘোড়া সাজে কে ওদের?
কার বুকে পা রেখে বুবলি মাথা ছোঁয় ছাদের?
এইসব বোধের দিনে জানতে চায়নি,
কেন ওদের এই অপ্রাপ্তির অভিশপ্ত জীবন?
তুই কী ফেরিওয়ালার কাচের বাক্সের মত খুলে দিয়েছিস আমার সব ভুলের খবর?
ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায় ভরিয়েছিস তাদেরও ভেতর?
ইদানীং খুব বদলে ফেলেছিস হয়তো নিজেকে
থমকে আছি শুধুই আমি একটা খামের শেষে।
আয় না, আরেকটিবার চেষ্টা করি, আয় না ফিরে।
নতুন করে আয় না ফিরে, পুরোনো সুখের নীড়ে।
আয় না আবার দুয়ে মিলে এক হই।
চল কাঁচা আম কাসুন্দি মেখে খায় স্কুল গেটের সম্মুখে
রাস্তারলোকেরা বেহায়া বলবে, বলুক। তবু হাতটা ধরতে দে।
চল যায় উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তায় বা ছেঁড়া দ্বীপ,
যেখানে অথৈ সমুদ্রের রঙ গাঢ় সবুজ, যার বুকে
কাশ রঙা বালিয়াড়ি চোখ মেলে বসেছে,
চল তার বুকে খালি পায়ে হল্লা করে ছুটি।
আবার যদি স্নানে নামিস, আমিও নামবো তোর সাথে
বিচ্ছেদ কতোটা মর্মস্পর্শী তা মৃত্যুভয়ও জেনে গেছে।।




বৃষ্টি নামে ডাকত তাকে

বৃষ্টি ছিলো তার ডাকনাম, বৃষ্টি।
উঁচু উঁচু অট্টালিকা, মাট-ঘাট পেরিয়ে
হিজল-তমালের মাথা ছাড়িয়ে
দূর গগনের বন্দিনী ছিলো সে।
মেঘালয়া প্রাসাদ ছিলো,
আয়নার কাচের মতো ঝিকিমিকি তারা ছিলো।
ছিলো নক্ষত্ররাজের দেয়া শাপলা ঝিল।
মাঝেমধ্যে কুমড়ো ফুলের মতো,
ঝুমকো দুলের মতো দলবলসমেত
উল্কাণুরও দেখা মিলত।
উনুনের আঁচে তেঁতুল খড়ির
স্ফুলিঙ্গের মতনই দ্যুতি চারিদিকে ছড়িয়ে
পড়ত সেই মিছিলের শেষ ভাগ দিয়ে।
তবু কেন জানি বিষাদময় একঘেয়ে সবকিছুই।
বৃষ্টি নামে ডাকত তাকে সবাই।
আয়নাহীন এক প্রাসাদবাসিনী সে।
শুধুই কল্পরাজ্যের মাঝেই বেড়ে ওঠা।
পুকুরপাড়হীন পাকুড় যেমন কস্মিনকালেও
শোনেনি তার নিজ রুপের প্রশংসা।
তেমনই নিজেকে দেখতে কেমন
জানতে পারেনি কখনো মেয়েটা।
আশেপাশের গুরুগম্ভীর সবাইকে জিজ্ঞেস
করলেই , তারা বলতো-
"বেশ তো, চলার মতনই। শোন মেয়ে রুপে নয়, গুণে অধিক মনযোগী হও"
নদীতে খেলে যাওয়া ঢেউয়ের নতনই অঙ্গ ছিলো তার।
বৃষ্টি বলেই ডাকত সবাই।
অদম্য ইচ্ছে ছিলো মেয়েটির নানা দেশ দেখবার।
অথচ, জানো? পা ছিলো না মেয়েটির।
হাঁটতে শিখেনি সে কোনদিনই।
কোথাও যে একটু বেরুবে,
ঘুড়বে-ফিরবে তার জো' নেই।
প্রাসাদের গা জুড়ে কামানের গোলার
সমান বড় বড় মনখারপের গর্ত।
সেগুলি দিয়ে নীচে মনমরা হয়ে তাকিয়ে থাকত সে।
নীচে মাটি, নীচে মাঠ
শুষ্ক ঠোঁট অগ্নি কাঠ।
শুকনো খাল, জলহীন পুকুর
বৃক্ষজাত ওষ্ঠাগত, কড়া দুপুর।
কোটি প্রাণের একটি আশার বাণী
বিবর্ণতা ঘুচাবে স্বয়ং বৃষ্টিরাণী।
হঠাৎই আকাশ যোদ্ধাদের শুরু হলো
এলোমেলো ছোটাছুটি।
এদিক সেদিককার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
সৈন্য সামন্তরা এক হয়ে দিলে ব্যারিকেড।
সবাই ভীত সন্ত্রস্ত।
শত্রু-সেনাপতি মেঘের ঘনঘটা
আকাশের দ্বারপ্রান্তে।
সঙ্গী আছে শ্রাবণ ও আষাঢ়।
আর হয়তো রক্ষে নেই দয়ামায়াহীন
ভয়ানক চেহারার কুচকুচে কালো
মেঘের কাছ থেকে !
পরাস্ত সৈন্য সামন্তদের দেখে
নিজ সত্ত্বাহীন, চলাফেরাহীন বৃষ্টি
ভয়ে কাঁপছে থর থর।
দূর হতে দেখা যাচ্ছে ধুলোর ঝড় সাথে নিয়ে
জাম রঙা মিশমিশে কালো ঘোড়ায় চেপে
ঘর দুয়োরহীন ভবঘুরে মেঘ আসছে ধেয়ে।
সকলকে পরাহত করে মেঘ কে
একটানে নিজ ঘোড়ার পেছনে বসিয়ে ছুটলো সে।
এই প্রথম বৃষ্টি একটি ছেলের হাতের ছোঁয়া পেলো
এই প্রথম মেয়েটির পরিচয় পেলো
পুরুষালি একটা শক্ত বুকের মধ্যেকার
নরম তুলতুলে হৃদয়টির।
বৃষ্টিকে হতভম্ব করে দিয়ে নিজ বুকে পুরে
মাটির টানে আছড়ে পড়লো দুজনে ভূপৃষ্ঠে।
ঝমঝমিয়ে নামলো তারা
বৃষ্টি এলো কদম তলায়।
ঝিলমিলিয়ে উঠল হেসে
সবুজ পাতা গাছের ডগায়।
বৃষ্টি এলো বৃষ্টি এলো
কালো মেঘের ঘোড়ায় চেপে
কুলুকুলু নদী ঐ বয়ে যায়
ধীতান ধীতান নেচে গেয়ে।
বৃষ্টি এলো বৃষ্টি এলো
মাটির সোঁদা গন্ধ উড়ে
ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে বৃষ্টি
টিনের চালের বাজনা জুড়ে।
শতবর্ষীয় সেই উপেক্ষিত প্রশ্নটা,
হঠাৎই মেঘকে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটি
"আচ্ছা মেঘ আমি দেখতে কেমন?
কী বর্ণ আমার?"
মেঘ বললে, "সত্যিই জানতে চাও?
অনিন্দ্য সৌন্দর্য তোমার।
অপলক চেয়ে থাকার মতই।
বিশ্বাস না হয় তবে দেখ
ওই সবুজ পাতাদের, পিয়াজ রঙা মাটি,
পদ্ম ফোটা ঝিল,
কিংবা চাঁদির মতো চকচকে টিনের চাল
অথবা ধরো শুভ্রতার কদম, সবুজের ক্ষেত, অরণ্য।
সবেই তুমি মেখে আছ। সবই তোমার বর্ণ।
জলতরঙ্গের মতই মিষ্টি তোমার কন্ঠ।"
"আর হ্যাঁ শোন, বৃষ্টি নামের মেয়ে,
এখন থেকে আমার সঙ্গেই থাকবে তুমি
আমার সাথেই ঘুড়ে বেড়াবে আকাশের
এ মাথা থেকে ও'মাথা পর্যন্ত।
ইচ্ছে হলেই, পুকুর ঝাঁপানো কিশোরের
মতই আমরাও ছুটে আসবো মাটির কাছে।
এখন থেকে আমার তোমার আজনমের সাথ।
আজন্ম ভাব, ঘর বাঁধা আর আজনমের সংসার।
মনে থাকবে তো?"
একথাগুলি এতো সুন্দর করে কেউ বলেনি তাকে আগে।
একথাগুলির জন্য যেন বৃষ্টির শতবর্ষীয় অপেক্ষার আসর।
ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলা বৃষ্টি মুখ লুকালে মেঘের অন্তরে।
সেই থেকে মেঘ দেখলেই আমরা জুড়ে দেই বৃষ্টির নাম।
সেই থেকেই প্রতি বর্ষাতেই মাটি ও বৃক্ষ তাকে উপহার দেয় কদম।
সেই থেকেই মেঘবৃষ্টির অমোঘ প্রেম।।



'দীর্ঘ সুত্রতার নীরাবতা?
 
আজ বহুদিন পরে ফের কথা হলো।
চিরাচরিত অনুযায়ী প্রথমে কুশল বিনিময়,
সালাম প্রণাম হলো।
প্রথা বিনিময়ের পাট চুকলে,
নেমে এলো শুনশান নীরবতা।
এক্সপ্রেস রেলটা ছেড়ে যাবার পর,
স্টেশনের আনাচে কানাচে পড়ে থাকা
খাঁ খাঁ নীরাজনতার মতো নীরাবতা।
থেকে থেকে শুধু চায়ের হকারের
ডাকের মতো দু'দিকের দীর্ঘশ্বাস
রিদমিকভাবে শোনা যাচ্ছিল।
শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত জনপদের উপর
নিক্ষিপ্ত টিয়ারশেলের ছত্রভঙ্গতা যে বিপুল
নীরাবতা নামিয়ে আনে রাজপথে,
তার মতন শুনশান আমাদের দু'প্রান্তে।
মৌনতা, শুধুই মৌনতা।
নীরাবতার চাদর ফুঁড়ে যখন প্রাচীন
গোপন নামটি ডেকে বললাম,
"মেঘ, আজকাল কোন আকাশে ওড়ো?
পাহাড় তোমার ভীষণ প্রিয় বলেছিলে?
আজও আমি ঠায় দাড়িয়ে, পাহাড় হয়ে।
অপেক্ষায় অপেক্ষায় আমার হাঁটু ভাঙতে বসেছে,
দু'পায়ে পানি নেমেছে। ফুলে হয়েছে টইটুম্বর।
অথচ, তুমি কথা দিয়ে, কথা না রাখার দলে
যোগ দিলে? কেন এমনটা করলে আমার সাথে?"
কথা শেষ হতে না হতেই আমি দেখলাম,
মেঘের জলকণাগুলি ভেঙে গিয়ে
ভীষণ বৃষ্টি আরম্ভ হলো, সে কি প্রবল বৃষ্টি!
আমার তৃণময়ী দেহ, চূড়ার ভিটা বসত বাড়ি
ভেসে যাবার উপক্রম পাহাড়ি ঢলের তোড়ে।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, "না না মেঘ, তুমি এভাবে ভেঙে পড়তে পারোনা।
আমার শেষ কথাটি এখনো শেষ হয়নি।
তুমি, এভাবে বৃষ্টি হয়ে যেতে পারোনা।
আমদের দমকা বাতাসে চূড়া পরিষ্কার
করার কথা ছিল,
সেখানে তোমার আমার ঘর বানাবার
কথা ছিল মেহগনি বাগানের মাঝে।
মেহগনির টিয়া রঙা কচি পাতায় তোমার গাল ঘষার 
দাগটুকু আজও স্মৃতির পাতায় দগদগে।
এভাবে, তুৃমি সব মুছে দিতে পারোনা।"
কিন্ত সে তো আর মেঘ নেই কই!
বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছে বহু আগেই।
এমনটাই তো হয়, পুরনো দুটি মন
যখন অমীমাংসিত একটা সম্পর্ককে
পুনরায় জোড়া লাগাতে তৎপর হয়,
দুজনের মাঝের দীর্ঘ ক্ষোভেরা ব্যপক
শুণ্যতা সৃষ্টি করে।
দুটি মন সঙ্গোপনে তাদের কথা সারে
যেখানে মুখদুটি নিস্তব্ধতায় ঢাকা থকে।।





অন্যথায় অন্যকিছু, প্রেম নয়?
 
হঠাত প্রেম করতে এলে যে! তাও এমন অবেলায়!
সময় এনেছ মুঠোয় পুরে? সঙ্গে আছে কিশলয়?
তাহলে বলো কী কী করতে পারো তুমি, প্রেমে?
ডুবতে জানো গহীন জলে? ছুটতে আকাশ পানে?
রাগ করতে জানো কথায় কথায়?
ধমকাতে জানো না বারণ ভাঙায়?
ছাতা সরিয়ে ভিজতে শিখেছ বুঝি, খুব বৃষ্টিতে?
খোঁপা সাজাতে জানো গোলাপ কিংবা জবা তে?
সমান্তরাল হাঁটতে শিখেছ তুমি, রেল লাইনের উপর?
অভিমানে ভেজাতে পারবে বুক, সকাল- সন্ধ্যা-দুপুর?
ফাগুনে, বৈশাখে শাড়ি পড়তে শিখেছ বাঙালিয়ানা?
প্রভাতফেরীর গাইতে শিখেছ গান, ২১শে ষোলআনা?
নদী দেখলে, ঢেউয়ের তালে ভাসো?
রাতের আকাশ থেকে তারা হয়ে খসো?
গাঙ দেখলে গাঙচিল হও, ঘাসের ডগায় শিশির?
তুলসী হও ঘর আঙিনার, জোছনা ছড়াও নিশির?
রক্তে ভেজা চিঠি লিখতে জানো
কিংবা চোখ ভেজানো গান?
বুকের গহীনে সুনীল কাব্য?
ঠোঁটের আগায় গীতবিতান?
খুকীর মতো গাল ফোলাতে জানো,
কিংবা ফুঁপিয়ে উঠে ফোলাতে জানো ঠোঁট?
চোখ পাকিয়ে বলতে পারবে-
"অনেক দেখেছি হেঁয়ালিপনা, নে এবার ওঠ?"
তোমায় ছাড়া বাঁচব না, বলতে পারবে যখন-তখন?
কিংবা, ভাল্লাগেনা কিছু আমার,তুমি ছাড়া আর এখন?
সত্যি বলো, এসব কিছুই পারবে তুমি প্রেমে?
এসব যদি নাই পারো, কেন প্রেম করতে এলে?






'অনিয়ন্ত্রিত ভুলগুলি
 
ইদানীংকাল খুব ভুল ত্রুটি করে ফেলছি প্রায়শই।
বেশ ভুল ভাল বকে ফেলছি যেখানেসেখানে।
বন্ধুদের তাসের আড্ডায় বলেছি ধর্মের কথা।
মুয়াজ্জিনকে অনায়াসে জিজ্ঞেস করলাম তার প্রাক্তনের কুশলমঙ্গল।
এক ভুঁই ফুঁড়ো পলিটিসিয়ানকে শোনালাম
প্রজাদের দুঃখনদীর আর্তনাদ।
ইদানীং ক্যাকটাসকেও বুকে জড়িয়ে ধরছি পরম যত্নে।
সিগনালের হাতপাতা ভিক্ষুকগুলিকে নিজের স্বজাত মনে হচ্ছে।
ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি অন্ধকারকে 
পুনর্বাসন করবার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগছে।
ইদানীং নিজ ঘরের দরজাটিও বেমালুম ভুলে খেয়েছি।
উঁচু উঁচু সকল দালানকোঠাকে, সদর দরজাগুলিকে নিজের মনে হয়।
মনেহয়, ওইতো! ওইতো তুমি কাঠগোলাপের মালা 
খোপায় গুঁজে গোধুলীরঙা বেনারসির আবরণে মিটিমিটি হাসছ ভেতরে বসে।
রাতবেরাতে পাড়াপড়শি উত্যক্ত হয়ে পড়ছে আমার কড়া নাড়ায়।
যখন তখন ভেতরে কেউ নেই জেনেও ভুলক্রমে মেকী কাশি দিয়ে ঢুকছি ঘরে।
ইদানীংকাল, কলিগদের নামগুলিও সব আমার কাছে একরকমই লাগছে।
মাঝেমধ্যেই সবার হাসির খোরাক হচ্ছি তোমার নামে অন্যকাউকে ডেকে ফেলে।
ক্রমাগত ভুল করছি, পরিচিত অপরিচিত যেকোন মানুষ 
দেখলেই ভেতরের হুড়কো খুলে ভালোবাসতে পরামর্শ দিচ্ছি।
ইদানীং বেশ উল্টা পালটা খাবার রুটিন আমার।
সকালের মেন্যুতে থাকছে কফির সাথে হাতে ভাজা মুরি।
দুপুরে খাবারে ঝিমুনি আসছে,
ঝিমুনি তে আসছ তুমি।
সবার অলক্ষ্যে রাতে খাবার টেবিলেও
তুমি এসে বসছ পাশে,
আমি বেহায়া বসে থাকি রোজ দুমুঠো
খাবো তোমার হাতে।
জানি এসবই ভুল ভুল আর ভুল।
কতো কতো রাত এপাশ ওপাশ করে কাটায় ঘুমের নামে।
ঘুম নয় ঘুম নয়, শুধুই আসছ তুমি, জাগছ তুমিও আনমনে।
উষ্ণ হাতের ছোঁয়া দিলে কপালে,
তখন স্বপ্নিল আমি, তোমার বাহুডোরে।
চুলে বিনি কাটবে কী কাটবেনা ভাবছ,
দুষ্টুমিভরা চোখে তাকিয়ে হাসছ।
এভাবেই ভুল করে আমার রাতেরা হচ্ছে খুন,
ভোর আসে, আলোয় ভাসে, ক্ষতে ছেটায় নুন।
এভাবে, এ বয়সে পুনশ্চ যদি মাতাল পায়ে এগিয়ে আসে প্রেম,
ভুল যোগে ভুল করে ক্যালকুলেটর আর ভেঙে পড়ে জীবন ফ্রেম।
ইদানীং সমাজবিধির তোয়াক্কা না করে,
সমস্ত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে,
এতো ভুলোমন নিয়ে কেন যে
তুমি ভালোবাসা আর নগ্ন পায়ে আলতা
পড়ে হাজির হও! আমি সব গুলিয়ে ফেলছি।
কৈশোরের সাথে মাঝবয়স গুলাচ্ছি,
তারুণ্যের সাথে মেশাচ্ছি বার্ধক্যকে।
আমার ইহকাল পরোকাল সব। সব।
ইদানীংকালের ভুলগুলিকে নিদারুণভাবে
ভালোবেসে ফেলেছি।
অথচ, পাড়াপড়শি বলছে,
"আচ্ছা লোক তো! সংসার, ধম্মকম্ম সব ছিকোয় তুলেছে। 
এটা একটা প্রেমে পড়ার বয়স হলো!
ভুল পথে পা বাড়িয়েছ। সময় থাকতেই ফিরে এসো।"
অথচ যেখানে আমার কারো কাছেই কিছু ফেরত চাইবার অভ্যাস নাই।
আর, আমি সময়ের সমগ্রটাই তোমায় দিয়ে বসে আছি।।



'নারী, এ তোর পুনঃজনম'
 
যেদিন আমি প্রথম পা রেখেছিলাম
তোমার উঠোনে, ঘুমিয়ে ছিলে তুমি।
সেদিন ঘরে ঢুকতেই আঁতকে উঠেছিলাম
জীবন কি এমন হয়!
এমন স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের মতই আলোহীন, তাপহীন, বাতাসহীন হয়?
এমনও কি নারী জনম হয়!
প্রচন্ড ঝড়ের সাথে লড়াইয়ের পর
যেমন রুগ্ন শুকনো পাতাহীন ডালহীন
একটা উদ্ভিদ কোন মতে টিকে থাকে,
তেমনি ভাবে জীবন চলছিল নারী তোমার।
একলক্ষ একটা গোর পোকায় কুঁড়ে কুঁড়ে
খাচ্ছিলো তোমায়,
যেমন ঝাঁপ দেবার পূর্ব মুহুর্তে কিশোরী দাঁড়ায় পাহাড়ের শেষ মাথায়,
তুমি সেদিন তেমনিই অপেক্ষায় ছিলে চিরনিদ্রার।
ও'ঘরে আশা ছিলনা, কেউ কোন কোণায়
আশ্বাস রেখে যায়নি কখনো,
শীতের কুয়াশারা যেমন ছাই রঙা জাল
বিছিয়ে রাখে মটরশুঁটির ক্ষেত জুড়ে,
তুমিও তেমনটাই ধোঁয়াশায় ছিলে আবৃত।
আমি বজ্র এনে হয়েছিলাম ঘনীভূত,
উল্কার বেগের মত প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস এনে সরিয়েছিলাম সেই কুয়াশার চাদর।
দুঃসাহসিক মাস্কেটিয়ারের মতই ভেঙ্গে ফেলেছিলাম গারদের সব লোহ্য বেড়ি।
প্রকান্ড বুলডোজারের আঘাতে আঘতে চূর্ণ বিচূর্ণ
করেছিলাম চারপাশের দম বন্ধ হওয়া উঁচু উঁচু সব দেয়াল।
ফালি ফালি চুলেরা ব্যস্ত ত্রস্তভাবে শুরু করেছিল ছোটাছুটি।
নাহ, বৃষ্টিটা সেদিন আর আমার আনা লাগেনি।
ও'বরং তুমিই এনেছিলে।
তোমার দু'চোখ বেয়ে ফিনকির মত ধেয়ে নামল শ্রাবণধারা, 
যেমন করে পাহাড়ের বুকে নামে পানির ঢল।
শান্ত ব্রহ্মপুত্রটা নিমিষেই ফুঁসে উঠে হয়ে গেল প্রমত্তা পদ্মা।
ডালে ডালে আসল সবুজ কচি পাতা, পাতার ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি রঙা ফুলের হাট।
অপূর্ব। অপূর্ব সেই ক্ষণ। চোখ মেলেছ তুমি। তোমার ঘুম ভেঙেছে। আজ কি আনন্দ।
কি আনন্দ আজ!
পলক মেলতেই
আজ তুমিও বললে
আমি হয়ত রক্ত মাংসের মানুষ নই,
নয়তো, এতো প্রেম কোত্থেকে জানি?
কে শেখালো আমায় এতো প্রেম!
আসলেই, কে শেখালো এতো প্রেম আমায়!
বিশ্বাস না হলে, জিজ্ঞেস করো
ওই আয়নাটাকে!
আমি শুধু ফুঁ দিয়ে কেবল ওটা পরিষ্কারই করেছি মাত্র,
এর বেশি জানতে চাইলে বলবো,
তুমি ওতে একটা জানালা দেখেছিলে খোলা।
যেখান থেকে দিগন্তহীন আকাশ দেখা যায়, অন্তহীন,
 সীমানাহীন আকাশ দেখা যায়।
তুমি সেই আকাশটাই হারিয়েছিলে,
আজ আপন করে ফিরে পেলে।।




'তুমি আসবে বলে
 
জানো? তুমি আসবে নামে
আমার একটা সুপ্রভাত রয়েছে,
একান্তই নিজের একটা সুপ্রভাত।
আর এই সুপ্রভাতের তোড়জোড়টা
লেগে যায়, যেই মুহুর্তে মন জেনে ফেলে
যে তুমি আসছ।
সেদিন, রাস্তার জ্যামে দাঁড়ানো গাড়িগুলির
জানালার কাচে অবিরত টোকা পড়তে থাকে
ফুল বিক্রেতা শিশুগুলির।
তুমি আসবে নিশ্চিত হলেই গাছের ডালে ডালে,
বিল্ডিং এর কার্নিশে চোখে পড়ে ঠোঁটে ঠোঁট
লাগানো জোড়া শালিক।
তুমি আসবে বলে, রাস্তার দুদিকে সারিবদ্ধ
হয়ে দাঁড়ায় দেবদারুর দল।
তোমাকে দেখবার ঠিক আগ মুহুর্তেও
রাজ্যের ঘুম চোখের কুম্ভকরণ আমি,
পরপর চার রাত নির্ঘুম পার করা আমি এক
পরিশ্রান্ত শৈল্য চিকিৎসক।
যেন একশো এগারো বছরের পলেস্তারা
খসে পড়া পুরোনো এন্টিক এক দালান।
আর তুমি এলে, মুহুর্তেই দপ করে
জ্বলে ওঠে দুচোখ, বিদ্যুৎ খেলে যায় শরীরে
যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টেজের সজোরে ধাক্কা।
চলন্ত বাসে গাদাগাদি করে দাঁড়ানো যাত্রীদের
মাঝে সাপুড়ের বাক্স থেকে বের হওয়া ঢোড়া সাপ
দেখে দিক্বিদিক কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষদের
ছোটাছুটির মতনই আমার দেহে আরম্ভ হয়
প্রতিটা রক্ত কণিকার এদিক সেদিক
উদ্দেশহীন ছোটাছুটি।
তুমি আসবে জানলে,
এ শহর হয়ে ওঠে তোরণের
কৃষ্ণচূড়া বিছায় লাল গালিচা
কোত্থেকে উড়ে আসে কোকিল
গেয়ে ওঠে গান, বলে- ভরা বর্ষায় বসন্ত এসেছে
কপথ কপথীর ওষ্ঠেরা ছড়ায় উষ্ণতা
তরুণীর গালে লেগে রয় ডালিমের আভা
তুমি আসলে একচল্লিশের আমিও
বনে যায় সাতের শিশু।
কথায় অকথায় ধরি জেদ
অভিমানে গাল ফুলিয়ে জানালায় চোখ ফেলি
দুরুহ থেকে দুর্বোধ্য হয়ে উঠি,
তখন আমি যেন এক উত্তাল সমুদ্র,
বুকের ভেতরে এক বুনো ঘোড়ার দাপাদাপি,
ভরা গাঙের ফোঁস ফোঁস ডাক।
সেই মুহুর্তে মনেহয়, জনশূন্য হয়ে পড়েছে পৃথিবী
এখানে আজ তুমি আমি ব্যতীত তৃতীয় কেউ নেই
আর আমি যেন মাঝ সাগরে ভাসমান
একুশ দিন অনাহারে কাটানো ক্ষুধার্ত নাবিক।
যতদূর চোখ যায়, দেখি শুধুই তোমার দুচোখ
গোলাপের কুঁড়ির মতো আধভেজা দুটি ঠোঁট
আর, গোধূলির মতই মায়াবী এক চেহারা।
অতঃপর, আমি পড়ে যাই বার্মুডা ট্রায়ঙ্গেলের
ঘূর্ণিপাকে, গহীনে অতলে ডুবছি তো ডুবছিই।
যেখান থেকে উঠে আসা বেজায় দুষ্কর,
বেজায় দুষ্কর।।





পাখির ঠোঁটে কালি'
তার সাথে প্রায় এক দশক পরে ফের হয়েছিলো কথা,
প্রশ্ন করলো আলতো হেসে, সেরেছে পুরোনো ব্যাথা?
বললাম, ছাড়ো তো সেসব, তুমি এখন কোন অরণ্যে থাকো?
রোদ ঝড় বৃষ্টি জলে, পাখি তুমি কার পেলব বুকে মুখ ঢাকো?
মনে আছে সেই বর্ষা দেয়াল, পাঙশা ভেজা তুমি আমি বসে কার্নিশে?
ডানা ঝাপটে শুকোতাম গা, চোখে চোখ, বুকে ঠোঁট, আদর থাকতো মিশে।
পাখি আমি উড়তে শিখিনি তখনও, সবেই সেবার কলেজে দিলাম পা,
বর্ষা মাথায় প্রথম দেখা, জল চোখের সেই নেশাতে ভাসিয়েছিলাম গা।
আমায় টানতো গহীন অরণ্য, নদীর উজান আর বৃক্ষলতা,
সেসব ফেলে, তন্ময় হয়ে শুনেছি পক্ষি ঠোঁটের
মিষ্টি কথা।
বললে তুমি, লিখতে জানো? কিছু একটা লেখ দেখি আমায় নিয়ে,
আমি লিখলাম সুনীল আর জীবনানন্দ, এঁরা লিখেছে সমগ্র মন দিয়ে।
আচ্ছা! তবে আঁকতে জানো? এঁকে দেখাও দেখি আমায় কেমন লাগে দেখতে?
তোমার ঘরে অল্প আলোর কুপি জ্বলে, আঁকছি আমি, আধাঁর পারেনি রুখতে।
আমি আঁকলাম অমাবস্যার নদী, ঘাটে কলসি কাঁখে এক গাঁয়ের মেয়ে,
জল ভরতে কলস ডুবায়, তার গা হতে জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ে জলের গায়ে।
মাঝেমধ্যে আমাতে তোমাতে পরিবার নিয়েও গল্প চলতো,
বাবাকে দেখোনি তুমি আর আমার বাবা কি কাজ করতো?
আমাদের মাঝে ব্যবধান ছিলো, ছিলো ধনী গরীবের অপার দুরুত্ব,
তুমি ছিলে প্রাসাদবাসিনী, আমার সেই রাজফটক নাগাদ দৌরত্য।
এ বয়সের প্রেম, সে কি খুবই কাঁচা? মিলন কি থাকেনা তাতে লেখা?
এসব আসেনি মনে, স্বপ্নে আমার পরিণয়, স্বপ্নেই ঘর বুনতে শেখা।
আমি তখন সবে পনেরো, আমি তখন প্রেমে ছিলাম মাতাল ও বুঁদ,
তেরোতে উপনীত তুমি, অথচ সে বয়সেই তোমার পরিপক্বতা অদ্ভুত।
একদিন ঘুম ভেঙে দেখি, সেই সে অরণ্যে পাখিটি
আর নেই,
তরুলতাকে পেছনে ফেলে উড়াল দিয়েছে বিত্তের
হাত ধরেই।
বিশ্বাস করো, আমি ছিলাম নবীন, ভালোবাসায়
ছিলাম ভীষণ কাঁচা,
বুঝিনি স্বপ্নেও হতে হয় বিত্তশালী রাজকুমার,
স্বপ্নে সোনার খাঁচা।
এভাবেই আমি গাছ হয়ে দিন গুনলাম যেন অপেক্ষার পাহাড় দাঁড়িয়ে অনড়,
শুকনো ঠোঁট নিয়ে মনমরা ফাগুন ফিরে ফিরে গেছে
বহু বছরের পর বছর।
বুঝতে পারিনি, তোমার প্রেম ছিলো আগুন, আমি
মোম হয়ে গলে একশেষ,
ধনী ঘরের ঝাড়বাতি তুমি, দিবা আলোতে ঘুমাও,
ভুলে যাও রাতের রেশ।
এক দশক পরে ফের দেখা, এখন আমি খোলা
আকাশ, পাখি নই আর,
দেখলাম তোমায় যেন পরিপাটি এক স্বর্ণমুদ্রা,
হাত বদলের উপহার।
আমি বললাম, কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে?
তুমি কি সেই, যার ছিলো আমায় ফেলে তারা হবার ইচ্ছে?
তা এখন তুমি কেমন আছো, বিশাল প্রাসাদ, উঁচু দেয়াল, এর মাঝেতেই থাকো?
সোনার হরিণ স্বপ্ন তোমার, তবু জানালা দিয়ে মুখ লুকিয়ে মেঘকে কেন ডাকো?
এসব রাখো,
আমি না হয় ভুল করেছি
মিথ্যে সুখে পা বাড়িয়েছি
তা কি মনে করে তুমি এতোদিন পরে?
তুমি শুধালে,
বৃত্ত দেখেছো পাখি?
যেমন ধরো এ বিশ্ব আকার
যেমন ধরো আমাদের জীবন
যেমন শৈশাবস্থা ফেরে পুনশ্চ বার্ধক্যে
সেই সে বৃত্ত,
যে বিন্দু থেকে তার শুরু
সেখানেই এসে মেলে।।







No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...