এমন একটি তোমাকে চাই
__ রুদ্র গোস্বামী।
আমি এমন একটি তোমাকে চাই
যে তুমি আমার বুকের ভিতরের পাহাড়টিকে পিটিয়ে
বার করে আনবে ঝরনার জল।
আমি এমন একটি তোমাকে চাই
যে তুমি আমার সব মিথ্যে গুলোকে পুড়িয়ে
আমাকে অভিমান শেখাবে, বৃষ্টি শেখাবে।
আমি এমন একটি তোমাকে চাই
যে তুমি শিকল ছাড়াই শুধু হাতের বাঁধনে
বাঁধবে আমাকে।
আমি এমন একটি তোমাকে চাই
যে তুমি জানাবে আমাকে, আমি আদিগন্ত মানুষ
আমাকে ভালোবাসা যায়।
আমি এমন একটি তোমাকে চাই
যে তুমি, আমাকে আকাশ বানিয়ে রাখবে
তোমার বুকের কাছে।
কেউ একটা চাই
রুদ্র গোস্বামী
কেউ একটা তো চাই, টিপ সরে গেলে
আয়নার মতো বলবে ‘টিপ বাঁকা পরেছ।’
চোখের কাজল লেপটে গেলে ধরিয়ে দেবে।
কেউ একটা তো চাই, পিছু ডাকবে
বলবে ‘সাবধানে যেয়ো।’
কেউ একটা তো চাই, ঘড়ির কাঁটার মতো
কাছে থাকবে। অভিমান দেখলেই বলবে,
‘সবুজ পাতা তোমাকে ভালোবাসি।’
কেউ একটা তো চাই, ভুল গুলোকে
শুধুই বকবে না। কাছে টেনে বলবে ‘বোকা মেয়েটা,
আর কিছু ভালো রাখা যত্ন নিয়ো।’
কেউ একটা তো চাই, খোলা জানালার মতো
আমাকে আকাশ দেখাবে। বলবে ‘এখানে ঠিকানা রেখে
তুমি পাখি হয়ে যাও।’
কেউ একটা তো চাই, হাওয়ার শিসের মতো
কানে এসে বলবে ‘আমাকে ছাড়া কারো
প্রেমে পড়তে নেই।’
কেউ একটা তো চাই, শাসন করবে আমার
খুচরো বিষাদ, আর আমাকে লুঠতে আসা
ডাকাত স্মৃতি।
কেউ একটা তো চাইই, গ্রীষ্মে বিছিয়ে রাখবে বুকে
শীতলপাটি, বলবে ‘এই বুকের মধ্যে তোমাকে
বসতে দিলাম।’
কেউ একটা তো চাইই, কাছে থাকবে
‘তুমি’ বললেই যেমন দুঠোঁটে দুঠোঁট মেশে।
কেউ তো একটা চাইই, কিছুটা সে তাঁর মতো থাক,
কিছুটা আমার মতো হবে।
মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর - রুদ্র গোস্বামী
কোথায় যাচ্ছ ?
- মেঘের মাঠে ।
কেন ?
- জিজ্ঞেস করতে ।...
কি ?
- এতো কষ্ট নিয়ে,
মেঘ কার কাছে যায় !
যদি না বলে ?
- ফিরবো না ।
তোমার তো খুব জেদ !
- উঁহু, ভালবাসা ।
মেঘের মাঠে মেঘ যে নেই ।
- একটু আগে এই যে ছিল !
হয়তো ছিল,
বৃষ্টি যে তার গা ধুইয়েছে ।
এখন সে নেই ।
- কোথায় গেছে ?
রঙধনুটা যেখানে তার ঘর বেঁধেছে ?
ওই সেখানে ।
- তাহলে যাই ঝর্ণা-বাড়ি ।
কেন ?
- জিজ্ঞেস করতে ।
কি ?
- মেয়ের কেন ঘুম আসে না,
কান্না নিয়ে জেগেই থাকে,জেগেই থাকে !
যদি না বলে ?
- দাঁড়িয়ে থাকবো পাথর যেমন,
তোমার ভারী জেদ ।
উঁহু, ভালবাসা ।
ঝর্ণা-বাড়ি ঝর্ণা যে নেই ।
- এই যে তাকে দেখেছিলাম ,
শব্দ করে কাঁদছিল ?
হয়তো ছিল, এখন সে নেই ।
সূর্য তাকে নিয়ে গেছে পথ দেখিয়ে ।
- কোথায় গেছে ?
যেখানে তার পাহাড় প্রেমিক আকাশ হোলো,
ওই সেখানে।
- তুমি তো বেশ বলতে জানো,কাব্যি পড়ো ?
উঁহু, ভালবাসি ।
- কি যেন নাম ?
ক’দিন আগে পাহাড় ছিল, এখন আকাশ ।।
যদি কেউ বলত
__ রুদ্র গোস্বামী।
এই বর্ষায় হাতে কদম দিয়ে
যদি কেউ ভালোবাসি বলত
কেউ যদি দেখে জ্বলে? তবে তার ইচ্ছে,
সে জ্বলত।
যদি হাওয়া আসত, উড়িয়ে দিত চুল
চুলের গোছায় জড়িয়ে, যদি কেউ বেঁধে দিত ফুল
মুখ বাঁকিয়ে কেউ আদিখ্যেতা বলত? তবে বলত।
যদি জ্বলে? জ্বলত।
যদি মুখের উপরে উপচে পড়ত রোদ
কেউ আড়াল দিয়ে বলত, ইস পুড়িয়ে দিল নির্বোধ।
কেউ চোখ টেরিয়ে যদি ঢঙ বলতই, তবে বলত।
যদি জ্বলে? জ্বলত।
যদি হাঁটার সময় হোঁচট লাগত পায়
কেউ এসে, ভয় নেই বলতো
গায়ের ওজন কুড়িয়ে নিয়ে, আমার সাথে চলত
মুখ ঘুরিয়ে কেউ যদি মরে যাক বলতই, তবে বলত।
যদি তার ইচ্ছেতেই সে জ্বলে, তবে জ্বলত।
যদি মেঘের সঙ্গে মেঘ এসে আকাশ জুড়ে নাচত
যদি আমার মনের শুকনো জমি বৃষ্টি পেয়ে বাঁচত
কেউ যদি বলত, শুধু তোর সাথেই ভিজব
তোর দুঃখগুলো ভাগিয়ে দিয়ে তোর কান্না গুলো মুছব। বলত।
কেউ শুনে জ্বললে? জ্বলত।
যদি কেউ জানত, কতদিন ধরে আমি মরছি
ভালোবাসার আগুনে আমি পুড়ছি
যদি কাছে এসে এই বর্ষায় কেউ মুখ খুলত
যদি ভালোবাসি বলত!
পবিত্র হত্যা
__ রুদ্র গোস্বামী।
মহামান্য আদালত আমি কাগজের পাথরলিপি ছুঁয়ে বলছি
আমার কোনও অপরাধ ছিল না আমার কোনও অপরাধ নেই।
আমার ছোট্ট মেয়েটাকে যেদিন ওরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো
অন্ধকার নরকের দিকে
সেদিন কোথায় ছিল আপনাদের কাগজের ঈশ্বর?
কোনদিকে ছিল আপনাদের পবিত্র ঈশ্বরীর সর্বদর্শী চোখ?
আমি কোনও অপরাধ করিনি আমার কোনও অপরাধ নেই।
চার রাত তিন দিন একটাই প্রার্থনা করেছে মেয়েটা আমার।
“যন্ত্রণা অসহ্য যন্ত্রণা, মুক্তি দাও আমাকে মুক্তি দাও বাবা।”
হ্যাঁ মহামান্য আদালত, আমি নিজের দু’হাতে ওর মুখে
স্নেহের থেকেও নরম বালিশ চেপে রেখেছি, ওর মুক্তি অবধি।
আমার স্নায়ুতন্ত্র তখন যুদ্ধরত সৈনিকের থেকেও, নবজাতককে
হাতে নেওয়া পিতার থেকেও অনেক বেশী সচেতন ছিল।
আমার মেয়েটার দেহে ছাব্বিশটা দগদগে ক্ষত ছিল
বুকের ভিতরে অগণন। পিতৃধর্ম জানে মেয়েটাকে আমি অজস্র মৃত্যুর
মুখ থেকে কেড়ে এনেছি। কে ডাকতো ওর ব্যাক্তিগত নাম! কে ওর
দিকে হাত বাড়িয়ে বলতো ? “কী ভীষণ নিষ্পাপ তোর মুখ!”
মহামান্য আদালত, আপনার মূর্খ ঈশ্বরের প্রতি আমার কোনও শ্রদ্ধা
নেই। আপনার অন্ধ ঈশ্বরীর প্রতি আমার কোনও আস্থা নেই।
এইবার আপনার নির্বোধ কলমে আর একটা মৃত মানুষের ফাঁসি লিখুন
বোকা ইতিহাসের সাক্ষি হিসেবে।
.
* কাব্যগ্রন্থ - "তবুও বৃষ্টি নামুক"
অভিরূপ তোমাকে
__ রুদ্র গোস্বামী।
ঘরে ফেরা কি এতটা কঠিন?
ঘর তো আর আকাশ নয়, ফিরতে গেলে পাখি হতে হয়।
পাখির মতো দুটো ডানা থাকতে হয়।
পায়ে হেঁটে এত দূরেও যাওয়া যায় অভিরূপ?
যেখান থেকে ফিরতে গেলে আকাশ পেরুতে হয়?
শূন্য অপেক্ষায়ও একটা খাঁ খাঁ নক্ষত্রের তাপ থাকে অভিরূপ
তুমি কখনও বুঝবে না অপেক্ষার শূন্যতা একটা মানুষকে যে
কী ভীষণ নিঃস্ব করে দিতে পারে।
যেখান থেকে জীবনের দিকে তাকালে মৃত্যুকেও প্রিয় মনে হয়।
অথচ প্রত্যেক দিন এই ক্ষতবিক্ষত শূন্যতার ভিতর আমি
ফোঁটায় ফোঁটায় ছড়িয়ে পড়তে দেখছি আমার নিজের শরীর।
অপেক্ষার যন্ত্রণাকে তুমি কখনও অনুভব করেছ অভিরূপ?
যে পাখিটাকে এনে তুমি আমার বুকের মধ্যে পুষে রেখেছিলে
তোমাকে না ছুঁতে পারার কষ্টে যন্ত্রণায় তার পাখা থেকে
রোজ খসে পড়ছে একটা একটা করে পালক।
আর সেই পালকের উপর জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য উপজীবী ছত্রাক।
এমন নৃশংসতার সাথে খেয়ে ফেলছে ওরা পালকের সবটুকু উড়ান
পাখিটার বেঁচে থাকার কথা ভাবতে গিয়েই আমার কান্না পায়।
যে চোখে জলের ফোঁটা দেখলে স্বর্ণমুদ্রা বলে রুমালে কুড়িয়ে নিতে
সে চোখের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এখন
অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো দাপিয়ে বেড়ায় তেরোটা নদী।
তাদের অবাধ্য স্রোত খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়
আমার বেঁচে থাকার লক্ষ লক্ষ দিন, আমার ভালো থাকার অসংখ্য সময়।
সাধারণ মেয়েদের কোনো পুনর্জন্ম থাকে না।
অপেক্ষার জীবাশ্ম বয়ে বয়ে যে ভালবাসা আজ আমার রক্ত প্রবাল
আমি কিছুতেই তাকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিতে পারব না অভিরূপ।
আমি বাঁচব অভিরূপ মৃত্যুর পাঁজরে পাঁজরে আমি বাঁচব
তুমি যতদিন বেঁচে আছো।
**কাব্যগ্রন্থ "তবুও বৃষ্টি নামুক"
কোনও প্রশ্ন নেই অভিরূপ
____ রুদ্র গোস্বামী।
পাখিও তার বাসার ভেতরে খসে যাওয়া পালক রাখে না
অথচ মানুষ তার ভুল স্মৃতি গুলোকেও বুকের ভেতরে আগলে রাখে।
আগলে রাখাটা একটা মানবিক রোগ অভিরূপ, এ রোগ সবার থাকে না।
কেঠো পাঁজরের নিচে বসন্তের মতো ফুলেল স্মৃতি।
বসন্ত তবু বারবার ফিরে আসে কিন্তু মানুষ কোনও ঋতুর মতো নয়,
মানুষ নিজের মতো যাযাবর।
শরীরের মতো মনের শিরদাঁড়া নেই অভিরূপ,
সামান্য আঘাতেই দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
একটি সাধারণ মেয়েকে কেন আঘাতের সাম্রাজ্য দিলে?
আঘাতে আঘাতে এ হৃদয় বিষ হয়ে আছে। যদি ভুল করেও ফিরে আসো,
এই হৃদয়ের কাছে কী পাবে?
মৃত্যুর মতো সব শোকের স্মরণসভা হয় না অভিরূপ
অথচ হৃদয় ভাঙার শোক মৃত্যুর থেকেও বড়ো। এ শোকের সান্ত্বনা নেই।
চোখ নষ্ট হলেও মানুষ মনের চোখে বাঁচে অভিরূপ,
যার মন নষ্ট হয়ে গেল সে কী নিয়ে বাঁচে?
এই পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক মানুষ আমি, শ্বাসপ্রশ্বাস আছে অথচ প্রাণ নেই।
আর কোনও প্রশ্ন নেই অভিরূপ, আর কোনও অভিযোগ নেই
যেটুকু শ্বাস বাকি আছে আজ সেটুকু দিয়ে তোমাকে অভিশাপ দিই,
আমি ছাড়া যদি অন্য কারো প্রেমে পড়ো,
তবে সুখের অসুখ তোমাকে ছারখার করে দিক।
একুশ কী মা?
-একুশ?
একুশ একটা পাখির জন্মদিন।
পাখি!
ওর কী নাম? কী রঙ?
-ওর নাম বাংলা ভাষা
আর ওর আগুন রঙ।
ও কোথায় থাকে?
-তোমার, আমার,
আমাদের বুকের মধ্যে থাকে।
আমার বুকেও আছে?
-আছে তো।
ইস ওর কষ্ট হয় না?
উড়তে ইচ্ছা হয় না?
-ওড়ে তো।
এই যে আমি কথা বলছি
তোমার দিকে উড়ে যাচ্ছে।
তুমি কথা বলছ
আমার দিকে উড়ে আসছে।
কোথায়! দেখতে পাচ্ছি না তো?
-এই যে তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছ,
নিঃশ্বাসকে দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি না তো!
ও কি নিঃশ্বাসের মতো মা?
-এতক্ষণে ঠিক বুঝেছ।
ও বুকের মধ্যে কোথায় থাকে?
-আমার বুকে কান পাতো।
কিছু শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি তো,
টিক টিক টিক...
-এই শব্দটাই
ওই পাখিটার বাসা।
জলপাই পাতা
___রুদ্র গোস্বামী।
-কবে ফিরছ বলো?
-আর কটাদিন প্লিজ। তারপর...
-তারপর কী?
-যা ইচ্ছে তাই...।
-ফিরতে হবে না। ওখানেই থাকো।
-খুব মনে পড়ছে? গ্যালারি খোলো।
টিয়াশুনি পাহাড়, দুংরি হোটেল,
তুমি আর আমি...
-শিকেয় মাছ তুলে বেড়াল ডাকছ?
-উঁহু, বললাম ছবি দেখতে।
-সামনে কে?
-জলপাই গাছ।
-গাছের নীচে?
-জলপাই পাতা।
-শুকনো পাতা?
-কয়েকটা শুকনো কয়েকটা সবুজ।
পাতাগুলো আগের মতো আর গাছটাকে পাবে?
-পাগলে গেছ?
কেন? ওরাও তো গ্যালারি আর আমার মতোই
কাছাকাছি আছে।
-ইস্ আমাকে দেখছিলে?
-ফিরতে হবে না ওখানেই থাকো।
কদিনে সবুজ পাতাগুলোও শুকিয়ে যাক।
.. রুদ্র গোস্বামী।
উপন্যাস : "জল পেরোচ্ছে রোদ্দুর" থেকে একটি চিঠি
প্রিয় জল,
আমি কী খুব অপেক্ষা করে আছি?
এই প্রশ্নটা বড্ড দ্বিধায় ফেলছে আমাকে।
অথচ তুই কেমন আছিস এ খবরটা জানা এখন আমার কাছে খুব জরুরী।
একটু আগেই তোকে লিখতে বসার সময়,
বাইরে খাঁখাঁ করে পুড়ে যাচ্ছিল রোদ্দুর।
আবার আকাশ ফাটিয়ে এই মাত্রই ঝেঁপে বৃষ্টি এল।
তোর মনে আছে? আমরা দুজনেই একসাথে একদিন দেখেছিলাম,
বৃষ্টি ছুঁলেই কেমন করে রোদ্দুর মরে যায়!
আমরা একসাথে বাঁচব একসাথে মরব বলে,
তুই সেদিন জল হতে চেয়েছিলি। আর আমাকে বলেছিলি,
“তুই কিন্তু আজ থেকে রোদ্দুর।
শুধু আমি ডাকব রোদ্দুর, আমার রোদ্দুর।”
সেদিনকার রোদ্দুর আর জলের থেকেও একটা কথা আজ অনেক বেশী সত্যি,
তুই চলে যাচ্ছিস। আচ্ছা তুই কী সত্যিই ঠিক করে জানিস তুই চলে যাচ্ছিস?
তুই কী ঠিক সত্যি করেই জানিস তোর চলে যাওয়ার খবর?
শীতের দুপুরে আমরা তখন মাঝেমধ্যেই হাওয়ার সাথে গাছেদের ফিসফাস শব্দ,
আর জংলিফুলের সাথে প্রজাপতির কথোপকথন নিয়ে আলোচনা করতাম।
আমি বলতাম, দ্যাখ ফুলটা প্রজাপতিটাকে বলছে,
আদর করলে পরাগ মাখিয়ে দেব পায়। তুই হেসে বলতিস,
‘অসভ্য একটা’। আমরা দুজনেই জানতাম,
এসব কথাগুলোর কোনও মানে নেই।
কিন্তু তবু আমরা তাকিয়ে থাকতাম আমাদের দুজনের মুখের দিকে।
এসব অকারণ কথাদের কখনও কী আর তোর মনে পড়বে?"
শুধু একটা কথা আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না।
আচ্ছা, তুই আমাকে কেন রোদ্দুর নাম দিলি?
আমার ভিতরে এতটা মেঘের ঘনঘটা এতটা বৃষ্টি জমেছিল, তুই কী জানতিস?
আমাকে নিয়ে ভাবিস না, আমি ভালো থাকব।
একটা মানুষের চলে যাওয়া মানেই কি আর, সব কিছু নিয়ে চলে যাওয়া?
ভালো থাকিস, যেমন সকাল ভালো থাকে সূর্যের আলোয়।
.
অভাব
__ রুদ্র গোস্বামী।
তুমি কাছে না থাকলে, বুকের ভিতরে
হুল্লোড় করে ঢুকে পড়ে একটা ভিখিরি স্বভাব।
মনে হয় এই ঘর আমার নেই,
এই আকাশ আমার নেই,
রাস্তা, মাঠঘাট, কোথাও যাবার তাড়া,
এ সবকিছু অন্য মানুষের।
তুমি কাছে না থাকলে,
সাত জন্মের অন্ধকার নিয়ে লাফিয়ে আসে রাত।
দিনগুলোকে শূন্য মনে হয়।
মনে হয় এই ব্যস্ত জনপদ, এই হকারের মতো চাঁদ,
ট্রেন ছেড়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্ম,
মানুষের জিজ্ঞাসার শব্দ, এরা সব এক একটা খুনে।
তুমি কাছে না থাকলে
পা দুটো দাঁড়িয়ে থাকে অনড়,
ঠোঁট দুটো বন্ধ তালার মতো থাকে চুপ।
বলতো, এতগুলো অভাব নিয়ে
একটা মানুষ সত্যি করে কি ভিখিরি হবে না?
কাব্যগ্রন্থ "অভিযোগ নেই"
যেতে পারবে?
__ রুদ্র গোস্বামী।
এই যে তুমি বার বার চলে যাই বলো
ধরো তুমি চলে গেছ
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে যদি দেখো
কষ্টে ভিজে যাচ্ছে আমার বুক
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে
তুমি কি তখন মুখ লুকাতে পারবে?
বলো পারবে?
আর এসে দেখো যদি
হাতে আমার ভেজা রুমাল
তখনও অপেক্ষায় আমি, যাইনি কোথাও
যদি বলি, এলে কেন ?
চাই না তোমায় চলে যাও যেখানে ছিলে
আমাকে কাছে না টেনে তখন তুমি পারবে?
বলো পারবে?
এই যে আমাদের কাছে
আমিও আসি আর তুমিও আসো
এ কথা তো জানে দশজনে,
ভালোবাসাবাসি কতখানি আছে তোমার আমার
এত ভালোবাসা ছেড়ে
তুমি কি কোথাও যেতে পারবে?
বলো যেতে পারবে?
** কাব্যগ্রন্থ "ভালো থেকো মন"
ফ্রাকচার
__ রুদ্র গোস্বামী।
কাল ছাদের কিনারে অমন দাঁড়িয়ে ছিলে
দেখেই মনে হয়েছিল তোমার মন ভালো নেই
শুনলাম তোমার বাঁ পায়ে ফ্রাকচার
কেমন আছ আজ? কেন ঝাঁপালে বোকার মতো?
ভালোবাসার আঘাত কি কাউকে দেখাতে আছে?
তুমি যাকে চেয়েছিলে সে তোমার প্রেমিক
মনে মনে হোক তবু
অভিমানে তাঁর বুকেই তুমি লুকিয়েছ মুখ
এমন ভালোবাসার বুক কি লোককে জানাতে আছে?
কেন ঝাঁপালে বোকার মতো?
আমিও দাঁড়িয়েছি এই গোটা একটা বছর
আমিও দাঁড়াই রোজ ছাদের কিনারে
বলো তো তোমাকে ভালোবেসে ভরে আছে যে বুক
কী করে সে বুক আছড়ে আমি পাথরে ভাঙি!
কেন ঝাঁপ দিলে বোকার মতো?
ভালোবাসার আঘাত কি কাউকে দেখাতে আছে?
** কাব্যগ্রন্থ - "ভালো থেকো মন"
অসময় কেটে গেলে
...... রুদ্র গোস্বামী।
এই অসময় কেটে গেলে আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
বলো হে প্রিয় মুখ, বলো হে প্রিয় নাম, আর কি দেখা হতে পারে?
বলো হে শহর, বলো হে নিয়নের আলো,
বলো হে আমার আরও যত আছ দেখার আকুতি
আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
দেখাতো হয়নি আমার, যেটুকু সুখ তুমি কাছাকাছি আছ।
বলো হে ফুল, বলো হে পাখির শিস আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
বলো হে ঘুম, বলো হে জেগে থাকা,
বলো হে আমার আরও যত আছ না বলা কথার আকুতি
আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
কাছেতো পাইনি তোমাকেও আরও যে তুমি কাছে রাখতে পারো।
বলো হে প্রেম, বলো হে ভালোথাকা, আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
বলো হে বিষাদ, বলো হে অভিমান,
বলো হে আমার আরও যত আছ না জানা অনুভূতি
আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
বলো হে বুকের ঢেউ, বলো হে দুটি চোখে অশান্ত চেয়ে থাকা,
আর কি আমাদের দেখা হতে পারে?
যে ভাবে ভালোবাসা এল
_ রুদ্র গোস্বামী।
প্রেম হয়েছিল প্রথম, বট অশথের।
সেই গল্পটা জানো?
বাড়ছিল ওরা, যেমন কাছাকাছি বাড়ির
দুটো ছেলেমেয়ে বাড়ে।
বট তখন বয়সে যুবক, সবুজ পাতা।
অশথেরও তাই, সবুজ পাতায় যুবতি যেন।
অশথের মানে জানো? অশথ মানে অশত্থ গাছ।
দেখত রোজ দুজন ওরা দুজনের দিকে,
যেমন কাছাকাছি ছাদের দুটি ছেলে মেয়ে দেখে।
বটের মনে ছিল প্রেম, আর অশথ চাইত
বট তাঁর কাছে আসে। তাই অভিশাপ দিল,
অশথ অভিশাপ দিল, “তোর পা হোক বট।”
এই অভিশাপ মানে জানো?
এই অভিশাপ মানে, ভালো চাওয়া।
অভিশাপে ছিল জোর, না বটের প্রেমে,
কেউ জানে না। পা হল বটের।
পা মানে ধরে নাও, বটের ঝুরি।
এরপর একদিন পা বাড়িয়ে,
হেঁটে গেলো বট তাঁর অশথের কাছে।
তারপর সেই থেকে মেয়েরা লাজুক, আর
ভালোবাসার কথা আগে ছেলেরাই বলে।
কাব্যগ্রন্থ "ভালোবাসব বলেই"
ঘর
__রুদ্র গোস্বামী।
মেয়েটা পাখি হতে চাইল
আমি বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিলাম।
দু-চার দিন ইচ্ছে মতো ওড়াওড়ি করে বলল
তার একটা গাছ চাই।
মাটিতে পা পুঁতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এ ডাল সে ডাল ঘুরে ঘুরে
সে আমাকে শোনালো অরণ্য বিষাদ।
তারপর টানতে টানতে
একটা পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে নিয়ে এসে বলল
তারও এমন একটা পাহাড় ছিল।
সেও কখনো পাহাড়ের জন্য নদী হোতো।
আমি ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে বললাম
নদী আর নারীর বয়ে যাওয়ায় কোনও পাপ থাকে না।
সে কিছু ফুটে থাকা ফুলের দিকে দেখিয়ে
জানতে চাইল
কি নাম?
বললাম গোলাপ।
দুটি তরুণ তরুণীকে দেখিয়ে বলল
কি নাম?
বললাম প্রেম।
তারপর একটা ছাউনির দিকে দেখিয়ে
জিজ্ঞেস করলো,
কি নাম?
বললাম ঘর।
এবার সে আমাকে বলল
তুমি সকাল হতে জানো?
আমি বুকের বাঁদিকে তাকে সূর্য দেখালাম।
.
* কাব্যগ্রন্থ - "তবুও বৃষ্টি নামুক"
তিল
___ রুদ্র গোস্বামী।
ঠোঁটের ডানদিকে গোটা সর্ষেদানার মতো কালো তিল,
কালার করা চুল, বাঁ হাতে একগাছা মেটালিক চুরি, কপালে মেরুন টিপ।
পারমিতা সেন। বঙ্গবাসী কলেজ ২০১১র ব্যাচ।
দিবাকর বিশ্বাস, ঈশানী দত্ত, অরিত্র সুর, আর আমি,
আমরা ক’জন স্বঘোষিত লিখিয়ে শুক্র শনির প্রায় বিকেলে
তখন আড্ডা জমাতাম কলেজপাড়ার কফি হাউসে।
পারমিতা, দীপান্বিতা সামন্ত,
অহনা ব্যানার্জী ওরাও ক’জন আসতো আমাদের আড্ডার টেবিলে।
আমাদের প্রথম আধঘণ্টা চলে যেত
পারমিতার নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কিত কথোপকথনে।
দিবাকরের বেজায় আপত্তি থাকলেও,
আমার কিন্তু কখনও খারাপ লাগত না। আমাদের মধ্যে কমন ফ্রেন্ড ছিল ঈশানী।
তখন উইন্টার। ১৭ জানুয়ারি শুক্রবার পারমিতার জন্মদিন।
সকাল বেলা গিফট কিনতে বেরুচ্ছি তখনই কিচেন থেকে
মা ডেকে সেলফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন গ্যাস বুক করতে।
গ্যাস বুক করে মায়ের হাতে ফোনটা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখি,
কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে যে বাজারের ব্যাগ এসেছে
তার ভিতর থেকে মা মটর শাক টেনে বার করছেন।
আর মটরলতার সাথে জড়িয়ে রয়েছে নীলচে রঙের
বেশ কিছু ছোটোছোটো ঝকঝকে ফুল। মাকে বললাম,
ফুলগুলো নেবো? মা অনুমতি দিলেন।
তারপর বাড়ির কোণের মাঠ থেকে একগোছা ঘাস এনে,
প্রতিটা ঘাসের উপরের দিক থেকে তিনটে জোড়া পাতা ছেড়ে,
ঘাসের পেটে ফুলগুলো বেঁধে,
রাংতাকাগজে ঘাসের গুচ্ছ পেঁচিয়ে তাতে জল ছিটিয়ে
পড়ার টেবিলে রেখে,
স্নান খাওয়া সেরে ঘাসের বোকে আর ক্যাডবেরি
সেলিব্রেশন নিয়ে পৌঁছলাম কলেজপাড়ায়।
অরিত্র আর অহনা ছাড়া সবাই তখন জমিয়ে বসেছে আড্ডার টেবিলে।
আমি প্রথমেই ঘাসের বোকে এগিয়ে দিলাম পারমিতার দিকে,
ও বাঃ বলে ঘাসের বোকেটা আমার হাত থেকে নিয়ে টেবিলে রেখে বলল,
“এ শহরে আজকাল তো আবার গোলাপ ফুটছে না।”
তারপর চকলেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ফুলগুলো যে কোথায় হারাল!
যতদূর মনে পড়ে ঈশানী শুধু বলেছিল ‘বড্ড যত্ন করে বেঁধেছ’।
এর কয়েকমাস পরেই ওদের কলেজের পাঠ ফুরলো।
দীপান্বিতা মাঝে মধ্যে আড্ডায় আসলেও,
অহনা ব্যানার্জী পারমিতা আর দিবাকর কলেজপাড়া ছেড়েই দিয়েছিল।
আজ কলেজস্ট্রিটে হঠাৎ পারমিতার সাথে দেখা,
হলুদ কালো ডুরেকাটা শাড়ি।
ঠোঁটের ডানদিকে গোটা সর্ষেদানার মতো তিল,
কালার করা চুল, বাঁ হাতে এক’গাছা মেটালিক চুরি,
কপালের টিপের রঙটা বদলে শুধু লাল হয়েছে।
পারমিতাই আগে আমাকে দেখতে পেয়েছে।
ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম,
দিবাকরের আঁকা “ঘরে ফেরা” ছবিটা এবার কোনও একটা
এ্যাওয়ার্ডের জন্য নমিনেশন পেয়েছে। “শূন্য” ছবিটা প্যারিস গেছে।
আমিও চট করে সেলফোন বার করে একটা ছবি দেখালাম ওকে। দেখে বলল,
“সুন্দর তবে ঠিক ফর্সা নয়।
নিদেন পক্ষে ঠোঁটের উপর একটা কালো তিল তো থাকতো আমার মতো।”
আমিও বললাম তুমি সুন্দর পারমিতা।
আর ও সুন্দরকে আরও সৌন্দর্য দিতে জানে,
ঠিক তোমার ঠোঁটের ওই কালো তিলটা যেমন এই দুপুরেও
তোমার মুখে চাঁদ নামিয়ে এনেছে। পারমিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “নাম কি?”
এখানে এই কলেজপাড়াতেই আমাদের প্রথম দেখার কথা বললাম।
বললাম সবুজহলুদ শাড়ি, ভায়োলেট ফ্রেম চশমা, পেন্সিলে আঁকা চোখ,
আর সিলভার কালারের ঝুমকোয় প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম,
সেদিন বলেছিল ওর নাম ঋতু। পরে আরও দুবার দেখা হয়েছে আমাদের।
তারপর নিজেই বললাম, আমি কখনও ওকে খুঁজবো না।
আমি ভালোবাসি তাই ও একদিন ঠিক খুঁজে নেবে আমাকে।
কেনই বা সেলফোন বার করে ছবিটা দেখালাম?
কেনই বা বললাম ঠিক খুঁজে নেবে আমাকে!
আমি এখনও জানি না। দু’জন দুদিকে পা বাড়াবার মুহূর্তে,
পারমিতা একটাই কথা শুধু দুবার বলেছিল “তোমার পাগলামি গুলো খুব মনে পড়ে।”
আমার চোখে বৃষ্টি ভিজছে খুব
__ রুদ্র গোস্বামী।
ভীষণ একলা হয়ে যাচ্ছি আরও দূর
আমি একলা হেঁটে যাচ্ছি সমুদ্দুর
আয় একটিবার তুই সন্ধ্যা নামার আগে
আয় একটিবার তুই বুকের বারান্দায়
আয় একটি বার তুই অভিমানে রাগে
আয় একটিবার তুই বাক-বিতন্ডায়
তোকে বুঝতে থাকার চেষ্টায়
আমি পেরুচ্ছি রোদ্দুর
আমি একলা হেঁটে যাচ্ছি সমুদ্দুর
আমার চোখে বৃষ্টি ভিজছে খুব
ক্লান্ত পাতায় ঘুমের আফসোস
আয় একটিবার তুই স্বপ্ন দেখার রঙ
আয় একটিবার তুই ঠোঁটের শব্দকোষ
একলা আমার লাগছে ভীষণ ভয়
আমি নিজের কাছেই বাড়াচ্ছি বিস্ময়
তোকে ভুলতে থাকার চেষ্টা
আমার হারিয়ে দিচ্ছে সুর
আমি একলা হেঁটে যাচ্ছি সমুদ্দুর ...
** কাব্যগ্রন্থ "ভালো থেকো মন"
সময়
______ রুদ্র গোস্বামী
কেমন আছো, কাকে বলবো ?
সবাই দিব্যি ভালো থাকার ভান করে আছে।
কথা রেখো, কাকে বলবো ?
সবার কাঁধে একটা করে না রাখা কথার
পাহাড়।
কাকে বলবো, মনে রেখো ?
সবার হৃদপিণ্ডে টাঙান কয়েক প্রস্ত রঙিন
মুখোশ।
কাকে বলবো, তুমি হাত ধরতে জানো ?
সবার মুঠো ভরতি স্বপ্ন খুনের ঋণ ।
কাকে বলবো, শুনতে পাচ্ছ ?
কেউ এখানে কান পেতে নেই ।
কাকে বলবো ? ইচ্ছে হলে আসতে পারো ।
সবাই যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে প্রস্তুত ।
কাকে বলবো ? দেখে যাও,
তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি ।
সবার চোখে চওড়া ফ্রেমের রুপালী আকাশ ।
No comments:
Post a Comment