Thursday, January 14, 2021

এলিট দাশ গুপ্তা

 

|| কথোপকথন ||
- চারুলতা সেন, চিনতে পেরেছেন? আমি ডাঃ অখিলেশ!
- হ্যা অখিলেশবাবু! আজ কতোগুলো বছর পর! আপনার সাথে এমন আচমকা কফিহাউসে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।
- সেই কলেজর পর আজ প্রায় ১৩ বছর শেষে আমরা দু'জন মুখোমুখি। সময় কিভাবে ফুরিয়ে যায় বলুন?
- সত্যি তাই! তারপর বলুন, কেমন আছেন? এখানে হঠাৎ?
- আমি এখন শিলিগুড়িতেই থাকছি। গেলো বছর ট্রান্সফার হয়েছি।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করলাম, আপনি কেমন ভাবলেশহীনভাবে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন!
- ইদানিং মন খারাপ হলে এখানেই আসি অখিলেশবাবু। রাতের শহরের মতো কফিহাউসটা কেমন ভীষণ শান্ত।
- রাতের শহরের মায়াটুকু ভারী অদ্ভুত চারুলতা! ভেতরের শূণ্যতাটুকু মুছে দেয়।
তারপর বলুন, বিয়েথা করেছেন? ''অনুরাগ রয়'' কেমন আছে?
- অখিলেশবাবু, আমাদের যোগাযোগটা আর নেই। সব নিভে গিয়েছিলো হঠাৎ!
শুনেছি, সামনের ফাল্গুনেই সে বিয়ে করছে!
- একি! শেষটা কেন হয়েছিলো?
- জীবনটা একটা ট্রাজেডি বুঝলেন। কিছু গল্পের শেষ বিনা নোটিশেই হয় কেমন ঝড়ের মতো।
- ঝড়টা সামলে উঠেছেন কিনা জানিনা। তবে গল্পটা ভীষণ শুনতে ইচ্ছে করছে!
- ঝড় কখনো একেবারে থেমে যায় অখিলেশবাবু? বারবার ফিরে ফিরে আসে। হুটহাট বুকের মাঝে এসে তুফান তোলে।
- কি হয়েছিলো চারুলতা?
- তখন আষাড় মাস। একদিন সন্ধ্যায় গায়ে ভীষণ কাপুনি দিয়ে জ্বর এলো। আমি টের পেলাম, যে হাতটা রোজ মাথার পাশে বসে চুলে বিলুনি কেটে দিতো, যত্ন করে কপালে চুমু খেতো, সেই হাতটা আস্তে আস্তে ভীষণ অবহেলায় দূরে সরে যাচ্ছে। আমি জ্বরের ঘোরে প্রায় নিষ্প্রাণ চোখে সেই হাতদুটো খুঁজতাম। মানুষটা আসতো, হঠাৎ এসে চোখভর্তি মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকতো। তারপর আবার হারিয়ে যেতো। সেই তেরো দিনের জ্বরটা ভীষণ ভোগালো অখিলেশবাবু। আমি কেমন নিস্তেজ হয়ে গেলাম।
- তারপর?
- তারপর একসময় কাচের পারদের উঠানামা শেষে জানতে পারলাম, মানুষটা আর আমার নেই। দূরত্বের খেসারত দিয়ে সে সম্পর্ক পাল্টেছে! নতুন ঘর হয়েছে তার। সে অন্য কারো সাথে আছে।
- সেকি চারুলতা! আপনি কারণ জানতে চাননি?
- চেয়েছি বহুবার। উত্তর আসেনি! সে হঠাৎ ঝড়ের মতো এসে একরাতে আমায় শক্তমুখ করে জানিয়ে দিলো, তার জীবনে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
সেদিন মানুষটাকে চিনতে পারছিলাম না অখিলেশবাবু! চশমার কাচ পাল্টানোর মতো জীবন থেকে মানুষ পাল্টানো এতো সহজ কেন বলুন তো?
- নতুন মানুষে চোখ আটকে গেলে পুরাতন মানুষে মুগ্ধতা ফুরিয়ে আসে চারুলতা!
- অখিলেশবাবু, মুগ্ধতা আর বিশ্বাস একটা সম্পর্কের এপিঠ-ওপিঠ তাইনা? কি অদ্ভুত!
অনুরাগ চলে যাওয়ার পর আমার সবকিছু ভীষণ এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি ভেঙে চুরমার হয়ে গেলাম, ভয়ে কুকড়ে গেলাম।
তারপর সেই ভুল দরজায় হাত পেতে গেছি বহুবার। অপমান আর অবহেলা গিলে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরেছি। নিজের ভালোবাসার কাছে ভীষণভাবে ঠকে গিয়েছি অখিলেশবাবু।
- চারুলতা, যে ঠকায় সেও ঠকে। ব্যবধান শুধু সময়ের। জীবনকে তার গতিতেই ছেড়ে দিন।
- ঠকে হয়তো। তবে অখিলেশবাবু, তাকে আমি অভিশাপ দিইনি। অনুরাগ চলে যাওয়ার সময় কেবল প্রার্থণায় বলেছিলাম - ''ঈশ্বর তোমায় কখনো বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণা না দিক।''
- দেখুন, আমরা ভুল করার বয়সে ভুল করি। তবে সেই পুরাতন ভুলগুলোকে এভাবে বুকে পুষে রাখলে নিজেই হেরে যাবেন চারুলতা।
- অখিলেশবাবু, আমি তো হেরেই বসে আছি।
আর ভুল কেন বলছেন? অনুরাগ আমার জীবনের একটা সুন্দর সত্যি। হয়তো আমাদের সময়টা ভুল ছিলো।
আমি বিশ্বাস করি, সম্পর্কের টানাপোড়েন শেষে একটা জলজ্যান্ত মানুষের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো কখনো মিথ্যে হয়ে যায়না। হয়তো ফিকে হয়, ধূলোবালি পড়ে৷ পুরাতন স্মৃতির উপর নতুন স্মৃতি জমা হয়!
- অনুরাগের প্রতি আপনার জমানো কোন অভিযোগ নেই?
- কি লাভ বলুন? যেখানে অধিকারটুকু বেঁচে নেই, সেখানে আমার অভিযোগ পুষে রাখা বড্ড বোকামো।
- তবুও তো মানুষ বুকে মিথ্যে অভিযোগের পাহাড় জমায়।
- দেখুন, সম্পর্ক শেষে নিজেকে স্বচ্ছ রাখতে বিচ্ছেদের দায় কেউ নিতে চায়না বলেই হয়তো একটা সময় শুরু হয় অভিযোগ পর্ব। আমি সেইসব মানুষের দলে নয় অখিলেশবাবু। মানুষটা আজ আমার নেই এটা যেমন ঠিক, তবে একসময় সে আমার ছিলো এটাও সত্যি। শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটা এতোটা ঠুনকো হলে তাকে ভালোবাসলাম কোথায় বলুন?
- আপনি ভারী গুছিয়ে কথা বলেন। আমি লক্ষ্য করেছি, আপনি কথা বলার সময় আপনার চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করে।
- মায়া নাকি মোহ ঠিক জানিনা। তবে সেই মায়া অনুরাগকে কেন আটকে রাখতে পারেনি বলুনতো?
- দেখুন চারুলতা, পৃথিবীতে মানুষের দুই ধরনের দুর্বলতা আছে। এক 'প্রয়োজনীয়তা' অন্যটা 'বিলাসিতা'। অনেক পুরাতন জিনিসের প্রয়োজন ফুরালেও আমরা সেগুলো বেশ যত্ন করে তুলে রাখি। তাতে আমাদের একটা মায়া পড়ে যায়, শ'খানেক স্মৃতি জড়িয়ে যায়। আমরা আগলে রাখি।
তবে বিলাসিতার ক্ষেত্রে মানুষ কেবল মোহের পেছনে ছুটে মরে৷ এইক্ষেত্রে 'মায়া' শব্দটা বড্ড ব্যাকডেটেড।
- অখিলেশবাবু, মানুষের জীবন একটা সুন্দর মিথ্যা।
সবটা জেনেও কিছু সত্যি আমরা এড়িয়ে চলি৷ সত্যি সুন্দর হলেও সবসময় কঠিন হয়৷ তখন আমরা মিথ্যাকে বিশ্বাস করে চোখ বুজে ভালো থাকি!
- হয়তোবা! চারুলতা, জীবন থেকে পালাতে ইচ্ছে হয় কখনো আপনার ?
- প্রায় হয়। তবে ইদানিং বুঝে গেছি, জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা সহজ নয় বুঝলেন। ভেতরের সব শূণ্যতা, ভয় মাঝরাতে ভীষণ ভোগায় অখিলেশবাবু। দমবন্ধ লাগে, ভয়ে শিটিয়ে থাকি এক কোনায়। দরজা জানলা আটকে কান্না করি। তারপর বুকের ভেতরের সমস্ত ভারী নিঃশ্বাস বের করে দেই।
- বিশ্বাস করুন, আপনি সেরে উঠবেন চারুলতা। সময়ের পেন্ডুলামটা ঘুরে গেলেই অনুভূতির দিক বদল হতে সময় লাগেনা।
আপনি কাদঁবেন না চারু। চোখ মুছুন প্লিজ। আপনি ভীষণ প্রানবন্ত নারী। অথচ আপনার চোখের তলার নিস্তেজ শূণ্যতা আপনাকে প্রাণখুলে হাসতে দেয় না।
- ওই দেখুন, সময় কিভাবে ফুরিয়ে যায়। আজ তো আপনার রোগী দেখার দিন। আমার সাথে আর কিছু পথ এভাবে হাটঁবেন অখিলেশবাবু?
- হ্যা নিশ্চয়। আজকের সন্ধ্যেটা কেমন অদ্ভুত সুন্দর তাইনা চারুলতা? শহরজুড়ে কার্ফিউ, শূণ্য কফিহাউজ, একটা গুমোট আকাশ, সোডিয়াম আলোতে দুটো মানুষের গন্তব্যহীন পায়ের ছাপ!
- গন্তব্য জেনে গেলে মায়া বাড়ে অখিলেশবাবু। মানুষটাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে রাখার মায়া!
- চারুলতা, আপনার পেছনের সব ক্ষতের চিহ্ন হয়তো আমি মুছে দিতে পারবো না। তবে একজন বিশ্বস্ত পুরুষ হয়ে সারাজীবন আপনার দূঃখবোধের নাবিক হতে পারি..
- এটা সম্ভব নয় অখিলেশ।
- কেন নয়?
- চরম দূঃখবোধের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কেউকে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে দেখেছেন? আমি আর কাছের মানুষ হারাতে চাইনা অখিলেশবাবু।
আমি খুব ক্লান্ত। ঘরে ফিরে সব ক্লান্তি মুছে একটু চোখ বুজে ঘুমোবো। আপনি ভালো থাকুন। আপনাকে ভীষন বিরক্ত করছি।
- একদম নয়। আমি ভীষন মনোযোগ দিয়ে শুনছি আপনার কথাগুলো।
-শুনছেন, তবে একদিন হাঁপিয়ে যাবেন!
- শুনুন, শহর থেকে বেশ অনেক দূরে একটা বাড়ি নেবো বুঝলেন। সেই বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে সকালের মিষ্টি রোদ যখন আপনার ঘুমন্ত চোখে এসে পড়বে, আমি রোজ দিব্যি কেটে বলবো ''চারুর চোখের সমস্ত দূঃখবোধ আমায় দাও ঈশ্বর''।
- আমি আর স্বপ্ন দেখি না অখিলেশবাবু!
- স্বপ্ন নয় তো!
চারুলতা, আমার সাথে সংসার করবেন...?
কখনো হাপিঁয়ে গেলে দু'জনে কাধে পিঠ ঠেকিয়ে নাহয় একটু জিরিয়ে নেবো কোথাও..
- দেখুন অখিলেশবাবু, সুখে থাকার অসুখে ভুগেছি বহুবছর। কিছু পায়নি। তবু মাঝসমুদ্রে তলিয়ে যেতে দিইনি নিজেকে।
জানেন তো, দূঃখিত নারীকে কাধ দেওয়ার মতো পুরুষের অভাব নেই। তবে আমায় তাদের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না প্লিজ। ঝড় শেষে নিজেকে সামলে নেবো ঠিক।
আপনি আসুন। বিয়ে করে সংসার করুন। আবার নাহয় বছর পাঁচেক পর এমন আরেকটা বর্ষার সন্ধ্যায় টেবিলের উপর কনুই ঠেকিয়ে আমার দুঃখবোধের নাবিক হবেন......
- বেশ চারুলতা! পুরোনো ঠিকানাটা বদলাবে না কখনো। ইচ্ছে হলে চিঠি দেবেন।
- বেশ! যদি কখনো আমার পথ ফুরিয়ে আসে, যদি পুরাতন ছেড়ে 'নতুন' ঘর খোঁজার ক্লান্তি জেকে বসে আমার নরম কাঁধে। যদি ভীষণ আক্ষেপে মাঝরাত্তিরে দীর্ঘশ্বাস আঁকড়ে ধরে বুকে, শেষ আশ্রয় যদি আর খুঁজে না পাই.. তবে আমাদের আবার দেখা হবে।
- অপেক্ষায় থাকলাম চারু!
হয়তো একটা সন্ধ্যায়, একটা ফুলের পসরা সাজানো ছোট্ট দোকানে, হলুদ সোডিয়াম বাতির নিচে ক্লান্তিভেজা দুই জোড়া ভেজা চোখের পাতায় আমাদের আবার দেখা হবে...
- যদি মাঝপথে কখনো মুগ্ধতা ফুরিয়ে আসে?
- চারুলতা, মুগ্ধতা ফুরোলেও আমি ফুরোবো না।
পুরাতন ঠিকানাটা ছেড়ে যাবো না কখনোই, যেভাবে আপনার ঠিকানাটা ছেড়ে গিয়েছিলো আপনার অনুরাগ........!
©
Elit Das Gupta
 
 
 
 
 
 
 
| মৃণালিনীর শেষ চিঠি ||
২৫শে শ্রাবন ১৪২৫।
রোজ রবিবার।
বরঃ নিখিলেশ মিত্র। কণ্যাঃ মৃণালিনী রায়।
শুভবিবাহ ও প্রীতিভোজ।
গোটা অক্ষরে আমার বিবাহের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হইলো। এখনো চোখ বুজিলে সে দিন আমি দেখিতে পাই।
তখন শ্রাবণ মাস। বাড়ির বাহিরে সেদিন আলো ঝলসানো উঠোন। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের ঝাপসা চাঁদ।
আমাদের শুভ-বিবাহ!
আপনি একটি ঘিয়ে রঙের ধুতি আর কপালে একখানা লাল তিলক পড়িয়া আমার মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছেন। বিয়েবাড়ির ভীড়েও আপনার সেই স্নিগ্ধ চোখের চাহনি আমার নজর এড়াইতে পারে নাই। বামুন ঠাকুরের সাথে কন্ঠ মিলাইয়া বিড়বিড় করিয়া আপনি মন্ত্র পড়িতেছিলেন!
হঠাৎ চারদিকে উলুধ্বনি পড়িলো। অগত্যা আমার ঘোর কাটিলো।
সেদিন কেনো আপনার মাঝে আমি আমার দেবতাকে খুঁজিয়া পাইলাম বলতে পারেন..? মনের সকল ভক্তি দিয়া যে পুষ্পমাল্য সেদিন আপনার গলায় আমি পড়াইলাম, তাতে কতখানি আমার অতীতের সকল পাপ মুছিলো তা আমি জানিনা, তবে সেই মুহূর্ত হইতেই আমার দেবতার জন্য নিজের সবটুকু প্রেম উজাড় করিয়া দিয়াছিলাম।
কেবল আপনি-ই জানিতেন আমার জীবনের সকল কালো-সত্য!
আমার মা গেলেন জন্মের সময়, আর বাপটাও শশ্মানের মুখ দেখিলেন ঠিক তার ৭মাস পর৷ অতএব ওই বয়সে অনাথ হইয়া আশ্রয় পাইলাম মায়ের এক দুসম্পর্কের পিসতুতো দাদার নিকটে।
কিন্তু যে পোড়া কপাল নিয়া দুনিয়ার মুখ দেখিলাম, সে লিখন খন্ডাবে কে?
একটু যৌবন খুলিতেই মামাবাবুর নজর আসিয়া পড়িলো আমার উপর। সেবার বয়স বারো পেরিয়ে তেরোতে পড়িলাম!
আমার সেই তেরো বৎসরে শরীরের যেসব অঙ্গে তখনো পরিপূর্ণতা আসেনি, মামামশাই সেসব স্থানে বিনা নির্দ্বিধায় কেমন স্পর্শ করিতেন। আমি ভয়ে আর ব্যথার যন্ত্রণায় চোখের জল ফেলিতাম কেবল। রাত বাড়িলে ব্যথায় কুকড়ে যাইতাম, কিন্তু এমনই এক ভাগ্য নিয়া জন্মাইছি যে মাথার উপরে না ছিলেন বাপ-মা, না ছিলেন আপনি!
সময় বাড়িতে লাগিলো। সাথে বাড়িলো একটা সরল মেয়েতুল্যা কিশোরীর উপর মামাবাবুর নোংরা চাহনি।
সেবার বৃষ্টিবাদলের রাত্রি। বাড়িতে চালার উপর ভীষণ বজ্রপাতের শব্দ। আলো চলিয়া গেলো সন্ধ্যা থেকে। প্রদীপের আলোয় ঘর আবছা অন্ধকার। আমি ভয়ে দরজার কপাট লাগাইলাম।
রাত বাড়িলে হঠাৎ মামামবাবুর চাপা কন্ঠ শুনিতে পাইলাম!
হায় কপাল! খানিকটা সময় নিয়া কাঁপা হাতে দরজা খুলিতেই একটা ষাটোর্ধ্ব বিশাল কালো দামড়া শরীর ঝাপিয়া পড়িলো আমার উপর। ভয়ে-ঘেন্নায় গলা থেকে আর শব্দ বাহির হইলো না। দাঁত-মুখ খিচিয়া কেবল বৃথা যুদ্ধ করিয়া গেলাম আমার নিয়তির সাথে!
সেরাতে আমি আমার সব হারাইলাম৷ সব..!
তবু মরে যাবার সাহস করিতে পারিলাম না! নিরুপায় হইয়া বাপের টিনের বাক্সখানা হাতে নিয়া রাতের আধারেই সে ভিটা ছাড়িলাম।
কিন্তু আমার ভাগ্য আমারে ছাড়িলো না!!
ট্রেনে চাপিয়া দৃষ্টিশূণ্য চোখে যখন উদাস হইয়া বসিয়া রইলাম, চোখে ক্লান্তি ভর করিলো। চোখ লাগিয়া আসিতেই জ্ঞানশূন্য হইলাম। তারপর নিজেকে আধমরা অবস্থায় পাইলাম এক প্রাচীন পতিতালয়ের আলো ঝলসানো বন্দী কক্ষে!
বুঝতেই পারছেন, এই ভাগ্য স্বয়ং ঈশ্বর লিখেছেন ভারী যত্নে। খন্ডাবে কার সাধ্যি?
সেখানে রোজ রাত নামিত আর শরীর বেচাকেনার কি অদ্ভুত একটা খেলা শুরু হইতো।
বুঝিতে পারিলাম, জীবনের সত্য থেকে আমি যতো পালাইয়া বাঁচিবো জীবন আমারে তত রঙ্গমঞ্চের সাক্ষী করিবে!
অতএব "শরীর" আমার কাছে আসিয়া ঠেকিলো কেবলই একটা শব্দে! এই শরীর বিলিয়া দিয়াছি অসংখ্য পতিতালয়ে, অসংখ্য পুরুষের কয়েকমুহূর্তের কাম মিটাইতে!
বিশ্বাস করুন, সেই পুরুষদের মধ্যে চোখভর্তি লালসা ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাইলাম না আমার জন্যে! কারো চোখে খুঁজে পাইলাম না বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব! আমার পিঠে আর বুকে কালো লালসিটের দাগ বলিতে পারে আমার রাত্রিগুলা কতোটা দীর্ঘ আর যন্ত্রণার ছিলো ! এ যেন পৃথিবীতে রাখিয়াও নরকের স্বাদ দিলেন আমায় ঈশ্বর!
তার কিছুদিন পর দেশে নতুন এক সরকার আসিল। আইনে হইলো কঠিন সংস্কার। পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধের দাবি উঠিলো।জোর অন্দোলনের চাপে সংবাদমাধ্যমেও ঝড় উঠিল। পত্রিকাতে ছাপানো হইলো নতুন শিরোনাম।
আমাদের পল্লিতে পুলিশের টহল পড়িলো। এক রাতেই ভেঙে গেলো শত পুরুষের কাম মিটানোর কারখানা!
আমরা মুক্তি পাইলাম!
সাথে আমি পাইলাম আপনার সাক্ষাৎ!
বৈশাখ মাসের এক সন্ধ্যায় শিয়ালদহের সেই স্টেশনে আমার সব অতীত জানিয়াও কি নির্দিদ্ধায় সেদিন আপনি আমায় গ্রহণ করিলেন তা আমি ভুলিতে পারি না। একমাত্র আপনার চোখেই নিজের জন্য ভীষণ সম্মান আর ভালোবাসা আমি খুঁজিয়া পাইলাম।
শ্রাবণ মাসে আমাদের বিয়ে ঠিক হইলো!
সেই থেকে বিবাহের পর আপনাকেই নিজের দেবতা মানিয়া অন্তরের সকল পবিত্রতা দিয়া পুজিতে লাগিলাম। নতুন করিয়া আশায় বুক বাঁধিলাম!
আমাদের সংসার হইলো!
কিন্তু গল্প-উপন্যাসের শেষের পাতার মতো আমরা আর এক হইলাম না!
বিবাহের দু'বছর পর গ্রীষ্মের এক তপ্ত দুপুরে আপনার পাঞ্জাবীর পকেট হইতে একখানা চিঠি উদ্ধার করিলাম। সেই দু'পাতার চিঠির ভাজ খুলিতেই আমি টের পাইলাম, আমার কপাল পুড়িলো!
শেষ লাইনে আপনি গোটা অক্ষরে লিখিয়াছেন-
"অনুরাধা, কাল নীল টিপ পড়ো! তোমার নীলাভো মায়া সমুদ্রকেও ভারী হার মানায়!
- ইতি তোমার নিখিলেশ!"
আমার বুক ধরিয়া উঠিলো। চোখ ঝাপসা হইলো। মুহূর্তেই মাথার উপর বিশাল আকাশ ভাঙিয়া পড়িলো। আমি সব হারাইলাম!
বুঝিলাম, আমায় আপনি জয় করার আগ মুহূর্ত পর্যন্তই মোহে ছিলেন৷ পেয়ে গেলে সেটার আর আবেদন থাকে না। অতএব আমিও ফিকে হইলাম।
তারপর মাস গেলো, বছর গেলো! তবু আপনারে আমি এতোটুকু ঘৃণা করিতে পারিনাই!
যদি জন্মান্তরে বিশ্বাস করেন, তবে জানিবেন পরের জন্মে আমি যেন যৌবনের প্রথম আলোয় আপনার সাক্ষাৎ পাই। তবে সেখানে কোন নীলাভো রঙের 'অনুরাধার' সাক্ষাৎ যেন আপনার না হয়, শুধু এই মিনতি আমার!
আপনাকে হারাইয়া আমি আবার সেদিন অনাথ হইলাম! আজ বাবা বাঁচিয়া থাকিলে হয়তো স্নেহ করিয়া মাথার উপর হাত বুলায়তেন। বাবার সেই হাসিমাখা কাঠের ফ্রেম বাধানো সাদাকালো ছবিটা হঠাৎ চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিলো। ভাবিলাম, জীবনের শেষ মুহূর্তে বাবাকে একখানা বেনামি চিঠি লিখি!
"শ্রীচরণেষু বাবা,
আজ বাইশ বছর পার হইলো আপনাকে হারাইলাম। সেই যে অনাথ হইলাম, সেথেকে জীবনের প্রতিটি মোড়েই কেবল নতুন এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হইলাম। আজ আমি ভারী ক্লান্ত৷
একবার ভাবিলাম, জীবনের বুঝি মোড় ঘুরিলো। নিখিলেশ আমারে অন্ধকার পতিতালয় থেকে আনিয়া এক মুক্তির স্বাদ দিলো ঠিক। কিন্তু আবার একটা ঝড় আসিয়া আমার সেই সংসারটাও তছনছ করিয়া গেলো।
নিখিলেশের কোন দোষ নাই! তিনি আমায় সব দিয়াছেন।
আলমারি ভর্তি বেনারসের শাড়ি, সোনার কাঞ্চনবালা, চার-পাঁচটে ঝি-চাকর, কিছুর অভাব রাখেন নাই আমার!
শুধু যে মানুষটাকে আশ্রয় করিয়া পেছনের সকল অন্ধকার পায়ে ঠেলিয়া বাচিঁতে চাইলাম, তিনি ফের আমায় অন্ধকারেই পাঠাইয়া দিলেন!
তোমার মৃণালিনী ভালো নাই বাবা!
শরীরকে রোগবালাই না ছুইলেও আমি মনের শক্ত ব্যামো বাধাইলাম! কিন্তু বাবা, শরীরটার ব্যামো নিয়াই দুনিয়ার সকলের দুশ্চিন্তা। এই গুমোট শহরে মনের খবর কেউ রাখেনা!
তবে আমি আমার ব্যামোর ব্যবস্থা করিলাম। খানিক আগে একখানা বিষের শিষি গলায় ঢালিয়া নিলাম!
আমার সকল যুদ্ধ ফুরিলো বাবা.…..!
ছোটবেলায় মামাবাবুর কাছে একজন 'ধর্ষিতা' , অসংখ্য পুরুষের বিছানায় একজন 'পতিতা' এবং নিখিলেশের কাছে একটা 'অতীত' হইয়া আমি আমার জীবনের গল্পের ইতি টানিলাম!
-ইতি তোমার মৃণালিনী!"
©
Elit Das Gupta
 
 
 
 
 
অতুল্য সেন,
তোমাকে যেদিন ছেড়ে এসেছিলাম সেদিন মাঘী পূর্ণিমা! সন্ধ্যেবেলার ভরা আলোয় তোমার মুখটা সেদিন আমি শেষ বারের মতো দেখেছিলাম!
আমার সেই আঠারো বছরের ভরা যৌবনে যে পুরুষ আমার মনে প্রথম বসন্তের আভা ছড়িয়েছিল, সেই মানুষটা তুমিই... "অতুল্য সেন!"
সদ্য ডাক্তারী পাশ, ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, ভারী গলার স্বর, কথার চটকায়ীতা এবং আদতে ভীষণ ভালো একজন মানুষ...
অথচ কি অদ্ভুত অতুল্য!
কি নিথর একটা দেহ নিয়ে আজ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছো তুমি! আমার কেবল দু'আঙ্গুল দূরত্বে দাঁড়িয়ে কেমন শক্ত হয়ে শুয়ে আছো, একটা ভেজা তোষকের উপর!
কি গাঢ় স্নিগ্ধ অঙ্গরূহ! কেমন মলিন তোমার মুখখানা!
অতুল্য, তুমি আর নেই....! এ-ও আমি ভাবতে পারি?
অথচ,
শহরের মহামারী শেষে একটা "কনেদেখা গোধূলী আলোয়" তোমার হাত ধরে আমার শিউলি কুড়োনোর কথা ছিল!
কফিহাউসের যে বেঞ্চিটায় আমাদের তুমুল প্রেমের গল্প জমেছিল একদিন, সেখানে মুখ ডুবিয়ে আরো একটা বর্ষার সন্ধ্যায় আমাদের ভেজার কথা ছিল...
সামনের পূজোয়, সিথীভর্তি সিঁদুর মেখে পূজোর ঘরে মায়ের সাথে দূর্বো বাছার কথা ছিল...
কথা ছিল, একটা অনাকাঙ্খিত রাতের শেষে ছোট্ট চাঁদের আলো হাতে নিয়ে প্রথম "বাবা" হবার আনন্দে তোমার আটকানা হবার!
কিন্তু কোথায়? কিছু তো হলো না.......
বরং আজ আমার কুড়ি বছরের মনের বয়সটা হুট করে অনেকখানি বেড়ে গেল! সমাজ আমায় পড়ালো "ধবধবে সাদা থান... "
আচ্ছা, মরে যাওয়ার আরাধনা এতো সহজ কেন অতুল্য ? কই, আমি তো মরিনা...?
আজ দু'মাস হলো, সাদা থান তুলেছি গাঁয়ে.. ছেড়েছি লাল সিদুঁরের দগদগে দাগ..
আষাড়ের বিদ্যুৎ চমকানো অন্ধকার রাতে বেনামি চিঠিতে লিখছি...
"অতুল্য সেন,
আমার ভারী সংসার করতে ইচ্ছে করে জানো... কেন কুড়িবছরের একটা সদ্য কিশোরীর গায়ে তুমি প্রেমের আল্পনা না একে, বিয়ের মাত্র তেরো দিনের মাথায় পড়িয়ে দিলে বিধবার সাদা থান..?
অতুল্য, বিকেলে উঠোনে চোখ ঝাপ্সা হলেই কেবল তোমায় দেখি.. "তুমি মাটিতে মুখ থুবড়ে নিথর হয়ে পড়ে আছো একটা নিস্পৃহ চাহনি নিয়ে..."
বুকের ভেতর কেমন দুমড়ে মুচড়ে হুহু করে উঠে....
জানো অতুল্য, আমি চোখে কাজল পড়িনা কতোকাল.. চুলে মাখি না সুগন্ধি তেল..মোড়ের দোকান থেকে যে রুপোর নুপুড়জোড়া গড়িয়ে দিয়েছিলে, খুলে রেখে দিয়েছি সেগুলো...বিয়ের শাড়ীটা আলমারিতে তুলে রেখেছি যত্ন করে...
আয়নায় নিজেকে আর দেখতে ইচ্ছে হয়না ইদানিং...
মা বলেছেন- "বিধবাদের সাজতে নেই"..
তোমার চিত্রা আর সাজে না অতুল্য...
অতুল্য মনে পড়ে, অভ্রদার কফিশপে তুমুল কালবৈশাখীর এক সন্ধ্যায় আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে তুমি বলেছিলে- "চিত্রা, আমি চলে গেলে কি করে সামলে নেবে সব?"
সেদিন ভৃতস্থ কন্ঠে বলেছিলাম- "এর উত্তর কেবল স্রষ্টা জানেন!"
তবে অতুল্য , তোমার সেই আঠারো বছরের "চিত্রা ব্যানার্জি" আজ ভারী শক্ত হয়ে গেছে...শত কালবৈশাখী ঝড় আজ আমায় আর ভাঙতে পারেনা..
আমি ভুলে গেছি বেঁচে থাকতে...
বুঝে গেছি, মাঝরাতে বুকের মধ্যে হুট করে নেমে আসা দুঃখে কেউ মরে যায়না... কেবল একটা জ্যন্ত লাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে হয়ত অনাগত বাধর্ক্যের দিকে...
তুমি ভেবো না, অতুল্য! সংসারে "অপয়া" নামে আজো বেঁচে থাকার ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে আমি টিকে আছি পশ্চিমের অন্ধকার ঘরে...
সময় ফুরোলে চলে যাবো! তুমি নাহয় অপেক্ষায় থেকো অতুল্য সেন .....
-ইতি "তোমার চিত্রা"!
©
Elit Das Gupta
 
 
 
 
 সহজ স্বীকারোক্তি!
 
'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।'
ভুল বলেছেন নজরুল, নারী কবে কী করলো ভালো?
আমি নারী, আমি ছলনাময়ী, আমি জগতের কালো।
গৃহিণী মানেই কাজ নেই কোনো, সারাদিন দেখি টিভি
সারা দিন শুধু জি বাংলা আর পাশের বাড়িতে ‘জানেন ভাবী?’
অফিসেও আমি বড় অকেজো, মুখে আটা মেখে সময় কই?
বসের সাথে ফ্লার্ট করেই বছর বছর প্রোমোটেড হই।
কথা কম বললে অহংকারী, বেশী বললে স্লাট
সমাজটাকে বিগড়ে দিচ্ছে আমার ব্লাউজের কাট।
লক্ষী ছেলে হঠাত এতো অবাধ্য হলো কেন?
নিশ্চয়ই বউ বশ করেছে, ডাইনী একটা যেনো।
ছেলেমেয়ে কথা শোনেনা, মা-ই খেয়েছে মাথা
স্বামী করছে পরকীয়া, সেও আমারই ব্যর্থতা।
প্রেম দিয়ে যদি আগলে রাখতাম লক্ষী বউয়ের মতো
দেবতা স্বামী আমার, সে কি অন্যমুখী হতো?
ডিভোর্স হলেও আমারই দায়, সংসার টেকাতে পারিনি।
আগে ভাগে সময়মতো ক্যারিয়ার কেনো ছাড়িনি?
আর, চাকরি করার দরকারটা কী? অনেক কামায় স্বামী
ঘরে বাচ্চা রেখে অফিস করি, কেমন মা আমি?
ধর্ষণটাও আমারই দোষ “ঐ মেয়ে তোর ওড়না কই?”
রাতের বেলা বাইরে ছিলাম, বিপদে তো পড়বই।
মেয়েরা সাজে বেশী, কাজে কম
ঝগড়া বাধায় হরদম
ছেলেরা করলে স্টাড- প্লেয়ার
মেয়ে করলে? বেশরম।
জাহান্নামে নারী বেশী; পুরুষ? সেতো সাধু সন্ন্যাসী
নারীই কেবল সর্বনাশী- প্রুড নাহয় হোর
দোষগুলো সব আমার রে ভাই- গুণগুলো সব তোর।
সংসার- সমাজের হাজারো মিথ্যা অপবাদ সহ্য করে আসছে বিশ্বের কোটি নারী।
আর না। হোক প্রতিবাদ।
 
 
 
 
 
আমাদের বিচ্ছেদটার ভীষণ প্রয়োজন ছিল অনিকেত!
সম্পর্কের বেলা ফুরিয়ে এসেছিল বহুকাল আগে! আমরা কেবল একটা বিন্দুতে আটকে ছিলাম অভ্যাসের পিছুটানে!
তবে অনিকেত,
আমারও মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটে পালানোর ইচ্ছে হতো! ইচ্ছে হতো, তোমার আমায় দেওয়া সবকটা অহেতুক অবহেলার হিসেব চুকিয়ে দিয়ে আমিও দেখিয়ে দিই - "অনিকেতদের ছাড়াও নীরারা ভালো থাকতে পারে!"
কিন্তু আমার সাহস হলো না। যে সম্পর্কে মরিচা ধরে গেছে বহুকাল আগে, সেটা আঁকড়ে পড়ে থাকে এই শহরের কয়েকশো নীরা'রা!
টের পায় কেবল , এই ইট-পাথরের লাল জমিনের গভীর দীর্ঘশ্বাসগুলো!
আমি তবুও বেশ আছি অনিকেত! এই যে মন খারাপ হলে চিঠি লিখছি? সন্ধ্যের অবসরে আজো আমি জ্যোস্না দেখি..বেহালার সুর শুনি!
যাই হোক! আমার নতুন চাকরিটায় বেশ মানিয়ে নিয়েছি এখন!
এই এতোবড় শহরে দিনশেষে মাথা গোজার জন্য যতটুকু ঠাঁই দরকার, তা আমার আছে বৈকি! শুধু দিনশেষে মুখগুজে কাঁদবার জন্য আমার কোন অনিকেত নেই!
এখন অনিকেতদের বুকে হাজারো নীরার বসবাস! আমার যে কেবল নিজস্ব একজন অনিকেত চাই... একান্ত নিজের, বড় আপন...!
শেষ চিঠিতে লিখেছিলে, প্রবল বর্ষণে আজো আমার ভ্রম হয় কিনা..
অনিকেত, গভীর রাতে তীব্র বজ্রপাতে যখন আকাশটা কেঁপে উঠে, আমি মায়ের হলুদে শালটা জড়িয়ে আজো দোতলার ছাদে উঠি!
ভেজা মাটির গন্ধ নিই..পাতার ভাজে বৃষ্টির ফোঁটায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু ছুঁয়ে দেখি!
কেমন হুট করেই বুঝতে পারি, এই রাতের শহরটা কতোটা পুরাতন!
অনিকেত, শহরের সমস্ত নীরাদের কি এমন হুট করে ভীষনভাবে বেচেঁ থাকতে ইচ্ছে করে?
উত্তরে তুমি লিখবে হয়তো-
" প্রিয় নীরা,
শ্রাবণ মাসে রাত জেগে সমরেশের "দীপাবলীর" গল্প তুমিই শোনাতে!
মনে পড়ে? কতোটা ভীষন যন্ত্রণা সইয়ে বেঁচে ছিল দীপা?
মরে যাই কাপুরুষরা! নীরা, তুমি চঞ্চল-বৃষ্টিবিলাসী এক কঠিন নারী। শহরের মায়াটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বুকে জড়িয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দাও।
বেচেঁ থাকতে শেখো নীরা..তুমুল ঝড়েও ভালো থাকতে শেখো!"
অনিকেত, কতো অবলীলায় তুমি কয়েক'শ গজ দূরত্বে থেকেও আমায় ভালো থাকতে বলো! বেশ!
নীরারা কখনো হেরে যায়না..
রাতের আবছা আলোয় খানিকটা শীতলতায় কেমন নিথর হয়ে যায়, কেবল ভোরের আলোয় শুকনো শিউলি ফুল কুড়োবে বলে.....
©
Elit Das Gupta
 
 
 
 
 
 
আমার পুরোনো শহরের শ্যাওলা ধরা দেওয়ালে যখন রবিঠাকুরের গল্পগুলো খেলা করে, তখন কেউ একজন থাকুক আমার "দিব্যেন্দু" হয়ে!
আমি কেবল রাত বিরাতে অবেলায় নাকের ডগা লাল করে গাল ফুলোবো। কেউ একজন সেরাতে বোচা নাক টিপে ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে বলুক নাহয়- "পাগলী, কাজলটা একেবারে ছড়িয়ে গেছে!"
একদিন হলুদ বিকেলে সোনালি রংঙে কোন অচেনা গলিতে হাটঁব, আর সন্ধ্যে হবে হবে সময়টায় একটা ঝুপড়িমতো টংঙে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সূর্য ডোবা দেখব!
খোলা বারান্দাটায় হয়ত একদিন এক পশলা ঝুপ বৃষ্টি নামবে। লাল কৃষচুড়ার গাঁ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা মুখে এসে পড়বে। তখন একটা কড়া চা, কানে প্যাচানো হেডফোন, দূরের কোন বাড়ি থেকে হালকা ভেসে আসা রবীন্দ্রনাথ কিংবা আমার ধুলো পড়া "সমরেশ" নিয়ে সেই সন্ধ্যেটা মিলিয়ে যাবে!
কোন একটা কালো শীতের রাতে কাঁচা-হলুদ তাতের শাড়ি আর খোঁপায় ''বেলিফুলের'' মালা জড়াবো। কপালের "লাল টিপে" কোন গল্পের মাধবীলতা হবো! তারপর কাঠের চৌকাঠে ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে দমকা বাতাসে কারো বাড়ি ফেরার অপেক্ষা হয়ত সারাটারাত!
সবথেকে উচুঁ দালানের মাথায় দাঁড়িয়ে, মধ্যরাতে গোটা শহরের মিটিমিটি আলোর নেশায় একদিন ডুব দেব! এতো অজস্র বাড়ি, এই এতো মানুষের হিজিবিজি চিন্তাগুলো কেমন হয় ওই সময়টাই?
রাতের শেষে ব্যস্ত শহরের মানুষগুলোর ঘরে ফেরা হয় কেন..?
অফিস ফেরা ছেলেটা হয়ত সারাদিনের ক্লান্তি শেষে প্রিয়মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়। কোন রিটায়ার্ড বাবা পরদিন সকালে কি করে ছেলের পরীক্ষার টাকা জোগাড় করবেন, সেই হিসেব মেলাতে গিয়ে হয়ত লুকিয়ে চোখ মুছে কাঁদেন! কমবয়সী মেয়েটা হয়ত কোনার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনের অন্যপাশে অহেতুক কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়!
তারপর গোটা একটা রাত শেষে একটা ধুসর মেঘলা আকাশ.. ভোরের পাখিগুলোর কিচিরমিচির শব্দ..এক পশলা ঝুপ বৃষ্টি.. মাধবীলতার কাচা-হলুদ তাতের শাড়ি.. ভেসে আসা রবীন্দ্রনাথ..!
ফের নতুন কিছু নস্টালজিয়া ....... ! 
©
Elit Das Gupta
 
 
 
 
 
|| হ্যালুসিনেশন ||
এখন সন্ধ্যা! প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যে সন্ধ্যে হলেই আলো নিভে যায় এখানে। চারপাশটায় একটা শূণ্যতা ছড়িয়ে পড়ে। আমি জানলায় এসে দাড়ায়! একফালি আকাশ দেখি! দূরের বাড়িগুলোর হালকা আলোগুলো আমার বেশ ভালো লাগে !
আমার ঘরের জানলা থেকে কখনো চাঁদ দেখা যায়না। তবে আজ দেখতে পাচ্ছি।
এসময় তুফান কিংবা খুব ঝড়ো বৃষ্টি হলে খারাপ হতো না। কতোদিন ভিজি না!
জোরে বাতাস দিতেই হঠাৎ পাশ থেকে ভারী গলার স্বর পেলাম! অরুনাভ এসে দাড়িয়ে আছে বেশ অনেকক্ষন! ছেলেটা অমনই।
ব্যস্ত শহরের বুকে আমার একমাত্র ভীষণ ভাললাগার নাম অরুনাভ!
সময় পেলেই সে এখানে আসে। কোন কথা না বলে একজোড়া মুগ্ধ চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখে! আমি বুঝেও এড়িয়ে চলি। আমার ভালো লাগে!
- অরুনাভ, একদিন শহরের সব থেকে উঁচু দালানটায় একটা ফ্ল্যাট নেব!
- বেশ! আকাশ ছোঁবে ভাবছো?
- নাগো! ওই ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাড়িয়ে কর্ণফুলীর মিটিমিটি আলো দেখব! দূরের জাহাজের আলো! আমার নেশা হয় খুব!
- আলোয় যে বিতৃষ্ণা বললে?
- আবছা আলো, যে আলোয় মানুষ চেনা যায়না! কেবল চেনা মানুষটার গায়ের গন্ধ থাকে!
- তুমি বড় অদ্ভুত!
- ভুল বললে! আমি বড় সেকেলে। আমার জ্বরটা মেপে দেবে অরুনাভ?
- সেকি? কমেনি এখনো? আজো ভিজলে তবে!
- না গো! আজ শহরে বৃষ্টি নামেনি! অরুন, আমি ভীষণ ক্লান্ত। একটু চোখ বুজে ঘুমোবো! তোমার হাতটা আমার কপালে দেবে?
- বেশ! আমি আছি...!
জ্বরের ভীষণ ঘোরের মধ্যেও আমি কপালে অরুনাভর হাতের তাপ পাচ্ছি! ওর হাত আমার চুলের মধ্যে বিলুনি দিচ্ছে, খুব যত্নে! আমি গভীর ঘোরে ঘুমোচ্ছি!
জ্বরের মধ্যে শুনেছি অনেকে প্রলাপ বকে! আমিও কি তাই বকছি?
জ্বর কমে প্রায় ভোররাতে! মাথার বাঁদিকটা এখনো ভারী হয়ে আছে।
বাইরে আবছা আলো! আমার উঁচু দালানের বারান্দা ঘেষে ভীষন সুন্দর কর্ণফুলির আলো।
জ্বরের ঘোরটা সম্ভবত কেটে গেছে। কারণ আশেপাশে কোথাও এখন অরুনাভ নেই!
আমি বুঝতে পারি - "আমার হ্যালুসিনেশন হয়েছে!"
ইদানিং প্রায় এমন হয়! অরুনাভ আসে হুটহাট। কখনো জ্বরের ঘোরে কিংবা কখনো কল্পনায়! আমি কথা বলি!
আমার যা কথা অন্যের ঘরে গিয়ে ভীষণ অবহেলায় ফিরে আসে, তার সবটা অরুনাভ শোনে খুব যত্নে! দুচোখে মুগ্ধতা নিয়ে কোন অভিযোগ ছাড়াই!
শুধুমাত্র হ্যালুসিনেশনেই বুঝি একটা মানুষ এতোটা নিখুঁত হতে পারে ??
©
Elit Das Gupta

 
 
 
প্রিয় অনিমেষ,
কেমন আছো? ভাবছো, এতোগুলো বছর পর আমি কোথা থেকে! সেদিন তোমায় দেখলাম অনেকটা দূর থেকে, রাস্তা পার হবার সময়। গায়ে একটা হলুদ পাঞ্জাবী, হাতে বাজারের ব্যাগ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা দেখলাম একটা! বেশ সংসারি লাগছিল তোমায়!
তবু চিনতে এতোটুকু সময় লাগল না! শুধু বয়সের ছাপে একটু মুড়িয়ে গেছো। কিন্তু গালে সেই খোচা খোচা দাড়ি, ঠোটের পাশে ছোট কালো তিল, সেই নেশা লাগানো ঘোলাটে চোখ, সবটা এক আছে! কেবল চুলে পাক ধরেছে খানিকটা!
অনি, তোমার মনে পড়ে? তুমি যখন বলতে - চুল দাড়ি না কেটে তুমি রবীন্দ্রনাথ হবে, আমি কি রেগে যেতাম সেটা শুনে?
আমি শুধু ভাবি, জীবনের এই ২২টা বছর কিভাবে চলে গেল আমাদের দুজনের থেকে!
সবতো ঠিক-ই ছিলো, হঠাত...
শেষ যেদিন তোমায় দেখলাম, সেদিন এক বর্ষার সন্ধ্যা! রাস্তাটা মরিচবাতি দিয়ে সাজানো ছিল! দুজনে মুখোমুখি দাড়িয়ে সেদিন সিধান্ত নিলাম, ''আর একসাথে নয়!''
কতোটা সহজে সেদিন এতোটা কঠিন হয়ে সারাজীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম আমরা?
অনিনেষ, সেই সন্ধ্যায় দুজন দুপাশে হেটে যাওয়ার সময় আমি খুব করে চাইছিলাম, তুমি আমায় একটাবার আটকাও! কিছুটা যাওয়ার পর যখন পিছু ফিরে দেখলাম- তখন নিয়ন বাতির আলোয় তুমি হেঁটে যাচ্ছো! ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছ দূরে কেমন জানি ধূসর হয়ে!
আকাশ ভেংগে খুব জোরে বৃষ্টি পড়েছিল সেদিন রাতে! আমি আমার উত্তরের ঘরটায় বসে তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম! এভাবে রোজ আকাশ কালো করে রাত নামতো, আর আমি আমার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সারাটারাত! তারপর একদিন বুঝে নিলাম,বিধাতা আমাদের সংসারটা একসাথে লেখেননি....
অনি, আমি হাজারবার টের পেয়েছি- "দূরত্ব বাড়ানো সহজ! বিচ্ছেদ সহজ!" জটিল ছিল শুধু তোমার শূণ্যতাটা একেবারে মুছে ফেলা!
অনিমেষ,খুব চেনা রাস্তায় দীর্ঘদিন পরে হাঁটলে এক ধরনের অনুভূতি হয়! সেদিন রাস্তা পার হবার সময় যখন তোমার মুখটা দেখলাম,মুহূর্তেই আমার সমস্ত অতীত চোখের সামনে ওলটপালট হয়ে গেল! সেদিন তোমায় একটু ছুঁয়ে দেখা হয়নি! ২২টা বছর আমাদের এতোটা দূরে সরিয়ে দিল কি করে অনিমেষ??
মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে হয়, পুরাতনে ফিরে যাই! আবার গোধূলীর সময় শহরের শেষ মাথায় বসে জ্যোৎস্নার আলো মাখি!
তোমার মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আবার নেশাগ্রস্থ হই!
আচ্ছা অনি, তোমার সেই বইয়ের নেশাটা এখনো আছে? তুমি ভালোবাসতে "বুদ্ধদেব গুহ" আর আমি "সমরেশ মজুমদার"!?
সেই আঠারো কি কুড়ি বছর বয়স তখন আমার! তারপরেই একদিন বসন্তের মতো জীবনে তুমি এলে!
আমার এখন বয়স বেড়েছে অনি! মুখে কুচকোনো চামড়া,চোখের নিচে কালো দাগ, তলপেটের মেদ, মাথায় কমে যাওয়া চুল,শরীরে রোগের বাসা প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়- আমি কতোটা মুড়িয়ে গেছি বয়সের তুলনায়! সবাই আমায় সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু আমার মন বলে- আমি আর বেশিদিন নেই! অনিমেষ, মৃত্যুর দরজাটা খুব কাছ থেকে দেখছি জানো? এখন একএকটা দিন আমার কাছে কেবল স্রষ্টার উপহার!
বিধাতার খেলা দেখো অনিমেষ, চলে যাওয়ার আগেই বোধহয় তোমায় দেখিয়ে দিলেন তিনি!
অনি, আমরা এখনো এক শহরেই আছি অথচ তাও কতোটা ভীষন দূরে তাইনা? কতোটা পথ হেঁটে গেলে তোমায় ছুঁতে পাবো, তাও জানা নেই!
অনি,তুমি ভালো থেকো! যদি কোনদিন পারো, এসে একবার ছুঁয়ে দিও! হোক সেই মুহূর্তে আমার শরীরটাই আর প্রাণ নেই...!
কতোগুলো বছর তোমার মুখে "মৃন্ময়ী" ডাকটা শুনিনা অনিমেষ! সখ করে দিয়েছিলে তুমি আমায় নামটা !
অনি...আবার একটাবার ডাকবে আমায় সেই নাম ধরে? চোখ বুজার আগে কেবল একটাবার.....???
এই ব্যস্ত শহরে কোন এক ফিকে সন্ধ্যায়, তোমার সেই পুরোনো ঠিকানায় ফিরে আবার একটাবার... ??
-ইতি তোমার 'মৃন্ময়ী'!
©
Elit Das Gupta
 
 
 
অনিন্দ্য ,
 
এলিট দাশ গুপ্তা..........
 
 অনিন্দ্য
তোমার জন্য সুখবর আছে। আজকাল খেয়াল করে দেখলাম, আমি তোমার পুরোনো সত্ত্বাকে ভুলতে বসেছি! মরিচা ধরা অতীত নিয়ে ইদানিং আর ঘাটছি না। মলাটবাধানো আধপড়া ফেলে রাখা বইয়ে যেমন ধুলো পড়ে, মনে করো আমাদের সম্পর্কেও ধুলোর স্তূপ জমেছে!
যে ধুলোয় বেখেয়ালে পা দিলেও, চোখের পাতা ইদানিং আর ভিজছে না! কি অদ্ভুত!
তুমি কিভাবে কথা বলতে, কিভাবে তাকাতে কিংবা কি অযুহাতে আমার মন ভালো করতে ভরদুপুরে, আজকাল খুব করে চাইলেও আমি আর মনে করতে পারছিনা। অনিন্দ্য, আমি ভুলতে বসেছি আমাদের দুজনের দেওয়া প্রিয় ডাকনাম!
বয়স যে বাড়েনি, তা বলবোনা! তবে আমার সকল ভাবলেশহীনতার দায়, কেবল আমার বয়স দিয়ে ঢাকতে চাইনা।
অনিন্দ্য , মানুষ কত অনায়াসে সব ছাড়তে পারে বলো? পুরোনো ঠিকানা, অস্তিত্ব, অসহায়তা, সব!
তবে, শুরুর দিকে বেশ ভুগেছি! আমার বারাসাতের দোতলার ঘরটার কথা মনে আছে অনিন্দ্য? কতো বড় উঠোন ছিলো! সন্ধ্যেবেলা মাথার উপর ছাদ ফেড়ে পূর্ণিমার চাঁদ নামতো। এতো সুন্দর সেই আলো!
সন্ধ্যে হলে মা কুমড়ো ফুলের বড়া ভাজতো। আর রেডিও-তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনতেন বাবা - "আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা..."
আমি সখ করে জবা আর সন্ধ্যামালতী ফুলের বাগান করলাম ছাদে। তার ঠিক পাশে তোমার দেওয়া গন্ধরাজ ফুলের ছোট গাছ! শীতের রাতে জানলা দিয়ে হু হু করে ঢোকা সেই ফুলের গন্ধে আমার ভারী নেশা হতো! ভোররাতে পর্দার ফাঁকে শীতের কুয়াশা নামতো।
তারপর, প্রায় সপ্তাহান্তে তোমার সাথে দেখা। বারাসাত থেকে বিকেলের ট্রেনে চেপে একেবারে বনগাঁ স্টেশন। তারপর একফালি মাঠ পেরিয়ে মিঠুদার চায়ের দোকান। তাতে সন্ধ্যে নামলে চায়ের কাপে আমরা আড্ডা জমাতাম। সেই আড্ডায় প্রাণ ছিলো!
বেশ ভালোই চলছিলো। তবে অনিন্দ্য, আমাদের জীবনের সুখে থাকার দিনগুলো বেশ চট করেই ফুরিয়ে যায় বলো?
তারপর... তারপর প্রায় মাস তিনেক তোমার কোন খবর পাইনি। তোমায় যত চিঠি লিখেছিলাম, একেক করে সব ফেরত এলো।
অনিন্দ্য, যারা নিজের ইচ্ছেতে ঠিকানা বদলে নিতে চায়, তাদের আর খুঁজতে নেই। আমিও সেই থেকে তোমায় আর খুঁজিনি।
তুমি হারাতে চাইলে, আমি পিছুটান রাখিনি!
এখনো মনে পড়ে, আমার সেই দোতলার বাড়িটা থেকে আমি বেরোইনি বেশ বহুমাস। ঠিকানাহীন অপেক্ষা, অসহায়ত্ব, আহা..!
বাড়িটা ছাড়তে বেশ কষ্ট হলো! আমাদের বইমেলা থেকে কেনা কবিতার বই, নকশাকাটা জানালার পর্দা, দেয়ালে টাঙানো সত্যজিতের আর্টফ্রেম...জানলার ধার ঘেঁষে উপচে পড়া সন্ধ্যামালতী, তোমার গন্ধরাজ ফুলের গাছ...এতোসব কিছু ছেড়ে আসা তো সহজ ছিলোনা অনিন্দ্য!
তবু....সময় তো ফুরোয়। জীবনে একটা করে মানুষ কমতে থাকে! হয় তারা ফুরিয়েছে, নয় আমি হারিয়েছি।
দিনশেষে এই বিষাদগ্রস্ত পুরাতন শহর প্রতিনিয়ত বদলেছে! অনিন্দ্য, এই শহরে যার নিজের কোন ঘর নেই, তার ঘরে ফেরার কোন তাড়া থাকেনা!
তুমি বরং ঠিকানাহীন থেকো। কখনো কোন ফাঁকা স্টেশনে তোমার অবয়বের ছায়া ক্লান্তিতে এসে মাথা ঠেকালে, সেদিন আমিও নাহয় ব্যস্ততায় পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাবো অবিকল তোমার মতো........
হোক, তা বছর আটেক পর...তবু তুমি জেনো, অপেক্ষারও মৃত্যু হয়....
এলিট দাশ গুপ্তা..........
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...