মল্লিকা বনে
উচ্চ শিক্ষার ভারে নোয়া ঘাড় টাকে সোজা করতে
মাঝে মাঝে গিয়ে বসি রাজুদার চায়ের দোকানের মাচাটাতে।
এসে বসে হারু, সানু, আর রমজান।
ফিজিক্স, ম্যাথ আর রমজান সংস্কৃত।
গড় গড় করে বলে শ্লোক গুলো ...,
মন্ত্র গুলোও।
আসে সাইকেল মিস্ত্রী নাড়ু, আসে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে যাওয়া মন্টু রাও।
মন্টু নতুন বিয়ে করেছে,
বউকে গড়িয়ে দিয়েছে পায়ের মল।
সেই নিয়েই কদিন চলছে গরমা গরম।
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আড্ডা চলে আমাদের।
গুমোট বিকেলের ঘাম গলার গামছারা শুষে চলে।
আর শীতের শুকনো হওয়া ফাটিয়ে চলে ঠোঁটের চামড়া।
মাথার চুলগুলোও বিদ্রোহ করে,
হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে।
বলে' পড়াশুনো করে করে এ ব্যাটা সব কটাকেই ঝরিয়ে ফেললো মাথা থেকে।
দাঁড়ানা কদিন পরে টাকে হাত বোলাবি হতোভাগা।"
গতানুগতিক ছকে বাঁধা মাচা আর মাচার আড্ডা।
সেদিন ছিল আটই মার্চ।
সকাল থেকেই মাইকে সেই ঘ্যান ঘ্যানে প্যান প্যানে গান আর বক্তৃতা
"নারী আমাদের মা, নারী আমাদের মা"...
আরে বাবা সব নারীই যদি মা হয় তবে তো...
যাক গে যাক, ঠোঁটের ফাঁকে বিড়িটা গুঁজে পা দোলাতে দোলাতে
গাইতে লাগলাম মান্না দে।
সুখী বেকার জীবন কিনা।
হঠাৎ আমার হৃদয়টা শরীর থেকে খুলে যেতে চাইলো গান থামিয়ে
মাচার সামনের দিকে চেয়ে,
রাজুদার দোকানের কাছেই।
চোখ দুটো বিস্ফারিত হতে চাইলো
আর নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে বলতে লাগলো
আমি বেকার, আমি শিক্ষিত কাপুরুষ;
আমি বেকার মল্লিকা।
মল্লিকা আমার বাল্যকালের বন্ধু
আমার প্রথম ভালোবাসা।
শেষও হয়তো ...
কি জানি!
বসন্তের বিকেলে আমার সাইকেলের সামনে বসিয়ে
আমি গাইতাম
"আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি, আমার মল্লিকা বনে"।
খিলখিল করে হেসে উঠে বলতো
"আঃ! সুমন দা, পড়ে যাবো তো,
দেখে চালাও"।
খোলা বুকে মাথা রেখে বলতো
"সুমন দা, তোমায় ছেড়ে যাবো না কখনো, কোনোদিনও না।
মল্লিকা তুই কোথায় রে, আজ তুই কোথায়!
কপালে জ্বলজ্বল করছে
সরকারি চাকরির সিঁদুর।
লাল শাড়ির নীচে তোর ফর্সা পা গুলো
আরো ফর্সা লাগছে রে।
আমার বিস্ফারিত চোখ মল্লিকার চোখের তারায় আটকে গেলো।
কিন্তু আমার মল্লিকা আজ বোধহয় বেশি লাজুক হয়ে গেছে।
তাকাচ্ছেই না।
সেদিন কোথায় ছিলি রে তুই,
তোর বাবা যেদিন আমার বেকার গালে ভালোবাসার স্পর্ধার উপর
সপাটে মেরেছিলেন চড়।
বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমি বামন
আর তুই চাঁদ।
শুনেছিলাম পরেরদিন মামার বাড়ি থেকেই তোর শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছিল।
ফেস বুকে তোর ছবি সেঁটে তোর বর লিখেছিল 'ফিলিং লাভ উইথ মলি'।
ব্লক করেছিলি আমায়। আর দেখিনি তোকে।
আমার ভিজে বালিশ গুলো এখনো তোর চুলের স্পর্শ পেতে চায়,
আমার সেই নদীর ধার গুলো এখনো তোর পায়ের ছাপ পেতে চায় বালির বুকে।
তুই সুখী থাক মল্লিকা ভালো থাক।
কিন্তু ব্লাউসের নীচে সরে যাওয়া আঁচলের তলায় এ কিসের দাগ মল্লিকা!
লম্বা লম্বা কালসিটে এত কিসের রে!
কপালের উপর ওই কাটা দাগ টাও তো ছিল না কখনো।
ও তোর স্বামী বুঝি দেবদাস?
তার পারোর কপালে এঁকে দ্যায়
ভালোবাসা।
এই মল্লিকা আমায় দেখে চোখ নামিয়ে নিলি তুই?
তোর কালসিটে পড়া সুখে ভাগ বসাবো ভাবছিস বুঝি?
আয়নারে একবার কাছে,
আমার জিভটা নড়ে উঠে জিজ্ঞেস করুক একবার
তুমি ভালো আছো তো?
মল্লিকা আজ আটই মার্চ। নারীদিবস।
আমি তোর স্বাধীনতা দেখতে পেয়েছি রে।
তোর বর বড্ড ভালোবাসে তোকে বুঝিবা।
তাই তোর গায়ে এঁকেছে ভালোবাসার রক্তচিহ্ন।
চলে গেল মল্লিকা।
আমার বোজা ঠোঁট দুটো আঠা হয়ে রইল যেন।
শেষের আশ্রয় রবি ঠাকুর
ভিজে বালিশের মাথার উপর
যিনি থাকেন রোজ রাতে
আবার ফিরে সেইখানে
সেই সাইকেলের বিকেলে
মল্লিকার গায়ের গন্ধে
"আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
আমার মল্লিকা বনে।"
=============
সুজান মিঠি । 27. 03. 2018
আভিভি...
সুজান মিঠি
ভারতবর্ষের আজকাল এক নতুন স্বভাব হয়েছে।
ইউরোপ আমেরিকা থেকে টেনে নিয়ে আসে
নিজের অস্তিত্ব, উদাত্ত কন্ঠে গান শোনায় আবার
কয়লার আঁচে ভাত ফোটায়, স্বপ্ন বাঁধে…
এইতো তেইশে জানুয়ারির ভোরবেলা হঠাৎ
ঘুম থেকে জেগে উঠে তীব্র চিৎকার শুরু করে,
...হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা তোমাকে রক্ত দেব!
জরুর হাম তুমে খুন দুঙ্গা!
বদলে আমাদের স্বাধীনতা এনে দাও।!
বদলেমে স্রেফ ফ্রিডম চাহিয়ে!
স্রেফ ফ্রিডম…
রাস্তায় ঘাটে মাঠে কাতারে কাতারে ভারতবর্ষ
সার দিয়ে দাঁড়িয়ে একটাই বাক্য উচ্চারণ করে
যাচ্ছে!
পথের ধুলোয়, দিঘির জলে, ক্ষেতের ধানে
বিচিত্র আলোড়ন, চমকিত আকাশ!
মুহূর্তেই ঝমঝম করে নেমে এল বৃষ্টি!
মুহুর্মুহু বজ্রপাত!
ভারতবর্ষগুলো তবুও ভয় পেল না।
যেন এক কী যেন ভরসায়, প্রচন্ড উদ্দীপনায়
প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত সে।
গাছেরা বিস্মিত চোখে তাদের কাছে গিয়ে
জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী চাও!
ভারতবর্ষগুলো বলে ওঠে, স্বাধীনতা গো!
তোমরা সবাই জয়ধনি করো!
উনি এসেছেন যে ফিরে!
গাছেরা অবাক হয়, পাখিরা অবাক হয়।
বাতাস পাতায় পাতায় লিখে নেয়,
শুনছ! ভারতবর্ষ জেগে উঠেছে আবার
উনি এসেছেন!
আবার তারা বীরত্বে ঝাঁপিয়ে পড়বে যুদ্ধে,
কাঁধে তুলে নেবে দেশের যন্ত্রণা।
কেঁপে উঠবে সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য!
সমগ্র ভয় জর্জরিত হয়ে উচ্চারণ করবে...
মাভৈ! মাভৈ!
সার দিয়ে একটানা দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষগুলো,
প্রচন্ড বজ্রপাতের নিচে।
ওরা গত রাতে ওদের নেতাজিকে ফিরে আসতে
দেখেছে।
ওরা তখন নুনভাত, কিংবা উপোস নিয়ে কুঞ্চিত
শীর্ণ শরীর এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়।
তবু চোখে এঁকে নিতে চাইছিল এক সুতোয়
গেঁথে নেওয়ার গান।
ওরা তখন আগুন চেনেনা, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় অন্ধ
ওদের চোখ।
হঠাৎ মধ্যরাতে চোখ খুলে গেল ওদের।
এলগিন রোডের বাড়ির সামনে হাজির হল সবাই।
তারপর হাতে হাত বেঁধে বেঁধে নেতাজিকে সামনে
রেখে কুচকাওয়াজ করতে করতে এগিয়ে গেল
ভারতবর্ষ গুলো...
হৃদয় কম্পিত করে মুখে উচ্চারণ করল,
বন্দেমাতরম!
এগোতে এগোতে সকাল হল,
ওরা বজ্রপাতে ভিজতে লাগল!
ওদের বুকে এক বিরাট প্রত্যয়!
সামনে নেতাজি।
ওদের চোখে আগুন!
সামনে নেতাজি।
ওদের হাতে অস্ত্র!
সামনে নেতাজি।
ওরা এগোল...
স্কুলে মাঠে হাটে নেতাজির মালা পরা মূর্তির সামনে
হাঁটু গেড়ে বসে ছিঁড়ে ফেলল মালা,
নিভিয়ে দিল ধুপ।
জীবিতের জন্য এসব লাগে না!
নেতাজি এসব চাননা! শুনছ? ওরা বলল।
ওরা রাত্তির নটার সময়ে রেডিও চালিয়ে দিল।
ভেসে এল বেতার তরঙ্গে...
আমি সুভাষ বলছি!
ভারত বর্ষের এক নতুন স্বভাব হয়েছে।
বিশেষ বিশেষ দিনে সে ভীষণ জেগে ওঠে।
চিৎকার করে বলে,
হে নেতাজি আর একবার এস!
হে চির বীর! আর একবার
আগুন জ্বালিয়ে যাও এ গণতন্ত্রের নামে
অশুদ্ধ রাজনীতিতে!
স্বার্থের কষাঘাতে!
তারুণ্যের ঘুমে!
আরো অনেক বেশি চিৎকার করে!
বজ্রপাতের মত শরীরের সব স্নায়ু এক করে
চিৎকার করে, আভিভি হাম তুমে খুন দুঙ্গা নেতাজি!
অর একবার…
ভারতবর্ষের কী এক নতুন স্বভাব হয়েছে!
স্বপ্নকেও নেতাজি ভেবে বসে!
নিবেদিতার পত্র
সুজান মিঠি
'THE END HAS COME, SWAMIJI HAS SLEPT LAST
NIGHT AT 9 O' CLOCK. NEVER TO RISE AGAIN…'
স্বামী সারদানন্দের কলমের সেই উচ্চারণ আমাকে
ভেঙে দিয়েছিল সেদিন,
আমার অন্তরাত্মার আকাশে অমাবস্যা নেমে
এসেছিল।
আমার হৃদয় চৌচির হয়ে গিয়ে গিয়েছিল!
তার ঠিক দুদিন আগে আপনি আমায় নিমন্ত্রণ
করে খায়িয়ে হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন, যীশু তো শিষ্যদের পা ধুইয়ে
দিয়েছিলেন!
আমার তখন একটুও মনে পড়েনি আপনার
PRACTICAL DEMONSTRATION...
দুবছর আগে অমরনাথ তুষার-মহাদেবের কাছে
চেয়ে নিয়েছিলেন আপনি।
আমার ষোলো নম্বর বাগবাজার লেনের যে
আঙিনায় আমি আকাশ দেখতাম!
সেই আকাশ সেদিন হঠাৎ ঘন মেঘে ঢেকে গেল!
অবাক হচ্ছেন স্বামীজী? ভাবছেন আপনার
সিস্টার নিবেদিতা যে নিজেও মৃত,
সে কেন আবার আপনাকে পত্র লিখছে?
এসব বিষাদ জানিয়ে?
না, জীবিতকালে আপনি চলে যাওয়ার পর
আপনার দেখানো পথে চলতে চলতে আর
প্রয়োজনই হয়নি আপনাকে এভাবে পত্র লেখার।
আজ হয়েছে।
উইম্বলডন থেকে আমি যে ঈশ্বরের সন্ধান
পেয়েছিলাম!
যার চোখে এক পৃথিবী আশ্রয়
শিখেছিলাম!
যার কপালে দিব্য বোধের জ্যোতি দেখেছিলাম!
সেই তো আমার স্বামীজী।
সেইতো আমার ভারতবর্ষ।
সেই তো আমার আরাধনা, ধর্ম!
যার পায়ের মাপে পা মিলিয়ে পৌঁছে যাওয়া
যায় অখন্ড মানব চেতনার এক স্বর্গে।
আপনি বলেছিলেন, "ওঠো জাগো!"
আপনি বলেছিলেন, ভারতবাসী সব আপনার ভাই!
আপনি বলেছিলেন, পাখির দুই ডানা পুরুষ
ও নারী।
এক ডানা জখম হলে অন্য একে আকাশ
ছোঁয়া যায়না…
আপনি বলেছিলেন, জীব সেবাই
শিব সেবা, পরমব্রত।
যে ব্রতে দীক্ষিত হয়ে আমি মার্গারেট থেকে
"নিবেদিতা", "লোকমাতা"।
আপনি চলে যাওয়ার পর আমিও মানুষ-মন্দিরে সেবায়েত্রী হয়ে থেকেছি যতদিন না
শরীর ছেড়ে গেছে আমার প্রাণ।
তারপর, গঙ্গায় জল বয়ে গেছে হু হু করে।
নর্দমা এসে মিশেছে মানুষ মন্দিরের শ্বেত আসনে।
পাখির এক ডানা কেটে ফেলতে চেয়েছে
অন্য ডানা।
আমি আবার জন্ম নিয়েছি বারবার…
কখনো নোবেল, কখনো নিবেদিতা, কখনো
মূক বধির কেউ হয়ে।
কিন্তু আমাকে পুণ্যভূমির সেবিকা বানিয়ে তোলার মত আপনি আর নেই!
আমাকে ভগিনী গড়ে নেওয়ার মত ব্রহ্মচর্য আর নেই!
তাই বারবার জন্ম নিতে নিতে ক্লান্ত আমি
আপনাকে লিখছি, স্বামীজী!
PRACTICAL DEMONSTRATION নয়,
আপনি অনন্ত যুগ ধরে আপনার চেতনায় ভারতবর্ষের মাটিকে করে তুলুন পুণ্যক্ষেত্র।
আর আমাকে গড়ে তুলুন…
আমি যে ভীষণ অপেক্ষায়, দেব!
নতুন সূর্য হয়ে আর একবার এ ভারতে জন্ম নিয়ে
জীবনের মন্ত্র শিখিয়ে যান পাখিটাকে।
যে তার দুই ডানার স্বার্থের কষাঘাতে পড়ে
উড়তে ভুলে গেছে!
মানুষই ভুলে গেছে মানুষ হতে!
এক আকাশের নিচে এক পৃথিবী জড়ো করে
আবার উদাত্ত কন্ঠে শিখিয়ে দিয়ে যান স্বামীজী,
"ONE INFINITE PURE AND HOLY – BEYOND
THOUGHT BEYOND QUALITIESI BOW DOWN TO THEE"
---------------
09. 01. 2020
শ্বাস-বায়ু
সুজান মিঠি
আমার ঠাকুমা গিরিবালা দেবী।
নামের আগে ঈশ্বর দিতে তিনি পছন্দ করতেন না।
বলতেন ঈশ্বর তো আমরা সবাই,
কেবল মৃত্যুর পর কেন! আগেও।
প্রত্যেকের হৃদয়েই যে ঈশ্বর বাসা বাঁধেন।
আমার ঠাকুমার ঈশ্বর তাই তাঁর হৃদয়েই
বাস করতেন, মন্দিরে নয়।
কেউ তাঁকে কখনো পুজো করতে দেখেনি।
আমি তাঁকে রবি ঠাকুরের সামনে নত হয়ে কাঁদতে
দেখেছি বহুবার!
জিজ্ঞেস করেছি, এই যে তুমি বলো সারাজীবন
শুধু আলো, তবে এমন চোখের জল ফেলো
কেন ঠাকুমা?
আমার ঠাকুরমা বলতেন, এও যে আরাধনা রে!
আনন্দের সাধনা!
লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়তেন ছেলেবেলায় ঠাকুমা।
তাই নাকি বাল্যবিবাহের ঘরকন্নার পাট তাঁর
মিটেছিল অল্পসময়েই।
মাত্র ষোলো বছর বয়সে সদ্যজাত একমাত্র
পুত্রকে কোলে নিয়ে এসে উঠেছিলেন বাপেরবাড়ি।
একান্নবর্তী পরিবারের রান্নাঘর আর কলতলা
করতে করতেও পুত্রকে শেখাতে চেয়েছেন
উদারতা।
আকাশ মেঘ বৃষ্টি চেনাতেন ছেলেকে।
ফুলের গন্ধ, পাকা ফলের ঘ্রাণ বুঝিয়ে দিতেন
হাত ধরে ধরে…
নাহ, এসব তাঁর পুত্র অবিনাশবাবু অর্থাৎ আমার
বাবা আমায় বলেননি,
বলেছে ঠাকুমার ডায়েরি; তাঁর নিভৃতের একমাত্র বন্ধুটি।
যা কেবল তাঁর থেকে পাওয়া আমার একমাত্র অধিকার।
বাপেরবাড়িতে এসে ঠাকুমা ভাইয়ের বউদের হাতে
তুলে দিয়েছেন তাঁর সংগৃহীত ছোট ছোট বই।
প্রচন্ড অপমানিত হয়েছেন নিজের পিতার কাছে।
তাঁর মাও কিছু কম বলতে বাদ রাখেন নি,
...ছি ছি ছি গিরি! তুই কি চাস তোর মত এ বাড়ির
বৌয়েরাও…ওরে ওরা যে তোর ভাই!
তুই কি জানিস না, মেয়েরা পড়াশোনা শিখলে
বিধবা হয়!
এসব কথা লেখা আছে ঠাকুমার ডায়েরির
যে পাতাগুলোয়, সেই পাতাগুলোকেও
আমি কাঁদতে দেখেছি…
আমার দুচোখ মিশে গেছে তাদের স্রোতে বারবার!
ঠাকুমার ছেলে অর্থাৎ আমার বাবা বিয়ে করার
পরে আমার মাকে বন্ধ ঘরের ভিতর বলেছিলেন
শোনো! আমার মাকে শ্রদ্ধা করবে ঠিকই কিন্তু
ওনার সব কথা মানবে না। বইপত্তর পড়ে
দিগগজ হতে চাইবে না, বুঝেছ!
ঠাকুমা বারান্দা দিয়ে যাওয়ার পথে শুনে ফেলে
ভেবেছিলেন, এইতো তাঁর সেই একমাত্র পুত্র
যাকে তিনি ধরে ধরে আকাশ মেঘ বৃষ্টি
রোদ্দুর চিনিয়েছিলেন…
ইংরেজি স্কুলে বিদেশি শিক্ষাচর্চা করিয়েছিলেন
ভাইদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও।
এইতো সেই, যাঁর জন্মের পর ভেবেছিলেন
আমার গর্ভের পুরুষ এ নিশ্চই আমার মতই হবে!
আমি জন্মাবার পর আমার মা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আঁতুড়ে।
শাঁখ বাজিয়েছিলেন আমার ঠাকুমা।
পাড়ার লোককে ডেকে ডেকে বলেছিলেন,
আমার লক্ষ্মী এসেছে গো, দেখে যাও!
আমার পড়াশোনার বয়স হলে তুলেছেন আঙুল...
আমার বাড়ির মেয়ে পড়বে! স্কুলে যাবেই!
আমি তরতর করে এগিয়ে গেছি।
দাদা, ভাইদের সঙ্গে একসঙ্গে দুধের গ্লাসে
চুমুক দিয়েছি, মাছের মাথায় কামড় দিয়েছি।
ঠাকুমাকে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকিয়ে দিয়েছি
পড়ে শুনিয়েছি জীবনানন্দ…
তারপর একদিন ঠাকুমার আঙুল নেমে এল
বালিশের পাশে।
ডাক্তারে জবাব দিলেন, মা বাবা কান্নাকাটি
শুরু করলেন।
ঠাকুমা আমায় ডেকে বললেন, তুই কিন্তু
একটুও কাঁদবি না! আমি তো এ পৃথিবী
ছেড়ে অন্য এক পৃথিবীতে যাচ্ছি কেবল।
তোরাও তো আসবি! দুদিন পরে।
আমি তো বড়, আমায় আগে গিয়ে সেসব
ঘর বাড়ি গুছিয়ে রাখতে হবে না?
আমার হাতে ডায়েরিটা তুলে দিয়ে ঠাকুমা
শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন।
ব্যাস! এরপর আমার দুধের গ্লাস, মাছের মাথা
আর পড়াশোনা তুলে রাখা হল পরের জন্মের জন্য।
ঠাকুমার আস্কারায় গোল্লায় যাওয়া মেয়ের জন্য
যেন তেন প্রকারেন এক পাত্র জোগাড় করা হল।
তার গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দিয়ে আমার বাবা
গলায় চাদর দিয়ে বললেন,
বাবা! আমার মেয়েকে দেখো।
দেখছে তো! সে আমার গালে গলায় পিঠে
রোজ চাকা চাকা কালশিটে দেখছে।
মারছে আর দেখছে!
হাসছে আর বলছে, আহা! শিক্ষিত বউ আমার!
মারলে কেমন কাঁদুনে হয়ে যায় গো!
আমার ঠাকুমার চিনিয়ে দেওয়া আকাশ,
বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ,
ফুল, ফল, পাকা ধান সবকিছুতেই আমি
কেবল রক্তের গন্ধ পেতে লাগলাম।
আমার লুকানো বই খাতা রবীন্দ্রনাথের ছবি
ওরা সব কেড়ে পুড়িয়ে দিল!
আমি ছুটে এলাম মায়ের কাছে, ও মা!
ও যে বড্ড মারে!
মা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, মেয়েমানুষ যে তুই
অনেক সহ্য করতে হয়।
পুরুষমানুষ বশে আনতে একটু সময় লাগে
একসময় দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
বাবা তেজি কন্ঠে বললেন,
এটা তোমার বাড়ি নয় আর, যে যখন খুশি চলে আসবে! ফিরে যাও!
ফিরে এসে আত্মহত্যার পথ খুঁজে চললাম।
আলমারির একেবারে গোপন জায়গায় লুকিয়ে
রাখা ঠাকুমার ডায়েরিটা বের করলাম।
ওকেই বরং জানিয়ে যাব আমার চলে যাওয়াটা…
ডায়েরিটা উল্টাতে উল্টাতে শেষ পাতায় এসে
চোখ আটকে গেল আমার।
ঠাকুমা লিখেছেন, মেয়েমানুষ! মেয়েমানুষ!
কেন বাপু! মেয়েরা পারে না কী?
কেবল মনে জোর আনা দরকার।
মরতে তো হবেই একদিন!
তার আগে প্রতিদিন কেন মরব?
আকাশ দেখতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয়, তো হোক!
নাহ, আমি আত্মহত্যা করিনি।
রাতে আমার পিঠে কালশিটে আঁকতে যাওয়া
মদ্যপ স্বামীর হাত থেকে চাবুক ছিনিয়ে
ওরই পিঠ ফালাফালা করে দিয়েছি।
তারপর ও যন্ত্রণায় কাতরেছে।
আর আমি সারারাত ওর পিঠে মলম লাগিয়ে
দিয়েছি।
ও কেঁদেছে, আমিও কেঁদেছি।
ঠাকুমার ডায়েরির শব্দেরা আমার কানে কানে বলেছে, কিছু কান্না
আনন্দের, জানিস তো?
আমারও এক পুত্র হয়েছে।
আমার মদ্যপ স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।
আমি পুত্রকে আকাশ চেনাই, বাতাস চেনাই।
ও আধো আধো গলায় আমাকে বলে,
আমি তোমায় কোনোদিন মেয়েমানুষ বলব না, মা!
কী বিচ্ছিরি লাগে শুনতে!
আমার গলা জড়িয়ে বলে, আমি যখন বড় হব
তোমায় অনেক অনেক নতুন বইয়ের গন্ধ
এনে দেব!
আমার ছেলের চোখে আমার বাবা নয়,
ঠাকুমার ছবি দেখতে পাই।
আমিও ডায়েরি লিখতে শুরু করেছি আমার
ঠাকুমার মত।
ঠাকুমার ঘর গোছানো শেষ হয়ে গেলে
একে একে ডাক আসবে আমাদের।
কে বলতে পারে, আমার ডায়েরি আমার কোনো উত্তর-আয়নার শ্বাস বায়ু হবে না!
------------------
08. 01. 2021
অচলায়তন
সুজান মিঠি
না! না! ওই জানলা খুলো না!
ওই জানলা খুলে ফেললে তুমিও আমার মত
পতঙ্গ হয়ে যাবে!
তারপর আগুনের দিকে ছুটে গেলে তুমিও যে
আমার মতই মরে যাবে!
ওই জানলা খুলো না!
ডুমুরের পাতার উপর শায়িত আমার মৃত শরীর।
জীবন নেই! শেষও নেই!
বনকলমি ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলে,
মুক্তি নেই বাছা...এই তো রাজনীতি!
নরম বাতাসে গা ভিজিয়ে নেয় ও পারের সব
পাতা, সব সুখ…
তুমি যদি যাও সেখানে,
জীবনের শেষে, শেষের আগে আটকে যাবে
আমার মতই।
কিন্তু তবু যদি আকাশ দেখতে চাও!
যদি আলো দেখতে চাও!
যদি আগুন ছুঁতে চাও!
তবে তোমায় জানলা খুলে ফেলতে হবে
আমার মত…
জানলার এ পারে তোমার মৃত্যুও নেই,
আকাশও নেই।
পতঙ্গ হও বা মৃত,
আকাশ দেখতে হলে তোমায় জানলা খোলার
স্পর্ধা দেখাতেই হবে!
লাউয়ের কচি পাতারা বিস্ময়ে বলবে,
এই তো মুক্তি! রাজনীতি কোথায়?
জীবন সেতু ও গড্ডলিকা
সুজান মিঠি
তার সঙ্গে দেখা আমার জীবন-সেতুর পড়ন্ত বেলায়।
জীবন-সেতু নাম তারই দেওয়া।
সে বলল, পড়ন্ত কিংবা উদয়
বেলাভূমিতে চিরন্তন আনন্দ, জানো?
জিজ্ঞেস করেছিলাম, মৃত্যু বাদ রেখে
এ কেবল জীবন-সেতু কেন?
সে খানিক হেসে বলেছিল…
মৃত্যুও যে জীবন একখানা!
তাই জীবন থেকে জীবন পর্যন্ত জীবন সেতু।
বলেছিল, চলো বিয়ে করি!
আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।
এই বয়সে? সে কী! লোকজন, আত্মীয় স্বজন
ছেলে মেয়ে…
সে বলেছিল, কাউকে তো কখনো সেতুর নিয়ম
ভাঙতে হয়!
নইলে যে গড্ডলিকা হয়ে যাব আমরা!
আমি পারিনি। প্রবাসী ছেলে মেয়ের এ কথা
শুনেই লজ্জায় মাথা কাটা গেছে।
আত্মীয় স্বজন গুনগুন শুরু করার আগেই
আমি সেতুর অন্য নামকরণ করে নিয়েছি...
বিধিলিপি।
তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি কোনোদিন।
শেষবার আমার কুঞ্চিত হাতে তার চঞ্চল
উষ্ণতা ঢেলে বলেছিল,
তোমার জীবন মনে রেখো। ভালো থেকো।
ধীরে ধীরে সন্ধে নেমেছে।
অস্ত গেছে জীবন। আমি সেতু পেরিয়ে
এ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি।
আবার বিস্মিত হয়ে দেখেছি আমার আগেই
এ পারে এসে উঠেছে সে।
হাতে কাদা নিয়ে মূর্তি তৈরিতে ভীষণ ব্যস্ততা তার!
একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল,
তারপর নিজের কাজে মন দিল।
আমি তার সেই সুন্দর কথা শোনার অপেক্ষা
করতে লাগলাম।
আমি অপেক্ষা করতে করতে এ পারে এসে উঠল
আমার প্রবাসী সন্তানেরা, আত্মীয় স্বজনেরা।
আমি ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম,
আমায় চিনতে পারছিস তোরা?
ও পারে থাকার সময় সন্ধে বেলা তোদের
ফোন করেছিলাম, বলেছিলাম একজন
সঙ্গী পেয়েছি…
তোরা ছি ছি করেছিলি! মনে আছে?
তারা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, আমরা তোমার
সন্তান কেন হব?
আমরা আমরাই। আমরা আমাদের।
আমি তার কাছে ছুটে গেলাম।
ওরা কী বলছে এসব? আমি তো ওদের জন্যই
তোমার হাত ছেড়ে একা হেঁটে এলাম
শেষবেলার পথ!
সে তার হাতের মাটি দিয়ে কেবল
গড্ডলিকা তৈরি করে চলল।
আমি তার দু কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলাম,
জোরে জোরে চিৎকার করলাম!
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সে তার বানানো মুর্তিগুলোর
দিকে তাকিয়ে বলল,
বলো তো ভেঙে ফেলি এদের?
নিজের নিজের জীবন শেখাই?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
ওদের গড়তে গড়তে দুপুর গড়িয়ে গেল,
সন্ধে হল।
শেষে ওরাই কিনা আমায় চিনতে পারেনা?
জীবন সেতু নয়, সব বিধিলিপি!
সে মাটি দিয়ে গড্ডলিকা প্রবাহ এঁকে
চলল...
সূর্য-কন্যা
সুজান মিঠি
...এই মেয়েটা কোথায় থাকিস? বাসা কোথায় তোর?
...ওই ওদিকে, যেইখানে রাত্তিরে হয় ভোর…
...কী বললি! যাঃ! হয় নাকি তা কোথাও কোনো!
...কে বলেছে হয়না, কানটা পেতে শোনো?
...ভোরকে শুনবো? বেশ বেশ নামটা তোর বল।
...ধরো, শ্রাবণ মাসে আমার নাম হয়ে যায় জল।
...নাম বদলে ফেলিস নাকি প্রতি মাসে তুই?
...হ্যাঁ, এই যেমন গ্রীষ্মে ছিলাম তিরতিরে এক জুঁই।
...তোর খাতাতে কী আঁকছিস দেখি ওটা!
...দেখবে? দেখো! আমি পৃথিবী আঁকছি গোটা।
...পৃথিবী কোথায়? এ তো একটা বিন্দু!
...আমার মায়ের নাম জানো তো সিন্ধু!
আমার বাবা ভীষণ শান্ত, মাটি নাম তার,
রাগলে কিন্তু ফুটিফাটা, কেউ পাবে না ছাড়।
যাকে তুমি বিন্দু বলছো, এই পৃথিবী গ্রহ।
আর যা কিছু দেখছো তুমি সবটা তোমার মোহ।
এই নিয়ে যাও বিন্দুটাকে সঙ্গে তোমার হাতে,
দেখবে তুমি পৌঁছে যাবে আমার ভোরের রাতে।
মা বাড়বে পান্তা পেঁয়াজ খেয়ে তবে এসো,
চলি চলি এবার এখন সময় আমার শেষও।
...শোন না শুনে য! এই মেয়েটা শোন!
তোর বিন্দুটা ঘুরছে কেন এত? বলে যা না বোন!
বাড়তে বাড়তে কী বিরাট বাড়ছে তোর বিন্দু!
ভাসছি আমি অথৈ জলে কী বিরাট সিন্ধু!
বাঁচিয়ে যা না আমায় ভোরের মেয়ে ওরে!
আমি না বাঁচলে, পৃথিবী বাঁচাবো কেমন করে?
হ্যাঁ হ্যাঁ গাছ কেটেছি,মানুষ মেরেছি অনেক...
ধরেছি, ধরেছি ধর্ম নিয়ে নানারকম ভেক!
দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার কোথায় পৃথিবী মা?
...সেই যেখানে রাত্রি নামে ভোরে,সেখানে চলে যা!
...একটিবার ক্ষমা করে দাও না বিশ্ব মাতা!
...এমন করেই বন্ধ হবে তোদের দূষণ খাতা।
… কষ্ট হচ্ছে ভীষণ আমার! এই বন্ধ হল শ্বাস!
...হি হি হি, শোনো এখন আমি সূর্যে করি বাস।
-------------------
11. 07. 2020
মাংসের লোভ
সুজান মিঠি
বিনু এসে বলে গেল, আমার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
নইলে এমন সুযোগ কেউ এভাবে হারায়?
তাই তোমায় চিঠি লিখছি।
তোমার মনে আছে, তুমি আমার স্কুলের গেটে
কেমন উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দীর্ঘক্ষণ?
আমি বেরোলে আমার হাতে তোমার লম্বা
প্রেমপত্র দিয়েই ছুট দিতে লজ্জায়।
আমি বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে নিয়ে যেতাম
তোমার লজ্জা, আদর, অনুনয়।
বাড়ি গিয়ে দরজা বন্ধ করে তোমায় পড়তাম।
পরদিন তুমি আবার আমার স্কুলের গেটে
দাঁড়াতে, হাতে গুঁজে দিতে ভালোবাসা,
আবার ছুটে পালাতে।
একদিন আমি তোমার পালাতে চাওয়া হাত
ধরে বলেছিলাম, এমন লজ্জা পেলে প্রেম করবে
কী করে? তুমি না ছেলে?
তোমার মনে আছে?
নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসা দুপুর,
ফুচকার ঝালে আমার চোখে জল আসা
আর তোমার বেদনার্ত মুখে তা মুছিয়ে দেওয়া বিকেলগুলো,
ভালোবাসাগুলো... তোমার মনের আছে?
অসুস্থ বাবা সংসারের বোঝা আর টানতে
পারছিলেন না।
আমার নিরক্ষর মা বলেছিলেন, লেখাপড়া তবুও তোকে করতে হবে রে মা!
আমি লোকের বাড়ি কাজ করেও তোকে পড়াবো।
তুই বড় হবি, মানুষ হবি, চাকরি করবি…
তোমার মনে আছে, তুমি বলেছিলে এই তো
সুযোগ, চলো চলে যাই!
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বলেছিলাম, সবে আমার
ক্লাস টেন। তোমারও বয়স কম।
এখন কোথায় যাবো?
তুমি বলেছিলে, কলকাতায় মস্ত বড়লোক মামাবাড়ি! মস্ত দোকান তাদের!
আমাদের ভবিষ্যৎ পাকা ছাতের মতোই
নিশ্চিন্তের।
আসলে দোষ তো আমার!
পড়াশোনায় মন ছিলনা মোটে!
তুমি বলেছিলে, গলায় হার, কানে দুল
বেনারসি শাড়ি সব তোমায় কিনে দেব…
অসুস্থ বাবা, মূর্খ মায়ের চোখে অন্ধকার নামিয়ে,
রাতের গভীরে তোমার হাত ধরে সূর্য খুঁজতে
চলে এলাম আমি।
তোমার মনে আছে?
জিজ্ঞেস করেছিলাম ট্রেন থেকে নেমে,
তোমার মামাবাড়ি কোথায়?
তুমি হেসেছিলে,
হাসলে তোমার দুই গালে টোল পড়ে।
আমার খুব ভালো লাগত সেই টোল।
টোল দুটো দেখলেই আমার মনে হত
এই যে আমার ভালোবাসা, পুরুষ হলেও
নগেন জ্যাঠা, বিমল দাদার মত হিংস্র নয়,
বড্ড নরম, লাজুক।
তুমি দুই গালে টোল ফেলে বলেছিলে,
আছে, আছে।
মাসখানেক কাটাই নিজেদের সোহাগে,
তারপর যাব মামাবাড়ি।
নতুন ঘরে ঢুকেই তুমি আমার মাথায়
এক খাবলা সিঁদুর তুলে দিয়ে টেনে
নিলে বুকের কাছে,
আমি বললাম, এক্ষুণি?
তুমি হেসে বললে, বা রে! ফুলশয্যা করব না?
আমার এমন সুন্দরী বউ!
হাসলে তোমার দুই গালে টোল পড়ত বেশ।
আমার খুব ভালো লাগত দেখতে...
তোমার বুকের নিচে আমিও ফুল বুনলাম কত
গোলাপ, চাঁপা, রজনীগন্ধা...
মাস তিনেক পরে একদিন আমার সেই ফুলশয্যা
হঠাৎ উবে গেল।
চারজন লোক এসে বলল, চলো! অমিতের
মামাবাড়ি।
তুমি নাকি আমায় নিতে পাঠিয়েছ ওদের।
বিশ্বাস করিনি!
তোমার মনে আছে?
ওরা আমার মুখ টিপে টানতে টানতে গাড়িতে তুলল।
তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই! কাঁচের বাইরে
আমি তখন তোমার টোল পড়া মুখ দেখতে
পেয়েছিলাম যে!
ওরা আমায় এই নরকে নিয়ে এসেছিল সেদিন।
চারিদিকে কত মানুষ, কত মেয়ে!
তাদের কী বিশ্রী সাজপোশাক!
তারা কী অদ্ভুতভাবে আমায় দেখতে লাগল!
আশেপাশের কুকুরগুলো পর্যন্ত ঘেউ ঘেউ করতে
লাগল বীভৎসভাবে!
ঘরের ভিতরে একটা একটা করে চারটে শরীর আমার উপরে চাপল।
তারপর আমার
বুকের উপর দাঁত, গালের উপর নখ,
পায়ের উপর পা!
ওরা হাসল, চিৎকার করল, বলল,
দেখছিস, এগুলো দেহশয্যা!
তোর বরই তোকে বেচে দিয়েছে এ নরকের
বিছানায়, শরীরের শয্যা পাততে!
তোমার আর মনে থাকার কথা নয়।
আমার শরীরের ভিতরেই একটা শরীর
তার কিছুদিন আগে থেকেই গজিয়ে উঠেছিল,
সে এ পাড়ায় এসে বাড়তে লাগল।
বাড়তে বাড়তে আমার অন্ধ বুকে
ফুল ফুটিয়ে নেমে এল পৃথিবীতে।
আমার ঘরে যখন রাত্রি নেমে আসে,
জানলার বাইরে একটানা ঝিঁ ঝিঁ ডাকে,
আমার শরীরের ভিতরের সেই শরীর
আমার মুখে হাসি ফুটিয়ে,
দুটো চোখ ঠোঁট হাত পা আর
কচি গাল নিয়ে দুলে দুলে নামতা মুখস্ত করে।
এক বুক জিজ্ঞাসা নিয়ে একা ঘুমোতে যায়
বিছানায় যখন,
আমি তখন পর্দার আড়ালে নিজের দেহশয্যা
বিছিয়ে দরদাম করি।
কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে।
তবু আমার বুকের ভিতরে সুর বেজে ওঠে…
তিন এক্কে তিন
তিন দুগুনে ছয়...
তোমার দেওয়া ফুলশয্যার
ফুল রোজ আমার এই নরকের জানলা দিয়ে
আকাশ দেখে।
বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে এ পাড়ার কাঁচা মাংসের
গন্ধ ধুয়ে নেয়।
ঝিঁ ঝিঁ'র একটানা সুরে মিশে যায় তার রবি
ঠাকুর, নজরুল।
তুমি জানো না, ও এ পাড়ার স্কুলে প্রথম হয়
প্রতিবার।
দিদিমণি আমায় ডেকে বলেছেন, তোমার মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে দেখো চাঁপা দি!
বিনু এসে বলল, তুমি নাকি ওকে ওই স্কুলেই
দেখেছ আগের দিন।
বলেছ, এক সপ্তাহের মধ্যে ওকে তোমার চাই।
বিনু বলল, অমিতবাবু বিরাট বড়লোক
মস্ত মামাবাড়ির সম্পত্তি পেয়েছে, বড় বড়
দোকান হোটেল আর কচি মাংসের বিক্রি!
একদিন মেয়েকে দিবি, এক বছরের কামাবি।
বিনু জানে না।
তুমিও ভুলে গেছ, ভেবেছ
সেই স্কুলের গেট, ফুচকার ঝাল, নির্মম
ফুলশয্যা সেসব এখন ইতিহাস!
বিনু বলল, কচি মাংসে তোমার বড় লোভ।
এমন নাকি অনেক আছে।
বিনু বলল, তুমি নাকি শুধু একদিন চেয়েছ!
শুধু একদিন!
তুমি ওর বুকের নরম কবিতায়,
ওর চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে,
নাকি তোমার টোল পড়া গালের লোভ
রাখতে চাও!
তাই তোমায় এ চিঠি লেখা...
বাক্সের গোপনে সেই সিঁদুর মাখা রুমাল,
সেই সব চিঠি,
সেই লজ্জিত ভ্রু'র অভিনয়, হালকা গোঁফ ছেলেটার
সব স্মৃতি সযত্নে সজ্জিত রেখেছি।
যদি কখনো এসে বলো,
চলো ফুলের বাগান করি!
চলো আকাশে তারা হই একসাথে!
কখনো এসে বলো, ক্ষমা করো…
সেই গালের টোল যদি কোনোদিন সত্যিকারের লজ্জা পায়!
…
আজ এই চিঠি লিখছি তোমায় ...
শুধু একটা কথা বলার জন্য,
যদি একবারও ফিরে আসার কথা ভাবো!
কিংবা তোমার রক্ত মাংস বীর্যে লোভ হানো!
যদি আর একবার গাড়ির জানলার কাঁচের
বাইরে গালে টোল ফেলে হাসতে চাও…!
তবে টুকরো টুকরো করে ঘেউ ঘেউ করা
কুকুরগুলোর মুখে ছুঁড়ে ফেলব তোমার
দাঁত, চোখ, গাল, টোল…
তোমার বোধহয় জানা নেই,
এমন বাপের মাংসে ওদেরও কিন্তু বড় লোভ!
-------------------
30. 12. 2020
রায়
সুজান মিঠি
বেঁচে থাকার জন্য আমায় একমাত্র শর্ত দেওয়া হল...
মৃত্যুদন্ড।
উপায় বেছে নিতে বলা হল নিজেকেই।
আমি চোখ বন্ধ করে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিলাম।
জলপ্রপাত হয়ে গেল আমার শরীর।
ঝর্ণা! ঝর্ণা! বলে আনন্দে মেতে উঠল গান।
আমার মৃত্যু হল না।
নদীতে গা ডোবালাম।
নুড়ি কাঁকর আমার গায়ের উপর গর্ত আঁকতে
আঁকতে এগিয়ে গেল।
স্রোত বলল, এ তো চাঁদের কলঙ্ক গো! নদীর মন্থকূপ!
স্বামী বিতাড়িতা বধূ গলায় কলসি বেঁধে ডুব দিলে,
আমি কলঙ্ক ঝেড়ে তাকে তুলে আনলাম।
জিজ্ঞেস করলাম, মৃত্যুতে শেষ নাকি?
কখনো নয়। জানো না মৃত্যুর পরেও
জীবন থাকে। কিন্তু ডুবে মরার নদী থাকে না!
বললাম, নদীতে স্নান করে কান্না বিসর্জন দাও,
দেখবে ভোর ফুটবে তোমার হৃদয়ে।
সর্বত্র আমার নাম ছড়িয়ে পড়ল
দেবদূত! দেবদূত!
আমার মৃত্যু হল না।
আমি বিষ গাছের ফল তুলে এনে
গলায় দিলাম ঠেসে।
আমার নাভি ভেদ করে গাছ বের হয়ে এল।
তাতে ফুল ফুটল, প্রজাপতি এল।
ফল ধরল। পাখি এল খেতে।
আমি চিৎকার করলাম, খেও না! খেও না!
ও যে বিষ!
পাখি ফল খেয়ে উড়ে গেল আকাশে।
উড়তে উড়তে বলল, ভালোবাসা পেলে
বিষেরও নবজন্ম হয় গো!
আমার মৃত্যু হল না।
আমার শরীরের লিঙ্গ নিয়ে কত আলাপ হল,
আলোচনা হল।
আমি পুরুষ অথবা স্ত্রী কিংবা ক্লীব কিনা
এ বিষয়ে তুমুল তর্ক উপস্থিত হল।
দল নির্বাচন শুরু হল।
কবি লেখক শিল্পী আমাকে নিয়ে সৃষ্টির
সমুদ্র তৈরি করল।
আমার মৃত্যু হল না।
আমাকে টানতে টানতে বিচারসভায় নিয়ে যাওয়া হল।
আমি হাত জোড় করে বললাম, হুজুর
এতে আমার কী দোষ?
বিচারক অনেকক্ষণ মুখ নিচু করে হিসেব
কষলেন,
তারপর বললেন, অতএব ভালোবাসার মৃত্যু হয়না।
* * * * * *
আমায় বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র শর্ত দেওয়া হল…
জীবিত থাকতে হবে।
উপায় নিজের।
আমি বেঁচে থাকতে চেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় বরফ হতে চাইলাম।
বজ্র এসে আমার শরীর ঝলসে দিল।
গলায় কলসি বাঁধা বধূকে টেনে তুলতে গেলাম
নদী থেকে, বললাম তোমার যে ছেলে আছে!
বৃদ্ধ বাবা মা…
ওদের নিয়ে বাঁচা যায় যে!
আমার হাত ঝিনকে দিল সে। স্বামীই যে তার
একমাত্র পৃথিবী!
আমি ডুবে গেলাম মন্থকূপ ছাড়িয়ে অনেক অনেক
গভীরে।
বিষ ফল খেয়ে তাকে খুব আদর দিলাম,
স্নেহ দিলাম।
গাছ হল, ফল হল।
পাখি, প্রজাপতি সেই ফল খেয়ে মরে গেল।
আমার নাভি চূর্ণ হয়ে যেতে যেতে বলল,
বিষ গাছে বিষ ফলই যে হয়! অমৃত নয়।
কবি শিল্পী আমার মৃত শরীর নিয়ে পরীক্ষা
নিরীক্ষা শুরু করল।
নাম দিল বিরহ কিংবা ঘৃণা।
আমাকে টানতে টানতে বিচারসভায় নিয়ে যাওয়া হল।
আমি চিৎকার করলাম মৃত কণ্ঠস্বরে, যেখানেই আমি বাঁচতে চাই,
সেখানেই আমার মৃত্যু হয়।
হুজুর এতে আমার কী দোষ?
বিচারক অনেকক্ষণ মুখ নিচু করে হিসেব কষলেন,
কুঞ্চিত ভ্রু'তে প্রশ্ন…
'ভালোবাসা বিপরীতে মরে যায়...?!'
-------------–-
29. 12. 2020
নামতা
সুজান মিঠি
ছেলেটা একটানা নামতা আউড়ে চলেছে।
সেই যেদিন তাদের ইস্কুল বাড়িটা ভেঙে পড়ছিল,
সব ছেলেরা হই হই করে এদিক সেদিক ছুটছিল!
ছেলেটা তখনও একটানা নামতা পড়ছিল।
ওর বন্ধুরা ওকে ঠেলছিল, ডাকছিল, ভয় পাওয়াচ্ছিল…
ছেলেটা নামতা আউড়েই চলেছিল।
ওর বন্ধুরা কেউ পালিয়েছিল জানলা দরজা দিয়ে,
কেউ পারেনি। সাপ, ব্যাঙ, প্রজাপতি, শ্যাওলা
তুলসি হয়েছে।
ছেলেটা নামতা আউড়ে চলেছে।
ইস্কুলবাড়ি পোড়ো হয়েছে।
সাপ, ব্যাঙ, শ্যাওলা, বৃদ্ধ হয়েছে।
বড় বড় বাড়ি উঠেছে।
আকাশ চুম্বন করেছে কংক্রিট।
ছেলেটা নামতা আউড়ে চলেছে।
এক এক্কে বিশ্বাস!
দুই এক্কে বিশ্বাস!
তিন এক্কে বিশ্বাস!
ঈশ্বর একদিন জোর করে
ছেলেটাকে বগলদাবা করে তার
শিকড় শুদ্ধ নিয়ে গেল এক
ছাপাখানায়।
ছেলেটাকে ঠেলে গুঁজে ভরে দিল মেশিনের মধ্যে।
শিকড় সমেত ছেলেটা ঝাঁ চকচকে মলাটের আভরণে বেরিয়ে এল।
ঘরে বাইরে পথে বাসে ট্রেনে
হাতে হাতে উঠে আসে ছেলেটা…
এক এক্কে বিশ্বাস…
দুই এক্কে…
পথ ঘাট বাস ট্রেন
ঝাঁকিয়ে উঠে থেমে যায়!
তবে কি সত্যিই তাই?
বিশ্বাস!
তবে কী...
সন্দিগ্ধ দুহাতের চাপে মলাট বন্ধ হয়।
পথ প্রান্তর ঘর দাওয়া উঠোন
শপিং মল মাল্টিপ্লেক্স শরীর
আবার ছুটতে থাকে।
মলাটের নীচে চাপা পড়া ছেলেটা
দুলে দুলে নামতা আওড়ায়...
এক এক্কে বিশ্বাস
দুই এক্কে ভালোবাসা!
তিন এক্কে হৃদয়
চার এক্কে আলো আশা...
ভালোবাসা
সুজান মিঠি
আজ সারাদিন তোমাকে তোমার মত মনে পড়ছে আমার।
অথচ মেঘলা আকাশ ছিলনা।
ভাপা গুমোট ছিল না।
তবুও আজ সারাদিন শ্বাসে প্রশ্বাসে তুমি
তোমার মত প্রবাহিত হচ্ছ আমার স্নায়ুতে।
তোমার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া দুঃসময় অথবা তোমার
কাছ থেকে চেয়েচিন্তে আমারই জোগাড় করে রাখা রক্তাক্ত স্মৃতিগুলো
যতই বাক্স বন্দি করে রাখতে গেছি,
ওরা ঠিক ফাঁক ফোঁকড় খুঁজে বের হয়ে এসে
আমাকে চোখ রাঙিয়েছে বারবার...
বলেছে, লক্ষ্মীর যেমন অলক্ষ্মী থাকে,
প্রেমের তেমনি অপ্রেম।
তোমার পকেট থেকে খসে পড়েছিল মাংসের গন্ধ
মাখা চিঠি।
তুমি হেসে উঠে বলেছিলে...এক লক্ষ কাঠ পুড়িয়ে দিয়ে তবে এ পাওয়া!
ফুলশয্যা প্রস্তুত রেখে সে যে দাঁড়িয়ে আছে
আমার জন্য! বুঝেছ?
একদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বলেছিলে
আজ কল্পতরু আমি, কী চাইবে চেয়ে নাও
তাড়াতাড়ি!
আমি ফিসফিস করে বলেছিলাম, অন্তত
একবার যদি আমার দিকে তাকাও!
আমার চোখের গভীরে যদি মাটির হোক
জীর্ণ হোক তবু আমাদের বাসা বানাও…
তুমি হেসেছিলে খুব! বলেছিলে,
চাঁদের কলঙ্ক দেখেছ? আজ আমি তোমায়
দেখাব। কল্পতরুর মত তোমায় আজ কলঙ্ক
দান করব!
আমার ঠোঁট গাল চিবুক বুক নাভি তোমার
কামড়ে কামড়ে আমারই মস্তিষ্কে সংবাদ প্রেরণ করল...
ঘৃণার পাহাড় রচনা করো!
কিংবা অপ্রেম!
একসময় ভাবতাম এত ঘৃণা নিয়ে তোমায় ঠিক
একদিন ভুলে যাব।
এক পৃথিবী ভালোবাসব।
আকাশের ক্যানভাসে সমুদ্র আঁকব
কিন্তু তবুও...
আজ তোমাকে ঠিক তোমার মত মনে পড়ছে।
ঘাসে পা রাখলে ঘাস হলুদ হয়ে উঠছে!
আকাশে দৃষ্টি রাখলেই মেঘ।
প্রাণ ভরে বাতাস নিতে চাইছি,
গুমোট উষ্ণতা প্রবেশ করছে প্রশ্বাসে!
তোমাকে তোমার মত মনে পড়ছে।
তুমি দাঁত জিভ রক্ত হাড় পাঁজর বের করে
হাসছ!
তুমি হেসে হেসে বলছ, এত ঘৃণা কেউ কখনও
ভোলে না, বুঝেছ?
তোমাকে তোমার মত ঘৃণায় ঘৃণায় মনে করতে
করতে আমার সারাবেলা কাটল।
সন্ধে কাটল। রাত্রি নামল।
থিকথিকে অমাবস্যার রাত্রি।
কিন্তু একটু আগে আমি সেই অমাবস্যার কালোর
ভিতরে একটা মুখ, দুটো চোখ আর সেই চোখে
স্বপ্ন দেখতে পেয়েছি।
স্বপ্নে মেঘ বৃষ্টি হয়ে গলে পড়ল!
মাটি ভিজে গেল।
ভেজা মাটি আমায় বলল, এই দেখ! আজ
আমি কল্পতরু হয়েছি।
তুই যা বানাবি আমায় দিয়ে তাই সত্যি হবে!
প্রেম, অপ্রেম, বিষাদ, আনন্দ...
আমি সেই মাটি দিয়ে একটা পূর্ণিমা বানাতে চাইলাম…
মাটি হাসল।
ঘাস সবুজ হল।
দখিনা বাতাস বইল।
আমিও মাটি হয়ে গেলাম।
সেই মাটি দিয়ে সেই স্বপ্নের দু চোখের ভিতরে
ঘর বানাল একটা ছেলে।
দাওয়ায় বসে লক্ষ্মী পুজোর আল্পনা দিল
মেয়েটা।
আজ সারাদিন তোমাকে তোমার মত মনে
করতে করতে আমি মন্দির হয়ে গেলাম।
সেই স্বপ্নের ঠোঁট প্রেমিকার ঠোঁটে ছুঁয়ে বলল,
আজ আমি কল্পতরু, যা চাও দিতে পারি!
অপ্রেম কিংবা বিষাদ ছাড়া…
আজ সারাদিন তোমাকে তোমার মত মনে
করতে করতে ...
মনে করতে করতে…
আমি আমার মত ভালোবাসা হয়ে গেলাম।
------–-----
20. 12. 2020
কষ্টিপাথর
সুজান মিঠি
আমার মায়ের বুকের উপর যখন নরকগুলো
হামাগুড়ি খাচ্ছিল!
আমার মায়ের অভাবী ঘরের খড়ের চালে
যখন দাউদাউ করে জ্বলেছিল আগুন!
আমার মাকে যখন গোটা গ্রাম আঙুল
তুলে বলেছিল, এখানে কোনো বেবুশ্যের
স্থান নেই!
আমার দিকে উঠলো গলা, নাম চড়ল
জারজ!
আমার মা যখন রাতের অন্ধকারে আমাকে
লুকিয়ে রেখে নরকগুলোর মাথা লক্ষ্য করে
ঝপাঝপ কোপ মারছিল!
নরকগুলো যখন লুটিয়ে পড়ছিল মাটিতে!
আমার মা যখন তার বৈধব্য জীবনে খুনি উপাধি পেল!
সবাই যখন আমার মাকে দেখে থুতু ছুঁড়ল!
টানতে টানতে যখন আমার মাকে
আর আমার শৈশব জীপে তুলল পুলিশ!
তখন আমার একটা নাম হল…
খুনির ছেলে।
সংশোধনাগারে আমার শান্ত নিরীহ মায়ের উপর
যখনই কেউ হাত তুলেছে!
আমার মায়ের দিকে যখনই কেউ নরক হতে চেয়েছে!
আমার মায়ের পোড়া রুটির থালা যখন কেউ
পুড়িয়ে দিতে চেয়েছে!
বিনিময়ে যখন আমি আমার ছোট্ট শরীরে বাঘ হতে চেয়েছি!
বিষধর সাপের মত নরকের আগুনগুলো খুবলে
খেতে চেয়েছি!
তখন আমার একটা নাম হয়েছে…মস্তান!
পাথরের উপর বসতে বসতে আমি পাথর হতে চেয়েছি।
আমার খুনি মা আমায় জাগিয়ে বলেছে, ওই দেখ
দেখতে পাচ্ছিস...আজ পূর্ণিমা।
আমি বলেছি, তুমি কী করে জানলে মা এই বন্দি
ঘরে থেকে?
আমি তো চাঁদ দেখতেই পাইনা!
মা বলেছে, যখন চোখ বুজে নিজের বুকের
ভিতরে তাকিয়ে আলো দেখতে পাবি
তখনই জানিস পূর্ণিমা।
আর যখন দেখবি তোর হাড় পাঁজর শিরা আর হৃদয়
সব নিকষ কালো, তখন বুঝিস কঠিন অমাবস্যা।
আমি ঘুম ভেঙে উঠেছি ধড়মড় করে
মাকে জড়িয়ে বলেছি মা! ওই দেখো পাঁক!
কিলবিল করছে পোকা!
উফফ কী দুর্গন্ধ!
মা হেসে আমার কপালে চুম্বন করে বলেছে
কোথায় পোকা? ও তো পদ্ম!
ভালো করে দেখ!
সংশোধনাগারের দেওয়ালে আগুন লেগেছে..
আমি বলেছি, মা আগুন!
পুড়ে খাক হয়ে যাব!
মা স্মিত হেসে বলেছে, খাঁটি সোনা হবি রে বাপ!
ভীষণ ঘোষণায় প্লাবিত হয়েছে চারিদিক...
...খুনির ছেলে আমরা সবাই
খুন ভিন্ন গতি নাই!
মদ গাঁজা ড্রাগের নেশা
আমাদের ভালোবাসা…
জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ
খুন খারাপি জিন্দাবাদ!
মা বলেছে, বন্যা এসে মাটির সব দোষ
ধুয়ে দেয়।
তখন মাটি হয় ভীষণ শুদ্ধ।
আমি অসহায়ের মত জিজ্ঞেস করেছি
কেন খুন করেছিলে মা?
মা বলেছে, নরকগুলো পরের জন্মে স্বর্গ হয়ে
জন্মায় যেন…
সেই নরক থেকে শুরু করে আমার মাকে
আমি হৃদয়ে এঁকে চলেছি।
তার বৈধব্যের উপরে বসিয়ে দিয়েছি লাল ফুলের
বাগান।
বিস্মিত হয়েছে সংশোধকেরা।
খুনির ছেলের শৈশব এমন অন্ধকারে থেকে
কীভাবে পূর্ণিমা আঁকতে পারে?
আমার আঁকা সে বাগান, সে জ্যোৎস্না,
সে জীবন নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে। গাদা গাদা মূল্যে বিক্রি হয়েছে।
প্রখ্যাত হয়েছে। দেশে দশে ভালোয় আলোয়
ছড়িয়ে পড়েছে।
অন্ধকার ফুঁড়ে সংবাদমাধ্যম এসে আমায়
প্রশ্ন করেছে, নাম কী?
আমার মা এগিয়ে এসে বলেছে,
কষ্টিপাথর।
------------------
19. 12. 2020
সংসার
সুজান মিঠি
বাউলের সুর ঘাসের শিশির ছুঁয়ে যায়।
বুকে ভোর খুঁজতে চেয়ে বাউল বুঝতে পারে
চারিদিকে ঘন রাত্রি নেমেছে আগেই।
হাঁড়িতে জল ফোটার শব্দে বাউলের স্ত্রী বোঝে
একদানাও চাল অবশিষ্ট নেই ঘরে।
বাউল একতারা বাঁধা দিয়ে এক মুঠো চাল আনে।
বাউলের স্ত্রী একমাত্র হাঁড়ি বিক্রি করে
বাউলের বুকে ভোর ফিরিয়ে দিতে চায়…
হাতে একতারা তুলে দিয়ে বলে,
ঘাস আছে, শিশির আছে, কচুরিপানা, শালুক আর জল খাবার নদী আছে!
বোজা চোখের নিচে সুর না থাকলে সিদ্ধ ভাত যে শক্ত পাথর হয়ে যাবে গো গোঁসাই!
বাউলের স্ত্রী মাটি দিয়ে হাঁড়ি গড়ে।
আগুনে পুড়ে খাঁটি হলে তাতে জল চড়ায়।
কলমি সিদ্ধ হয়।
বাউলের কাঁধে মাথা রেখে বলে, একটা এমন সুর বাঁধো দেখি,
যেখানে খিদে তেষ্টা ঘুম এসব মিথ্যে হয়ে যায়!
পিঁপড়ের মত দল বেঁধে মানুষ সুখ সঞ্চয় করে!
এমন একটা সুর, যেখানে মাটির হাঁড়িতে
জীবন সুখে সুখে বাঁচে!
অচেতন স্ত্রীকে মেঝেয় শুইয়ে বাউল ছুটে গেল
পথে!
একতারা, ঝোলা, উত্তরীয় সব দিল বেচে।
তার একমাত্র জীবনসঙ্গীর যে বড় অসুখ!
তাকে যে বাঁচিয়ে তুলতেই হবে বাউলকে!
বুকের ভিতর ভোরের সন্ধান কেবল যে সেই জানে!
আনমনা হাঁটতে হাঁটতে বাউল পথে কুড়িয়ে পায়
ভারতবর্ষকে। নানা রঙে নদী নালা পাহাড়
চিহ্নিত করা ভারতবর্ষের এক সুবিশাল মানচিত্র
রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
বাউল দুহাতে তুলে নিল দেশমাতাকে।
কপালে ঠেকিয়ে ভাবল, এটা সে বেচবে না।
যদি যোগ্য কাউকে পায়, তবে এমনি দেবে…
এক শিক্ষিত মুখ এগিয়ে আসতে দেখে বাউল
তাকে বলে, এই যে মানুষ! দেখে তো লেখাপড়া
জানা মনে হচ্ছে গো! আমার এ দেশকে নেবে সঙ্গে?
আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ কিনা! তাই আমার রাখবার
জো নেই।
সেই শিক্ষিত মুখ হঠাৎ তার আটকানো চোয়াল
খুলে কথা শুরু করল।
সেই মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল দেশের
নদী নালা পাহাড় সমুদ্র... তাদের সবার রং ধূসর,
সবকিছুর রঙ মোছা।
মুখটা বলল, বয়স বত্রিশ। এম এ পাস। চাকরি নেই।
ডোমের চাকরির পরীক্ষাতেও প্রশ্ন এসেছিল,
পূর্ব অভিজ্ঞতা?
বলেছিলাম, প্রথমবার হবে।
প্রত্যুত্তর ছিল, মরা পুড়িয়ে আসবে।
রোজ পোড়াই, লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে…
...আমার স্বপ্ন! স্বপ্ন পোড়াই।
বাবা বলেছেন, এই বয়সে যে রোজগার করতে
পারে না, সে কাপুরুষ! কুলাঙ্গার!
তাই অভিমান ঠেসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি।...
হঠাৎ কথা বলতে বলতেই বাউলের দিকে সেই শিক্ষিত মুখটা আসে।
বাউলের হাতের মানচিত্রটা দেখে জিজ্ঞেস করে,
আচ্ছা এই যে ছবি! দেশের ছবি...কত রঙের
পাহাড় টাহাড় সব…
এই পুরো দেশ যদি আমি চিবিয়ে খাই,
তবে কতদিন পেট ভরা থাকবে আমার?
বলুন না, এই মানচিত্র খেলে আমার কতদিনের খিদে মিটবে?
বাউলের বুকে রাত্রি আরও ঘন হয়।
একছুটে তার স্ত্রীর কাছে আসে বাউল।
হাতে মানচিত্রটা দেখে বাউলের স্ত্রী বলে,
এইতো কী ভালো এনেছ গোঁসাই! এই দেশের বুকে
তুমি যদি আরাম করে শোও, তবে ঠান্ডা লেগে আর
তোমার গানের গলা বসতে পারবে না গো!
মৃতপ্রায় স্ত্রীর ঠোঁটে বাউল তার একবুক ইচ্ছে
উপুড় করে দেয়।
মানচিত্রের লাল নীল হলুদে ভেসে ওঠে
কচি সবুজ ঘাস…
সিদ্ধ হয় বাউলের রুগ্ন স্ত্রীর হাঁড়িতে।
কৃষক
সুজান মিঠি
একবার কি হল জানো?
জলকামান, কৃষি বিল, আলাপ আলোচনা, সভা
সব কিছুর উপর ঘাস গজাল, কিন্তু সে ঘাসের
রং হল হলুদ।
সব ক্ষেতের সব মাটির উপর জন্মাল কাঠকয়লা; প্রতিবাদ,
...জলকামান দিয়ে চাষ করা যায়?
চেরা সরু আলগুলো সে প্রতিবাদে গলা মিলিয়ে বলল…
আমরা চাষ করব না!
মরতে হলে মরব তবু,
মাটিতে প্রাণ ভরব না!
কৃষি বিল দিয়ে কি আর মরুভূমিতে বৃষ্টি বোনা যায়?
তারপর কি হল জানো?
যারা শুয়ে ছিল প্রাসাদে!
যারা ধুঁকছিল পথে!
সব একাকার হয়ে গেল।
পথ প্রাসাদ সব হাহাকার হয়ে গেল।
একবার মানুষ টাকা, চাকরি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,
বিদেশ ভ্রমণ, রাজনীতি, অভাব, ফুটপাত খেয়ে পেট ভরাতে চাইল।
একবার মানুষ জলকামানও খেতে শিখতে চাইল।
কৃষি বিল, কৃষক, ধান, আলু, গম স্মৃতি হতে চাইলে
মাটি ভয়ে কেঁপে উঠল তারপর একদিন।
চুপিচুপি একটা মৃতপ্রায় বেগুন গাছে বাসা বাঁধল
ছোট্ট টুনটুনি।
গাছটাকে না বাঁচালে ওর বাসা থাকে কী করে?
একবার কি হল জানো?
প্রতিবাদের পিতার করুণা হল।
নিভু নিভু শরীর নিয়ে সে
গাছটায় জল দিল,
সার দিল,
যত্ন দিল।
মাটি জাগল।
ক্ষেত জাগল।
ফসল দুলল।
পথ ও প্রাসাদ ভিন্ন হল।
জলকামান তীব্র হল।
জলকামান দিয়ে কি আর স্নেহ আটকানো যায়?
একবার কি হল জানো!
কৃষক ঘাম ছড়িয়ে ধান বুনল।
সুগন্ধি ও ঘাম
সুজান মিঠি
তোমার বাড়ির বারান্দায় প্রতি পুজোয় দেওয়া আলপনাগুলো
মুছে গেছে জানি,বাথরুমের ভিতরে শাওয়ারের শব্দও নেই।
আর সেই বিছানার চাদরটা যেটার উপর হাত দিয়ে টেনে টেনে
ভাঁজ গুলোকে সমান করে দিয়েছিলাম, সেটাও এখন নেই তাই না?
হাবুর মাকে দিয়েছো তো আমার আটপৌরে শাড়ি গুলো?
আর ওই যে জুতোর শেলফে রাখা আমার পুরনো জুতো?
ওগুলো তো একটু সেলাই করালেই চলতো। তুমি বলেছিলে
থাকনা, আমি তোমার পায়ের মাপ জানি, আনবো আর এক জোড়া।
বলছি যে ড্রয়ারের নীচের দিকে আমার মাইগ্রেনের ওষুধ থাকতো
তুমি বলেছিলে, এই হোমিওপ্যাথিগুলো খাও,
দেখবে এরপর আর হবে না মাথাব্যথা।
সেগুলো নিশ্চই ফেলে দিয়েছো?
ফ্রিজের মাথার উপর রাখা আমার চশমা,
তোমাদের রান্নাঘরের তাকে সাজানো কৌটোগুলো
যাদের গায়ে লিখে রাখতাম মশলার নাম,
তোমাদের বাথরুমে আমার গায়ের গন্ধ, এগুলো সব গেছে তো?
তোমাদের ছাদের বিকেলগুলো, তুমি কাজ কামাই করে
যখন মাঝেমধ্যে গিয়ে বসতে আমার কাছে
আমি তোমার কোলে মাথা দিয়ে বসতাম চোখ বন্ধ করে
তুমি কিছুক্ষন মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে,
'বয়স বাড়ছে তো নাকি?'
আচ্ছা ছাদের বিকেলগুলোতে আর বিকেল হয়?
সেই সাগরিকা কেমন আছে গো তোমার?
যার চুলে ঠোঁটে পেয়েছিলে দামি সুগন্ধি আর মরীচিকার স্বাদ।
তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে তো, তোমার আর?
আমি কোনো গন্ধ ব্যবহার করতাম না বলে কি রাগ ছিল তোমার!
আচ্ছা ঘাম মোছবার সময় আমার শাড়ীর আঁচল ধরে যে টানতে,
তখন তাতে কি পেতে গো?
সাগরিকার উগ্র মেকাপি সোহাগ, নাকি আমাকেই আমার মত;
ঘাম প্যাচপেচে সেই গরম দুপুরে?
আমার শেষ লেখার ডায়েরিটা যেটা শেষবার বালিশের নীচে
রেখেছিলাম। যেটার প্রতি পাতায় তুমি থাকতে আমার সঙ্গে শুয়ে,
শেষটায় আমাকে তো দিলে না ওটা খুঁজে নিতে,
বললে, "দেখবো ওটাতেই কোনো প্রমাণ থাকতে পারে হয়তো!'
আচ্ছা বলোতো, তুমি নিজের দোষ ঢাকতে আমাকে যে
চরিত্রহীন করতে চেয়েছিলে, তখন তোমার বুকের ভিতরে
সেই বিকেলগুলো উঁকি দেয়নি, একবারও?
পাশাপাশি শুয়ে হেসেছি বিনা কারণে, বুকে মুখে মেখেছি
আদর দুজনে।
স্নান করেছি রাতের নৈঃশব্দের প্রেমে।
সেই আদরগুলো সাবান দিয়ে ঘষে তুলে দিয়েছো তো শরীর থেকে?
তোমার বন্ধু হাবু'দা দেখা হলো সেদিন বাসে, বললো
'তুমি তো একা, আমিও। বৌটা একদম ভালোবাসে না'
আমি কোনো কথা না বলে বাস থেকে নেমে আসছিলাম।
শুনতে পেলাম হাবু'দা বলছে, ' সাগরিকা অন্য মধু পেয়ে গেছে বৌদি, শুনছো?'
তোমার রান্নাঘর, তোমার ছাদ, তোমার কলতলা, তোমার
ব্রাশের থুতুতে নোংরা বেসিন, তোমার বাথরুমের আয়নাতে
তোমার বিছানায় ঠিক তোমার বাঁ পাশটা
তোমার বুকটা…
বলোতো, আমি আছি কোথাও আর?
আমি আবার একটা ডাইরি লিখছি।
প্রতি পাতায় নানান ফুল দিয়ে সাজাই তা।
আমার সন্তান আমায় জড়িয়ে রাখে
চোখে ঠোঁটে চুমু দেয়। আমার বুকে মাথা গুঁজে বলে
'মা গো, তুমি আমার পৃথিবী।'
আমি তো দিব্যি আছি। আমার কোথাও তুমি নেই আর।
সাজ পোশাক শাড়ি আয়না সব নতুন, তোমার অচেনা।
কিন্তু তোমাদের ওই বাড়ি থেকে ওই পুজোর আল্পনা
আমার ছেঁড়া জুতো আমার গন্ধ তুমি মুছতে পেরেছো তো?
সাগরিকা টাগরিকা যেই আসুক না,
তার সুগন্ধির বোতলে আমার ঘাম খুঁজছো না তো?
________________
30. 08. 2019
এক পৃথিবী সূর্য
সুজান মিঠি
দুকূল ছাপিয়ে বান ডাকল চেনা নদীটা।
আমি ভরা নদীর বুকে আমার শরীর ডোবালাম।
ধীরে ধীরে শ্বাস বন্ধ করলাম, তারপর…
ঠিক প্রতিবারের মত ভেসে উঠলাম আবার!
জেগে থাকা ডাঙা থেকে উড়ে এল বিদ্রূপ…
হো! হো! হো! ডুবছে কিন্তু ডুবছে না!
পাথর ছেনে ছেনে নিকষ কালো শ্রমিক
বানালাম। তার বুক কেটে বসিয়ে দিলাম শোক।
কোমরবন্ধনীতে অস্ত্র রাখলাম, কপালে তেজ!
হাতের তালু কেটে কেটে তাতে এঁকে দিলাম
আমাকে…
প্রবল কালবৈশাখী এসে তার শোক অস্ত্র
তেজ আর হাতের তালু উড়িয়ে নিয়ে গেল।
আমি তার পিছনে ছুটলাম! ভীষণ ছুটলাম!
আম কুড়োতে কুড়োতে আমতলা হেসে উঠল
খুব...আহা গো! এমন পোড়া কপালও হয়!
মনে পড়ে! খুব মনে পড়ে!
বুকের ডানদিক বামদিক
দুদিকের প্রবল যন্ত্রণা!
যম আর ডাক্তারে টানাটানি
ডাক্তার বললেন, স্তন দুটো বাদ গেলে
অন্তত শরীর টিকবে!
বন্যার নদী আমার কানে কানে প্রতিবার বলেছিল,
ছি! সামান্য ত্রুটি! তাতেই মরতে হবে?
কেন? পৃথিবীতে পা ফেলার ঘাস নেই?
ফুলের সুবাস, কিংবা সু বাতাস?
যাও, নিজের কাজে মন দাও।
পাথর কেটে নিকষ অন্ধকার এক শ্রমিক
বানিয়েছিলাম বলে কালবৈশাখী বলেছিল,
সেকি? কেন? তুমি অন্ধকারে নিজেকে
আড়াল করতে চাও তাই ও'ও বুঝি এমন
অন্ধকারে হাতড়ে মরবে? যন্ত্রণা রাখবে বুকে?
নতুন গড়ো! শুনছ!
আলো বানাও।
যে তারা মরবে এক্ষুনি, সেও আমার দিকে
তাকিয়ে হাসে, বলে…
বুঝলে! শরীরের চাপ কমলে আলো বেশি খেলে
হৃদয়ে।
আলোর গান গাও, আলোর!
আমি বন্যার পলি জমিয়ে তাতে ফসল ফলাই।
পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানাই।
হাতে বাঁশি, মাথায় চূড়া…
কখনো হাতে বীণা, পায়ের কাছে হাঁস,
কখনো স্তন ছাড়া উদোম গা…
যার বুকে ঢেউ খেলে যায় আলো!
বিদ্রূপ ভাসতে ভাসতে একদিন ক্লান্ত হয়ে যায়।
রাজা ভেসে আসে অনেক দূরের দেশ থেকে।
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, এমন মায়া
দেখিনি তো আগে!
আমি পিছন ফিরলেই সে আমার ছায়া
দুহাতে আগলে ধরে। আমি এগোই, সেও
আমার পিছনে…
আমি পিছিয়ে আসি, সে আরো পিছনে…
তবু আমার ছায়া ধরে থাকে!
রাজা বলে, শরীর যত কম ভারী হবে,
ততই বাতাস খেলবে মনে!
বিদ্রূপ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
একটা স্তনহীন শরীর, যাকে দেখলে ধর্ষণও
হর্ষ করে, সে এমন রানী হয় কী করে!
রাজাকে চিৎকার করে বলে, এ হয় না!
সমাজ আছে! ওর পরীক্ষা হওয়া দরকার, অগ্নিপরীক্ষা!
রাজা শান্ত চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
আমি রামচন্দ্র নই।
পাথর কেটে মূর্তি বানাই আমি।
বন্যার জলে গা ধুই।
বুকের কাপড় খুলে ভাসিয়ে দিই পলির ফসলে।
রাজা আমার যন্ত্রণাগুলোর কঙ্কাল ছুঁড়ে ফেলে
দূর দেশে…
তারপর কপালে তেজরশ্মি নিয়ে নামে খনির
গভীরে, কয়লা তুলবে, আলো জ্বালবে!
আমার বুকের ভিতরে অপেক্ষার বাতাস আসে যায়,
ভাসে কিন্তু ডোবে না!
আমার শ্রমিক রাজা কয়লা তুলে এনে
তার কালো হাত ধুয়ে ফেলে আমার বুকে
আলো জ্বেলে দেয়,
বুঝলে রানী! তোমার এই বুকে এক
পৃথিবী সূর্য বাঁধব একদিন, দেখো!
--------------
05. 12. 2020
হারানো-প্রাপ্তি বিভাগ
সুজান মিঠি
আমি একদিন একটা রুমাল কুড়িয়ে পেলাম পথে।
কী সুন্দর করে তাতে লেখা ছিল...
"কৌশিককে...পামেলা।"
আমি খুব যত্নে তা রেখে দিলাম ড্রয়ারে।
তারপর বিজ্ঞাপন দিলাম সংবাদপত্রের
হারানো প্রাপ্তি বিভাগে...
"ভালোবাসা কি হারিয়ে যেতে চলেছে?
কৌশিক আর পামেলা যোগাযোগ করুন।"
সঙ্গে রুমালটির ছবি।
কিন্তু কেউ যোগাযোগ করল না।
পুরানো সংবাদপত্র ঠোঙা হয়ে গেল মুদির দোকানে।
আমি আবার একদিন একটা ঘড়ি কুড়িয়ে পেলাম পথে।
উল্টো পিঠে ছোট ছোট করে লেখা ছিল
"অলিকে... গুঞ্জন।"
আবার আমি বিজ্ঞাপন দিলাম,
"অলি আর গুঞ্জন
ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছ? এস নিয়ে যাও।"
সঙ্গে ঘড়ির ছবি। কেউ এল না।
সংবাদপত্রের কেটে রাখা হারানো প্রাপ্তি সংবাদটা
আমার মা দুদিন পরে ঝাঁট দিয়ে বের করল
ঘর থেকে।
আমি এরপর প্রায়ই কিছু না কিছু কুড়িয়ে পাই।
একটা পায়ের নুপুর, টাই, চুলের ক্লিপ
আর সব এনে ড্রয়ারে রাখি।
বিজ্ঞাপন দিই।
সংবাদপত্রগুলো হাসে,
মুদির দোকানে, ঝাঁটার ধুলোয় গড়াগড়ি খায়।
এভাবে বিজ্ঞাপন দিতে দিতে, হঠাৎ একদিন এক
হারানো প্রাপ্তি বিভাগ খুলে আমি নিজেই অবাক হয়ে দেখি,
ওখানে আমারই ছবি দিয়ে কেউ যেন
বিজ্ঞাপন দিয়েছে সেঁটে…
"ইনি হারিয়ে গেছেন এই পৃথিবী থেকে,
পৌঁছে গেছেন ভালোবাসার গ্রহে।
শরীর ছাড়াও স্নেহ খোঁজেন, উপহারের
মূল্য খোঁজেন।
কেউ যদি এনাকে খুঁজে পান…
বিশেষ বৈশিষ্ট্য এনার মানসিক বৈকল্য আছে,
কুড়িয়ে রাখতে চান ভালোবাসা!"
আমি চুপিচুপি বিজ্ঞাপনটা কেটে ঢুকিয়ে রাখি
ড্রয়ারের অন্ধকারে, কেউ দেখে ফেলার আগেই।
তারপর হতাশ হয়ে চেয়ারে বসি।
কিছুক্ষণ পরে আমার টেবিল থেকে ড্রয়ারটা বের হয়ে আসে।
মুদির দোকান, মিষ্টির দোকান, মায়ের ঝাঁটা
সব জায়গা থেকে ওই হারানো প্রাপ্তির
আমার হারিয়ে যাওয়ার সংবাদটুকু উড়ে আসে!
আমার মুখে নাকে বুকে নাভিতে পায়ের পাতায়
আমাকে আঁকড়ে ধরে!
আমার সারা শরীর হারানো প্রাপ্তি বিভাগের তলায়
ডুবে যেতে থাকে!
কী প্রচন্ড বিকট হাসির শব্দ ভীষণ চিৎকারে আমার কানে প্রবেশ করতে থাকে,
সমস্বরে বলতে থাকে...
"এইতো, আমি কৌশিক!"
"আমি পামেলা!"
"আমি অলি!" "এই যে আমি গুঞ্জন!"
"আমি রাখি!" "আমি কল্পনা!"
"সবাই আছি, শরীরে! শরীরে!
ভালোবাসায় নেই!"
"রুমাল, ঘড়ি, ক্লিপ, টাই এসব কিচ্ছু নেই!
শুধু বিজ্ঞাপন আছে!
শুধু বিজ্ঞাপন আছে!"
হারানো প্রাপ্তি বিভাগে সাঁটানো আমার ছবিটার
ভিতরে ঢুকে গেল আমার ড্রয়ার আর
আমার শরীর।
মানুষ চাইলে…
সুজান মিঠি
মানুষ চাইলে উড়তে পারে
মনের মধ্যে ডানা পেয়ে।
চাইলে দুঃখ ভুলতে পারে,
সুখ আকাশের সুর গেয়ে।
মানুষ চাইলে মরতে পারে,
হাজার রকম উপায় আছে।
বাঁচতে চাইলে একটা পথই
সব মানুষের বুকে বাঁচে।
মানুষ চাইলে বাঁচতে পারে,
শক্ত করে মনের মুঠো!
লোকের কথায় কান্না পেলে
লোক আর কান্না বাদ দুটো।
দুচোখ বুজেও সবুজ বিশ্ব,
মানুষ চাইলে আঁকতে জানে!
ফুল পাখি গান বাতাসেই,
লুকিয়ে আছে বাঁচার মানে।
ছুটলে জীবন আকাশ মত,
মেঘও খানিক আসবে যাবে!
তাই নিয়ে কী দুর্ভাবনায়
কেঁদে কেটে মরতে হবে?
মানুষ চাইলে আগুন জ্বালায়,
পাহাড় ডিঙায়, ফসল বোনে।
চাইলে মানুষ মৃত্যু খরায়,
বেঁচে থাকার বৃষ্টি শোনে।
চাইলে মানুষ সুখ যাপন,
আলোয় হাসে এক পৃথিবী।
ভালোবাসাই বাঁচার হদিস,
হৃদয় মাঝে হৃদয় দাবি।
--------------
29. 11. 2020
চুপিচুপি স্লিপিং ট্যাবলেটের পাতা থেকে সব ট্যাবলেট বের করে জলে মেশাই। তারপর চুমুক দিয়ে আমার বাকি জীবনের গল্পকে অপ্রকাশিত রাখতে ঢক করে গিলে ফেলি...কিন্তু কিছুতেই সম্পাদকমশাই আমায় ছাড়েন না! ওষুধ ইনজেকশন, ওয়াশ! ব্যাস আবার সেই টানা হেঁচড়া যাপন যাপন খেলা।
জ্যোতিষী বলেন, এত সহজে মৃত্যু নেই মশাই!
ঝুরঝুরে ফ্যানে গলা বাঁধি বেশ শক্ত করে…
কিছুক্ষণই তো! তারপর মাটি হয়ে যাবে ঘর, ফ্যান, চোখ, ঠোঁট, স্নেহ…
এখানেও গন্ডগোল! বড় টর্চ নিয়ে প্রকাশক গলায় যন্ত্র ঢুকিয়ে বলেন, বুঝলেন মশাই! এর নাম যন্ত্রণা!
কেরোসিনের জার গায়ের উপর উপুড় করে দিলাম। এইবার আগুনে বেশ নিশ্চিন্তে সাঁতার কাটতে পারবো!
যাহ! এ কী হলো! কলাপাতায় মুড়ে আমাকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলো ভাবী গবেষকদল...আরো পঞ্চাশ শতাংশ বাকি! পত্রিকার সম্পাদক অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন, মশাই! আগুনে সোনা আরও খাঁটি হয়, যন্ত্রণাও।
জ্যোতিষের সহকারী ব্যক্তিটি ঘাড় নাড়েন।
আপনি তো সেই, যিনি হাজার বছর পথ হেঁটে চলেছেন…
এরপর গলগল করে বমি বেরিয়ে আসে। পাকস্থলী, যকৃৎ সব উঠে আসে বাইরে। হন্তদন্ত হয়ে প্রকাশক ছুটে আসেন আমার কাছে, শুনছেন মশাই! স্লিপিং ট্যাবলেট, কেরোসিনের ফোয়ারা কিংবা ঝুরো ফ্যান এ দিয়ে যদি একটা উপন্যাস লেখেন...তবে বাজারে হেবি কাটতি হবে কিন্তু!
----
সুজান মিঠি
রাই ও শশী
সুজান মিঠি
চাঁদ, তুমি এসেছ এই যমুনা তীরে!
বৃন্দাবনে সন্ধ্যা নামার অনেক আগে থেকেই
যে আমি তোমার অপেক্ষায়, শশী!
এই যমুনায় তোমার ছায়ায় আমার কানুর
বিরহাতুর মুখখানা দেখার জন্য আমিও যে
উন্মাদিনী!
কী বলছ? বিরহ কেন?
প্রেমাস্পদে চির বিরহিনী যে আমি!
তাঁর কোলেও তাঁকে হারানোর ভয়ে আমি শঙ্কিত
থাকি, ক্রন্দন করি, ভালোবাসার ক্ষণস্থায়ী সুখ
আমায় যে আরও বেশি ব্যথিত করে দেয়!
ওই যে আমার সখীগণ নিজ নিজ কাজে
ব্যস্ত হয়েও কেমন কৃষ্ণের জন্য উদাসীন!
ওই দেখো, ফুল, পথ,সন্ধে, নদী, সবাই কেমন
সেজে উঠেছে!
তোমার অমৃতে প্লাবিত হচ্ছে চারিদিক!
আমার সখীদের উন্মাদনা সত্ত্বেও আমি কেন
সাহসিনী, ভাবছ তুমি ইন্দু?
ওগো! সর্বস্ব ত্যাগ করে তবেই না ঈশ্বর পেতে হয়!
গলায় বৈজয়ন্তী ফুলের মালা, পীত বাস,
মধুর বাঁশির সুরে যে কাম, সে তো নিষ্কাম!
সেই তো ঈশ্বর প্রাপ্তি!
তিনি তো আমার একার নন!
তিনি আকাশ বাতাস জল মাটির, সারা জগতের!
দেখো চেয়ে, ওই যমুনার জলে তোমার ছায়ায়…
আদুল গায়ে স্নিগ্ধ মায়ায় কেমন তিনি ভাসছেন !
ওরে, নীল যমুনার জল! আয়, তোকে আলিঙ্গন করি আজ!
তোর শরীর ছুঁয়ে তাঁর কোমল অঙ্গ আর একবার
জড়িয়ে ধরি আমার পিপাসিত বক্ষে!
বিস্মিত হয়ো না বিধু! গোপীগণ তাঁকে পাবে
আরাধ্য দেবতায়, নিষ্কাম পরমাত্মায়।
আমি তাঁর বাঁশি শুনতে শুনতে তাঁর দেহেই
প্রবেশ করব পরম আনন্দে।
লোকে বলবে, রাধা! রাধা! রাধাই কৃষ্ণের হ্লাদিনী।
ওই দেখো রাকেশ, প্রহর ডাকছে পাখি!
এ যমুনায় এবার আমি আর মায়া আজ রাসলীলা আঁকি…
নাদিরা
সুজান মিঠি
মাছের আঁশ ভেঙে ভেঙে নাদিরা রোদ্দুর
খুঁজে চলে।
লোকটা বলেছিল, "মাছের গায়ে
চলকে ওঠে রোদ আর বুকের মধ্যে অভিমান।"
সন্ধ্যাতারার নীচে বসে নাদিরা পথ আঁকে
মজা নদীর বাঁকে বাঁকে।
লোকটা বলেছিল, "পথ একদিন ঠিক মিলে
যাবে স্রোতহীন দেহে।"
নাদিরার গলায় আটকে থাকে কান্না!
লোকটা বলেছিল, "ওদের বরং ডানা দিও কখনো,
ওরা একদিন বৃষ্টি হয়ে নেমে আসতে পারে
শুকনো ক্ষেতে।"
লোকটার বুকের বামপাশে নাদিরা একটা
ঘর বুনেছিল।
একটাই ঘর, একটা বিছানা,
একটা বালিশ, একটা ঘুম, একটা স্বপ্ন
দুটো শ্বাস।
লোকটা বলত, "এইখানেই তোমার চিরকালীন বাস।'
নাদিরা বলেছিল, "কিন্তু ধর্ম…"
লোকটা নাদিরার ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিল,
"যখন আমি ছেড়ে যাব পৃথিবী, ওই গাছের
নীচে ঝরা পাতায় পা রেখো, আমার হৃদয়ের
মর্মর শুনতে পাবে,ধর্ম নয়।"
খোলা মাঠে নাদিরা বাতাসের গায়ে হেলান দিতে
গিয়ে বারবার পড়ে যায়।
লোকটা বলেছিল, "খোলা মাঠের বাতাস জানে
কেমন করে উদাসী মনে সবকিছু ভাসিয়ে দেওয়া
যায়। তুমিও পারবে ওর পিঠে ঠেস দিয়ে, দেখো!"
নাদিরা মাছের আঁশ ভাঙতে ভাঙতে একদিন
সন্ধ্যাতারার নীচে ঠিকানা খুঁজে পেয়ে গেল ঠিক।
মজা নদী, খোলা হাওয়া এসব কিছুই সে ঠিকানায়
নেই, এমনকি সেই একটা ঘর একটা বিছানা দুটো
শ্বাস!
কোত্থাও নেই কোনোখানে!
লোকটার বাবা ক্রুর হেসে বলল, "ছেলে আমার
মস্ত অভিনেতা, কত তার প্রতিভা!
এইতো এবার গেছে এক মৃত সৈনিকের স্ত্রীর
অন্দরমহলে।"
নাদিরা মাছের গন্ধ ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করল,
"তবে কি কেবল ধর্মের কারণ?"
লোকটার বাবা চোখ ছোট করে বলল,
"আবেগ সঙ্গে আছে এখনো? ভাসিয়ে দাও ওই খালে।
ওসব ধর্ম টর্ম কিছু নয়, অভিনয়টাই আসল।
কজন পারে এমন?"
নাদিরা ঝরা পাতার উপর পা রেখে বুঝতে পারল
একটু আগে বৃষ্টি হয়ে ওরা ভিজে গেছে।
নাদিরা ছুঁড়ে দিল মাছের আঁশগুলো।
সূর্যের নীচে চুল খুলে বসল সে।
তার চুল, পিঠ, কাঁধ, ঘাড় রোদ্দুর চিনে নিল
মুহুর্তেই।
ঠোঁট অভিমানী ভঙ্গিতে বলল, "এতদিন কেন
আসোনি?"
রোদ্দুর বলল, "ডাকোনি তো! মাছের আঁশ ভেঙেছ।"
মজা নদীর উপর বৃষ্টি জমে জমে প্রবল স্রোত
হল একদিন।
নাদিরা পা ডুবিয়ে চিৎকার করে বলল, "তার অভিনয় দেখতে চাই একবার!
আমায় নিয়ে যাবে?"
সন্ধ্যাতারা চুপিচুপি নাদিরাকে নিয়ে গেল
লোকটার কাছে।
মৃত সৈনিকের স্ত্রী তখন অভিনেতা লোকটার
সারা শরীর অস্ত্রের আঘাতে ফালা ফালা করে কাটছে আর বলছে,
"তোমার এইবার একটাই অভিনয়...
মৃত্যুর!"
নাদিরা এখন রোদ্দুর নিয়ে ঘর বোনে।
সোয়েটার বোনে।
তার বুকের বামে কচি কচি অনাথ মুখগুলো
তাকে মা বলে ডাকে।
গাছের নীচে ঝরা পাতায় নতুন বৃষ্টি এসে বলে যায়...
"ধর্ম কেবল একটাই, ভালোবাসা।"
------–-----
19. 11. 2020
আকাশ কুসুম
সুজান মিঠি
--টুকটুকে ওই ভোরের হাসি
নামটা বলো দেখি!
--এতো ভীষণ সহজ প্রশ্ন,
ছোট্ট সোনা পাখি!
--জ্যোৎস্না মাখা নদীর ঢেউ
চাঁদের পিসি মাসি,
কার সুখেতে ছড়িয়ে দেয়
নানা রঙের হাসি?
--এ তো চেনা; ভীষণ জানা,
ছোট্ট সোনার মুখ!
স্বপ্নে তখন গড়াগড়ি
জড়িয়ে মায়ের বুক।
--মনখারাপে রাঙা গালে
কার বলো তো আড়ি?
এমা! এমা! তাও জানো না?
চলো খোকার বাড়ি।
ওই যে দেখো, টগর তলায়
বাতাস লুটোপুটি!
ওই খানেতেই লুকিয়ে আছে
খোকার লুডোর ঘুটি।
দুষ্টু দুপুর শুরু করেছে
লুকোচুরি খেলা,
তাইতো খোকন মান করেছে,
গাল ফুলেছে মেলা।
--তাই না কি গো? সকাল দুপুর
বন্ধু তার বুঝি?
--তার চোখেতেই প্রহরগুলো
দিনরাত্তির খুঁজি।
*** *** ***
--আর যেখানে রাত্রি নামে
ভীষণ অন্ধকার!
যেখানে তার ছোট্ট বয়স
আছড়ে চুরমার!
যেখানে নদীর ঢেউগুলো সব
মিথ্যে রূপকথা!
যেখানে খোকন চা দোকানে
কান্না চুমুক ব্যাথা!
যেখানে খুকু রক্ত দেহে
লুটিয়ে পড়ে ক্ষেতে,
যেখানে সোনা ময়লা মেখে
ডাস্টবিনে হাত পাতে!
কয়লা ভাঙে, আগুন জ্বালায়
যেখানে কচি মুখ…
--সেখানে তো কবেই জেনো
গুঁড়িয়ে গেছে সুখ।
সেখানেতেই জগৎ মৃত
শুধুই মানুষ ভাজ্য,
ছোট্ট সোনার দুঃস্বপ্নের
সেই তো আঁধার রাজ্য!
চাঁদ তারা সব ঘুমিয়ে থাকে,
নদীর ঢেউও তাই,
আর যা থাকে থাকুক; শিশুর
আকাশ কুসুম নাই।
--মায়ের কোলে সব সোনারা
থাকতো হেসে যদি!
স্বপ্নে কেউ আর বিষাদ তো নয়,
দেখতো সুখের নদী।
---------------
11. 11. 2020
সুতোর টান
সুজান মিঠি
বড় ছেলের ভাগে মস্ত বাড়ি, খাট,
আলমারি আর বাবা।
ছোট ছেলের ফ্ল্যাট, গাড়ি, সোফা আর মা।
অথচ বাবা মা দুজনেই একসময় দুই
ছেলেকে টগবগে ঘোড়ার মত ছুটতে
শিখিয়েছেন,
দুই কপালে চুম্বন করেছেন একসাথে।
ইদানিং বাবা মায়ের বার্ধক্য পড়ন্ত রোদ্দুরে
গা এলিয়ে স্মৃতিমেদুর ত্বকে আর কান্নায় চোখ রাখে।
আধ বোজা কন্ঠ কাঁপতে কাঁপতে বলে,
"খোকা! একটু শুনতে চাই!"
দুই মস্ত খোকার চোয়াল শক্ত হয় রাগে,
"খবরদার!"
বৃদ্ধ বাবার জমানো খুচরো বড় ছেলে ফুঁ
দিয়ে উড়িয়ে দেয়, "কী! এই টাকায় মোবাইল?
আর তাও ছোটর ঘরে? কখনো নয়!"
বৃদ্ধা মায়ের ছিন্ন আঁচলে ছোট ছেলে বিরক্তির
দলা ছুঁড়ে দেয় "আহঃ! কী যে
ঘ্যান ঘ্যান করো! বড়োর ঘরে ওসব ফোন টোন
একদম নয়!"
এক আকাশের এক চাঁদে শহরের দুই প্রান্ত
একটাই চিঠি লেখে, "তোমায় একটু শুনতে চাই!"
এক সমুদ্র তফাৎ নিয়ে বাতাস উড়ে আসে
দুজনের অভাবী জানালায়, "শুনছ! তোমায়
শুনতে চাই!"
তারপর হঠাৎ কী এক আশ্চর্যজনকভাবে
একদিন সারা শহরের সব কংক্রিট,
সব অট্টালিকা, সব বিচ্ছেদের গায়ে
জড়িয়ে গেল লম্বা লম্বা সুতো!
পথ ঘাট কল কারখানা নদী সর্বত্র শুধুই
সুতোর জাল!
আর শহরের দুই প্রান্তের দুই বাড়িতে দুটো
বৃদ্ধ বৃদ্ধার কানে দুটো দেশলাইয়ের খোল।
সারা শহর জুড়ে তারা বলছে, হ্যালো,শুনছ!
হ্যালো...হ্যালো!
কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না তাদের কথোপকথন!
দুই মস্ত খোকা কানে চাপা দিতে দিতে ক্রমশ আবার ছোট হয়ে যাচ্ছে…
আর ধীরে ধীরে বৃহৎ হচ্ছে পড়ন্ত রোদ্দুর,
লাঠি, জীর্ণ ত্বক আর বিচ্ছেদের গায়ে
সুতোর টান... হ্যালো শুনছ!
হ্যালো, শুনছ!
ওগো, শুনছ!
শবর ও শহর
সুজান মিঠি
"উঁচা উঁচা পাবত তোঁই বসই শবরী বালী।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিণ গীবত গুঞ্জরী মালি।।
উমত শবরো পাগল শবরো মা কর গুলি গুহাড়া
তৌহরি
নিঅ ঘরণী সহজ সুন্দরী।।"
পাহাড়ের উপরে শবরীর কোলে মাথা রেখে
শবর বলে, "একটো পাহাড়ি নোদি, একটো
ছোট ঝর্ণা, একটো আকাশ রঙের ঘর, তার
ছাদখানা হবেক জোছনা দিয়ে...খুব ইচ্ছে
তুকে দিব ইসব আমি!"
শবরী অনুযোগের সুরে বলে, "হুঁ! হাঁড়িতে ভাত নাই আছে,
ঘরে লুন নাই আছে, অথিতি আসতেই লাগে বারোমাস!
মাথার উপর ছাদ নাই, গায়ে ছেঁড়া কাপড়, উসব নোদি,
ঝর্ণা নিয়ে আমি কী করব বল তো?"
শবর শবরীর চোখের পাতায় পাহাড়ি ফুল দিয়ে
কাজল পরিয়ে দেয়। লতা গেঁথে গেঁথে পায়ে
নুপুর বেঁধে দেয়। জোগাড় করা হাঁড়িয়া খেয়ে নেশা করে দুজনে।
নেশার ঝোঁকে শবরী শবরের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
"তুই যদি ভদ্দরলোকদের ঘরে জন্মাইতিস,
তবে তুই ঠিকই পদ্য লিখতিস বটে! ইসব ঘর, ভাত, কাপড়, ইসব তুকে কখনো
বিরক্ত করত নাই রে! তবু তো বাঁচতে হবেক বল!
চল কেনে মরদ, আমরা পাহাড় থাকেন নাবে উ শহরটাতে যাই!
ইখানে যে আর পারছি নাই রে!"
শবর আর শবরী খিদে তৃষ্ণা আর স্বপ্ন নিয়ে
পাহাড় থেকে নেমে মানুষের গন্ধে প্রবেশ করল।
মাঠে ঘাটে কাজ করবে শবর,
শবরী তার জন্য রান্না করবে ভাত,
গনগনে আঁচে টগবগ করে ফুটবে ভাত আর তাদের সুখ!
শহরে পৌঁছানোমাত্র হুড়হুড় দুরদার করে কত
মানুষ একসঙ্গে যেন ওদের সামনে এসে হাজির
হল। যেন ওরা বিরাট এক দর্শনীয় বস্তু।
যেন ওদের গায়ে মানুষের রঙ নেই কোনো!
শবরী বলল, "তুরা ইভাবে ঘিরে ধরছিস কেনে আমাদের?"
একজন বলল, "এই শবর আসামি হবি? অনেক পয়সা পাবি!"
শবর শবরীর কানে কানে বলল, "শহরে আসতে না আসতেই
ইমন পয়সার জোগাড় হয়ি গেল রে বউ!"
জোরে জোরে বলল, "হ্যাঁ হ্যাঁ আসামি হব! কেনে হব নাই!
কী কী কাম করতে হুবে শুধু বুলে দে কেনে!"
শবরকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল
থানায়।
এক নেতার ছেলে হত্যা করেছে অন্য নেতার ছেলেকে।
মধ্যে আসামি হয়ে অন্য লোক
যদি স্বীকার করে দোষ, তবে অপরাধী নেতার ছেলে বেকসুর খালাস পাবে।
এমন মওকা ছাড়া যায় নাকি!
শবরী গাছের তলায় বসে থাকে একা।
গলায় গুঞ্জার মালাও আর নেই।
সে শুধুই কাঁদে আর ভাবে, তার মরদ এখনো
কেন আসামির কাজ শেষ করে এল না!
একদিন দুটো মানুষ এসে সামনে দাঁড়াল।
কিছু টাকা, কাপড় আর ভাত ছুঁড়ে দিল তার দিকে।
বলল, "এই নে! তোর মরদের রোজগার।"
শবরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিৎকার করে উঠল,
"না! না! ইমন ভাত আমার লাগবে নাই বাবুলোক!
আমার মরদ রে আনি দেও!
আমার শুধু পাহাড়ি নোদি লাগবেক!
আমার শুধু ঝর্ণা লাগবেক!
আমার শুধু আকাশ রঙের ঘর লাগবেক!
নানা রঙে রঙিন, সুগন্ধ যুক্ত মানুষগুলো
শবরীর পাশ দিয়ে পেরোনোর সময় নাকে চাপা
দেয়।
পাহাড়ি সরলতার গন্ধ পায় নাকি শহরে এসে বিষাক্ত
হয়ে যাওয়া শবরীর কান্নার গন্ধ পায় ওরা...ঠিক বোঝা যায় না।
কিলিং
সুজান মিঠি
এর নাম অনার কিলিং।
মাথা আর ধড় আলাদা করে রাস্তার পাশে
নয়ানজুলিতে ছুঁড়ে দাও, ব্যাস!
আর কোনোদিন মেয়ে কোনো নিচু জাতির
ছেলের বুকে মাথা রাখতে পারবে না!
কান্না বন্ধ করে দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারবে না
বাবা, ভালোবাসি ওকে!
ওই ভালোবাসা নয়ানজুলির নীচে গলে পাঁক
হয়ে যাবে, একসময়।
বাঁচবে আভিজাত্য, বাঁচবে বাবা কাকার মাথা!
এর নাম লাভ জিহাদ!
তোমায় ভাববেসেছি, আমার জন্য ধর্মান্তরিত হওয়া এমন কী আর কথা!
কেন মানবে না? তাই তোমাকে ধর্মান্তরিত করা
বা না করিয়েও শুধু ভালোবাসা দেওয়ার থেকে
সহজ প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে মারা।
ওই বুকের মাঝখান দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত
বেরোবে!
আমি দেখবো তোমার ছটকানো
দেহটা কেমন ধীরে ধীরে প্রতিবাদ ভুলে
শান্ত হয়ে যায়!
এর নাম জিঘাংসা!
আমি তোমায় ভালোবাসি,
এটাই কী কম বড় কথা!
তুমি কিনা আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছ বারবার?
তোমার পথ আটকে তোমার মুখ ফালাফালা
করে দেব আমি!
তুমি দুহাত দিয়ে মুখ আগলে চিৎকার করবে
বাঁচাও! বাঁচাও!
আমার চকচকে ছুরি তখন তোমার পাকস্থলী ভেদ
করে ঢুকে যাবে দু ইঞ্চি গভীরে!
তোমার প্রতিবাদ বেরোনোর সব পথ দেব বন্ধ করে…
আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া!
প্রথমবার বাবা শুনে আনন্দ পাওয়া,
মেয়ের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা শেখানো বাবা,
পিঠে বসিয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলা করা কাকা,
দুজনে মিলে সেই মেয়ের শরীর যখন দু টুকরো করে, রক্তে ভেসে যায়
তাদের দু হাত!
কিন্তু মন ভেজে না।
মেয়েটা শেষবারের মত বাঁচতে চেয়ে ঠোঁট
নাড়ায়,
কিন্তু সেই ঠোঁটে আর কোনো বাবা কাকার স্নেহ থাকে না!
শুধু খবরের কাগজের হেডলাইন থাকে…
তবুও নয়ানজুলির জল ভাবে, পথ ভাবে, অন্ধকার
ছুরি সবাই ভাবে… অনারের মূল্য কী করে
প্রাণের চাইতে বড় হয়ে যায়!
তুমি যেমন, আমি তাতেই তোমায় ভালোবাসি
বলা ছেলেটা যে মেয়েটার বুকে খুঁজে নিয়েছিল
ভালোবাসার ঘর বাড়ি,
কী করে সেই বুক, সেই সুখ ফালাফালা করে
দিতে পারে সে?
কী ভাবে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে পারে
ভালোবাসার সেই ঘর?
প্রকাশ্য দিবালোক ভাবে, সে প্রেম কোথায়
যেখানে মুসলিম স্বামীর বাড়িতে বসে
হিন্দু স্ত্রী পুজো করে আরাধ্য দেবতার!
যেখানে হিন্দু স্বামী মুসলিম স্ত্রীর মৃত্যুর পর
ভেঙে পড়ে তাকে সমাধিস্থ করে যত্নে!
যেখানে কেবল ভালোবাসাটুকু থাকে
ভালোবাসার ঘরে।
ভালোবাসা না পাওয়া ছেলেটা ভীষণ বড়
ডাক্তার হতে পারে, কবি হতে পারে,
বড়জোর পাগল হতে পারে! কিন্তু
রক্তের গন্ধ ভালোবাসে কী করে?
পৃথিবী মায়ের বড় যন্ত্রণা!
অনার কিলিং, লাভ জিহাদ এসব অসুখ
তার অঙ্গগুলোয় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে কর্কট!
প্রতিদিন বুকে নেমে আসা রোদ্দুরকে
পৃথিবী মা জিজ্ঞেস করে, এমন চিকিৎসক
কী এখনো জন্ম নেয়নি কোথাও…
যে আমার এ অঙ্গগুলো শল্য চিকিৎসায় বাদ
দিতে জানে!
--------------
30. 10. 2020
স্পর্শ
সুজান মিঠি
আমি যদি বলি, আমার একটা পাহাড় চাই!
এই নাও পাহাড়! বলে সে আমাকে পৃথিবীর
সব উচ্চতা এনে দেয়।
আমি যদি বলি, নদী নেব একখানা!
সে হাজার ঝর্ণা এনে বলে, তুমি যেমন খুশি
নদী বানিয়ে নাও।
আমি ডানা চাইলে সে আকাশ এনে দেয়।
বলে, উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে বাসা বেঁধো,
আমি অরণ্য বুনে রাখছি।
সে তার বুকের বামদিকে শিকড় পোঁতে
শাল সেগুন পলাশ…
বসন্তে আমি আকাশে ভাসতে ভাসতে বলি
শুনছো! আমি দোল খেলতে চাই!
আমার রং কোথায়?
সে তার অরণ্যে আরও খানিক মহুল পলাশ
ফুটিয়ে বলে, আর একটু পরেই
ভোর নামবে! তোমায় আমি ভোরের
রামধনু করে দেব, কেমন?
আমি যদি বলি, আমি বৃষ্টি ভিজতে চাই!
সে নিজেই স্নান হয়ে যায়।
আমি যদি উষ্ণতা চাই, সে ফায়ার প্লেস
হয়ে যায়।
আমি যদি ধর্ম চাই, ঈশ্বর আল্লা যীশু বুদ্ধ
সব মিলিয়ে আমার সামনে একেশ্বর হয়ে ওঠে
সে'ই…
কিন্তু আমি যদি স্পর্শ চাই…
হো হো হেসে ওঠে সে!
বলে, কাব্য দিয়ে নদী নারী পাহাড় পুরুষ
সব এক হয়ে যায়,
কিন্তু তা দিয়ে স্পর্শ দেব কেমন করে?
আমার বিছানায় বালিশে রামধনু
বৃষ্টি, আকাশ, অরণ্য খেলে বেড়ায়,
কিন্তু আমি তাদের স্পর্শ করতে পারিনা!
নীল চেয়ারে চোখ বুজে বসে আমি তার
কাছে নীল সমুদ্র চাইলে,
সে সপ্ত সাগর তুলে দিয়েছে আমার আঁচলে।
কিন্তু আমি কোনোদিন তার এলোমেলো
ঘর চাইনি!
আমি কোনোদিন তার বাগানের গোলাপ চাইনি!
আমি কোনোদিন তার ক্যানভাসের তুলি হতে চাইনি!
আমি কোনোদিন তার কানে কানে বলতে চাইনি,
পাহাড়, নদী, রং, ভোর সব পাওয়া হবে, তোমাকে পেলেই!
সে বলে, কাব্যে ডুবে মরতে হলে
শ্বাস রুদ্ধ করে শব্দে প্রবেশ করতে হয়,
তলিয়ে যেতে হয়…
কিন্তু আমি তার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে
কোনোদিন বলিনি,
তোমারই ঠোঁটের উষ্ণতা চাই কেবল!
তোমার বুকে অরণ্য!
নীল মলাটের বইটা যখন শেষবার দিতে এলো
সে, তখন বসন্তের গোধূলি।
কুঞ্চিত ত্বকে সোনালী আলো,
আকাশে অস্তরাগের ছোঁয়া।
এতটুকু বিষাদ নেই…
সে বললো, নাও!এখানেও সমুদ্র পাবে।
আমি এবার স্পর্শ করি তার ঠোঁট, আমার
অপেক্ষার ওষ্ঠে।
তারপর বলি, গোধূলির রঙে কি দোল
খেলা যায়না?
সে বললো, এবার এই শেষবেলায় কী চাও?
আমি তার বুকে মাথা রাখি।
নীল মলাটের বইটা তখন পাখি হয়ে
উড়ে গেছে…
সে আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে,
ভালোবাসো?
আমি বলি, স্পর্শ চাই!
তোমাকে চাই!
তোমাকেই চাই!
------------
27. 10. 2020
কবি, তোমাকে…
সুজান মিঠি
মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল আমার।
ফুলশয্যার খাটে বত্রিশ বছরের স্বামী বলল,
দেখো, 'তোমার বাবা গরিব,তাই উদ্ধার করেছি
কেবল, মনে আমার অন্য সোহাগ।
থাকবে, খাবে, দাবে... শাড়ি গয়না সব পাবে কিন্তু,
আমাকে চেও না কখনো।'
বিবাহের নানা নিয়ম কানুনে ক্লান্ত আমার চোখে
নেমে এল ঘুম।
আমার স্বামী ভীষণ বড় ব্যবসায়ী, আমার ঘরের
সঙ্গে লাগোয়া ঘরেই রাত্রিবাস করেন।
আমি ঠাকুর-শাশুড়ির বেঁধে দেওয়া খোঁপায়
ফুল লাগিয়ে বিছানায় বসে থাকি একা।
দিন দশেক পরে আমি তোমাকে পেলাম হঠাৎ জানো।
আমার ছোট দেওর এসে আমার হাতে গীতবিতান
দিয়ে বললো, 'বৌদি নাও। এ তোমার উপহার!'
আমি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে ঘরে নিয়ে এলাম।
তারপর তুমি আমার হলে।
যুবতীর প্রেম হলে।
প্রত্যেক বিকেলে দেওর পাঠ করে শোনাতো তোমায়।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
বৈশাখে বৃষ্টি আসতো।
আমার সমবয়সী দেওর ওর দুহাত দিয়ে আড়াল করতো
আমায়।
তারপর সকালে তোমার গান দিয়ে ধুইয়ে দিত
আমার দু চোখ।
আমি একদিন ওকে জড়িয়ে ধরি আমার অবশ মূর্ছনায়।
ও আমায় ওর খোলা বুকে আশ্রয় দেয় সেই প্রথম।
ঠোঁটে ভিজিয়ে দেয় তোমার কবিতা, তোমার গান, তোমার প্রেম, প্রকৃতি, পূজা।
আমি আমার দেওরের নতুন বৌঠান হয়ে উঠলাম কখন যেন।
আমার স্বামীর ব্যস্ততা বাড়তে বাড়তে আমার সঙ্গে
দেখা সাক্ষাতও কম হয়ে গেল।
শাশুড়ি ঠাকুর-শাশুড়ি আমাকে গঞ্জনা দিতে শুরু করলো।
দেওরের অন্যত্র বিবাহ পাকা হয়ে গেল কয়েক মাসের
মধ্যেই।
একলা ছাদের বৃষ্টি মাখতে মাখতে যখন কান্না বুনতে
ব্যস্ত আমি ভীষণ,
আমার দেওর এসে আমার দু চোখ চেপে তোমাকে
শোনালো শেষবারের মত-
'মতিয়া যখন উঠেছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষান!'
আমি অভিমানে মুখ লুকিয়ে ফেলি ওর বিপরীতে।
সেই খোলা বুক, ভিজে ঠোঁট, উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি
মিলিয়ে গেল প্রচন্ড বজ্রপাতের শব্দে।
আমার প্রিয় বন্ধু আমার রবি দেওরের বিয়ে হয়ে গেল
ধুমধাম করে।
আমার উপর ভার পড়লো নতুন বউকে ফুলশয্যার সাজে
প্রস্তুত করার জন্য।
আমি তোমাকে সেই গীতবিতান থেকে আঁকড়ে
ধরেছিলাম কবি।
তোমার সোনার তরী তে ডুবেছি একলা দুপুর,
তোমার বলাকা ভাসিয়েছে বিকেল-অভিমান,
তোমার সঞ্চয়িতা মুখের উপর চেপে ঘুমিয়েছি রাতে।
আমার খোপার ফুল লুটিয়েছে বালিশের আনন্দে,
ঠাকুর-শাশুড়ি ভেবেছে আচারের বন্দোবস্ত করার কথা।
আমার দেওর আমার সামনে দিয়ে সুসজ্জিত বউকে
নিয়ে গেল ঘরে, হাতে তুলে দেবে গীতবিতান,
বুকে পূর্ন আদর।
আমার খোঁপার চারিদিকে গজিয়ে উঠবে বিষাদ।
আমার ঠোঁটে দেওরের এঁকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ
নেমে যাবে ধুলোয়, খুঁজবে আফিম।
কবি, আমি তোমার নতুন বৌঠান হয়ে গেলাম
তোমায় বুকে নিয়ে!
ডাক্তার দেওরের ঘর থেকেই জোগাড় করে রেখেছিলাম
ঘুমের ওষুধ গুলো।
ওদের ফুলশয্যার পরিতৃপ্ত মুখ দেখে
তবেই না মৃত্যু সহজ হবে আমার!
অপেক্ষা করছি ভোর রাতের,
ঝমঝম করে বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে জানলার ওপার।
হঠাৎ আমার ঘরের লাগোয়া ঘরের দরজা খুলে গেল।
আমার ব্যবসায়ী বর বেরিয়ে এসে আমার খাটের
কোণে বসলো অপরাধীর মুখ নিয়ে,
তারপর ফিসফিস করে বললো, 'মাপ করো।'
জড়িয়ে ধরলো আমার শরীর, শূন্য মন।
ঘুমের ওষুধ গলে গেল তোমার গানে…
আমার গা দিয়ে নেমে আসছে অনুতপ্ত বরের আদর
আর দেওরের ঘর থেকে বয়ে আসছে তোমার গান,
'এমন দিনে তারে বলা যায়…'
আমার আর নতুন বৌঠান হওয়া হলো না।
সস্ত্রীক দেওর বিদেশ চলে গেল।
আমার বর সোহাগ-যাপনে আমার কালো মুখখানা
আদর করে তুলে ধরে গাইলো…
কৃষ্ণকলি আমি তারই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক
… … ...
27. 04. 2020
উড়ো চিঠি
সুজান মিঠি
সন্ধ্যে নামল একরাশ।
গলিতে, পাড়ার মোড়ে তেলেভাজা আর
মুখরোচক আড্ডা শুরু হলো।
গৃহবধূ তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বেলে
ইতিউতি উঁকি দিয়ে খুঁজতে লাগলো
তার পৃথিবীকে; দু একটা তারা দিয়ে
সে একসময় গান বাঁধতে পারতো
এখন সে সব অতীত!
তেলেভাজার গন্ধ উবে রাত নামতো।
গভীর রাত!
গাছের মাথা থেকে দু একটা পাখি
প্রহর ঘোষণা করতো।
কুচকুচে শরীর নিয়ে গৃহবধূর নতুন
পৃথিবী ফিরে আসতো তার বিছানায়।
মাধবীলতার গন্ধ ভেসে আসতো খোলা
জানলা দিয়ে।
গৃহবধূর পৃথিবী তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে
ব্যাগ থেকে বের করতো স্নো, পাউডার, লিপস্টিক
সুগন্ধি…
মাধবীলতার গন্ধ নিয়ে গৃহবধূ একসময় কবিতা
লিখতে পারতো…
সেসব এখন অতীত!
ভোর হতে না হতেই কুচকুচে শরীরটা মিলিয়ে যেত
নদীর বুকে।
ছপাত ছপাত জল কেটে পেরিয়ে যেত ভয়…
গৃহবধূর একটা গান ছিল ভোরের রঙ নিয়ে।
এখন সেসব…
একদিন রাতের আয়নায় যখন গৃহবধূ
নিজের দুই চোখে কাজল ঘষছিল,
মাধবীর গন্ধকে বলছিল, চুপ কর! সে আসছে!
ঠিক তখন খোলা জানলা দিয়ে উড়ে এসেছিল
উড়ো চিঠি…
তাতে লেখা ছিল, যে দেশে জঙ্গির বউ
গান ভুলে যায়...সে দেশের মাটিকে চিতা
বলা হয়! চাও কী এমন চিতা?
গৃহবধূ কুচকুচে শরীরে মুখ ডুবিয়ে গাইলো
তারাদের গান…
তার চলে যাওয়ার সময় গাইলো ভোরের গান।
মাধবীর গন্ধ নিজের সুগন্ধিতে ভরে লিখলো
আনন্দ!
পাড়ার মোড়ে, গলিতে নিন্দে উঠলো।
তেলেভাজার কামড়ে চিবানো মুচমুচে আওয়াজ...
ঘরের বউ না কী বেবুশ্যে! এমন সাজপোশাক!
এমন গলা ছেড়ে গান, ছি!
শাশুড়ি চুলের মুঠি ধরে তুলসিতলার প্রদীপে
জ্বালিয়ে দিতে গেল গৃহবধূর!
কুচকুচে শরীরটা হঠাৎ উড়ে এসে ঝিনকে নিল
চুল…
তাতে ছড়িয়ে দিল মুঠো মুঠো মাধবী।
বললো, জঙ্গির বউ বলে কী গান লুকোবে মেয়ে?
গলিতে, পাড়ার মোড়ে গুনগুন উঠলো,
তেলেভাজার কামড়ে টগবগে হাসি...
ব্যাটা, জঙ্গি! আজ পড়েছিস ধরা!
যা! জেলের ঘানি টান এবার!
গৃহবধূ সারারাত প্রহর জাগার কান্না গায়,
জানলার বাইরে মুখ থুবড়ে পড়ে মাধবী।
হঠাৎ ঘুলঘুলি দিয়ে উড়ে আসে উড়ো চিঠি…
. ..বন্দির বউ বলে যে দেশে কান্না বোনে মেয়ে,
সে মাটিতে কেবল মেঘ ঘর বাঁধে, চাও কী এমন মেঘ?
শাশুড়ি আচার বানায়।
রোদে শুকোতে দেয়। গৃহবধূ জিভে তোলে।
শিশুর কান্না ছুটে যায় পাঁচিল টপকে…
কুচকুচে শরীর উড়ো চিঠি উড়িয়ে দেয় বাতাসে।
সরকার বলেছে, সে সত্যিই ষড়যন্ত্রের শিকার
তাই ছেড়ে দেওয়া হবে তাড়াতাড়িই।
সারাদিন ধরে দুটো শরীর রোদ্দুর বুনবে গানে।
উড়ো চিঠি জড়ো করতে করতে গৃহবধূ সদ্যজাতের কানে কানে বলে,
তোর বাবাটা না একদম পাগল!
---------------
11. 10. 2020
মধ্যবর্তী
সুজান মিঠি
তোমার আমার আবার দেখা বছর তিরিশ পর
শূন্য পার্কের বেঞ্চি, শুকনো পাতার মর্মর!
কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, সাদা চুল, তুমি এখন ষাট,
আমার চওড়া সিঁথি, পঞ্চান্নের ধূ ধূ চেরা মাঠ।
তুমি বললে, চলো নতুন করে শুরু করি তবে,
দুজনেরই সাথী দুজন, সেই যে গেছে কবে!
ছেলে মেয়ে বিদেশ চেনে, আমাদের আর কী!
একসঙ্গে কাটাই তবে, যে কদিন আছি বাকি…!
আমি বললাম, মনে পড়ে সেই কফির চুমুক?
একটা কাপে দুজন সাথে, হুমড়ি দুটো মুখ!
মনে পড়ে হাতের উপর হাত? কত্ত সেসব গল্প!
তোমার তখন গোঁফ উঠেছে, লজ্জা অল্প অল্প!
তুমি চশমা খুলে বললে, প্রিয়া মনে আছে!
তোমার দেওয়া সেই রুমাল আজো আমার কাছে।
এসো না, হাতের উপর আবার হাত রাখি,
কান পেতে দেখো গল্প এখনো রয়েছে বাকি!
আমি কান পাতলাম শূন্য বেঞ্চির পাঁজরে,
নাঃ! সেইখানে কেবল স্মৃতিরাই আছে ভরে।
কোথায় আছে বাকি কথা সব? একটুও নেই!
তুমি বললে,ভারী আশ্চর্য! কোথায় গেল সেই?
আমি হাসলাম। বললাম, ছেড়ে গিয়েছিলে কেন?
বললে পড়াশোনা চাকরি আরো কী সব যেন...
আমি বললাম, এবার বলো কী আছে বাকি?
তুমি বললে, ওষুধপত্র এখন বুক পকেটেই রাখি।
চশমা ছাড়া চোখে দেখি না, সুগার প্রেসার,
গিন্নির নামে স্মৃতি সৌধ, দান ধ্যান আর…
থাক ওসব! আমি থামিয়ে দিলাম তোমায়,
শোনো, আমারও জীবন এমনিই বয়ে যায়।
বছর দুয়েক হলো আমার সে চলে গেছে,
তবুও এই হৃদয়ে তার অভ্যেস বেঁচে আছে।
তোমার চশমা, পাকা চুল, জামার কলার,
সব কিছুতেই কেবল তোমার যে ছিল... তার!
পার্কের বেঞ্চিতে একটু পরে নতুন বিকেল হবে।
আমাদের যে দিন ছিল, তা তো গেছেই কবে!
তুমি বললে, আর একটিবার ফেরা যায় না কি?
আমি বললাম একটাই প্রশ্ন আছে বাকি...
আছে বললে রুমাল খানা, পারবে দিতে?
যার মধ্যে লিখেছিলাম, ইতি তোমার মিতে!
চোখ নামিয়ে বললে, মিথ্যে বলেছি তোমায়...
আমি বললাম, চলি, বেলা বয়ে যায়!
তুমি দুহাত চেপে ধরলে আমার, বললে, একবার...
আমি বললাম এরই নাম স্মৃতিময় সংসার।
কিছুই নেই বাকি, ভালোবাসাও নয়।
যেটুকু আছে কেবল একলা থাকার ভয়।
এটাও হয়ে যাবে দেখো ঠিক অভ্যেস,
তোমার রুমালে তার নাম দিব্য দেখেছি বেশ!
তুমি বললে, এটাই তার শেষ স্মৃতি বাকি।
আমি বললাম, আমি এখনো তাকেই বুকে রাখি।
এর নাম স্মৃতিময় সংসার, চলি বেলা পড়তি।
রাতের তারারাই আসলে দিনের মধ্যবর্তী।
ঊর্মিলা ও ব্ল্মীক
সুজান মিঠি
পিতা জনক ভূমি কর্ষণকালে পেয়েছিল আমার
ভগিনী জানকীকে।
তখন থেকেই সে ছিল পিতার প্রিয় পাত্রী।
সমগ্র রামায়ণই রচিত হলো তার কারণে।
আমি জনক কন্যা, অযোধ্যার পুত্রবধূ
নবোঢ়া ঊর্মিলা রয়ে গেলাম অন্ধকারে, অনধিকারে।
রামচন্দ্র বনবাসে যাওয়ার আদেশ পেলে;
সীতা তার অনুগামী হওয়ায় কর্তব্যপরায়ণা
মহানুভব স্ত্রীর পরিচয় রাখে পুরাণে, কিন্তু
আমি আমার ভ্রাতৃভক্ত স্বামীর অনুগামী
হওয়ার কথা বললেই হয়ে যাই স্বেচ্ছাচারী!
অনায়াসে আমার স্বামী আমাকে তার পিতা
মাতার সেবা কার্যে নিযুক্ত করে অগ্রজ এবং
তার স্ত্রীর সঙ্গী হতে পারেন নির্দ্বিধায়!
আমি একা রয়ে যাবো চোদ্দ বছর!
আমি ব্রহ্মচর্য পালন করবো!
ফলাহার করে বৈধব্য পালন করবো রাজবাটির
অভ্যন্তরেই!
স্বয়ং রামচন্দ্র, যিনি মহান! অন্যের দুঃখে
যার হৃদয় ব্যথিত হয় প্রবল…
তিনিও দেখতে পেলেন না এক বিবাহিত
নারীর পতির শোক!
ভগিনীও তখন বনবাসে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত!
নিজের স্বামী, আর দেবর সহযোগে বন-রানী
হওয়ার সুখ…
তার আর আমার কথা মনে পড়ার সময় কোথায়?
চোদ্দ বছর!
চোদ্দ বছর আমি শীতল মেঝের উপর
খড় বিছিয়ে ভোগ করবো শরশয্যা!
আর আমার ভগিনী আমার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে
গাইবেন... আমার সোনার হরিণ চাই!
না! সূর্পনখার কোনো দোষ আমি দিইনা।
সে যুবতী, রামচন্দ্রের প্রতি মোহাবিষ্ট
হলে রামচন্দ্র নিজেই তাকে ঠেলে দিলেন
ওই দেখো, আমার অনুজ!
কেন, ওনার কি স্মৃতি লুপ্ত হয়েছিল সেক্ষণে?
উনিও কি বিস্মিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে...
অযোধ্যায় বিবাহিত স্ত্রীকে ফেলে কেউ ভ্রাতা
ভ্রাতৃবধূর জন্য বনবাসে নিমজ্জিত হয়!
চোদ্দ বছর ফল খেয়ে, বৈধব্য যন্ত্রণা কাটিয়ে
পতি ফিরে আসবেন,
জন্ম দেবেন অঙ্গদ, ধর্মকেতু…
আমিও আজীবন তাদের মানুষ করার হেতু
ভুলে যাবো আমি জনক কন্যা!
মন্দিরে মন্দিরে পূজিত হবেন রামচন্দ্র!
পূজিতা হবেন মৃত্তিকায় ফিরে যাওয়া
আমার ভগিনীও!
আমার পতি লক্ষ্মণ ভ্রাতার পাশে উল্লেখিত হবেন
ভ্রাতৃ ভক্তির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে...
বিস্মৃতির অন্তরালে থাকবো আমি!
নাঃ! আমি আর চোদ্দ বছর কেবল
অপেক্ষা করবো না ব্রহ্মচর্যে!
রামায়ণের পাতা ভেদ করে চলে যাবো
বনবাসের সুসজ্জিত কুটিরে।
ভগিনীর 'সোনার হরিণ চাই!' বায়নাক্কা
সামলাবো,
সূর্পনখার নাক সামলাবো,
রাবণের চাতুর্য বুঝে সামলাবো
গোটা যুদ্ধ!
বনবাস শেষে রাজ্যের প্রজারা বলবে ...
ভাগ্যিস, মা ঊর্মিলা ছিল সঙ্গে!
রামায়ণের যুদ্ধের পৃষ্ঠা আর আমার চোদ্দ
বছরের অবহেলায় বাসা বাঁধবে
কোটি কোটি ব্ল্মীক।
--------------
07. 10. 2020
বন এবং দেবী
সুজান মিঠি
জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করলো মেয়েটা।
কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ আর ধুতি পাঞ্জাবিতে
সামনে এসে দাঁড়ালো কবি।
মেয়েটা বললো, কী চাও?
কবি বললো মৃত্যু!
মেয়েটা বললো, অপেক্ষা করো, দাবানল আসছে।
কবি বললো, না ওতে নয়। সুরা আর নারী
প্রবল ঝড়, উথাল পাতাল নদী।
মেয়েটা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো, মৃত্যুতেও রতি?
কবি স্মিত হেসে বললো, ওই তো জগৎ!
দাউ দাউ করে দাবানল জ্বলে উঠলো জঙ্গলে, কিন্তু
মেয়েটার কান্নায় আগুন নিভে নদী হয়ে গেল তখনই।
কবি মেয়েটার কোমর ধরলো দুহাতে।
গাছ কেটে ফালা করে নৌকো বানালো,
মহুয়ার ফুল সেঁচে সুরা।
কবি মেয়েটার নাভির নীচে পৃথিবী খুঁজতে খুঁজতে
ভেসে চললো মৃত্যুর সুখে।
কুমোর টুলি থেকে আনা মা দুর্গার মূর্তিতে
বোধন শুরু করার আগেই বিষ্ময়ে পুরোহিত
অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন মেঝেয়।
মায়ের স্তনের আভরণ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন।
মহিষাসুর মায়ের দুই পায়ের ফাঁকে প্রবেশ করাচ্ছে
রড, বোতল, ব্লেড।
রক্তাক্ত সারা মন্ডপ।
মাইকে তখনো বেজে চলেছে মায়ের পুজোর মন্ত্র
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন…
ছুটে এলো রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, শিক্ষিত অশিক্ষিত
গোটা সমাজ! কে বানিয়েছে এমন মূর্তি?
কেন অপমান করা হয়েছে মাতৃত্বকে?
হুকুম হলো জারি, খোঁজা হোক কে করেছে এমন!
কার সাহস এত!
আলুথালু বেশ; মাথায় উকুন;মেয়েটা খিলখিল করে
হেসে বললো, কিন্তু খুঁজবে কাকে?
যে কবি কবিতায় লিখতো, নারী মানেই মা অথবা দেবী!
সেই কবিও তো আমার গুহা দেখতে দেখতে
মরেছে!
সবাই বললো, আরে এ পাগল!
সময় নষ্ট কোরো না, চলো ধরে আনি সেই পোটোকে।
ঠিক সময়মত পোটোকে ধরে আনা হলো।
গাছে বেঁধে জিজ্ঞেস করা হলো,
বলো এমন স্পর্ধা কেন হলো তোমার?
সে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, ভাবলাম দেবীকে এমন
দেখে যেন আর কোনো মা মেয়ে জন্ম না দেয়!
মেয়ে না জন্মালে তুই হবি কোথা থেকে?
পুরোহিত হিসহিস করে বললো পোটোকে।
পোটো বললো, আমি তো হবো না!
আমরা কেউ আর হবো না!
শুধু গাছ হবে, ফুল হবে, পাখি হবে, নদী হবে...
মেয়েটা ছুটে এসে পোটোর বাঁধন খুলতে খুলতে
বললো, আর নদীতে গা ধুয়ে আমি সেই
কবির বীর্য ভাসিয়ে দেব, তাই না পোটো?
পোটো এবার ভীষন জোরে চিৎকার করে
উঠলো…
রড হবে, কাঁচি হবে, বোতল হবে, ব্লেড হবে…
কিন্তু ঢুকিয়ে রক্ত বের করে দেওয়ার যোনি
আর হবে না!
তাই শেষবারের মত দেবীকেও নির্ভয়া করে দিলাম!
মেয়েটা হাততালি দিতে দিতে এগিয়ে গেল...
কী মজা! কী মজা! আবার জঙ্গল হবে!
আর আমি বনদেবী!
পৃথিবী এখনো জেগে আছে
সুজান মিঠি
গলির শেষের শূন্যস্থানে একটা পাগল দিনরাত অনন্তকাল জেগে থাকত।
তার মাথার জটা বন্ধনে ছিল সহস্রাধিক ভয়,
তাই সে জেগে থাকত অতি প্রাচীনকাল থেকে।
অস্থিচর্মসার শরীরের মধ্যে গনগনে দুটো চোখে
কয়েক কোটি ভাষা পুড়িয়ে পুড়িয়ে সে
প্রতি মুহূর্তে বলে যেত, সাবধান! কেউ ঘুমিও না!
ঘুমোলেই দেখবে এ পৃথিবী থেমে যাবে!
আর ঘুরবে না!
গলির মোড়ে পাগলটাকে চিনত সবাই।
বার্ধক্য যৌবন শৈশব সবাই হাসত…
পাগলটা মাছের মত চোখ নিয়ে ঠোঁটে আঙুল
ঠেকিয়ে বলত, সাবধান! জেগে থাকো!
জেগে থাকো!
যাতায়াতের পথে প্রায় দেখি ওই চোখ আমি,
আর ভাবি বাড়ি ফিরে আমিও ওর মত জেগেই
থাকব এরপর…
রাতের পৃথিবী দেখব, ঝুপ করে নেমে আসা
অন্ধকারে জেগে থাকলে অন্তত জোনাকি বা
তারা নিয়ে গান তো বাঁধতে পারব!
বিছানায় পিঠ পাতলেই পাগলটার ফিসফিসানি
শুনতে পাই, জেগে থাকো…
আর রোজ রাতে আমার দুটো চোখ প্রবেশ করে গভীর ঘুমের গুহায়!
সেদিন সকালবেলা ওই স্থানের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম বাজার করতে।
পাগলটা আমায় হাত নেড়ে ডাকল।
কাছে যেতেই কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে
বলল, রাত গভীর হলে এসো, দেখবে পৃথিবী কেমন
একটু একটু করে থমকে যাচ্ছে এখানে! তাই তো বলি, ঘুমিও না
জেগে থাকো!
ইচ্ছে করেই জেগে থেকে সেদিন রাতে গেলাম
পাগলটার কাছে।
তার কাছে পৌঁছানোর আগেই দূর থেকে দেখতে পেলাম
পাগলটাকে কারা যেন গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে!
মুখেও কাপড় বাঁধা তার!
কেবল চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে।
আমি দূর থেকেও দেখতে পেলাম সে দৃষ্টি!
আর গাছটার ঠিক পাশে কতকগুলো যৌবন
খেলা করছে একটা নারী শরীর নিয়ে।
আমি ভয়ে দূর থেকেই পালিয়ে এলাম ফিরে।
সারারাত রাতের ছবি আঁকতে পারলাম না,
ঘুমোতেও পারলাম না!
ভোর হতেই ছুটে গেলাম আবার সেই শূন্যস্থানে।
সবকিছু আবার ঠিকঠাক…!
পাগলটা আমায় হাত নেড়ে ডেকে বলল,
বললাম, ঘুমোস না! শুনলি না তুইও!
লাসটা খুঁজবি? পাবি না, পাবিনা!
ওরা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে!
রোজ খায়, মুরগি...ছাগল...গরু...নারী!
ভাবলাম পুলিশে জানাই, রাতে জায়গাটা ঘিরে রাখুক,
তবে এর এমন হবে না…
কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ দেব কিসে?
পাগলটার চোখ নাকি আমার গভীর রাতে জেগে থাকার
অহেতুক কারণ?
সারাদিন জেগে থেকে রাতের অপেক্ষা করলাম।
গভীর রাত নামলো ফাঁকা শুনশান গলির শেষের গাছতলায়।
বুকের ভিতর বিষাক্ত ছুরিটা ভরে নিয়ে এগিয়ে
গেলাম সেইখানে।
পাগলটার আগুন চোখ দেখে পথ চিনে চিনে
এগিয়ে গেলাম।
মত্ত মানুষগুলো মদের বোতল আর এক শিশুর নরম শরীরে পৃথিবী খুঁজছিল।
আমাকে দেখতেই পেল না…
আমি পাগলটার বাঁধন খুলে দিয়ে তার হাতে তুলে দিলাম
বিষাক্ত ছুরিটা!
সে তার আগুন চোখ নিয়ে আমার কানে কানে বলল,
জেগে আছে পৃথিবী তবে এখনো?
তারপর একটু একটু করে এগিয়ে গেলো পাগলটা
ওদের দিকে।
ওর জটা বন্ধন লুটিয়ে পড়লো মাটি ছুঁয়ে!
পাগলটা ঝপাঝপ কোপ মারতে লাগলো
থমকানো পৃথিবীর প্রতি ধাপে ধাপে…
মারতেই লাগলো! মারতেই লাগলো!
গলা ফাঁক হয়ে গেল ওদের!
মুন্ডু ছিটকে পড়লো এদিক সেদিক!
মদের বোতল ভেঙে ওদের হাতে বন্দি আহ্নিক গতি
হো হো করে হেসে উঠলো।
আমি অচৈতন্য শিশুটিকে কোলে নিয়ে ফিরে এলাম
শেষ রাতে।
আকাশ থেকে খসে পড়ল তারা।
আমি দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বললাম
পাগলটার চোখে এবার অন্তত ঘুম দাও, ঈশ্বর!
সকালবেলা পুলিশে, জনগণে ছয়লাপ এলাকা।
শিশুটিকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম সেই গলির শেষের স্থানে।
এত চিৎকার, এত হই চই তার মধ্যেও দেখি
সেই অনন্তকাল জেগে থাকা পাগলটা কী ভীষন
ঘুমোচ্ছে!
দুচোখের পাতায় শান্তি, আর ঠোঁটের কোণে
লেগে আছে এক ছোট্ট টগর ফুলের একটা
পাপড়ি।
পুলিশ বলল, দীর্ঘদিন ধরে এদের খুঁজছিলাম আমরা।
নানা জায়গা থেকে শিশু, নারী এদের এনে এনে
ধর্ষণ আর খুন করত এরা,
তারপর বহুদূর, দূরে ফেলে আসত।
পাগলটার চোখের পাতার উপরে কেউ একজন
তুলসি পাতা রেখে দিলো।
অস্থিচর্মসার দেহটা গাড়িতে তুললো পুলিশ,
দাহ সমাধা করবে ওরাই।
তার ঠোঁটের কোণ থেকে টগরের পাপড়িটা খসে পড়ে গেছে।
কিন্তু হাতের ছুরিটা খুলে নিতে পারেনি কেউ!
আমার হাতে ধরা শিশুটি হঠাৎ সকলকে চমকে দিয়ে এগিয়ে গেল পাগলটার দিকে।
তার নোংরা পা দুখানি ছুঁয়ে বলল,
রাজামশাই! রাজামশাই! দেখো
পৃথিবী এখনো জেগে আছে!
____________
28. 09. 2020
বিদ্যাসাগর
সুজান মিঠি
আমার কাছে বিদ্যাসাগর মানে স্ত্রী শিক্ষা, বিদ্যালয়,
বিধবা বিবাহ।
আমার মেয়ের কাছে বিদ্যাসাগর মানে বর্ণপরিচয়,
গোপাল, রাখাল...মাসির কান কামড়ে ধরা ছেলেটা,
আর আমার পাশে এসে ঘ্যানর ঘ্যান, বলো না!
মাসি কেন ছেলেটাকে শাসন করেনি?
আমার কিশোর ছেলের মনে বিদ্যাসাগর মানে প্রশ্ন,
আচ্ছা! বিদ্যাসাগর ছেলেবেলায় রাখাল ছিলেন না,
একদিনও?
তার কাছে বিদ্যাসাগর মানে কার্মাটার রেলস্টেশন,
ডাক্তার বাবুটির কুলি কুলি ডাক, বিদ্যাসাগর মশাইকে
কুলি বানিয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং পরে ভুল বুঝতে পারা।
আমার মায়ের কাছে বিদ্যাসাগর টলটলে ভরা নদী
পার হয়ে ছুটে আসা মাতৃভক্ত পুত্র।
আমার গ্রামের বৃদ্ধ চাষী দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করেন।
তার পিতামহ বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন
দান… তার কাছে বিদ্যাসাগর মানেই ঈশ্বর!
ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ভবিষ্যতের কাছে বিদ্যাসাগর এক মূর্তি ভাঙা
নীরব অধ্যায়, যেন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এখনো
বিচারের আশায়!
যেন তিনি প্রচন্ড অসহায়ের মত তাকিয়ে আছেন
জাতির দিকে, যেন বলছেন... বলো! কী আমার অন্যায়?
নাঃ! এগুলো কোনোটাই বিদ্যাসাগর নন।
সদর্পে সাহেবের সামনে টেবিলের উপর খড়ম পরিহিত
পা দুখানি তুলে ধরা প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্বময় ব্যক্তি,
না তিনিও নন!
বিদ্যাসাগর ঈশ্বরও নন।
তিনি এক বিরাট স্পর্ধা!
তিনি এক বিরাট সাহস!
বিষাক্ত কণ্টকাকীর্ণ ছিল যে স্থান,
সেই স্থানে সবুজ পৃথিবী বানিয়েছেন যিনি...
কুসংস্কারের মুখে ছুঁড়ে মেরেছেন থুক্কার যিনি...
তিনি কোনো ঈশ্বর নন, তিনি কেবল কোনো সংস্কারক নন!
তিনিই বিদ্যাসাগর!
এক বিরাট গনগনে আগুন!
যদি তাঁর সমস্ত মূর্তি কখনো ভেঙে যায়…!
যদি তাঁর সব জন্মদিন মৃত্যুদিন কখনো স্মৃতিভ্রষ্ট হয় ক্যালেন্ডার!
কোনো বিচারের আশায় তিনি তাকিয়ে থাকবেন না…,
ভবিষ্যতের সব শৈশবের আঙুল ধরে পড়তে শেখাবেন আবার…
অ জ...অজ
আ ম...আম।
-------------
25. 09. 2020
তৃতীয় পুরুষ
সুজান মিঠি
মেয়েটির প্রথম পুরুষ কালো চশমার ভিতর থেকে
ভালোবাসি বলেছিল।
তারপর মেয়েটা যখন সেই
চশমার কালোকে কাজল করে পরলো চোখে,
ঠিক তখন মেয়েটির প্রথম পুরুষ বিদেশে
ভেসে গেল প্রতিপত্তি আর বিদেশিনী নিয়ে।
মেয়েটির দ্বিতীয় পুরুষ তার বিবাহিত স্বামী।
এক পুত্রের জন্মের পরেও তাকে
জড়িয়ে ধরতো কারণে অকারণে। স্বপ্নের কাজল
পরিয়ে দিত নিজে, খোঁপায় গুঁজে দিত বেল, জুঁই।
একদিন মেয়েটার খোঁপা খুলে ঝরে গেল সব
শুভ্রতা। মেয়েটার চোখের কাজল ফ্যাকাশে হয়ে
কেমোথেরাপির শেষ আশায় নিভে গেল।
ইলেকট্রিক চুল্লিতে ছাই হয়ে গেল মেয়েটির
দ্বিতীয় পুরুষ।
মেয়েটার বিছানায় স্থান পেল তার তৃতীয় পুরুষ।
দরজা বন্ধ করে মেয়েটা খোঁপায় জুঁই গুঁজলো।
খিলখিল করে হেসে উঠে গান ধরলো,
এই সুরে কাছে দূরে…
দরজায় কান পাতলো পুত্রবধূ,
তারপর একমাত্র পুত্র..
একদিন দুদিন তিনদিন…
দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে মেয়েটাকে চেপে ধরলো
পুত্র, বলো কে এসেছিল ঘরে?
ব্যালকনি দিয়ে পালিয়ে গেলো বুঝি?
মেয়েটা চোখে কাজল লাগিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল
রাস্তায়।
আকাশে পেঁজা মেঘ আর পুজোর রোদ্দুর!
মেয়েটার খোঁপায় সতেজ জুঁই।
গলিতে গলিতে গুঞ্জন...এত বয়স, তাও নিশ্চয়ই...
বুঝেছো তো!
নইলে এমন সাজ, পোশাক…!
মণ্ডপের সামনে মাইক হাতে ঘোষণা করছিল ছেলেটা…
আসুন দশভূজার সামনে আমরা আমাদের কথা
বলি। স্বীকৃতি দিই নিজের, আত্মার।
আজ এই হোক আমাদের উৎসব।
মেয়েটা মাইক হাতে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো
আছে, আছে। আমার তৃতীয় পুরুষ!
সব গলি চুপ হয়ে গেলো।
জানলা দিয়ে ছুটে আসা শব্দেরা মেয়েটার পুত্র আর
পুত্রবধূর কানে প্রবেশ করলো।
বিষ্ময়ে নির্বাক তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা নিজের ঘরে ঢুকে
দরজা বন্ধ করলো।
বিছানার উপর শুয়ে রবীন্দ্রনাথ বুকে জড়িয়ে নিয়ে
বললো, কী গো! তৃতীয় পুরুষ! ভালোবাসো তো,
আমায়?
ইচ্ছে করে!
সুজান মিঠি
খুব ইচ্ছে করে, বুকের ভিতর একটা নদী এনে বসাই।
তারপর তার পাশে শরৎ,
কাশের দোলায় বিকেল গড়াবে!
একটা প্রেমিক প্রেমিকার কপালে এঁকে দেবে
বিশ্বাস!
খুব ইচ্ছে করে, বুকের ভিতর একটা মরুভূমি
তুলে আনি সাহারা কিংবা গোবি থেকে।
তার পাশে রাত,
ঠক ঠক করে কাঁপবে প্রেমিকা ...
হঠাৎ হারিয়ে গিয়ে!
গায়ের পশম খুলে প্রেমিক,
প্রেমিকার চোখে এঁকে দেবে স্নেহ!
খুব ইচ্ছে করে বুকের ভিতর একটা উপন্যাস
লিখে রাখি।
তার প্রত্যেক ছত্রে সুখ,
প্রেমিক প্রেমিকা বিয়ের পরে কাটিয়ে দেবে
সবগুলো বছর ভালোবেসে,
সব আলো নেমে আসবে উপন্যাসের সব শব্দে।
শিশু নির্যাতনে চোখের জল ফেলবে না কেউ,
শিশুটাকে বের করে এনে নির্যাতনের পাতা
ছিঁড়ে টুকরো করে দেবে সব বাক্যেরা!
খুব ইচ্ছে করে, সেই উপন্যাসটার নাম দেব পৃথিবী!
কিন্তু ইচ্ছেপূরণ করার পরমেশ্বর বুকের ভিতর
ইচ্ছে রাখার জায়গাটা বড্ড ছোটো করে দিয়েছেন…
অলিন্দ, নিলয় আর ছুটন্ত রক্তে ভর্তি সে ঘর!
নিজেই বেঁচে থাকার জন্য সে এমন ছুটোছুটি করে যে,
ইচ্ছেগুলো বন্দী হয়ে যায় ভার্চুয়ালে!
কেবল ঘুমের মধ্যে বালিশে এসে বসে এক ছায়া।
কানের পাশে মুখ নামিয়ে বলে, এত বড় আকাশ
পেলি মাথায়, এত মাটি পায়ে…
তবুও দোষারোপ করিস, আমায়!
তেত্রিশটা ওষুধ
সুজান মিঠি
গুনে গুনে তেত্রিশটা ওষুধ জলে গুললাম।
ডায়েরির পাতায় কলম ঠেকিয়ে লিখে চললাম
দুঃখ, অভিযোগ, হতাশা, অভিমান…
স্বামীর বহুগামিতা, গরীব বাবা মায়ের অভাব,
কন্যা সন্তান হওয়ার খোঁটা…
এত কিছু থেকে মুক্তির জন্য তেত্রিশটা
ওষুধ যথেষ্ট!
অনেকদিন ধরে একটু একটু করে জমিয়ে রেখেছিলাম
এগুলো, আজ জলে দিলাম।
লিখলাম আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী এই তেত্রিশটা ওষুধ।
লিখলাম, আমি না থাকলে নিশ্চই তুমি আমার জন্য
কষ্ট পাবে, আর মেয়েটাকে ভালোবাসবে…
লিখলাম, ঢকঢক করে গ্লাস শেষ করে ফেললাম আমি,
আমার তৃষিত বুকে এবার শান্তি নামবে…।
কলম থামালাম। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করলাম শুয়ে।
কিন্তু একটু পরেই বুকে প্রবল চাপ শুরু হলো!
সারা শরীর বুক পেট কী ভয়ঙ্কর জ্বালা করতে লাগলো!
শরীরের সব স্নায়ু ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো!
তারপর দুটো চোখ জুড়ে গেল ঘুমে।
অনেক পরে ঘুম ভাঙলো আমার। প্রথমে ভাবলাম
তেত্রিশটা ওষুধেও বুঝি কিছুই হয়নি!
আবার হয়তো জোগাড় করতে হবে তেত্রিশ দুগুনে ছেষট্টিটা।
কিন্তু একটু পরেই ভুল ভাঙলো।
ফুরফুর করে উড়ছে আমার শরীর, কোথাও কোনো
ব্যাথা নেই, যন্ত্রণা নেই,
আর আমার সামনে আমার শরীরটাকে
পুড়িয়ে দিচ্ছে ওরা সবাই মিলে।
আমার গা ভেসে ধোঁয়া হয়ে মিশে যাচ্ছে বাতাসে।
আমার স্বামীর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
শ্বশুর মশাই আমার গরীব বাবার হাতে গুঁজে দিচ্ছে টাকা।
আমার বাচ্চাটা এক নাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে,
কেউ ওকে কোলে নিচ্ছে না!
কেউ ওকে ভোলাচ্ছে না!
রাত দশটা বাজে, ওকে কেউ খাইয়ে পর্যন্ত দেয়নি এখনো!
না না ওই তো পাড়ার রানু কাকিমা...
ওর জন্য খাবার এনেছে,
ওকে খাওয়াচ্ছে!
কিন্তু ও খাবারটা তো ঝাল কাকিমা!
ওতো ঝাল খেতে পারে না!
কাকিমা ওকে বকছে, ও কাঁদছে তাই ওকে খাওয়ালো না
আর!
ও কাকিমা, ওর রাতে খিদে পাবে যে!
আহা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল মেঝেয় শুয়ে সোনা
আমার!
আমার লেখা ডায়েরির পাতাটা উড়ে গিয়ে ডাস্টবিনে
পড়লো।
আমাকে কেউ মনে রাখলো না!
আমায় বাতাস ডাকে, আয় খেলি,
আমাকে আকাশ ডাকে, মেঘ হবি?
আমাকে আমার মেয়ে ডাকে, ও মা! কোলে নাও না!
আমি ঈশ্বরকে ডাকি, ঠাকুর আর একবার শরীর দাও আমার!
আর কখনো এমন করবো না, আর কখনো নয়!
আমার মেয়েটাকে যে কেউ দেখে না!
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার স্বামী আমার বেনারসি
পরিয়ে নতুন বউ নিয়ে এলো।
আমার মেয়েকে শাশুড়ি তার কোলে দিয়ে বললো,
নাও এ আপদ এবার থেকে তোমার!
আমি বাঁচি একটু হাত পা ছড়িয়ে!
আমি চিৎকার করছি! আমি কাঁদছি!
আমি রাগে জ্বলছি! আমি আগুন হতে চাইছি!
কিছুতেই পারছি না!
আমার স্বামী মেয়েকে মেঝেয় শুইয়ে
নতুন বউয়ের গায়ে আঁকছে সোহাগ,
মাখছে সুখ!
আমার মেয়ে নতুন মায়ের আঁচল টেনে বলছে,
আমার মা এনে দাও না!
ওরে সোনা! আমি এখানে রে বাবা!
এই দেখ!
আরো বছর খানেক পরে আমার স্বামীর বউ
পোয়াতি হলো, তারপর ফুটফুটে ছেলে হলো
তার।
একদিন আমার মেয়েটা খেলতে গিয়ে সেই
ছেলের চোখে আঙুল দিয়ে ফেললো।
মেয়েটাকে ওরা কত মারলো! কত মারলো!
আমি শরীর ছাড়া শুধু মন নিয়ে, শুধু আফসোস নিয়ে
শুধুই দেখে গেলাম।
একদিন দুপুরে আমার স্বামীর নতুন বউ
জলের গেলাসে ওষুধ মেশালো।
আমি এবার ভীষণ চিৎকার করলাম…
না! না! এটা কোরো না তুমি!
ওকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দাও!
ওকে মেরো না!
ওকে মেরো না!
ওই ওষুধ পেটে যাওয়ার পরে কী ভয়ংকর যন্ত্রণা
তা আমি জানি!
ওইটুকু বাচ্চাকে তোমরা সে যন্ত্রণা দিও না!
নতুন বউ আমার কথা শুনতেই পেলো না।
গুনে গুনে তেত্রিশটা ওষুধ মেশালো জলে!
-------------------
19. 09. 2020
আলোর চিঠি
সুজাতা মিশ্র(সুজান মিঠি)
ছেলেবেলায় তোমার গায়ের গন্ধটাকে আঁকড়ে ধরতাম
ঘুমের ঘোরে।
বলতাম,মাগো! তুমি খুব সুন্দর!
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো দিয়ে বলতে
'হয়েছে, নে ঘুমো এবার, অনেক রাত…'
আমি হেসে উঠতাম জোরে, ও মা! মাগো! আমার আবার
রাত!
বাবা চাপা গম্ভীর কণ্ঠে বলতো, 'আহঃ, খুকু! ঘুমোতে দাও।'
তুমি স্নান করে পিঠে ভিজে চুল মেলে যখন পুজোর থালা
নিয়ে আসতে ঠাকুর ঘর থেকে;
আমি তোমার গায়ে তখন দেবীর গন্ধ পেতাম।
মনে মনে প্রণাম করতাম ঠিক তখন তোমায়, রোজ।
তুমি তখন ব্যস্ত ভীষণ, বাবার অফিস, কাকুর কলেজ
রান্না টিফিন স্নানের জল সব তুমি একা করতে একা,
আমি চুপ করে বসে থাকতাম তোমার অপেক্ষায়।
বাড়িতে আর কেউ চায়নি আমি পড়ালেখা শিখি
কত ঠান্ডা যুদ্ধকে সামাল দিয়ে তবে তুমি পেরেছিলে
আমার হাতে অক্ষর তুলে দিতে।
আমি অক্ষর গুলো সাজিয়ে সাজিয়ে এরপর শিখলাম
মালা তৈরি করতে।
তুমি তখন কী ভীষণ খুশি হয়েছিলে।
বাবা সেই গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল,' ঠিক আছে, এত নাটক
কোরো না এরপর।
জন্ম তো দিয়েছো একটা…'
আমার মুখটা বোধহয় দেখতে পেত, আর তারপর বাবা
থেমে যেত।
তুমি মুখে আঁচল চেপে বেরিয়ে যেতে ঘর থেকে।
পায়ের শব্দে কান্না শুনতে পেতাম আমি।
আমি একা একা কলতলা যেতে পারতাম।
আমি একা একা জামা বদলাতে পারতাম।
আমি একা একা শব্দের অর্থ বুঝতে পারতাম।
আমার কাকুর বন্ধুর পায়ের আওয়াজে বুঝেছিলাম
একা একা লড়াই করতে হবে এইবার।
কাঁধের উপর থেকে তার হাতটা ঝিনকে দিয়ে বলেছিলাম
আমি কিন্তু লোভ দেখতে পাই।
আমি কিন্তু জিভ দেখতে পাই।
কাকু তোমাকে ভীষণ অপমান করেছিল।
তোমার কোনো কথা শুনছিল না মা,
ঠিক তখন বাবার পায়ের শব্দে এক জোরালো আশ্বাস
শুনেছিলাম প্রথম বারের মত,
কাকুর গালে ঠাস করে চড় দিয়ে বলেছিল,
'এরপর কোনো বন্ধু আনলে ঘাড় ধরে বের করে দেব পথে।'
তারপর কত বর্ষা দেখেছি জানলার পাশে বসে তার শব্দে
কত বসন্ত কোকিলের কণ্ঠে বলে পাঠিয়েছে আমায়
…'ওই শোনো, বসন্ত এসে গেছে।'
তুমি গ্রীষ্মের দুপুরে গুনগুন করে গাইতে রবীন্দ্রনাথ।
আমায় বলতে, 'খুকু, ওই গানটা কর না একবার।'
আমি তোমার গন্ধে তখন মনখারাপ দেখতে পেতাম
'তুমি রবে নীরবে' গাওয়া শেষ হলে বুঝতে পারতাম
তোমার চোখের নিচ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে
ফেলে আসা জীবনের মনখারাপ।
মাগো, তোমার মনখারাপদের গন্ধও যে আমার বড্ড চেনা,
বড্ড চেনা।
গন্ধ নিয়ে অনুভূতিদের যত্ন করে জমা করে রাখতাম টেবিলের ড্রয়ারে।
হঠাৎ সেদিন আমাদের বাড়িতে এক নতুন শব্দ পেলাম।
নতুন গন্ধ।
কেমন যেন অবশ করে দেওয়ার মত।
ঘরের ভিতর থেকে তোমায় ডাকলাম জোরে,
মা কে এসেছে?
তুমি কাছে এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলে,
'তোর বাবার অফিসে কাজ করে, বাবার কাছেই এসেছে।'
পাশের ঘর থেকে শুনতে পেলাম বাবা তাকে বলছে
'আমার ওই একটাই মেয়ে, কী বলব আর
জন্ম থেকেই ওই...
তবে অনেক পড়াশোনা করেছে।
কত সব লেখে টেকে, কই গো যাও না নিয়ে এসো।'
তারপরের গন্ধগুলো ধীরে ধীরে তোমাদের অজান্তে
আমার ভীষণ চেনা হয়ে গেল।
মাগো, আমি ওই চেনা গন্ধের হাত ধরে চলে এসেছি।
ও আমায় বুঝিয়েছে,
যে নদীর গভীরতা বেশি, তার বয়ে যাওয়ার আওয়াজ
তত কম।
ও আমায় বুঝিয়েছে… আমি গভীর নদী।
আমি গভীর নদী।
আমার বুকে নাকি অসীম পূর্ণতা!
জানি, বাবা হয়তো খুব রেগে গেছে আমার উপর।
তার একমাত্র মেয়ে সে অন্ধ হয়েও জাত্যাভিমান ভাঙার
মত অপরাধ করেছে যে!
মাগো, বাবা কাকু ওরা আমার মুখ আর হয়তো দেখবে না
কিন্তু তোমার ঐ পুরানো মনখারাপের গন্ধে কি
একটুও আনন্দ যোগ হয়নি মা?
তুমি কি খুশি হওনি?
ও আমাকে ওর রানীর মত রেখেছে।
আমার সামনে বসে হাত ধরে ধরে সব রং চিনিয়েছে।
কিন্তু মাঝরাত্তিরের সেই সুন্দর মা মা গন্ধটাকে
খুব ফিরে পেতে ইচ্ছে করে মা।
মাগো, তোমার অন্ধ মেয়ের সুখ নিজের চোখে
দেখে যাবে না মা?
ও মা! নিজের চোখে অন্ধ মেয়ের আলোর দৃষ্টি দেখবে না?
মাগো, ও মা! তুমি অন্ধ মেয়ের আলোর চোখ দেখবে না?
---------------
16. 12. 2019
No comments:
Post a Comment