Sunday, August 29, 2021

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

  

দৃশ্যের বাহিরে – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সিতাংশু, আমাকে তুই যতো কিছু বলতে চাস, বল।
যতো কথা বলতে চাস, বল।
অথবা একটাও কথা বলিসনে, তুই
বলতে দে আমাকে তোর কথা।
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।
কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
ঘরের ভিতরে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।
(সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।)
কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
দৃশ্যের সংসার থেকে তুই
(সংসারের যাবতীয় অস্থির দৃশ্যের থেকে তুই)
স্থিরতর কোনো-এক দৃশ্যে যেতে গিয়ে
গিয়েছিস স্থির এক দৃশ্যহীনতায়।
অনন্ত রাত্রির ঠাণ্ডা নিদারুণ দৃশ্যহীনতায়।
দৃশ্যের বাহিরে তোর ঘরে।
জানিরে, সিতাংশু, তোর ঘরের চরিত্র আমি জানি।
ওখানে অনেক কষ্টে শোয়া চলে, কোনোক্রমে দাঁড়ানো চলে না।
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
মাথার দু’ইঞ্চি মাত্র উর্ধ্বে ছাত। মেঝে
স্যাঁতস্যাঁতে। দরোজা নেই। একটাও দরোজা নেই। তোর
চারদিকে কাঠের দেয়াল।
এবং দেয়ালে নেই ঈশ্বরের ছবি।
এবং দেয়ালে নেই শয়তানের ছবি।
(তা যদি থাকত, তবে ঈশ্বরের ছবির অভাব
ভুলে যাওয়া যেত।) নেই, তা-ও নেই তোর
নির্বিকার ঘরের ভিতরে।
না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।
যাব না, সিতাংশু, আমি কিছুতে যাব না।
যেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শয়তান নেই, কোনো-কিছু নেই,
প্রেম নেই, ঘৃণা নেই, সেখানে যাবো না।
যাব না, যেহেতু আমি মূর্তিহীন ঈশ্বরের থেকে
দৃশ্যমান শয়তানের মুখশ্রী এখনো ভালোবাসি।
না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।
সিতাংশু, তুই-ই বা কেন গেলি ?
অস্থির দৃশ্যের থেকে কেন গেলি তুই
স্থির নির্বিকার ওই দৃশ্যহীনতায় ?
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।
দৃশ্যের ভিতর থেকে দৃশ্যের বাহিরে
প্রেম-ঘৃণা-রক্ত থেকে প্রেম-ঘৃণা-রক্তের বাহিরে
গিয়ে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।





অমলকান্তি
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী--

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।




মল্লিকার মৃতদেহ
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। দেখেছি, উদ্যান
বড় শান্ত ভূমি নয়। উদ্যানের গভীর ভিতরে
ফুলে-ফুলে
তরুতে-তরুতে
লতায়-পাতায়
ভীষণ চক্রান্ত চলে; চক্ষের নিমেষে খুন রক্তপাত
নিঃশব্দে সমাধা হয়। উদ্যানের গভীর ভিতরে
যত না সৌন্দর্য, তার দশ গুণ বিভীষিকা।

উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। সেখানে কখনও
কেহ যেন শান্তির সন্ধানে আর নাহি যায়।
যাওয়া অর্থহীন; তার কারণ সেখানে
কিছু ফুল
নিতান্ত নিরীহ বটে, কিন্তু বাদবাকি
ফুলেরা হিংসুক বড়, আত্মরূপরটনায় তারা
যেমন উৎসাহী, তত বলবান, হত্যাপরায়ণ।

উদ্যানে গিয়েছি আমি বারবার। সেখানে রূপের
অহঙ্কার ক্ষমাহীন। সেখানে রঙের
দাঙ্গায় নিহত হয় শত-শত দুর্বল কুসুম।
আজ প্রত্যুষেই আমি উদ্যানের বিখ্যাত ভিতরে
মল্লিকার মৃতদেহ দেখতে পেয়েছি।
চক্ষু বিস্ফোরিত, দেহ ছিন্নভিন্ন, বুক
তখনও কি উষ্ণ ছিল মল্লিকার?
কার নখরের চিহ্ন মল্লিকার বুকে ছিল,
কে হত্যা করেছে তাকে, কিছুই জানি না।
কিন্তু গোপালের লতা অতখানি এগিয়ে তখন
পথের উপরে কেন ঝুঁকে ছিল?
এবং রঙ্গন কেন আমাকে দেখেই
অত্যন্ত নীরবে
হঠাৎ ফিরিয়ে নিল মুখ?

আমার বাগানে আরও কতগুলি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে?




 

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?




কবির মূর্তির পাদদেশে
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী---সময় বড় কম

কবিকে তারাই বানিয়ে তুলেছিল, এই
ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে
তারা এখন
ছেনি ও হাতুড়ি নিয়ে
কবির মূর্তির পাদদেশে এসে দাঁড়িয়েছে।

ভাদ্রমাস ফুরিয়ে আসছে।
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাবার পরে টলটলে নীল আকাশকে এখন
সমুদ্র বলে ভ্রম হয়।
কিন্তু ঠিক এই সময়েই নীচের মাটিতে জমেছে তাদের
ভ্রান্তির খেলা।

কবি যে তাদের হুকুম মানতে রাজি হয়নি,
তাঁর এই অমার্জনীয় অপরাধের
শাস্তি হিসেবে
তারা বলছে, “আমরাই তাঁকে বানিয়েছিলুম, এখন
আমরাই তাঁকে ভাঙব।”

কিন্তু, তারা যদি না-ই বানাবে, তবে
কে বানিয়েছিল এই কবিবে?
বানিয়েছিল তাঁরই সময়।
তাঁরই প্রস্তুতিপর্বের নিরন্তর ব্যর্থতা ও গ্লানি,
অপমান ও যন্ত্রণা।

আজ যারা তাঁর মূর্তি ভাঙবার জন্যে
হাতুড়ি তুলেছে,
প্রাতিষ্ঠানিক সেইসব বর্বরের
অন্তহীন প্রতিরোধ ও ধিক্কারও অন্তত খানিক পরিমাণে তাঁকে
তৈরী করে তুলেছিল।

মূর্তির পাদদেশে দাঁড়িয়ে তারা আজ আস্ফালন করছে।
কিন্তু তাদের জানা নেই যে,
তাদের অনিচ্ছার আগুনে ঢালাই হয়ে
তৈরী হয়েছে ওই মূর্তি।
কোনো হাতুড়িই ওই মূর্তিকে আর এখন ভাঙতে পারবে না।


























প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...