গুপ্তধন
পুরোনো আলমারিটা রয়েছে ঘরের কোণে
কতকাল কেউ জানে না এতদিন কেই বা গোনে
বর্মার সেগুন কাঠে হাতি আর বাঘ-থাবাতে
দেখলেই ধন্দ লাগে কারুকাজ এমন তাতে
কারুকাজ দারুন তাতে …
ভিতরে বোঝাই করা কি যেন পুঁথির গাদা
যতদিন ছিলেন বেঁচে আমাদের ঠাকুরদাদা
নিকেলের চশমা চোখে মাঝে মাঝে মন দিয়ে কি
দেখতেন গভীরভাবে আমরা তো ছাই বুঝেছি !!
তা তিনি সগ্গে গ্যাছেন….
তা তিনি সগ্গে গ্যাছেন আজ প্রায় দুযুগ হলো
চাবি দেওয়া আলমারিটা থেকে শুধু জমছে ধুলো
কেবলই জমছে ধুলো…
গৃহিনী বলেন সেদিন এ আবার কেমনতরো
জঞ্ঝাল জমিয়ে রাখা? এখনই বিদেয় করো
এ আপদ বিদেয় করো …
কথাটা ধরলো মনে কাজ কি হুলুস্থুলে
লেগে যাই সাফাই কাজে ধুলো ঝেড়ে পাল্লা খুলে
(গৃহিনী গররাজি , তাই
কাজ নেই হুলুস্থুলে!) …
ওদিকে টিপ্পনি হয়..
ওদিকে টিপ্পনি হয় দেখে নাও পেতেও পারো
সন্ধান গুপ্তধনের যাই হোক জলদি সারো
খদ্দের নাই যদি পাও বেচে দাও কিলোর দরে
বুজলাম আলমারিটার আয়ু আর নেই এঘরে !!
দেরাজে হাতড়ে দেখি ভিতরে চশমাজোড়া
মোটা কাঁচ, হালকা ডাঁটি ছোট রং নিকেল মোড়া
কি ভেবে চোখে দিতেই ঘটে গেলো ভোজের বাজি
বাড়ি ঘর রাস্তা উধাও জানি না কি কারসাজি
নিমেষে আলমারিটা খোলা এক জানলা হয়ে
অপরূপ দৃশ একি নয়নে অানল বয়ে
একোথায় এলাম আমি !..
একোথায় এলাম আমি শহরের বৃত্ত থেকে
বনতল পাতায় ছাওয়া মেঠোপথ চলছে বেঁকে
ছোটো ছোটো মাটির বাড়ি ধানক্ষেত যাচ্ছে দেখা
গোলাভরা সোনাধানে অনাবিল শান্তি লেখা !!
আলবেয়ে আসছে কে ও ?…
আলবেয়ে আসছে কে ও গায়ে ঘাম দুপায় কাদা
মুখে হাসি রহস্যময় অরে ! এ যে ঠাকুদাদা
“এতদিনে সময় হলো ? দাদুভাই পড়লো মনে ?”
শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো সুমধুর সম্বোধনে !
‘ঘুরে দ্যাখ দেশের ভিটে খোড়ো ঘর মাটির পোতা
যেখানেই যাস না কেন বুকে এর শিকড় পোঁতা
মাটি-জল-বাতাস নিয়েই এসেছিস এই দুনিয়ায়
এ ছেড়ে মাতবি কেন পিশাচের দৌড় খেলায় ?
ছিঁড়ে ফেল সোনার শিকল খুঁজে দ্যাখ রত্ন পাবি
চোখে মন-চশমা দিলাম হাতে ওই সুখের চাবি
আমাকেও বাপি পিতেমো সঁপেছেন এমনি করে
ফিরে তাই দিলাম তোকে আগলাস আঁকড়ে ধরে !!
— এ বলেই মিলিয়ে গেলেন …
এ বলেই মিলিয়ে গেলেন দেখি যেন নেশার ঝোঁকে
এক ঘরে দাঁড়িয়ে আছি, চাবি হাতে চশমা চোখে
খোলা হাট আলমারিটা হাসে যেন ফোকলা দাঁতে
দুহাতে যত্ন করে চাবি এঁটে দিলাম তাতে !!
কখনোই বেচবো না তা কখনোই বেচবো না তা
বোকা বলে বলুক যে জন আমি জানি এর ভিতরে
পেয়েছি কি গুপ্তধন !!
রাখহরি – আল্লারাখা
আমার ঘরের বাঁয়ে থাকেন রাখহরি
ডান দিকের পড়শি আমার আল্লারাখা
কেউ বলতো একই বৃন্তে দুটি কুসুম
কেউ বলতো একই গাছের দুটি শাখা !
রাখহরি মজুর ছিল কারখানাতে
আল্লারাখা খিদিরপুরে জাহাজঘাটে
হপ্তা যা পায় , মোটামুটি দিন চলে যায়
দুঃখে-সুখে দুজনারই সময় কাটে!
মাঝখানে যে আমি , ওহো ভুলেই গেছি !
ধর্ম বা জাত কী যে আমার কেউ জানেনা
রাখহরি, আল্লারাখা ভেবেই মোর
আমার নিরেট অবস্থাটা কেউ মানেনা !
আল্লারাখা শুধোয় চাচা, খোদায় ডরাও ?
আমি বলি খোদা তো নয় খিদেয় ডরাই
এর চে’ বড়ো শত্রু আর নেই এ দেশে
তার বিরুদ্ধে আমার জেহাদ জানের লড়াই !
রাখহরি বলে - দাদা বাক্যি রাখো
কষ্ট যা পাই সবই আগের জন্মপাপে
ইহকালে হরিনামের জপ না নিলে
পরকালে পুড়তে হবে মনস্তাপে
হেসেই বলি, তোমার হরি মাথায় থাকুন
পাপের বোঝা চাপিয়ে দাও আমার ঘাড়ে
তোমার মতো ভক্তজনের বইলে বোঝা
এতোও যদি আমার কিছু পুণ্যি বাড়ে !
এভাবে দিন চলছিল বেশ হটাৎ সে' দিন
হিসহিসিয়ে সাপের মতন গুজব ছড়ায়
পিরসাহেবের মাজারে এক মরা শুয়োর
মরা গরুর শিং পড়েছে বামুনপাড়ায় !
ছড়িয়ে গেলো দাঙ্গা দাবানলের মতন !
আল্লারাখা লাফিয়ে এলো সড়কি হাতে
রাখহরির তেলপাকা এক বাঁশের লাঠি
ভাঁটার মতো ঘুরছে দুচোখ রাগের তাতে !
দুহাত ধরে বোঝাই ওদের – হচ্ছেটা কি ?
যাচিয়ে দেখো এসব খবর সত্যি কিনা
আল্লারাখা বললো – কাফের হঠ যা অভি !
ম্লেচ্ছ ! চেঁচায় রাখহরি, আর ছুঁবি না !
রক্তগঙ্গা বইলো আমার চোখের আগে
জখম হয়ে জ্ঞান হারালাম পথের ধরে
ততক্ষনে ওরাও দুজন ভূতলশায়ী
পরস্পরের সড়কি আর লাঠির মারে !
কার যে রক্তে সেদিন ভিজলো জমি
হিসেবে তো নেই, দুটোই যে লাল – আর যা জানি
রাখহরি করেছিল জলের তোরে
আল্লারাখা চাইছিলো এক আঁজলা পানি !
বহু বছর লাগলো আমার ঘা শুকোতে
দেহেরটা নয়, মনের ঘা-টাই আসল দাগা
ঘর যে যাই এ ইচ্ছেটাও আর ছিল না
ফিরবো কোথায় ? ঘর যে আমার আগুন লাগা !
তবু সেদিন চাইলো কি মন, গেলাম ফিরে
আকাশটা নীল, অলস দুপুর — ওই সে পাড়া
উড়ছে ফড়িং, কোথাও গ্লানির চিহ্ন তো নেই
ইতস্তত ভাঙা বাড়ির দেওয়াল ছাড়া !
আমবাগানটা তেমনি আছে, শীতল ছায়া
গাছের নীচে কুড়িয়ে রাখা আমের ঝুড়ি
টলটলে জল তালপুকুরের পাড় ডিঙিয়ে
কাদের দুটো দস্যি ছেলে ওড়ায় ঘুড়ি !
হঠাৎ যেন বাজের মতন চমকে দিয়ে
এক নিমেষে উধাও হলো মনের ধোঁকা
সুতো টানছে আল্লারাখার ছেলে করিম
লাটাই গুটায় কানাই, — রাখহরির খোকা !