"যদি প্রেম"
কেষ্ট মন্ডল(01/08/20)
ব্রিজের অনিশ্চিত ছাদের নিচেও
সুখের নিশ্চিন্ত সংসার পাতা যায়-
যদি প্রেমটা গভীর হয়।
যদি প্রেম গভীর হয়-
তবে অগভীর জীবন থেকেও
তুলে আনা যায় ভালোবাসার
একশ আট নীল-পদ্ম।
তুলে আনা যায় মুক্তো গর্ভের ঝিনুক।
হাজার না-পাওয়ার মাঝেও
সব পাওয়া হয়ে যায়,
যদি প্রেম দিয়ে হৃদয় ভাসিত হয়।
যদি প্রেম প্রেরণার হয় -
বর্ষার বেদনা আর গ্রীষ্মের দহন,
অনায়াসে হাসি মুখে বওয়া যায়-
একসাথে ভাগাভাগি আলিঙ্গনে।
খোলা জানালার দখিনা বাতাস
অভিজাত-গন্ধ বয়ে নাইবা আনুক,
পড়ন্ত বেলায় দলিত সূর্যের
লোহিত রেণু মেখে,
স্ত্রীর খোঁপায় মলিন ফুল গুঁজেও
ভালোবাসা যায় অমলিন সুখে,
যদি প্রেমটা হৃদয়ের হয়।
যদি প্রেম সত্য হয়-
তবে রুগ্ন পৃথিবীর বুকে
সব ফুল রঙ হয়ে ফুটে ওঠে
জীবনের ত্রি-সীমায়।
প্রেমের পুজো শুধু প্রেম দিয়েই হয়
প্রেমই হয় তার প্রসাদ।
হৃদয় শুধু প্রেমের উপাচার।
আর প্রেম যদি না থাকে প্রেমে
তবে গাড়ি,বাড়ি,বৈভবের বিলাসিতা
এক সময় সুখের অসুখে কাতরায়
নিঃসঙ্গ রাতে।
ভাবের অভাবে প্রেম কলুষিত হয় বারংবার।
অভাবের ভাবে কখনো নয়-
যদি প্রেম হৃদয়ের হয়।
------:------
"মা"
কেষ্ট মণ্ডল (২৯/১২/১৮)
আমার বাড়ির দক্ষিণে যে উঠোন খোলা বাড়ি।
সে বাড়ির আঠারো বছরের ছেলেটাকে,
কতবার দেখেছি
কোনো আবেগের আনন্দে,
বা,হৃদয়ের কোনো অজানা বিস্ফোরণে,
মায়ের স্নিগ্ধ আঁচলের শীতলতায়
চির শান্তির আশ্রয় খুঁজে নিতে;
সকল ব্যথা গলে যায় যে অভয় আশ্রয়ে।
কতোবার দেখেছি মা-কে,
ছেলের টিউশন থেকে ফিরতে দেরী হলে,
বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে
অধীর অপেক্ষায় পথের বাঁকে চেয়ে থাকতে।
কোনো শীতের উত্তাপহীন রোদ গায়ে মাখতে
যখন উত্তরে এসে বসি;
তখন দেখি অন্য এক সৃষ্টি-বিপন্ন দৃশ্য।
দিনের আলোতেও যা-
অন্তরে নামায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
বাচ্চাটার কত বয়স-
মোটে ন' বছর।
বছর দুয়েক আগেই মাকে হারিয়েছে
বিষাক্ত ক্যানসারের নির্দয় গ্রাসে।
এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই
বাবা আবার বিয়ে করেছিল।
সবাই ভেবেছিল বাচ্চাটা আবার মা পাবে।
একটা নারীর অভাব আর একটা নারীরই
পূরণ করতে পারে।
নারীর অভাব নারী দিয়েই পূরণ হয়,
কিন্তু মায়ের অভাব অন্য মা তে পূরণ হয় না কোনোদিনই।
নবাগতা মা বারবার অস্বীকার করেছে
পরের সন্তানকে।
বাবাও পুরনোকে ভুলে গেছে নতুন স্ত্রীর ঝোঁকে।
কিন্তু নয় বছরের বাচ্ছা,
সে এখনো ভুলতে পারেনি তার মায়ের মুখ।
ভুলতে পারেনি মায়ের বুকের গন্ধ।
তার পরিত্যক্ত ছেঁড়া শাড়ির ভাঁজে,
গন্ধ শোঁকে মুখ গুঁজে।
কখনো ওই শাড়ি ছুঁয়ে নরম হাতে
স্পর্শ খোঁজে মায়ের।
এখনো এঘর থেকে ওঘর,বারান্দা থেকে কলঘর
ঘুরে বেড়ায় তার মায়ের অলীক সন্ধানে।
না পেয়ে ছোট অবসন্ন হৃদয়,
অশ্রুরুদ্ধ অভিযোগে মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠে
একটা ব্যর্থ নালিশে-------
"আমি এবার মায়ের কাছে যাব বাবা!
তুমি যে বলেছিলে দুদিন পরেই মা ফিরে আসবে
কত দিন হলো এখনো কেন এল না?"
প্রতিদিন পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে
সন্ধ্যায় কোনো উজ্জ্বল তারার দিকে।
তার মা সেখানেই নাকি আছে,
তারার আলোর সাথে আলোর দিশারী হয়ে মিশে।
ফেরার অপেক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত গোনে সে।
দুবছর আগে মা তাকে
আদর-মাখা জলে স্নান করিয়ে
বাম পাশে সিঁথি দিয়ে চুল আঁচরে দিত।
পিঠে বই এর ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে পাঠাত।
তখন ক্ষিদে ছিল কম,
খাওয়ানোর ছলনা ছিল বেশি।
এখন খিদে পায় বেশি,শুধু ছলনাটা আর নেই।
যে নরম শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরলে
শাড়ির আঁচলে মুছে যেত নিমেষই।
আর আজ সেই জল নামে
নোনা হয়ে চোখের কোণ বেয়ে,সাদা দাগ কেটে।
শুধু নিজেকেই মুছে নিতে হয় উল্টো হাতে।
একটা অনির্বাণ মায়ার
চির প্রজ্বলিত দীপের সেই অম্লান শিখা
আজ আকাশের অন্তহীন দূরত্বের
কোনো তারাদের মাঝে বিলীন হয়ে আছে।
মা-ছেলের আঙিনা ভরা অট্টহাস্য
এখন ভ'রে গেছে শৈশবের কান্নায়।
হে মাতৃরুপিনী নারী,
তোমার এক হাতে শোভিত
সকল অশুভ শক্তির পরাভূত মুণ্ড,
আর অন্যহাতে থাকে বরাভয়ের আশীর্বাদ।
তবে এ কোন্ মা তুমি!
যার মধ্যে মাতৃশক্তির পূর্ণতা নেই।
অন্তরে অসহায় শিশুর কান্নার আলোড়ন নেই।
একটা বিষাদের বিস্বাদ লবণাক্ত ঢেউয়ে
হৃদয় পুড়ে যায় আমার।
মনে হয় ছুটে গিয়ে নিয়ে আসি তাকে নিজের কাছে।
আদরে,যত্নে তার বর্ণহীন ছেলেবেলাকে,
বর্ণময় ক'রে তুলি আবার।
ছোট হৃদয়ের সাধটা বড়ো কিন্তু সাধ্যটা কম।
মনে পড়ে আমার স্ত্রীর মুখটা-
সেও অন্য কারোর মা!
কোনো মা-মরা বাচ্চার
মা হতে পারবে কি কখনো,কোনোদিন??
--------ঃ--------
"আমি ধর্ম মানি না"
কেষ্ট মন্ডল(04/07/20)
হ্যাঁ,তুমি বলেছ, "ধর্ম মানি না"
চিৎকার করে বলেছ -
"ধর্মের সুতো-বাঁধা কোনো আচার মানি না।
ধর্ম শুধুই আফিংএর নেশা"
আকৃষ্ট হয়ে,ভালোবেসে ছিলাম তোমাকে,
ভালোবেসে ছিলাম তোমার আদর্শকে...
সেই তুমিই আবার
চুলের মাঝে সিঁথি বরাবর সিঁদুর টেনে
মন রেখেছ সংসারে।
হাত ভরিয়ে রেখেছ শাঁখা-পলার ঝংকারে।
অথবা,
গ্রীষ্মের গনগনে আঁচে বোরখা পরে
ভিতরে ভিতরে জীবন্ত সিদ্ধ হয়েছ প্রথা মেনে।
তবুও বলেছ-"আমি কোন ধর্ম মানি না,
মানি না কোন ধর্মের আচার।"
সভায় তোমার বক্তৃতা মুগ্ধ করতো আমাকে।
তোমার কথাগুলো বারবার অনুরণিত হতো
আমার সহজ মনের গভীরে।
মনুবাদ আর জাতি-বর্ণ-কাস্টের
বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তোমার কলম।
কিন্তু দেখলাম... তুমিও,
তুমিও পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে,
বড়ো বড়ো হরফে ছেপেছ তোমার
গোত্র,বর্ণ,জাতির পরিচয়।
চেয়েছ স্ব-ধর্মের ফর্সা সুন্দরী রমণী।
দেখলাম,
শুভ দিন,শুভ লগ্ন দেখে
অগ্নিকে সাক্ষী ক'রে
"যদিদং হৃদয়ং মম
তদুস্তু হৃদয়ং তব"-
চিরাচরিত সেই বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত ক'রে-
অভীষ্ট হৃদয়কে নিজের হৃদয়ে
অঙ্গীভূত ক'রে অধিকার চেয়েছ,
তার শরীর-মন -প্রাণ আর ধর্মের।
"লজ্জানাং নারীনাং ভূষণম"
সেই শাশ্বত বাণী মনের দেওয়ালে টাঙিয়ে
লজ্জার ঘোমটা টেনেছ ছাতনা তলায়।
শাস্ত্রের বিধি মেনে সন্তানের অন্নপ্রাশন
করেছ নাপিত,পুরোহিত ডেকে।
অথবা,
সন্তানের খৎনা করেছ আর
নিষ্পাপ অঙ্গচ্ছেদের তীব্র জ্বালা মিটিয়েছ,
ধর্মের উপশম দিয়ে।
তবু এখনো তুমি রাস্তায় রাস্তায় বলছ-
"আমি ধর্ম মানি না,আমি জাত মানি না"
দেখেছি, তোমার বাবা
যেদিন চলে গেলেন অমৃতলোকে।
সেদিনই এক খন্ড মার্কিন পরে
গলায় চাবি,কোমরে কম্বল জড়িয়ে
মস্তক মুন্ডন ক'রে
পিতৃ আত্মার শান্তি কামনা করেছ শ্রাদ্ধ ঘাটে।
একবার সেদিন গুলোতে তোমার হৃদয়ে
উত্তাল তরঙ্গ উঠেনি।
ধর্মের আধারে নির্মিত সকল সংস্কার
মুখ বুজে মেনে নিয়েছ।
মেনে নিয়েছ চুপিচুপি সকল বিধি
আর অহেতুক দানের বিধান।
সব মানিয়ে নিয়েছ সমাজের সহাবস্থানে।
তবুও যখন সুযোগ পেয়েছ
আটপৌরে হৃদয় নিয়েও চিৎকার করে বলেছ-
"আমি ধর্ম মানি না,আমি আচার মানি না"
তোমাকে মেলাতে পারিনি কখনও।
এক করতে পারিনি তোমার কর্ম আর বিশ্বাস।
যা নিজে পারনি কিন্তু
বিপ্লবের বীজ রোপন ক'রে,
বৃক্ষ চেয়েছ পাশের বাড়ির উঠোনে।
আর কত ঠকাবে সারা বিশ্বকে,
এই সহজ মানুষগুলো কে?
আসলে ধর্ম ভন্ড নয়,ভন্ড তুমিই।
ধর্মের কোনো মুখোশ নেই।
সে কঠোর বরাবর নিজের কাজে।
"বরং তুমি প্রচারের মুখ ঢেকেছ
বেহায়া মুখোশে।
ধর্ম মানিনা বলে
তাকে মেনেছ গোপনে বা প্রকাশ্যে"
#রক্তাক্ত_বিজয়া
"#দুই_পার"
কেষ্ট মন্ডল (16/10/21)
এপারেতে বুর্জ খলিফা
মাথা নাচায় আকাশ গাঙে।
ওপারেতে মন্ডপ ভাঙে
কুমিল্লা আর চট্টগ্রামে।
এপারেতে অসুর মেরে
মা হয়েছে অভয়দায়িনী।
ওপারেতে প্রাণের দায়ে
ভিখারিনি ত্রিনয়নী।
এপারেতে আলোর রোশনাই
চলছে যখন দুর্গা বোধন।
ওপারেতে চুপিসারে
অষ্টমীতেই বিসর্জন।
এপারেতে মা এসেছে
অলিতে গলিতে নানান থিমে।
ঢাকের তালে ধুনুচি নেচে
বাংলা মেতে উৎসবী মরসুমে।
ওপারেতে চলছে নিধন
থাবা মারছে মৌলবাদে।
এপারেতে সেকুলারিজম
মাছ,মাংসের নানান পদে।
এপারেতে দেবীর বিদায়
উলুধ্বনি আর সিঁদুর খেলায়।
ওপারেতেও ভরলো সিঁথি
প্ৰিয়জনের রক্ত মেলায়।
এপারেতে শুরু হলো
কোন পুজোটা টেক্কা দিল।
ওপারেতেও কাউন্টডাউন
কোন লাশটা কাদের ছিল।
দুই পারেতেই পুজো ছিল।
এপারেতে ঢাক বাজলো,শাঁখ বাজলো।
ওপারেতে কান্নার রোল-
লাশের ভিড়ে লাশ হারালো।
আয়না"
কেষ্ট মন্ডল
রাত্রি ন'টাতেও যেন মধ্য রাতের নিঝুম নিস্তব্ধতা।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলে পুরো ফাঁকা বাড়ি গমগম করে ওঠে।অন্ধকার দু-ভাগ করে দেওয়া নীল আলোর উৎসকে লক্ষ করে অরুণাভ বিছানা ছেড়ে এগিয়ে আসে। ফোনটা কানে নিয়ে বলে -
"হ্যাঁ, মা বল। "
মনে হলো 'মা' শব্দে আরও জ্বলে উঠল ওপ্রান্ত-
- "এসব কী শুনছি?"
- "বিস্তারিত না বললে তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না।"
- "তোমার কত বয়স হলো জানো তুমি?"
অরুণাভ একটু হাসলো। সে বুঝতে পারে মেয়ে সুজাতার ভবিষ্যত বাণী।
- "আজ চার বছর হলো রিটায়ারমেন্ট। মানে চৌষট্টি, কেন কী হয়েছে?"
- "এই বয়সে তুমি আবার বিয়ে করার কথা ভাবছো- খবরটা কী সত্য?"
- "হ্যাঁ,তুই যা শুনেছিস একদম ঠিক।"
- "মানে,তুমি স্বীকার করছো?"
সুজাতা রাগে,ক্ষোভে থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার আদৰ্শ এক পুরুষের এই নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিতে ঘৃণায় পুরো শরীর রি-রি করে ওঠে।
- "তুমি আমার মায়ের জায়গায় কাউকে বসাতে পারো না, কিছুতেই মেনে নেবো না।"
- "তোদের মানা না মানাতে আমার কিছু এসে যায় না। তাছাড়া তোর মা আজ পনেরো বছর হলো
আমাদের ছেড়ে গেছে। শূন্যস্থান চিরদিন শূন্য হয়ে থাকতে পারে না।"
সুজাতা তার বাবাকে জানে। লৌহসম দৃঢ়তা।কিন্তু এমন নির্লজ্জ বাতুলতা কেন। এ যে বুড়ো বয়সে ভীমরতি।
-"তুমি আমার,দাদার সম্মানের কথা, আমাদের স্টেটাসের কথা একবার ভাববে না? আমরা একটা সমাজে বাস করি।এই ঘটনা যখন সবাই জানবে কী করে করে মুখ দেখাবো আমরা? ছি! ছি! ছি!"
- "সমাজ কোনো বস্তু নয়, একটা ভাবনা মাত্র।সেই ভাবনা থেকে বরং নিজেদের আরও ফ্রিজ করে নিও । "
- "আশ্চর্য! সত্যি বলছি,তোমাকে বাবা বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে।"
অরুণাভর কোনো লজ্জা নেই, এইটুকু বেহায়াপনা না থাকলে উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়।সে মৃদু হেসে বলে -
"মানুষের মানসিক পরিস্থিতি,পরিণতি যারা বোঝে না, তাদের কাছে এই ঘৃণাটাই স্বাভাবিক।
তাছাড়া এই ঘৃণা ছাড়া বাকি সবটাই তো তোদের মেকি।"
এই বাবাকে সুজাতা চিনতে পারছে না। বাবা নয়, যেন অন্য কোনো অভিলাষী পুরুষ। ছেলে মেয়েদের সম্মানের কথা দুরেই থাক,যে আত্ম-সম্মানকে তোয়াক্কা করে না-তার সাথে আর কী কথা বলা যায়!যে সময় তার বাণ-প্রস্থে যাওয়ার কথা সে কী না এই বয়সে আবার গার্হস্থ জীবনে- এ কি মানা যায়! বুকে যার বেদনা নেই, তার কাছে আবেদনের কোনো অর্থ নেই। তাই এই নিয়ে কথা বাড়ানো রুচিতে বাঁধল তার।কথা শেষ না করেই ফোনটা কেটে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বিছানায়।
তারপর একটা ফোন করে তার দাদা বিপ্লবকে। দুজনের আলোচনায় ঠিক হয় তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ।যে করেই হোক আগত অসম্মানের হাত থেকে তাদের বাঁচতেই হবে।
সে রাত্রে আর ঘুম হলো না সুজাতার। অবশ্যম্ভাবী অপমান, লজ্জার একটা গভীর দুশ্চিন্তার অন্ধকার কাজলের মতো ঘিরে রইল তার দু-চোখ জুড়ে।
ওদিকে অরুণাভও ছাদে গিয়ে চেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকে অন্ধকার আকাশের দিকে। এমন সির্ধান্ত তাকে নিতেই হতো। স্ত্রী আরতির মুখটা মনে পড়ে তার। সুখের সময়েই তার মহাপ্রস্থান। না না ভুল! বোধ হয় সুখ নয় যন্ত্রণা থেকেই মুক্তি নিয়ে পাড়ি দিয়েছে অন্য এক সুখের দেশে।লক্ষ লক্ষ তারা অলক্ষে রচনা করছে জীবনের জটিলতা। পশ্চিম আকাশে এক-দু' চিলতে নীল আলো চাবুক মারছে আকাশের পিঠে।কাল যে একটা ঝড় উঠবে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।
মৃত মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আপন বেগে জল গড়িয়ে এল সুজাতার।-
"মা, আমাদের ক্ষমা করো।তোমার এই ঘরে আর কোনোদিন আসতে পারবো না।যেখানে তোমার স্মৃতি থাকবে না সেখানে আমাদের কোনো মায়া থাকতে পারে না ।"
বাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে -
"আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
মা যে গয়নাগুলো আমাকে দিয়ে গেছিলো সেগুলো তোমার আলমারিতেই আছে।আমাকে সেগুলো বুঝিয়ে দাও। আমি চাই না সেগুলো কোনো বাইরের মেয়ে এসে...."
মেয়ের দাবী শুনে একটু থমকে যায় অরুনাভ। তারপর ছেলে বিপ্লবের দিকে তাকিযে বলে-
"বৌমা ওর নিজের অংশটা বুঝে নিয়ে গেছে অনেকদিন আগে। তোর কী বুঝতে কিছু বাকি আছে- জানতে চাই!তাছাড়া তৃষার নামে যে ফিক্সড ডিপোজিট..."
- " থাক বাবা!তোমার ওই সত্তর হাজারের ফিকসড ডিপোজিটটাই আমার মেয়ের প্রয়োজন নেই। বরং রেখে দাও তোমার হবু স্ত্রীর জন্য। আর হ্যাঁ,আমার টাকায় বাড়ির দো-তলাটা করা হয়েছিল সেটা আমি তালা মেরে দেব।ওটার অধিকার তোমার নেই।
আবারও হাসে অরুণাভ। ড্রয়ার টেনে আলমারীর চাবিগুচ্ছ বের করে সুজাতার হাতে দিয়ে বলে -
যাও আলমারি খুলে তোমার যা কিছু আছে নিয়ে নাও।"
তারপর বিপ্লবকে বলে -
- "তালা তুমি মারতেই পারো.. তো সেটা কি আমার
তালাই ?"
- "না আমি তালা নিয়েই এসেছি।"
- "ও, তার মানে প্ল্যান করেই এসেছো?"
সুজাতা ঝাকুনি দিয়ে বলল -
"হ্যাঁ,তুমি একা একা এই বয়সে এত কিছু প্ল্যান করতে পারো আর আমরা করতে পারি না?"
- "সুজাতা, তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি।এই শিক্ষা তোকে কে দিয়ে ছিল! আমরা তো কখনও দিইনি।"
জবাবটা দিল বিপ্লব -
"তুমি কোন শিক্ষার উদাহরণ রাখছো আমাদের সামনে? তোমাকে ন্যূনতম সম্মান করতেও লজ্জা বোধ হচ্ছে আমাদের।"
ধৈর্য্যর অগ্নি- পরীক্ষায় নারীরা পুরুষের থেকে অনেকটা এগিয়ে।এরা যেমন ধৈর্য্যশিলা তেমনই
যত্নশিলা। তাই তো চা বাগানে পাতা তোলার মতো বিরক্তিকর, একঘেয়ে কাজে নারীরাই উপযুক্ত, পুরুষরা নয়।সুজাতার মনে সেই সময়ে নারীর সেই চিরন্তন প্রবৃত্তি একবার জেগে উঠলো-
"বাবা, তুমি মায়ের জায়গায় অন্য কারোর কথা কীভাবে ভাবতে পারলে?"
অরুণাভ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো-
"কে বলেছে তোর মাকে আমি ভুলে যাচ্ছি? রক্ত- মাংসের মানুষটাকে যদিও ভুলে যাওয়া যায়,কিন্তু তার কর্তব্য আর ডেডিকেশনকে কেমন করে ভুলি!"
- "তাহলে এত বড়ো এই অসম্মান জনক সিদ্ধান্ত কী করে নিজে নিতে পারলে? আমাদের সম্মানের কথা ভাববে না তুমি?"
- "যেদিন তুই রাজীবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলি আমি মত দিইনি। সেদিন তুই বলেছিলিস -'আমি আর বাচ্চা মেয়ে নই ,আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যথেষ্ট হয়েছে আমার।'
আমি সেদিনই বুঝেছিলাম তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস। ছেলে মেয়েরা বড়ো হলে বাবার সাবেকি চিন্তাধারা সন্তানদের আধুনিক মানসিকতার উপর চাপানোটা শুধু অন্যায় নয়, পাপও।সেদিন থেকেই আমি তোদেরকে মুক্ত করে দিয়েছি এই সাবেকিয়ানা থেকে।"
সুজাতা মাথা নামায়। সেদিনের মেয়ে সুজাতা আজ মা এর ভূমিকায়। মাতৃত্বের স্নেহ-নিবিড় উষ্ণতায় দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারে সন্তান প্রেম কখনও বয়সের কোষ্ঠী-পাথরে রেখে বিশ্লেষণ করা যায় না।যেটা প্রাণের চেয়ে প্ৰিয় তাকে ভালোবাসা দিয়েই আগলে রাখতে হয় চিরকাল।গলার উচ্চ স্বর নেমে আসে-
"কিন্তু আবার বিয়ের..."
- "আমি এখন চৌষট্টি । আগামী কাল, না কি সত্তরে, না নব্বইএ - কত বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া ছাড়বো জানি না।যে কটা দিনই বাঁচি এই একাকিত্বের জীবনটা কীভাবে কাটাবো? এই অন্ধকারে, পরিবার,পরিজনহীন হয়ে? লোকে খারাপ বলবে, তোদের সম্মান নষ্ট হবে জানি কিন্তু আমি তো বাঁচবো, অন্তত দুটো কথার বলার মানুষ পাবো । জ্বর এলে জলপট্টি দেওয়ার মতো একটা মানুষকে পাশে পাবো।"
কথাটা অযৌক্তিক নয়। এই সব মানুষদের সব আছে, সবাই আছে কিন্তু আবার কিছুই নেই,কেউই নেই।এই থেকেও না থাকার যে কী যন্ত্রণা সেটা একমাত্র সেই বোঝে যে এই পরিস্থিতির মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে । আমরা নানা সমস্যার কথা তুলে ধরি, না পেলে আন্দোলন করি। রাস্তা ঘাটে চিল চিৎকার করি। নারী অধিকার , শিশু অধিকার,শ্রমজীবীর অধিকার নিয়ে পথে নামি কিন্তু বৃদ্ধদের জীবনের এই অসহ যন্ত্রণা নিয়ে ভাবার সময় ব্যস্ত নাগরিকের ব্যস্ত জীবনে নেই। বুকের ভিতর গোপন যন্ত্রণা চার দেওয়ালের মাঝেই বন্দী থেকে একদিন চিতার আগুনে ভস্মিভূত হয়ে ছাই হয়ে যায়।
অরুণাভ তার মৃত স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে -
"এটা শুধু কালের ব্যবধান।আজ আমরা কাল তোরা। এই যন্ত্রণার যাতাকলে একদিন সকলেই পিষতে হবে।এখানে একটা অসহায় বৃদ্ধ যদি কাউকে বিরক্ত না করে শুধু নিজে ভালো থাকার জন্য একটা এমন সিধান্ত নেয় তাতে সবার সম্মান যায়,সবার হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। তোরা আধুনিক-আহারে বিহারে।কিন্তু এই আধুনিকতা বড্ড আপেক্ষিক, অপরের বেলায় বদলে যায় তার সংজ্ঞা।"
সুজাতা আশ্বাস দিয়ে বলে -
"তোমাকে অন্তত একশবার বলেছি। আমার বাড়িতে এসে থাকো ।"
হেসে ওঠে অরুণাভ-
"তোর বাড়িতে তোর বিধবা শাশুড়ির জায়গা হয়নি
তাহলে আমার জায়গা কেমন করে হয়?"
অরুণাভ এবার জামাই রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলে-
"বাবা, আমাকে তোমার বাড়িতে রাখলে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?"
রাজীব খুশি হয়ে বলে -
কেন আপত্তি হবে? আপনি আমারও...
- "রাজীব, তোমরা বড়ো শিরদাঁড়াবিহীন পুরুষ।"
কথাটা চাবুকের মতো সপাটে পড়লো রাজীবের পিঠে।অরুণাভ বলল -
"তোমার ফ্ল্যাটে আমার জায়গা হবে তাহলে তোমার বিধবা মায়ের একটু জায়গা হচ্ছে না? আমি তোমার স্ত্রীর বাবা বলে তুমি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছ। আর তোমার মায়ের বেলায় সুজাতাকে বাধ্য করতে পারছো না? কী বিচার তোমার!"
সুজাতা একটা যুক্তির ঢাল খাড়া করে -
"কেন হবে,উনি কি আমার একার শাশুড়ি?
আমার দেবর, জা কোনো দায়িত্ব নেবে না। অথচ সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিয়েছে ষোলো আনা,তাহলে আমিইবা কেন..."
- "চুপ কর! তোর কথা শুনে আজ মনে হচ্ছে বড়ো বড়ো ডিগ্রি গলাতে ঝুলালেই সে যে শিক্ষিত হয় না- তুই তার চরম উদাহরণ।তোদের এই অজুহাত আর স্বার্থের দড়ি টানাটানির খেলায় বেচারা বয়স্ক মানুষটা এই অসহায় মুহূর্তে অসহনীয় কষ্ট ভোগ করবে?এই বয়সে তাকে আমি বাজার করতে দেখেছি, একা ডাক্তার খানায় যেতে দেখেছি তখন তোদের সম্মানে লাগে না? রুচিতে বাঁধে না? আচ্ছা তোদের মায়া নেই?মমতা নেই? বিবেক বোধ কিচ্ছু নেই?"
- "মাথা নামাই সুজাতা। মাথা নামিয়েই বলে তাহলে তুমি দাদার কাছে..."
- "সেটা তোর দাদাকেই জিজ্ঞেস কর। তোর বিয়েতে খরচ করেছি, রাজীবের ব্যবসাতে দিয়েছি, আবার পি-এফের কিছুও দিতে চেয়েছি তাহলে ওরাই বা আমার দায়িত্ব একা কেন নেবে?"
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না সুজাতা। আর উত্তর দেওয়ারই বা কী আছে কিন্তু অরুণাভ বলেই চলে -
"ছেলেদের পড়াশুনার নাম করে দূরে পালিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর এক মহা উপায় বের করেছিস তোরা। কিন্তু বাচ্চাদের কোন শিক্ষা দিচ্ছিস - সেটা ঈশ্বর জানেন! সময় তার উত্তর দেবে। আচ্ছা বলতো ওই বুড়ি মানুষটা কতটা খাবার নষ্ট করবে তোর? কতটুকু চাহিদা আছে তার যে তুই মেটাতে পারবি না? আমি যতদূর জানি বুড়ো বুড়িরা একটু খাবার, ওষুধের নিরাপত্তা আর নাতি নাতনিদের সঙ্গ ছাড়া কিছুই চায় না। "
অরুণাভ একবার রুমের ভিতর গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল-
এই নাও,আমার সমস্ত সম্পত্তি তৃষা আর অরিনের নামে উইল করে দিয়ে গেছি। আমি মারা যাওয়ার পর তারাই তা...
বিপ্লব জিজ্ঞেস করে তবে বিয়ে?
কিছু মনে করো না বাবা বিপ্লব। আজ স্বার্থে ঘা লেগেছে বলেই সমস্ত ব্যস্ততা ভুলে বাবার কাছে এসে হাজির হয়েছো। দোষ তোমাদেরও নেই।আসলে তোমরা যুগের অবক্ষয়। আর বিয়েটা!বিয়েটা কিছুই নয় তোমাদের চরিত্রের আয়না।
------:------
"কাবুলের কাবুলিওয়ালা"
কেষ্ট মন্ডল (18August, 2021)
বিংশ শতকের কোনো এক শরতের সকাল।
শিশির ধৌত রৌদ্রের স্বর্ণালী সোহাগে
ভরে উঠেছিল কোলকাতার গৃহস্থের উঠোন।
সে উঠোনে দাঁড়িয়ে বিশালকৃতির আফগানি রহমত।
দু-চোখে উজ্জ্বল অপত্য বিলাসিতা।
রুক্ষ মরু প্রান্তরের গিরি কন্দরে জন্ম হলেও
চোখে মায়ার তৃষ্ণা তার দুর্নিবার।
রাঙা চেলি, কপালে চন্দন চর্চিতা
সেদিনের একরত্তি মিনি তখন বধূ বেশে তার সামনে।
যেন আকাশ চ্যুত কোনো চন্দ্রলেখা,
আগত অনুরাগে জোৎস্না প্লাবিত তার দু-নয়ন।
রহমত অশ্রুকাতর চোখে চেনাতে চায় নিজেকে-
"খোকী চিনতে পারতেস,
আমি সেই কাবুলিওয়ালা
সেই......"
মিনি আর চিনতে পারছে না তাকে
ভুলে গেছে শৈশবের সই।
রহমত ভেবেছিল তার সেই খোকী
এখনও খোকীই আছে,
এখনও ডাকলে ছুটে আসবে অপ্রতিরোদ্ধ গতিতে।
রহমত শুনতে চায় সেই আধো ডাক-
"কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা।"
ময়লা ঢিলে পঞ্জাবির পকেটে আঙুরের
দাগ মুছে যায়নি তখনও।
সে সওদাগর তবু হৃদয়ের সওদা করেনি।
প্রেম কোনো সওদায়
বিক্রি হয়নি কখনও কোনোদিন।
কিন্তু মিনির সে স্নেহ-তেষ্টা
বিলীন হয়েছে সময়ের গ্রাসে।
হাজার হাজার ক্রোশ দূরে রুক্ষ পাথরের
ধূলি ধূসর শুষ্ক মাটিতে তার মেয়েও
ঠিক আজ মিনির মতোই বড়ো হয়ে গেছে।
কতদিন তার মুখে দেখেনি।
মিনির মুখেই ছিল তার মুখের সুনিবিড় ছায়া।
আজ একশ বছরের ব্যবধানে
বদলে গেছে কাবুলিওয়ালার মাটি।
ঘৃণার আসক্তিতে বদলে গেছে প্রেমের পিপাসা।
ভুলে গেছে কাবুলিওয়ালার
শুধু প্রেমের পথে বিজয়ের বার্তা।
রহমতের দেশে রহমতরা আজ অসহায়,অবাঞ্চিত।
পুরোনো চেতনার বুক ফুঁড়ে ফণা তুলেছে আজ
হিংস্র কৌতূকের মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
এখানে প্রাণ ক্ষণস্থায়ী,সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী।
প্রতিমুহূর্তে আর্তনাদ তোলে মৃত্যুর বিভীষিকা।
বাংলার যে মিনির আদরে আর্দ্র হয়ে
সুজলা সুফলা হয়েছিল আফগানি
এক শুষ্ক পিতার অন্তর।
সেই পিতার হাতে চকচকে রাইফেল।
গোলাপের দেশে গোলাপের রঙ
রক্তের লালে মিশে একাকার।
কাবুলের রানওয়ে-
উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে সেই মিনি ।
পিছনে ছুটছে রহমত।
এ মৃত্যু-ভূমি তাদের নয়
এ প্রেমহীন নিষেধের বিষাক্ত মাটি তাদের নয়।
তারা ফিরে পেতে চায় প্রাণ।
ফিরে পেতে চায় সেই প্রেম।
ফিরে যেতে চায় সে পুন্যভূমি,
যেখানে অভিমান হলে-
মিলিয়ে দেবে আদরের ত্রাণ।
------:-----
'"#রেনকোট"#Rain_coat"
কেষ্ট মন্ডল।(19/06/21)
কেন মেঘ জমে আকাশে
কেন শ্রাবণ ঝরে অবিরত।
অভিমানের ভিজে বাতাস
কেন যে বাড়িয়ে দেয় বুকের ক্ষত।
এখনও বৃষ্টি এলে শুনি
তোমার সেতারের মেঘমল্লার।
এখনও মেঘ-গর্জনে বুঝি
এ তো অভিমানী স্বরাঘাত তোমার।
এখানে জল থৈ থৈ তোমার প্লাবন
স্মৃতি ভিজে ডানা ঝাপটায়।
এখানে হতাশা ডুবে যায়
আমেজের চায়ের কাপটাই।
এখানে বৃষ্টি এলে,
তুমি হও মুষলধারা।
ভাঙা কাচে জলের দাগে,
কেন যে তুমি ছন্নছাড়া!
বলো না,তোমারও কী এমন হয়?
বৃষ্টি কী তোমাকেও কাঁদায়?
নাকি তোমার সুখের ঠিকানায়
আমার নোনা জল মূল্য হারায়?
এখনও শ্রাবণ এলে, তুমি আসো অঝোর ধারায়।
জীর্ণ জীবনের পলেস্তারা খসে যায়।
এখনও মেঘ এলে অজানা অসুখ আসে।
অথচ যে কথা ভুলে গিয়ে ভালো থাকা যায়।
কেন যে এত বরষায়!
কেন যে তোমাকে ভুলে যাওয়া যায় না!
কেন যে এত ভিজি এখনও
কেন যে কোনো রেনকোট হয় না!
-------:-------
"বিজয়োল্লাস"
কেষ্ট মন্ডল
রাজ-পথ থেকে গলি-পথ
জন-পথ থেকে মন-পথ
ব্যাথাতুর আজ রক্ত খেলায় ।
ভিজে মাটিতে শোণিতের গন্ধ,
চপার উঠেছে হেসে আকণ্ঠ।
প্রতিশোধের ধারালো নেশায়,
মানুষ মেতেছে মানুষ মারার খেলায়।
অসহায় মায়ের আর্তনাদ,
পরিহাসে ঢেকে দিয়ে যায়
উন্নয়নের হিংস্র উল্লাস।
মরছে মানুষ,পুড়ছে ঘর,
মরচে ধরেছে বিবেকের 'পর।
ফাটছে মাটি, ভাঙছে দোকান
বেদুঈনের খুরে মরে মায়ের প্রাণ।
বর্গীরা টর্গীরা সব অনেক দূরে,
বাঙালির উৎসব লেগেছে আজ বাঙালি মেরে।
তোমার জয়ধ্বজায় উড়ছে দেখো
পরাজিতের লাশ।
শিশু, আগামীর চোখে দেখে
এ কোন বিস্মিত সর্বনাশ!
কবি, এখনও তুমি মত্ত প্রেমের কবিতায়!
তোমার চেতনার রঙে রাঙানো মানব প্রেম
আজ কেঁদে আকাশ ফাটায় ।
তুমি দেখেও দেখো না,শুনেও শোন না
দাওনি কোনো শান্তির নিদান।
সদ্য বিধবার হাহাকারে কাঁপে উঠোন থেকে শ্মশান।
পশ্চিমে উঠলে ঝড়, তুমি করো চিৎকার
নিজের যখন উড়ছে চাল,তুমি কেন নির্বিকার!
তবে কী অজানা অনুগ্রহে
তুমিও নিয়েছ অজ্ঞাতবাস।
শান্তির ললিত বাণী, নয় কী তবে,
তোমার কাছেই বড়ো পরিহাস?
"দাগ"
কেষ্ট মন্ডল
কতবার বুকে একবুক দাগ রেখে গেছে
তোমার অভিমানের অভিঘাতি ঢেউ।
কতবার স্তব্ধ হয়ে গেছে সব শব্দ,
প্রতিজ্ঞায় ঝরে পড়েছিলো আগুন -
আর ফিরবো না কারও কাছে কেউ কখনই ।
তবু ফিরে গেছি উজানের টানে,
তোমার হাতের মুঠোতেই যে বন্দি আমার বিশ্ব ।
সব শপথ অসাড় হয়ে যেত, যখন-
অভিমানের বক্র-তল মুছে দিত
তোমার অশ্রুপাতের জ্যামিতি বাক্স।
শৈশবে খেলার আঘাতের এমন কিছু দাগ
শরীর ছুঁয়ে যায়,যা থেকে যায় আমরণ।
যে দাগে ব্যথা মিলিয়ে যায়,
প্রলেপ দিয়ে দেয় সময়ের সঞ্চরণ।
শুধু মিলিয়ে যায় না স্মৃতি,
মিলিয়ে যায় না অনুভূতি।
মস্তিষ্কের সূক্ষ্য তারে দোলা লাগায়
দাগের সাক্ষী।
হয়তো এমনই এক খেলার ছলেই শুরু
তোমার প্রেম।
খেলা শেষে হৃদয়ের গভীরে যে দাগ
তুমি এঁকে দিয়েছিলে-
তাকেও আর মুছে দেওয়া যায়নি।
সে দাগ আজও পোড়ায়,
আমার অপরাহ্নের অবকাশ।
যে দাগ এখনও নিয়ে যায়,
সেই ধূসর ইতিহাসের স্বর্ণালী বর্ণমালায়।
বারান্দার পড়া রোদের মতো
বেড়িয়ে আসে এক চিলতে
বেদনা বিহীন শক্তিহীন এক ইচ্ছে।
যে ইচ্ছেই আর ব্যথা নেই,
কোনো হা-হুতাশ নেই তোমার জন্য।
বরং একটা সুখ আসে সেই ফিকে দাগ বেয়ে।
তোমাকে মনে পড়ার এক অনন্ত সুখ।
দুঃখের মাঝেও যে একটা সুখ
বাঁধা থাকে গোপন সুতোই।
আসলেই দাগ কোনো ক্ষত নয়,স্মৃতির শুকতারা।
প্রলয় মেঘের অন্তরালে যেমন শ্রাবনী ধারা।
তুমি যতই পোড়াও আমায়
গোপন প্রেমের আঙিনায়।
পুড়ে গিয়েই তারারা উজ্জ্বল, জেনো-
আকাশের সীমানায়।
"আর একটা ভুল"
কেষ্ট মন্ডল
মাথার উপর নিশ্ছিদ্র নীল উদাসীন আকাশ।
তার নীচে এত বড়ো জীবন।
কখনও সেখানে বর্ষিত হয়েছে সজল ধারার মতো
অনন্ত সুখ, প্রেম, প্রেরণা।
কখনও বজ্রপাতের মতো ধেয়ে এসেছে
ভুলের যন্ত্রণা, না-পাওয়ার দুঃসহ বেদনা।
কখনও বুকের আস্তিনে লুকিয়ে রাখা
সেই গোপন প্রেরণাই লেলিহান
আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে
আমার সময়, আমার প্রেম,আমার সাধনা।
যে বুক তাকে আগলে রাখতো ভালোবাসা দিয়ে-
সেই বুক থেকেই উঠেছে কাঁচা মাংস পোড়ার গন্ধ।
অথচ যেখান থেকে সুগন্ধি ওঠার কথা ছিলো।
আবারও ভুল ক'রে
বিষোল্লিকরণ খুঁজেছি সেই তোমারই মাঝে।
তোমার কাছেই ছুটে গেছি সেই দগ্ধ বুকের
যন্ত্রণার ক্ষত চেনাতে।
নতজানু হয়ে করজোড়ে তোমার সামনে বসে চিৎকার করে বলেছি -
একটা কিছু দাও আমায়,এমন একটা কিছু দাও-
যাতে আমি ফিরে পাই,
আমার হারিয়ে যাওয়া সেই শীতল আকাশ।
যাতে মিলিয়ে যায় আমার পোড়ার দাগ।
একমাত্র তুমিই পারতে দিতে সেই শীতল আবেশ ।
কিন্তু দিলে না,
পরিবর্তে দিলে অন্ধকার অভিযোগের
এমন এক নিষ্করুণ আঘাত
যাতে শুধু আমি নই,আমার এতদিনের
লালিত,অর্জিত আদৰ্শ
সমুহান মৃত্যুর মুখে আজ শয্যাশায়ী।
আসলে ভুল ছিলাম আমিই
ভুল ছিলো সেই কাঙ্ক্ষিত ভাবনা..
কারণ,যে পোড়ায় তার কাছে আগুনই থাকে...
বরফের শীতলতা নয়।
ফিরে এসো
কেষ্ট মন্ডল
চোখে চোখ রেখে দেখ না পলকহীন।
কখনো সে প্রদীপ্ত ভাস্বর
কখনওবা আলোকহীন।
চেয়ে দেখ না ভালো ক'রে,
যে চোখ তোমার প্রেমে আজও বিদ্ধ
সে চোখ যে তোমার ঐশ্বর্যেই ঋদ্ধ।
তোমার জলছবিতে আজও
রঙ ভরি কল্পনায়।
পূর্ণ তুমি ভেসে ওঠ এখনও
আমার ভাঙা আয়নায়।
ভুলে যেও বললেই কী
ভুলে যাওয়া যায় ।
চোখের তারায় এঁকে দেওয়া ইতিহাস,বলো
কী ক'রে মুছে দেওয়া যায়!
ভুলতে পারিনি, তুমি ফিরে এসো বিশ্বাসে।
কথারা নিশ্চুপ তবু
শব্দরা সেজে থাকে অভ্যাসে।
প্রাপ্তিতে নয়,
আসলে প্রেম মোড়া থাকে প্রতীক্ষার নীল খামে।
আমার ঋণ-পত্র লিখে রেখেছি তোমার নামে।
#আ_মরি_বাংলা_ভাষা
কেষ্ট মন্ডল ( 20/02/21)
একবার কেঁদে দেখ,বাংলায়-
সব ব্যাথা শুষে নেবে পতিত অশ্রুর উষ্ণতা।
একবার হেসে দেখ, বাংলায় -
সর্ষে খেতে দুলে উঠবে জীবনের হলুদ হিল্লোল।
বুলেটের শাসনে বন্ধ হয়নি চর্যাপদের আতুরঘর।
রক্ত-মাখা রাজ-পথে এখনও শোনা যায়
রফিকের মায়ের বাংলা-আর্তনাদ।
মঙ্গলের চাঁদ সওদাগর এখনও উজ্জ্বল
আত্ম-সম্মানের গৌরবে।
এ ভাষা আমার আদরের ভাষা,
অন্তরের চির আকুতির ভাষা।
হৃদয়ের গহনে জমে থাকা আবদ্ধ আবেগের
বিশুদ্ধ মুক্তি ঘটে এখনও,বাংলার রঞ্জিত ব্যঞ্জনে।
যে ভাষা বুঝে কৃষকের বলদ আজও
রুক্ষ মাটি চৌচির ক'রে,গর্ভবতী করে ক্ষেত,
যে ভাষায় সকল অনুভব বোঝানো যায়
ভাগীরথী,পদ্মার স্বচ্ছ ধারার মতো।
বাংলায় একবার "ভালোবাসি" বলে দেখ-
হৃদয়ের সব অভিমান হয়ে যাবে চৈতালি-পত্র ।
কান পেতে শুনে দেখো তখনই-
প্রতিশ্রুতি করেছে প্রণয়ী,
তোমার মলিন পাতায় নিজেররে করি উৎসর্গ ।
এই ভাষাতেই বন্য কালকেতুকে
ভালোবেসেছিল ফুল্লরা।
বিদ্যাপতি বাজিয়েছিল বেদনার বাঁশি
হৃদয় কাঁদিয়ে।
জ্ঞানদাস ভেসেছিল অনুরাগে,
নিজেকে হারিয়ে।
এই ভাষাতেই ভাটিয়ালি ঢেউয়ে আজও
ঘরে ফেরে মাঝি মাল্লারা।
একবার ডেকে দেখ, বাংলায়-
নিকানো উঠোনে এখনও অপেক্ষায় মায়ের আঁচল।
ফিরে এস বাঙালি,আপন হৃদয় বিন্যাসে।
নিজেকে ভুলে এ কোন খেলা তবে সর্বনেশে।
প্রেম ছাড়া প্রাণ পুর্ণতা পায়নি কোনোদিন,
স্বর-বর্ণেই তোমার বিকাশ এখনও সর্বাঙ্গীন।
কলম
কেষ্ট মন্ডল ( 29/01/22)
মাস্টারমশাই একটা কলম দিয়ে
আমাকে বলেছিলেন-
"বাবা,এই কলমটা বাক-দেবীর পায়ে
একবার ছুঁয়ে রেখো।
এই কলমই একদিন তোমার
পরিচয় এনে দেবে সারা বিশ্বে।"
আমি জিজ্ঞাসার চোখে চেয়েছিলাম তাঁর দিকে।
মাস্টারমশাই কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন -
"তোমার এলেম আছে,বাবা!
কলমের কালি বুলেটের থেকেও দ্রুতগামী।
বুলেট শুধু প্রাণ নিতে পারে, দিতে পারে না।
এই কলমই অত্যাচারীর বাস্তিল ভেঙে
এনেছিল সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার মহা-উৎসব ।
এই কলমই এনে দিতে পারে লক্ষ লক্ষ
অন্ধকার মনে বিপ্লবের প্রাণের চেতনা।"
আমি সে বারে দেবীর পায়ে কলম ছুঁয়ে বলেছিলাম-
"ওঁম সহনাববতু সহ নৌ ভুনুক্ত
সহ বীর্যং করাববহৈ
তেজস্বীনাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ।
ওঁম শান্তি!শান্তি!শান্তি!"
মনের মধ্যে একটা প্রেরণার বিদ্যুৎ,
একটা অদ্ভুত শক্তির শিহরণ অনুভব করলাম।
ক্লাসরুম, সামনে একঘর ছাত্র-ছাত্রী।
মাস্টারমশায়ের দৃপ্ত কণ্ঠ -
"ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।
একটা সঠিক জ্ঞান থেকেই জন্ম হয় বোধের ।
আর বোধ থেকেই বিকিরিত হয় আলো।
একটা কলমেই থাকে সেই ক্ষমতা।
কালির কয়েকটা শব্দ শুধু শব্দ নয়,শব্দ-ব্রহ্ম।
যে ব্রহ্ম জুড়ে থাকে ব্রহ্মান্ডের সকল
নির্যাতিত, নিপিড়িত মানুষের মুখের ভাষা।
পরিবর্তনের বীজ-মন্ত্র।
সারা ক্লাস নিস্তব্দ, মন্ত্র-মুগ্ধ।
কথা শেষ হলো না-
দরজা থেকেই ঝলসে উঠলো-
সরকারের বেসরকারি পিস্তল।
পর পর তিনটি-
মাস্টারমশাই লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে একবার হাত তুলে
কি যেন বলতে চায়লেন।
তারপর নিথর হয়ে গেল সব কিছু।
রক্তের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল
তাঁর বুকের বিপ্লবী কলম।
মাস্টারমশায়ের আজ তিরিশতম মৃত্যুবার্ষিকী।
বুলেট শুধু তাঁর নয়-
কেড়ে নিয়েছিল একটা কলমের প্রাণ।
আর্ত,নিপিড়িত মানুষের ভাষা।
তারপর তিরিশটা গ্রীষ্মের দহন,
তিরিশটা শ্রাবণের সান্ত্বনা,
প্রদক্ষিণের শেষ প্রান্তে আরও তিরিশটা
হেমন্ত অবগাহন।
আমি এখন প্রথিতযশা,দিকে দিকে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমার কলম।
সম্মান আর সম্বর্ধনার ফুলেল আড়ম্বরে
সারাবছর আমার জেগে থাকে বসন্ত।
তবু আমার শানিত কলম একবারও গর্জে ওঠেনি
মাস্টারমশায়ের মৃত্যু তদন্তের দাবীতে।
দলাদলির হিংসায় কোল খালি হওয়া
মায়ের চোখের জলের মমতা,
সদ্য বিধবা স্ত্রীর অসমাপ্ত প্রেমের আবেগ-
আমার কালিতে মিশে বিদ্রোহী হয়নি।
লক্ষ লক্ষ চাকুরী প্রার্থী যুবকের
অসহায় মিছিল যখন
আমার দুয়ারে,আমার প্রতীক্ষায়।
তখন আমি আমি ডুবে আছি অভিধানে
শাসক বন্দনার সুচারু শব্দ-চয়নে।
স্তাবকতা যদি স্তবক বয়ে আনে
কোনো ভূষণ বা বিভূষণ।
ঘুণ ধরুক রাষ্ট্রে,তবু আমি নতজানু বিভীষণ।
যে কলম মরেও মরেনি
এখনও লেখে ইতিহাস।
সেই কলমই দাসত্বের শৃঙ্খলে রচে
আমার বসন্ত বারোমাস।