Friday, July 17, 2020

কাজী নজরুল ইসলাম




কাজী মোতাহার হোসেন এর কাছে লিখা কাজী নজরুল ইসলাম এর একটি চিঠি।

১৫, জুলিয়াটোলা স্ট্রীট
কলিকাতা
০৮-০৩-২৮
সন্ধ্যা

প্রিয় মতিহার
পরশু বিকালে এসেছি কলকাতা। ওপরের ঠিকানায় আছি। ওর আগেই আসবার কথা ছিল , অসুখ বেড়ে উঠায় আসতে পারিনি। ২/৪ দিন এখানেই আছি। মনটা কেবলই পালাই পালাই করছে। কোথায় যাই ঠিক করতে পারছিনে। হঠাৎ কোনদিন এক জায়গায় চলে যাবো, অবশ্য দু - দশ দিনের জন্য। যেখানেই যাই, আর কেউ না পাক, তুমি খবর পাবে।
বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে , সেদিন অন্ততঃ তোমার বুক বেঁধে উঠবে। তোমার ঐ ছোট্ট ঘরটিতে শুয়ে , যে ঘরে তুমি আমায় প্রিয়ার মত জড়িয়ে শুয়েছিল, অন্ততঃ এইটুকু স্বান্তনা নিয়ে যেতে পারবো , এই কি কম সৌভাগ্য আমার !!!
কেন এই কথা বলছি শুনবে ? বন্ধু আমি পেয়েছি যার সাক্ষাত আমি নিজেই করতে পারবো না । এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু , গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে , প্রিয় হয়ে উঠেনি কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটির লেখা তোমার কাছে লিখে গেলাম। আকাশের সবচেয়ে দূরের যে তারাটির দিপ্তী চোখের জলকনার মত ঝিলমিল করবে, মনে কর, সেই তারাটি আমি । আমার নামেই তার নামকরণ কর, কেমন ?
মৃত্যু এত করে মনে করছি কেন ? জানো, ওকে আজ আমার সবচেয়ে সুন্দর মনে হচ্ছে বলে ! মনে হচ্ছে, জীবনে যে আমায় ফিরিয়ে দিলে, মরলে সে আমায় বরন করে নিবে। সমস্ত বুকটা ব্যাথায় দিন রাত টন টন করছে। মনে হচ্ছে সমস্ত বুকটা যেন ঐখানে এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। ওর যেন মুক্তি হয়, বেঁচে যাবো। কিন্তু কী হবে কে জানে !! তোমার চিঠি পেয়ে অবধি কেবল ভাবছি আর ভাবছি। কত কথা, কত কী !!! তার কি কূল কিনারা আছে !!! ভাবছি আমার ব্যাথার রক্ত কে রঙীন খেলা বলে উপহাস যে করেন , তিনি হয়তো দেবতা, আমার ব্যাথার অশ্রুর বহু উর্ধ্বে। কিন্তু আমি মাটির নজরুল হলেও সে দেবতার কাছে অশ্রুর অঞ্জলি আর নিয়ে যাবো না। ফুল ধূলায় ঝরে পড়ে , পায়ে পিষ্ট হয়, তাই বলে কি ফুল এত অনাদরের ? ভুল করে সে ফুল যদি কারোর কবরীতেই ঝরে পড়ে এবং তিনি যদি সেটাকে উপদ্রব বলে মনে করেন , তাহলে ফুলের পক্ষে প্রায়শ্চিত হচ্ছে এক্ষুনি কারো পায়ের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করা।
সুন্দরের অবহেলা আমি সইতে পারিনে বন্ধু, তাই এত জ্বালা। ভিক্ষা যদি কেউ তোমার কাছে চাইতেই আসে , অদৃষ্টের বিড়ম্বনায় তাহলে তাকে ভিক্ষা নাই ই দাও , কুকুর লেলিয়ে দিওনা। আঘাত করার একটা সীমা আছে, সেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে আর তক্ষুনি তার নাম হয় অবমাননা। ছেলেবেলা থেকেই পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে , যে প্রেমে বুক ভরে উঠে কাঁনায় কাঁনায়, তা কখনো কোথাও পাইনি।
এবার চিঠির উত্তর দিতে বড্ড দেরী হয়ে গেল। না জানি কত উদ্বিগ্ন হয়েছ !!! কি করি বন্ধু , শরীর টা এত বেশী বেয়াড়া আর হয়নি কখনো। ওষুধ খেতে প্রবৃত্তি হয়না।
আমায় সবচেয়ে অবাক করে নিশুতি রাতের তারা। তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আকাশের প্রায় সব তারাগুলোকেই চিনি। তাদের সত্যিকারের নাম জানিনে কিন্তু তাদের প্রত্যেকের নামকরন করেছি আমার ইচ্ছে মত। সেই কত রকম মিষ্টি মিষ্টি নাম , শুনলে তুমি হাসবে। কোন তারা কোন ঋতুতে কোন দিকে উদয় হয়, সব বলে দিতে পারি। জেলের ভিতর যখন সলিটারি সেলে যখন বন্দি ছিলাম, তখন গরমে ঘুম হত না। সারারাত জেগে কেবল তারার উদয় অস্ত দেখতাম। তাদের গতিপথে আমার চোখের জল বুলিয়ে দিয়ে বলতাম , বন্ধু, ওগো আমার নাম না জানা বন্ধু, আমার এই চোখের জলের পিচ্ছিল পথটি ধরে তুমি চলে যাও অস্ত পাড়ের পানে। আমি শুধু চুপটি করে দেখি। হাতে থাকতো হাতকড়া, দেয়ালের সঙ্গে বাঁধা চোখের জলের রেখা আঁকাই থাকতো মুখে, বুকে। আচ্ছা বন্ধু , ক'ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয় , তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে ? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই - সেই সব জিজ্ঞাসা।
যেদিন আমি ঐ দূরের তারার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাকে বলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দু'ফোঁটা অশ্রুর দর্পন দেয়, শুধু আমার নামে। হয়তো আমি সেদিন খুশীতে উল্কা ফুল হয়ে তাঁর নোটন খোপায় ঝরে পড়বো। তাঁকে বলো বন্ধু, তাঁর কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমি পেয়েছি, তাঁকে পেয়েছি। আমার বুকের রক্তে, চোঁখের জলে আমি তাঁর উদ্দেশ্যে আমার শান্ত , স্নিগ্ধ অন্তরের পরিপূর্ন চিত্তের একটি সশ্রদ্ধ নমষ্কার রেখে গেলাম। আমি যেন শুনতে পাই, সে আমারে সর্বান্তকরনে ক্ষমা করেছে। ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উর্ধ্বে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আবার লিখছি। কিন্তু আর লিখতে পারছিনে ভাই। চোখের জল , কলমের কালি দুইই শুকিয়ে গেল। তোমরা কেমন আছো , জানিয়ো। তাঁর কিছু খবর দাওনা কেন ? না কী সে এটুকুও মানা করেছে? ঠিক সময় মতো সে ওষুধ খায়তো ?
কেবলি কীটস্‌ কে স্বপ্নে দেখছি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যানিব্রাউন পাথরের মত।
ভালোবাসা নাও
ইতি

তোমার নজরুল।



                                                                   রাজবন্দীর চিঠি


রাজবন্দীর চিঠি
প্রেসিডেন্সি জেল, কলিকাতা
মুক্তি-বার, বেলা-শেষ

প্রিয়তমা মানসী আমার।

আজ আমার বিদায় নেবার দিন। একে একে সকলেরই কাছে বিদায় নিয়েছি। তুমিই বাকি। ইচ্ছা ছিল, যাবার দিনে তোমায় আর ব্যথা দিয়ে যাব না, কিন্তু আমার যে এখনও কিছুই বলা হয়নি। তাই ব্যথা পাবে জেনেও নিজের এই উচ্ছৃঙ্খল বৃত্তিটাকে কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। তাতে কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবে না, কেন না তোমার মনে তো চিরদিনই গভীর বিশ্বাস যে, আমার মতন এত বড়ো স্বার্থপর হিংসুটে দুনিয়ায় আর দুটি নেই।

আমার কথা তোমার কাছে কোনোদিনই ভালো লাগেনি। (কেন, তা পরে বলছি), আজও লাগবে না। তবু লক্ষ্মী, এই মনে করে চিঠিটা একটু পড়ে দেখো যে, এটা একটা হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া পথিকের অস্ত-পারের পথহারা পথে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিদায়-কান্না। আজ আমি বড়ো নিষ্ঠুর, বড়ো নির্মম। আমার কথাগুলো তোমার বে-দাগ বুকে না-জানি কত দাগই কেটে দেবে। কিন্তু বড়ো বেদনায় প্রিয়, বড়ো বেদনায় আজ আমায় এত বড়ো বিদ্রোহী, এত বড়ো স্বেচ্ছাচারী উন্মাদ করে তুলেছে। তাই আজও এসেছি কাঁদাতে। তুমিও বলো, আমি আজ জল্লাদ, আমি আজ হত্যাকারী কসাই। শুনে একটু সুখী হব।

আমার মন বড়ো বিক্ষিপ্ত। তাই কোনো কথাই হয়তো গুছিয়ে বলতে পারব না। যার সারা জীবনটাই বয়ে গেল বিশৃঙ্খল আর অনিয়মের পূজা করে, তার লেখায় শৃঙ্খলা বা বাঁধন খুঁজতে যেও না। হয়তো যেটা আরম্ভ করব সেইটেই শেষের, আর যেটায় শেষ করব সেইটেই আরম্ভের কথা। আসল কথা, অন্যে বুঝুক চাই নাই বুঝুক, তুমি বুঝলেই হল। আমার বুকের এই অসম্পূর্ণ না-কওয়া কথা আর ব্যথা তোমার বুকের কথা আর ব্যথা দিয়ে পূর্ণ করে ভরে নিও। – এখন শোনো।

প্রথমেই আমার মনে পড়ছে (আজ বোধ হয় তোমার তা মনেই পড়বে না), তুমি একদিন সাঁঝে আমায় জিজ্ঞেস করেছিলে, – ‘কী করলে তুমি ভালো হবে?’

তোমারই মুখে আমার রোগ-শিয়রে এই নিষ্ঠুর প্রশ্ন শুনে অধীর অভিমানের গুরু বেদনায় আমার বুকের তলা যেন তোলপাড় করে উঠল!

হায় আমার অসহায় অভিমান! হায়, আমার লাঞ্ছিত অনাদৃত ভালোবাসা। আমি তোমার সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। দেওয়া উচিতও হত না। তখন আমার হিয়ার বেদনামন্দিরে যেন লক্ষ তরুণ সন্ন্যাসীর ব্যর্থ জীবনের আর্ত হাহাকার আর বঞ্চিত যৌবনের সঞ্চিত ব্যথা-নিবেদনের গভীর আরতি হচ্ছিল। যার জন্যে আমার এত ব্যথা সেই এসে কিনা জিজ্ঞেস করে, – ‘তোমার বেদনা ভালো হবে কিসে?’ …

মনে হল, তুমি আমায় উপহাস আর অপমান করতেই অমন করে ব্যথা দিয়ে কথা কয়ে গেলে। তাই আমার বুকের ব্যথাটা তখন দশ গুণ হয়ে দেখা দিল। আমি পাশের বালিশটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। আমার সবচেয়ে বেশি লজ্জা হতে লাগল, পাছে তুমি আমার অবাধ্য চোখের জল দেখে ফেল। পাছে তুমি জেনে ফেল যে, আমার বুকের ব্যথাটা আবার বেড়ে উঠেছে! যে আমার প্রাণের দরদ বোঝে না, সেই বে-দরদির কাছে চোখের জল ফেলা আর ব্যথায় এমন অভিভূত হয়ে পড়ার মতো দুর্নিবার লজ্জা আর অপমানের কথা আর কী থাকতে পারে? কথাও কইতে পারছিলুম না, ভয় হচ্ছিল এখনই আর্দ্র গলার স্বরে তুমি আমার কান্না ধরে ফেলবে। যাক, ভগবান আমায় রক্ষা করলেন সে বিপদ হতে। তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগলে। তার পর আস্তে আস্তে চলে গেলে। তুমি বোধ হয় আজ পড়ে হাসবে, যদি বলি, যে, আমার তখন মনে হল, যেন তুমি যাবার বেলায় ছোট্ট একটি শ্বাস ফেলে গিয়েছিলে। – হায় রে অন্ধ বধির ভিখিরি মন আমার! যদি তাই হত, তবে অন্তত কেন আমি অমন করে শুয়ে পড়লুম, তা একটু মুখের কথায় শুধাতেও তো পারতে।

তুমি চলে যাবার পরেই ব্যথায় অভিমানে আমার বুক যেন একেবারে ভেঙে পড়ল। নিষ্ফল আক্রোশে আর ব্যর্থ বেদনার জ্বালায় আমি হুঁকরে হুঁকরে কাঁদতে লাগলুম। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তার পর ডাক্তার এল, আত্মীয়-স্বজন এল, বন্ধু-বান্ধব এল। সবাই বললে, – হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বড়ো অস্বাভাবিক। গতিক…ডাক্তার বললে, – ‘রোগী হঠাৎ কোনো – ইয়ে – কোনো বিশেষ কারণে এমন অভিভূত হয়ে পড়েছে। এ কিন্তু বড্ডো খারাপ। এতে এমনও হতে পারে যে …।’

বাকিটুকু ডাক্তার আমতা আমতা করে না বললেও আমি সেটার পূরণ করে দিলুম, – ‘একেবারে নির্বাণ দীপ গৃহ অন্ধকার। না ডাক্তার বাবু?’ – বলেই হাসতে গিয়ে কিন্তু এত কান্না পেল আমার যে, তা অনেকেরই চোখ এড়াল না। সত্যিই তখন আমার কণ্ঠ বড়ো কেঁপে উঠেছিল, অধর কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল, চোখের পাতা সিক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও কেউ আর আমায় তুলতে পারলে না। আমার গোঁয়ার্তুমির অনেকক্ষণ ধরে নিন্দে করে বন্ধু-বান্ধবরা বিদায় নিলে। আমিও মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলুম।

হায়, এই নিষ্ঠুর লোকগুলো কি আমায় একটু নিরিবিলি কেঁদে শান্তি পেতেও দেবে না?… তখনও তোমরা সবাই আমার পাশে, কেউ বা আমার শিয়রে বসেছিলে। হঠাৎ মনে হল, তুমি এসে আমার হাত ধরেছ। এক নিমেষে আমার সকল ব্যথা যেন জুড়িয়ে জল হয়ে গেল। এবারেও কান্না এল, কিন্তু সে যেন কেমন এক সুখের কান্না! তবে এ কান্নাতেও যে অভিমান ছিল না, তা নয়। তবু তোমার ওই ছোঁয়াটুকুর আনন্দেই আমি আমার সকল জ্বালা সকল ব্যথা-বেদনা মান-অপমানের কথা ভুলে গেলুম। মনে হল, তুমি আমার – তুমি আমার – একা আমার! হায় রে শাশ্বত ভিখিরি! চির তৃষাতুর দীন অন্তর আমার! কত অল্প নিয়েই না তুই তোর আপন বুকের পূর্ণতা দিয়ে তাকে ভরিয়ে তুলতে চাস, তবু তোর আপন জনকে আর পেলিনে। খানিক পরেই আমি আবার সকলের সঙ্গে দিব্যি প্রাণ খুলে হাসি-গল্প জুড়ে দিলুম দেখে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলে। কেউ বুঝলে না, হয়তো তুমিও বোঝনি, কেমন করে অত অধীর বেদনা আমার এক পলকে শান্ত স্থির হয়ে গেল। সে সুখ সে ব্যথা শুধু আমি জানলুম আর আমার অন্তর্যামী জানলেন। হাঁ, সত্যি বলব কি? আরও মনে হয়েছিল, সে ব্যথা যেন তুমিও একটু বুঝতে পেরেছিলে? দেখছ? কী ভিখিরি মন আমার! তুমি না জানি আমায় কতই ছোটো মনে করছ! – আহা একবার যদি মিথ্যা করেও বলতে লক্ষ্মী যে, আমার ব্যথার কারণ অন্তত তুমি মনে মনে জেনেছ, তা হলে আমি আজ অমন করে হয়তো ফুটতে না ফুটতেই ঝরে পড়তুম না! আমার জীবন এমন ছন্ন-ছাড়া ‘দেবদাস’-এর জীবন হয়ে পড়ত না! – যাঃ, খেই হারিয়ে বসেছি আমার কথার! –

হ্যাঁ, সেদিন তোমার ওই একটু উষ্ণ ছোঁয়ার আনন্দেই বিভোর হয়ে রইলুম। তার পরের দিন মনে হতে লাগল, তোমায় আড়ালে ডেকে বলি, কেন আমার এ বুকভরা ব্যথার সৃষ্টি। সারা দিন তোমার পানে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলুম, যদি আবার এসে জিজ্ঞেস কর তেমনই করে, কী করলে তুমি ভালো হবে?

হায়রে দুর্ভাগার আশা! তুমি ভুলেও আর সে-কথাটি আর একবার শুধালে না এসে! সারাদিন আকুল উৎকণ্ঠা নিয়ে বেলা-শেষের সাথে সাথে আমারও প্রাণ যেন কেমন নেতিয়ে পড়তে লাগল। আমার কাঙাল আত্মার এক নির্লজ্জ বেদনা ভুলবার জন্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটা বড়ো দুঃখে বড়ো প্রাণ ভরেই গাইতে লাগলুম, –

‘তুমি জান ওগো অন্তর্যামী
পথে পথেই মন ফিরালেম আমি।
ভাবনা আমার বাঁধলনাকো বাসা।
কেবল তাদের স্রোতের পরেই ভাসা,
তবু আমার মনে আছে আশা,
তোমার পায়ে ঠেকবে তারা স্বামী॥

টেনেছিল কতই কান্না হাসি,
বারে বারেই ছিন্ন হল ফাঁসি!
শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে –
‘মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’
জানি জানি, নামব তোমার কোলে
আপনি যেথায় পড়বে মাথা নামি।’

আমার কণ্ঠ আমার আঁখি আমারই ব্যথায় ভিজে ভারী হয়ে উঠল! আমার গানের সময় আমি আর বাহিরকে ফাঁকি দিতে পারিনে। সে সুর তখন আমার স্বরে কেঁপে কেঁপে ক্রন্দন করে, সে-সুর সে-কান্না আমার কণ্ঠের নয়, আমার প্রাণের ক্রন্দসীর। গান গেয়ে মনে হল, যেন এই বিশ্বে আমার মতোন ছন্ন-ছাড়ারও অন্তত একজন বন্ধু আছেন, যিনি আমার প্রাণের জ্বালা, মর্ম-ব্যথা বোঝেন, আমার গান শুনে যাঁর চোখের পাতা ভিজে ওঠে। তিনি আমার অন্তর্যামী। অমনি এ-কথাটিও মনে হয়েছিল যে, যদি সত্যিই আমার কেউ প্রিয়া থাকত, তাহলে সে আমার ওই ‘শুধোয় সবাই হতভাগ্য বলে, মাথা কোথায় রাখবি সন্ধ্যা হলে?’ – ওইটুকু শুনবার পরই আর দূরে থাকত পারত না, তার কোলে আমার মাথাটি থুয়ে সজল কণ্ঠে বলত, – ‘ওগো, আমার কোলে প্রিয়, আমার কোলে।’ তার তরুণ কণ্ঠে করুণ মিনতি ব্যথায়-অভিমানে কেঁপে কেঁপে উঠত, – ‘ছি লক্ষ্মী! এ গান গাইতে পারবে না তুমি।

কী বিশ্রী লোভী আমি, দেখেছ? তুমি হয়তো এতক্ষণ হেসে লুটিয়ে পড়েছ আমার এই ছেলেমান্‌ষী আর কাতরতা দেখে! তুমি হয়তো ভাবছো, কি করে এত বড়ো দুর্জয় অভিমানী, দুরন্ত বাঁধন-হারা এমন করে নেতিয়ে পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারে, কেমন করে এক বিশ্বজয়ীর এত অল্পে এমন আশ্চর্য এত বড়ো পরাজয় হতে পারে! তা ভাব, কোনো দুঃখ নেই। আমিও নিজেই তাই ভাবছি। কিন্তু ভয় হয় প্রিয়, কখন তোমার এত গরব না-জানি এক নিমেষে টুটে গিয়ে সলিল বয়ে যাবে নয়ানে। সেই দিন হয়তো আমার এ ভালোবাসার ব্যথা বুঝবে। আমার এই পরাজয়ের মানেও বুঝবে সেদিন।

যাক, যা বলছিলাম তাই বলি। – গান গেয়ে কেন আমার মনে হল, আমার অন্তর্যামী বুঝি আমার আঁখির আগে এসে নীরবে জল-ছল-ছল চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের জল মুছে সামনে চাইতেই, – ও হরি! কে তুমি দাঁড়িয়ে অমন করুণ চোখে আমার পানে চেয়ে? আহা, চটুল চোখের কালো তারা দুটি তাদের দুষ্টুমি চঞ্চলতা ভুলে গিয়ে ব্যথায় যেন নিথর হয়ে গেছে! সে পাগল-চোখের কাজল আঁখি-পাতা যেন জলভারাতুর। ওগো আমার অন্তর্যামী! তুমি কি সত্য-সত্যই এই সাঁঝের তিমিরে আমার আঁখির আগে এসে দাঁড়ালে? হে আমার দেবতা! তবে কি আমার আজিকার সন্ধ্যা-আরতি বিফলে যায়নি? আমি আমার সব কিছু ভুলে কেমন যেন আত্মবিস্মৃতের মতো বলে উঠলুম – ‘তুমি আমার চেয়ে কাউকে বেশি ভালোবাসতে পাবে না? কেমন?’

কোনো কথা না বলে তুমি আমার কোলের উপরকার বালিশটিতে এসে মুখ লুকালে। কেন? লজ্জায়? না সুখে? না ব্যথায়? জানি না, কেন। তাই তো আজ আমার এত দুঃখ আর এত প্রাণপোড়ানি। তোমার প্রাণের কথা তুমি কোনো দিনই একটি কথাতেও জানাওনি, তাই তো আজ আমার বুক জুড়ে এত না জানার ব্যথা! অনেক সাধ্য-সাধনায় তুমি মুখ তুলে চাইলে, কিন্তু বললে না, কেন অমন করে মুখ লুকালে। সেদিন একটিবার যদি মিথ্যা করেও বলতে, – ‘হে আমার চির-জনমের প্রিয়! যে, …।’ না, না, যাক সেকথা।

এইখানে একটা মজার খবর দিই তোমাকে। এই হাজত-ঘরে বসেও আমার এমন অসময়ে মনে হচ্ছে, যেন আমি একজন কবি। রোসো, এখনই হেসে লুটিয়ে পড়ো না! তোমার চেয়ে আমি ভালো করেই জানি যে আমার কবি না হওয়ার জন্যে যা-কিছু চেষ্টা-চরিত্তির করার প্রয়োজন, তার কোনোটাই বাদ দেননি ভগবান। তাই আমার বাহির-ভিতর সব কিছুই যেন খোট্টাই মুল্লুকের চোট্টাই ভেইয়্যার মতোই কাঠখোট্টা! তবু যদি আমি কবি হতুম, তাহলে আমার এই ভাবটাকে কী সুন্দর করেই না বলতুম, –

শুধু অনাদর শুধু অবহেলা শুধু অপমান!
ভালোবাসা? – সে শুধু কথার কথা রে!

অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ!

শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান!

যাক, যা হইনি, কপাল ঠুকলেও আর তা হচ্ছি নে। এখন যা আছি, তাই নিয়েই আলোচনা করা যাক।

দাঁড়াও, – অভিমান করে চেঁচিয়ে হয়তো ও কথাটার অপমানই করছি আমি। নয় কি? আমার মতোন হয়তো তুমিও ভাবছ, কার উপর এ অভিমান আমার? কে আমায় এ অধিকার দিয়েছে এত অভিমান দেখাবার? একবিন্দু ভালোবাসা পেলাম না, অথচ এক সিন্ধু অভিমান নিয়ে বসে আছি! তবু শুনে আশ্চর্য হবে তুমি যে, সত্যি-সত্যিই আমার বড্ড অভিমান হয়। যার উপর অভিমান করি, সে আমার এ অভিমান দেখে হাসবে, না দুপায়ে মাড়িয়ে চলে যাবে, সে দিকে ভ্রূক্ষেপও করি না। চেয়েও দেখি না, আমার এত ভালোবাসার সম্মান সে রাখবে কিনা, শুধু নিজের ভালোবাসার গরবে আজ অন্ধতায় মনে করি, সেও আমায় ভালোবাসে। তাই তো আর আমার এত লাঞ্ছনা ঘরে-বাইরে!

অনেক পথিক-বালা এ পথিকের পথের ব্যথা মুছিয়ে দিতে চেয়েছিল, হয়তো ভালোও বেসেছিল (শুনে হেসো না), আমি কিন্তু ফিরেও চাইনি তাদের পানে। ওর মধ্যে আমার কতকটা গরবও ছিল। মনে হত, এ বালিকা তো আমার সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারবে না, অনর্থক কেন তার জীবনটাকে ব্যর্থ করে দেব? যে-সে এসে আমার মতোন বাঁধন-হারা বিদ্রোহীর মনটাকে এত অল্প সাধনায় জয় করে নেবে, এও যেন সইতে পারতুম না। তাই কোনো হতভাগীর মনে আমার ছাপ লেগেছে বুঝতে পারলেই আমি অমনই দূরে – অনেক দূরে সরে যেতুম; আর দেখতুম, তার এ আকর্ষণের জোর কত – সে সত্যি আমায় ভালোবাসে, না একটু করুণা করে না ওটা মোহ? ওই দূরে সরে যাবার আর একটা কারণ ছিল যে, আমাদের কাউকে যেন কোনো দিন অনুতাপ করতে না হয় শেষে কোনো ভুলের জন্যে।

আমার এক জায়গায় বড়ো দুর্বলতা আছে। স্নেহের হাতে আমার মতো এমন করে কেউ বুঝি আত্মসমর্পণ করতে পারে না। তাই কেউ স্নেহ করছে বুঝলেই অমনি বাঁধা পড়বার ভয়ে আমি পালিয়ে যেতুম। ওই দূরে গিয়ে কিন্তু অনেকেরই ভুল ধরা পড়ে গেছে। অনেকেই নাকি আমায় ভালোবেসেছিল, কিন্তু তাদের সকলেরই মনের মিথ্যেটা আমি দেখতে পেয়েছিলুম ওই দূরে সরে গিয়েই। তাদের কেউ আমায় তার জীবন ভরে পেতে চায়নি। আমি পথিক, তাই পথের মাঝে আমায় একটু ক্ষণের জন্যে পেতে চেয়েছিল মাত্র। তাই কেউ আমায় কোনদিনই তার হাতের নাগালের মধ্যেও পেলে না। অনেকে বলে হয়তো এটাও আমার অভিমান। জানি না। কিন্তু দু-এক জায়গায় একটু আত্মবিস্মৃত হয়ে যেই নিকটে আসতে চেয়েছি, অমনি সে আমার দেবতার – আমার ভালোবাসার বুকে জোর পদাঘাত করেছে। তবু কি তুমি বলবে, ও আমার অহেতুক অভিমান?

এইখানে একটা কথা মনে রেখো কিন্তু যে, এই যে যারা আমায় পেতে চেয়েছিল, তাদের সকলেই আগে আমায় ভালোবেসেছিল, আমি কখনও তাদের ভালোবাসিনি। অত পেয়েও আমার মন চিরদিন বলে এসেছে , – এ নহে, এ নহে।

হায় আমার অতৃপ্ত হিয়া! কাকে চাস তুই? কে সে তোর প্রিয়তমা? কে সে গরবিনী, কোথায় কোন্ আঙিনা-তলে তোর তরে মালা-হাতে দাঁড়িয়ে রে?…আমার মনের যে মানসী প্রিয়া, তাকে না পেয়েই তো কাউকে ভালোবাসতে পারলুম না এ জীবনে। কতগুলো কচি বুকই না দলে গেলুম আমার এই জীবনের আরম্ভ হতে না হতেই, তা ভেবে আজ আর আমার কষ্টের অন্ত নেই। তবে আমার এইটুকু সান্ত্বনা যে, আমি কারুর ভালোবাসার অপমান করিনি। কাউকে ভালোবেসেছি বলে প্রলোভন দেখিয়ে শেষে পথে ফেলে চলে যাইনি। উলটো তাদের কাছে দু-হাত জুড়ে ক্ষমাই চেয়েছি, অমনি করে সুদূর থেকেই। আমায় ভালো না বাসতে অনুরোধ করে তার পথ হতে চিরদিনের মতো সরে গিয়েছি। পাছে কোনোদিন কোনো কাজে তার বাধা পড়ে, সেই ভয়ে আর কোনোদিন তার পথের পাশ দিয়েও চলিনি। অনেকে আমায় অভিশাপও দিয়েছে আমার এই নির্মমতার জন্যে, অনেকে আবার অহংকারী দর্পী বলে গালও দিয়েছে।

এমনই করে বিজয়ী বীরের মতো আপন মনে পথে-বিপথে আমার রথ চালিয়ে বেড়াচ্ছিলুম। এমন সময় একদিন সকালে তোমায় আমায় দেখা। হঠাৎ আমার রথ থেমে গেল! আমার মন কী এক বিপুল সুখে আনন্দ-ধ্বনি করে উঠল, – পেয়েছি, পেয়েছি। আমার মনের পথিক-বন্ধু হঠাৎ ম্লান মুখে আমার সামনে এসে বললে – বন্ধু বিদায়! আর তুমি আমার নও; এখন তুমি তোমার মানসীর! তোমার পথের শেষ হয়েছে! দেখলুম, সে পথের শেষে দিগন্তের আঁধারে মিলিয়ে গেল।

এতদিন আমায় শত সাধ্য-সাধনা করেও পথিক-বালারা আমার রথ থামাতে পারেনি, কতজন রথের চাকার সামনে বুক পেতে শুয়ে পড়েছে, আমি হাসতে হাসতে তাদের বুকের উপর দিয়ে রথ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু হায়, আজ আমার এ কী হল? রথ যে আর চলে না! তুমি শুধু আমার পানে চোখ তুলে চাইলে মাত্র, একটু সাধলেও না যে, পথিক! আমার দ্বারে একটু থামো!

তবু আমার দুঃখ হল না, মান-অপমান জ্ঞান রইল না, আমি মালা-হাতে রথ থেকে নেমে পড়লুম। তোমার গলায় আমার জন্ম-জন্মের সাধের গাঁথা মালা পরিয়ে দিলুম। তুমি নীরবে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলে। তোমার ওই মৌন বুকের ভাষা বুঝতে পারলুম না। প্রাণ যেন কেমন করে উঠল। তুমি সুখী হলে, না ব্যথা পেলে, কিছুই বোঝা গেল না। অমনি চির-অভিমানী আমার বুকে বড়োই বাজল। ভগবান কেন অন্যের মনটি দেখবার শক্তি দেননি মানুষকে? কিন্তু তোমার প্রতি অভিমান আমার যতই হোক, তোমাকে নালিশ করবার কিছুই ছিল না আমার (আজও নেই)। আমি যে তোমার মনটি না জেনেই তোমায় ভালোবেসেছি। চিরদিন জয় করে ফিরে তোমার গলায় যে হার-মানা হার পরিয়েছি – তুমি যে আমার মানসী প্রিয়া। আমার মনে-মনে জন্ম-জন্মান্তর ধরে যে ছবি আঁকা ছিল, যাকে খুঁজতে এমন করে আমার এমন চিরন্তন-পথিক বেশ, সে-মানসীকে দেখেই চিনে নিয়েছি। তাই আমি একটুক্ষণের জন্যেও ভেবে দেখিনি, তুমিও এ পরাজিত বিদ্রোহীর নৈবেদ্য-মালা হেসে গ্রহণ করবে, না পায়ে ঠেলে চলে যাবে। তুমি আমায় ভালো না বাসতে পার, তার জন্যে তো তোমায় দোষ দিতে পারিনে। আমি জানি,খুব জানি প্রিয়, যে কোনো মানুষেরই মন তার অধীন নয়। সে যাকে ভালোবাসতে চায়, যাকে ভালোবাসা কর্তব্য মনে করে, মন তাকে কিছুতেই ভালোবাসবে না। মন তার মনের মানুষের জন্যে নিরন্তর কেঁদে মরছে, সে অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। কত জন্ম ধরে তোমায় খুঁজে বেড়িয়েছি এমনই করে, তুমি কিন্তু ধরা দাওনি। এবারেও ধরা দিলে না। কখন কোন্ জন্মে কোন্ নাম-হারা গাঁয়ের পাশে তোমায় আমায় ঘর বাঁধব, কখন তুমি আমায় ভালোবাসবে জানি নে। তবু আমি তোমায় ভালোবাসি, তাই আমার এত বিপুল অভিমান তোমার উপর।

ধরো, আমার এ-অভিমান যদি মিথ্যে হয়, যদি সত্যিই তুমি আমায় ভালোবাস, তা হলে হয়তো মনে করবে যে, আমি কেন তোমায় ভুল বুঝে এমন করে কষ্ট পাচ্ছি। কেন তোমাকে এমন করে ব্যথা দিচ্ছি। সেই কথাটি জানবার জন্যেই কাল সারা রাত্তির ধরে তোমার দয়ার দান চিঠিকটি নিয়ে হাজার বার করে পড়েছি, কিন্তু হায়, তাতেও এমন কিছু পেলুম না, যাতে করে আমার এ নির্মম ধারণা, কঠোর বিশ্বাস দূর হয়ে যেতে পারে। আমার দুঃখে, আমার বেদনায় করুণা-বিগলিত হৃদয়ে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছ, অনেক কিছু লিখেছ, অনেক জায়গায় পড়তে পড়তে চোখের জলও বাধা মানে না, কিন্তু ‘তোমায় আমি ভালোবাসি’ এই কথাটি কোথাও লেখনি – ভুলেও না। ওই কথাটি ঢাকবার জন্যে যে সলজ্জ কুণ্ঠা বা আকুলতা, তাও নেই কোনো চিঠির কোনোখানটিতেই। হায় রে অন্ধ বিশ্বাস আমার! তবু এতদিন কত অধিকার নিয়ে কত অভিমান করেই না তোমায় চিঠি দিয়ে এসেছি। সেই লজ্জায় সেই অপমানে আজ আমার বুকের বেদনা শতগুণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে, তবু কিন্তু আর তোমায় ছেড়ে দূরে চলে যেতে পারছিনে। এবার যে আমি আগে ভালোবেসেছি! যে আগে ভালোবাসে , প্রায়ই তার এই দুর্দশা এই লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তাই বড়ো দুঃখে আজ অবিশ্বাসী নাস্তিকের মতো এই বলে মরতে যাচ্ছি যে, পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই। ভালোবেসে ভালোবাসা পাওয়া যায় না এই অবহেলার মাটির ধরায়। মানুষ যে কত বড়ো ঘা খেয়ে অবিশ্বাসী নাস্তিক হয়, তা যে নাস্তিক হয়, সেই বোঝে। জানি যে ভালোবেসে আত্মদানেই তৃপ্তি। বিশ্বাসও করি যে, যাকে সত্যিকার ভালোবাসা যায়, সে অপমান আঘাত করলে হাজার ব্যথা দিলেও তাকে ভোলা যায় না। প্রিয়ের দেওয়া সেই ব্যথাও যেন সুখের মতোই প্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে এত প্রাণ-ঢালা ভালোবাসার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে প্রাণটা হা-হা করে কেঁদে ওঠে না, এ যে বলে, সে সত্যি কথা বলে না।

পুরুষ জন্ম-জন্ম সাধনা করেও নারীর মন পায় না। নারীর অন্তরের রহস্য বড়ো জটিল, বড়ো গোপন। নারী সব দিতে পারে, কিন্তু তার মনের গোপন মঞ্জুষার কুঞ্জিকাটি যেন কিছুতেও দিতে চায় না। শুনেছি, কাউকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে তবে তার হাতে ওই চাবিকাঠিটি নাকি সমর্পণ করে। তোমার উপর আজ আমার এত অভিমান কেন জান? তুমি আমার সকল আদর সকল সোহাগ আমার দুরন্ত ভালোবাসার সকল বাড়াবাড়ি নীরবে সয়ে গেছ। কখনো এতটুকু প্রতিবাদ করনি। তোমার মুখ দেখে কোনোদিন বুঝতে পারিনি, তুমি আমার সে আদর-সোহাগে ব্যথা পেয়েছ, না সুখী হয়েছ। তোমার মুখে কোনোদিন এক রেখা হাসিও ফুটে উঠতে দেখিনি সে সময়। তাই আজ এই কথাটি ভাবতে বুক আমার ভেঙে পড়ছে যে, হয়তো তুমি দায়ে পড়েই আমার অত বাড়াবাড়ি নীরবে সয়েছ, হয়তো ওতে কত ব্যথাই পেয়েছ মনে মনে। কোনো চিঠিতে ও-কথাটির ভুলেও উল্লেখ করনি। তাই মনে হয়, ওটাকে কোনোরকমে চাপা দেওয়াই তোমার ইচ্ছা। আচ্ছা, তাই হোক! এইবার সকল ভুল সকল যাতনা চিরতরেই চাপা পড়বে, ফিরলেও আর সে-কথা কখনও তুলব না, না ফিরলে তো নয়ই। তাতে প্রাণ যত বেশিই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাক না কেন। যদি ফিরি, তবে আর একবার আত্মবিদ্রোহী হবার শেষ চেষ্টা করব। কিন্তু হায়! কার কাছে এ-কথা বলছি! কোন্ পাষাণ মৌন-নির্বাক দেবতা আমার এ তিক্ত ক্রন্দন শুনছে? যা বলছিলাম, তাই বলি।

আমি কেন সুখী হতে পারছিনে, জান? সাধারণ লোকের মতোন সহজ ভালোবাসায় তুষ্ট হতে পারছিনে বলে। আমারই চারি পাশে আর সক্কলে কেমন খাচ্ছে-দাচ্ছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছে আবার তখনই মিল হয়ে যাচ্ছে, – এমনই করে তাদের সুখে-দুঃখে বেশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই সাধারণের পথ ধরে চলতে পারি নে বলেই ওদের একজন হয়ে সুখী হওয়া তো দূরের কথা, অমনই অসুখীও হতে পারলুম না। ওরা বিয়ে করে , ছেলে-পিলে হয়, বড়ো হলে বে দেয়, জামাই-বউ ঘরে আসে, – ব্যাস, আর কী চাই? ওরই মধ্যে হাসে, কাঁদে, সব করে। ওরা ওতেই সুখী। ওরা যা পেয়েছে তাতেই তুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, বেচারাদের শতকরা নব্বই জনই যেন জানে না আর জানতে চায় না যে, যে-মানুষটিকে নিয়ে এতদিন ঘরকন্না করছে, সেই মানুষটির মনটিই তার নয়। দুইজনাই দুই জনের মন কোনোদিন বোঝেনি, বুঝবার দরকারও হয়নি। এত কাছাকাছি থেকেও তাই – মনের দেশে দুইজন দুইজনের সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই ফাঁকি আমার চোখে যে-দিন ধরা পড়েছে, সেই দিন থেকে আমি আর কাউকে সাথি করে ঘর বাঁধতে সাহস পাচ্ছিনে। সদা ভয় হয় আর ব্যথাও বাজে এই কথাটি ভাবতে যে, আমারই বুকে মাথা রেখে আমারই জীবন-সঙ্গিনী অন্যের কথা ভাববে, তার ব্যর্থ জীবনের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, আর আমি তারই কাছে আমার ভালোবাসার অভিনয় করে যাব, সেও দায়ে পড়ে দিব্যি সয়ে যাবে, – উঃ! এ-কথা ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে! আমি যাকে নিয়ে বাসা বাঁধব, আগে দেখে নেব তার মনের মানুষটি আমার মনের মানুষটিকে চিনেছে কিনা। তা যত জন্ম না হবে, তত জন্ম আমি হয় মায়ের লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে মায়ের কোলেই থাকব, নতুবা লোটা কম্‌লি নিয়ে এমনই বোম্-বোম্ করেই বেড়িয়ে বেড়াব।

আমি মানুষ দেখেই তার মনের কথা ধরে দিতে পারি বলে বড্ডো গর্ব করে এসেছি এতদিন, আর অনেক জায়গাতেই চিনেওছি ঠিক। কিন্তু তোমার কাছে যে এমন করে আমার সকল অহঙ্কার চোখের জলে ডুবে যাবে, তা কে জানত। সত্যই,

‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে ধরা পড়ে কে জানে।
সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়ানে।’

তা না হলে এতো বড়ো দুর্দান্ত দুর্বার আমাকেও তুমি আজ শিশুর মতোন করে কাঁদাচ্ছ! তুমি আর-সকলের কাছে এত সরল, আর আমার কাছেই কেন এত দুর্বোধ হয়ে পড়েছ, বলতে পারো লক্ষ্মীমণি? – হাঁ, একটি কথা নিবেদন করে রাখি এর মধ্যে, – যখন জীবনে বড্ডো ক্লান্ত হয়ে পড়বে তোমার ভালোবাসার অবমাননা দেখে, যখন দেখবে তোমার বুক-ভরা অভিমান পদাহত হয়ে ধুলোয় পড়ে লুটাচ্ছে, যখন নিরাশায় বুক ভেঙে যেতে চাইবে (ভগবান না করুন), সেদিন এই ভেবে সান্ত্বনা পেয়ো প্রিয় আমার, যে, এই দুঃখের সংসারেও অন্তত একজন ছিল, যে তোমায় বড়ো প্রাণ ভরে ভালোবেসেছিল। বিনিময়ে তার এক কণাও ভালোবাসা সে পায়নি, তবু সে এতটুকু ব্যথা রেখে যায়নি তোমার জন্যে, এমনকী কোনোদিন তোমার কাছে তা নিয়ে অনুযোগও করেনি। সে তোমায় পেলে মাথার মণি করে রাখত। তোমাকে রাজরাজেন্দ্রাণী করবার সকল ক্ষমতা, সকল সাধ তার ছিল। তোমার এত ভালোবাসা এত অভিমানের অধিকারী হলে সে এমন করে তার বিপুল আশা-আকাঙ্ক্ষা-ভরা উদ্দাম তরুণ জীবনকে এত অল্প দিনে ব্যর্থ করে এমন করে বিদায় নিত না। অনেক-অনেক বড়ো কিছু বিশ্বের বিস্ময় হতে পারত। বড়ো ব্যথায় তার সারা জীবনটা বিদ্রোহ আর স্বেচ্ছাচারিতা করেই কেটে গেল। আরও মনে করো যে, পরপারে গিয়েও সে শান্ত হতে পারেনি, চিরদিনের মতো এবারেও সে সেখানে তোমারই তরে মালা হাতে করে তার অশান্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে পথে পথে ঘুরে। তোমায় বুকে করে তুলে নেবার জন্যে সে সকল সময় তোমার পানে তার সকল প্রাণ-মন নিয়োজিত করে রেখেছে। সে যে তোমায় সত্যিই ভালোবাসে, তাই প্রমাণ করতে সে তার নিজের গর্দানে নিজে খড়্গ হেনে মরেছে! আরও মনে করো সেই দিন, যাকে তুমি একদিন মনে মনে তোমার সুখের পথের কাঁটা, তোমার জীবনের অভিশাপ মনে করেছিলে, সে-ই তোমার সকল অকল্যাণ সকল অমঙ্গল থেকে বাঁচাবার জন্যেই চিরদিনের মতো তোমার পথ হতে সরে গিয়েছে। মনে করো, যাকে তুমি অনাদর করেছ, তার এককণা ভালোবাসা পাবার জন্যে বহু হতভাগিনি বহুদিন ধরে সাধনা করেছিল, কিন্তু সে কোনোদিন তার মানসী-প্রিয়া – তোমায় ছাড়া আর কারুর পানে একটু হেসেও চাইতে পারেনি, পাছে তোমার অভিমান হয়, পাছে তুমি ব্যথা পাও ভেবে।

আর একটা ছোটো কথা এইখানেই মনে পড়ে গেল। শুনে তুমি হয়তো আমায় কী ভাববে, জানি না। তোমার বিরুদ্ধে যে-যে কারণে আজ এত বড়ো বুক-জোড়া অভিমান নিয়ে যাচ্ছি, এটাও তারই একটা। সেটা আর কিছু নয়, কাল চিঠিগুলো তোমার পড়তে পড়তে হঠাৎ ও-কথাটা মনে পড়ে গেল। তুমি জান, আমি বড্ড হিংসুটে। তোমায় অন্যে ভালোবাসবে, এ-চিন্তাটাও সইতে পারিনে, দেখতে পারা তো দূরের কথা। সকলে তোমার খুব প্রশংসা করুক, তোমায় ভালো বলুক, তাতে খুবই আনন্দ আর গৌরব অনুভব করব, কিন্তু তাই বলে অন্যকে তোমায় ভালোবাসতে তো দিতে পারিনে। আমি চাই, তুমি একা আমার – শুধু আমার – ভিতরে বাইরে পরিপূর্ণরূপে আমার হও, আর আমিও পূর্ণরূপে তোমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সুখী হই। আমি ছাড়া তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না – কখনই না, কিছুতেই না। তাই যখনই দেখেছি যে, অন্যে তোমার দিকে একটু চেয়ে দেখেছে আর তুমিও তার পানে হেসে চেয়েছ, অমনি মনে হয়েছে এক্ষুণি গিয়ে তার বুকে ছোরা বসিয়ে দিই। কিন্তু ভগবান তোমাকে রূপ আর গুণ এত অপর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েছেন যে, তোমায় দেখেই লোকে ভালোবেসে ফেলে। তোমাকে ভালোবাসা-পিয়াসী তৃষাতুর মানুষের মন যে ভালো না বেসেই পারে না। তাই কতদিন মনে হয়েছে যে, তোমাকে নিয়ে এমন বিজন বনে পালাই, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। চোখ মেললেই আমি তোমাকে দেখব, তুমি আমাকে দেখবে। আমার এ যেন রাহুর প্রেম। নয়? আমায় ছেড়ে অন্যকে তুমি ভালোবাসবে, আমার এই ব্যথাটাই সব চেয়ে মর্মন্তুদ। তাই তো এমন করে তোমার কাছে যাচ্ঞা করে এসেছি যে, আমার চেয়ে বেশি ভালো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না – পারবে না। কিন্তু তুমি আমার অত সকরুণ মিনতি শুনেও কোনোদিন কথা কয়ে তা জানাওনি, একটু মিথ্যা করে মাথা দুলিয়েও বলনি, যে, হাঁ গো হাঁ। … শুধু নিস্তব্ধ মৌন হয়ে গেছ। তোমার তখনকার ভাবের মানেটা আজও বুঝতে পারছিনে বলেই আমার এত প্রাণপোড়ানি আর ছটফটানি। আজ আমি বড়ো সুখে মরতে পারতাম, যদি আমার এই চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ির ক্ষণেও জানতে পারতাম তোমার সত্যিকার মনের কথা। এখন জানাতে চাইলেও হয়তো আর জানাতে পারবে না। যদিই পারতে, তাহলে হয়তো চির-হতভাগ্য বলে একটু করুণা করে আমায় অনেক কিছু সিক্ত সান্ত্বনা দিয়ে আমায় প্রবোধ দিতে, কিন্তু হায় প্রিয় আমার, এ মৃত্যুপথের পথিককে আর ভুলাতে পারতে না, সে সুযোগ তাই আমি ইচ্ছে করেই দিলাম না তোমায়। যখন তুমি আমার এই চিঠি পড়বে, তখন আমি তোমার নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ব। দেখো, আমার আজ মনে হচ্ছে পুরুষদের মতোন বোকা ভ্যাবাকান্ত আর নেই, অন্তত মেয়েদের কাছে। পুরুষ যেমন করে ভালোবাসা পাবার জন্যে হা-হা করে উন্মাদের মতোন ছুটে যায়, তা দেখে মনে হয়, এর এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা বুঝি স্বয়ং ভগবানও মেটাতে পারবে না, কিন্তু তাকে একটি ছোট্ট মিষ্টি কথা দিয়ে তোমরা এমনই ভুলিয়ে দিতে পার যে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। এত বড়ো দুর্দান্ত দুর্বিনীতকে ওই একটু মিষ্টি করে ‘লক্ষ্মীটি’ বলে একটু কপালে গিয়ে হাতটি রাখলে, বা গিয়ে তার হাতটি ধরলেই সে যত দূর হতে-পারা-সম্ভব সুশীল সুবোধ বালকটির মতোন শান্ত হয়ে পড়ে। তোমার মনে কী আছে তা ভেবে দেখতে চায় না, ওই একটু পেয়েই ভালোবাসার কাঙাল পুরুষ এত বেশি বিভোর হয়ে পড়ে। তবু তোমরা এই বেচারা হতভাগা পুরুষদের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধরা দাও না। কিছুতেই তোমাদের মনের কথাটি পাওয়া যায় না, সব ভালোবাসাটুকু পাওয়ার আশা তো মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই। কোথায় যেন তোমাদের মনের সীমারেখা, কোথায় যেন তোমাদের ভালোবাসার তল, কোথায় যেন তার শেষ! আমি তাই অবাক হয়ে অনেক সময় ভাবি আর ভাবি! মনে কোরো না যে, এগুলো সকলেরই মনের ভাব। আমি আমার এখনকার মনের ভাবগুলো সোজাসুজি জানাচ্ছি। তোমার সঙ্গে তা না মিলতেও পারে। এমনি করে পুরুষ নারীর কাছে চিরদিন প্রতারিত হয়ে আসছে। কারণ, তারা বাইরে যতো বড়ো কর্মী বিদ্বান আর বীর হোক না কেন, তোমাদের কাছে তারা একের নম্বর বোকা, একেবারে ভেড়া বনে যায় বললেও অত্যুক্তি হয় না। তোমাদের কাছে থেকেও তোমাদের মন বুঝতে স্বয়ং ভগবান পারবে না, এ আমি আজ জোর গলায় বলছি। তোমরা নারী, তোমাদের স্বভাবই হচ্ছে স্নেহ করা, সেবা করা, যে কেউ হোক না কেন, তার দুঃখ দেখলে তোমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে, একটু সেবা করতে ইচ্ছা হয়। ওতে তোমাদের গভীর আত্মপ্রসাদ, নিবিড় তৃপ্তি। এইখানে তোমরা দেবী, সন্ন্যাসিনী। এই ব্যথিতের ব্যথা মুছাতে তোমরা সকল রকম ত্যাগ স্বীকার করতে পার, কিন্তু তাই বলে সবাইকে ভালোবাসতে পার না, আর ভালোবাসও না। এইখানে পুরুষ সাংঘাতিক ভুল করে বসে। তোমাদের ওই সেবা আর করুণাটুকু সে ভালোবাসা বলে ভুল করে দেখে, অবশ্য যদি সে তোমায় ভালোবেসে ফেলে। আর যাকে জান যে, সে সত্যি-সত্যিই তোমাকে বড়ো প্রাণ দিয়েই ভালোবাসে, অথচ তুমি কিছুতেই তাকে ভালোবাসতে পারছ না; তা হলে তার জন্যেও তুমি সকল রকম বাইরের ত্যাগ স্বীকার করতে পার, তার সেবা কর, শুশ্রূষা কর, তার ব্যথায় সান্ত্বনা দাও,




রাজবন্দীর জবানবন্দী
কাজী নজরুল ইসলাম
.....................................

আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। এক ধারে রাজার মুকুট; আর ধারে ধূমকেতুর শিখা। একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। রাজার পক্ষে_ নিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমার পক্ষে_ সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অন্তকাল ধরে সত্য_ জাগ্রত ভগবান।

আমার বিচারককে কেহ নিযুক্ত করে নাই। এ মহাবিচারকের দৃষ্টিতে রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, সুখী-দুঃখী সকলে সমান। এর সিংহাসনে রাজার মুকুট আর ভিখারির একতারা পাশাপাশি স্থান পায়। এঁর আইন_ ন্যায়, ধর্ম। সে-আইন কোনো বিজেতা মানব কোনো বিজিত বিশিষ্ট জাতির জন্য তৈরি করে নাই। সে-আইন বিশ্ব-মানবের সত্য উপলব্ধি হতে সৃষ্ট; সে-আইন সার্বজনীন সত্যের, সে-আইন সার্বভৌমিক ভগবানের। রাজার পক্ষে_ পরমাণু পরিমাণ খণ্ড-সৃষ্টি; আমার পক্ষে_ আদি অন্তহীন অখণ্ড স্রষ্টা।

রাজার পেছনে_ ক্ষুদ্র, আমার পেছনে_ রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তাঁর লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি তাঁর লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ। রাজার বাণী বুদ্বুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র। আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে-বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে-বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে-বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য-স্বরূপ।

সত্য স্বয়ংপ্রকাশ। তাহাকে কোনো রক্ত-আঁখি রাজ-দণ্ড নিরোধ করতে পারে না। আমি সেই চিরন্তন স্বয়ম-প্রকাশের বাণী, যে বীণায় চির-সত্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছিল। আমি ভগবানের হাতের বীণা। বীণা ভাঙলেও ভাঙতে পারে, কিন্তু ভগবানকে ভাঙবে কে? একথা ধ্রুব সত্য যে, সত্য আছে, ভগবান আছেন_ চিরকাল ধরে আছে এবং চিরকাল ধরে থাকবে। যে আজ সত্যের বাণী রুদ্ধ করছে, সত্যের বাণীকে মূক করতে চাচ্ছে, সেও তাঁরই এক ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র সৃষ্টি অণু। তারই ইঙ্গিত-আভাসে, ইচ্ছায় সে আজ আছে, কাল হয়ত থাকবে না। নির্বোধ মানুষের অহঙ্কারের আর অন্ত নাই; সে যাহার সৃষ্টি, তাহাকেই সে বন্দী করতে চায়, শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু অহঙ্কার একদিন চোখের জলে ডুব্বেই ডুব্বে!

যাক, আমি বলছিলাম, আমি সত্য প্রকাশের যন্ত্র। সে-যন্ত্রকে অপর কোনো নির্মম শক্তি অবরুদ্ধ করলেও করতে পারে, ধ্বংস করলেও করতে পারে; কিন্তু সে-যন্ত্রে যিনি বাজান, সে-বীণায় যিনি রুদ্র-বাণী ফোটান, তাঁকে অবরুদ্ধ করবে কে? সে বিধাতাকে বিনাশ করবে কে? আমি মর, কিন্তু আমার বিধাতা অমর। আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মতন অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে, আবার এমনি অভিযোগ আনয়নকারী বহু রাজাও মরেছে, কিন্তু কোনো কালে কোনো কারণেই সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি_ তার বাণী মরেনি। সে আজও তেমনি ক'রে নিজেকে প্রকাশ করছে এবং চিরকাল ধরে করবে। আমার এই শাসন-নিরুদ্ধ বাণী আবার অন্যের কণ্ঠে ফুটে উঠবে। আমার হাতের বাঁশি কেড়ে নিলেই সে বাঁশির সুরের মৃত্যু হবে না; কেননা আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সুর ফোটাতে পারি। সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং আমার বাঁশি সৃষ্টির কৌশলে। অতএব দোষ বাঁশিরও নয় সুরেরও নয়; দোষ আমার, যে বাজায়; তেমনি যে বাণী আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে, তার জন্য দায়ী আমি নই। দোষ আমারও নয়, আমার বীণারও নয়; দোষ তাঁর যিনি আমার কণ্ঠে তাঁর বীণা বাজান। সুতরাং রাজবিদ্রোহী আমি নই; প্রধান রাজবিদ্রোহী সেই বীণা-বাদক ভগবান। তাঁকে শাস্তি দিবার মতো রাজ-শক্তি বা দ্বিতীয় ভগবান নাই। তাঁহাকে বন্দী করবার মতো পুলিশ বা কারাগার আজও সৃষ্টি হয় নাই।

রাজার নিযুক্ত রাজ-অনুবাদক রাজভাষায় সে-বাণীর শুধু ভাষাকে অনুবাদ করেছে, তাঁর প্রাণকে অনুবাদ করেনি। তাঁর অনুবাদে রাজ-বিদ্রোহ ফুটে উঠেছে, কেননা তার উদ্দেশ্য রাজাকে সন্তুষ্ট করা, আর আমার লেখায় ফুটে উঠেছে সত্য, তেজ আর প্রাণ। কেননা আমার উদ্দেশ্য ভগবানকে পূজা করা; উৎপীড়িত আর্ত বিশ্ববাসীর পক্ষে আমি সত্য তরবারি, ভগবানের আঁখিজল। আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধ বিদ্রোহ করেছি। আমি জানি এবং দেখেছি_ আজ এই আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় একা আমি দাঁড়িয়ে নেই, আমার পশ্চাতে স্বয়ং সত্যসুন্দর ভগবানও দাঁড়িয়ে। যুগে যুগে তিনি এমনি নীরবে তাঁর রাজবন্দী সত্য-সৈনিকের পশ্চাতে এসে দণ্ডায়মান হন। রাজনিযুক্ত বিচারক সত্য বিচারক হতে পারে না। এমনি বিচার-প্রহসন করে যেদিন খ্রিস্টকে ত্রুক্রশে বিদ্ধ করা হল, গান্ধীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল, সেদিনও ভগবান এমনি নীরবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের পশ্চাতে। বিচারক কিন্তু তাঁকে দেখতে পায়নি, তার আর ভগবানের মধ্যে তখন সম্রাট দাঁড়িয়েছিলেন, সম্রাটের ভয়ে তার বিবেক, তার দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গেছিল। নইলে সে তার ঐ বিচারাসনে ভয়ে বিস্ময়ে থরথর করে কেঁপে উঠত, নীল হয়ে যেত, তার বিচারাসন সমেত সে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
বিচারক জানে আমি যা বলেছি, যা লিখেছি তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু তবু হয়ত সে শাস্তি দেবে, কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য।
তবু জিজ্ঞাসা করছি_ এই যে বিচারাসন_ এ কার? রাজার, না ধর্মের? এই যে বিচারক, এর বিচারের জবাবদিহি করতে হয় রাজাকে, না তার অন্তরের আসনে প্রতিষ্ঠিত বিবেককে, সত্যকে, ভগবানকে? এই বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? রাজা না ভগবান? অর্থ না আত্মপ্রসাদ?

শুনেছি, আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকট। কিন্তু বেলাশেষের শেষ-খেয়া এ প্রবীণ বিচারককে হাতছানি দিচ্ছে, আর রক্ত-ঊষার নব-শঙ্খ আমার অনাগত বিপুলতাকে অভ্যর্থনা কচ্ছে; তাকে ডাকছে মরণ, আমায় ডাকছে জীবন; তাই আমাদের উভয়ের অস্ত-তারা আর উদয়-তারার মিলন হবে কি-না বলতে পারি না। না, আবার বাজে কথা বললাম।

আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো_ একি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এতদিন হয়েছিল, হয়ত সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত-আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে। এই অন্যায় শাসন-ক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী? এ ক্রন্দন কি একা আমার? না_ এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল-নীরব ক্রন্দসীর সম্মিলিত সরব প্রকাশ? আমি জানি, আমার কণ্ঠের ঐ প্রলয়-হুঙ্কার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আত্মার যন্ত্রণা-চিৎকার। আমায় ভয় দেখিয়ে মেরে এ ক্রন্দন থামানো যাবে না। হঠাৎ কখন আমার কণ্ঠের এই হারাবাণীই তাদের আরেক জনের কণ্ঠে গর্জন করে উঠবে। আজ ভারত পরাধীন না হয়ে যদি ইংল্যান্ডই ভারতের অধীন হতো এবং নিরস্ত্রীকৃত উৎপীড়িত ইংল্যান্ড-অধিবাসীবৃন্দ স্বীয় জন্মভূমি উদ্ধার করবার জন্য বর্তমান ভারতবাসীর মতো অধীর হয়ে উঠত, আর ঠিক সেই সময় আমি হতুম এমনি বিচারক এবং আমার মতোই রাজদ্রোহ অপরাধে ধৃত হয়ে এই বিচারক আমার সম্মুখে বিচারার্থ নীত হতেন, তাহলে সে সময় এই বিচারক আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বলতেন, আমিও তাই এবং তেমনি করেই বলছি।

আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, _কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই, _আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, _তার জন্য ঘরে-বাইরের বিদ্রূপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার উপর অপর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই, নিজের সাধনালব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই, কেননা আমি যে ভগবানের প্রিয়, সত্যের হাতের বীণা; আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা। আমি অজানা অসীম পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। এ আমার অহঙ্কার নয়, আত্ম-উপলব্ধির আত্ম-বিশ্বাসের চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি। আমি অন্ধ-বিশ্বাসে, লাভের লোভে, রাজভয় বা লোকভয়ে মিথ্যাকে স্বীকার করতে পারি না। অত্যাচারকে মেনে নিতে পারি না। তাহলে যে আমার দেবতা আমায় ত্যাগ করে যাবে। আমার এই দেহ-মন্দিরে জাগ্রত দেবতার আসন বলেই তো লোকে এ-মন্দিরকে পূজা করে, শ্রদ্ধা দেখায়, কিন্তু দেবতা বিদায় নিলে এ শূন্য মন্দিরের আর থাকবে কী? একে শুধাবে কে? তাই আমার কণ্ঠে কাল-ভৈরবের প্রলয়-তূর্য বেজে উঠেছিল; আমার হাতের ধূমকেতুর অগি্ন-নিশান, দুলে উঠেছিল, সে সর্বনাশা নিশান-পুচ্ছে মন্দিরের দেবতা নট-নারায়ণ রূপ ধরে ধ্বংস-নাচন নেচেছিল। এ ধ্বংস-নৃত্য সব সৃষ্টির পূর্ব-সূচনা। তাই আমি নির্মম নির্ভীক উন্নত শিরে সে নিশান ধরেছিলাম, তাঁর তূর্য বাজিয়েছিলাম। অনাগত অবশ্যম্ভাবী মহারুদ্রের তীব্র আহ্বান আমি শুনেছিলাম, তাঁর রক্ত-আঁখির হুকুম আমি ইঙ্গিতে বুঝেছিলাম। আমি তখনই বুঝেছিলাম, আমি সত্য রক্ষার, ন্যায় উদ্ধারের বিশ্ব-প্রলয় বাহিনীর লাল সৈনিক। বাংলার শ্যাম শ্মশানের মায়া নিদ্রিত ভূমে আমায় তিনি পাঠিয়েছিলেন অগ্রদূত তূর্যবাদক করে। আমি সামান্য সৈনিক, যতটুকু ক্ষমতা ছিল তা দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করেছি। তিনি জানতেন ... ... প্রথম আঘাত আমার বুকেই বাজবে, তাই আমি এবারকার প্রলয় ঘোষণার সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিক মনে করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেছি। কারাগার-মুক্ত হয়ে আমি আবার যখন আঘাত-চিহ্নিত বুকে, লাঞ্ছনা-রক্ত ললাটে, তাঁর মরণ-বাঁচা-চরণমূলে গিয়ে লুটিয়ে পড়ব, তখন তাঁর সকরুণ প্রসাদ চাওয়ার মৃত্যুঞ্জয় সঞ্জীবনী আমায় শ্রান্ত, আমায় সঞ্জীবিত অনুপ্রাণিত করে তুলবে। সেদিন নতুন আদেশ মাথায় করে নতুন প্রেরণা-উদ্বুদ্ধ আমি, আবার তাঁর তরবারি-ছায়াতলে গিয়ে দণ্ডায়মান হব। সেই আজো-না-আসা রক্ত ঊষার আশা, আনন্দ, আমার কারাবাসকে_ অমৃতের পুত্র আমি, হাসিগানের কলোচ্ছ্বাসে স্বর্গ ক'রে তুলবে। চিরশিশু প্রাণের উচ্ছল আনন্দের পরশমণি দিয়ে নির্যাতন লোহাকে মণিকাঞ্চনে পরিণত করবার শক্তি ভগবান আমায় না চাইতেই দিয়েছেন। আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই; কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন। আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ-পীড়া নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগি্ন-মশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে। আমার বহ্নি-এরোপ্লেনের সারথি হবেন এবার স্বয়ং রুদ্র ভগবান। অতএব, মাভৈঃ, ভয় নাই।

কারাগারে আমার বন্দিনী মায়ের আঁধার-শান্ত কোল এ অকৃতী পুত্রকে ডাক দিয়েছে। পরাধীন অনাথিনী জননীর বুকে এ হতভাগ্যের স্থান হবে কি না জানি না, যদি হয় বিচারককে অশ্রু-সিক্ত ধন্যবাদ দিব। আবার বলছি, আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই। আমি 'অমৃতস্য পুত্রঃ' আমি জানি_

ঐ অত্যাচারীর সত্য পীড়ন
আছে তার আছে ক্ষয়;
সেই সত্য আমার ভাগ্য-বিধাতা
যার হাতে শুধু রয়।'

প্রেসিডেন্সি জেল, কলিকাতা।
৭ই জানুয়ারি, ১৯২৩।
রবিবার_দুপুর।





হিন্দু-মুসলমান - কাজী নজরুল ইসলাম
 
একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সংগে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?
হিন্দু-মুসলমানের কথা উঠলে আমার বারেবারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে, যে এ ন্যাজ গজালো কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? ঐ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদের গজায় – তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক – তারাই হয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে – শৃঙ্গ রুপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে – যাদের হিংস্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি! শিংওয়ালা গরু-মহিষের চেয়ে শৃঙ্গহীন ব্যাঘ্র-ভল্লুক জাতীয় পশুগুলো বেশী ভীষণ। এ হিসেবে মানুষও পড়ে ঐ শৃঙ্গহীন বাঘ-ভালুকের দলে। কিন্তু, বাঘ-ভালুকের তবু ন্যাজটা বাইরে, তাই হয়তো রক্ষে। কেননা, ন্যাজ আর শিং দুই ভেতরে থাকলে কী রকম হিংস্র হয়ে উঠতে হয়, তা হিন্দু-মুসলমানের ছোরা-মারা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। যে প্রশ্ন করেছিলাম এই যে ভিতরের ন্যাজ, এর উদ্ভব কোথায়? আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে। টিকিপুর আর দাড়িস্তানেই বুঝি এর আদি জন্মভূমি। পশু সাজবার মানুষের “আদিম” দুরন্ত ইচ্ছা। ন্যাজ গজাল না ব’লে তারা টিকি দাড়ি জন্মিয়ে যেন সান্তনা পেল। সে দিন মানব-মনের পশু-জগতে না জানি কী উত্সবই সারা পড়েছিল, যে দিন ন্যাজের বদলে তারা দাড়ি-টিকির মত কোনো কিছু একটা আবিষ্কার করলে।
মানুষের চিরন্তন আত্মীয়তাকে এমনি ক’রে বৈরিতায় পরিণত করা হ’ল দেওয়ালের পর দেওয়াল খাড়া ক’রে। ধর্মের সত্যকে সওয়া যায়, কিন্তু শাস্ত্র যুগে যুগে অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলেই তার বিরুদ্ধে যুগে যুগে মানুষও বিদ্রোহ করছে। হিন্দুত্ব-মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা, ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব-হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিত্ব! তেমনি দাড়িও-ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব! এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি! আজ যে মারামারি বেধেছে, সেটাও এই পন্ডিত-মোল্লার মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়। নারায়নের গদা আর আল্লার তলোয়ার কোনোদিনই ঠোকাঠুকি বাঁধবে না, কারণ তাঁরা দুইজনেই এক, তাঁর এক হাতের অস্ত্র তাঁরই আর এক হাতের ওপর পড়বে না। তিনি সর্বনাম, সকল নাম গিয়ে মিশেছে ওঁর মধ্যে। এত মারামরির মধ্যে এইটুকুই ভরসার কথা যে, আল্লা ওর্ফে নারায়ণ হিন্দু নন মুসলমানও নন। তাঁর টিকিও নেই, দাড়িও নেই। একেবারে “ক্লিন”। টিকি-দাড়ির ওপর আমার এত আক্রোশ এই জন্য যে, এরা সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষকে যে, তুই আলাদা আমি আলাদা। মানুষকে তার চিরন্তন রক্তের সম্পর্ক ভুলিয়ে দেয় এই বাইরের চিহ্নগুলো।
অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি — আলোর মত, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তরা বললে, কৃষ্ণ হিন্দুর, মুহম্মদের ভক্তেরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানদের, খ্রীস্টের শিষ্যরা বললে, খ্রীস্ট ক্রীশ্চানদের। কৃষ্ণ-মুহম্মদ-খ্রীস্ট হয়ে উঠলেন জাতীয় সম্পত্তি! আর এই সম্পত্তিত্ব নিয়েই যত বিপত্তি। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করে না মানুষে, গরু-ছাগল নিয়ে করে। বেশ মনে আছে ছেলেবেলায় আমরা সূর্য নিয়ে ঝগড়া করতাম। এ বলত আমাদের পাড়ায় সূর্য বড়; ও বলতো আমাদের পাড়ায় সূর্য বড়! আমাদের গভীর বিশ্বাস ছিল, প্রত্যেক পাড়ায় আলাদা আলাদা সূর্য ওঠে। স্রষ্টা নিয়েও ঝগড়া চলেছে সেই রকম। এ বলছে আমাদের আল্লা; ও বলছে আমাদের হরি। স্রষ্টা যেন গরু-ছাগল! আর তার বিচারের ভার পড়েছে জাষ্টিস সার আবদুর রহিম, পন্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রভৃতির ওপর! আর বিচারের ফল মেডিক্যাল কলেজ গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে!
নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু — তার জন্য ত তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ন হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়ছি —আমারই মত একজন মানুষকে’।
কিন্তু আজ দেখচি কি? ছোরা খেয়ে যখন খায়রু মিঞা পড়ল, আর তাকে যখন তুলতে গেল হালিম, তখন ভদ্র সম্প্রদায় হিন্দুরাই ছুটে আসলেন, “মশাই করেন কি? মোচলমানকে তুলছেন! মরুক ব্যাটা!” তারা ‘অজাতশ্মশ্রু’ হালিমকে দেখে চিনতে পারেনি যে সে মুসলমান। খায়রু মিঞার দাড়ি ছিল। ছোরা খেয়ে যখন ভুজালি সিং পড়ল পথের উপর তাকে তুলতে গিয়ে তুর্কীছাট-দাড়ি শশধর বাবুরও ঐ অবস্থা!
মানুষ আজ পশুতে পরিণত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজ গজিয়েছে ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে লুঙ্গিকে, মারছে নেঙ্গোটিকে; মারছে টিকিকে, দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মুর্খদের মারামারির কি অবসর নেই।
মানুষ কি এমনি অন্ধ হবে যে, সুনীতিবাবু হ’য়ে উঠবেন হিন্দুসভার সেক্রেটারী এবং মুজিবর রহমান সাহেব হবে তঞ্জিম তবলিগের প্রেসিডেন্ট?
রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম, একটা বলদ যাচ্ছে, তার ন্যাজটা গেছে খসে। ওরই সাথে দেখলাম, আমার অতি বড় উদার বিলেত-ফেরত বন্ধুর মাথায় এক য়্যাব্বড় টিকি গজিয়েছে।
মনে হ’ল পশুর ন্যাজ খসছে আর মানুষের গজাচ্ছে।




অপরাধ শুধু মনে থাক
কাজী নজরুল ইসলাম 
 
মোর অপরাধ শুধু মনে থাক!
আমি হাসি, তার আগুনে আমারই
অন্তর হোক পুড়ে খাক!
অপরাধ শুধু মনে থাক!
নিশীথের মোর অশ্রুর রেখা
প্রভাতে কপোলে যদি যায় দেখা,
তুমি পড়িয়ো না সে গোপন লেখা
গোপনে সে লেখা মুছে যাক
অপরাধ শুধু মনে থাক!
এ উপগ্রহ কলঙ্ক-ভরা
তবু ঘুরে ঘিরি তোমারই এ ধরা,
লইয়া আপন দুখের পসরা
আপনি সে খাক ঘুরপাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক!
জ্যোৎস্না তাহার তোমার ধরায়
যদি গো এতই বেদনা জাগায়,
তোমার বনের লতায় পাতায়
কালো মেঘে তার আলো ছাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক!
তোমার পাখির ভুলাইতে গান
আমি তো আসিনি, হানিনি তো বাণ,
আমি তো চাহিনি কোনো প্রতিদান,
এসে চলে গেছি নির্বাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক।
কত তারা কাঁদে কত গ্রহে চেয়ে
ছুটে দিশাহারা ব্যোমপথ বেয়ে,
তেমনই একাকী চলি গান গেয়ে
তোমারে দিইনি পিছু-ডাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক!
কত ঝরে ফুল, কত খসে তারা,
কত সে পাষাণে শুকায় ফোয়ারা,
কত নদী হয় আধ-পথে হারা,
তেমনই এ স্মৃতি লোপ পাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক!
আঙিনায় তুমি ফুটেছিলে ফুল
এ দূর পবন করেছিল ভুল,
শ্বাস ফেলে চলে যাবে সে আকুল –
তব শাখে পাখি গান গাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক!
প্রিয় মোর প্রিয়, মোরই অপরাধ,
কেন জেগেছিল এত আশা সাধ!
যত ভালোবাসা, তত পরমাদ,
কেন ছুঁইলাম ফুল-শাখ।
অপরাধ শুধু মনে থাক!
আলোয়ার মতো নিভি,পুনঃ জ্বলি,
তুমি এসেছিলে শুধু কুতূহলী,
আলেয়াও কাঁদে কারও পিছে চলি –
এ কাহিনি নব মুছে যাক।
অপরাধ শুধু মনে থাক!



কল্যাণীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনই এক আষাঢ়ে এমনই এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নবমেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার। এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো, তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা।
তোমার ওপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি —তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।
তুমি ভুলে যেও না আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কী জান বা শুনেছ জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।
তোমার আজিকার রূপ কী জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ দেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভরে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়তো সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব,-তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।
দেখা? না-ই হলো এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগ্ধ , হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস, আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে? তারই মায়াস্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে একঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না।
মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাকো জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্বদুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা-সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রী বিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারল না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারাদিন-রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।
যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশীর্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ত।
ইতি
নিত্য শুভার্থী
নজরুল ইসলাম



অবেলার ডাক
- কাজী নজরুল ইসলাম
 =======================
অনেক ক’রে বাসতে ভালো পারিনি মা তখন যারে,
আজ অবেলায় তারেই মনে পড়ছে কেন বারে বারে।।
আজ মনে হয় রোজ রাতে সে ঘুম পাড়াত নয়ন চুমে,
চুমুর পরে চুম দিয়ে ফের হান্‌তে আঘাত ভোরের ঘুমে।
ভাব্‌তুম তখন এ কোন্‌ বালাই!
কর্‌ত এ প্রাণ পালাই পালাই।
আজ সে কথা মনে হ’য়ে ভাসি অঝোর নয়ন-ঝরে।
অভাগিনীর সে গরব আজ ধূলায় লুটায় ব্যথার ভারে।।
তর”ণ তাহার ভরাট বুকের উপ্‌চে-পড়া আদর সোহাগ
হেলায় দু’পায় দ’লেছি মা, আজ কেন হায় তার অনুরাগ?
এই চরণ সে বক্ষে চেপে
চুমেছে, আর দু’চোখ ছেপে
জল ঝ’রেছে, তখনো মা কইনি কথা অহঙ্কারে,
এম্‌নি দার”ণ হতাদরে ক’রেছি মা, বিদায় তারে।।
দেখেওছিলাম বুক-ভরা তার অনাদরের আঘাত-কাঁটা,
দ্বার হ’তে সে গেছে দ্বারে খেয়ে সবার লাথি-ঝাটা।
ভেবেছিলাম আমার কাছে
তার দরদের শানি- আছে,
আমিও গো মা ফিরিয়ে দিলাম চিন্‌তে নেরে দেবতারে।
ভিক্ষুবেশে এসেছিল রাজাধিরাজ দাসীর দ্বারে।।
পথ ভুলে সে এসেছিল সে মোর সাধের রাজ-ভিখারী,
মাগো আমি ভিখারিনী, আমি কি তাঁয় চিন্‌তে পারি?
তাই মাগো তাঁর পূজার ডালা
নিইনি, নিইনি মণির মালা,
দেব্‌তা আমার নিজে আমায় পূজল ষোড়শ-উপচারে।
পূজারীকে চিন্‌লাম না মা পূজা-ধূমের অন্ধকারে।।
আমায় চাওয়াই শেষ চাওয়া তার মাগো আমি তা কি জানি?
ধরায় শুধু রইল ধরা রাজ-অতিথির বিদায়-বাণী।
ওরে আমার ভালোবাসা!
কোথায় বেঁধেছিলি বাসা
যখন আমার রাজা এসে দাঁড়িয়েছিল এই দুয়ারে?
নিঃশ্বসিয়া উঠছে ধরা, ‘নেই রে সে নেই, খুঁজিস কারে!’
সে যে পথের চির-পথিক, তার কি সহে ঘরের মায়া?
দূর হ’তে মা দূরন-রে ডাকে তাকে পথের ছায়া।
মাঠের পারে বনের মাঝে
চপল তাহার নূপুর বাজে,
ফুলের সাথে ফুটে বেড়ায়, মেঘের সাথে যায় পাহাড়ে,
ধরা দিয়েও দেয় না ধরা জানি না সে চায় কাহারে?
মাগো আমায় শক্তি কোথায় পথ-পাগলে ধ’রে রাখার?
তার তরে নয় ভালোবাসা সন্ধ্যা-প্রদীপ ঘরে ডাকার।
তাই মা আমার বুকের কবাট
খুলতে নারল তার করাঘাত,
এ মন তখন কেমন যেন বাসত ভালো আর কাহারে,
আমিই দূরে ঠেলে দিলাম অভিমানী ঘর-হারারে।।
সোহাগে সে ধ’রতে যেত নিবিড় ক’রে বক্ষে চেপে,
হতভাগী পারিয়ে যেতাম ভয়ে এ বুক উঠ্‌ত কেঁপে।
রাজ ভিখারীর আঁখির কালো,
দূরে থেকেই লাগ্‌ত ভালো,
আসলে কাছে ক্ষুধিত তার দীঘল চাওয়া অশ্র”-ভারে।
ব্যথায় কেমন মুষড়ে যেতাম, সুর হারাতাম মনে তরে।।
আজ কেন মা তারই মতন আমারো এই বুকের ক্ষুধা
চায় শুধু সেই হেলায় হারা আদর-সোহাগ পরশ-সুধা,
আজ মনে হয় তাঁর সে বুকে
এ মুখ চেপে নিবিড় সুখে
গভীর দুখের কাঁদন কেঁদে শেষ ক’রে দিই এ আমারে!
যায় না কি মা আমার কাঁদন তাঁহার দেশের কানন-পারে?
আজ বুঝেছি এ-জনমের আমার নিখিল শানি–আরাম
চুরি ক’রে পালিয়ে গেছে চোরের রাজা সেই প্রাণারাম।
হে বসনে-র রাজা আমার!
নাও এসে মোর হার-মানা-হারা!
আজ যে আমার বুক ফেটে যায় আর্তনাদের হাহাকারে,
দেখে যাও আজ সেই পাষাণী কেমন ক’রে কাঁদতে পারে!
তোমার কথাই সত্য হ’ল পাষাণ ফেটেও রক্ত বহে,
দাবাললের দার”ণ দাহ তুষার-গিরি আজকে দহে।
জাগল বুকে ভীষণ জোয়ার,
ভাঙল আগল ভাঙল দুয়ার
মূকের বুকে দেব্‌তা এলেন মুখর মুখে ভীম পাথারে।
বুক ফেটেছে মুখ ফুটেছে-মাগো মানা ক’র্‌ছ কারে?
স্বর্গ আমার গেছে পুড়ে তারই চ’লে যাওয়ার সাথে,
এখন আমার একার বাসার দোসরহীন এই দুঃখ-রাতে।
ঘুম ভাঙাতে আস্‌বে না সে
ভোর না হ’তেই শিয়র-পাশে,
আস্‌বে না আর গভীর রাতে চুম-চুরির অভিসারে,
কাঁদাবে ফিরে তাঁহার সাথী ঝড়ের রাতি বনের পারে।
আজ পেলে তাঁয় হুম্‌ড়ি খেয়ে প’ড়তুম মাগো যুগল পদে,
বুকে ধ’রে পদ-কোকনদ স্নান করাতাম আঁখির হ্রদে।
ব’সতে দিতাম আধেক আঁচল,
সজল চোখের চোখ-ভরা জল-
ভেজা কাজল মুছতাম তার চোখে মুখে অধর-ধারে,
আকুল কেশে পা মুছাতাম বেঁধে বাহুর কারাগারে।
দেখ্‌তে মাগো তখন তোমার রাক্ষুসী এই সর্বনাশী,
মুখ থুয়ে তাঁর উদার বুকে ব’লত,‘ আমি ভালোবাসি!’
ব’ল্‌তে গিয়ে সুখ-শরমে
লাল হ’য়ে গাল উঠত ঘেমে,
বুক হ’তে মুখ আস্‌ত নেমে লুটিয়ে যখন কোল-কিনারে,
দেখ্‌তুম মাগো তখন কেমন মান ক’রে সে থাক্‌তে পারে!
এম্‌নি এখন কতই আমা ভালোবাসার তৃষ্ণা জাগে
তাঁর ওপর মা অভিমানে, ব্যাথায়, রাগে, অনুরাগে।
চোখের জলের ঋণী ক’রে,
সে গেছে কোন্‌ দ্বীপান-রে?
সে বুঝি মা সাত সমুদ্দুর তের নদীর সুদূরপারে?
ঝড়ের হাওয়া সেও বুঝি মা সে দূর-দেশে যেতে নারে?
তারে আমি ভালোবাসি সে যদি তা পায় মা খবর,
চৌচির হ’য়ে প’ড়বে ফেটে আনন্দে মা তাহার কবর।
চীৎকারে তার উঠবে কেঁপে
ধরার সাগর অশ্র” ছেপে,
উঠবে ক্ষেপে অগ্নি-গিরি সেই পাগলের হুহুঙ্কারে,
ভূধর সাগর আকাশ বাতাস ঘুর্ণি নেচে ঘিরবে তারে।
ছি, মা! তুমি ডুকরে কেন উঠছ কেঁদে অমন ক’রে?
তার চেয়ে মা তারই কোনো শোনা-কথা শুনাও মোরে!
শুনতে শুনতে তোমার কোলে
ঘুমিয়ে পড়ি। – ও কে খোলে
দুয়ার ওমা? ঝড় বুঝি মা তারই মতো ধাক্কা মারে?
ঝোড়ো হওয়া! ঝোড়ো হাওয়া! বন্ধু তোমার সাগর পারে!
সে কি হেথায় আসতে পারে আমি যেথায় আছি বেঁচে,
যে দেশে নেই আমার ছায়া এবার সে সেই দেশে গেছে!
তবু কেন থাকি’ থাকি’,
ইচ্ছা করে তারেই ডাকি!
যে কথা মোর রইল বাকী হায় যে কথা শুনাই কারে?
মাগো আমার প্রাণের কাঁদন আছড়ে মরে বুকের দ্বারে!
যাই তবে মা! দেকা হ’লে আমার কথা ব’লো তারে-
রাজার পূজা-সে কি কভু ভিখারিনী ঠেলতে পারে?
মাগো আমি জানি জানি,
আসবে আবার অভিমানী
খুঁজতে আমায় গভীর রাতে এই আমাদের কুটীর-দ্বারে,
ব’লো তখন খুঁজতে তারেই হারিয়ে গেছি অন্ধকারে!


হে রুদ্র আদেশ দাও
কাজী নজরুল ইসলাম
... .... ... ... ...
অগণিত মানবের শ্রান্তি-হীন
অসহায় অশান্ত- রোদন,ভেসে আসে মোর কানে
নিশীথের বাণীহীন নিস্তব্ধ অন্ধকারে
ধরণীর দশদিক হতে,
চমকিয়া উঠে মোর ধ্যানের কৈলাসে
মহামণি যোগিন্দ্র শীব।
কোটি শাখা বাহু মেলি আকাশের পানে
যেমন আশ্রয় মাগে বন তরুলতা
কালবৈশাখীর ঝড়ে,দূর্যোগে নিশীথে
পৃথিবীর মাতৃক্রোড়
সহস্র শিকড় দিয়া আঁকড়িয়া কাঁদে
দেশে দেশে কাঁদিছে মোর আত্মার আত্মীয়
আমারই স্রষ্টার সৃষ্ট জীব
সে কোন জন্মের মোর
ভূলে যাওয়া পুত্র কন্যা
পিতা মাতা ভাই বোন
তেমনি করুণ রবে আর্ত ঝংকার তোলে
তাহাদের বিপুল রোদনধ্বণি
হৃদয়ের নীরব তন্ত্রিতে
গভীর প্রশান্তি মোর উদ্বেলিয়া উঠে
সমাধি শয্যায় শুনি,জীবন্ত সমাধি ভীত
মানবের অসীম আকুল হাহাকার
সরোষে ভাঙ্গিতে চাই সমাধির কারা
তপস্যার বল্মীক স্তুপ
পরম একাকী যেই জন
রাখিয়াছে মোরে একাকী করিয়া
ছিন্ন করি সর্ব মানবের সঙ্গ হতে
উচ্চস্বরে ডাকি সেই মহাকালে
হে রুদ্র আদেশ দাও
বাহিরে আসার
দ্বারে মোর কাঁদে সর্বহারা
নিপীড়িত জনগণ আত্মীয় স্বজন
পাতাল তলের দৈত্য অসুর দানব
বাহিরিয়া আসিয়াছে ধরণীর সূর্য়ালোকে
মানুষের বেশ ধরি
হরিয়াছে মানুষের অধিকার
লুটিয়াছে সুখ শান্তি
টুটিয়াছে স্নেহ নীড়
হে রুদ্র আদেশ দাও
শান্তি স্বর্গ হতে টেনে দাও ফেলে
ধরণীর ধূলিতলে
আমারে মরিতে দাও
সর্বঅবমানিতের সাথে।
হেরিনু মৌন শীব মৃদু মৃদু হাসে
শক্তি সাথে অটল কৈলাসে
ধূর্জটির ললাটের বহ্নিশিখা মাঝে
জাগিছে যোগেশ্বরী
মহাশক্তি রক্তচামুন্ডা রুপ ধরি
যেন রক্ত মহাসিন্ধু
সেই প্রলয়ের রক্ত সিন্ধু ম্লান করি
উদিতেছে নব প্রভাতের সূর্য নারায়ণ
সংগ্রাম শশ্মানে আসে যেন
দলে দলে বিভূতি তিলক পড়ি
আঁধারের কারামুক্ত দেব ও সেনাদল
প্রণতি জানায় সবে
নব প্রভাতের নর নারায়ণে।




দারিদ্র্য
– কাজী নজরুল ইসলাম
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!
বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল
টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….
গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….
ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্‌,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্‌ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!
চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!
বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!
নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!
লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!
প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্‌
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….
শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্‌ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।
উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!
পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!



No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...