Tuesday, November 16, 2021

ঋত্বিকা গায়েন

 

এখানে এসো না।
এখানে এখন মেঘে মেঘে আঁধার,
এখানের দরজায় এখন অযত্নের ভাঁটফুল।
এখানে এখন শোক উদযাপনের মহড়া।
এখানে এখন তপস্বীর মতো মৌনব্রত।
এখানে এখন সৃষ্টি স্থিতি লয়।
এখানে এসো না।
এখানে তোমাকে সযত্নে বসাবার আসন পিঁড়ি নেই।
দু গ্ৰাস ভাত কম খেলে নালিশ জানানোর মানুষ অনুপস্থিত।
এখানে তোমার চোখের কালি মাপার ভার দিতে হবে অন্ধকারের ওপর,
মরুভূমির ওপর হেঁটে গিয়ে মেটাতে হবে মনের খিদে।
এখানে এসো না।
এখানে বড়ো বেশি আলো চারিদিকে।
জানালায় চির চেনা হলুদ ঠোঁটের পাখিটা বসে না আর।
এখানে পলেস্তারা খসে পড়েছে বুকের কিনারা বেয়ে,
হারমোনিয়ামের পুরানো কর্ডের ওপর ছুটে বেড়িয়েছে একটা বড়ো ইঁদুর।
অথচ একবিন্দু জল নিয়ে এসে দাঁড়ায়নি কোনো পথভোলা পথিক।
এখানে এসো না।
এখানে এলে তোমার বন্ধু হবে দুঃখ,
আত্মীয় হবে শোক,
প্রতিবেশী হবে অজস্র না বলা অপারগতা,
সঙ্গী হবে নরকের আগুন থেকে উঠে আসা হাজার বছরের গভীর দীর্ঘশ্বাস।
এখানে এসো না।
এখানে এলে তুমি পাবে
ব্যর্থ জীবন দিয়ে গাঁথা অনাকাঙ্ক্ষিত এক অমরত্ব। 
 
 
 
 
 
অনিমেষ,
এখানে রাত মায়ার মতো জ্বলছে,
বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে আশ্চর্য শিশির,
হিম হিম গন্ধে ভেসে যাচ্ছে আঙুর গাছের লতা,
পাহাড়ি পথের বাঁকে বিস্মৃতির জোনাকি ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে।
তুমি কি দূর শহরে কোনো ম্যাড়ম্যাড়ে সন্ধ্যায়
চুনখসা বাড়ির অন্ধকারের ভিতর দিয়ে_
আরও নিষ্প্রভ কোনো জানালার দিকে তাকিয়ে বসে আছো?
তুমি কি এখন আলমারির তাক থেকে বাছাই করে এনে শোনাচ্ছো ফরাসি বিপ্লব,
রাশিয়ার গন অভ্যুত্থান,
আফ্রিকার হাড় জিরজিরে কোনো শিশুর
দু'চোখ ভরা স্বপ্ন।
তুমি কি এখন শুকনো রুটি আর কলাইয়ের ডাল খেয়ে 
ঘুমিয়ে গেছো একলা তক্তপোশে!
তোমার ঘুমের মধ্যে আসছে ভোর,
একটা আগুন রঙা ভোর।
সেই ভোরে তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে,
কথা হচ্ছে,
গল্প হচ্ছে।
রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে।
মানুষ খুশিতে জড়িয়ে ধরছে একে অপরকে।
আমাদের মাথার ওপর একটা টকটকে লাল সূর্য উঠছে।
এখানেও রাত মায়ার মতো জ্বলছে।
বেনামী গাছেরা জানান দিয়ে যাচ্ছে তোমার শেষ ঠিকানা।
জানালায় এসে বসছে জলভরা মেঘ।
যেন প্রস্ততি নিচ্ছে আগামী র জন্য,
যেন কিছুক্ষণ পরেই ভাসিয়ে দেবে পাহাড় থেকে সমতল,
যেন কিছুক্ষণ পরেই বুনোলতার ঝোপ থেকে হারিয়ে যাওয়া 
ফুলটাও জলের স্পর্শে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে সূর্যের দিকে,
যেন বেনামী পাখিও নাম খুঁজে পাবে হঠাৎ আসা
বৃষ্টিতে,
যেন ফোকলা দাঁতের পাহাড়ি বুড়োটাও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে প্রিয়তমার বুকে,
যেন পাহাড়ের পাইন বনে বনে প্রতিধ্বনিত হবে
একই সুর,
একই গান,
একই চেতনা,
একই আনন্দ,
একই ঐক্যতান...
যাকে তুমি এতটাকাল সযত্নে বুকের মধ্যে লালন করে চলেছো "ভালোবাসা" বলে। 
 
 
 
 
 
 
একদিন এই শহরের বুকেই তোমার আমার সংসার হবে।
সমস্ত দিনের কাজ শেষে,
ঘাম জবজবে মুখ হবে।
জানালা জুড়ে নীল রঙের পর্দা হবে,
কাঁচের ওপর বর্ষা দিনে অভিমানের রঙ হবে।
রবিঠাকুর আর নজরুল,
বোদলেয়ার কিংবা সাঁত্রে,
জীবনানন্দ আর বিভূতিভূষণ...
হাত ধরাধরি করে থেকে যাবে ইয়া বড় কাঠের আলমারিতে।
সান্ধ্যকালীন চায়ের কাপে
ছোটোবেলার গান হবে।
হাতের ওপর হাত রেখে
শীত দুপুরে ঘুম হবে।
বাগান জুড়ে পাতাবাহার
ছাদের কোনে হলুদ টব,
গরমকালের সন্ধ্যাবেলা
ছাদের পরে' একান্ত সব।
বাড়ির পিছনে পুকুর হবে
তাতে ভর্তি শালুক হবে,
আমগাছের ছায়ায় ছায়ায়
গোটাকয়েক চড়ুই রবে।
বছর ঘুরে পাহাড় চূড়ায়
রূপালী রঙ বরফ হবে,
পুজোর ছুটি- নোনা জলে
একসাথে বেশ স্নান হবে।
একদিন এই মিথ্যে কথার শহরে
আমাদের সত্যিকারের সংসার হবে।
কথা হবে,
গান হবে,
হাসি হবে,
কান্না হবে,
প্রেম হবে,
ভালোবাসা হবে,
থেকে যাওয়া হবেই।
এইদিন আলো হবে, একদিন ভালো হবেই।
 
 
 
চলে যাবে? তবে তাই হোক।
যাওয়ার আগে নিয়ে যেও প্রিন্সেস ঘাটের প্রথম হাওয়া,
শহরের রাস্তায় সন্ধ্যাবেলার হাওয়াই মিঠাই,
দূরে জ্বলতে থাকা নিওন আলোর মধ্যে প্রথম জড়িয়ে ধরা...
যদি নিয়ে যেতে পারো, তবে নিয়ে যাও।
চলে যাবে? তবে তাই হোক।
ছেলেমানুষি বয়সে বুকপকেটে রাখা পুরানো চিঠি,
বৃষ্টির সন্ধ্যায় আলো জ্বলা বাতিদান ,
গলি রাস্তার সোঁদা গন্ধ,
পুরানো বাড়ির শ্যাওলা ধরা অন্ধকার...
যদি নিয়ে যেতে পারো, তবে নিয়ে যাও।
চলে যাবে? তবে তাই হোক।
আলপথের ধারে কচি কড়াইশুঁটির গন্ধ,
ধানের গোলার পাশে মাথা উঁচু করে ওঠা মাশরুম,
প্রদীপের আলোর পাশে ঘুরে বেড়ানো মফস্বলের সন্ধ্যা...
যদি নিয়ে যেতে পারো, তবে নিয়ে যাও।
চলে যাবে? তবে তাই হোক।
বাগানের ডুবে যাওয়া ঘাসে পা ভিজিয়ে,
সযত্নে পোঁতা লাউমাচাকে পাশ কাটিয়ে,
নীলমনিলতার ছায়া এড়িয়ে,
নকশা করা চৌকাঠের ওপর এসে বসে একটা দোয়েল পাখি...
যদি নিয়ে যেতে পারো, তবে নিয়ে যাও।
চলে যাবে? তবে তাই হোক।
তার আগে আমার বিছানায় এসে পড়া প্রথম রোদ,
ভোরবেলার প্রথম শিশির,
নদীর পাড়ের সাদা কাশ,
জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া একটুকরো আকাশ...
এগুলো সব নিয়ে যেও।
একেবারে চেটেপুটে নিঃশেষে সাবাড় করে দিও।
কারন এগুলোকে আমি এতটাকাল ভালোবাসা বলে জেনে এসেছিলাম। 

 
 
 
"তুমি আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাও,
তুমি আমাকে পরাজয় থেকে জয়ের দিকে নিয়ে যাও,
তুমি আমাকে মিথ্যে থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যাও।
কারন তুমি শিখিয়েছো সত্য মানে আলো,
সত্য মানে সোনার চেয়েও ভালো।" .....
শিক্ষক দিবসের দিন স্বরচিত একটা লেখা পাঠ করছিল আমার এক ছাত্র।
কথাগুলোর মধ্যে একটা একান্ত আপন ভাব ছিল যেন।
ঠিক যে ভাব খুঁজে পেয়েছিলাম আমার গ্ৰামের স্কুলের রতন মাষ্টারমশাইয়ের মধ্যে।
বেঁটেখাটো চেহারার মানুষটা শীত গ্ৰীষ্ম বর্ষা_
একটা লম্বা হাতল দেওয়া ছাতা ,
একটা কালো ব্যাগ হাতে রোজ হাজির হতেন এগারোটা বাজার আগেই।
কোনোদিন তাঁকে কামাই করতে দেখিনি।
শুধু একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছিল যখন,
মাসখানেক স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিলেন সেবার।
প্রাইমারী স্কুলের সেই স্যাঁতসেঁতে মাটির মেঝেতে চটের আসন পেতে বসে পাশাপাশি বসতাম
আমি, আনোয়ার, বিশু, কোয়েল, শ্যামলী।
বিশু প্রায় দিন পান্তা খেয়ে আসত সকালে।
রতন মাস্টার জিজ্ঞেস করত কি রে আজ কি দিয়ে পান্তা খেয়ে এসেছিস?
কোনো কোনোদিন রতন চুপ করে থাকত,
সেদিন ওর পান্তাটুকুও জুটত না।
রতন মাস্টার বুঝতেন সব,
তারপর চক ডাস্টার তুলে নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিত কয়েকটা শক্ত শক্ত অঙ্ক।
শুধু টিফিনের সময় সেদিন বিশুর জন্য তাঁর ভাগের খাবার বরাদ্দ ছিল।
মনে আছে কয়েকজন বড়লোক হিন্দু বাড়ির ছেলে আনোয়ারের পাশে বসতে চাইত না।
রতন মাস্টার বুঝত সব।
তারপর বলতেন,
"বাবা মায়েরা যে শিক্ষা মানুষের সাথে মানুষের ভেদাভেদ তৈরি করে,
যেনো সে শিক্ষা মিথ্যে,
জীবনে তার আটআনা দাম নেই।"
শ্যামলী ছিলো মিশমিশে কালো।
ওর বাড়ির লোক থেকে শুরু করে সবাই ওকে
অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দিত ও এলেবেলে,
ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই,
মেয়ে হয়ে জন্মেও ওর গায়ের রঙ কালো।
রতন মাস্টার বুঝত সব।
তারপর বলত,
"প্রকৃত শিক্ষা মনের কালিমা মুছে দেয়,
অন্ধকার ভেদ করে আলো এনে দেয় সমাজে,
অজ্ঞানতার সমুদ্র থেকে আমাদের নিয়ে আসে সবুজ ডাঙায়।
সেখানেই তো শান্তি রে,
সেখানেই তো মুক্তি,
সেখানেই তো আনন্দ।"
রতন মাস্টার মারা গিয়েছেন পাঁচ বছর হল।
শেষবার তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম হসপিটালে,
ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ।
পড়ন্ত বেলার আলো এসে পড়েছিলো তাঁর মলিন বিছানায়।
মৃত্যু শয্যায় শুয়ে তিনি বলেছিলেন,
"মানুষ হোস বাবা-মায়েরা।
দেশের মানুষের কথা ভাবিস।
ওদেরকে আলো দেখাস,
আর শেখাস সত্য সোনার চেয়েও ভালো।"
বিশু এখন অস্ট্রিয়াতে,
রিসার্চ করছে রুরাল ডেভেলপমেন্টের ওপর।
শ্যামলী এখন হরিশপুর গ্ৰামের নাম করা গাইনোকোলজিস্ট।
আনোয়ার এখন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার,
ওর এলাকার মানুষ ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কোয়েল এখন কলেজে পড়ায়।
আর আমি মফস্বলের একটা স্কুলের শিক্ষিকা।
এখানেও অনেক আনোয়ার রা বঞ্চনার শিকার হয়,
এখানেও অনেক বিশু পান্তা খেয়ে আসে,
এখানেও অনেক শ্যামলী পরিবার- সমাজ থেকে অবহেলা পেয়ে আসে।
আমি শুধু ওদের কে বলি,
"সত্য বড়ো কঠিন যেনো,
বুঝতে পারলে তবেই মেনো।
সত্য মানে আলো,
সত্য মানে সোনার চেয়েও ভালো। "
 
 
 
আমার বান্ধবীরা বলছে নতুন একটা প্রেম করতে,
আমার আত্মীয় রা বলছে তারা খুঁজে দেবে,
বাবা মা বলছে আগেই নিষেধ করেছিলাম।
এই জেট প্লেনের জুগে একজনের জন্য আর পরে না থাকতে।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি যে
মানুষকে ভোলা যায় কিন্তু রক্তের মধ্যে মিশে যাওয়া মূহুর্তগুলো ভোলা যায় না।
ভোলা যায় না নিত্যদিনের খুঁটিনাটি অভ্যাসগুলো।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি,
চরমতম খারাপ সময়েও কেউ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি,
কিভাবে হাতে হাত রেখে অপেক্ষা করে গেছি ভালো সময়ের।
তবুও শেষে দেখলাম সত্যিই আসলে সময় ফুরোয় একদিন।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি,
তুমুল ঝগড়াঝাটির পর ভীষণভাবে অপমানিত হয়েও
আমি ফোন করে মানিয়ে নিয়েছি ঠিক।
অথচ এতগুলো দিন পেরিয়ে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস শোনার সময় তোমার থাকবে না,
এটা আমাকে মেনে নিতে হল অবশেষে।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি,
আমার জ্বর হলে ভাঙাচোরা সাইকেলটা নিয়ে তুমি কিভাবে ছুট্টে আসতে ওষুধ দিতে,
তাই বোধহয় আমার জ্বর একদিনের বেশি টিঁকত না।
কিন্তু তাও ছেলেমানুষি শোনার ধৈর্য্য তোমার আর থাকবে না,
এটাও আমাকে মেনে নিতে হল ঠিক।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি,
চারিপাশের পৃথিবীটা আমার গলা টিপে ধরলে
প্রথম ফোনটা করে হাউমাউ করে কাঁদার জন্য আমার একটা মানুষ ছিলো।
অথচ সেই কান্নাগুলোকে 'ঘ্যানঘ্যানে' তকমা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা যায়,
এটাও মেনে নিতে হল একদিন।
আমি ওদেরকে বোঝাতে পারি নি,
খোয়াইয়ের তীর,
ব্যালকনির গল্প,
পাহাড়ের কথা,
কবিতার খাতা,
আলসে দুপুর,
রাতের ফিসফিস,
ঠোঙা ভর্তি ঘটিগরম,
প্রিন্সেপ ঘাট,
বইমেলা.......
কিচ্ছু বোঝাতে পারি নি
কিচ্ছু বোঝাতে পারব না।
কারন লড়াইটা শেষ হয়ে গেছে,
হেরে গেছে ভালবাসার অভ্যাসগুলো।
আর হেরে যাওয়া মানুষের কথা শোনার লোক থাকে না চারিদিকে।
ভালোবাসা আসলে একপ্রকার 'পরাজয়'ই,
যা কষ্ট হলেও তিতো ওষুধের মতো গিলে যেতে হয় দিনের পর দিন।
 
 
 
 
অনিমেষ,
ভাঙন যে এতো নিঃশব্দে, চুপিসারে হয়
সেটা বুঝিনি কখনো,
এত সাধারণ অথচ তীব্র ভাবে ঘুন ধরতে শুরু করে সম্পর্কে,
তা আগে জানা ছিলো না।
কত সহজে স্বাভাবিক মান-অভিমান গুলো বিরক্তির কারন হয়ে উঠতে পারে,
কত সহজে স্বাভাবিক কথাবার্তা গুলো সময়ের অপচয় হয়ে উঠতে পারে,
কত সহজে আসল আমি টা কেবলমাত্র অবসরের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে,
এত এত না জানা কথা কত সহজেই জেনে ফেলেছি এখন।
এইরকম মফঃস্বল শহরে প্রতিবছরের মতো এবারও বৃষ্টি আসবে,
এবারও ভিজে যাবে গৃহস্থ বাড়ির শখের বোগেনভিলিয়া,
এবারও পল্টু কাকুর চা দোকানে গরম তেলে ভাজার গন্ধে ম-ম করবে চারিপাশ,
এবারও রথের দিন বৃষ্টিতে ভিজে মাটির পুতুল কিনবে কোনো শিশু,
এবারও ইলেভেনের ব্যাচ শেষে একই ছাতায় ফিরবে কোনো কিশোর কিশোরী।
এবারও বৃষ্টির দিনে কারশেডে বসে ভিজবে কোনো বৃদ্ধ ভিখারী,
এবারও বর্ষা দিনে অন্ধকার গলি রাস্তায় কোনো মেয়ের শ্লীলতাহানি হবে,
এবারও বকুল দির বস্তি ঘরে ভাঙা টিনের চাল বেয়ে জল পড়বে টুপটাপ,
এবারও লোডশেডিং এ বারান্দায় বসে সিধু জ্যেঠু জলের গান গাইবে,
এবারও অজিতেশ দা ঝুম বৃষ্টির দুপুরে
বারান্দায় বসে ভাববে আশালতা দির কথা।
শুধু আমাদের আর কথা হবে না,
আমাদের আর দেখা হবে না।
আর দৈবাৎ কথা হলেও বুঝিয়ে দেব
আমরা একে অপরকে ছেড়ে কতটা ভালো আছি।
কতটা অভিনয় শিখে গেছি তার পরীক্ষা হবে সেদিন।
আসলে পৃথিবীতে ধ্রুব বা শাশ্বত বলে কিছু হয় না,
তার প্রমাণ দিয়ে যাব আমরা।
শুধু ক্লাস ইলেভেনের মোটা বিনুনি র মেয়েটা আর পাগলাটে স্বভাবের সেই ছেলেটা থেকে যাবে আজন্মকাল,
এমনকি, হয়ত মৃত্যুর পরেও।
 
 
 
 
জন্মের সময় কন্যাসন্তান হওয়ার জন্য পরিবার থেকে যখন আহা উঁহু স্বর উঠেছিলো, তখন যে পুরুষটা এগিয়ে এসে সদ্যোজাতাকে কোলে তুলে বলেছিলো, "ও আমার প্রথম আলো, আমার শ্লোকা", সেইসব পুরুষ ধর্ষক হতে পারে না।
পছন্দের নারীর থেকে 'না' শুনেও, রাতের অন্ধকারে বা সন্ধ্যের ঝাপসা আলোয় যেসব পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়েনা নারী মাংসের ওপর কিংবা ছুঁড়ে দেয়না তীব্র বিদ্বেষের ACID, সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
রাত বারোটায় একা রাস্তায় কোনও মেয়ে দেখলে, যারা সুযোগ না নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে, "আমি সামনেই যাচ্ছি, অসুবিধা মনে করলে আমার সাথে আসতে পারেন," সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
প্রেমিকার বাড়ির চাপে একটা চাকরি পাওয়ার জন্য জর্জরিত হতে হতে যে পুরুষ একটা গোটা পিচ গলা বসন্তের উপর দিয়ে হেঁটে যায় বছরের পর বছর, যার আসমানী রং গিটারে প্রথম দিনের মতো সুর খেলে যায়না আর, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে রাস্তার ধারের ভাতের হোটেল থেকে ডিমভাতের অর্ডার দিয়ে ক্যান্সেল করে আবার সবজি ভাত অর্ডার করে, সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
বান্ধবী সুযোগ নিচ্ছে বুঝেও অকাতরে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নোটস দিয়ে চলে যে ছেলেটা, তারপর পরীক্ষা হওয়ার পরে কেমন আছিস এর জবাবটা পর্যন্ত পাওয়া যায়না ওপার থেকে, এপারে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। শুধু সময় বয়ে যায় খরস্রোতার মতো। সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
বিধর্মে প্রেম করার অপরাধে মৃত্যু আসন্ন জেনেও প্রেমিকার হাত শক্ত করে ধরে রেখে কাঁটাতারের সমুদ্র পেরোয় যে পুরুষ, ধর্মের চোখ রাঙানির নীচে এক পৃথিবী ভালোবাসার কথা লিখে চলে যে পুরুষ, সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
নিজের বাইক কেনার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে জন্মদিনে বউয়ের জন্য এনে দেয় দামী কোনো গয়না, কিংবা ভালো কোনো রেস্টুরেন্টের প্রিয় খাবার। সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
বিকলাঙ্গ বাবা আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মায়ের দুঃখ ঘোচাতে যে ছেলেটার জীবনে সত্যিকারের 'অমলকান্তি' হয়ে ওঠা হয়নি, অন্ধকার ছাপাখানায় সারাটা দিন কাটিয়ে রাতের বেলা মায়ের ওষুধ কিনে বাড়ি ফেরে যে , সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
মফস্বলের কোনো গ্ৰাম থেকে ভোর পাঁচটায় দুটো সিদ্ধভাত খেয়ে রওনা দেয় যেসব পুরুষ,সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও ফেরার পথে ট্রেন বা বাসের কামরায় কোনো বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষ উঠলে সবার আগে জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় যারা, সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
বেকার বলে যার প্রেমিকা আজ অন্য কারোর স্ত্রী, তবুও বন্ধুদের আড্ডায় আজও যে ছেলেটা বলে, "ও আমার সাথে থাকলে ভালো থাকতো না, যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।" সেইসব পুরুষ কখনো ধর্ষক হতে পারে না।
পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ ধর্ষক নয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আজও আকাশের তলায় ছাতিম ফোটা বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
আমরা দুজন এই আকাশের সকালবেলার ফুল
আমরা দুজন এই পৃথিবীর আসল তরুমূল।
 
 
 
 
 
প্রিয় পারমিতা,
এখন ঘড়িতে রাত দশটা। জানালার বাইরে জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে জানো। আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা আজ মনে পড়ছে। ক্লাস ইলেভেনে শঙ্কর স্যারের ইংরেজি ব্যাচ। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। আমাদের প্রথম দেখা। দিনগুলো কি ভালোই ছিলো বলো। ভবিষ্যতের চিন্তা ছিলো না। চাকরির উত্তেজনা ছিলো না। শুধু নিখাদ ভালোবাসা টুকু ছিলো।
আমরা বড়ো হতে থাকলাম। সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পাঞ্জাবি থেকে দুর্গা পুজোর অষ্টমী তে চিকেন রোল... বেশ চলছিলো আমাদের জীবন টা। কলেজ পাশের পর আসল জীবন শুরু হতে থাকল ধীরে ধীরে। আমাদের নতুন একটা নামকরণ হল তখন। "শিক্ষিত বেকার।" দুজনে যত বড়ো হতে থাকলাম, তত গলা টিপে ধরতে চাইল আত্মীয় স্বজন, পরিবার, সমাজের মানুষগুলো।
আমি জন্মানোর পর মা নাকি বলত, "আমার ছেলে একদিন আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।" বাবা বলত, "আমার ছেলে চাকরি করে দশজনের একজন হবে। আমাকে আর মুদি দোকানে গিয়ে বসতে হবে না।" অথচ এদের কারোর সাধ পূরন হলো না। মা এখন সন্ধ্যে নামতেই ম্যাড়ম্যাড়ে আলোয় সেলাই করতে বসে। মা আসলে ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন সেলাই করতে বসে রোজ। বাবার চুলে আরও পাক ধরেছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে শরীর। তবুও মুদি দোকানে খাতা লিখতে বসছে রোজ, ঠিক রাত ন'টা পর্যন্ত।
আরও ক'টা টিউশন বেশি নিয়েছিলাম। তার সাথে জোর কদমে চলছিলো চাকরির প্রস্তুতি। তোমার এবছরের জন্মদিনে তিন হাজার টাকার যে শাড়িটা দিয়েছিলাম, তার জন্য সংসার খরচ বাঁচিয়ে জমাতে শুরু করেছিলাম বেশ কয়েক মাস আগে থেকে। দু'মাস অটো, বাস চড়েছি অল্প। পায়ে হেঁটে হেঁটে টিউশন পড়াতে গেছি দু'তিন মাইল পথ পেরিয়ে। জুতো ছিঁড়ে গেলে রাস্তার পাশ থেকে ৭০ টাকার সস্তার জুতো কিনেছি। খুব তেষ্টা পেলেও ডাব কিনে খাইনি কখনো। বড্ড দাম যে। রাস্তার পাশের কল থেকে জল ভরে নিয়েছি বোতলে।
বছরখানেক হল তুমি খালি ফোন করে কাঁদতে। বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, অথচ তোমার প্রেমিক এখনো চাকরি জোগাড় করে উঠতে পারেনি। শেষের দিকে আমাদের কথা ফুরিয়ে আসছিলো। তোমার সাথে যখন শেষ দেখা হয়েছিলো, তখন চোখের তলায় পুরু হয়ে কালি পরেছে। আমি বেশিক্ষণ তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। মুখ নিচু করে সস্তার জুতো টার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
আমি উঠে পরে লেগেছিলাম চাকরির জন্য। খুব ভালো প্রস্তুতি ছিলো। কিন্তু হলো না। একটা ছোট্ট ভাইরাস সব কিছু তছনছ করে দিলো। সবাই ঘরে বন্দী হয়ে গেলাম। স্কুল-কলেজে তালা পড়লো, অফিস আদালত বন্ধ হলো, কারখানার ঝাঁপ ফেলে দেওয়া হলো, কিছু মানুষ বাড়ি ফিরতে গিয়ে ট্রেনে চাপা পড়ে মারা গেলো, কিছু মেয়েরা রং মেখে গলি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো পেটের খিদে মেটাতে, নেতা-মন্ত্রীরা এসে ভাষন দিয়ে বললো বাড়িতে থাকবেন, কোনোমতেই বাইরে বেরোবেন না।
এই দেড় বছর মতো গৃহবন্দী। চাকরির সব পরীক্ষা বন্ধ। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম... কত শত ঢেউ আসবে এই ভাইরাসের তা কারোর জানা নেই। আরও কতগুলো বছর পচে গলে মরতে হবে মানুষকে জানা নেই। কতগুলো স্বপ্ন দেখা চোখের আলো নিভে যাবে ঠিক নেই।
আমার দ্বারা কিছু হলো না পারমিতা। পারলাম না আমি। হেরে গেলাম। সারাটা দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। দুপুরে ভাতের ওপর দিয়ে বিড়াল হেঁটে যায়। রাতে সবাই খেয়ে শুয়ে পড়লে ভাতের থালার সামনে বসি। চোখ ফেটে দু'এক ফোঁটা জল পড়ে থালায়। ভোরের দিকে চোখে ঘুম লেগে আসে।
তোমাকে মুক্তি দিলাম পারমিতা। তোমার অপদার্থ বেকার প্রেমিককে ভুলে যেও। ভুলে যেও আমাদের দেখা স্বপ্ন গুলো। ভুলে যেও আমাদের প্রতিশ্রুতি গুলো। একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করো। সুখী হও। কাল যখন সিলিং থেকে আমার মৃতদেহ নামানো হবে, দেখতে এসো শেষবার টি। বাবা মা কাঁদবে। তুমিও কাঁদবে জানি। তবু এটা ভেবে স্বস্তি পাবে তোমরা যে 'বেকার' নামক একটা অভিশাপ আর বয়ে বেড়াতে হবে না তোমাদের। ইমেলে ভালোবাসা পাঠানো যায় কিনা জানি না, তবুও এই মেইল এর সাথে শেষ আবেগ টুকু পাঠালাম। আসি।
ইতি,
তোমার অপদার্থ প্রেমিক
 
 
 
(সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে লিখেছিলাম লেখাটা)
জ্বর সারলে একদিন রেলগাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবি, অপু?
অন্ধকার পেরিয়ে নরম তুলতুলে রোদ মেখে আমরা বেরিয়ে পরবো কেমন!
 সবুজ ধানক্ষেতে সকালের কাঁচা সোনা রোদ 
আশার মতো জ্বলতে থাকবে দুপাশে।
 গ্ৰামের উঠোন পেরিয়ে আমরা হাঁটতে থাকব।
 বৌ ঝিরা উঠোনে কলাইয়ের ধান মেলতে আসবে। 
জেলে পাড়ার পাঠশালা থেকে নামতা পড়ার সুর ভেসে আসবে। 
নোনাগাছের ডালে লম্বা লেজ ফিঙে ডাকবে ইতিউতি। 
আনোয়ার কাকা আর অসীম দাদু অনর্গল বকতে বকতে
 এগিয়ে যাবে ঘাটের পথে। 
আমগাছের নীচে কয়েকটা বিচ্ছু ছেলে মেয়ে এক্বা দোক্বা খেলবে।
 চন্ডীমন্ডপ তলায় সুর করে ভজন গাইবে কেউ একটানা।
 সোনামুগ ডালে ফোড়নের গন্ধ আসবে গৃহস্থ বাড়ি থেকে।
 বনকলমীর ঝোপে কাঁচপোকা এসে বসবে। 
নদীর ওপর বাঁশের সাঁকোটা পেরিয়ে যাব আমরা।
 পাশেই জলার জলে একরাশ শালুক ফুটে থাকবে বেশ। 
ধুলোমাখা পথ ধরে বাউল ঠাকুর গান গাইতে থাকবে, 
"বনমালী গো পর জনমে হয়ো রাধা, বনমালী গো, পর জনমে হয়ো রাধা।"
 আমরা আরও এগিয়ে যাব। দুপুর গড়িয়ে আসবে। 
পোড়ো বাড়ির বাগানে বনভোজন করবে গুটিকয়েক 
আপন ভোলা ছেলেমেয়ে ।
 আয়োজন যৎসামান্য। ভাত, মেটে আলুর চচ্চড়ি, আর বেগুন ভাজা। 
আমরা পাশ কাটিয়ে আরও অনেকটা হেঁটে যাব।
 দূর থেকে অপরিচিত একটা জান্তব স্বর ভেসে আসবে অবশেষে। 
তারপর আসতে আসতে চোখের সামনে প্রায় সন্ধ্যে 
হয়ে আসা অপরাহ্নে ফুটে উঠবে চাকার আওয়াজ, আলোকিত কামরা, 
মানুষের কলরব, 
জানলা দিয়ে মুখ বার করা কোনো কিশোরের অবাক চাউনি।
পৃথিবীর অসুখ এখন। 
জ্বর সারলে একদিন আমাকে নিয়ে যাবি অপু, 
আলো দেখাতে, ভোর দেখাতে, স্বপ্ন দেখাতে? 
রেলগাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবি একদিন
 
 
 
 
গতরাতে আরও কয়েকটা লাশ ভেসে গেছে জলে।
আমি শান্ত থেকেছি।
গতরাতে অক্সিজেনের অভাবে আরও কয়েকটা কিশোর ছটফট করেছে শেষবারের জন্য।
আমি অক্সিজেন সিলিন্ডার গুলো তখন বিক্রি করছিলাম আকাশছোঁয়া দামে।
তারপর সারাদিনের ক্লান্তি মেখে স্কচের শেষ চুমুক টুকু তুলে নিচ্ছিলাম ঠোঁটে।
গতরাতে রক্ত চেয়ে ফোন করেছিলো একজন মা,
ওর দশ বছরের ছেলেটা রক্তের অভাবে ছটফট করছিলো।
আমি দ্বিগুণ দাম বলায় হাউমাউ করে কাঁদছিলো মহিলাটা।
আমি ফোন কেটে দিয়ে লেটেস্ট ভিডিও গেমটা শুরু করেছিলাম।
গতরাতে একটা ছেলে ফোন করেছিলো তার বয়স্ক বাবার জন্য ওষুধের খোঁজ করতে।
আমি চারগুণ দাম বলায় অনেকক্ষণ অনুনয় বিনয় করেছিলো সে।
আমি ফোন কেটে জ্যোম্যাটো থেকে অর্ডার করেছিলাম চিকেন পাস্তা উইথ হোয়াইট সস।
কি হবে কান্না শুনে?
কি হবে যন্ত্রণা শুনে?
কি হবে আর্তনাদ শুনে?
এই তো দিব্যি আছি।
আমার ঠান্ডা ঘরের চারধারে অদ্ভূত দামী সব মুখোশ,
বামদিকে রঙিন বোতলের সারি।
লকার উপচে পরছে নোটের তাড়ায়।
শুধু মাঝে মাঝে রাত হলে ছোটোবেলার সেই কিশোরীর কথা মনে পরে।
সে আমাকে লেবু গাছের তলায় কোনো এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় বলেছিলো,
"আমার না বৃষ্টি ভেজা জুঁই বড্ড ভালোলাগে।
আর ভালো লাগে গীতবিতান।
জানিস কেনো?
ওখানে মানুষকে ভালোবাসা র কথা বলা আছে যে।
'ভালোবাসা' র থেকে গভীর সত্য পৃথিবীতে আর কি আছে বল?"
আমি সব গীতবিতান পুড়িয়ে দিয়েছি।
আমি বাগানের জুঁই ফুলের গাছ উপড়ে দিয়েছি।
তবুও শান্তি নেই, শান্তি নেই।
ঘুম নেই, ঘুম নেই।
কি আশ্চর্যজনক ভাবে জুঁই ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে রোজ।
আমাকে শান্তি দাও,আমাকে ঘুম দাও,
ভালোবাসা দাও আমাকে...
একটু ভালোবাসা....
 
 
 
 
 
প্রিয় রবিঠাকুর,
বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্ৰামে আমার জন্ম।
জন্মের সময় মা গেলেন চলে,
বাবা হলেন চূড়ান্ত অখুশী।
শুধু পাড়ার মঞ্চে ২৫ শে বৈশাখের বানী ভেসে আসছিলো মাইকে সেদিন,
"হেথাও তো পশে সূর্যকর!
ঘোর ঝটিকা রাতে দারুণ অশনিপাতে। "
সেই থেকে তুমি আমার মা।
মেয়েবেলার ছেলেমানুষি রং খেলায়
ফিঙে এসে দোল খেত লাউমাচার ডগায়।
সকাল বিকেল কালি-কলম নিয়ে
মনে মনে বেশ আউড়াতাম,
"যদি ননী ছানার গাঁয়ে
কোথাও অশোক-নীপের ছায়ে
আমি কোনো জন্মে পারি হতে ব্রজের গোপবালক,
তবে চাই না হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক।"
সেই থেকে তুমি আমার বন্ধু।
স্কুলে পড়তে আমার এক পাণিপ্রার্থী
যে কিনা ধর্মে মুসলিম ছিলো,
সে আমাকে চিঠিতে লিখেছিলো,
"আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমিই জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।"
তারপর তাকে আর কোথাও খুঁজে পাইনি আমি।
সেই থেকে তুমিই আমার একমাত্র প্রেমিক।
আমার কারখানায় কাজ করা বাবা একদিন ছাঁটাই হলো।
ঠাকুমা সেই শোক সহ্য করতে না পেরে গত হলেন।
আমাদের ঘরের ফুটো চাল দিয়ে জল পড়তে লাগল,
ঝমঝম, ঝমঝম, ঝমঝম...
"আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো।
আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো।
আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো। "
সেই থেকে তুমি আমার বুকের বাম পাশ।
আমার পাড়া গেঁয়ে বাবা অষ্টাদশী মেয়েকে বাঁচাতে
বিয়ে দিয়ে দিল চল্লিশ বছরের গাঁয়ের মোড়লের সাথে।
আমি বাপের বাড়ি থেকে কেবল এনেছিলাম তোমাকে।
বাসর রাতের একরাশ কুণ্ঠা আর যন্ত্রণার মধ্যে কেবলমাত্র তোমার মুখ মন করে উচ্চারণ করেছিলাম
"আমরা দুজন ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের আদিম উৎস হতে।"
সেই থেকে তুমি আমার সাথী।
বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামী গত হলেন মহামারীতে।
কোলে তখন ফুটফুটে এক মেয়ে।
আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো শ্বশুরবাড়ি থেকে।
আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে সেদিন বলেছিলাম,
"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পূণ্য করো দহন-দানে।
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। "
সেই থেকে তুমি আমার লড়াই।
তারপর,আমি ঠিক করে ফেললাম আমার গন্তব্য।
আমি ফিরে গেলাম তোমার কাছে।
আমি ফিরে গেলাম মানুষের কাছে।
আমি ফিরে গেলাম সাম্যের পৃথিবী প্রতিষ্ঠায়।
আমি ফিরে গেলাম ধর্মের চোখ রাঙানি কে অগ্ৰাহ্য করে।
আমি ফিরে গেলাম শোষণের বিরুদ্ধ মত প্রতিষ্ঠায়।
আমি ফিরে গেলাম কৃষক, শ্রমিক, পতিতা, জন মজুর, 
চন্ডাল, ফুটপাতবাসী, গৃহহীন, স্নেহহীন মানুষের মাঝে।
রবিঠাকুর, আমার মতো একটা পাড়া গেঁয়ে মেয়ের চোখে আগুন পরিয়ে দিয়েছিলে তুমি।
তোমাকে কখনো ঈশ্বর ভাবিনি।
ভেবেছি আগুনের ফলা থেকে উঠে আসা এক গান।
শুনতে পাচ্ছো সেই গান?
শোনো রবিঠাকুর, শোনো, শোনো, সেই গান...
"অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বানী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রীষ্টানী।
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন মাঝে
প্রেমহার হয় গাঁথা।
জনগন ঐক্য বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা।
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে।"
 
 
 
 
 
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
যুদ্ধক্ষেত্রে যে মানুষটা লাশের পাহাড়ের ওপর
হীরের মুকুট পরেছিলো মাথায়,
আমরা তার কথা ছাপিয়ে রেখেছি বইয়ের পাতায়।
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
সহকর্মীর সাথে প্রতারণা করেও যে জিতে নিয়েছিলো অফিসের সবথেকে উঁচু পদটা,
আমরা প্রকাশ্যে তার প্রশংসা করে এসেছি চিরকাল।
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
মোটা টাকার ঘুষ দিয়ে যোগ্য প্রার্থীকে পিছনে ফেলে চাকরির রেজাল্টে নাম তুলল যে,
আমরা তার বাড়ি মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছি সবসময়।
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
পাশের বাড়ির ছেলেটা অর্থের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিল দেখেও, যে লোকটা ঝকঝকে মারুতি অল্টো কিনে আনল পরের মাসে,
আমরা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলাম, "কি চমৎকার তোমার গাড়ির রং।"
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
লক্ষ মানুষের পেটে লাথি মেরে ভোটের ভাষণে কোনো নেতা যখন বলেছিলো, "এবার থেকে সাম্য আসবে",
আমরা সন্ধ্যাবেলায় কালো চশমা পরে তাকে ভোট দিয়ে এসেছিলাম।
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
বস্তি গুঁড়িয়ে মাল্টিপ্লেক্স হওয়ার পরেও আমরা হাঁ করে গিলেছি তাদের গ্ল্যামার,
টিভিতে তাদের দেখে চোখে জেগেছে অপার্থিব বিস্ময়।
আমরা হেরে যাওয়া মানুষের কথা শুনতে ভালোবাসি না।
টেবিলের তলা দিয়ে মোটা টাকা ঘুষ নেওয়া লোকের সাথে সমঝে কথা বলেছি,
আত্মীয় হলে বাড়ি ডেকে দামী মিষ্টি খাইয়েছি আর গল্প শুনেছি তার সফলতার।
আমরা আসলে জিতে যাওয়াকে মনে রাখি।
আমরা আসলে হেরে যাওয়াকে ভুলতে চাই।
আমরা আসলে প্রত্যেকে একেকটা হেরে যাওয়া সৈনিক,
যারা জিতে যাওয়া অন্ধকারকে আশা ভেবে ভালোবেসে ফেলি অজান্তেই। 
 
 
 
 
প্রিয় আকাশ,
গত পরশু তোমার শেষ মেসেজ পেয়েছি। আর আজ সকালে বন্ধুর পাঠানো ছবিতে দেখলাম তোমার টুকটুকে লাল ভেলভেটের বিয়ের কার্ড। ঠিক যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম। শুধু নামগুলোর পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
তোমার শেষ মেসেজে তুমি লিখেছিলে তোমার বাবা অসুস্থ, তোমাকে এবার সত্যিই বিয়ে করতে হবে। আমি শুধু বলেছিলাম, "বেশ তো তাই করো। " তারপর চিরজীবনের মতো তোমার নাম্বার উড়িয়ে দিয়েছিলাম আমার মুঠোফোন থেকে। কাল রাতে শুধু অন্ধকার ঘরে কটা দীর্ঘশ্বাস বেশি পড়েছিলো।
তোমার মনে আছে আকাশ যখন তুমি আমি দুজনেই বেকার ছিলাম, রাস্তার ধার থেকে সত্তর টাকার জুতো কিনে দু'মাইল হেঁটে ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরতাম রোজ।মোবাইলে ব্যালেন্সটুকু ভরে দিতাম একে অপরকে মাঝে মাঝে। বাবা মারা গেছে কবেই। সঞ্চিত কিছু টাকা যা ছিলো মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিলো। তবুও আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি তোমাকে সাহায্য করার। আমাদের পোড়া দেশটা ফ্রি তে অনুদানের জন্য কাড়াকাড়ি করে মরে, অথচ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির কথা নিয়ে মাথা ঘামায় কম লোক। কম লোক শিড়দাঁড়া উঁচু করে বাঁচার কথা বলে। আমরাও বাঁচতে চেয়েছিলাম, এই সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতাকে হারিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। যেদিন তোমার বিসিএসে গ্ৰুপ এ র রেজাল্ট বেরোলো, সেদিন মায়ের কেমো ছিলো। আমি হাসপাতালে ছিলাম। ফোনে খবরটা শুনে আমি অসুস্থ মাকে বলেছিলাম,"আমি জিতে গেছি মা, আমি জিতে গেছি!"
আসলে পজিশন বোধহয় মানুষকে পাল্টে দেয়, তাই না? আমাকে বরাবরই সাধারণ দেখতে। কিন্তু অফিসার হওয়ার পর তুমি আমার চাকরি পাওয়ার থেকে রূপ নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লে। অফিসারের পাশে সুন্দরী বউ না হলে চলে না! তোমার চ্যাট বক্সে প্রমাণ পেয়েছি কয়েকবার। আমাদের বিকেলের ইতিউতি ঘোরাঘুরি তোমার কাছে একঘেয়ে হয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে, আমার জন্মদিনে চিঠি পাঠাতে ভুলে গেলে তুমি, আমার চাকরির পরীক্ষার রেজাল্ট জানতে ভুলে গেলে তুমি। আমিও নিজেকে গুটিয়ে নিলাম তোমার থেকে। তুমিও পিতৃতান্ত্রিক ইগোর তাড়নায় হঠাৎ করেই বন্ধুত্ব করে ফেললে অসাধারণ রূপসী আমার এক বান্ধবীর সাথে। তারপর একমাস কোনো যোগাযোগ নেই। গত পরশু শেষ মেসেজ, আর আজ বিয়ের কার্ড।
এযুগে ফলাও করে বেকার ছেলের যন্ত্রনার কথা লেখা হয়, কিন্তু সাদামাটা দেখতে বেকার মেয়েদের ক'ফোঁটা চোখের জল লিখে রাখা হয় সাদা কাগজে বলতে পারো? মাধবীলতারা সারাজীবন লড়াই করেই মরে, কিন্তু স্বীকৃতি পায় হাতে গোনা কয়েকজন।
আজ সকালে আমার appointment letter এসেছে। সামনের মাসে পয়লা তারিখ থেকে জয়েনিং। তোমাকে কথাটা জানালাম কারন এযুগেও মাধবীলতারা লড়তে জানে, এযুগেও মাধবীলতারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গালে থাপ্পড় মেরে এগিয়ে যেতে জানে, এযুগেও মাধবীলতারা অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে শেখেনি। এমনকি সেটা নিজের মানুষের বিরূদ্ধে হলেও। কারন বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা।
ইতি,
লতা 
 
 
 
 
 
 
আমাকে নিয়ে কেউ কখনো বাস্তব লেখেনি।
কেউ ঠাঁই দেয়নি সুখী গৃহ কোণের কল্পনায়।
প্রতি বর্ষায় সবুজ ঘাসেরা যখন টলমল করত ,
হাসনুহানার শরীর জুড়ে খেলা করত অনুরাগ।
ভারি ইচ্ছে হত আমার কালো ঠোঁটকে পেরিয়ে
কেউ একজন পড়ে নিক্ আমার যা কিছু গোপন।
কিন্তু আমাকে নিয়ে কেউ কখনো বাস্তব লেখেনি।
কেউ ঠাঁই দেয়নি সুখী গৃহ কোণের কল্পনায়।
বইয়ের পাতায় আজন্মকাল ধরে চলা প্রেম
উঠে আসত যখন অবেলার মনকেমনে,
ভারি ইচ্ছে হত আমার কালো পায়ের চামড়ায়
সযত্নে কেউ পরিয়ে দিক্ হাসির নূপুর।
কিন্তু আমাকে নিয়ে কেউ কখনো বাস্তব লেখেনি।
কেউ ঠাঁই দেয়নি সুখী গৃহ কোণের কল্পনায়।
কবিতার ছন্দ জ্যান্ত হয়ে উঠে 'কৃষ্ণকলি'র মতো
যখন উড়ে বেরিয়েছে ছাতিম গাছের তলায়,
ভারি ইচ্ছে হত আমার উজ্জ্বল দুটো বড়ো বড়ো
চোখের সমুদ্রে কেউ অবগাহন করে খুঁজুক শান্তি।
কিন্তু আমাকে নিয়ে কেউ কখনো বাস্তব লেখেনি।
কেউ ঠাঁই দেয়নি সুখী গৃহ কোণের কল্পনায়।
মিটিং মিছিলে ভাষণে তর্কে আমাকে নিয়ে
যখন থিসিস আর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে,
ভারি ইচ্ছে হত আমার নিটোল দুটো কালো হাতে
জড়িয়ে নিক আর একটা ভরসার হাত।
কিন্তু আমাকে নিয়ে কেউ কখনো বাস্তব লেখেনি।
কেউ ঠাঁই দেয়নি সুখী গৃহ কোণের কল্পনায়।
আসলে কালো মেয়েরা কাব্যে আর প্রতিবাদে
থেকে যায় আজীবন,
কিন্তু মানুষ আর হয়ে ওঠা হয় না।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...