দেবব্রত সিংহ
শিকড় –
দেবব্রত সিংহ
কেঁদুলির মেলা পেরাই তখেন আমাদে রাঙামাটির দেশে
ফাগুনা হাওয়া বইছে,
কচি পলাশের পারা রোদ উঠেছে ঝলমলা,
সেই রোদ ধুলা পথে কানা বাউলের আখড়ায় যাতে যাতে
থমকে দাঁড়ালেক মাস্টর,
কিষ্টনগরের সুধীর মাস্টর,
বললেক, ‘তুই হরিদাসীর লাতি কানুবাগাল না?”
গরুবাথানের গোরুপাল খুলে
গাছতলাতে বাঁশি ফুঁকতে যাইয়ে
আমি ফিক করে হাস্যে ফেলেছি।
মাস্টর বললেক, ‘শুন তোকে একটা কাজ করতে হবেক’।
বললম, কাজ টো কি বঠে?
বললেক, ‘তোকে একটা ছবি আঁকে দিতে হবেক’,
ই বাবা! ছবি আবার কী আঁকব হে
আমি গােরুবাগালি আর বাঁশি ফুঁকা ছাড়া
আর ত কিছু জানি নাই ।
মাস্টর নাছোড়,
ঝোলা হাতড়ে বললেক, ‘এই লে রং, এই লে তুলি
এই লে কাগজ।’
সক্কাল বেলা গোরুবাথানের মাঠে এক পাল গাইগোরুর মাঝে
আমি হা হয়ে ভাল্যে,
বললম, বাবুদে ইসকুলডাঙাতে দেখগা যাইয়ে
আমার পারা কত ছেলেপিলেরা
বসে বসে ছবি আঁকছে,
দেদার ছবি।
মাস্টর শুনলেক নাই কিছুই।
বললেক, ‘উয়াদে ছবি অনেক আছে আমার ঝোলাতে
লে লে দেরি করিস না
তুই একটা গাছের ছবি আঁক দেখনি
অজয়ের পাড়ে এত ফুল ফুটেছে পলাশের
তুই আমাকে একটা পলাশ গাছের ছবি আঁকে দে।”
আমি আর কি করি
অত বড় মানুষ অমন করে বলছে
ই দেখে শেষতক কাগজ নিয়ে বসে গেলম
গরুবাথানের ধুলাতে
হেলাবাড়ি ছাড়ে বাঁশি ফেলে তুলি ধরলম হাতে,
তাবাদে ভাবতে ভাবতে একসমতে
অজয় লদীর পাড়ের একটা আদ্দা পলাশ গাছ’কে
উপড়াই লিইয়ে আস্যে
কৌটা ভর্তি রঙে চুবাই
বসাই দিলম মাস্টরের কাগজে,
কি হইছে কে জানছে
বললম, হেই লাও তুমার ছবি।
ছবি দেখে চোখের পাতনা লড়ে নাই মাস্টরের
আলোপনা মুখে মাস্টর বললেক,
‘তুই ই কি করলি
ই কি ছবি আঁকলি?’
বললম, কেনে, কি হইছে।
মাস্টর বললেক, পলাশ ফুলের গাছ টা না হয় বুঝলম
গাছের তলায় মাটির ভিতরে
তুই ই সব আঁকিবুকি কি আঁকলি?’
বললম, উগুলা শিকড় বঠে হে মাস্টর
চিনতে লারছ,
তুমি শিকড় চিনতে লারছ!
মাস্টর তখন ঝোলা উবুড় করে
যত ছবি সব দিলেক ঢাল্যে,
দেখলম কতরকমের সব গাছের ছবি
তার একটাতেও শিকড় নাই,
আমি অবাক,
বললম, হে মাস্টর,
ই গুলা কি গাছ বঠে হে-?
বাবুদে ঘরের স্কুলে পড়ে ছেলেপেলারা ইসব
কি আঁকছে?
মাস্টর কোনো রা নাই কাড়লেক
আমার আঁকা ছবির দিকে ভালতে ভালতে
একটা কথা শুদালেক,
‘তুই গাছের সঙ্গে শিকড় কেনে আঁকলি ?
বললম, ই বাবা, বড় আশ্চয্যি শুনালে বঠে
গাছ আছে শিকড় নাই
ই কখনঅ হয় নাকি?
তুমি বলঅ,
শিকড় ছাড়া কি গাছ বাঁচে?
জানঅ মাস্টর, বাপ বলথক
‘ছােটোলােক মােটোলােক যে যা বলছে বলুক
আমরা কি জানিস,
আমরা হলম শিকড়ের লোক
আমরা হলম শিকড়ের লোক।’
ইতি
মৃণাল
তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন
এ যুগের মৃণাল।
তারা বললেক গপপোটা আজকার লয় হে
ইটা বহুত পুরোনো গপপো,
তেল চুকচুকা বাঁশে বাঁদর উঠে আর নামে
যতবার চায় উঠতে
ততবার যায় পড়ে,
কী করে উঠবেক বাঁশটাতে যে আচ্ছা করে লগাড়ে মাখাইছে
কাঁচা সরষার তেল
কারা মাখাইছে কেনে মাখাইছে
সে বুঝতে গেলে মাথা লাগবেক হে
বহুত মাথা লাগবেক।
তিনি বললেন না-না-তা-না
ব্যাপারটা কি জানেন
ব্যাপারটা হল ধারাবাহিকতার অভাব,
অন্য আর কিছু না
ধারাবাহিকতার অভাবে বহু সাক্ষর ফের নিরক্ষর।
তখন একজনা ধানকাদামাখা মানুষ
মাখা খাড়া করে উঠে দাঁড়াই বললেক,
আমি বিজয় রুইদাস
মিটিঙে মিছিলে গেলে পার্টিবাবুরা বলে
কমরেড বিজয় রুইদাস
আর পুরন্দরপুর মোড়ে শিরিষতলায় জুতা সেলাই করলে
বলে বিজা মুচি
মাপ করবেন লেতাবাবু
গপপোটা যে কী
সেটা তাহালে খুলে বলি,
তখেন মনসাথানের সানবাঁধানো নিমতলায়
আমাদের মুনিষকামীনদে পাড়ায়
সাক্ষরতা সেন্টার
পার্টিবাবুরা বললেক তোদিকে নবসাক্ষর করব
মিছা নাই বলব
কথাটা শুনে ফুরতি লাগেছিল খুব,
কী বলব আঁইজ্ঞা,
সবে দিনটা কতেক চলেছে মাত্তক
তাবাদে হুট করে অ্যাকদিন মাস্টর বললেক,
যা হইছে বহুত হইছেে
ইবার তোদের মূল্যায়ন হবেক
মূল্যায়নের পরে নবসাক্ষর
নবসাক্ষরের পরে পূর্ণসাক্ষর।
বললাম, হে মাস্টরই যে গোটা বইটাই বাকি হে
পথম পাতাটা ছাড়া তুমি আর ত কিছু শিখাও নাই।
মাস্টর বললেক, যা শিখেছিস বহুত শিখেছিস ।
তাবাদে আর কী
নিরক্ষাররা সাক্ষর হােক বা না হােক
পোস্টারে ফেস্টুনে পতাকায় শ্লোগানে
গোটা জেলা পূর্ণসাক্ষর।
বললাম, বঠে মাস্টর তুমরা দেখালে বঠে
তবে শুনঅ,
আমরা কিন্তুক জানথম
সব জানথম
তুমরা যে আর কিছু শিখাবে নাই
সেটা আমরা জানথম
কেনে শিখাবে নাই তাও জানথম
মাস্টর বললেক, কী জানতিস ?
বললম, শুনঅ তাহালে
আমরা যদি সব শিখে ফেলি
আমরা যদি সব জানে ফেলি
তাহলে তুমাদে চেয়ারগুলানই ত উলটে যাবেক
তখেন তুমরা বসবে কুথায়,
আমরা যদি সব শিখে ফেলি
আমরা যদি সব জানে ফেলি
তাহালে তুমাদে গদিগুলানই ত উলটে যাবেক
তখেন তুমরা দাঁড়াবে কুথায়
তুমরা তখেন দাঁড়াবেটা কুথায়।
শিকড় –
দেবব্রত সিংহ
কেঁদুলির মেলা পেরাই তখেন আমাদে রাঙামাটির দেশে
ফাগুনা হাওয়া বইছে,
কচি পলাশের পারা রোদ উঠেছে ঝলমলা,
সেই রোদ ধুলা পথে কানা বাউলের আখড়ায় যাতে যাতে
থমকে দাঁড়ালেক মাস্টর,
কিষ্টনগরের সুধীর মাস্টর,
বললেক, ‘তুই হরিদাসীর লাতি কানুবাগাল না?”
গরুবাথানের গোরুপাল খুলে
গাছতলাতে বাঁশি ফুঁকতে যাইয়ে
আমি ফিক করে হাস্যে ফেলেছি।
মাস্টর বললেক, ‘শুন তোকে একটা কাজ করতে হবেক’।
বললম, কাজ টো কি বঠে?
বললেক, ‘তোকে একটা ছবি আঁকে দিতে হবেক’,
ই বাবা! ছবি আবার কী আঁকব হে
আমি গােরুবাগালি আর বাঁশি ফুঁকা ছাড়া
আর ত কিছু জানি নাই ।
মাস্টর নাছোড়,
ঝোলা হাতড়ে বললেক, ‘এই লে রং, এই লে তুলি
এই লে কাগজ।’
সক্কাল বেলা গোরুবাথানের মাঠে এক পাল গাইগোরুর মাঝে
আমি হা হয়ে ভাল্যে,
বললম, বাবুদে ইসকুলডাঙাতে দেখগা যাইয়ে
আমার পারা কত ছেলেপিলেরা
বসে বসে ছবি আঁকছে,
দেদার ছবি।
মাস্টর শুনলেক নাই কিছুই।
বললেক, ‘উয়াদে ছবি অনেক আছে আমার ঝোলাতে
লে লে দেরি করিস না
তুই একটা গাছের ছবি আঁক দেখনি
অজয়ের পাড়ে এত ফুল ফুটেছে পলাশের
তুই আমাকে একটা পলাশ গাছের ছবি আঁকে দে।”
আমি আর কি করি
অত বড় মানুষ অমন করে বলছে
ই দেখে শেষতক কাগজ নিয়ে বসে গেলম
গরুবাথানের ধুলাতে
হেলাবাড়ি ছাড়ে বাঁশি ফেলে তুলি ধরলম হাতে,
তাবাদে ভাবতে ভাবতে একসমতে
অজয় লদীর পাড়ের একটা আদ্দা পলাশ গাছ’কে
উপড়াই লিইয়ে আস্যে
কৌটা ভর্তি রঙে চুবাই
বসাই দিলম মাস্টরের কাগজে,
কি হইছে কে জানছে
বললম, হেই লাও তুমার ছবি।
ছবি দেখে চোখের পাতনা লড়ে নাই মাস্টরের
আলোপনা মুখে মাস্টর বললেক,
‘তুই ই কি করলি
ই কি ছবি আঁকলি?’
বললম, কেনে, কি হইছে।
মাস্টর বললেক, পলাশ ফুলের গাছ টা না হয় বুঝলম
গাছের তলায় মাটির ভিতরে
তুই ই সব আঁকিবুকি কি আঁকলি?’
বললম, উগুলা শিকড় বঠে হে মাস্টর
চিনতে লারছ,
তুমি শিকড় চিনতে লারছ!
মাস্টর তখন ঝোলা উবুড় করে
যত ছবি সব দিলেক ঢাল্যে,
দেখলম কতরকমের সব গাছের ছবি
তার একটাতেও শিকড় নাই,
আমি অবাক,
বললম, হে মাস্টর,
ই গুলা কি গাছ বঠে হে-?
বাবুদে ঘরের স্কুলে পড়ে ছেলেপেলারা ইসব
কি আঁকছে?
মাস্টর কোনো রা নাই কাড়লেক
আমার আঁকা ছবির দিকে ভালতে ভালতে
একটা কথা শুদালেক,
‘তুই গাছের সঙ্গে শিকড় কেনে আঁকলি ?
বললম, ই বাবা, বড় আশ্চয্যি শুনালে বঠে
গাছ আছে শিকড় নাই
ই কখনঅ হয় নাকি?
তুমি বলঅ,
শিকড় ছাড়া কি গাছ বাঁচে?
জানঅ মাস্টর, বাপ বলথক
‘ছােটোলােক মােটোলােক যে যা বলছে বলুক
আমরা কি জানিস,
আমরা হলম শিকড়ের লোক
আমরা হলম শিকড়ের লোক।’
মৃণালের পত্র
- দেবব্রত সিংহ
সেই ছুটুবেলাতে আমাদের পাহাড় কোলের জোড়ে
লদী পেরাতে যাইয়ে
এক আষাঢ় মাসের হড়কা বানে
আমি আর আমার ভাই
ভাস্যে গেছলম বানের তোড়ে
ভাইটি গেল ডুবে আমি উঠলম বাঁচে
পাড়ার লোকে বললেক
বিটিছেল্যার জীবন
যদি বেটাছেল্যা হতক
তাহলে কি বাঁচতক।
লদী পেরাতে যাইয়ে
এক আষাঢ় মাসের হড়কা বানে
আমি আর আমার ভাই
ভাস্যে গেছলম বানের তোড়ে
ভাইটি গেল ডুবে আমি উঠলম বাঁচে
পাড়ার লোকে বললেক
বিটিছেল্যার জীবন
যদি বেটাছেল্যা হতক
তাহলে কি বাঁচতক।
আমার মরণ নাই
সেই কথাটাই আজ তুমাকে লতুন করে বলতে চাই
বেশিদিনের কথা লয়
আমাদে বাঘমুণ্ডির পাহাড়ী পথে জিবগাড়ি ছুটাই
লাল ধুলা উড়াই
যিদিন আল্যে তুমরা
পাহাড়কোলে জোড়ের ধারে চড়ুভাতি করতে আল্যে
সিদিনটা মনে আছে তুমার
দিনটা ছিল খরবার
মাসটা ছিল মধুমাস
টাঁড়ে টাঁড়ে ডাঙা ডহরে
পলাশবনে আগুন লাগা মধুমাস।
আমার মরণ নাই
তুমি বলেছিলে তুমার সঙ্গে দেখা হবেক বলে
মরণ নাই আমার
তুমি রাজপুত্তুর
কত লেখাপড়া জানা মানুষ তুমি
বি এ, এম এ পাশ
হাই ইসকুলের মাস্টার
আমি
আমি আর কে
কাঠকুড়ানি
রাঙামাটির গাঁয়ে ঘরের ইসকুলছুট কাঠকুড়ানি
কী সুন্দর গায়ের রং তুমার
একবারি চাঁপা ফুলের পারা
আমি
আমি একবারি কালো
আঁকড় ফলের পারা মিশমিশে কালো
তবে সবাই বলে কালো হলে হবে কী
আমার গড়ন খুউব ভালো
টানা টানা চোখ বাঁশির মতন নাক
ছিপছিপে চেহারা
বাঘমুণ্ডির হাটের হলুদরাঙা শাড়ি পরে দাঁড়ালে
খোঁপায় লাল পলাশের ফুল গুঁজলে
আমাকে নকি দেখায় দারুণ
একবারি মনভুলানি
একবারি মনকাড়ানি।
সেই কথাটাই আজ তুমাকে লতুন করে বলতে চাই
বেশিদিনের কথা লয়
আমাদে বাঘমুণ্ডির পাহাড়ী পথে জিবগাড়ি ছুটাই
লাল ধুলা উড়াই
যিদিন আল্যে তুমরা
পাহাড়কোলে জোড়ের ধারে চড়ুভাতি করতে আল্যে
সিদিনটা মনে আছে তুমার
দিনটা ছিল খরবার
মাসটা ছিল মধুমাস
টাঁড়ে টাঁড়ে ডাঙা ডহরে
পলাশবনে আগুন লাগা মধুমাস।
আমার মরণ নাই
তুমি বলেছিলে তুমার সঙ্গে দেখা হবেক বলে
মরণ নাই আমার
তুমি রাজপুত্তুর
কত লেখাপড়া জানা মানুষ তুমি
বি এ, এম এ পাশ
হাই ইসকুলের মাস্টার
আমি
আমি আর কে
কাঠকুড়ানি
রাঙামাটির গাঁয়ে ঘরের ইসকুলছুট কাঠকুড়ানি
কী সুন্দর গায়ের রং তুমার
একবারি চাঁপা ফুলের পারা
আমি
আমি একবারি কালো
আঁকড় ফলের পারা মিশমিশে কালো
তবে সবাই বলে কালো হলে হবে কী
আমার গড়ন খুউব ভালো
টানা টানা চোখ বাঁশির মতন নাক
ছিপছিপে চেহারা
বাঘমুণ্ডির হাটের হলুদরাঙা শাড়ি পরে দাঁড়ালে
খোঁপায় লাল পলাশের ফুল গুঁজলে
আমাকে নকি দেখায় দারুণ
একবারি মনভুলানি
একবারি মনকাড়ানি।
বাপ আমার বাবু ঘরে মুনিষখাটা খেতমজুর
এমনিতে তার সব ভালো
শুধু দোষের মধ্যে দোষ
সে একজনা নেশাভাঙ করা মানুষ
দিন ফুরালে সনঝা হল্যেই
তাকে হাতছানি দেয় মহুয়াতলার মদ ভাঁটি
ঘরদুয়ার, ছেল্যাপেলা, লেখাপড়া
বাপের কনদিকে লজর নাই
তখন বহুত ছুটুবেলা
তখন থাকেই দেখতম
বাপ আমাকে বিদায় করলেই বাঁচে
একদম হাঁফ ছাড়ে বাঁচে
মা কিন্তুক তা লয়
মা বলতক আত ছুটুতে বিহা কীসের
আর পাঁচটা বিটিছেলা যেরম যাচ্ছে ইসকুলে
তেমনি যাক
দুপাতা লেখাপড়া করে আসুক
সেই করে টানেটুনে কোনোমতনে গাঁয়ের ইসকুলে ওই নাইন টুকুন
ইয়ার মাঝে বলা নাই কওয়া নাই
বাপ একদিন হুট করে লাগাই দিলেক বিহা
তখন কী আর জানথম অত
পুরুল্যার খোট্টা পাড়ার জানকি যাদবের কাছে
আগাম টাকা লিইছে বাপ
আমি দাঁড়াইছিলম রুখে
সেই রুখে দাঁড়ানর জোরে
বিহার দিনে থানায় যাইয়ে আমি ভাঙে দিইছিলম সব
কাগজআওলা টিভিআওলারা কুথায় থাকে কেজানে
তারা আমাকে লিয়ে একঘড়িকে দুনিয়া দিলেক খবর করে
সে খবর ত দেখেছিলে তুমি
মিছা নাই বলব এতসব জানে শুনে
তুমি আমাকে বিহা করেছিলে বলে
গাঁয়ের লোকে দেবতা বলেছিল তুমাকে
মনে আছে আমার সব মনে আছে।
এমনিতে তার সব ভালো
শুধু দোষের মধ্যে দোষ
সে একজনা নেশাভাঙ করা মানুষ
দিন ফুরালে সনঝা হল্যেই
তাকে হাতছানি দেয় মহুয়াতলার মদ ভাঁটি
ঘরদুয়ার, ছেল্যাপেলা, লেখাপড়া
বাপের কনদিকে লজর নাই
তখন বহুত ছুটুবেলা
তখন থাকেই দেখতম
বাপ আমাকে বিদায় করলেই বাঁচে
একদম হাঁফ ছাড়ে বাঁচে
মা কিন্তুক তা লয়
মা বলতক আত ছুটুতে বিহা কীসের
আর পাঁচটা বিটিছেলা যেরম যাচ্ছে ইসকুলে
তেমনি যাক
দুপাতা লেখাপড়া করে আসুক
সেই করে টানেটুনে কোনোমতনে গাঁয়ের ইসকুলে ওই নাইন টুকুন
ইয়ার মাঝে বলা নাই কওয়া নাই
বাপ একদিন হুট করে লাগাই দিলেক বিহা
তখন কী আর জানথম অত
পুরুল্যার খোট্টা পাড়ার জানকি যাদবের কাছে
আগাম টাকা লিইছে বাপ
আমি দাঁড়াইছিলম রুখে
সেই রুখে দাঁড়ানর জোরে
বিহার দিনে থানায় যাইয়ে আমি ভাঙে দিইছিলম সব
কাগজআওলা টিভিআওলারা কুথায় থাকে কেজানে
তারা আমাকে লিয়ে একঘড়িকে দুনিয়া দিলেক খবর করে
সে খবর ত দেখেছিলে তুমি
মিছা নাই বলব এতসব জানে শুনে
তুমি আমাকে বিহা করেছিলে বলে
গাঁয়ের লোকে দেবতা বলেছিল তুমাকে
মনে আছে আমার সব মনে আছে।
সেই ফাগুন দিনের দিন ফুরনো বেলায়
যিদিন তুমার সঙ্গে গেলম তুমাদে ঘরে
সিদিন ঘোমটা মাথায় আমাকে দেখে
ভূত দেখেছিল তুমার মা
তার মু গেছল শুকাই
তুমার বউদিদি মানে আমার বড়ো জা
সেও দেখলাম তাই
তুমার ইসকুলের মাস্টাররা পাড়ার বন্ধুরা
তারা বাহবা দিইছিল খুব
তবে সে কিন্তুক ভালো লাগে নাই আমার
সে ঠিক বাহবা লয়
তার ভিতরে কতকটা ছিল কৌতুক কতকটা করুণা।
যিদিন তুমার সঙ্গে গেলম তুমাদে ঘরে
সিদিন ঘোমটা মাথায় আমাকে দেখে
ভূত দেখেছিল তুমার মা
তার মু গেছল শুকাই
তুমার বউদিদি মানে আমার বড়ো জা
সেও দেখলাম তাই
তুমার ইসকুলের মাস্টাররা পাড়ার বন্ধুরা
তারা বাহবা দিইছিল খুব
তবে সে কিন্তুক ভালো লাগে নাই আমার
সে ঠিক বাহবা লয়
তার ভিতরে কতকটা ছিল কৌতুক কতকটা করুণা।
তুমি বলেছিলে লতুন করে আবার আমাকে লেখাপড়া শিখাবে
তুমি বলেছিলে লতুন করে আবার আমাকে ভরতি করে দিবে ইসকুলে
কাজের চাপে সে আর তুমার হল্য কই
কত ব্যস্ত মানুষ তুমি
ইসকুল, পার্টি, ক্লাব, বস্তিবাসী, গরিব দুখী
প্রতিবন্ধী, রক্তদান জীবনদান,
তুমার কত কাজ।
একেক দিন কাজের টানে তুমি বাইরে কাটাতে রাত
একেক দিন কাজের টানে ঘরের কথা মনে পড়ত না তুমার
এমনি করে দেখতে দেখতে
ঘরের চাইয়ে বাইরে থাকার সময় গেল বাড়ে
একদিক তুমার মা বললেক,
'ও তো ঘর সংসারের মানুষই না
বিয়ে টিয়ে কেনে যে গেল করতে',
একদিন তুমার বউদিদি বললেক,
'ও তো বাঁধনছাড়া লাগামছাড়া মানুষ
বাউন্ডুলে মানুষ
ওকে এসব মানায় না
বিয়ে টিয়ে একবারি মানায় না'
তুমি বলেছিলে লতুন করে আবার আমাকে ভরতি করে দিবে ইসকুলে
কাজের চাপে সে আর তুমার হল্য কই
কত ব্যস্ত মানুষ তুমি
ইসকুল, পার্টি, ক্লাব, বস্তিবাসী, গরিব দুখী
প্রতিবন্ধী, রক্তদান জীবনদান,
তুমার কত কাজ।
একেক দিন কাজের টানে তুমি বাইরে কাটাতে রাত
একেক দিন কাজের টানে ঘরের কথা মনে পড়ত না তুমার
এমনি করে দেখতে দেখতে
ঘরের চাইয়ে বাইরে থাকার সময় গেল বাড়ে
একদিক তুমার মা বললেক,
'ও তো ঘর সংসারের মানুষই না
বিয়ে টিয়ে কেনে যে গেল করতে',
একদিন তুমার বউদিদি বললেক,
'ও তো বাঁধনছাড়া লাগামছাড়া মানুষ
বাউন্ডুলে মানুষ
ওকে এসব মানায় না
বিয়ে টিয়ে একবারি মানায় না'
কথা শুনে কষ্ট হত খুব
দুঃখও
সেই দুঃখে একলা ঘরে দু চোখ দিয়ে জল গড়াত আমার
তখন মনে পড়ত দিদিমার কথা
দিদিমা বলত, 'গরিব ঘরের বিটিছেলার আবার দুখ কীসের
আমাদে দুখ ও যা সুখও তা
আর হেই দ্যাখ আমার একটা কথা শুনে রাখ
যার রং কালো
তার মব ভালো'
কিন্তু মন ভালো হলে হবেকটা কী
সে মনের খবর লিবার লোক কুথায়।
দুঃখও
সেই দুঃখে একলা ঘরে দু চোখ দিয়ে জল গড়াত আমার
তখন মনে পড়ত দিদিমার কথা
দিদিমা বলত, 'গরিব ঘরের বিটিছেলার আবার দুখ কীসের
আমাদে দুখ ও যা সুখও তা
আর হেই দ্যাখ আমার একটা কথা শুনে রাখ
যার রং কালো
তার মব ভালো'
কিন্তু মন ভালো হলে হবেকটা কী
সে মনের খবর লিবার লোক কুথায়।
বড়লোকদের হুজুগের কোনো কমতি নাই
কতরকমের হুজুগ,
গরিবঘরের বিহা ভাঙে যাওয়া
কালো মেইয়াকে উদ্ধার করাও যে একটা হুজুগ
সে আমি জানব কীরম করে,
দেখলম হজুগটা একটুন কাটতে না কাটতেই
তুমি পড়লে আমার গায়ের রং লিয়ে,
কালো রং ফরসা করার যত রকমের নামি দামি রকমারি ক্রিম
সব একের পর এক আনতে লাগলে তুমি
তার সঙ্গে আবার পালা করে শুনাতে লাগলে খবর
কাগজের সব মনখারাপ করা খবর
'গায়ের রং কালো বলে বউকে খুন করল বর'।
'গায়ের রং কালো বলে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় গলায় দড়ি দিল মেয়ে'
এমনি সব আরও কত খারাপ খবর
তবে তুমি আবার সান্ত্বনাও দিতে
তুমি বলতে,
'কেন যে কাগজগুলো ছাপে এসব খবর',
আমি বলতম, চাই নাই ইসব খবর শুনতে নাই চাই।
তুমি বলতে,
'দেখো খারাপ খবরও জানা দরকার তুমার
নাইলে দেশটা যাচ্ছে কোনদিকে সে তুমি পারবে না বুঝতে',
আমি বলেছিলম, এমন দেশকে বুঝে আমার কাজ নাই।
এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন
দিনের পর দিন।
তারপর একদিন জষ্টিমাসের বেলা পড়তি অবেলায়
তুমি বললে, হাওয়া খেতে যাব
চলো হাওয়া খেতে যাব গঙ্গার পাড়ে
কথা শুনে তুমার মুখের দিকে আমি রইলাম চাইয়ে
তাই দেখে তুমি বললে 'না না মিথ্যে নয় সত্যি বলছি'।
কতরকমের হুজুগ,
গরিবঘরের বিহা ভাঙে যাওয়া
কালো মেইয়াকে উদ্ধার করাও যে একটা হুজুগ
সে আমি জানব কীরম করে,
দেখলম হজুগটা একটুন কাটতে না কাটতেই
তুমি পড়লে আমার গায়ের রং লিয়ে,
কালো রং ফরসা করার যত রকমের নামি দামি রকমারি ক্রিম
সব একের পর এক আনতে লাগলে তুমি
তার সঙ্গে আবার পালা করে শুনাতে লাগলে খবর
কাগজের সব মনখারাপ করা খবর
'গায়ের রং কালো বলে বউকে খুন করল বর'।
'গায়ের রং কালো বলে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় গলায় দড়ি দিল মেয়ে'
এমনি সব আরও কত খারাপ খবর
তবে তুমি আবার সান্ত্বনাও দিতে
তুমি বলতে,
'কেন যে কাগজগুলো ছাপে এসব খবর',
আমি বলতম, চাই নাই ইসব খবর শুনতে নাই চাই।
তুমি বলতে,
'দেখো খারাপ খবরও জানা দরকার তুমার
নাইলে দেশটা যাচ্ছে কোনদিকে সে তুমি পারবে না বুঝতে',
আমি বলেছিলম, এমন দেশকে বুঝে আমার কাজ নাই।
এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন
দিনের পর দিন।
তারপর একদিন জষ্টিমাসের বেলা পড়তি অবেলায়
তুমি বললে, হাওয়া খেতে যাব
চলো হাওয়া খেতে যাব গঙ্গার পাড়ে
কথা শুনে তুমার মুখের দিকে আমি রইলাম চাইয়ে
তাই দেখে তুমি বললে 'না না মিথ্যে নয় সত্যি বলছি'।
সেই কতদিন আগে লতুন বউ হইয়ে আসার পরে
শাশুড়ি আর জায়ের সঙ্গে একদিন
পূজা দিয়ে আইছিলম গঙ্গার ঘাটে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে
ইপারে তুমাদে পুরোনো শহর
ভাঙা মন্দির চানের ঘাট কাঁসর ঘন্টা
উপারে সবুজ খেত সরষে ফুল আঁখের বাদা ইঁট ভাটা
তালসুপারি, মাটির বাড়ি, ডিঙি নৌকা, খায়াঘাট, হইচই মানুষজন
তুমার হাত ধরে কতদিন পরে আবার সেই গঙ্গার পাড়ে
দিন ফুরনো অবেলাতে আউলিবাউলি হাওয়ার তোড়ে
আমার চুড়িদারের ওড়না যাচ্ছিল উড়ে
তুমি চাইছিলে নিরিবিলি
আরও নিরিবিলি
সে বহুতদূরে পোড়া মন্দিরের ভাঙন ধরা ঘাটের ধারে
আমার কেমন দম আসছিল আটকে
তুমার তখন বাঁধ ভাঙেছে ভালোবাসার
বউয়ের গলা জড়াই চুমু খাইয়ে আদর করার ধুমে
তুমার তখন 'রা' সরে নাই মুখে।
শাশুড়ি আর জায়ের সঙ্গে একদিন
পূজা দিয়ে আইছিলম গঙ্গার ঘাটে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে
ইপারে তুমাদে পুরোনো শহর
ভাঙা মন্দির চানের ঘাট কাঁসর ঘন্টা
উপারে সবুজ খেত সরষে ফুল আঁখের বাদা ইঁট ভাটা
তালসুপারি, মাটির বাড়ি, ডিঙি নৌকা, খায়াঘাট, হইচই মানুষজন
তুমার হাত ধরে কতদিন পরে আবার সেই গঙ্গার পাড়ে
দিন ফুরনো অবেলাতে আউলিবাউলি হাওয়ার তোড়ে
আমার চুড়িদারের ওড়না যাচ্ছিল উড়ে
তুমি চাইছিলে নিরিবিলি
আরও নিরিবিলি
সে বহুতদূরে পোড়া মন্দিরের ভাঙন ধরা ঘাটের ধারে
আমার কেমন দম আসছিল আটকে
তুমার তখন বাঁধ ভাঙেছে ভালোবাসার
বউয়ের গলা জড়াই চুমু খাইয়ে আদর করার ধুমে
তুমার তখন 'রা' সরে নাই মুখে।
আমি কাঠকুড়ানি
রাঙামাটির গাঁ গেরামের ইসকুল ছুট কাঠকুড়ানি
আমি কী আর বুঝতে পারি
তুমার অমন আদর করার মানে কি আর বুঝতে পারি
আমার জায়গায় থাকত যদি অন্য কেউ
সেও কি পারত বুঝতে
ভালোবাসার মানুষ জড়িয়ে ধরে আদর করার ফাঁকে
একঘড়িকে লদীর জলে ফেলতে পারে ঠেলে
বলো না এটা বুঝবে কীরকম করে।
কত কী যে বুঝার আছে এই দুনিয়ায়
এই যে তুমি বি এ এম এ পাশ দিয়ে
মাস্টার হইছিলে হাই ইসকুলে
তুমিও কি পারেছিলে বুঝতে
যাকে অমন করে ঠেলে ফেললে ভরা গঙ্গার জলে
সে দিব্যি সাঁতার কাটে উথালপাতাল ঢেউয়ের তালে
পার হইয়ে যাবে লদী
অত বড় লদী
পারঅ নাই বুঝতে
একদম পারঅ নাই
তাই তখুনি পাড় ছাড়ে পালাইছিলে দৌড়ে
কী অদ্ভুত মানুষ তুমি
তুমাকে একদিন বসাইছিলাম দেবতার আসনে
বলঅ আজ কুথায় বসাব তুমায়।
রাঙামাটির গাঁ গেরামের ইসকুল ছুট কাঠকুড়ানি
আমি কী আর বুঝতে পারি
তুমার অমন আদর করার মানে কি আর বুঝতে পারি
আমার জায়গায় থাকত যদি অন্য কেউ
সেও কি পারত বুঝতে
ভালোবাসার মানুষ জড়িয়ে ধরে আদর করার ফাঁকে
একঘড়িকে লদীর জলে ফেলতে পারে ঠেলে
বলো না এটা বুঝবে কীরকম করে।
কত কী যে বুঝার আছে এই দুনিয়ায়
এই যে তুমি বি এ এম এ পাশ দিয়ে
মাস্টার হইছিলে হাই ইসকুলে
তুমিও কি পারেছিলে বুঝতে
যাকে অমন করে ঠেলে ফেললে ভরা গঙ্গার জলে
সে দিব্যি সাঁতার কাটে উথালপাতাল ঢেউয়ের তালে
পার হইয়ে যাবে লদী
অত বড় লদী
পারঅ নাই বুঝতে
একদম পারঅ নাই
তাই তখুনি পাড় ছাড়ে পালাইছিলে দৌড়ে
কী অদ্ভুত মানুষ তুমি
তুমাকে একদিন বসাইছিলাম দেবতার আসনে
বলঅ আজ কুথায় বসাব তুমায়।
দ্যাখঅ মানুষে মানুষে কী তফাত দ্যাখঅ
তুমি কত কাছের মানুষ হইয়ে কত সহজে
আমাকে ঠেলে ফেলে দিলে লদীর জলে
আরেকজন কত দূরের মানুষ হইয়ে লদীতে ঝাঁপ দিয়ে
সাঁতার কাটে দু হাত দিলে বাড়ায়ে
মানুষটা দেহাতি মানুষ
নাম শিউচরণ
পেশায় ইট ভাটার বদলি মজদুর
না তুমার মতন পড়াশুনা করা মাস্টার লয়
লেখাপড়ায় সে বিলকুল আনপড়।
তুমি কত কাছের মানুষ হইয়ে কত সহজে
আমাকে ঠেলে ফেলে দিলে লদীর জলে
আরেকজন কত দূরের মানুষ হইয়ে লদীতে ঝাঁপ দিয়ে
সাঁতার কাটে দু হাত দিলে বাড়ায়ে
মানুষটা দেহাতি মানুষ
নাম শিউচরণ
পেশায় ইট ভাটার বদলি মজদুর
না তুমার মতন পড়াশুনা করা মাস্টার লয়
লেখাপড়ায় সে বিলকুল আনপড়।
তুমি ভাবছ নালিশ করব তুমার নামে
না নালিশ আমি করব না
কী হবেক নালিশ করে
আমাদে এই পোড়া দেশটার সবই ত তুমাদে দখলে
নেতা, মন্ত্রী, থানা, পুলিশ,কোর্ট, কাছারি সব
সিখেনে গাঁ গেরামের গরিব ঘরের মেইয়াদের
কতটুকুনি আর জায়গা আছে বলঅ
তবে আখনো মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ
আখনো মানুষের জন্যে জীবন দেয় মানুষ
সেই মানুষকে সাক্ষী রাখে এক বড়মানুষের বহুতকালের কথা
আজ আবার লতুন করে বলি তুমাকে
শুনঅ,
না নালিশ আমি করব না
কী হবেক নালিশ করে
আমাদে এই পোড়া দেশটার সবই ত তুমাদে দখলে
নেতা, মন্ত্রী, থানা, পুলিশ,কোর্ট, কাছারি সব
সিখেনে গাঁ গেরামের গরিব ঘরের মেইয়াদের
কতটুকুনি আর জায়গা আছে বলঅ
তবে আখনো মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ
আখনো মানুষের জন্যে জীবন দেয় মানুষ
সেই মানুষকে সাক্ষী রাখে এক বড়মানুষের বহুতকালের কথা
আজ আবার লতুন করে বলি তুমাকে
শুনঅ,
আর আমার দরকার নেই।
.... তোমরা যে আপন ইচ্ছামত আপন দস্তুর দিয়ে
.... তোমরা যে আপন ইচ্ছামত আপন দস্তুর দিয়ে
জীবনটাকে চিরকাল পায়ের তলায় চেপে রেখে
দেবে, তোমাদের পা এত লম্বা নয়।
দেবে, তোমাদের পা এত লম্বা নয়।
মৃণাল
তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন
এ যুগের মৃণাল।
তেজ
– দেবব্রত সিংহ
‘মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।’
কাগজওয়ালারা বইললেক,
“উঁ অতটুকু বইললে হবেক কেনে?
তুমি এবারকার মাধ্যমিকে পত্থম হইছ।
তোমাকে বইলতে হবেক আরো কিছু।”
পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি-
সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার
কোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,
হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেক
তখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।
কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখে
চোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।
-একি স্বপন দেখছি নাকি-
স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে।
কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।
আজ বাপ বেঁইচে থাইকলে
আমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-
আমার বুকের ভিতর
যে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা।
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।
সেটো দেখাইতে পাইত্থম।
আপনারা বইলছেন বটে
“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”
কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু
উঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই।
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।
বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…
আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।
যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি
“বিটি না মাটি’
ঠাকুমা বইলথক্,
পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’
গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্
“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।
শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালে
আর এক কানে বার কইরে দিবি।’
তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।
ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।
মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মা
চুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।
মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।
আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলাম
ইতিহাস…
কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।
মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!
আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।
ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।
শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাই
মায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।
পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,
সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,
দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসন
আমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম
“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”
বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-
“কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,
তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কাল
আমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালো
আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”
বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।
তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”
কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেড়োই চইলে আইলম।”
তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।
বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলে
দুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা
সাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।
মা কুনো রা কাড়ে নাই।
আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলে
গা-হাত-পা সেঁকছিল মা।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটা
ঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।
আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।
বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকে
মাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –
যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।
শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।
বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।
তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,
তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।
যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াই
নিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।
এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।
না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”
আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,
কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়ে
কাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…
তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপে
আগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।
‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতে
বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,
হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,
“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,
তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।
তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসে
তার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।
– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।
শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,
আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–
এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“
তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,
ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,
ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।
গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।
আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-
“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারা
যে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’
মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।
গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।
ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-
“ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,
তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।
বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”
বইল্ লম –
“ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।
আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিন
অন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারা
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“
– দেবব্রত সিংহ
‘মু জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি বটে।’
কাগজওয়ালারা বইললেক,
“উঁ অতটুকু বইললে হবেক কেনে?
তুমি এবারকার মাধ্যমিকে পত্থম হইছ।
তোমাকে বইলতে হবেক আরো কিছু।”
পঞ্চায়েতের অনি বৌদি, পধান, উপপধান, এইমেলে, এম.পি-
সব একেবারে হামলিয়ে পড়ল আমাদের মাটির কুঁইড়েঘরে।
জামবনি ইস্কুলের হেডমাস্টার
কোন বিহান বেলায় টিনের আগর খুইলে,
হেইকে, ডেইকে, ঘুম ভাঙাই- খবরটা যখন পথম শুনালেক
তখন মাকে জড়াই শুয়ে ছিলুম আমি।
কুঁড়াঘরের ঘুটঘুইটা আঁধারে হেডমাস্টার মশাইরে দেইখে
চোখ কচালে মায়ের পারা আমিও হাঁ – হয়ে ভাইবে ছিলেম।
-একি স্বপন দেখছি নাকি-
স্যার বইলল, এটা স্বপুন লয়, স্বপুন লয়, সত্যি বইটে।
কথাটো শুইনে কেঁইনদে ভাসায়েছিলুম আমরা মা বিটি।
আজ বাপ বেঁইচে থাইকলে
আমি মানুষটাকে দেখাইতে পাইত্থম। দেখাইতে পাইতত্থেম বহুত কিছু-
আমার বুকের ভিতর
যে তেজালো সইনঝা বাতিটা জ্বালায়ে ছিল মানুষটা।
সেই বাতিটা আজকে কেমন আমাদের কুঁইড়ে ঘরটাকে আলো কইরেছে।
সেটো দেখাইতে পাইত্থম।
আপনারা বইলছেন বটে
“তুমাদের মতো মেইয়ারা যদি উঠে আসে তবে ভারতবর্ষ উঠে আসে।”
কথাটা খুবই সত্যি, কিন্তু
উঠে আসার রাস্তাটা যে এখোন তৈয়ার হয় নাই।
খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিস।
বহুত দম লাগে। বহুত ত্যাজ লাগে…
আমি জামবনির কুঁইরি পাড়ার শিবু কুঁইরির বিটি সাঁঝলি।
যখন থেকে হুঁশ হইছে তখন থেকে শুইনে আসছি
“বিটি না মাটি’
ঠাকুমা বইলথক্,
পরের ঘরে হেঁইসেল ঠেইলবেক্ তার আবার লিখাপড়া’
গাঁয়ের বাবুরা বইলথক্
“দ্যাখ সাঁঝলি – মন খারাপ কইরলি তো হেইরে গেলি।
শুন যে যা বইলছে বলুক্। সে সব কথা এক কানে সিধালে
আর এক কানে বার কইরে দিবি।’
তখ্যান বাবুপাড়ার দেঘইরা ঘরে কামিন খাইটতক মা।
ক্ষয় রোগের তাড়সে-মায়ের গতরটা ভাঙে নাই অতোটা।
মাঝে মইধ্যে জ্বরটর আইত বটে, জ্বর এলে মা
চুপচাপ এঙনাতে তালাই পাইতে শুইয়ে থাইকতো।
মনে আছে সে ছিল এক জাঁড় কালের সকাল।
রোদ উঠেছিল ঝলমলানি ঝিঙা ফুলা রোদ।
আমি সে রোদে পিঠ দিয়া গা দুলাই পড়ছিলাম
ইতিহাস…
কেলাস সেভেনের সামন্ত রাজাদের ইতিহাস।
দে ঘরের গিন্নি লোক পাঠাইছিল বারকতক।
মায়ের জ্বর সে তারা শুইনতে নাই চায়!
আমাদের দিদি বুঢ়ি তখনো বাঁইচে।
ছেঁড়া কম্বল মুড়হি দিয়ে বিড়ি ফুকছিল বুড়হি।
শেষতক্ বুড়হি সেদিন পড়া থেকে উঠাই
মায়ের কাইজ টুকুন কইরতে পাঠাই ছিল বাবু ঘরে।
পুরানো ফটক ঘেরা উঠান-অতোবড়ো দরদালান- অতোবড়ো বারান্দা,
সব ঝাঁট ফাট দিয়ে সাফ সুতরো করে আসছিলুম চইলে,
দেঘইরে গিন্নি নাই ছাইড়ল্যাক, একগাদা এটাকাটা-জুঠা বাসন
আমার সামনে আইনে ধইরে দিলেক। বইল্লুম
“আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো,”
বাবু গিন্নির সেকি রাগ’-
“কি বইল্লি তুই যতবড়ো মু লয় তত বড়ো কথা? জানিস,
তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা সবাই এতক্কাল
আমাদের জুঠা বাসন ধুয়ে গুজারে গ্যালো
আর তুই আমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবি!”
বল্লুম “হ আমি তোমাদের জুঠা বাসন ধুইতে লাইরবো।
তোমরা লোক দেখে লাওগা। আমি চইল্লোম”
কথাটো বইলে গটগট গটগট কইরে বাবু গিন্নির মুখের সামনে
আমি বেড়োই চইলে আইলম।”
তা বাদে সে লিয়ে কি কাইন্ড। কি ঝাম্যালা।
বেলা ডুবলে মাহাতোদের ধান কাট্টে বাপ ঘরে ফিরে আইলে
দুপাতা লিখাপড়া করা লাত্নির ছোট মুখে বড়ো থুতির কথা
সাতকাহন কইরে বইলেছিল বুড়হি দিদি।
মা কুনো রা কাড়ে নাই।
আঘর মাসের সইন্ ঝা বেলাই এঙ্গ্নাতে আগুন জ্বেইলে
গা-হাত-পা সেঁকছিল মা।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকানো বাপের পেটানো পাথরের মুখটা
ঝইলকে উঠেছিল আগুনের আঁচে।
আমি বাপের অমুন চেহারা কুনোদিন দেখি লাই।
বাপ সেদিন মা আর দিদি বুড়ির সমুখে আমাকে কাইছে ডেইকে
মাথায় হাত বুলাই গম্ গইমা গলায় বইলেছিল –
যা কইরেছিস্! বেশ্ কইরেছিস্।
শুন্, তর মা, তর মায়ের মা, তার মায়ের মা- সবাই কইরেছে কামিনগিরি।
বাবুঘরে গতর খাটাই খাইয়েছে। তাইতে হইছে টা কি।
তাতে হইছে টা কি! ই-কথাটো মনে রাখবি সাঝ্লি,
তুই কিন্তু কামিন হবার লাগে জম্মাস লাই।
যত বড় লাট সাহেবই হোক কেনে কারু কাছে মাথা নোয়াই
নিজের ত্যাজ বিকাবি লাই।
এই ত্যাজ টুকুর ল্যাইগে লিখাপড়া শিখাচ্ছি তুকে।
না হলে আমাদের মতো হা-ভাতা মানুষের ঘরে আর আছে টা কি?”
আমি জামবনির কুইরি পাড়ার শিবু কুইরির বিটি সাঁঝলি,
কবেকার সেই কেলাস সেভেনের কথা ভাবতে যায়ে
কাগজওয়ালা টিভিওয়ালাদের সামনে এখুন কি যে বলি…
তালপাতার রদ দিয়ে ঘেরা গোবুর লতার এঙ্গনাতে লুকে এখন লুকাকার।
তার মাঝে বাঁশি বাজাই, জিপগাড়িতে চেইপে
আগুপিছু পুলিশ লিয়ে মন্ত্রী আইল্যাক ছুটে।
‘কুথায় সাঁঝলি কুইরি কুথায়’, বইলতে বইলতে
বন্দুকধারী পুলিশ লিয়ে সুজা আমাদের মাটির কুইড়ে ঘরে,
হেডমাস্টার বইললে ‘পনাম কর, সাঁঝলি পনামকর’
মন্ত্রী তখন পিঠ চাপড়াইল্যাক। পিঠ চাপরাই বইল্লেক,
“তুমি কামিন খেইটে মাইধ্যমিকে পথম হইছ,
তাই তুমারে দেইখতে আইলম্, সত্যিই বড় গরীব অবস্থা বটে।
তুমাদের মতো মিয়ারা যাতে উঠে আসে
তার লাগেই তো আমাদের পার্টি, তার লাগেই তো আমাদের সরকার।
– এই লাও, দশ হাজার টাকার চেকটা এখুন লাও।
শুন আমরা তুমাকে আরো ফুল দিব, সম্মর্ধ্বনা দিব,
আরো দ্যাদার টাকা তুলে দিব।–
এই টিবির লোক, কাগুজের লোক, কারা আছেন, ই-দিকে আসেন।“
তক্ষুনি ছোট বড় কতরকমের সব ঝইলকে উঠল ক্যামেরা,
ঝইলকে উঠল মন্ত্রীর মুখ। না না মন্ত্রী লয়, মন্ত্রী লয়,
ঝইলকে উঠল আমার বাপের মুখ।
গন্ গনা আগুনের পারা আগুন মানুষের মুখ।
আমি তক্ষুনি বইলে উঠলম-
“না না ই টাকা আমার নাই লাইগব্যাক। আর আপনারা
যে আমায় ফুল দিব্যান, সম্মর্ধ্বনা দিব্যান বইলছেন তাও আমার নাই লাইগব্যাক।’
মন্ত্রী তখন ঢোক গিলল্যাক।
গাঁয়ের সেই দেঘইর্যা গিন্নির বড় ব্যাটা এখুন পাটির বড় ল্যাতা।
ভিড় ঠেলে সে আইসে বইলল্যাক-
“ ক্যানে, কি হইছেরে সাঁঝলি,
তুই তো আমাদের বাড়ি কামিন ছিলি।
বল তর কি কি লাইগব্যাক, বল, তর কি কি লাইগব্যাক খুলে বল খালি,”
বইল্ লম –
“ আমার পারা শয়ে শয়ে আর অনেক সাঁঝলি আছে।
আর শিবু কুইরির বিটি আছে গাঁ গিরামে। তারা যদ্দিন
অন্ধকারে পইড়ে থাইকবেক তারা যদ্দিন লিখ-পড়ার লাগে কাঁইদে বুলব্যাক্।
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগব্যাক্। শুইনছ্যান আপনারা
তদ্দিন কুনো বাবুর দয়া আমার নাই লাইগ্ ব্যাক।“
জাগরণ
-দেবব্রত সিংহ
তারা বললেক গপপোটা আজকার লয় হে
ইটা বহুত পুরোনো গপপো,
তেল চুকচুকা বাঁশে বাঁদর উঠে আর নামে
যতবার চায় উঠতে
ততবার যায় পড়ে,
কী করে উঠবেক বাঁশটাতে যে আচ্ছা করে লগাড়ে মাখাইছে
কাঁচা সরষার তেল
কারা মাখাইছে কেনে মাখাইছে
সে বুঝতে গেলে মাথা লাগবেক হে
বহুত মাথা লাগবেক।
তিনি বললেন না-না-তা-না
ব্যাপারটা কি জানেন
ব্যাপারটা হল ধারাবাহিকতার অভাব,
অন্য আর কিছু না
ধারাবাহিকতার অভাবে বহু সাক্ষর ফের নিরক্ষর।
তখন একজনা ধানকাদামাখা মানুষ
মাখা খাড়া করে উঠে দাঁড়াই বললেক,
আমি বিজয় রুইদাস
মিটিঙে মিছিলে গেলে পার্টিবাবুরা বলে
কমরেড বিজয় রুইদাস
আর পুরন্দরপুর মোড়ে শিরিষতলায় জুতা সেলাই করলে
বলে বিজা মুচি
মাপ করবেন লেতাবাবু
গপপোটা যে কী
সেটা তাহালে খুলে বলি,
তখেন মনসাথানের সানবাঁধানো নিমতলায়
আমাদের মুনিষকামীনদে পাড়ায়
সাক্ষরতা সেন্টার
পার্টিবাবুরা বললেক তোদিকে নবসাক্ষর করব
মিছা নাই বলব
কথাটা শুনে ফুরতি লাগেছিল খুব,
কী বলব আঁইজ্ঞা,
সবে দিনটা কতেক চলেছে মাত্তক
তাবাদে হুট করে অ্যাকদিন মাস্টর বললেক,
যা হইছে বহুত হইছেে
ইবার তোদের মূল্যায়ন হবেক
মূল্যায়নের পরে নবসাক্ষর
নবসাক্ষরের পরে পূর্ণসাক্ষর।
বললাম, হে মাস্টরই যে গোটা বইটাই বাকি হে
পথম পাতাটা ছাড়া তুমি আর ত কিছু শিখাও নাই।
মাস্টর বললেক, যা শিখেছিস বহুত শিখেছিস ।
তাবাদে আর কী
নিরক্ষাররা সাক্ষর হােক বা না হােক
পোস্টারে ফেস্টুনে পতাকায় শ্লোগানে
গোটা জেলা পূর্ণসাক্ষর।
বললাম, বঠে মাস্টর তুমরা দেখালে বঠে
তবে শুনঅ,
আমরা কিন্তুক জানথম
সব জানথম
তুমরা যে আর কিছু শিখাবে নাই
সেটা আমরা জানথম
কেনে শিখাবে নাই তাও জানথম
মাস্টর বললেক, কী জানতিস ?
বললম, শুনঅ তাহালে
আমরা যদি সব শিখে ফেলি
আমরা যদি সব জানে ফেলি
তাহলে তুমাদে চেয়ারগুলানই ত উলটে যাবেক
তখেন তুমরা বসবে কুথায়,
আমরা যদি সব শিখে ফেলি
আমরা যদি সব জানে ফেলি
তাহালে তুমাদে গদিগুলানই ত উলটে যাবেক
তখেন তুমরা দাঁড়াবে কুথায়
তুমরা তখেন দাঁড়াবেটা কুথায়।
স্বাধীনতা
– দেবব্রত সিংহ
কথাটা ত মিছা লয়
লালগড়ের জঙ্গলমহলের সবাই জানে
ডুমুরগড়্যা, বেণাচাপড়া, বাঁকিশোল,হাতিঘোসা,শালডাঙ্গা
মোহনপুর, কলাইমুড়ির জানে সবাই
দিনের বেলা পুলিশ
রাতের বেলা উয়ারা,
পুলিশ বলে স্বাধীনতা
উয়ারা বলে মিছাকথা
ফের পুলিশ বলে স্বাধীনতা
ফের উয়ারা বলে মিছা কথা,
আমরা গরীব মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
ইসবের ত কিছু বুঝি নাই,
তবু দিনের বেলা পুলিশ আসে,
“হপন আছিস?”
হঁ আইজ্ঞা আছি
আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
রাতের বেলা জঙ্গলমহলে রাত নামলে
আমার তালপাতায় ছাওয়া মাটির ঘরে
জুমড়াকাঠের আংরার পারা অন্ধকার
কপাট ও নাই হুড়কাও নাই
তখন উয়ারা আসে
কমরেড হপন আছো?
বলি হঁ আইজ্ঞা আছি
আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
এমনি করে দিন কাটে
এমনি করে রাত কাটে
ইয়ার মাঝে গেলবছরে
বাঁকিশোলের কালভাট গেল বোমা তে উড়ে
তখন আমি খাটতে গেছি খড়গপুরের মুরগি খামারে
দিনটা ছিল বাবুদে পতকা তুলার দিন
আমরা হাভাতা মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
পতকা ত বুঝি নাই
তাই ভাল্যে ভাল্যে দেখছিলম
কিরম তিরঙ্গা পতকা তুলছে বাবুরা
খড়গপুরের টাউনের বাবু
দেখতে দেখতে পুলিশ গাড়ি,
পুলিশ বললেক, তোর নাম কি?
বললম, হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
গাঁ?
বেণাচাপড়া।
বলক?
লালগড় জঙ্গলমহল।
বললেক, আর বলতে হবেক নাই চল চল।
বলি যাব অ কুথাকে?
বললেক,লক আপে।
সেটা কী বঠে আইজ্ঞা?
সে তুই বুঝে যাবি থানাতে গেলেই বুঝে যাবি।
ই বাবা আমি হপন মান্ডি হে
গরিব মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
উসবের ত কিছু বুঝি নাই।
মারাংবুরুর কিরা কাড়্যে বলছি
হাঁ দেখ অ বোমা যে কী জিনিস বঠে
বাপের কালে সেটা চোখে দেখি নাই।
বলতে বলতে আমার লাঙ্গল চষা আঁকল পরা হাতে
লুহার বেড়ি দিলেক পরাই
তারপরে ঘাড়ে ধরে ধাঁকালে জিবগাড়িতে দিলেক ভরে,
গাড়ির ভিতরে বন্দুকের নল ঠেকাই ইপাশে পুলিশ উপাশে পুলিশ
তার মাঝে আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি।
দিনটা ছিল বাবুদে পতকা তুলার দিন
থানায় তখন পতকা তুলছে দারগাবাবু
আমরা গরীব মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝি তিলষা বুঝি
ইসবের ত কিছু বুঝি নাই
তাই শুদাইছিলম,
ইটা কী বঠে আঁইজ্ঞা?
এই পতকা জিনিসটা কি বঠে?
পতকা তুললে কী হবেক আমাদে?
মাত্তক এইটুকুন কথা
মাইরি বলছি,
সেই কথা শুনে কি বলব
ভেড়ার পালে যেমনি হামলে পড়ে নেকড়া হুঁড়াল
তেমনি করে আমার ঘাড়ের উপরে
হামলে পড়লেক দারগাবাবু
তা বাদে বুট জুতা পরা পায়ে
এমন একটা গড়ারি দিলেক মারে
আমি মু থুবড়াই গেলম পড়্যে
বললেক,
তুই জানিস নাই
তুই শুনিস নাই
শা-লা
ইটাই তো স্বাধীনতা
ইটাই তো স্বাধীনতা।
আমি হপন মান্ডি
বাপ তিলকা মান্ডি
আমরা গরীব মানুষ
আমরা গো মুখখু মানুষ
খিদা বুঝথম
তিলষা বুঝথম
ইবার বুঝলম
কাকে বলে স্বাধীনতা
কাকে বলে মিছা কথা
কাকে বলে স্বাধীনতা
কাকে বলে মিছা কথা ।
মৃনালের চিঠি
দেবব্রত সিংহ
শ্রীচরণ কমলেষু,
আজ পর্যন্ত তোমাকে চিঠি লিখিনি।
চিরদিন কাছেই পড়ে আছি – মুখের কথা
অনেক শুনেছ, আমিও শুনেছি।
চিঠি লেখবের মত ফাঁকটুকু পাওয়া যায়নি।
আমি তোমাদের মেজো বউ। আজ এই ‘গঙ্গারপাড়ে দাড়িয়ে’
জানতে পেরেছি জগত এবং জগদীশ্বরের
সঙ্গে আমার অন্য সম্বন্ধও আছে।
তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি লিখছি, এ তোমাদের মেজো
বউয়ের চিঠি নয়’।
সেই ছুটুবেলাতে আমাদের পাহাড় কোলের জোড়ে
লদী পেরাতে যাইয়ে
এক আষাঢ় মাসের হড়কা বানে
আমি আর আমার ভাই
ভাস্যে গেছলম বানের তোড়ে
ভাইটি গেল ডুবে আমি উঠলম বাঁচে
পাড়ার লোকে বললেক
বিটিছেল্যার জীবন
যদি বেটাছেল্যা হতক
তাহলে কি বাঁচতক।
আমার মরণ নাই
সেই কথাটাই আজ তুমাকে লতুন করে বলতে চাই
বেশিদিনের কথা লয়
আমাদে বাঘমুণ্ডির পাহাড়ী পথে জিবগাড়ি ছুটাই
লাল ধুলা উড়াই
যিদিন আল্যে তুমরা
পাহাড়কোলে জোড়ের ধারে চড়ুভাতি করতে আল্যে
সিদিনটা মনে আছে তুমার
দিনটা ছিল খরবার
মাসটা ছিল মধুমাস
টাঁড়ে টাঁড়ে ডাঙা ডহরে
পলাশবনে আগুন লাগা মধুমাস।
আমার মরণ নাই
তুমি বলেছিলে তুমার সঙ্গে দেখা হবেক বলে
মরণ নাই আমার
তুমি রাজপুত্তুর
কত লেখাপড়া জানা মানুষ তুমি
বি এ, এম এ পাশ
হাই ইসকুলের মাস্টার
আমি
আমি আর কে
কাঠকুড়ানি
রাঙামাটির গাঁয়ে ঘরের ইসকুলছুট কাঠকুড়ানি
কী সুন্দর গায়ের রং তুমার
একবারি চাঁপা ফুলের পারা
আমি
আমি একবারি কালো
আঁকড় ফলের পারা মিশমিশে কালো
তবে সবাই বলে কালো হলে হবে কী
আমার গড়ন খুউব ভালো
টানা টানা চোখ বাঁশির মতন নাক
ছিপছিপে চেহারা
বাঘমুণ্ডির হাটের হলুদরাঙা শাড়ি পরে দাঁড়ালে
খোঁপায় লাল পলাশের ফুল গুঁজলে
আমাকে নকি দেখায় দারুণ
একবারি মনভুলানি
একবারি মনকাড়ানি।
বাপ আমার বাবু ঘরে মুনিষখাটা খেতমজুর
এমনিতে তার সব ভালো
শুধু দোষের মধ্যে দোষ
সে একজনা নেশাভাঙ করা মানুষ
দিন ফুরালে সনঝা হল্যেই
তাকে হাতছানি দেয় মহুয়াতলার মদ ভাঁটি
ঘরদুয়ার, ছেল্যাপেলা, লেখাপড়া
বাপের কনদিকে লজর নাই
তখন বহুত ছুটুবেলা
তখন থাকেই দেখতম
বাপ আমাকে বিদায় করলেই বাঁচে
একদম হাঁফ ছাড়ে বাঁচে
মা কিন্তুক তা লয়
মা বলতক আত ছুটুতে বিহা কীসের
আর পাঁচটা বিটিছেলা যেরম যাচ্ছে ইসকুলে
তেমনি যাক
দুপাতা লেখাপড়া করে আসুক
সেই করে টানেটুনে কোনোমতনে গাঁয়ের ইসকুলে ওই নাইন টুকুন
ইয়ার মাঝে বলা নাই কওয়া নাই
বাপ একদিন হুট করে লাগাই দিলেক বিহা
তখন কী আর জানথম অত
পুরুল্যার খোট্টা পাড়ার জানকি যাদবের কাছে
আগাম টাকা লিইছে বাপ
আমি দাঁড়াইছিলম রুখে
সেই রুখে দাঁড়ানর জোরে
বিহার দিনে থানায় যাইয়ে আমি ভাঙে দিইছিলম সব
কাগজআওলা টিভিআওলারা কুথায় থাকে কেজানে
তারা আমাকে লিয়ে একঘড়িকে দুনিয়া দিলেক খবর করে
সে খবর ত দেখেছিলে তুমি
মিছা নাই বলব এতসব জানে শুনে
তুমি আমাকে বিহা করেছিলে বলে
গাঁয়ের লোকে দেবতা বলেছিল তুমাকে
মনে আছে আমার সব মনে আছে।
সেই ফাগুন দিনের দিন ফুরনো বেলায়
যিদিন তুমার সঙ্গে গেলম তুমাদে ঘরে
সিদিন ঘোমটা মাথায় আমাকে দেখে
ভূত দেখেছিল তুমার মা
তার মু গেছল শুকাই
তুমার বউদিদি মানে আমার বড়ো জা
সেও দেখলাম তাই
তুমার ইসকুলের মাস্টাররা পাড়ার বন্ধুরা
তারা বাহবা দিইছিল খুব
তবে সে কিন্তুক ভালো লাগে নাই আমার
সে ঠিক বাহবা লয়
তার ভিতরে কতকটা ছিল কৌতুক কতকটা করুণা।
তুমি বলেছিলে লতুন করে আবার আমাকে লেখাপড়া শিখাবে
তুমি বলেছিলে লতুন করে আবার আমাকে ভরতি করে দিবে ইসকুলে
কাজের চাপে সে আর তুমার হল্য কই
কত ব্যস্ত মানুষ তুমি
ইসকুল, পার্টি, ক্লাব, বস্তিবাসী, গরিব দুখী
প্রতিবন্ধী, রক্তদান জীবনদান,
তুমার কত কাজ।
একেক দিন কাজের টানে তুমি বাইরে কাটাতে রাত
একেক দিন কাজের টানে ঘরের কথা মনে পড়ত না তুমার
এমনি করে দেখতে দেখতে
ঘরের চাইয়ে বাইরে থাকার সময় গেল বাড়ে
একদিক তুমার মা বললেক,
‘ও তো ঘর সংসারের মানুষই না
বিয়ে টিয়ে কেনে যে গেল করতে’,
একদিন তুমার বউদিদি বললেক,
‘ও তো বাঁধনছাড়া লাগামছাড়া মানুষ
বাউন্ডুলে মানুষ
ওকে এসব মানায় না
বিয়ে টিয়ে একবারি মানায় না’
কথা শুনে কষ্ট হত খুব
দুঃখও
সেই দুঃখে একলা ঘরে দু চোখ দিয়ে জল গড়াত আমার
তখন মনে পড়ত দিদিমার কথা
দিদিমা বলত, ‘গরিব ঘরের বিটিছেলার আবার দুখ কীসের
আমাদে দুখ ও যা সুখও তা
আর হেই দ্যাখ আমার একটা কথা শুনে রাখ
যার রং কালো
তার মব ভালো’
কিন্তু মন ভালো হলে হবেকটা কী
সে মনের খবর লিবার লোক কুথায়।
বড়লোকদের হুজুগের কোনো কমতি নাই
কতরকমের হুজুগ,
গরিবঘরের বিহা ভাঙে যাওয়া
কালো মেইয়াকে উদ্ধার করাও যে একটা হুজুগ
সে আমি জানব কীরম করে,
দেখলম হজুগটা একটুন কাটতে না কাটতেই
তুমি পড়লে আমার গায়ের রং লিয়ে,
কালো রং ফরসা করার যত রকমের নামি দামি রকমারি ক্রিম
সব একের পর এক আনতে লাগলে তুমি
তার সঙ্গে আবার পালা করে শুনাতে লাগলে খবর
কাগজের সব মনখারাপ করা খবর
‘গায়ের রং কালো বলে বউকে খুন করল বর’।
‘গায়ের রং কালো বলে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় গলায় দড়ি দিল মেয়ে’
এমনি সব আরও কত খারাপ খবর
তবে তুমি আবার সান্ত্বনাও দিতে
তুমি বলতে,
‘কেন যে কাগজগুলো ছাপে এসব খবর’,
আমি বলতম, চাই নাই ইসব খবর শুনতে নাই চাই।
তুমি বলতে,
‘দেখো খারাপ খবরও জানা দরকার তুমার
নাইলে দেশটা যাচ্ছে কোনদিকে সে তুমি পারবে না বুঝতে’,
আমি বলেছিলম, এমন দেশকে বুঝে আমার কাজ নাই।
এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন
দিনের পর দিন।
তারপর একদিন জষ্টিমাসের বেলা পড়তি অবেলায়
তুমি বললে, হাওয়া খেতে যাব
চলো হাওয়া খেতে যাব গঙ্গার পাড়ে
কথা শুনে তুমার মুখের দিকে আমি রইলাম চাইয়ে
তাই দেখে তুমি বললে ‘না না মিথ্যে নয় সত্যি বলছি’।
সেই কতদিন আগে লতুন বউ হইয়ে আসার পরে
শাশুড়ি আর জায়ের সঙ্গে একদিন
পূজা দিয়ে আইছিলম গঙ্গার ঘাটে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে
ইপারে তুমাদে পুরোনো শহর
ভাঙা মন্দির চানের ঘাট কাঁসর ঘন্টা
উপারে সবুজ খেত সরষে ফুল আঁখের বাদা ইঁট ভাটা
তালসুপারি, মাটির বাড়ি, ডিঙি নৌকা, খায়াঘাট, হইচই মানুষজন
তুমার হাত ধরে কতদিন পরে আবার সেই গঙ্গার পাড়ে
দিন ফুরনো অবেলাতে আউলিবাউলি হাওয়ার তোড়ে
আমার চুড়িদারের ওড়না যাচ্ছিল উড়ে
তুমি চাইছিলে নিরিবিলি
আরও নিরিবিলি
সে বহুতদূরে পোড়া মন্দিরের ভাঙন ধরা ঘাটের ধারে
আমার কেমন দম আসছিল আটকে
তুমার তখন বাঁধ ভাঙেছে ভালোবাসার
বউয়ের গলা জড়াই চুমু খাইয়ে আদর করার ধুমে
তুমার তখন ‘রা’ সরে নাই মুখে।
আমি কাঠকুড়ানি
রাঙামাটির গাঁ গেরামের ইসকুল ছুট কাঠকুড়ানি
আমি কী আর বুঝতে পারি
তুমার অমন আদর করার মানে কি আর বুঝতে পারি
আমার জায়গায় থাকত যদি অন্য কেউ
সেও কি পারত বুঝতে
ভালোবাসার মানুষ জড়িয়ে ধরে আদর করার ফাঁকে
একঘড়িকে লদীর জলে ফেলতে পারে ঠেলে
বলো না এটা বুঝবে কীরকম করে।
কত কী যে বুঝার আছে এই দুনিয়ায়
এই যে তুমি বি এ এম এ পাশ দিয়ে
মাস্টার হইছিলে হাই ইসকুলে
তুমিও কি পারেছিলে বুঝতে
যাকে অমন করে ঠেলে ফেললে ভরা গঙ্গার জলে
সে দিব্যি সাঁতার কাটে উথালপাতাল ঢেউয়ের তালে
পার হইয়ে যাবে লদী
অত বড় লদী
পারঅ নাই বুঝতে
একদম পারঅ নাই
তাই তখুনি পাড় ছাড়ে পালাইছিলে দৌড়ে
কী অদ্ভুত মানুষ তুমি
তুমাকে একদিন বসাইছিলাম দেবতার আসনে
বলঅ আজ কুথায় বসাব তুমায়।
দ্যাখঅ মানুষে মানুষে কী তফাত দ্যাখঅ
তুমি কত কাছের মানুষ হইয়ে কত সহজে
আমাকে ঠেলে ফেলে দিলে লদীর জলে
আরেকজন কত দূরের মানুষ হইয়ে লদীতে ঝাঁপ দিয়ে
সাঁতার কাটে দু হাত দিলে বাড়ায়ে
মানুষটা দেহাতি মানুষ
নাম শিউচরণ
পেশায় ইট ভাটার বদলি মজদুর
না তুমার মতন পড়াশুনা করা মাস্টার লয়
লেখাপড়ায় সে বিলকুল আনপড়।
তুমি ভাবছ নালিশ করব তুমার নামে
না নালিশ আমি করব না
কী হবেক নালিশ করে
আমাদে এই পোড়া দেশটার সবই ত তুমাদে দখলে
নেতা, মন্ত্রী, থানা, পুলিশ,কোর্ট, কাছারি সব
সিখেনে গাঁ গেরামের গরিব ঘরের মেইয়াদের
কতটুকুনি আর জায়গা আছে বলঅ
তবে আখনো মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানুষ
আখনো মানুষের জন্যে জীবন দেয় মানুষ
সেই মানুষকে সাক্ষী রাখে এক বড়মানুষের বহুতকালের কথা
আজ আবার লতুন করে বলি তুমাকে
শুনঅ,
‘সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা যে কী তা আমি পেয়েছি।
আর আমার দরকার নেই।
…. তোমরা যে আপন ইচ্ছামত আপন দস্তুর দিয়ে
জীবনটাকে চিরকাল পায়ের তলায় চেপে রেখে
দেবে, তোমাদের পা এত লম্বা নয়।
ইতি
মৃণাল
তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন
এ যুগের মৃণাল।
No comments:
Post a Comment