তিমিরহননের গান
কোনো হ্রদে
কোথাও নদীর ঢেউয়ে
কোনো এক সমুদ্রের জলে
পরস্পরের সাথে দু-দণ্ড জলের মতো মিশে
সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে
আমাদের জীবনের আলোড়ন—
হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।
অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে
আমরা হেসেছি,
আমরা খেলেছি;
স্মরণীয় উত্তরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে
একদিন ভালোবেসে গেছি।
সেই সব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু—
তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক।
হেমন্তের প্রান্তরের তারার আলোক।
সেই জের টেনে আজো থেলি।
সূর্যালোক নেই— তবু—
সূর্যালোক মনোরম মনে হ’লে হাসি।
স্বতই বিমর্ষ হ’য়ে ভদ্র সাধারণ
চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে
আরো বেশি কালো-কালো ছায়া
লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে
মধ্যবিত্ত মাহুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে
নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে
নর্দমায় নেমে—
ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে
নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম’রে যেতে জানে।
এরা সব এই পথে;
ওরা সব ওই পথে— তবু
মধ্যবিত্তমদির জগতে
আমরা বেদনাহীন— অন্তহীন বেদনার পথে।
কিছু নেই— তবু এই জের টেনে খেলি;
সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি;
জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে— অন্ধকারে—
মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।
তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ’য়ে
আমরা কি তিমিরবিলাসী?
আমরা তো তিমিরবিনাশী
হ’তে চাই।
আমরা তো তিমিরবিনাশী।
আট বছর আগের একদিন
শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;
বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম— অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা;
যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের–
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে— গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু— আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে এসে
চোখ পাল্টায়ে কয়: ’বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার—’
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো
কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
সুচেতনা
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।
আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ
পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো
ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু
দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে;
পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।
কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে
দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;
সেই শস্য অগণন মানুষের শব;
শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়
আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ
মূক ক’রে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।
মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে;
এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়—
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
সিন্ধুসারস
দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি
হে সিন্ধুসারস,
মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি
নাচিতেছ টারান্টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি
চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায়
ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়।
মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান,
আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ
নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ
পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান
শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান।
জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি
আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে— হারায়েছি আনন্দের গতি;
ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান— এই বর্তমান
হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের— বেদনার আমরা সন্তান?
জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান,
তুমি পিছে চাহোনাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর
পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর।
যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত
নেই তব; নেই নিম্নভূমি—নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত।
স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো— পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা
বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা
রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতে রেখা
প্রাণে তার— ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো;
একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো
নিভে গেছে; যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, করে না বুনন
মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে অবিচল শালিকের মন,
মেঘের দুপুর ভাসে— সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন
মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে;
সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে;
তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনোনাকো; অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে
জানোনাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের— ইন্দ্রধনু পরিবার ক্লান্ত আয়োজন
হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।
এই সব জানোনাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডানার উল্লাসে;
রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডান শাদা ফেনা-শিশুদের পাশে
হেলিওট্রোপের মতে দুপুরের অসীম আকাশে!
ঝিকমিক করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা,
যদিও এ পৃথিবীর স্বপ্ন চিন্তা সব তার অচেনা অজানা।
চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি— জন্ম তুমি নিয়েছিলে কবে,
বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে
আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে— দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে।
শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে
নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে।
ধানের রসের গল্প পৃথিবীর— পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ
পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই– আর তার প্রেমিকের ম্লান
নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ,
জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায়
শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।
শঙ্খমালা
কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা:
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।
কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে-আগুনে হায়।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার;
এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।
সুরঞ্জনা
সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে
কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? —গিয়েছে হারায়ে।
বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের
ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;
তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
একটি পাখির গান কী রকম ভালো।
মানুষ কাউকে চায়— তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।
মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে
ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে
উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে
তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে
সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।
যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা
মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে
ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;
তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
বোধ
আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।
পথে চ’লে পারে—পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।
আমি থামি—
সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?
—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।
নীলিমা
রৌদ্র-ঝিলমিল
উষার আকাশ, মধ্যনিশীথের নীল,
অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে-বারে
নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে।
উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,
উগ্র চুল্লীবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি’,
আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,
মরীচিকা-ঢাকা।
অগণন যাত্রিকের প্রাণ
খুঁজে মরে অনিবার, পায়নাকো পথের সন্ধান;
চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল;
হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধি-বিধানের এই কারাতল
তোমার ও-মায়াদণ্ডে ভেঙেছো মায়াবী!
জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি
কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি
বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী;
স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা
মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!
চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধা ধরণীর রুধিরলিপিকা,
জ্ব’লে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!
বসুধার অশ্রুপাংশু আতপ্ত সৈকত,
ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,
লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,
এই ধূলি—ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার
ডুবে যায় নীলিমায়—স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,
শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে, শুক্লাকাশে নক্ষত্রের রাতে;
ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক
তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক!
কুড়ি বছর পরে __
জীবনানন্দ দাশ
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী
নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাই আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড় থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের
ঝাউয়ের-আমেরঃ
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার !
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাকে
কোথায় লুকায় আপনাকে !
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !
বনলতা সেন
- জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
আবহমান
পৃথিবী এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম।
সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে;
যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে;
যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় খেতের গোধূম
চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম
গাঢ় ক’রে দিয়ে যায়। —এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
সমুদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ
নদীর তরঙ্গে— ক্রমে— তুষারের স্তূপে তার ঢেউ
একবার টের পাবে— দ্বিতীয় বারের
সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে টের
এইখানে সময়কে যতদূর দেখা যায় চোখে
নির্জন খেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভূত চাষা;
এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা
সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে;
অঘ্রাণের বিকেলের কমলা আলোকে
নিড়ানো খেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে;
একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে।
পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে
নষ্ট হ’য়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে;
সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে।
ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হ’য়ে আসে।
মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হ’লো মানুষের বৃত্তি আদায়।
যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে
তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায়
আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন।
অভিভূত হ’য়ে আছে— চেয়ে দ্যাখো— বেদনার নিজের নিয়ম।
নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়;
জলপাই-অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা;
ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়;
প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে
আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে।
সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ
অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে
এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়।
পৃথিবীর রাজপথে— রক্তপথে— অন্ধকার অববাহিকায়
এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়।
তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মূক অপেক্ষায়;
তাহার মাথার ’পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়;
এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হ’য়ে থেকে ক্রমে একদিন
কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ?
চেয়েছে মাটির দিকে— ভূগর্ভে তেলের দিকে
সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা,
মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার;
দূরবীনে কিমাকার সিংহের সাড়া
পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে।
বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তা’রা।
যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে,
মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা
দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে;
চিরদিন এই সব হৃদয় ও রুধিরের ধারা।
মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে
নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে;
অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া।
মোমের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে ব’সে— অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে
আমরা যতটা দূর চ’লে যাই— চেয়ে দেখি আরো-কিছু আছে তারপরে।
অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে
ছায়া ফেলে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে,
কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে,
অথবা যে-সব থাম সমীচীন মিস্ত্রির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে,
তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ।
হয়তো অনেক এগিয়ে তা’রা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ
জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোল্তার নেই অবলেশ।
তাই তা’রা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরো জীবনের লিপ্ত অভিধানে
বৰ্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে।
সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয়— এই জ্ঞানে
লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে
নিজের বীজের তরে জোর ক’রে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে।
অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে।
একটি আলোক নিয়ে ব’সে থাকা চিরদিন;
নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে;
সে-সবের দিন শেষ হ’য়ে গেছে
এখন সৃষ্টির মনে— অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে।
সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে।
একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে— বালুচরে,
সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে।
আমরা জটিল ঢের হ’য়ে গেছি— বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে।
যদি কেউ বলে এসে: ‘এই সেই নারী,
একে তুমি চেয়েছিলে; এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ—’
তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কবে ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ?
আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর,
যদিও অনেক মৃত্যুপরম্পরা ছিলো ইতিহাসে;
বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অব্লঙ ছবি;
নানারূপ ক্ষতি ক্ষয়ে নানা দিকে ম’রে গেছি— মনে পড়ে বটে
এই সব ছবি দেখে; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে
নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থানু।
এক দরজায় ঢুকে বহিষ্কৃত হ’য়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে
অমেয় আলোয় হেঁটে তা’রা সব।
(আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্ বাতাসের শব্দ শুনেছিলো;
তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?)
আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
কাচের গেলাসে জলে উজ্জ্বল শফরী;
সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো;
তারপর অন্য গ্রহ নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে
যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে।
সৃষ্টির নাড়ীর ’পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
তবু তা’রা করেনাকো পরস্পরের ঋণশোধ।
সূর্যতামসী
কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র’য়ে গেছে— তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে— অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন্ সিন্ধুর স্বর:
মরণের— জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা স’য়ে—
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হ’য়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক’রে জেগে ওঠে।
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর—
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে।
সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি-করোজ্জ্বল
হ্বিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ— তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওই দিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলান্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ— নিত্য দিকদৰ্শিন;
অনুভব ক’রে নিয়ে মানুষের ক্লান্ত ইতিহাস
যা জেনেছে— যা শেখেনি—
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মতো জ্ব’লে
জাগে না কি হে জীবন— হে সাগর—
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।
No comments:
Post a Comment