Wednesday, May 12, 2021

অনুপম সৌরিশ সরকার

 

 

বর্ণমালার অনন্ত সংগীত ======
অনুপম সৌরিশ সরকার
 
====================
ওরা জানত না,
মাতৃভাষা জড়িয়ে থাকে হৃদয় বন্ধনে
মাতৃভাষা পরায় আলো ওষ্ঠচুম্বনে
মাতৃভাষা ছড়িয়ে থাকে রক্ত সঞ্চালনে
মাতৃভাষার অপমানে আগুন জাগে প্রাণে ।
সেই মাতৃভাষাকে হত্যা করতে হুংকার দিল দানব,
“মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষা হবে উর্দু,
বাংলা বললে গর্দান নেওয়া হবে,
চাবুক পড়বে পিঠে,উপড়ে নেব চোখ,
ছিঁড়ে নেব জিভ ।”
সেই মাতৃভাষাকে নির্মূল করতে গর্জালো গভর্নর জেনারেল,
“যারা উর্দুর বিরোধিতা করবে তারা দেশের শত্রু ।”
ওরা জানত না,
বাংলাভাষা ভরিয়ে রাখে আদরচন্দনে
বাংলাভাষা ছড়িয়ে থাকে অমৃতসন্ধানে
বাংলাভাষা চিরজাগ্রত মনুষ্যত্বের ধ্যানে
বাংলাভাষার অপমান হলে বাংলার সন্তান
রাস্তায় নামে রাজপথেতে রক্ত ঢালে বিপ্লব আন্দোলনে ।
অতএব বিদ্রোহে উত্তাল হল সন্তানের রক্ত,
অতএব সরকারের চাবুক হল ক্ষিপ্ত,
আগ্নেয়াস্ত্র হল হিংস্র উন্মাদ,
বারুদের সে কী রাগ !
ঘাতক গুলি ঢুকে পড়ল
জব্বার বরকত রফিকের শরীরে,
ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল,ভাষাপ্রেমিকের রক্ত,
সেই রক্তের রঙ মায়ের হৃৎপিণ্ডের মতো রাঙা ।
মাটি সেই রক্তকে ধারণ করল বুক তার পেতে দিয়ে,
ঘাস সেই রক্তে সেরে নিল গভীর পূণ্যস্নান,
বাতাস সেই রক্তের ঘ্রাণে ছুঁয়ে দিল শুদ্ধতা ।
সেই রক্ত রাজপথেতে এঁকে দিল বাংলা বর্ণমালা ,
সেই রক্ত মাটির বুকে ফুটিয়ে দিল ভাষাপ্রেমের ফুল,
সেই রক্ত লাখো মানুষের প্রাণে জাগালো প্রতিরোধের সাহস ।
বুকের রক্তে মাতৃভাষার চরণ ধুইয়ে সে কী গভীর সুখ !
ভাষার জন্য জীবন বলিদানের সে কী উল্লাস স্ফূর্তি !
আগ্নেয়াস্ত্রকে উপহাস করার সে কী প্রবল আনন্দ !
চাবুকের আঘাতে শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করার
সে কী উচ্ছ্বাস উন্মাদনা !
পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল স্বৈরাচারী সরকার,
ক্লান্ত হল পুলিশের উন্মাদ অত্যাচার,
নির্মম নির্লজ্জ চাবুক হল অবসন্ন শিথিল,
বর্বর অস্ত্র যত চাইল বিশ্রাম,
মুক্ত হল বাংলাভাষা জহ্লাদের হাত থেকে ।
ওরা জানত না,
এভাবেও মায়ের ভাষাকে ভালবাসা যায়,
এভাবেও শুধুমাত্র ভাষার জন্য
শরীরে ধারণ করা যায় গরম সীসা,
মাতৃভাষাকে মায়ের আসনে বসিয়ে
সেই মাকে বাঁচাবার জন্য
এভাবেও মৃত্যুকে উৎসব জ্ঞান করা যায় !!
আকাশ গ্রহ নক্ষত্র বলল, “যায়,যায়”,
ঘাস মাটি কলমীলতা বলল, “যায়,যায়”,
পদ্মা মেঘনা ইছামতী বলল, “যায়,যায়”,
প্রতিবাদী অত্যাচারিত ভাষাসৈনিকরা বলল, “যায়,যায়”,
মৃত্যুর চোখে চোখ করে তরুণ তরুণীরা বলল, “যায়,যায়”,
ঘুমের দেশে যেতে যেতে শহীদেরা বলল, “যায়,যায়” ।
এই “যায়,যায়” “যায়,যায়” “যায়,যায়”
ধ্বনি মন্ত্রধ্বনির মত সম্মিলিত উচ্চারণে
হয়ে উঠল “জয় জয়”, “জয় জয়”, “জয় জয়”,
“জয় বাংলাভাষার জয়” ,“জয় মাতৃভাষার জয়” ।
বেহেস্ত থেকে বরকত রফিক জব্বার সালাম
এবং আরো অসংখ্য ভাষাশহীদ
আলো হয়ে উড়িয়ে দিলো মাতৃভাষার রঙীন বৈভব,
জ্যোৎস্না হয়ে ছড়িয়ে দিলো সুকোমল স্নিগ্ধতা,
বৃষ্টি হয়ে ঝরিয়ে দিল অমৃতময় বাংলা বর্ণমালার
অনন্ত সংগীত ।

 
 
 
কে আপনি রবীন্দ্রনাথ ? 
অনুপম সৌরিশ সরকার
 
=======================
রবীন্দ্রনাথকে দেবতা বা ঈশ্বর ভাবে যারা,
তাদের একজন বলল,
“আমার সকল পূজার আয়োজন তোমায় ঘিরে সাজে ।”
কারো কাছে তিনি গুরুদেব, কারো কাছে সখা
কারো কাছে অলংকার
আবার কারো কাছে আলমারিতে সাজানো অহংকার ।
তাঁকে যারা টিলা ভাবত,
একদিন তারা বুঝল রবীন্দ্রনাথ আসলে এক উত্তুঙ্গ পর্বত ।
তাদের একজন বলল,
“বামনত্ব ধরা পড়তেই বুঝলাম
আমরা পাদদেশের তৃণ কিম্বা গুল্ম ।”
চঞ্চল শিশুদের ঘুম পাড়াতে চাওয়া
কত মায়েদের হাতে তিনিই রূপোর কাঠি,
কত একাকী ক্ষয়িষ্ণু জীবনে তিনিই সঞ্জীবনী সুধা,
সংসারের ফাঁসে হাঁসফাঁস করা নারীটি বলল,
“রবীন্দ্রনাথ আমার তালগাছ ।”
রাগী ইনটেলেকটুয়াল ছোকরা ততোধিক রাগী দাড়ি নিয়ে বলল,
“রবীন্দ্রনাথ মশায় বাঙালীর বদভ্যাস,
ঐ চুলকানি জাতীয় আরকি ।
আসলে রবীন্দ্রনাথ একটা ক্লোজড চ্যাপ্টার ।
আজকাল আর ওসব লেখা চলে না বাজারে ।”
এক প্রতিভাবান ডিগবাজিসিদ্ধ গায়ক দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
“রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর আদিখ্যেতা,
কুসংস্কারও বলতে পারেন ।”
গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল এক পণ্ডিতপ্রবর বলল,
“রবীন্দ্রনাথ ভীতু ডরপুক আর অবিশ্বাসযোগ্য একটা লোক ।
রাণুকে কাদম্বরীকে আরো কতজনকে
গাছে তুলে কেড়ে নিয়েছে মই ।”
নৌকা নিয়ে জোয়ারের জলে ভাসতে ভাসতে
মাঝিটি বলল, “রবীন্দ্রনাথ আমার ভাটিয়ালি,
আমার গাঙচিল,আমার অথৈ দরিয়া ।”
কারো কাছে তিনি আলখাল্লা, কারো কাছে শ্মশ্রু,
কারো কাছে তিনি বৈশাখ, কারো কাছে শ্রাবণ ।
পঁচিশে বৈশাখে বান্ধবীর সঙ্গে মস্তি করা
যুবকটি বলল, “আ্যনিকে হেব্বি লাগছে আজ শাড়ি ব্লাউজে,
লিখে দিন এই শাড়িব্লাউজটাই রবীন্দ্রনাথ ।”
আ্যনি বলল, “আমার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তোর ঝক্কাস পাঞ্জাবীটা ।”
রবীন্দ্রনাথ যার আশ্রয় সেই তরুণটি বলল,
“রবীন্দ্রনাথ হলেন সোনাঝুরির বন ।
পাশের তরুণীটি গাঢ় চোখে বলল,
“রবীন্দ্রনাথ আমার অনিঃশেষ আবির ।
কারো কাছে তিনি সাগর, কারো কাছে তরঙ্গরাজি,
অনেকের কাছেই তিনি ভ্রমর,
আবার অনেকেরই কাছে বাগিচা,
কারো কাছে তিনি গানের পাখি,
কারো কাছে পাখির ডানাতে লেগে থাকা রোদ্দুর ।
বধূটি বলল, “রবীন্দ্রনাথ আমার জানালা,তিনিই আমার আকাশ ।”
তার শিশুটি বলল, “রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ আমার
তাতা থৈ থৈ,আমার তোতা পাখি আমার ঠাকুরদাদার বৌ ।”
একজন দার্শনিক বলল, “রবীন্দ্রনাথ এক অনন্তের পথে যাত্রা,
তাঁর লেখার সমস্ত অক্ষরগুলি
একটার পিছনে একটা বসিয়ে দাও,
তৈরী হবে এক অনন্তগামী পথ ।”
অবশ্য আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ একটি বৃক্ষ
বৃক্ষের আছে অজস্র পাতা—
সেই পাতায় পাতায় খাদ্যের আয়োজন,
তেমনি রবীন্দ্রনাথের জীবন জুড়ে অগনন ব্যথা,
সেই ব্যথায় ব্যথায় সৃজন শুধু সৃজন ।
==============
 
 
 

শকুন্তলা
=অনুপম সৌরিশ সরকার

হে মহাপরাক্রমশালী সম্রাট,দুষ্মন্ত,
অবশেষে আপনি নতজানু হলেন,
না,কোনো শত্রুর নিকট নয়,
না,প্রণয় বা হৃদয়ের নিকটও নয় ।
আপনি আত্মসমর্পণ করলেন সত্যের কাছে,
যে সত্য অপেক্ষা বড় কিছু নেই
যে সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছু নেই
যে সত্য অপেক্ষা ধর্ম কিছু নেই ।

অবশ্য এর পূর্বে যথেচ্ছ মিথ্যাচার করেছেন কুণ্ঠাহীনভাবে ।
আমি অরণ্যকন্যা শকুন্তলা,
আজ যখন আপনার পুত্রের হাত ধরে
আপনার সম্মুখে এসে বললাম,
আপনার পুত্রকে অভিষিক্ত করুন যৌবরাজ্যে ।
তখন বলেছিলেন,আমাকে নাকি চিনতে পারছেন না,
আমি নাকি আপনার পত্নী নই,
আমাকে সম্ভাষণ করলেন
দুষ্ট তপস্বিনী বলে,স্বেচ্ছাচারিণী বলে,বহুবল্লভা বলে ।

যখন নয়বছর আপনার প্রতীক্ষায় থেকেও
আপনার প্রত্যাশিত আগমন ঘটে নি,
তখনও আমি হারাইনি ক্ষমাশীলতা,
কিন্তু অপেক্ষারও একদিন ক্লান্তি আসে,মহারাজ দুষ্মন্ত ।
ধৈর্যেরও একদিন ধৈর্যচ্যুতি ঘটে
ক্ষমাধর্ম একদিন হারিয়ে ফেলে তার কোমলতা ।
তবু সংযতভাবে আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম,
আমি শকুন্তলা,মহর্ষি কণ্ব আমার পালক পিতা,
অপ্সরাশ্রেষ্ঠা মেনকা আমার জননী,
আমার জন্মদাতা রাজর্ষি বিশ্বামিত্র ।
একদা আপনি আমার পাণিগ্রহণ করেছিলেন
গান্ধর্ব মতে,তপোবনে,মালিনী নদীর তীরে
মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে ।
পাণিগ্রহণের প্রাক্কালে আমি বলেছিলাম,
“আগে আপনি শপথ করুন যে,
আমাদের পুত্র হবে হস্তিনাগরের পরবর্তী মহারাজ,
তবেই আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মতি দেব ।”
আপনি তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন,
“বেশ তাই হবে,
চতুরঙ্গিনী সেনা প্রেরণ করে তোমায়
রাজঅন্তঃপুরে নিয়ে যাব,
তোমায় দেব রাজমহিষীর সম্মান ।”
এইসব শোনার পর আপনি বললেন,
আপনার নাকি কিছুই মনে পড়ছে না ।
বললেন স্ত্রীজাতি নাকি প্রবঞ্চণাপটু ।
বললেন,বর্ষাকালীন নদী যেমন
তীরবর্তী বৃক্ষকে পতিত আর আপনস্রোতকে কর্দমাক্ত করে—
তেমনি আমি নাকি আপনাকে এবং আমার নিজ বংশকে
কলঙ্কিত করছি,
আরো বললেন,স্ত্রীলোকেরা সাধারণত মিথ্যা কথাই বলে,
বললেন,আমার কথা নাকি বিশ্বাসের অযোগ্য
কারণ আমার জন্ম নিকৃষ্ট,
কারণ আমার মাতা মেনকা একজন স্বৈরিণী ।

পৌরবরাজ,সহনশীলতার বৃক্ষও একদিন নিপতিত হয়,
সংযমের বাঁধও একদিন ভেঙ্গে যায় ।
অতএব এবার আমার চোখের জলকণায় জ্বলে উঠল হুতাশন,
আমার অন্তরের বেদনা হয়ে উঠল নিদারুণ ক্রোধ,
আমার ক্ষাত্ররক্তে জেগে উঠল অশ্বের হ্রেষা ।
আমি বললাম,
আপনি আমার সর্ষে-প্রমাণ ছিদ্র দেখে নিন্দামুখর,
অথচ আপনার ছিদ্রগুলি বেলফলসদৃশ ।
আমি বললাম,
আপনার মতো কুৎসিত লোকেরা
দর্পনে যতক্ষণ নিজের মুখ দর্শন না করে
ততক্ষণই আপনাকে সুন্দর বলে মনে করে ।
ঐশ্বর্যমোহে মত্ত হয়ে
আপনি হারিয়েছেন ধর্মাচার,সত্যজ্ঞান ।
তাই মনে পড়ছে না নয়,
আসলে মনে করতে চাইছেন না ।
তার কারণ,অন্যান্য রাজাদের মতই
আপনিও আমাদের মত অরণ্যতনয়াদের
বা দরিদ্রকন্যাদের বা নীচবর্ণাদের
খেলার সামগ্রীজ্ঞান করেন ।
আপনাদের সান্নিধ্য পাওয়াটাই সৌভাগ্যের,
এইভাবেই ভাবিত দরিদ্রকন্যাসকল ।
আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে
সন্তানের পিতৃত্ব দাবি করার কথা
কেউ কোনদিন ভাবেনি ।
তারা তাদের সন্তানকে হয় নদীতে ভাসিয়ে দেয়
বা ত্যাগ করে আসে কোনো নিভৃত অরণ্যে ।
তাই আমার আগমনে আপনি
রুষ্ট,ক্রুদ্ধ,বিভ্রান্ত এবং স্তম্ভিত ।
আপনাকে আমি জানিয়ে দিলাম,
আপনি থাকুন আপনার অসত্য নিয়ে,
আপনার মতো অধার্মিকের সঙ্গে
আমার সম্মেলন আমার সহবাস অসম্ভব ।
বিদায়ের সময় হলো আমার,
আমি অভিসম্পাত করলে আপনি ধ্বংস হবেন,
তবে অভিশাপ দেব না আপনাকে,
শুধু জানিয়ে যাই,আপনার সাহায্য ব্যতিরেকেই
আমার পুত্র শাসন করবে সসাগরা পৃথিবী ।

তবে বিদায় নেওয়া আমার হলো না,
কারণ আপনি স্বীকার করে নিলেন যে
আমার উচ্চারিত প্রতিটি বর্ণ সত্য,
আপনি স্বীকার করে নিলেন যে
আমি আপনার পত্নী ।
জানি না কী কারণ
অভিশাপের ভয় নাকি বিবেকবোধের জাগরণ ।
তবে এই যে আপনি অসত্যের মোহ চূর্ণ করে
আপন সন্তান ভরতের পিতৃত্ব স্বীকার করলেন সর্বসমক্ষে,
এ আমার সতীত্বের জয় নয়,
এ আমার মাতৃত্বের জয় নয়,
এ আমার পত্নীত্বেরও জয় নয়,
এ আমার নারীত্বের জয়,
এ আমার প্রতিবাদের জয়,
এ আমার সাহসের জয়,
এ আমার সত্য উচ্চারণের জয় ।

শেষকথা শুনুন আর্যপুত্র,
আজ আমার যে হেনস্থা হলো,
এইরকমই প্রকাশ্য রাজসভায়
এর চাইতেও হীনতর ব্যবহার
যথা বস্ত্রহরণের শিকার হয়তো হতে হবে
কোন নারীকে আগামী দিনে,
পুরুষতন্ত্রের হাতে,
সমকারণে বা ভিন্নতর কারণে ।
সেইদিনও এইভাবেই গর্জন করবে নারী
পুরুষের বিরুদ্ধে,
কারণ আমি আজ জ্বালিয়ে দিলাম যে অগ্নিশিখা,
এই শিখা নেভানোর ক্ষমতা কারো নেই,
সেই আগুন বহুগুণ হয়ে দহন করবে
হস্তিনানগরের মতো ক্ষমতার ক্ষেত্রকেও ।
তারও পরেও হয়তো চলতে থাকবে পৌরুষের জুলুম,
পৌরুষের দম্ভ,পৌরুষের অপব্যবহার ।
ছলনা করে বা ভীত করে বা ঐশ্বর্যের লোভ জাগিয়ে
এমনকি হত্যা করেও
নারীকে বশীভূত করতে চাইবে পুরুষ,
তবু এই পবিত্র আগুনকে পুরোপুরি
বশে আনতে তারা ব্যর্থ হবে,
সুযোগ পেলেই এই প্রতিবাদের আগুন সাহসী হবে
আর পোড়াবে পুরুষের সকল কৌশল
সকল নষ্টামি,
বিবস্ত্র হয়ে প্রকাশ পাবে
পুরুষের যত প্রতারণা,যত ধূর্তামি,যত ব্যভিচার ।
যুগযুগান্ত ধরে অপমানিত
নারীহৃদয়ের মধ্যে জমে থাকা পুঞ্জীভূত আগুন
আজ প্রকাশ্য রাজদরবারে
উন্মুক্ত হবার সুযোগ পেল আপনার সৌজন্যে ।
অতএব হে সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর,দুষ্মন্ত,
আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকবে
কেবলমাত্র এই শকুন্তলা নয়–
চিরকৃতজ্ঞ থাকবে এই সসাগরা ধরিত্রীর সমগ্র নারীকূল ।
 
 
 

নারী ও নদীর গল্প –অনুপম সৌরিশ সরকার

নারী বসে ছিল মজা নদীটির তীরে
নদীর বুকে বালি আর বালি চড়া
নদী সে তো বিগত যৌবনা
বৈধব্যের সাজে ধূসর তার জীবন|
নারী তার বুক জুড়ে তৃপ্তি ঘনঘোর ,
পুরুষটি পাশে সজল হৃদয় সবুজ ,
নারী সে তো পূর্ণ যুবতী প্রাণ |

নদীর জন্য নারীর মনে সমবেদনার ছায়া |
তবু নদী ও তো নারী ,
ঈর্ষায় তার আগুন আগুন চোখ
নবীন বধূর সহানুভূতি তে গায়ে লাগে তার ছ্যাঁকা ,
বিধবা শাশুড়ির মতো দাঁতে দাঁত চেপে
অস্ফুটে সে বলে ,
“ছুঁড়ি তোর বড্ডো দেমাক দেখি
তোর গুমোর যদি না ভেঙেছি আমি …|”
রইলো নদী সুযোগের সন্ধানে ,
ঝড় তার প্রতিবেশী হয় , তাকেই বলে সে ,
“আর যে সহ্য হয় না সই
একটা কিছু তো কর |”

একদিন এলো প্রবল সাইক্লোন
বৃষ্টি হলো অবিশ্রান্ত পাগল
ভরলো নদী কানায় কানায় জলে
সে কী ভীষণ স্রোত—ভয়ঙ্কর তেজ !!!
এক ছুটে সে ভাঙলো সেই নারীটির ঘর
ভাসিয়ে নিয়ে চললো নারীর
বুকের সন্তান—-প্রবল উল্লাসে |
নারীটির বুক জুড়ে হাহাকার বালুচর |

তবু এই গল্পের আরও ছিল বাকি |
ভুলে গিয়েছিলো নদী—
মানুষ পারে জেগে উঠতে ধ্বংসস্তূপ থেকে
মানুষ পারে গড়ে নিতে ভাঙা জীবন তার
নতুন করে নতুন উদ্যমে |
অতএব জল সরতেই আবার নারীটি
বাঁধলো তার ঘর ,
পুরুষটি হাত বাড়িয়ে দিতেই
নারী আবার পূর্ণগর্ভা চাঁদ !!
 
 
 

বস্ত্রহরণ
=অনুপম সৌরিশ সরকার

সদ্য বিধবা মেয়েটির সবটুকু চোখের জল
তখনো শুকিয়ে যায়নি ।
ছেঁড়া শাড়িটার আঁচলে তখনো মানুষটার কপালের ঘাম ।
ছোট্ট আট বছরের ছেলেটাকে বুকে চেপে
তখনো চলছিল কষ্ট চাপার চেষ্টা ।
এমন সময় দুর্যোধনের প্রতিহিংসা
আর দুঃশাসনের লাম্পট্য নিয়ে
মহাভারতের লজ্জাকে ওরা বিবসনা করতে এলো ।
পৃথিবীর যাবতীয় নষ্টামি ওদের শরীরী বীভৎসতায়,
পৃথিবীর সমস্ত কদর্যতা
ওদের হলদে দাঁতের আস্ফালনে,
পৃথিবীর সব দানবীয়তা ওদের কুৎসিত উপস্থিতিতে ।
বদ্ধ ঘরের চাপচাপ অন্ধকারে
কিলবিল করে উঠল পোকামাকড় ।
শুরু হলো বস্ত্রহরণ ।
সাদা শাড়িটা খসে পড়ল কলঙ্কের কালি মেখে ।
মেয়েটি কৃষ্ণের আগমন প্রার্থনায়
জোড়হস্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“হে কৃষ্ণ,প্রাণের ভগবান,
বাঁচাও আমার শেষ সম্মানটুকু ।”
ছেলেটা কৃষ্ণের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল হয়ে
দরজার দিকে তাকিয়ে ।
বিকট আওয়াজে খুলে গেল দরজা ।
ঘরে ঢুকল কৃষ্ণ
মুখে তার ভরসাজোগানো হাসি,
“এই তোরা এখানে কী করছিস ?
হঠ যা নয়তো জিনা হারাম করে দোব ।”
দুর্যোধনেরা সরে দাঁড়াল ।
ছেলেটা হাততালি দিয়ে উঠল,
নেচে উঠল প্রজাপতির মতো ।
সদ্য বিধবা মেয়েটি কৃতজ্ঞতায় নম্র হতে হতে
পরে নিল শাড়ি ।
কিন্তু একি ! কৃষ্ণ শাড়িতে টান দেয় কেন ?
ছেলেটা দেখল তার অসহায়া মায়ের শাড়ি
গড়াগড়ি খাচ্ছে কৃষ্ণের পায়ে ।
ছেলেটা চীৎকার করে উঠল,
“কৃষ্ণ মায়ের শাড়ি ফিরিয়ে দে ।”
ছেলেটা ঝাঁপিয়ে পড়ল কৃষ্ণের উপর,
এলোপাথাড়ি আক্রোশে ঘুষি মারতে লাগল কৃষ্ণের মুখে ।
ঠিক তখনই কৃষ্ণের হাতে ঝলসে উঠল চক্র ।
চক্র চক্রাকারে ঘুরল বনবন—বনবন—।
বাচ্চাটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।
নিরূপায় মায়ের আর্তনাদেও
যে কৃষ্ণের ঘুম ভাঙে নি,
দেয়ালের সেই কৃষ্ণ চমকে জেগে উঠলেন,
তাঁর মুখে ছিটকে পড়েছে
ছেলেটার গরম রক্ত ।
 
 
 
 

ফুলের মৃত্যু
==অনুপম সৌরিশ সরকার

সদ্য স্নানশেষে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে—
সাধারণ পরিবারের অতি সাধারণ এক তরুণী ।
প্রথমেই সে দেখে তার চোখ—স্বপ্নভরা দুনয়ন,
প্রত্যেক সাধারণ নারীর মতই
একটি শিশুর আঁধারবিনাশী হাসি
লেগে আছে তার চোখে ,
যে চোখ দিয়ে সে তার সন্তানকে মাখিয়ে দিতে চায়
আদরের রেণু ও আশীর্বাদের স্নানজল ।

এবার সে দেখে তার শরীর,
সব মেয়ের মতো
তার বুকের মধ্যেও আছে এক মা,
সেও চায় সন্তানকে কোলে নিয়ে
অমর্ত্যস্বাদের পরশ পেতে ।
সেও চায় তার হৃদয়-পীযূষ-ধারায়
পুষ্ট হবে তার গর্ভকুসুম ।

সবশেষে সে দেখে তার মুখ,
সব মেয়ের মতো
তার মুখেও আছে এক প্রণয়িনীর লজ্জাবিভোর আলো,
সে আলোতে পথ চিনে হেঁটে আসবে এক দেবশিশু,
সেই শিশুর ঠোঁটের স্পর্শ লেগে
স্বর্ণময় হবে তার ধূলিধুসরিত জীবন ।

কিন্তু হায়! এ জীবনে তার মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার নয়,
কারণ চাকরির শর্তানুসারে,কেটে নেওয়া হয়েছে
তার গর্ভাশয় ।
=====

 

 

 

সেই আগুনের নাম নেতাজী
=অনুপম সৌরিশ সরকার

তারপর পরাধীন ভারতবর্ষের সেই নিদারুণ অন্ধকারে,
তারপর সেই বীভৎস নারকীয়তার রক্তলোলুপ সাম্রাজ্যে,
তারপর সেই নৃশংস বিভীষিকার চক্রবূহ্যে,
জন্ম নিল এক সুপবিত্র
তেজোদীপ্ত ক্রোধোক্ষিপ্ত দেশপ্রেমতৃপ্ত আগুন ।
সেই আগুনের নাম সুভাষ—নেতাজী সুভাষ বোস ।
সেই অগ্নি জাগরণে কেঁপে উঠেছিল অন্ধকারের রাজরাজত্ব,
চমকে উঠেছিল উদ্ধত বুটের আস্ফালন, অস্ত্রের হুংকার শাসন,
শিহরিত হয়েছিল আসমুদ্র হিমাচল,
কাশ্মীরি জাফরান থেকে ভাগীরথীর তরঙ্গ দেখেছিল সুদিনের স্বপ্ন ।

সেই আগুন অসহায় দেশটার কোনায় কোনায় আলো জ্বেলে দিয়েছিল,
সেই আগুন সংগ্রাম এঁকে দিয়েছিল বিপ্লবীর পঞ্জরে অস্থিতে রক্তে,
সেই আগুন শাসকের দম্ভে ছিটকে পড়েছিল প্রবল আক্রোশে,
সেই আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল শোষকের আরামদায়ক নিদ্রাবিলাস,
পুড়িয়ে দিয়েছিল বিদেশী বেনিয়ার লোভের অজস্র প্রাসাদ ।

সেই আগুনকে দমিয়ে রাখার জন্য
রচিত হয়েছিল কত না কৌশল,
কত না নির্যাতন,কত না চক্রান্ত,
কত না বার হাজতবাসের ফরমান ।
তবু তা অদম্য,অপ্রতিরোধ্য ।

সেই আগুনের অক্ষর জানিয়ে দিয়েছিল,
দেশকে কত গভীরভাবে ভালবাসা যায়,
সেই আগুনের অক্ষর জানিয়ে দিয়েছিল,
দেশের জন্য কিভাবে আত্মমগ্ন সর্বসুখ বিসর্জন দেওয়া যায়,
সেই আগুনের অক্ষর জানিয়ে দিয়েছিল,
দেশের জন্য সব বিপদকে বিদ্রূপ করা যায়,তুচ্ছ করা যায়,
সেই আগুনের অক্ষর জানিয়ে দিয়েছিল,
দেশ মানে মানুষ, দেশ মানে স্বাধীনতা,
দেশ মানে ধর্ম জাত পাতের অনেক উর্দ্ধে থাকা
এক সুবিস্তৃত মহিমান্বিত গৌরবের অনুভব ।

সেই আগুন রচনা করেছিল
সংগ্রামের অমোঘ আহ্বান,
“ভারত ডাকছে ।রক্ত ডাক দিয়েছে রক্তকে ।
উঠে দাঁড়াও,আমাদের নষ্ট করার মতো সময় নেই ।”
সেই আগুন উচ্চারণ করেছিল অভিযানের মন্ত্র,
“চলো দিল্লী”,
সেই আগুন অঙ্গীকার করেছিল,
“তোমরা আমায় রক্ত দাও,আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব ।”

সেই আগুনের শপথ সত্যি করে একদিন এসেছিল স্বাধীনতা,
আলো জ্বলেছিল,ফুল ফুটেছিল,গান জেগেছিল,প্রাণ নেচেছিল,
উদ্ভাসিত হয়েছিল আকাশ দিগন্ত চরাচর,
শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ।

কিন্তু চক্রান্ত থেমে রইল না ।
অতএব অচিরেই নিভে গেল আলো
দেশজুড়ে আবার প্রকট হলো ভয়ংকর অন্ধকারের তাণ্ডব ।
ভোটের রাজনীতি
দেশপ্রেমকে বানালো প্রহসন আর নিদারুণ জালিয়াতি,
দেশদ্রোহী ভণ্ডের দল
দেশপ্রেমকে পরে নিল রঙচঙে মুখোশের মতো ।

সেই ভ্রষ্টাচারের পথ ধরেই দেশের আনাচে কানাচে
আজ যখন গাঢ় হচ্ছে চক্রান্তের অন্ধকার,
আজ যখন স্বাধীন দেশের মুষ্টিমেয় মানুষ
বাস করে গগনচুম্বী প্রাসাদে,
তাদের জীবন ভরে যায় ফুলে ফলে সম্পদে ঐশ্বর্যে ।
আর কোটি কোটি মানুষ পড়ে থাকে পশুর মত রাস্তায়,
দারিদ্র তাদের জঠরে জ্বালা হয়ে জেগে থাকে প্রতিক্ষণ ,
তখন যে আগুনের সামনে আজো থমকে দাঁড়ায় সব নোংরামি,
তখন যে আগুন আজো আলোর অভ্রান্ত নিশানা,
তখন যে আগুনকে কখনো নিঃশেষ করা যায় না,
দমন করা যায় না,ধ্বংস করা যায় না,
তখন যে আগুনের ছবি বুকে ধারণ করে
সেই আগুনের সামনে বসে থাকে কোটি কোটি মানুষ
আর সব অন্ধকার পেরিয়ে যাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে
২৩ শে জানুয়ারীর প্রভাতে উচ্চারণ করে
“জয় হিন্দ”—-
সেই আগুনের নাম সকাল,
সেই আগুনের নাম সংগ্রাম,
সেই আগুনের নাম দেশপ্রেম
সেই আগুনের নাম নেতাজী ।
সেই আগুনকে আমি বক্ষে ধরি,
সেই আগুনকে আমি চক্ষে পরি,
সেই আগুন দিয়ে আমি নিজেকে গড়ি,
সেই পরম শুদ্ধ আগুনকে আমি প্রণাম করি ।
=====

 

 

ভালোবাসার পরশমণি
অনুপম সৌরিশ সরকার
 
রাজপুত্রের অদ্ভুত এক রোগ---
কোন ওষুধ নেই এই বিরল ব্যাধির ।
একটু একটু করে ছোট হতে হতে
সে হয়ে যাবে শূন্য একদিন ।
কুলগুরু জানালেন, “পবিত্র মানবের স্পর্শ পেলে,সুস্থতা মিলবে--
নিরাময়ের এই একমাত্র উপায়---অভ্রান্ত এ পথ । ”
রাজা উদভ্রান্ত---রানী পাগলপ্রায়
কে পবিত্র--- কোথায় পবিত্র মানব--
কোথায় অমৃতের পরশ ?
পুরস্কার ঘোষণা হল---বিপুল অংকের,
"শুনুন শুনুন শুনুন
যে পারবে রাজপুত্রের ঘটাতে রোগমুক্তি
দশ ঘোড়া স্বর্ণমুদ্রা দেবেন রাজামশাই তাকে ।''
এল সাধুসকল—শয়তানেরা এল ছদ্মবেশে
পবিত্র পাথর এল---চন্দন বৃক্ষ
আগুন এল---যজ্ঞানল দাউদাউ শিখাসহ ।
পবিত্র বলে খ্যাত নদী সেও এল
সাবান এল আত্মপ্রত্যয়ী ।
ফুলেরা এল---ভোরের শিশির---নরম রোদ্দুর ।
কবিরা এল---পণ্ডিতেরাও---সঙ্গে পুরোহিত ।
এবং একটি শিশু ।
বিচক্ষণ রাজা প্রস্তুত
দেশের বাঈজীপ্রধানাকে বসানো হলো বিচারকের আসনে ।
রাজামশাই বললেন,
"এই মদালসা লাস্যময়ী যৌবনতীক্ষ্ণ নারী
পরীক্ষা নেবে সকলের পবিত্রতার আজ
সকলকে প্রস্তুত হবার বার্তা দিলাম আমি |"
সেই নারীর চোখ বাসনা বিহ্বল—মদির কটাক্ষ তার,
স্পর্শ তার সর্বগ্রাসী, ভয়ানক আগ্রাসী
তার আলিঙ্গন ধ্বংসসুখে উন্মাদ দুর্বার ।
সাধুশ্রেষ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
"এই স্থান এই ক্ষণে ত্যাগ করব আমি
কী ভয়ঙ্কর এই নারী
আমার ধ্যানলব্ধ সকল প্রাপ্তি দগ্ধ হয়ে যাবে|"
অন্য সাধুরাও ভয়ে পালিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে,
শয়তানেরা হয়ে পড়ল হৃতসর্বস্ব—ক্ষীণদেহী পঙ্গু অথর্ব,
শয়তান শ্রেষ্ঠ বললো,
"বিষ আমার বড্ডো প্রিয়
বিষ আমার খেলার সামগ্রী
কিন্তু এই নারীর বিষ অসহনীয়
ও কী তীব্র এ বিষের জ্বালা
কী মারাত্মক ধ্বংস ক্ষমতা এই হলাহলের |"
কবিদের আঙুল পুড়ে গেল---গালে হলো ফোসকা,
পণ্ডিতদের মাথায় বের হল শিং,
পুরোহিতদের সারা গায়ে জন্ম নিল
দাদ হাজা চুলকানি !!
শিশুটি হতে চেয়েছিল কৃষ্ণ
বিজয়ী হতে চেয়েছিল সে পুতনা বধ করে,
কিন্তু "বাঁচাও বাঁচাও" চিৎকার করতে করতে
সে হয়ে গেল রক্তহীন পাণ্ডুর ফ্যাকাশে ।
সাবান ভরে গেল দুর্গন্ধে
নদী পরিণত হলো নর্দমায়
পাথর হয়ে গেল নোংরা ধুলো,
চন্দনের বৃক্ষ হলো গলিত মৃতদেহ,
আগুন হয়ে গেল ভষ্ম,
ফুলের শরীর ডুবে গেল পুরীষের গহ্বরে,
শিশিরকে হতে হল ফসলবিনাশী তীক্ষ্ণাগ্র শিলাখণ্ড,
আর রোদ্দুর মিশে গেল চিতার আগুনে !!
অবশেষে এল সে ।
তরুণ প্রেমিক কবি---
ছোট্ট এক নিমের চারা বুকের ভেতর নিয়ে---
এই লড়াই-এ সেটিই তার একাঘ্নী বাণ ।
লড়াই হল—তুমুল লড়াই কত না দিন ধরে---
আপেল এবং নিম-এ !!
প্রবল ঝড়---তুমুল বৃষ্টি—বজ্র বিদ্যুৎ---উত্তাল ক্ষীরসাগর ।
কবি হলেন নীলকণ্ঠ
বাঈজী প্রধানা বললো,
"কেউ কোনোদিন ভালোবাসে নি আমায়
আহা কী মধুর এই ভালোবাসার স্বাদ
আমার সকল বিষ অমৃত হতে চায় |"
বাঈজী প্রধানার বক্ষে এখন অমৃতের কলস ।
রাজপুত্রের শরীর এখন ব্যাধির হাতছাড়া ।
এদিকে রাজার নতুন বিপদ
পুরস্কার দেবেন যাদের তারা এখন কোথায় ?
বৃথা হলো সকল অন্বেষণ ।
হঠাৎ মালী খবর দিল,পরদিন সকালে,
রাজার বাগানে হাসছে দুলছে দুইটি নিমের চারা !!

 

 
 সীতার প্রতি দ্রৌপদী
- অনুপম সৌরিশ সরকার


হে চিরস্মরণীয় সীতা,
আমার প্রণাম গ্রহণ করুন ।
সকলে বলে আপনার সঙ্গে আমার প্রভূত মিল ।
আপনাকে যেমন আপনার পিতামাতা দেননি পরিচয়,
সকলে জেনেছে আপনি যজ্ঞসমাপনান্তে
হলকর্ষণজাতা,ভূমিসমুথ্থিতা,
এবং আপনার পালকপিতা রাজা রাজর্ষি জনক-
তেমনি আমার জন্মও রহস্যে আবৃত,
আপনার মত আমিও অযোনিসম্ভূতা
যজ্ঞবেদীর অগ্নিসমুদ্ভূতা ,
সকলে জেনেছে আমার পিতা পাঞ্চালরাজ দ্রূপদ ।

দুজনেই আমরা দিব্যরূপা দিব্যঅংশজাতা ।
দুজনেই আমরা রাজকূলবধূ ।
আপনি জন্মেছিলেন ত্রেতাযুগে,
আপনার বিবাহ হয়েছিল সূর্যবংশে ।
আর আমি জন্মেছি দ্বাপরযুগে
আমি চন্দ্রবংশের বধূ ।
বীরত্বের অধিকারে হরধনু ভঙ্গ করে
নবদূর্বাদলশ্যাম রাজকুমার
আপনাকে প্রাপ্ত হন ।
আমাকে জয় করেন কৃষ্ণবর্ণ অপরূপ অর্জুন
ধনুর্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠতা প্রদর্শনে ।

এরপর আমাদের দুজনের মিল যা কিছু
সব অন্ধকার দিয়ে আঁকা ।
রাজবধূ হয়েও যাপন করেছি দুজনেই
বনবাসীর জীবন ।
লম্পট রাবণ কর্তৃক অপহৃত হন আপনি,
সেই অপহরণ ছলনা ও লাঞ্ছনা দিয়ে আঁকা ।
নারীত্ব সতীত্বের অপমানে
আপনার প্রতিটি প্রহর হয়েছে
ক্রন্দন আর বিলাপে অশ্রুভারে রুদ্ধ,
হৃদয় আপনার হয়েছে বেদনাবিদ্ধ, রক্তক্ষরণক্লান্ত ।
আমিও প্রকাশ্য রাজসভায় লাঞ্ছিত নিপীড়িত
চরিত্রহীনের লালসার বিষে আমিও বিষাক্ত নীল ।
আমার হাহাকারেও বাতাস হয়েছে ভারি
আমার হৃদয়ও জ্বলেছে পুড়েছে বিপুল অন্তর্দাহে ।

আপনাকে রামচন্দ্র বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাষায়,
“আমি রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি তোমার কারণে নয়,
যা করেছি তা কেবল নিজের চরিত্ররক্ষা,
সর্বত্র অপবাদ খণ্ডন আর
আপন বংশকে গ্লানি থেকে মুক্ত করার মহৎ মানসে ।
তোমার চরিত্রে আমার সন্দেহ হয়েছে ।”
এই উক্তির মধ্যে রয়েছে সুতীব্র অপমান
যার অভিঘাতে আপনার পায়ের তলার মাটি গেছে সরে ।
তবু আমার যাতনা করেছে অতিক্রম আপনার দুঃখসকল ।
অত্যন্ত অপমানজনক শর্তে
আপনাকে অন্য ভ্রাতাদের সঙ্গে ভাগ করে নেন নি
রামচন্দ্র,ভিক্ষাসামগ্রীজ্ঞানে ।
আপনাকে বহন করতে হয় নি
পাণ্ডবদের মাতৃসত্য রক্ষার দায়,
পঞ্চস্বামীর ভার্যা হবার ভার ।
এই ভার শুধু দুর্বহ নয়,এ ভার অপমানের ।

প্রতিবছর আগুনে প্রবেশ করে শুদ্ধ হয়ে
এবং নিজেকে কুমারী করে
এক স্বামীকে ছেড়ে অন্যস্বামীর কণ্ঠলগ্না হওয়ার মত
মানসিক আর শারীরিক নির্যাতন
আর কী আছে বলতে পারেন ?
পঞ্চপাণ্ডব,ব্যাস,নারদ,পিতা দ্রূপদ এবং পাণ্ডবজননী কুন্তীর
রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হলো,
আর আমার স্বপ্নপাখি হলো ধূলিলুণ্ঠিত,
অর্জুনের স্ত্রী হয়ে অনন্ত সুখী হবার
আজন্ম বাসনা হলো মৃত্যুপথযাত্রী ।
আমি যেন মাংসের স্তূপ,
আমার মনের খোঁজ রাখেননি পঞ্চপাণ্ডবের একজনও ।
তাঁরা শুধু কর্তব্য করেছেন আমার প্রতি অক্ষরে অক্ষরে
আর ভালবাসার জন্য খুঁজে নিয়েছেন আপন মানুষী ।
যুধিষ্ঠির দেবিকাকে,ভীম হিড়িম্বা আর বলাঙ্গনাকে,
অর্জুন উলূপী চিত্রাঙ্গদা আর সুভদ্রাকে,
নকুল করেণুমতীকে,আর সহদেব বিজয়াকে ।

সীতাদেবী,আমার মনস্তাপ অকল্পনীয় ।
নিয়তি আমার জন্য
আরো মর্মঘাতী যন্ত্রণার ব্যবস্থা করলেন ।
আপনাকে শুনতে হয়নি আপনার পুত্রদের মৃত্যুসংবাদ ।
আর আমার পঞ্চপুত্র
প্রতিবিন্ধ্য,সূতসো্ম,শ্রুতকর্মা,শতানীক শ্রুতসেনকে
হত্যা করল পাপিষ্ঠ অশ্বথ্থামা ।
পঞ্চপুত্রের মৃত্যুতে নিভে গেল আমার শেষ আলোটির শিখা,
খসে গেল আমার শেষ পাখিটির ডানা,
ঝরে গেল শেষ আশাতরুটির পাতা ।

এরপর আর কী-ই বা থাকে বাকী ?
থাকে শুধু মহাপ্রস্থানে যাওয়া আর
মৃত্যুর মাঝে শান্তি খুঁজে পাওয়া ।
এই মুহূর্তে মৃত্যু আমার আসন্ন,
ভূতলে পতিত আমি একা,
ঐ চলে যায় পঞ্চপাণ্ডব দৃর থেকে দূরে ।

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে আমাদের দুই যুগকন্যার
আরো একটি চারিত্রিক মিলের কথা ।
হ্যাঁ আপনার মত আমিও প্রতিবাদী ।
বস্ত্রহরণকালে আমি উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছি
পুরুষের অন্যায়ের বিপক্ষে,
রুখে দাঁড়িয়েছি ধর্মের নামে নারীর ধর্ম
ভূলুণ্ঠিত করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে ।
কিন্তু আপনার মত সূক্ষ্ম প্রতিবাদ
করতে পারলাম কই ?
যে প্রতিবাদ অনুচ্চারিত কিন্তু অমোঘ ।
আপন নারীজীবনের উপর পুরুষপ্রেরিত
সব অপমানের অবসানকল্পে যে নীরব প্রতিবাদে
আপনি দ্বিখণ্ডিত ধরিত্রীর বিবরে
স্বেচ্ছায় প্রবেশ করে,
জয়ী করেছিলেন আপনার নারীত্বকে
আর গর্বিত করেছিলেন আপনার বিদায়কে,
সেই দৃঢ়তা আমি অর্জন করতে পারলাম কই ?
অতএব আমার জীবনের শেষ সময়টুকুও
স্বাক্ষর হয়ে রইল নারীজীবনের পরাজয়ের,
এক নারীহৃদয়ের যন্ত্রণার,
অপাঙক্তেয়ের মত পঞ্চপাণ্ডবের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে
একসময় পতিত ও পরিত্যক্ত হলাম,
এভাবেই আমার মৃত্যু সাক্ষী রইল সুবিপুল অগৌরবের হায় !!
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...