ফাদি আবু সালাহ্
লতিফুল ইসলাম শিবলী
তোমাকে দেখার আগে জানা ছিল না-
মানুষের পা কেড়ে নিলে তার পিঠে গজায় ডানা,
আর হাঁটতে বাধা দিলে মানুষ শিখে যায় উড়তে।
ওরা শুরু করেছিল তোমার পায়ের নিচের মাটি থেকে,
তাই প্রথমে ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার জমিন।
দেশ নামের যে এক চিলতে জেলখানায় তুমি থাকতে
সে জমিন শত শত শহীদের ভিড়ে কবেই হয়ে গেছে মর্ত্যের জান্নাত।
এরপর ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার শৈশব,
অথচ তুমি কখনোই শিশু ছিলে না,
তুমি ছিলে সেই জান্নাতের সবুজ আবাবিল।
আব্রাহার হস্তি বাহিনীর উপর কঙ্কর ছুড়ে যেভাবে তছনছ করে দিয়েছিল,
আজ তাবৎ পৃথিবী জানে তুমিই সেই আবাবিল,
একই কায়দায় ছুড়ে মারো কঙ্কর আব্রাহাম ব্যাটেল ট্যাঙ্কের দিকে।
তোমাকে তো ছেড়ে দেয়া যায় না-
এরপর ওরা কেড়ে নিলো তোমার তারুণ্য,
তোমাকে জেলে পুরে ওরা ভেবেছিলো
শুকনা পাতার নিচে ওরা লুকিয়ে রাখবে আগুন।
আটলান্টিকের এপার ওপার হয়ে সে আগুন ছড়িয়ে পরেছে
সাতটি সাগর মহাসাগরের কুলে উপকুলে
আর তোমার দৃপ্ত পদভারে যখন কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করেছে
জেরুজালেমের প্রাচীন দেয়াল
ঠিক তখনি ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার অনিন্দ্য সুন্দর পা জোড়া।
সাধ্য আছে কার
কি ভাবে থামাবে ওরা তোমার চার চাকার হুইল চেয়ার,
ওরা জানত হুইল চেয়ারে বসেও বৃদ্ধ ইমাম শেখ ইয়াসিন ছিলেন কতটা অপ্রতিরোধ্য,
সেই বৃদ্ধকে হত্যা করতে যারা হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে মিজাইল ছুড়তে পারে,
তারা তোমার এই উদ্ধত যৌবনের কাছে কেমন অসহায় কাপুরুষ।
ওরা জেনে গেছে তোমার প্রাণশক্তির উৎস,
ওরা জেনে গেছে এই ফিলিস্তিনের মাটিতেই ডেভিডের ছোড়া ঢিলের আঘাতে
কি ভাবে পরাজিত হয়েছে জালিম গোলিয়াথ
হে ফাদি আবু সালাহ্, হে পাথর ছোড়া আবাবিল-
তাই আজ ওরা কেড়ে নিলো তোমার জীবন।
আহা, জান্নাতের সবুজ পাখি
তোমাকে দেখার আগে জানা ছিলো না
পা’হীন মানুষের পিঠে গজায় এমন উড়াল ডানা।
আমরা জানি তুমি ফিরে আসবে বলেই দিয়েছ এই উজাড় উড়াল,
আমরা প্রতীক্ষায় আছি, ঝাঁকে ঝাঁকে
ফিরে আসো, আবাবিল; ঝাঁকে ঝাঁকে...
ডানা
লতিফুল ইসলাম শিবলী
উড়ে বেড়ানো ছাড়া
তোমার কাছ থেকে কিছুই শিখলাম না পাখি।
তোমার সহিষ্ণু মৌনতা
ধ্যানমগ্নতা
বেপরোয়া নির্ভরতা যদি শিখে নিতে পারতাম
তবে নিশ্চিত আমার নাম হতো ‘পাহাড়’
নিপুণ বুননে যদি শিখে নিতাম
বাসা বানানোর কৌশল
তবে কি ঝড়ো বাতাসে তছনছ হই বারংবার -
এত কিছু থাকতে কেন যে তোমার কাছ থেকে
চেয়ে নিলাম ডানা
শূন্যে ওড়ার সাধ মেটাতে
শূন্য হয়ে গেলাম।
প্যারিসের চিঠি
-লতিফুল ইসলাম শিবলী
প্রিয় আকাশি,
গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি,
খামের ওপর নাম-ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি
তোমার হাতের লেখা
ঠিকানা পেলে কীভাবে, লেখনি
কত দিন পর ঢাকার চিঠি, তাও তোমার লেখা
ভাবতে পারো আমার অবস্থা!
গতকাল প্যারিসে ঝরেছিল এ বছরের রেকর্ডভাঙা তুষারপাত
তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি, এই প্রথম আমি
অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ ।
তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর
বদলে যাওয়ার সংবাদ
তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছ, রাত্রির ঢাকা এখন
নিয়নের স্নিগ্ধতা ছেড়ে নিয়েছে
উৎকট সোডিয়ামের সজ্জা,
আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরা এখন
কালের সাক্ষী,
মিষ্টি কয়েন বক্সের জায়গা দখল করে নিয়েছে
ডিজিটাল কার্ডফোন
শীতের বইমেলা পরিণত হয়েছে
মিনাবাজারে,
টিএসসির চত্বর যেন উত্তপ্ত বৈরুত ।
বদলে যাওয়ার কষ্টের অপর নাম স্মৃতি
এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছ
এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও বদলে যেতে দেখলাম
কত সুদৃঢ় ইতিহাস
বালির বাঁধের মতো ভেসে গেল পূর্ব ইউরোপ
নদীর পাড় ভাঙার মতো ভেঙে গেল বার্লিন প্রাচীর
ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন;
ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে,
ক্ষিদে পেলেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও, স্বাধীনতা মানেই যেন উদরপূর্তি
তুমি লিখেছ, ‘তোমাকে ভুলে গেছি কি না’
প্রিয় আকাশি, আমি জেনে গেছি, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ ভুলে থাকা;
স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য এই সুদীর্ঘ প্রবাসের
অর্ধেকটা কাটিয়েছি বোহেমিয়ানদের মতো ঘুরে ঘুরে
মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ, নিউক্যাসল নেপলি থেকে প্রাগ
বুখারেস্ট মেসিডোনিয়া, নর্থ সি থেকে মেডিটেরিয়ান
কিংবা ব্ল্যাক সি।
তবু বাঁচতে পারিনি স্মৃতি থেকে ।
ফ্রাংকফুর্টের বইমেলায়
নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তোমাকে
ফোরেন্সে মিকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’,
রোমে ‘পিয়েতা’ আর সিস্টাইন চ্যাপেলের
‘লাস্ট জাজমেন্টের’ মতো
মহান সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে
প্রথমেই মনে পড়েছে তোমাকে।
সিসিলির কার্নিভেলে, এথেন্সের কফিশপের জমজমাট
কবিতাপাঠের আসরে মনে পড়েছে তোমাকে;
পালারমোর সৈকতে কিম্বা ভিয়েনার তারাজ্বলা রাত্রির
আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছে
তোমার প্রিয় কবির কবিতা
Under the wide and starry sky
Dig my grave and let me lie
Glad did I live and gladly die
And I laid me down with a will.
সুইজারল্যান্ডের লেকের স্বচ্ছ জলে নিজের ছায়ার পাশে
যাকে খুঁজেছি, সে তুমি
ভার্টিক্যানের প্রার্থনা সভা শেষে এক গ্রিক তরুণীকে
বাংলায় কী বলেছিলাম, জানো?
বলেছিলাম, ‘তুমি আমার আকাশি হবে?’
ভুলতে পারিনি তোমাকে, শত চেষ্টা করেও পারিনি
আর কেউ না জানুক অসংখ্য জিপসি রাত জানে
সেই না ভুলতে পারার ইতিহাস।
তুমি জানতে চেয়েছ প্যারিসের কথা
সত্যি বলতে কি,
প্যারিস খুলে দিয়েছে আমার আত্মার চোখ
সংগীত আর শিল্পের অভিন্ন সুর আমি শুধু
প্যারিসেই শুনেছি।
কনসার্টে যতবার মোৎসার্ট কিম্বা বিটোভেন শুনেছি
ততবারই কেন যেন চিরদুখী পাগল
ভিনসেন্ট ভ্যান্গগের কথা মনে পড়েছে।
সমস্ত প্যারিসের রাস্তায় গ্যালারিতে ফেস্টিভেলে খুঁজে ফিরেছি ভিনসেন্টের কষ্ট।
তোমার প্রিয় গায়ক জিম মরিসনের শেষ দিনগুলো
কেটেছে এই প্যারিসে। প্যারিসেই জিমের কবর।
অগণিত শিল্পীর কষ্ট থেকে প্যারিস পেয়েছে সৌন্দর্য;
কষ্টই প্যারিসের ঐশ্বর্য।
আমাদের সুবর্ণ সময়ের স্বপ্নের প্যারিসে আজ
নিজেকে ভীষণ একা মনে হয়
এলোমেলো পড়ে আছি শিল্প-সাহিত্যের এই জাগযজ্ঞে
তীব্র শীতের জন্য শ্বাসকষ্ট ভোগায় মাঝে মাঝে
এই তো সেদিন আবারও বদলালাম চশমার কাচ
প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছি সময়ের কাছে;
তুমি মনে রেখো, পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায়
আমি বদলাইনি এতটুকু।
বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মতো তোমাকে ঘিরে থাক
পৃথিবীর সমস্ত সুখ
তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে ওঠো তোমার সৃষ্টিতে
তুমি ভালো থেকো...
No comments:
Post a Comment