Saturday, February 29, 2020

গল্প


গল্প.........
=====================


গল্পের নাম: এক কাপ চা
লেখক: তাসনীম ফারজানা প্রমী


- হ্যালো মুনা, কেমন আছেন?
মুনা কারোর কন্ঠে নিজের নাম শুনে পেছন ফিরে তাকালো। কী বলবে মনে হয় বুঝতে পারছে না , ভারী কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারলাম মুনা অবাক হয়ছে এখনও সে আমাকে চিনতে পারেনি।
.
আমি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল মানুষ। ধৈর্য্যসহকারে তাকে পরিচয় দিলাম,
.
- সেদিন দেখা হয়েছিলো ক্যাম্পাসে জারুলতলার সামনে, মনে নেই আপনার?
মুনা নামের মেয়েটা এখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার মানে এখনো সে মনে করতে পারে নাই সেদিনের কথা , মুনা কি আমায় চিনে ফেলবে?

মুনা বোকার মত ডানে বামে মাথা নাড়লো তারমানে এখনো চিনতে পারে নাই। আমি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল একটা মানুষ। ধৈর্য্য সহকারে আবারো তাকে ব্যাখ্যা দিলাম।
- আমি রিজুর বন্ধু, তমাল। কম্পিউটার সাইন্স ফোর্থ ইয়ার। রিজুদের সাথে একদিন ক্যাম্পাসে পরিচয় হইছিলো। এখনো চিনতে পারেননি?
.
আমি মুনার চশমার ভেতর দিয়ে দেখছি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। বড় বড় চোখের সাইজ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল।নাকি ওর চশমাটাই এমন কে জানে! আচ্ছা মুনা কি ভয় পেয়ে গেল নাকি! নাকি বিরক্ত হচ্ছে? চলে যাব নাকি? জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় এবার মুনা মুখ খুললো ,
- আমার আসলে চেহারা মনে থাকে না , ভুলোমনা স্বভাবের। তাই আপনার চেহারাটা ঠিক আসলে কোথাও দেখেছি কিনা মনে করতে পারছিলাম না। দুঃখিত আসলে চিনতে পারছি না।

- তো ভালো আছেন, আপনি?
- হুম ভালো। আপনি?
- ভালো।
- ও , রিজু কোথায়?
- রিজু আজ আসে নাই। আপনাদের ক্লাস শেষ?
- হুম।
- তারমানে চলে যাবেন এক্ষুণি?
- হুম।
- ও হহ! আরেকটু পরে গেলে সমস্যা হবে?
- কেন? কোনো দরকার ছিল?
- এক কাপ চা খাব আপনার সাথে।
- চা! এখন?
- হুম
- এই অবেলায়? দুপুরে ?
- হুমম, যদি না আপনার আপত্তি থাকে।
.
আমি মুনার দিকে তাকিয়ে অনুরোধটা এমনভাবে করলাম যাতে এতে ভদ্রতাও থাকে আবার অধিকার খাটানোও থাকে তবে জানি মেয়েটা বুঝতে পারবে না। মুনা দুই সেকেন্ড কী যেন ভাবলো তারপর আমি রিজুর বন্ধু বলায় ভদ্রতা করে বললো,
- আচ্ছা চলুন।

আমি মুনা নামের আমার দেখা কোঁকড়া চুলের সবচেয়ে সুন্দর রূপবতী মেয়েটার সামনে বসে আছি। মুনার দিকে সরাসরি তাকাতেও পারছি না, মুনা কেমন জড়তা নিয়ে বসে আছে।
এখন বরং আমার চা খেতে অস্বস্তিবোধই হচ্ছে, মুনা চুপ করে বসে চা খাচ্ছে। খাচ্ছে বললেও ভুল হবে বড় বড় করে চুমুক দিচ্ছে যাতে জলদি চা শেষ হয়ে যায়।
আমার ইচ্ছে করছে মুনাকে আরো কয়েক যুগ আমার সামনে বসিয়ে রাখি। মুনাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম শাটলে, ক্লাস করে ক্লান্তসান্ত চেহারায় দরজায় দাঁড়িয়ে যেতে। হুম, সাড়ে পাঁচটার শাটলে। তখন ছিল শীতকাল জলদি সন্ধ্যে নামতো। ট্রেন যখন অন্ধকার পথটা শব্দ তুলে পাড়ি দিচ্ছিলো আমি তখন মুনার খুব কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মুনার চোখে জোনাক পোকার উড়াউড়ি দেখছিলাম। তখনো নাম জানতাম না , তারপর মুনার সাথে আবার দেখা পহেলা বৈশাখে কলা ভবনের ঝুপড়ি হতে কে যেন মুনা বলে ডাক দিলো তারপর থেকে আমি কাটা পাহাড়ের অজস্র ভীড়ে , স্টেশনের অচেনা মুখে মুনাকে
মুনা নামের রূপবতী মেয়েটাকে খুঁজে বেড়াই।

মুনাকে নিয়ে এক লাইনের একটা চিঠি লিখা কাগজ নিয়ে আমি পুরো ১০১ দিন পর মুনার সামনে বসে আছি। মুনা সে কাগজটা পড়ে কেমন চমকে যাবে ভেবেই কেমন জানি ঘাবড়ে যাচ্ছি। এবার কাগজটা দেবার পালা কিন্তু কীভাবে দিব ভেবেই পাচ্ছি না।
- আপনার চা তো দেখছি শেষ।
- হ্যাঁ, উঠবো এবার।
- শুনুন, একটা অনুরোধ ছিল, যদি রাখতেন।
- কী?
- এই কাগজটা আপনার জন্য।
- কীসের কাগজ? প্রেমপত্র?
- প্লিজ, আমার সামনে কাগজটা খুলবেন না, পরে পড়ে নিবেন, উত্তর দেয়াটাও জরুরি না।
- যদি না নিই?
- সেটা আপনার ইচ্ছে তবে নিলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না এতটুকু গ্যারান্টি দিচ্ছি।

মুনা কাগজটা নিবে নাকি ছুঁড়ে ফেলে দিবে আমি জানি না। আমি আপাতত পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাগজ খুঁজায় ব্যস্ত, না কাগজটা পাচ্ছি না কোথায় গেল!
হঠাৎ মনে পড়লো, কাগজটা কোথায় রেখেছি। মুনার দিকে না তাকিয়ে আমার কুঁচকানো হাতা গুটানো শার্টের বুকপকেট থেকে কাগজটা বের করলাম। মুনার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে একপলক তাকালাম দেখি মুনা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাগজটা হাতে নিতেই আমি বিদায় নিয়ে রিক্সায় উঠে গেলাম।
আমি জানি কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তা একবার হলেও মুনা কৌতুহলবশত খুলে দেখবে এবং খুলে মুনা অবাক হবে যখন দেখবে পুরো কাগজ জুড়ে শুধু ১০১ বার
" মুনা মুনা মুনা মুনা মুনা মুনা ...... মুনা শুভ জন্মদিন "
আমি হতভাগা কারণ আমি মুনা নামের সেই রূপবতী মেয়েটার অবাক হওয়া ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা দেখতে পাবো না। কারণ আমি আসলে কোনো রিজুকে চিনি না, মুনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল মুনার সাথে ভরদুপুরে এককাপ চা খাওয়ার। চা খাওয়াটা আমার এমন কোনো নেশা না যে তাই মুনার সাথে খাচ্ছি। জানি মুনার এই অদ্ভুত কাজটাই অনেকদিন মনে থাকবে হয়তো বহু মাস বা বহুবছর, বারবার মনে করবে, কারণে অকারণে মনে করবে। কোনো মেয়ে অবাক হওয়া কাজ সহজে ভুলতে পারে না ইচ্ছে করেই অন্য আরেকজনকে বলবে। হয়তো রিজুকেও জিজ্ঞেস করবে কিন্তু যখন জানতে রিজুর তমাল নামে কোনো বন্ধুই নেই তখন কী হবে সেটা কেবল নিয়তিই জানে।
হয়তো মুনার মেজাজ খারাপ হবে কিন্তু সে মেজাজ খারাপের পরও মুনা ব্যাপারটা অকারণে মনে রাখবে।
পৃথিবীতে সেই ভাগ্যবান পুরুষ যে কোনো মেয়েকে চমকে দিতে পেরেছে।

মুনাও বারবার নিজেকে প্রশ্ন করবে, "কেন ছেলেটা এমন করলো! সে কি আমাকে অনুসরণ করতো? সে কি আমাকে পছন্দ করতো?"
হয়তো ভাবতে ভাবতে আনমনে আয়নায় নিজেকে দেখবে, মনে মনে হাসবে। এই অদ্ভুত শখের বশে তার সাথে চা খাবার জন্যই ইচ্ছে করে তার বন্ধুর নাম বলে চালিয়ে দিলাম,অবশ্য এ নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই কারণ আমি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল মানুষ। আর আমার পরিচয়? 😀 তাতেই বা কী এসে যায়। আমি তমাল না রিসান কে জানে।
মুনার সাথে আজই আমার শেষ দেখা, রূপবতী মেয়েদের আশেপাশে বেশিক্ষণ থাকতে নেই, দীঘির জলে টলমল শীতল বাতাসের মত মন জুড়ানো অতৃপ্ত মায়া পড়ে যায় আর এ মায়া বড্ড ভয়ংকর জিনিস, চাইলেও এ মায়ার জাল এড়ানো যায় না, অক্টোপাসের মত পেঁচিয়ে মারে।





কৃষ্ণচূড়া
++++++
কত রাত এখন তোমার ওখানে? আকাশে তারাদের আলোক সজ্জা দেখতে ঘুম ভাঙা চোখে উঁকি দাও আকাশে?
কোন এক চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় প্রথমবার পড়া শাড়িতে জবুথবু আমাকে মনে পড়ে? তোমার পরনে ছিল জলপাই রঙ এর পাঞ্জাবী, ওই রঙ যেন চোখে জ্বালা ধরাচ্ছিল। তারপর ও ভিড়ের ভেতরে আমার চোখ দুটো শুধু তোমার খোঁজে ফেলুদা হয়ে এদিক ওদিক ফিরছিল।
গান শেষে আমরা সবাই নেমে এলাম আর তুমি এগিয়ে এসে ঠিক আমার সামনে দাঁড়ালে। সবে মাত্র উনিশে পা দেয়া আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। এক কাপ ঠান্ডা চা আমার হাতে দিয়ে বললে,' নাও ধরো সেই কবে থেকে চায়ের কাপ ধরে বসে আছি, চা জুড়িয়ে শরবত হয়েছে। 'একদম অচেনা কারোর এমন উদ্ভট আপন করা ব্যবহারে চমকে উঠেছিলাম কিন্তু তাতে একরাশ ভাল লাগাও ছিল।
সেই শুরু, এরপর নানা বাহারী রঙ এর পাঞ্জাবী পরে সময়ে অসময়ে চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে ঘুর ঘুর করতে। টর্নেডো হয়ে আসতে আবার উল্কার গতিতে হারিয়ে যেতে। সব সময়ই মনে হত তোমার অনেক তাড়া। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে ছিল তোমার এত্ত এত্ত বন্ধু । তবে কোন বান্ধবী ছিল না দেখে স্বস্তি পেতাম। মাঝেমাঝে হঠাত আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে দুই তিন লাইন রুটিন মাফিক কথা বলতে। 'কেমন আছো? পড়াশোনা কেমন চলছে এসব। ' কোন এক অদ্ভূত কারণে তুমি আমায় কৃষ্ণচূড়া নামে ডাকতে। আমি প্রথম কবার নামটা শুধরে দিয়ে পরে বুঝেছি ওই নামটা তোমার দেয়া।
আমি চুপচাপ থাকা একজন মানুষ, বেলী, কাঁঠালচাঁপা ডাকলেও মানিয়ে যেত। অমন টকটকে বখাটে রঙ এর ফুলের নামে কেন ডাকতে আমায়, তুমিই জান।
তোমার সব কথার উত্তর খুব সংক্ষেপে দিতাম। মাঝে মাঝে আমার হাসিতেই তুমি বুঝে নিতে। কেন যেন তোমার সামনে কখনই স্বাভাবিক থাকতে পারতাম না। তবে তুমি চলে গেলে সেদিন সন্ধ্যায় বা রাতে যখন সবাই শুয়ে পড়ত, তখন তোমার সাথে আমি একান্তে মন খুলে কথা বলতাম। কল্পনার আমি ছিলাম উচ্ছল ঝরনার মতন আর তুমি সবুজ পাহাড়।
এক দুপুরে ক্লাস শেষে বারান্দায় এসে দেখি তুমি দাঁড়িয়ে। মনে হল কারো জন্যে অপেক্ষায় আছো। আমার দিকে এগিয়ে এসে টুকটাক কথার ফাঁকে হঠাৎ ই খুব সরল গলায় বললে তোমার চোখদুটো খুব সুন্দর, টলমলে শিশিরের মতন। সেই রাতে তোমার বলা প্রতিটি শব্দকে রেশমের চাদরে জড়িয়ে বুকে টেনে নিলাম। আহ কি সুখ, কি সুখ।
এভাবে কেটে গেল বহু বহুদিন৷ তারপর এল সেই দিন টি। প্রায় বুধবার তুমি আসো, তাই সেইদিনটাতে মুখে আলগা পাউডারের পরশ, কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চুল টা আলগা করে খুলে রাখা। বাতাস আর চুলের দড়ি লাফ চলছে, মন জুড়ে শুধুই তুমি।
কে যেন পেছন থেকে কাঁধে টোকা দিল। ঘুরে দাঁড়ালাম। তুমি দাঁড়িয়ে। সেদিন পড়েছিলে লাল টকটকে পাঞ্জাবী, আমি ঠোঁটে হাল্কা হাসি ধরে রেখে চেয়ে রইলাম। তোমার চোখের ভাষায় কি যেন ছিল তাই একটু ভাল করে তাকাতেই দেখলাম তোমার পাশে ম্যাথস ডিপার্টমেন্টের মিষ্টি চেহারার রুবা আপু দাঁড়িয়ে। সেই চির পরিচিত আপু কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিলে তুমি। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে জানো। তুমি উচ্ছল হাসি দিয়ে বলেছিল ' এই যে নাও তোমার হবু ভাবী, আমার পুরো পৃথিবীর সম্রাজী ও'। আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু আমার চারপাশে বিশাল শব্দে ভেংে পড়ছিল কল্পনায় সাজানো ছোট্ট পৃথিবীটা। বুকটা হু হু, কষ্টের জলে ভেজা ভারী বাতাসে ছিল না একবিন্দু অক্সিজেন। ফিস উইদাউট ওয়াটার কথাটি শুনেছি বহুবার সেদিন সত্যিকার ভাবে বুঝেছি তা কত কষ্টের হতে পারে।
তবে কি তুমি এত এত টা দিন আমার ভাই হয়ে ছিলে? আমি বুদ্ধু, কিভাবে তাকে ভুল বুঝেছিলাম বলতে পারো।
জানি না আমার চোখে তুমি কতটুকু ভাংচুর দেখেছিলে, এরপর থেকে তোমার দেখা মেলেনি আর। আজ পঁচিশ বছর কেটে গেল। একটা সময় পর্জন্ত চেষ্টা করেছি সব ভুলে যেতে। কিন্তু এখন সে মূহুর্ত গুলো কে খুব যত্নে গুছিয়ে রাখি। সময় পেলেই ওদের খুলে আদরের আঙুল বুলাই, তোমার বলা প্রতিটি কথা একের পর এক গেঁথে মালার মতন গলায় পরি। আমার বাড়ির সামনে একটা বিশাল কৃষচূড়া গাছ। সে গাছে কান পেতে তোমার ডাক শুনি। অতো সুন্দর মায়া মেখে আমায় আর কেউ ডাকেনি। আমার পৃথিবীতে তুমি আছো বলেই তো আমি বুঝি ভালোবাসায় কোন বাঁধন থাকে না। কোন ঘুমহীন রাতে বুকের ভেতরে চিন চিনে অনুভূতি জানান দেয় তুমি আছো, ভালবাসারা আছে। আমার খুব খুব কাছে।
তোমার কৃষ্ণচূড়া
( লিখেছেন - কাজী রাহনুমা নূর)







এক মুঠো রোদ্দুর ও একটি টি-শার্ট
( অণু গল্প)
+++++++++++++++++++++
পাতারা রঙ বদলাচ্ছে,বাতাসে কুচি হিম। ওই যে মেয়েটা ছোট্ট দুই হাত অবিরাম ঘসে ওম হাতড়ে চলে,তার টিমটিমে শরীরে একফালি কাপড়, কোন এক সময় রাজার দুলালীর টি শার্ট ছিলো।এখন আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে ক্ষয়ে যাওয়া সুতোর গিঁটে ওই শীর্ণ শরীরের তাপ টুকু বেঁধে রাখতে। বখে যাওয়া বাতাসের সাথে পেরে উঠছে না ।
ক'বছর আগেও টি শার্টটি আয়না ঢাকা কাবার্ডের মখমলে মোড়া হ্যাংগারে দোল খেতো, বাতাসে ছড়িয়ে থাকতো মিষ্টি গন্ধ, না কোন ফুলের গন্ধ নয়, কখনো স্ট্রবেরী, কখনো বা অরেঞ্জ। মাঝে মাঝে কাবার্ডে এলাচ এলাচ গন্ধ ও পেতো। প্রথম কিছুদিন ওর খুব কদর ছিলো। মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে পার্কে, বীচে কত্ত ঘুরে বেরিয়েছে।
শুনেছে কারো কারো কপালে সুখ সয়না।তার ও সইলো না। কয়দিন পর ঝুপ করে ঠান্ডা নামলো, আর কাবার্ডের মাঝ থেকে সরে ওর জায়গা হলো ছোট্ট এক কোণে । দূর থেকে তাকিয়ে দেখতো বাহারী শীতের পোশাক। পার্পেল রঙের চমৎকার কাটের কোটটার কলারে গেঁথে থাকা মুক্তোটার নাক উঁচু
ভাব দেখে গা জ্বলে যেতো।শীতের পোশাক গুলোর টিপ টপ সাজগোজ দেখে মাঝেমাঝে নিজকে খুব ছোট মনে হতো। খুব নিসংগ ছিলো সেই দিন গুলো, অবহেলার তীক্ষ্ণ সুঁচের খোঁচা খেয়েই কাটতো রাত দিন।
এমনই এক শীতের সকালে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলো সে, হঠাতই গোলাপী গালের মিষ্টি মেয়েটা ওকে টেনে হাতে তুলে নিলো। আহ কতদিন পর ওর স্পর্শ পেলো,আবেগে মনটা ভিজে উঠতে না উঠতেই ওকে ছুঁড়ে ফেলা হলো কুচকুচে কালো ব্যাগে।চারদিকে অন্ধকার, আরো নানান আকারের কাপড়ের ভেতর ও গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো।
পাশেই একটা কাপড় নাকি সুরে বিলাপ জুড়েছে। দুলুনি থেকে টি শার্টটি বুঝতে পারছিলো ওদের গাড়ী করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সেই শুরু, এরপর যে কত কত গাড়ী আর জাহাজে চড়ে কত শত হাত গলে কত কত দেশ ঘুরে বেড়ালো। একদিন সে এসে পৌঁছুলো এক অদ্ভুত দেশে। এ দেশের বাতাস শুকতেই বুকের ভেতরটায় একটা টান অনুভব করলো। এখন তার পড়ন্ত বেলা, শরীরের এখানে সেখানে বয়সের হলদেটে ছাপ। দিনের বেশিটা সময় ঘুমিয়েই কাটে। কিন্তু এই নতুন দেশের মাটিতে নামার সাথে সাথে শরীরে এক রকম জোর পাচ্ছে যেন। দুইদিন পর জানতে পারলো এ দেশটির নাম বাংলাদেশ, এ যে তার জন্মভূমি। আহা শেকড়ের টান বুঝি একেই বলে।
এর ক'মাস পর সময়টা এখন ও মনে আছে, পূবে সুর্য সবে উঠি উঠি করছে, টি শার্টটি পড়ে ছিলো এক গাদা ময়লা কাপড়ের বাক্সে। হঠাত খসখস শব্দে তার ঘুম ভাঙে। একটা কালচে হাত তাকে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো, এরপর ওর গায়ে হাত বুলিয়ে হাত দুটো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আহা মায়ের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। সেই মায়াবতি মা কে সবাই মমতাজের মা বলে ডাকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। সেদিন ও কাজেই যাচ্ছিলো, ভাগ্যগুণে তাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিয়েছিলো। শেষ বাড়িতে কাজ করার সময় বেগম সাহেবের অনুমতি নিয়ে মমতাজের মা ওকে খুশবু মাখা সাবান দিয়ে সুন্দর করে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিয়েছিল। তার সারাটা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ভালোবাসা আর মায়া।
শেষ কবে গোসল করেছিলো মনে নেই। আর সেই গোসল মানে তো এত্ত বড় মেশিনে একগাদা দুর্গন্ধ যুক্ত কাপড়ের সাথে ডিগবাজি আর একগাদা নোংরা পানিতে নাকানী চুবানী। প্রতিবার ধোয়া শেষে টিশার্ট টি অসুস্থ হয়ে পড়তো। অথচ সেদিন মমতাজের মায়ের হাতের জাদুতে সে তো ঘুমিয়েই পড়েছিলো। ঘুম ভাংতেই দেখলো ও একটা ছোট্ট মেয়ের শরীরে ঝুলছে। সেই থেকে তার নতুন জীবনের শুরু। ছোট্ট মমতাজ তাকে কক্ষনো একা রেখে কোত্থাও যায় না। ওকে নিয়ে সে কত কি যে খেলে, মাঝে মাঝে মেয়েটা দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে, সে ও সংগ দেয়।
অথচ আজ ছোট্ট মমতাজ ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছে কিন্তু টি শার্টি তার দুমড়ে যাওয়া বুড়ো শরীর দিয়ে বাচ্চাটাকে এক টুকরো ওম দিতে পারছে না। কষ্টে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে টি শার্টটি খনখনে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো
" সূর্য দেব এক মুঠো রোদ্দুর দাও, মেয়েটার গায়ে মাখিয়ে বাকিটা জীবন শুধু তোমারই বন্দনা করবো। দয়া করো প্রভূ, চাই এক ছটাক ওম ।"
তার হাহাকার বাতাসের দেয়ালকে ছোবল দিয়ে আবার তার কাছেই ফিরে এলো।
সূর্য ঘুমিয়ে আছে।










হরি ঘোষের উপাখ‍্যান
ঘোল লাগবে ঘোল,  রসোওগোল্লা-
------হুমায়ুন কবির ববি

হরিঘোষকে এ শহরটার যারা আদি বাসিন্দা তারা প্রায় সবাই চেনে।
একটা বদ্ধ পাগল, কতদিন স্নান করে না কে জানে।
হরির বাবার মত হরি, এই শহরটা যখন ছোট ছিল তখন থেকে গরুর মত কাঁধে জোয়াল নিয়ে চিৎকার করে "ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা" বলে বলে ছোট্ট শহরটার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বাড়ি বাড়ি ঘোল আর রসগোল্লা বেঁচে বেড়াতো।
৭১ এ ওর বাবা মাকে হত্যা করলো, বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে হরিকে ধরে  মারতে থাকে।
হরি রাজাকার কমান্ডার খালেক মেম্বরের পা জড়িয়ে ধরে  বলেছিল, হুজুর আমাদের মারবেন না।
মেম্বর এর মাথায় কি এলো বললো, মুসলমান হয়ে আমাদের সাথে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিলে তোরে মারবো না।
আর আমার বাড়ির পাশের যে জমিটা ঐখানে থাকবি তোরা।
- সাহেব আপনি যা বলবেন সব করবানে, শুধু আমারে আর বউডারে ছাইড়ে দ্যান।
মেম্বরের বাড়ি থাকতো,  সকালে তার সাথে রাজাকার ক্যাম্পে আসতো। রাজাকারের খাতায় তার নাম উঠায়ে দিয়েছিল,  মাস গেলে ৭০ টাকা বেতন আর ১৫ কেজি চাল, ১০ কেজি আটা, তেল লবন পেত। মেম্বর কখনো বাড়িতে নামাজ পড়ত না, ক্যাম্পে যখন থাকতো তখন হরিকে নিয়ে নামাজ পড়তো। জুম্মার দিন মেম্বর বয়ান দিত ইসলাম আর পবিত্র ভূমি রক্ষায় মুসলমানদের আজ কি কাজ।
হরির নাম দিয়েছিল রহমত আলী,  আর বউয়ের নাম আয়শা। মেম্বর নামাজের সময় ডাকতো "রহমত আলী "
- এইতো হুজুর
- চল নামাজে যায়।
- জি হুজুর চলেন।
কোন কোন রাতে হরি ওরফে রহমত আলীকে ক্যাম্পের নাইট ডিউটি দেয়া হত। সে রাতে সুরমা চোখে আর আতরের সুগন্ধি মেখে মেম্বর আয়শা বিবির ঘরে রাত কাটাতো। দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন আয়শা বিবির ছয় মাস। মেম্বর পালিয়ে গেছে, রহমত আলী হরি হয়ে ছয়মাসের পোয়াতি বউ শিমুলকে ৫৭০ সাবান ঘসে নিজের বাপের ছোট্ট ভিটেতে ওঠে আর চিৎকার করে " ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা"।

৩ মাস যেতে শিমুল রাজাকারের বাচ্চা পয়দা করতে যেয়ে মরে যায়। হরি বাচ্চাটাকে ধরে আছাড় মারতে গিয়ে,  কোলে জড়ায়ে ধরে হাসতে থাকে আর বলতে থাকে এই রাজাকারের বাচ্চা এবার তুই কোথায় যাবি?  আমি তোর নাম দিলাম নমশূদ্র ঘোষ, তুই রোজ মন্দিরে যাবি আর হরিনাম করবি।
 সেই  থেকে মাথাটা খারাব হয়ে যায় হরির।
কদিন পর কোন এক বিদেশি সংস্থার লোক এসে ছেলেটাকে নিয়ে যায় হরি তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করে। তাতেও হরির ভাল হবার লক্ষ্মণ না দেখে পাগলা গারদে ভর্তি করে দেয়। আশির দশকে একটু ভাল হলে হরি বাড়ি ফিরে দেখে তার জমিতে নতুন পাকা বাড়ি। নতুন রাজনীতির পান্ডা জাল দলিল করে তার চৌদ্দ পুরুষের ভিটায় নতুন কি সুন্দর বাড়ি বানায়েছে। ভাল লাগে বাচ্চাদের নিয়ে এক সুন্দরী নারীকে খেলা করতে দেখে।
গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে, ধেয়ে আসে বাড়ির দারোয়ান বের হয়ে যেতে বলে।

- এটা আমার জমি
- পাগল কি বলে
হরি বের হতে না চাইলে পিটিয়ে বের করে দেয়।        সে সময় মাথায় আঘাত লাগে, হরি রাস্তায় পড়ে থাকে। হুশ হলে চিৎকার করে বলতে থাকে
"আমি মুসলমান হয়ে যাব মেম্বর হুজুর, আমার বউয়ের পেটে আপনি আবার রাজাকারের বাচ্চা জন্ম দেবেন।  হা হা হা---"।
তারপর থেকে রাস্তায় হরি, হরি পাগলা। রাস্তায় থাকে, রাস্তায় ঘুমায়, রাস্তায় খাই। ছেড়ে যাওয়া ময়লা পোষাক,  ছালা জড়ানো বাচ্চাদের ইট, ঠাট্টা, মানুষের অবহেলায় পার করে দেয় জীবনের ৭২ বছর।
হরি তার নাম কি মনে করতে পরেনা, হরিঘোষ নাকি রহমত আলী,  তার ধর্ম কি সে সনাতনী না মুসলমান।  তার দেশটার নাম কি পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশ,
  না না সে কিছু মনে করত পারেনা।

হরির আজ কদিন কেমন গা ছম ছম করছে।
রাস্তায় চকরা বকরা পোষাকের অস্ত্রধারীরা ঘুরছে সাথে পুলিশ।  মাইক দিয়ে কি সব বলছে তারা, বাড়ি যেতে বলছে।  বাড়ি গেলে নাকি কিসের থেকে মুক্ত থাকা যাবে। সবার মুখে কি যেন বাঁধা।  হরি বাড়ি যাবে কি করে, তার বাড়ি কোথায়,  তারতো কোন বাড়ি নেই। রাত নামতে হরির কেন যেন ৭১ এর রাতের নিস্তব্ধতার কথা মনে হয়। তবে একটা বড় পার্থক্য তখন রাত বাড়ার সাথে সাথে গুলির আওয়াজ বাড়তো। কিন্তু এখন শুনশান, এ যেন মৃতপুরি, কোন মাতালো মাতলামি করতে করতে রাস্তা পার হয়না।
সকাল হলে হরি রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা কাপড় টুকরো ঐ গতকাল রাস্তার সবার মুখে বাঁধা দেখেছিল পড়ে থাকা দেখে কুড়িয়ে নিয়ে মুখে বাঁধে। সারাদিন তেমন কোন খাবার জোটেনা, গা গরম যেন বুঝতে পারে হরি, হাচ্চি হতে থাকে।  এতদিন রাস্তায় রাস্তায় তার শরীর তেমন অসুস্থ হয়না শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায়।
৩/৪ দিন পর কাশতে থাকে হরি, গলার মধ্যে কেমন যেন চেপে ধরে দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় ৭১ এ মেম্বর রাজাকার কমান্ডারের নির্দেশে এক রাজাকার তার গলা পাড়িয়ে ধরলে তার যেমন দমবন্ধ হয়ে এসেছিল ঠিক তেমন দমবন্ধ হয়ে আসে। প্রচন্ড কাশি জ্বর,হরি জরের ঘোরে চিৎকার করতে থাকে।
"হুজুর আমায় মারবেন না, আমার বউডারে ছেড়ে দ্যান, আমি আপনি যা বলবেন তাই করবানে"। "ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা "। "এই রাজাকারের বাচ্চা এবার তোর নাম দেব, এবার এবার"-----
বলতে বলতে হরির নিঃশাষ বন্ধ হয়ে যায়।

৭ এপ্রিল ২০২০।।
২২, টুটপাড়া প্রধান সড়ক,  খুলনা




প্রতিশ্রুতি

অলভ্য ঘোষ

===================

ইন্দ্র, ২৭ তারিখ রাত একটায় ঠাকুরানী বাঁশ বাগানে আমার সাথে দেখা করো।
ইতি- সুস্মিতা

ওকি আবার নতুন করে ভালবাসবে আমায়।তবে কেন আমায় এভাবে ঘোরালো এতদিন।ফোনটা পাবার পর থেকে প্রতি কটা সেকেন্ড আমার মনে হয়েছে ভারী দীর্ঘ, কাটতেই চায়না।আজ চার বছর ওর মুখ থেকে একটিবারও ইন্দ্র ডাক শুনিনি।যতবারই ওর কাছে গেছি আমাকে চিনতে চায়নি ও।আমার ইচ্ছে করছে আবার নতুন করে বাঁচতে।তিলে তিলে ফুরিয়ে যাচ্ছিলাম আমি।

১২.৩০ পৌঁছে গেছি ঠাকুরানী বাগানে।আসলে ওকে কাছে পাওয়ার প্রবল আকর্ষণ আমায় টানছিল, আমি আর ঘরে থাকতে পারছিলাম না।

চারিদিকে জোনাকির হাট।দূরে খড়ের চালের বাড়ির জানালা দিয়ে অর্থ বিকশিত তেলের বাতির আলো।আকাশে গোটা চাঁদ, বাঁশ বাগান টিকে আবছা আলোর অবগুণ্ঠনে মুড়ে রেখেছে।আজো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এই অজ গ্রামে।কলকাতা থেকে প্রায় চার ঘণ্টার রাস্তা।পূর্ণিমার এক সন্ধ্যায় সবার চোখের অলক্ষ্যেই আমার সাইকেলে চড়ে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এই ঠাকুরানী তে এসেছিল সুস্মিতা।আমরা দুজনে মফস্বল গ্রামে মানুষ। ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়েছিল, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম-

-“তোমার ভয় করছে না”।

ও নির্বিকার-ভাবে বলেছিল- “কিসের ভয়”

আমি বলেছিলাম-
“এই নির্জনে একা------”।

-“কে। ......... কে বলল একা, তুমি তো কাছে আছো।”

এরপর কেউ আর কোন কথা বলতে পারিনি। দুজনেই চেয়েছিলাম দুজনের দিকে। ও আমার কাছে এগিয়ে এলো, সপে দিল নিজেকে আমার বুকে।আলিঙ্গন বদ্ধ এক দীর্ঘ চুম্বন। বেসামাল হয়ে গেছিল সুস্মিতা। আমার হাতে মেলে দিচ্ছিল নিজেকে।ইচ্ছে করলে আরও বহু দূর এগোতে পারতাম, কিন্তু এগুইনি। কারণ সত্যিই আমি ওকে ভালোবাসি।ওর কোন ক্ষতি আমি চাইনি কোনদিনই।এই মূল্য পেলাম, আমার ভালোবাসার।মেডিকেল কলেজে ও যখন এমবিবিএস পড়ছে। দিনের পর দিন কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম ওর জন্য।ওর বন্ধুরা নাকি হাসাহাসি করত, তাই বন্ধ হল ওখানে দাঁড়ানো।বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় ওর সাথে দেখা করতাম।আর যেদিন দেখা হতো না, ভীষণ মন খারাপ করত।পরের দিন অভিমান দেখিয়ে বলতাম-
"একটা ছাপোষা সাধারণ ছেলেকে এমবিবিএস ডাক্তার মেয়ে পাত্তা দেবে কেনও ------"

কথাটা শেষ করার আগেই আমার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরত সুস্মিতা।

“চুপ করো। আমি তোমার কাছে শুধুই তোমার। আর কিছু না………… কিছু না।”

ভালবাসার সমুদ্রে নিমজ্জিত আবেগের তরঙ্গে আচ্ছাদিত প্রত্যেক প্রেমিকাই হয়তো এ কথা বলে থাকে।তারপর যখন, আবেগের আচ্ছাদন হয় অপসারিত, সেই মানুষগুলো হারিয়ে যায়।কথা গুলো রয়ে যায়।কথাগুলো বিবর্ণ মনের মধ্যে প্রতিটা মুহূর্তে আঘাত করে চলে।

কথা দিয়ে তুমি রাখতে পারলে না সুস্মিতা। চার চারটে বছর আমি হন্যে হয়ে তোমার জন্য ঘুরছি।তুমি ভুলে গেছো আমাকে।নাম যশ, খ্যাতি তে তোমার সমকক্ষ নই।আমার বাড়ি নেই, গাড়ী নেই, নেই মোটা ব্যাংক-ব্যালেন্স।তাই আমার ভালোবাসার আজ মূল্য ও নেই তোমার কাছে।কেন সেদিন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমাকে? এই চার বছরে আমি যতবার তোমার সাথে দেখা করতে গেছি;তুমি আমার সাথে অপরিচিতার নাটক করেছ। নিজের সম্মান বাঁচাতে অস্বীকার করছ আমাদের সম্পর্ককে।লোক দিয়ে আমাকে তোমার ডিসপেনসারির বাইরে বার করে দিয়েছ ।আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, কারণ তুমি সবার চোখে এখন ডঃ সুস্মিতা ব্যানার্জী।তবে কেনও আমায় ডেকে আনলে এই নির্জনে।তবে কি তোমার মনে পড়লো প্রতিশ্রুতির কথা।

ঘড়ির দিকে তাকায় ইন্দ্র।

ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় একটা।তোমার দেখা নেই।এবারেও হয়তো তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রাখবে না।ভীষণ স্বার্থপর তুমি; নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝ না বুঝতে চাও না।তুমি আর একবার আমাকে ঠকালে সুস্মিতা।তুমি তো সব পেয়েছ আমাকে ঠকিয়ে; তবুও আশা মেটে না।শেষবার তোমার কাছ থেকে যেদিন অপমানিত হয়ে গলা ধাক্কা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম;ঠিক করেছিলাম; তিলে তিলে নিজেকে শেষ করব। রাত দিন বেপরোয়া মদ খেতে শুরু করলাম।এ পৃথিবীটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল।তুমি আমার জীবন টাকে বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছ। বাঁচার সবটুকু সম্বল কেড়ে নিয়েছ।

প্রাণহীন একটা লাশের মত জীবন কাটছিল।ঠিক সেইসময় এই ফোনটা যেন মৃত শরীরে আবার প্রাণের সঞ্চার ঘটাল।প্রলোভন দেখাল নতুন করে বাঁচার।

বোকার মত বকে চলে ইন্দ্র,শ্রোতা এই নির্বাক বাঁশ বাগান,মাঠ,রাতের আকাশ,চাঁদ।কোথায় সুস্মিতা?বেডরুমে স্বামীর বুকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়তো এখন।

একটা আলো ইন্দ্রর পিঠ স্পর্শ করল।বাঁশঝাড়ের গায়ে প্রতিফলিত ইন্দ্রর ছায়াটা ক্রমে ক্রমে ছোট হয়ে এলো।গাড়ির আওয়াজে পিছন ফিরল ইন্দ্র।
সাদা একটা প্রাইভেট কার আস্তে আস্তে মাটির রাস্তা বেয়ে এগিয়ে এলো।কালো চাদর মোড়া অস্পষ্ট মুখ।বাঁ হাতে একটা ব্রিফকেস,মাঝারি দৈর্ঘ্য-প্রস্থর একটি দেহ ইন্দ্রর কাছে এসে দাঁড়ালো।ইন্দ্রর চেনা,পুরানো সেই গলা।যার বর্ণনা ইন্দ্র কোনদিন খুঁজে পাইনি।খুঁজে পায়নি তার সমতুল্য বিকল্প কিছু।

-সরি একটু দেরি হয়ে গেল।

সুস্মিতা এসেছে,ইন্দ্রর জন্যও এসেছে।ইন্দ্রর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে প্রবল আনন্দে।

-আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না,এবারও তোমার কথা রাখবে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে উভয়ে।

-“একা ড্রাইভ করে এলে।”
- “ফাঁকা রাস্তা খুব একটা অসুবিধা হয়নি”।
-“তোমার স্বামী জানেন? ”
-“না। ”
-“আজ চার বছর বারবার চিনতে অস্বীকার করেছো।তবে হঠাৎ আবার এমন।রাত একটায় এই নির্জনে তোমার আসাটা ঠিক হয়নি । ”

বেদনার্ত সুস্মিতা;
-“তোমার কাছে একটু সুখ ভিক্ষা চাইবো।তুমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করো ইন্দ্র।ভুলে যাও আমাকে।এই মাঝ রাতে স্বামী পুত্র কে লুকিয়ে চোরের মত এখানে এসেছি অতীতের কোন ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে।”

ইন্দ্র অবরুদ্ধ প্রায়। কথার মাঝে প্রবল ব্যঙ্গ।
-“ও তাই বলুন। ভুল তাহলে আপনারাও করেন ডঃ ব্যানার্জী।”

সুস্মিতার কণ্ঠে রুক্ষতা প্রস্ফুটিত হল;
-“বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই।ভোর হবার আগেই আমায় বাড়ি ফিরতে হবে।”

-“বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?”

-“একটু শান্তি!আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।তোমার জ্বালায় আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।আমি কি পাপ করেছিলাম বলতো?কোন এক সময় তোমায় ভালবেসেছিলাম।তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু পারলাম না;বাবা মায়ের চাপে পড়ে………।”

ইন্দ্রর উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ টা যেন গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। -"মিথ্যে……… সব মিথ্যে।”

-“না মিথ্যে নয়,বিশ্বাস করো,এ বিয়েতে আমার মত ছিল না।দাদা বাবা জোর করে ধরে বেঁধে বিয়েটা দিয়ে দিল। তুমি-তো জানো ওরা চাইত না তোমার সঙ্গেই আমার......... "

ইন্দ্রর কাটা জায়গায় সুস্মিতা যেন নুন ছিটিয়ে দিল;
-"জানি আমি এফ,আর, সি. এস.এম.বি.বি.এস নই।যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সামান্য একটা এম.এ...."

-"কিন্তু তুমি তো তুমি চাইলেই তো। ......."

বাধা দেয় ইন্দ্র;
-"থাক!"

-"কেন থাকবে,সেদিন ওভাবে কাপুরুষের মত পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?"

-“পালিয়ে গিয়েছিলাম?তুমিই তো বলেছিলে জলপাইগুড়ির চাকরিটা নিতে!"

-"কারণ তোমার স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজন ছিল।তবলে একটা ফোন নয় চিঠি নয়।"

-"কোথায় ফোন করবো। কোথায় চিঠি পাঠাব।(উল্লেখ্য এই গল্প যখন লেখা তখন কেবল ল্যান্ড ফোন উপলব্ধ ছিল।)তোমার বাড়ির লোকজন..!মাস তিনেকের মধ্যে সেটেল হয়ে তোমাকে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম।"

-"জীবনটা ইন্দ্ররা বিকাশ পত্র নয়। সবকিছু ভেবে চিন্তে হবে না।চাকরিটা ছাড়লে কেন?"

-"যার জন্য চাকরি সে যখন....."

-"জীবনে তোমার কোন এম নেই। "

-"ছিল এখন লক্ষ্য ভ্রষ্ট।"

– "আচ্ছা তোমার ইচ্ছা হয় না আমাকে দেখে? আমার মত সুখী হতে মন চায় না?লোকে তোমাকে সাইকিয়াস্টিক পেশেন্ট বলে মনে করে!"

-“তবে আজ চলে আসো আমার কাছে ”।

-“আমার স্বামী সন্তান সব ফেলে।"

-“ সবকিছু ছেড়ে নতুন করে”।

-“ তা আর হয় না ইন্দ্র।”

-“কেন হয় না?এই তো বললে জীবন হিসেবের খাতা নয়।"

-“সলিল যে আমায় ভীষণ ভালবাসে।"

-আমি পারবো না সলিল কে ঠকাতে,ফুটফুটে বাচ্চা টা কে মাহারা করতে।”

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সুস্মিতা।

আবার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ প্রকাশ পায় ইন্দ্রের ভাষায়।
-“কাঁদছেন ডক্টর ব্যানার্জী বলতে পারেন আমাকে কেন ঠকালেন।জানেন আপনাকে হারিয়ে প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার কেমন কেটেছ।”

-“জানি ইন্দ্র,আমি জানি। কিন্তু সলিল ও যে আমায় ভালবাসে,ওর স্বচ্ছ ভালোবাসা কে কি করে ঘোলা করে দিই বলও।”

-“বা কি বিচার আপনার। ভালবাসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটা লোককে দলা মোচড়া করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আবর্জনার মতো।তাকেই আবার বলছেন স্বচ্ছ ভালোবাসার গল্প।”

-“আমি জানি ইন্দ্র তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না।আমি এই ব্রিফকেসে কিছু টাকা এনেছি।তুমি দূরে কোথাও চলে যাও।এখানকার মাঠ-ঘাট আকাশ,রাস্তা সবই যে একদিন আমাদের প্রেমের…।”

-“এটা কি আপনার প্রায়শ্চিত্ত।”

-“না ইন্দ্র না!তোমাকে আমি এভাবে তিলে তিলে নষ্ট হয়ে যেতে দেখতে পারবো না।তোমার আমার সম্পর্ক আমি অস্বীকার করলেও, লোকে তা নিয়ে রসালো গল্প জুড়েছে।সলিল আমায় বিশ্বাস করে তাই কথাটার এখনো কোনও গুরুত্ব দেয়নি।একদিন সেই বিশ্বাসটাও নষ্ট হয়ে যাবে।তুমি এভাবে দিনের পর দিন আমার ক্লিনিকে যেতে থাকলে।আমি সলিল কে কষ্ট দিতে চাই না। ”

-“তা দেবেন কেন, আমার মত একটা ফালতু লোক তো তিনি নন।আপনি আমার ভালোবাসার মূল্য দিতে এসেছেন।কিন্তু মিসেস ব্যানার্জী ওই ব্রিফকেসের টাকায় যে তার ছিটে ফোঁটাও বেচতে আমি রাজি নোই।”

-“কি চাও তবে তুমি?”

-“আমি আপনাকে চাই।যে প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি আপনার জন্য নিজেকে শেষ করেছি তার মাশুল শুধুমাত্র আপনি।”

পাগল হয়ে গেলে ইন্দ্র এগিয়ে চলল সুস্মিতার দিকে।চোখ দুটো বিস্ফোরিত প্রায়।

-“একি;অমনভাবে আমার দিকে এগিয়ে এসো না ইন্দ্র। পাগলামি করো না। আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো।”

-“হ্যাঁ আমি আপনাকে ভালোবাসি।তাই আমার ভালোবাসা কে আর কারো হতে দেবো না। এখানেই তোমার গলা টিপে শেষ করে দেবো।”

-“ না তুমি তা পারো না ইন্দ্র, কখনোই পারো না, কখনো না।"

উদ্যত ইন্দ্র কে দেখে ভীত সুস্মিতা পিছু হাটে,পিঠ ঠেকে প্রাইভেট-কারে।
-“ইন্দ্র,আর এগিয় না।আমার কাছে রিভলভার আছে।”

ইন্দ্র এগিয়ে চলে, সুস্মিতা কাঁধের ব্যাগ থেকে রিভলভারটা বার করে।

-“আমি তোমায় গুলি করে দেবো।"

হেসে ওঠে ইন্দ্র,আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে।

-“করো গুলি করো, মরতে আমি ভয় পাই না।”

-“প্লিজ,আর এগিয় না ইন্দ্র”।

ব্রিফকেস ফেলে দুহাতে রিভলভারটা শক্ত করে ধরে সুস্মিতা।ইন্দ্র প্রবল গতিতে ওর হাতটা চেপে ধরে।এক সময় হাত মুচড়ে কেড়ে নেয় রিভলভারটা।

-“এবার সুস্মিতা ব্যানার্জী । ”

রিভলভারের মুখ সুস্মিতার দিকে।ইন্দ্র হাসতে থাকে;
-"আমি কথা দিলাম বহুদূর চলে যাব, আর কখনো আসবো না তোমার কাছে, কখনো না।আমার প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ হবে না,আমার প্রেম ব্যর্থ নয়----।”

ট্রিগারে ইন্দ্রর আঙ্গুলটা আস্তে আস্তে চেপে বসছে;চোখ বন্ধ করে দুহাতে সুস্মিতা মুখ ঢেকে নিলো। গুড়ুম একটা আওয়াজ।একটা গুলি চলেছে যার প্রতিধ্বনি রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে চারিদিকে কাঁপিয়ে রক্তের ফোয়ারা হয়ে ছুঁয়েছে সুস্মিতার শরীর।সুস্মিতা চিৎকার করে উঠল। না গুলিটা তার বুকে চলেনি,চলেছে ইন্দ্রের মাথায়,মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ইন্দ্র।

রক্তাক্ত ইন্দ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সুস্মিতা। চোখ বুজল ইন্দ্র।

-“না, ইন্দ্র আমি এ চাইনি।আমি চেয়েছিলাম তোমার কাছে প্রার্থনা করবো নতুন করে জীবন শুরু করো তুমি,সম্পূর্ণ নতুন ভাবে দূরে কোথাও-----।ভেবেছিলাম তুমি যদি তবুও আমার প্রার্থনা গ্রহণ না করো,আর বাড়ি ফিরব না শেষ করে দেবো নিজেকে।কারণ সলিল আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।আমি যে ওর বিশ্বাসের জায়গাটা ঝাঁজরা হয়ে যেতে দেখতে পারবো না।সব ওলট পালট হয়ে গেল।তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারলে না। যে ভয় আজ চার বছর ধরে আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছে তাকে আরও সত্যি করে দিলে তুমি।যে রিভলভারের গুলিতে তোমার মাথা রক্তাক্ত হল;কাল তার লাইসেন্স পাওয়া যাবে আমার বেডরুমের ড্রয়ারে।সলিলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার আমার সম্পর্কের সত্যতা।আমি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হব।তোমার মত অও আমায় বলবে প্রতারক।কেউ বুঝবে না আমাকে।কেউ বোঝেনি আমাকে।তুমি না সলিল না। কেউ না।ইন্দ্র তুমি চাও সব ছেড়ে সলিলকে ছেড়ে মুন্না কে ছেড়ে আমি তোমার কাছে আসি।তাই আসছি আমি।আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো ইন্দ্র।আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো।

পুনর্বার একটা আওয়াজ আবার রাতের আকাশ জেগে উঠল।ইন্দ্রর বুকে মুখ গুজে পড়ে রইলো ডক্টর সুস্মিতা ব্যানার্জীর বডি টা। পূর্ণিমার চাঁদ যেন কোথায় যেন আবছা হতে হতে লুকিয়ে পড়েছে। পূবের আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে।অন্ধকার কাটিয়ে আসছে দিন। চারিদিকে পাখির ডাক।ইন্দ্র আর সুস্মিতা দীর্ঘ প্রতীক্ষার সময় কাটিয়ে গভীর নিদ্রায় ঘুমাচ্ছন্ন। 

 

 



©শ্রাবন্তী_মিস্ত্রী
-"আর দুশোটা টাকা বেশি দেবেন বাবু?"
নন্দার কথায় বেশ রেগে গেলো গিন্নি।-"হ্যাঁ রে নন্দা আগের মাসেই তো‌ তোর মাইনে দুশো টাকা বাড়িয়ে দিলাম আবার দুশো টাকা বেশি!তোর তো দেখছি কিছুতেই দাবি মেটে না আর।"
গিন্নিকে বললাম-"আহা গিন্নি এতো রাগ করলে চলে?"
নন্দাকে আরো দুশো টাকা দিয়ে দিলাম।ওর মুখে দেখলাম তখন কি খুশির হাসি।টাকাটা নিয়ে ও ব্যস্ত হয়ে পড়লো ঘরের কাজে।
নন্দা মেয়েটা বেশ চুপচাপ তেমন কথা বলে না,একমনে নিজের কাজ করে বেরিয়ে পড়ে অন্য বাড়ির কাজে।সব সময় সে কাজ করে চলে,যেনো ওর ক্লান্তি নেই।নন্দা এ বাড়িতে কাজে এসেছে মাস ছয়েক হলো।আগে একজন কাজ করতো সে কাজ ছাড়ার সময় নন্দাকে কাজটা দিয়ে গেছিল।নন্দা তাড়াতাড়ি করে কাজ করলেও নন্দার কাজ বেশ পরিষ্কার আর গুছানো তাই গিন্নিও আর আপত্তি করেনি।
সেদিন বসার ঘরে ঢুকতেই অবাক হলাম দেখে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে নন্দা আমার ইংরেজি খবরের কাগজটা মন দিয়ে পড়ছে।জিজ্ঞেস করলাম-"কিরে নন্দা তুই ইংরেজি কাগজ পড়তে পারিস?"
নন্দা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।বললাম-"কতো দূর লেখাপড়া শিখেছিস তুই?"
নন্দা বললো-"মাধ্যমিক পাশ করে এলেভেনে ভর্তি হয়েছিলাম দাদাবাবু।কিন্তু
বস্তির মেয়ে তো আমি তাই বাপ মা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিল তাই আর পড়া হয়নি।"
আমি সেদিন অবাক হলাম মেয়েটার দুর্দশার কথা ভেবে।লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেলে হয়তো ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো অনেক।
সেদিন রান্না ঘরে শুনলাম গিন্নি আর নন্দার কথোপকথন।নন্দা বলছে-"দুটো দিন ছুটি দেবেন গিন্নি মা?"
গিন্নি বললো-"না না এখন ছুটি দেওয়া যাবে না আমার শরীর ভালো নেই।আসতেই হবে তোকে।"
নন্দা সেদিন মুখ ফুটে বলতে পারলো না যে ছেলেটার পরীক্ষা শুরু হবে কদিন পর তাই ছুটিটা চাইছিল সে‌।গিন্নি রান্না ঘর থেকে বেরোতেই বললাম-"তোমার শরীর তো ঠিকই আছে তাহলে ছুটিটা দিলে না কেনো?"
গিন্নি ওমনি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো-"তুমি তো চলে যাবে তোমার স্কুলে আর সব কাজ তো আমাকেই করতে হবে ও না এলে।তাই কোনো ছুটি দেওয়া যাবে না।"
আস্তে আস্তে বললাম-"ছুটি চাওয়ার কারণটাতো জানতে চাইতে পারতে।"
কিন্তু গিন্নি আমার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়েই চলে গেলো।
নন্দার এ কদিন রাতে ঘুম নেই।রাত থাকতে উঠে রান্না চাপায় ছেলের জন্য। পরীক্ষার দিন নাহলে যে ছেলেটাকে খালি পেটে যেতে হবে।সকালে ছেলে বসে থাকে মুখ গুঁজে বইয়ে,নন্দা ছেলেকে খাইয়ে দেয় নিজের হাতে।তারপর ছেলেকে ভালো করে পরীক্ষা দেওয়ার কথা বুঝিয়ে দিয়ে ছোটে বাস রাস্তায়।কাজের বাড়িতে যেতে দেরি হলে আবার ঝামেলা।এ কদিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করে নন্দা।পরীক্ষা দিয়ে ফিরলে ছেলেটার মুখে তরকারি ভাত তুলে দেওয়ার আশায়।কখনো কেউ কেউ তাড়াতাড়ি ফেরার অনুমতি দেয়,কেউ দেয় না।এইভাবে দেখতে দেখতে এক সময় নন্দার ছেলের পরীক্ষা শেষ হল।
নন্দার অনেক স্বপ্ন তার ছেলেটাকে নিয়ে। অনেক লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবে সে।বাপ মা তো সেই বিয়ে দিলো লেখাপড়া বন্ধ করে,তারপর দু'বছর পর ছেলেটা হলো।বর ভোলা দূরের শহরে কাজ করতে গিয়ে তো আর ফিরলো না।সবাই বলে আবার নাকি বিয়ে করেছে সে।নন্দা পড়ে রয়েছে তার একমাত্র ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে।নিজে শত কষ্ট করলেও ছেলের সব প্রয়োজন মেটায় নন্দা।যদিও উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকে ছেলের টিউশনি পড়ার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে নন্দাকে।কিন্তু তাও নন্দা থামেনি নিজে খেটে ছেলের লেখাপড়ার টাকার জোগান দিয়েছে।
আজ সকালে খবরের কাগজটা পেতেই আমি তো আনন্দে আত্মহারা।আমার স্কুলের ছাত্র আনন্দ এবার উচ্চমাধ্যমিকের কৃতী প্রথম দশজন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন।বারবার বলছি সত্যি ছেলেটা জিনিয়াস।ওই ছেলে আমাদের স্কুলের নাম উজ্বল করলো।আমি খুব খুশি আনন্দ'র শিক্ষক হিসাবে।রিটায়ার হওয়ার এক বছর আগে আমার এটা অনেক বড় প্রাপ্তি।এর আগে আমাদের স্কুলের কোনো ছাত্রছাত্রীই এতো ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি করে রেডি হলাম দামী শার্ট, প্যান্ট,বুড পরে।আজ নিশ্চয়ই সাংবাদিকরাও স্কুলে আসতে পারেন,যতোই হোক আমি কৃতী ছাত্রের শিক্ষক বলে কথা।গিন্নি সমানে বলে চলেছে-"কি আক্কেল নন্দাটার!না বলে কয়ে হুট করে কামাই!আর ওকে কাজে রাখলে চলবে না তো বলে দিলাম।"
আমার এখন এসব শোনার মোটেই ইচ্ছা নেই। বেরিয়ে পড়লাম স্কুলের উদ্দেশ্য।
স্কুলে পৌঁছে আনন্দকে অনেক আশির্বাদ করলাম।রেজাল্ট দেওয়া হচ্ছে সব মাষ্টারমশাইরা সেখানে উপস্থিত।একজন শিক্ষক প্রশ্ন করলেন-"আনন্দ তুমি তো এতো ভালো রেজাল্ট করেছ,তোমার জুনিয়র ভাই বোনদেরকেও একটু বলো তোমার কঠোর অধ্যাবসায়ের কথা।"
আনন্দ বলতে শুরু করলো-"আমি তো শুধু লেখাপড়া করে গেছি মন দিয়ে,সফলতা পেয়েছি তাই আপনারা আমার সাফল্য দেখছেন কিন্তু এর পিছনে আছে একটা মানুষের কঠোর পরিশ্রম।যার জন্য আজ আমি সফল আজ আমি তাকে দেখাবো আপনাদেরকে।"
আমাদের স্কুলের সেরা ছেলেটা হঠাৎ ছুটে গেল স্কুলের গেটের কাছে।দেখলাম হাত ধরে টেনে আনছে একজন মহিলাকে। কিন্তু এই মুখটা তো আমার খুব চেনা,এ যে আমার বাড়ির কাজের মেয়ে নন্দা।আজ আমি আর মুখ তুলে তাকাতে পারছি না নন্দার দিকে।ওর মুখে জয়ের হাসি আমি এ স্কুলের কৃতী ছাত্রের শিক্ষক আর ও‌ যে সেই ছাত্রের মা।আমি সরে গেলাম ওখান থেকে।নন্দা'র আজ কাজে না যাওয়া আমার স্ত্রী'র অশান্তির কারণ,সে তো জানেই না আজ নন্দার ছেলের রেজাল্ট।
আমার স্কুলের যে ছাত্রের জন্য আমি এতো খুশি,পরীক্ষার দিনগুলোতে তার মা ছুটি পর্যন্ত পায়নি ছেলেটাকে ঠিক করে খাবার দেওয়ার জন্য।একদিন ওই ছেলেটার একটা নতুন বই কেনার জন্য দুশো টাকা বেশি দিতে গিয়ে কথা শুনিয়েছে আমার স্ত্রী।আসলে আমরা হয়তো ভাবতেই পারিনা যে একটা কাজের মেয়ের সন্তান এতো মেধাবী হতে পারে।বাস্তবেও কিন্তু এমন হয়।আমরা শুধু নিজেদের সমস্যা গুলো দেখি কিন্তু ওদেরও প্রয়োজন আছে ছুটির কিম্বা টাকার,অনেক সময় আমরা সেসব ভুলে যাই।
বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী শুরু করলো-"নন্দা কাল এলে টাকাটা মিটিয়ে দিও আর ওকে আসতে হবে না।"
নিজের সন্তানের জীবনের একটা এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে মা কাজে আসেনি বলে তার কাজটা চলে যাচ্ছে।পুরো ঘটনাটা না জানলে হয়তো আমি এটাই করতাম‌‌।কিন্তু স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে বললাম-"তোমার ছেলে যদি পরীক্ষায় সেরা দশজনের একজন হতো তুমি কি ছেলের পাশে থাকতে না?"
গিন্নি অবাক হয়ে বললো-"তার মানে?"
সবটা বলতেই গিন্নির চোখেমুখে ফুটে উঠলো অনুশোচনার ছাপ।
পরের দিন সকালে গিন্নি আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তুলে বাজারে পাঠালো।বাজার আনতেই নিজেই রান্না চাপিয়েছে দেখলাম।নন্দা বোধহয় আঁচ করে এসেছিল বকা শুনবে চুপ করে এসে ঘরের কাজে হাত দিতেই,গিন্নি বললো-" সোফায় বস আমি আসছি।"
নন্দার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা।আমি দেখলাম আমার রাগী গিন্নি হাতে এক গাদা টিফিন বক্স এনে ধরিয়ে দিলো নন্দার হাতে।বললো-"বলিসনি কেনো সবকিছু বল? এগুলো ছেলেটাকে খাওয়াস।বলিস আমি পাঠিয়েছি।আর একদিন আনিস আমার বাড়ি।ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ভুলতে বসেছে আমাদের কথা,তাই মেজাজ ঠিক থাকে না রে।যা বোন দুদিন ছুটি তোর সব কাজ আমি সামলে নেবো।"
আমি বললাম নন্দা-"এই নে এটা আমার প্রিয় ছাত্র আনন্দ'র জন্য উপহার তার মাষ্টারমশাইয়ের তরফ থেকে।"
বলে দুটো নতুন জামার প্যাকেট ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে।নন্দা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে।আমি বললাম-"হ্যাঁ রে নন্দা আমিই তোর ছেলের স্কুলের সেই শিক্ষক,যে কিনা তোর ছেলের সাফল্য দেখেছে তার পিছনে থাকা তোর পরিশ্রমের খোঁজ রাখেনি।"
আজ নন্দার মুখে সেই হাসিটাই দেখলাম যেটা আগেরবার দুশো টাকা বেশি দিয়ে দেখেছিলাম।



ডাকপিয়ন

নুরেন দূর্দানী

 হিম হাওয়ার দুপুরে কাঁপুনি দেয় কবিতার ডাক। প্রশ্ন দিয়ে ঝিমোয় কবি। অক্ষরের পর অক্ষর উত্তর দিয়ে যাই। ইনবক্স তখনো ফাঁকা! শুভ্র চিবুক উন্মুক্ত করে কালো মখমল ডানায় লালচে ঠোঁটের শঙ্খচিল ভেসে বেড়ায়। একটা গাছ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে ভালোবাসার শহরে। সানমুন বালিকার কথা মনে আছে? রোজ স্নাস ক্লাউড শহরতলি থেকে কাঁধেচাপা কিপিং-ব্যাগ লেটারবক্স নিয়ে যে এই শহরে আসে। আপন মনে মেট্রোলাইফের চিঠিগুলো নীলকন্ঠ সুরে পাঠ করে বালিকা।

প্রেরক মার্কো, চিঠিতে লেখা থাকে এমন:

‘পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ে যাই। বেশ কিছুদিন ঘুমহীন। সকালে সময় পেরোতে শুকনো টোস্ট কুড়মুড় শব্দ তুলে ব্ল্যাক কফির সাথে পেটে পুরছি। ভাবনায় থাকে দুপুরে আয়োজন করে খেয়ে নেওয়ার। অথচ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে হাটছি তো হাটছি। মনের ভেতর জমছে পাহাড়ি হিমবাহ। চারপাশের আবহে মধ্যস্রোত নিভে যাচ্ছে। যদি পুরোন বন্ধুর খোঁজ মিলতো! জানতে চাইতো আজ খেয়েছি কিনা কিংবা মুখ দেখে টের পেয়ে বলতো; ‘’তোর মতো আমারও মুখ ফুটে চাইবার জোর টুকু নেই। তবুও জানতে চাই, কেমন আছিস?’’ প্রশ্নটা বিব্রতকর হলেও, ইচ্ছে করে তবুও কেউ একজন বলুক! কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক!’

সানমুন উড়োজাহাজ বানিয়ে মার্কোর চিঠি ঝুলিয়ে দেয় গাছের শাখায়। নতুন সুর তুলে প্রবীণ পার্থের চিঠির উপর হাত বুলিয়ে পড়ে যায়;

‘ট্রেনের অপেক্ষায়। এতো প্রযুক্তি এলো অথচ মিনিট পাঁচেক সময় হয়না কারো সাথে কথা বলার। সেই রকম সঙ্গও নেই। অবসর খুঁজে পাওয়া দায়। ইদানীং অতীতের দৃশ্য চোখে ভাসে, মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। দূর বন্দর থেকে পাশের বাসার ল্যান্ডফোনে বাবার ফোন আসতো। মা’কে দেখতাম বিড়বিড় করে কথা বলতো, হু-হা বলেই ছেড়ে দিতো। খুব বেশিদিন ব্যবস্থাটা রইলো না। তখন সংসারে টানাপোড়ন লেগে থাকতো। তারই মাঝে মাসখানের মধ্যে ‘মা’ কিছু অর্থ জমা করে ল্যান্ডফোনের লাইন নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। আমলাতন্ত্রের ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে ছয় মাসের মাথায় বন্দবস্ত হলো ডিমান্ডনোট। বাড়িতে যেদিন ল্যান্ডফোনের লাইন সংযোগ হলো, সেকি আনন্দের দিন! আমাদের ল্যান্ডফোনের রঙ ছিলো র্ডাক-রেড। মায়ের আনন্দ খোঁজ নিতে পারবে স্বজনদের আর রোজ ফোন করবে বাবা। আমার আনন্দ ছিলো বাড়িতে ল্যান্ডফোন বাজবে, ক্রিং ক্রিং। লাইনম্যান সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমি মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। লাইনম্যান চলে যাওয়ার পর ডার্ক-রেড ল্যান্ডফোনের প্রথম ফোনকলের রিং শুনতে আমিও মায়ের সাথে অপেক্ষায় থাকলাম। সেই রিং ক্রমাগত বেজেই চলছে ক্রিং ক্রিং… ক্রিং ক্রিং…’

অতন্দ্র সময়ের ভাষ্যে ফুল-পাখি বানিয়ে পার্থের চিঠিকে রেখে দেয়। আরো একটা চিঠি তুলে নেয় বালিকা। প্রেরকের নাম মিকা:

‘ভালোবাসি! ভালোবাসি তোদের! ভালোবেসেছিই তোদের!
পনেরো বছর পর শেষবারের মতো একটা চিঠি লিখছি। জানি না এই চিঠি পৌঁছাবে কিনা। রাতের আলোয় রিক্ত শীতের আকাশে নীলচে সবুজ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যদিও এতে বৃষ্টি হওয়ার কোন আশংকা নেই। ভালোবেসেছিস অফুরন্ত। বিনিময়ে তোদের বুকে গেঁথেছি অবজ্ঞা-মনঃক্ষুণ্ণ ব্যবহার্য শব্দ। প্রতিনিয়ত কতো কিনা করেছিস অথচ সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছি। সহৃদয় প্রপাতে এক অজানার প্রান্ত ধরে দাগ কেটে যায় নিরব ক্রন্দন। দিনকে দিন বেড়েছে তর্ক, ভুল বোঝাবুঝির রেশ। নিরবে মেনে নিয়ে এড়িয়ে যেতে হয়। সেইদিন বুঝিনি সময়ের সন্ধিতে ছাড় দিতে হয়। অতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষকে পুড়িয়ে মারে। জ্বলেছি সে দহনে একদিন! ভেবে অবাক হই তিন জীবনের সূর্য ভিন্ন যাত্রা মেপে অস্ত দিচ্ছে। পনেরোটা বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। শেষ আলিঙ্গন হবে কি কোথাও ফের?’

স্ব-যত্নে মিকার চিঠিকে তারামাছ বানিয়ে নীলকন্ঠ সুরে গান গেয়ে যায় সানমুন। লালচে ঠোঁটের শঙ্খচিল ভেসে বেড়ায়। রোজ স্নাস ক্লাউড শহর থেকে ভালোবাসার শহরে চিঠি নিয়ে আসে বালিকা। সভ্যতা গড়ে ওঠে তবুও হোয়াংহোর আদিতে দু’কূলের দুঃখ আছড়ে পড়ে। ইনবক্স তখনো ফাঁকা! পারি থেকে আমাতে চলে যাচ্ছি, সেই সাথে এ-ঘর ছাড়চ্ছি। রজনীগন্ধার ঘ্রাণ কবির ঝিমুনি ভাঙ্গায়। নিজ্ব ঠিকানাই বড় স্বস্তির। তবুও বেখেয়ালি আমি, নৈঃশব্দে হাত রাখি তোমার কপালে। ডাকপিয়নের খোঁজ পেলে বলে দিও; ভালো লাগে নীল অপরাজিতা, ভাষামুকুট, কাগজের দোল আর ঐ কমলা পালকের বৃথিকা ফুল!

 

 

 

৪/৫ পেইজের সিভি'টা কে সব কেটে-ছেটে ছুটে, মাত্র ২ পেইজে নিয়ে আসছি! 
 
'এই জাহাজ মাস্তুল ছারখার
তবু গল্প লিখছি বাঁচবার
আমি রাখতে চাইনা আর তার
কোনো রাত-দূপুরের আবদার
তাই চেষ্টা করছি বারবার
সাঁতরে পাড় খোঁজার'
এতো সার্টিফিকেট, এতো অভিজ্ঞতা, এতো ভোলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করা, এতো সেমিনার অংশগ্রহণ, এতো এতো অডিও ওয়ার্ক, প্রোডাকশন ওয়ার্ক, কবিতা সংগঠন, সাহিত্যের অংগনে কাজ, মঞ্চের কাজ, এতো এতো স্ক্রিপ্টিং ওয়ার্ক, নানা রকম ছোট-বড় কাজ গুলো কে পাশ কাটিয়ে আমি জানি কই চলে যাচ্ছি!
'কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে
যদি নেমে আসে ভালবাসা খুব ভোরে
চোখ ভাঙ্গা ঘুমে তুমি খুঁজোনা আমায়
আশেপাশে আমি আর নেই'
গত ৭/৮ বছরের রাত-দিন অমানুষিক খাটুনি, ক্লাস-সংগঠন-অফিস নিয়ে দৌড় ঝাপ, সময়হীনতা, আমিহীনতা এবং এই সকল অন্যের স্বপ্নের পিছনে ছোটা আমি যেনো, ভীষণ মৃয়মান।
হতাশ লাগে না, বিষন্ন না লাগে না শুধু গলার ভেতরে কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গিলে ফেলি। ছুটতে ছুটতে এতো শিখতে শিখতে আর চারপাশের মানুষ দেখতে দেখতে ভীষণ ক্লান্তি লাগে। অজানা এক ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়। অনিশ্চিত গতিবিধি..
'আমার জন্য আলো জ্বেলনা কেউ
আমি মানুষের সমুদ্রে গুনেছি ঢেউ
এই স্টেশনের চত্বরে হারিয়ে গেছি
শেষ ট্রেনে ঘরে ফিরবো না'
আমাকে কেউ যখন বলে তোমার জীবনের লক্ষ্য কি, আমি চুপসে যাই। কোথায় যেতে চাও? আমার জানা নেই। কি করতে চাও জীবনে? আমি উত্তরহীন। সকল প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসেব ভুলে। প্রতিটা প্রশ্নের তীর ভীষণ বেদনাময় লাগে। মঞ্চের দু'ধারের নেমে আসা কালো পর্দা'টা যখন আমার সামনের দিক থেকে আড়াল করে ফেলে, আমি ফিরে আসি নিজস্ব পৃথিবীতে; নতমুখে!
এই 'আমি' টুকু ছাড়া; কোথাও যাওয়ার নেই, কোথাও আলো নেই, কোথাও কেউ নেই...
'যেটা ছিলোনা ছিলোনা সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন
তোমার এই দুনিয়ার ঝাপসা আলোর
কিছু সন্ধ্যের গুড়ো হওয়া কাচের মত
যদি উড়ে যেতে চাও তবে গা ভাসিয়ে দাও
দূরবীণে চোখ রাখবো না'
:খোঁজার
নুরেন দূর্দানী

 

দ্বিতীয় প্রেম  আবশ্যক।
#প্রাক্তন_যখন_বর্তমান

আমি করবী সেন, আমার মা অদিতি সেনের একমাত্র মেয়ে। বর্তমানে লন্ডনের একটা খ্যাতনামা হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়া করছি। মা থেকে গেছে আমার জন্মস্থান ভারতবর্ষে। মাকে কথা দিয়েছি পড়া শেষে ফিরবো তার কাছেই। আমি জানি আমাকে ছাড়া আমার মা ভীষণ একলা। বছরে বেশ কয়েকবার মায়ের কাছে যাই। মাকে অনেকবার বলেছি আমার কাছে চলে আসতে,মা বলেছে অপেক্ষা করবে আমার জন্য তাও দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকবে। মাঝ রাতে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়তে পড়তে মনে হয় এইসময় যদি মা পাশে থাকতো বেশ হতো। মা কখনো কষ্টের আঁচ লাগতে দেয়নি আমার উপর। সব আঘাত নিজে সহ্য করে গেছে সারাজীবন ধরে। সেদিন যদি মায়ের বাক্স খুলে পুরনো চিঠি গুলো না পড়তাম তাহলে জানতেই পারতাম না নিজের সন্তানের জন্য একটা মা ঠিক কতোটা আত্মত্যাগ করতে পারে। আমি ভগবান দেখিনি কিন্তু আমার মাকে দেখেছি। আমি যে মায়ের সব গল্প জেনে ফেলেছি তা মা জানে না। মা তো চিরকাল তার কষ্টের আড়ালে হাসিমুখটা দেখিয়েছে আমাকে। মায়ের চিঠি পড়েছি তিন বছর হয়ে গেছে তারপর থেকে ভেবে এসেছি কিভাবে মাকে একটু সুখী দেখতে পারি, কিন্তু পারিনি। তবে আমার মাকে ভালো রাখার এমন একটা সুযোগ আমি পেয়ে যাবো আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
সেদিন আমাদের ইউনিটের পেশেন্টের ফাইলগুলো দেখতে দেখতে একটা নাম দেখে থমকে গেলাম হঠাৎ করে। ফাইল হাতে সোজা হন্তদন্ত খেয়ে পৌছালাম পেশেন্টের কেবিনে। দেখলাম সেই সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে। আমি ওনাকে না ডেকেই ওনার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম। এইতো সেই মুখ,মায়ের কাঠের বাক্সে সযত্নে রাখা সাদা কালো ফটোতে এই মুখটাই তো দেখেছিলাম আমি। একটার পর একটা চিঠির লেখাগুলো ভেসে উঠলো আমার কাছে।
প্রিয় দিতি,
আমি জানি তুমি ভালো নেই। তোমার উপর আমার অনেক অভিমান জানো,কিন্তু রাগ নেই এতোটুকু। কাউকে নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসলে হয়তো তার উপর রাগ করা যায় না। সেদিন সন্ধ্যায় রক্তকরবী ফুলগুলো যেনো আরো রক্তাক্ত দেখাচ্ছিল,মনে হচ্ছিল ওরা বুঝি আমার হৃৎপিন্ডের সব রক্ত শুষে নিজেদের সাজিয়েছে। সারারাত অপেক্ষা করেছিলাম ওই গাছের নীচে বসে,তবুও তুমি এলে না। ভোর হতেই তোমাদের বাড়ি থেকে ভেসে এলো সানাইয়ের সুর, গাঁয়ের পুকুর ধারে দেখলাম মেয়েদের হাঁকডাক তাদের আদরের দিতির গায়ে হলুদ বলে কথা। যখন মনে হচ্ছিল আর কিছু সময় পর তুমি অন্যকারো হয়ে যাবে,মনে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে সব শেষ করে এই বুকে তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলি তুমি শুধু আমার আর কারো নয় কিন্তু পারিনি আমি। দুচোখ ভরা জল নিয়ে গ্ৰাম ছেড়ে চলে এসেছিলাম দূরের শহরে।
দু বছর পর গ্ৰামে ফিরে তোমার বান্ধবী হীরার মুখে সব শুনলাম তোমার উপর তোমার স্বামীর অত্যাচার আর কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে তোমাকে পরিত্যাগ করার ঘটনাও। তোমার ছোট্ট সোনার নাম রেখেছো করবী শুনে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে জানো? আচ্ছা দিতি আর কতোদিন বলোতো? আর কতোদিন? আমি এটাও জেনেছি কাকা আর তার ছেলেরা তোমার মৃত বাবা মায়ের সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে তোমাকে প্রতিনিয়ত অপমান অবহেলা করে চলেছে। দিতি এই চিঠির নীচে শহরের একটা বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলাম তিনমাসের ভাড়া দেওয়াই আছে আর নীচে বেশ কিছু চাকরির খোঁজ। তুমি তো একসময় আমাদের স্কুলের মেধাবী ছাত্রীদের একজন ছিলে। আমি জানি তুমি ঠিক পারবে নিজের সন্তানকে নিয়ে সাবলম্বী হয়ে বাঁচতে। আমি এই সাহায্যটুকু করেই চলে যাবো এ দেশ ছেড়ে। তোমার ছোট্ট মেয়ের জন্য রইলো অনেক আদর।
ইতি
হতভাগ্য নিখিলেশ
প্রিয় নিখিল,
তোমার শেষ চিঠির জবাব লিখতে লিখতে আমার সারাজীবন কেটে যাবে কিন্তু জানি কখনো চিঠিগুলো তোমার কাছে পৌঁছবে না। নিখিল শুধু অভিমানই করে গেলে একটুও বুঝলে না আমাকে। তুমি তো জানতে বলো আমি ভীতু চিরকাল। সেদিন রাতে ভেবেছিলাম সব ছেড়ে তোমার হাত ধরে ঘর ছাড়বো,নতুন সংসার গড়বো তোমার সাথে। বিশ্বাস করে বলেছিলাম কথাটা কাকার মেয়ে পিউকে কিন্তু সে কথা পৌঁছলো কাকা কাকির কানে,আর ঘর ছাড়া হল না। মরা বাপ মায়ের দোহাই দিয়ে জোর করে বিয়ে দেওয়া হল বিপত্নীক সমরেশ সরকারের সাথে। তারপর জানো ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে তোমাকে ভুলে যাবো, কিন্তু পারিনি জানো প্রতিটা মূহুর্তে তোমার স্মৃতিগুলো আমাকে অস্থির করে তুলেছে। তারপর মা হলাম। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে শ্বশুরবাড়ি ছাড়া হলাম। বাড়ি ফিরতেই কাকা বললো আমি নাকি বোঝা,আমার বাবার সম্পত্তিতে আমার মালিকানা আর নেই। নিজের বাড়িতে কাজের লোকের মতো পড়েছিলাম আমি তারপর হীরার হাতে তোমার চিঠি পেলাম। আমি পেরেছি নিখিল। সব ছেড়ে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি তোমার দেওয়া নতুন ঠিকানায়। এখন আমি সাবলম্বী। বাচ্ছাদের স্কুলে পড়ানোর চাকরীটা জুটে গেছে। তুমি না থাকলে হয়তো আমি কখনোই পারতাম না এতোকিছু। আমার এখন একটাই লক্ষ্য তোমার আদর্শ দিয়ে আমার সন্তানকে বড় করার।
ইতি
দিতি
প্রিয় নিখিল,
জানো নিখিল আমার মেয়েকে আমি মনের মতো করে বড় করেছি। ও এখন ডাক্তারির ছাত্রী। আমি বুড়ি হয়েছি বুঝলে, মাথার চুলে পাক ধরেছে। তবে আমার খুব গর্ব আমার মেয়েকে নিয়ে। নিখিল একটাবার যদি আমার করবীকে দেখতে বুঝতে দিতি কতোটা সুখী। আমার মেয়ে আমার জগত। ওকে ছাড়া একটা দিন চলে না আমার। জানো আমার মেয়ের ভালোবাসাটাকে আমি উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে খুব খুশি। আমি খুব সহজেই মেনে নিয়েছি অনুজ আর ওর সম্পর্কটা। ওদের বিয়ে দেবো ঠিক করেছি দুজনের পড়া শেষ হলে। অনুজের বাবা নেই ওর মায়ের মত নিয়ে তবেই স্বস্তি পেয়েছি। আমি চাই না আমার মতো কেউ চিরকাল হাহাকার করুক একটু ভালোবাসার জন্য। আচ্ছা নিখিল তুমি বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই। তোমার স্ত্রী সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। কথা মতো রোজ রাতে গোলাপ নিয়ে বাড়ি ফেরো নিখিল? আচ্ছা সিগারেট টাকি আজও তোমার নরম ঠোঁট পোড়ায় নাকি স্ত্রী'র আব্দারে সে অভ্যাস ছেড়েছ? খুব হিংসুটে শোনাচ্ছে নাগো নিখিল? সত্যিই হিংসুটে হয়ে গেছি আমি। কিন্তু যতো দূরেই থাকি এটাই চাই তুমি ভালো থাকো সবসময়।
ইতি,
দিতি
চিঠির কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেছিলাম আমি। হঠাৎ ভদ্রলোক বলে উঠলেন-"হ্যালো ডক্টর গুড ইভিনিং।"
মৃদু কাঁপা গলায় বলে উঠলাম-"আপনি নিখিলেশ বোস তো?"
ভদ্রলোক এবার উৎসাহিত হয়ে বললেন-" আরে বাঙালী দেখছি, ভারতের রত্ন বিদেশের মাটিতে কেনো?"
কি জানি কি হল আমার হাসপাতালের বেডে বসা লোকটার সামনে পা মুড়ে বসে প্রণাম করলাম আমি। উনি অনেক আশির্বাদ আর আদর করলেন আমায়। আমি ওনার হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম-" আপনাকে আমি আর ছাড়ছি না পেয়েছি যখন একবার।"
উনি হাসি মুখে তাকালেন আমার দিকে। আর তারপর ওনার ডিসচার্জ হবার পর সোজা পৌঁছে গেলাম ওনার বাড়ির ঠিকানায়। ওই ঠিকানায় পেলাম বিশ্বাস আর ভরসার সেই বুকটা যেটার অভাব ছিল ছোটবেলা থেকে। আমার মায়ের নাম শুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিখিলেশ বোসের চোখে জল দেখলাম। তারপর স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম আপনাকে আঙ্কেল বলে ডাকার ইচ্ছে কিন্তু আমার নেই। ভদ্রলোককে বললাম ছয় মাস অপেক্ষা করতে আমার এখানকার কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত, একজন যে ওনার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন সেটাও জানালাম।
আজ ২২ শে মার্চ আমার আর অনুজের বিয়ে। কনে সাজে আমি তৈরি। সবাই বলছে খুব সুন্দর লাগছে আমাকে,আর একজনকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে সেটা হল আমার মা। আমি মাকে নিজের হাতে সাজিয়েছি আজ। মা আপত্তি করেছিল বটে,কিন্তু সেসব শোনার পাত্রী আমি নই। আজ দুটো মন বাঁধা পড়বে একসাথে, আজ থেকে চারজন ভালোবাসার মানুষ একসাথে থাকবে। আজ শুধু আমার নয় আমার মায়ের ভালোবাসাও পূর্ণতা পাবে। মা এখনো জানে না মায়ের জন্য বরবেশে অপেক্ষা করছে তার সখা তার প্রাণের নিখিল।

সমাপ্ত
 
 
 
 
 
#কলমেঃ #স্বাতী_বোল
 
রাত তখন প্রায় বারোটা। শুভ্রজ্যোতি প্রতিদিনের ন্যায় রেকর্ডিং থেকে ফিরে ঘুমোচ্ছিল অঘোরে৷ অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই ক্লান্ত ছিল সে। হঠাৎ বেজে উঠল তার ফোন। ফোনটি যেহেতু লাউডেই দেওয়া থাকে তাই একবার রিং হওয়াতেই ফোনটি রিসিভ করলেন তিনি। ঘুমকাতুরে কন্ঠে বলে উঠলেন,
- হ্যালো। কে?
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অতি পরিচিত এক মহিলা কন্ঠ ভেসে এল তার কানে। মহিলাটি কাতর কন্ঠে বলে উঠল,
- শুভ্র আমি।
কন্ঠস্বরটি শুনে মুহুর্তেই ঘুমের ঘোর কেটে গেল শুভ্রজ্যোতির। বহু পুরাতন বুহু পরিচিত গলার স্বর এটি তার জীবনে। চোখের পাতায় ভিড় করে আসতে লাগল একরাশ শুভ্রজ্যোতি একটু কঠিন হয়েই বলল,
- অনিন্দিতা?
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আসা কন্ঠস্বরটি চুপ করল কিছুক্ষণ। শুভ্রজ্যোতি কোনো সাড়া না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
- অনিন্দিতা লাইনে আছো?
কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দই ভেসে এল না। শুভ্রজ্যোতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল
- কিছু বলবে অনিন্দিতা?
অনিন্দিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
- শুভ্র আবার সব নতুন করে শুরু করলে হয় না? ধরো তুমি আর আমি। আর কেউ না আর কিচ্ছুটি না। আবার সেই কলেজের মত হাত ধরে কলেজ বাঙ্ক করে চলে যাব বহু দূরে। বলো না শুভ্র হয় না এমনটা?
অনিন্দিতার কথা গুলো শুনে শুভ্রজ্যোতির চোখের কোনায় জল চিক চিক করে উঠল। চোখে ভেসে উঠল অতীত গুলো। অনিন্দিতা বলেই চলল কিন্তু সে বাকরুদ্ধ। সে তখন অতীতের স্মৃতির সারনী বেয়ে পৌঁছে গিয়েছে বহু দূরে। সেই কলেজের সীমানায়। কলেজের প্রথম দিন ভেসে উঠল তার চোখে৷
অনিন্দিতার পরনে সেদিন ছিল লাল সাদা চুড়িদার। চুল বাধা খুব অগোছালো ভাবে, কাজল কালো চোখ। মুখে লেগেছিল একরাশ মিষ্টি হাসি। কলেজের অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় বেশ খানিকটা আলাদা লেগেছিল তার অনিন্দিতাকে। তাই বোধ হয় কারো সাথে কথা না বললেও শুভ্র কথা বলতে চেয়েছিল তার সাথে। শুভ্রর ক্লাসমেটই ছিল সে। প্রথম দিন যদিও বা সে কথা বলে নি শুভ্রের সাথে কিন্তু ধীরে ধীরে বেশ ভাব জমে উঠেছিল তাদের। শুভ্রর সাথে প্রায়ই সে ঘুরতে যেতে চাইত বিভিন্ন জায়গায়। তারও যে ভালো লাগত অনিন্দিতার সাথে সময় কাটাতে। বেশ ভালো এক বন্ধুত্বের বাধনে বাধা পরেছিল তারা। সবাই তাদের প্রথম দিকে প্রেমিক যুগল ভাবলেও তারা কিন্তু তখনও একে অপরকে বন্ধুর বেশি কিছু ভাবতে পারে নি। শুভ্র যে ব্যস্ত তখন ভীষণ কেরিয়ার গড়তে। কিন্তু এক দমকা হাওয়ায় ওলট পালট হল সবটুকু৷ শুভ্রর এখনও মনে আছে সেই দিনটার কথা। সেবার সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করে প্রায় সাতদিন কলেজ যেতে পারে নি সে। অনিন্দিতা বারবার ফোন করেছিল সেদিন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ফোন রিসিভ করতে পারে নি শুভ্র। শেষ অব্দি তাদের ক্লাসেরই এক সহপাঠী অনিন্দিতাকে জানিয়েছিল শুভ্রের দূর্ঘটনার ব্যপারে। দূর্ঘটনার খবর শুনে বিন্দুমাত্র দেরী না করে সেই ছেলেটির সঙ্গেই শুভ্রকে দেখতে এসেছিল অনিন্দিতা। এভাবে প্রায় রোজদিনই আসতে শুরু করেছিল সে শুভ্রের বাড়িতে। শুভ্রের প্রতি অনিন্দিতার এতখানি যত্ন দেখে শুভ্রের মায়েরও যে তাকে ভালো লেগেছিল সে কথা মিথ্যে নয়৷ শুভ্রও বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছিল তাকে। সে জানত অনিন্দিতা প্রত্যাখান করবে না কোনোভাবেই। আর তাই সুস্থ হয়ে উঠে কলেজে এক ভ্যালেন্টাইন্স ডের দিনই গোলাপ গুচ্ছ সহ গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে অনিন্দিতাকে সে জানিয়েছিল তার মনের কথা। অনিন্দিতা ও তার হাত ধরে মিষ্টি করে বলেছিল,
"হ্যা ভালোবাসি তো। "
এক মিষ্টি সোনালী আবেগেই যেন তারা ভেসে গিয়েছিল অনেকদিন। বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে তারা মাথা রাখত একে অন্যের কাধে। ভবিষ্যৎ সাজাত সুন্দর করে। অনিন্দিতার কোলে মাথা রেখে সে হারাত এক সোনালী স্বপ্নে। অনিন্দিতাও যে তার পরশে ধন্য ছিল। সারা কলেজে সবাই তাদের আর্দশ যুগল হিসেবেই চিহ্নিত করত।
শুভ্রের আজও মনে আছে এক পড়ন্ত বিকেলে লালবর্ণের সূর্যকে সাক্ষী রেখে অনিন্দিতা তার কাধে মাথা রেখে বলেছিল,
- শুভ্র তুই কোনোদিন আমায় ছেড়ে যাবি না তো? আমার মা চায় না আমি লাভ ম্যারেজ করি। কারণ আমার মায়েরও যে লাভ ম্যারেজ ছিল।দশবছর প্রেমের পর বিয়ে আর তারপর ডির্ভোস। বাবা বিয়ে করেছিলেন অন্যত্র৷ তুই এমন করবি না তো?
শুভ্র তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল,
- না রে কখনো না।
অনিন্দিতার সেই আবেগঘন চাহুনি আজও মনে পরে শুভ্রজ্যোতির। বেশ চলছিল তাদের সম্পর্কটা। একদিন কলেজ শেষ হল। সংসারের হাল ধরতে শুভ্র আর মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারল না। বাবার স্ট্রোকের পর সংসারের দায় ভার এসে চাপল তার কাধে। অন্যদিকে অনিন্দিতার বাড়িতেও সম্বন্ধ দেখা শুরু হল। যদিও বা কখনোই অনিন্দিতার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে নি শুভ্র। কিন্তু অনিন্দিতার ব্যবহার কেমন যেন বদলে যেতে লাগল দিনের পর দিন। সে যেন দেখাই করতে চাইত না আর শুভ্রর সাথে। শুভ্র সাইকেল নিয়ে দেখা করতে এলে অনিন্দিতা তাকে কটাক্ষ করে বলত,
"শুভ্র এবার একটা বাইক কেন। আর কতদিন এভাবে ঘুরব আমরা? আমার বান্ধবীদের প্রেমিকদের দেখ। আর তোকে দেখ। "
শুভ্র যদিও বা কর্ণপাত করত না সেসব কথায়। সে জানত খুব ভালো করেই তাকে সেভিংস করতে হবে তার আর অনিন্দিতার ভবিষ্যতের জন্যে। সে তাই ওভার টাইম করে বসের সুনজরে আসার চেষ্টা করে চলল প্রাণপন। কিন্তু সে বুঝতে পারল না তার অনিন্দিতা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে তার থেকে। কাজের ফাঁকে যখনই সময় পেত সে ফোন করত অনিন্দিতাকে। কিন্তু অনিন্দিতা ফোন ধরার প্রয়োজন টুকু মনে করত না। শুভ্র বুঝতে পারত না তার এমন এড়িয়ে চলার কারণ। ঝগড়ার পরিমান যেন বেড়েই চলছিল তাদের মধ্যে।
শুভ্রর এখনও সেই দিনটার কথা মনে পরলে চোখ জলে ভরে আসে। সেদিন দুপুর বেলা অনিন্দিতা তাকে মেসেজ করে বলেছিল,
- আমার সাথে আজকে একটু দেখা করতে পারবি খুব আর্জেন্ট।
শুভ্রর ছুটিই ছিল সেদিন। সে তাই অনিন্দিতার সাথে বিকেলেই দেখা করতে চলে গেল। অনিন্দিতাও এসেছিল নির্ধারিত সময়। শুভ্র দেখেছিল অনিন্দিতা যেন অন্যদিনের মত খুশি হল না তাকে। দেখে। ব্যপারটা অবাক করেছিল তাকে। অনিন্দিতা তার দিকে তাকিয়ে ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের ক্যারি বের করে কিছু জিনিস তার হাতে দিয়ে বলল,
- চেক করে নিস ঠিক আছে কিনা।
শুভ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল
- কি আছে এতে?
অনিন্দিতা কটাক্ষ করে হেসে বলেছিল,
- তুই আমায় যা যা দিয়েছিলিস সে সব আছে এতে। যদিও বা দামী কিছুই না।
শুভ্র আরো অবাক হয়ে বলেছিল,
- আমায় দিচ্ছিস কেন?
অনিন্দিতা হেসে বলেছিল,
- আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুভ্র। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত। দেবাশীষ সান্যাল নাম তার। তোর মত কোম্পানিতে কর্মরত সামান্য ক্লার্ক নয় সে। মাসে ষাট হাজার ইনকাম করে। অনেক ভাবলাম বুঝলি আমার বান্ধবীরা ঠিকই বলে তোর কোনো ফিউচার নেই। খালি মিষ্টি গান গেয়ে কি আর পেট ভরে? বাবার স্ট্রোকের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাড়িটাও বেঁচে দিলি। বিয়ের পরে ভাড়া বাড়িতে উঠব?
শুভ্র সেদিন ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। অনিন্দিতার হাত ধরে কাকুতি মিনতি করছিল সে ভীষণ রকম। অনিন্দিতার হাত ধরে উন্মাদের ন্যায় কেঁদে সে বলেছিল,
- যাস না প্লিজ। তুই আমায় ছেড়ে গেলে সব যে শেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু অনিন্দিতা শোনে নি সে কথা। তাকে ছেড়ে চলে এসেছিল সে চিরতরে। শুভ্র সেদিন পার্কে বসে একা তাকিয়ে ছিল বিকেলের অস্তগামী সূর্যের দিকে। মনে করছিল অনিন্দিতার সাথে কাটানো তার মুহুর্ত গুলো। জীবন বড্ড বৃথা লেগেছিল সেদিন তার অনিন্দিতাকে ছাড়া। সব যেন শেষ তার জীবনে। তাই সেদিন পার্ক সংলগ্ন স্টেশনে গিয়ে নিজেকে শেষ করার ব্রতে ব্রতী হয়েছিল শুভ্র। বুঝতে পারছিল না ঠিক কার জন্যে সে থাকবে বেঁচে? বাবা ও গত হয়েছিলেন তার কিছুদিন আগে। মাও যে নেই তার বহুকাল। অনিন্দিতাকেই যে সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ছিল সে। কিন্তু হায়! আজ কেরিয়ার আর অর্থের দোহাই দিয়ে সেও যে ছেড়ে চলে গেল তাকে। সব দিকটাই যে শেষ। নিস্তব্ধ নিঃঝুম নিঃসঙ্গ হয়ে বসে ছিল তাই সে স্টেশনের বেঞ্চে। আজ বাড়ি ফিরতে চায় না সে কোনো ভাবেই। হঠাৎ তাকে বসে থাকতে দেখে তারই কলেজের এক জুনিয়ার মিতশ্রী ছুটে এসেছিল তার দিকে। যদিও বা কখনো কথা হয় নি তাদের তবে একই কলেজে পড়ার কারণে মুখ চেনা। শুভ্রজ্যোতির গানের স্যারের মেয়ে সে। অবাক হয়ে তার দিকে মিতশ্রী তাকিয়ে বলেছিল,
- তুমি শুভ্রদা না? আমাদের কলেজে গান গেয়ে বেশ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলে? আমার বাবার স্টুডেন্ট?
শুভ্র অবাক হল তার কথা শুনে। একটু বিষাদ ঘন হাসি হেসে বলল,
- হ্যা। কিন্তু তাতে কি?
মিতশ্রী অবাক হয়ে বলেছিল,
-তাতে কি মানে? তোমাকে কবে থেকে খুঁজছে বাবা জানো? আমাদের গানের স্কুল থেকে টিভির এক মিউজিক কন্টেস্টে প্রতিযোগী পাঠানো হচ্ছে। এবার তেমন কেউ নেই। তাই বাবা তোমাকে খুঁজছিলেন।
শুভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
- আমার দ্বারা আর গান হবে না। বহুকাল আগে ছেড়ে দিয়েছি।
মিতশ্রী অবাক হয়ে বলল,
- কেন হবে না শুনি? এত ভালো গান গাও তুমি। চল বাড়ি চল৷ আমি তোমার বাড়িতেই গিয়েছিলাম। তোমার পাড়ার লোক বলল তোমরা বাড়ি বিক্রি করে চলে এসেছ অন্য কোথাও। কত জনকে জিজ্ঞেস করেছি। কেউ বলে নি।
মিতশ্রীর কথা শুনে খানিকটা বিরক্তি এবং তার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নিয়েই তাকে আসতে হয়েছিল তার সাথে। প্রায় তিনমাস ধরে তালিম দেওয়ার পর মিতশ্রীর বাবা তার সবচাইতে প্রিয় ছাত্রকে পাঠিয়েছিল মিউজিক কম্পিটিশনে। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। তার গানের গলায় মুগ্ধ হয়ে একের পর এক রেকর্ডিং র অফার পাঠানো শুরু করে তাকে নামী সঙ্গীত পরিচালকেরা।
এত কিছুর মধ্যেও সে যে মিতশ্রীকে ভুলতে পারি নি। তার যেন কোথাও একটা মনে হতে থাকে সেদিন যদি মিতশ্রী তাকে স্টেশনে না দেখত আজ হয়ত এত কিছু তার জীবনে হতই না। কোনো এক নিঝুম একাকী রাতে মিতশ্রী এবং অনিন্দিতার কথা চিন্তা করে সে ভাবে ঠিক কতখানি পার্থক্য দুজনের। ইতিমধ্যে যদিও বা মিতশ্রীর হাতে লেখা একটি ডায়েরিও পেয়েছে সে। মিতশ্রী যে তাকে কলেজ জীবন থেকেই ভালোবাসে এবং অনিন্দিতার কারণেই তা জানাতে পারে নি তা সেই ডায়েরি পড়েই তা জানতে পেরেছে। মিতশ্রীকে ঘিরে তার তৈরী হয়েছে এক অন্য অনুভূতি। মিতশ্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে ভালোবাসা জন্মাতে থাকে তার ক্রমশ। সে বুঝতে পারছিল না কিভাবে মিতশ্রীকে জানাবে সে কথা। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার গানের স্যার প্রয়াত হওয়ায় মা হারা মিতশ্রী হয়ে পরল একা। সেদিন আর দেরী করে শুভ্রজ্যোতি। সে বুঝতে পেরেছিল মিতশ্রীর এখন অবলম্বন হিসেবে তাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অনিন্দিতা তাকে যে অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছিল সেই জায়গায় সে মিত্রশ্রীকে দাড়াতে দিতে পারে না। সে যে তাকে পুর্নজীবন দিয়েছে। সে তাই সময় নষ্ট না করে গানের স্যারের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব পালন করে এক বৈশাখের বিকেল্র মিতশ্রীকে স্ত্রীর সম্মানে নিয়ে এল তার বাড়িতে।
অতীতের স্মৃতিচারনা করে চোখ জলে ভরল শুভ্রজ্যোতির। চোখ মুছে সে অনিন্দিতার কথায় মনোযোগী হওয়া মাত্রই শুনতে পেল অনিন্দিতা তাকে বলছে তার বৈবাহিক জীবনের কথা যেখানে বিন্দুমাত্র শান্তি নেই। অর্থের প্রাচুর্যে সে ঘুমালেও ভালোবাসার কাধটা আজ আর জোটে না তার যে ভালোবাসার কাধ সে পেত শুভ্রজ্যোতির কাছে। সে আবার সেই কাধটা ফিরে পেতে চায়। তার কথা শুনে শুভ্রজ্যোতি হেসে বলল,
- তুমি কোথাও শান্তি পাবে না অনিন্দিতা। কারণ তুমি লোভী। ভালোবাসা পেলে অর্থ চাই তোমার। অর্থ পেলে ভালোবাসা। অন্য কাউকে খুঁজে নিও পারলে।
অনিন্দিতা কিছু বলত যাচ্ছিল৷ কিন্তু শুভ্রজ্যোতি মুখের ওপর ফোন কেটে নাম্বার ব্লক লিস্টেড করে রাখল। অন্যদিকে শুভ্রের কথা শুনে ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই মিতশ্রীর। সে চুপচাপ শুনছিল সবটুকু। শুভ্র ফোন কাটা মাত্রই সে ঘুম ভাঙার ভনিতা করে বলল,
- কে ছিল লাইনে?
শুভ্রজ্যোতি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
- ছিল এক রং নাম্বার। রাইট নাম্বার হওয়ার চেষ্টা করছিল।
মিতশ্রী হেসে শুভ্রের বুকে মাথা রাখল। শুভ্রজ্যোতিও তার মাথায় আবেগ চুম্বন করে মনে মনে তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাল তার জীবনে আসার জন্যে। সে না এলে যে শুভ্রের জীবন এত সুন্দর হত না। মনে মনে তাই তার উদ্দেশ্যে শুভ্র বলে উঠল,
- দ্বিতীয় প্রেম বড় আবশ্যক।
 
 
 
 
 
 (সংগৃহিত) গল্প
 
আমার বাবা ছিলেন পুলিশ, আর মা চোর। রোজ সকালে, বাবা স্নানঘর গেলেই দেখতাম, মাকে সন্তপর্ণে, শোওয়ার ঘরে ঢুকে গোপনে রুমালের নিচে চাপা দেওয়া খুচরো পয়সাগুলো নিজের আঁচলে বেঁধে নিতে। ভাত খেয়ে বাবা অফিসের দিকে রওনা হলে, মা যত্ন করে চুরির পয়সা লাল রঙের মাটির ভাঁড়ে জমা করে রাখত। আমি ভাবতাম মা একেবারে দস্যু মোহন - বাবার এতো পয়সা চুরি করে রোজ, আর আমার অবোধ বাবা কিছুই টের পায়না। মার উপর মাঝে মাঝে রাগ হতো। ক্রিস্টিয়ান ইশকুলে লেখাপড়া শেখা আমার নৈতিকতায় রোজকার এই বেহায়া পকেটমারি বড়ো বিতশ্রদ্ধ লাগত।
এই ভাবেই দিন কতেক যাওয়ার পর, একদিন স্নান শেষে শোওয়ার ঘর থেকে হুংকার আসত, " আরে আমার খুচরো গুলো কোথায়? " চোরের মন বোঁচকার দিকে থাকায় সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর উত্তর দিত, " আমি কি করে জানব!"
"না, তুমি জানো না আর। রোজ রোজ অটোওয়ালা নোট ভাঙ্গিয়ে দেবে না। আমার পয়সাগুলো ফেরত দাও। "
চুরি ধরা পড়ে যাওয়াই, অপরাধী মা কেঁদে কেঁদে পয়সা ফেরত দিত - " সব নিয়ে নাও আমার কাছ থেকে। আর কোনদিনও তোমার পার্সে হাত দেবো না। " পয়সার ঠুং-ঠ্যাংর সঙ্গে জড়িয়ে থাকত কেমন একটা অপাপবিদ্ধ অসহায়তাও।
সেইদিন সকালে অফিসের ভাত বাড়ার মধ্যে যদিও লুকিয়ে থাকত রাগ- অভিমান- অভিযোগ , আমি জানতাম, সেইদিন সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফিরে বাবা কোথা থেকে জোগাড় করে আনা ১টা ৫টাকার কয়েন, মার ঝাঁপিতে আলতো করে ফেলে দেবে। মাও বোধহয় জানত তা। তাই মুখে কিছু না বললেও পর্দার ফাঁক থেকে তার উঁকি চোঁখের মুচকি হাঁসি জানান দিত সব। ঠিক যেমন করে বাবাও জানত পরের দিন সকালে আবার অটোর খুচরো পাওয়া যাবে না।
আমি ভাবতাম এহেন একুশে আইন তো ভালো বটে - পকেট কাটলে সাঁজা নাই। সাঁজার বদলে গজা আছে যখন, তখন আমিও বা পকেট কাটি না কেন। এক সকালে, তাই দস্যু মোহনের আগে আমি নিজেই বাবার পাঞ্জাবিতে সিঁধ কেটে ফেলি। যদিও চুরির মাল উপভোগ করার আগেই আসামি সিধে জেলে আটক। বন্দী দশায় মার হাতের খুন্তির third degree না হয় আজ এখানে নাই মনে করলাম। বুঝলাম দাম্পত্যের নিয়ম বাৎসল্যে খাটে না। অভিযোগী গলায় মাকে বলেছিলাম " তুমি যে রোজ নাও, তাতে কিছু হয় না বুঝি। " মা আরেকবার খুন্তি ঘা মেরে বলেছিল, " গরিবের ঘরে মা বাবার পকেট না কাটলে সংসার চলে না। "
কথাটার মানে তখন (অবশ্যই) বুঝিনি। বুঝেছিলাম ঘটনাটার ১০-১৫ বছর পর, যখন আমার IIT যাওয়া প্রায় বন্ধ টাকার অভাবে। আমার অন্নপূর্ণা মা, সেইদিন, তার দস্যু মোহনের খুলি গুহা থেকে সব গুপ্তধন বেড় করে দিয়েছিল - এই ১০ বছরে জমানো ৫টা লাল মাটির ভাঁড় - আমার বাবার পকেট মেরে জমানো। সাকুল্যে এই ১০ বছরে ১০ হাজার টাকা - সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন। IITর ভর্তি পুরো টাকাটা না হলে, অনেকটাই এসেছিল সেই থরে থরে রাখা মাটির ভাঁড়গুলো থেকে। কসবার এঁদো গলির, এক ফেলি বারান্দায় যার পৃথিবীর পরিধি শেষ - সেই মার ১০ বছরের সবটুকু সঞ্চয় ঢেলে পাঠিয়েছিল আমাকে IIT তে পড়তে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত সব বাড়ীতেই নাকি এইরকমই হয় - আমার, আপনার বেড়ে ওঠার গল্প প্রায় একই - কোন এক বাবা- মার চোর-পুলিসি সঞ্চয়- সম্বল আছে তার পেছনে।
হাতে টোনার কালো leather walletটা নিয়ে এই সব হ-য-ব-র-ল ভাবছি, আর ওইদিক থেকে কেউ একজন walletর জন্যে চেঁচিয়ে মরছে। মার মতন স্বামীর পকেটমারি করার guilty pleasureএ পার্সের মধ্যে সদ্য হাতটি ঢুকিয়েছি - কিন্তু কোথায় কি!!! ডলার তো না হয় ছেঁড়েই দিলাম, এক খানি কুঁচো পেনিও তো হাতে এলো না। পার্সের ১০১ খাপ থেকে শুধু উঁকি মারছে ১০২টি ক্রেডিট কার্ড - লাল, নীল, হলুদ, সবুজ- রথের মেলা মতন। কিন্তু এখানে শুধু রথ দেখেই দিন কাটলো, কলা বেচা আর হল না । মনে মনে ভাবি আজ থেকে ১০-১৫ বছর পর আমার সন্তানের প্রয়োজনে আমি কোথা থেকে নিয়ে আসব সেই যক্ষপূরীর ধন। কোথা থেকে আসবে সেই ঐন্দ্রজালিক লক্ষ্মীর ঝাঁপি.
(সংগৃহিত)
 
 
 
 
 
 
 

Sunday, February 23, 2020

আরণ্যক বসু



মনে থাকবে?
-- আরণ্যক বসু

পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু'জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার
চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক'রে দুচোখ
ভ'রে থাকবো চেয়ে...
মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের
জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের
জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের
জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?
আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার
আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান
বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে
মেলায় মেলায় বাউল
হয়ে ঘুরে বেড়াবো...
মনে থাকবে?
আর যা কিছু হই বা না হই
পরের জন্মে তিতাস হবো
দোল মঞ্চের আবীর হবো
শিউলিতলার দুর্বো হবো
শরৎকালের আকাশ দেখার
অনন্তনীল সকাল হবো;
এসব কিছু হই বা না হই
তোমার প্রথম পুরুষ হবো
মনে থাকবে?
পরের জন্মে তুমিও হবে
নীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরা
গাঁয়ের পোষাক ছুড়ে ফেলে
তৃপ্ত আমার অবগাহন।
সারা শরীর ভ'রে তোমার হীরকচূর্ণ
ভালোবাসা।
তোমার জলধারা আমার
অহংকারকে ছিনিয়ে নিল।
আমার অনেক কথা ছিল
এ জন্মে তা যায়না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের
অসঙ্গতে
পরের জন্মে মানুষ হবো
তোমার ভালোবাসা পেলে
মানুষ হবোই মিলিয়ে নিও!
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে...
বলতে ভীষণ লজ্জা করছে
ভীষণ ভীষণ লজ্জা করছে
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে...
মনে থাকবে?




যেন বলে ওঠে
আরণ্যক বসু

আসলে কথারা সব বিলুপ্ত পাখির ঠোঁটে
শিলালিপি হয়ে আছে
আসলে কথারা সব নিঃশেষে মুছে গেছে
আলোকবর্ষ দূরে
তারাহীন নীল অন্ধকারে
আসলে কথারা এসে ফিরে চলে গেছে সেই
মটরশুঁটির ক্ষেতে, সবুজে সবুজে।
তুমি ফিরে এসে সেই শিলালিপি পাঠ করো প্রিয়বন্ধু
কি কথা? কী কথা? এই শিলালিপি ভরে আছে
পাথরের বুকে ঘুম হয়ে!
মৃত তিতিরের ঠোঁটে কোন সে শব্দের রেশ
লেগে আছে লক্ষ বছর ধরে-আমাকে শোনাও!
চলো গিয়ে বসি সেই শব্দহীন
তিরতির গ্রামীণ নদীর কাছে
চলো, শুনি, কী কথা বলার ছিল তার
সে-ও তো অনেক কথা উজানে,
ভাঁটির টানে বলে ব’য়ে গেছে।
তুমি সেই অন্তহীন স্তব্ধতায় শব্দরাশি
মুক্ত করে দাও প্রিয়মুখ
তুমি সেই বৃষ্টিধোয়া নিরুচ্চার
শব্দগুলো চালচিত্র করে দাও
জীবনে আমার
টুং টাং বেজে যাক অশ্রুত শব্দের কথামালা
অপেক্ষার, প্রতিক্ষার টুকরো টুকরো যতো উন্মীলন
বাগ্ময় হয়ে উঠে আমাকে কাঁদায় যেন
আমাকে ভাসায় যেন বাঁধভাঙা উৎসের অনিবার্য স্রোতো
সব শব্দ মিলে মিশে যেন বলে ওঠে-ভালোবাসি, ভালোবাসি….











Saturday, February 22, 2020

মায়ের কবিতা




"মিথ্যাবাদী মা"
আদিত্য অনীক

এতটা দিন পেরিয়ে আজো মায়ের জন্য কাঁদি
কারণ আমার মা যে ছিল ভীষণ মিথ্যাবাদী।
বাবা যেদিন মারা গেল আমরা হলাম একা
সেদিন থেকেই বাঁক নিয়েছে মায়ের কপাল রেখা।
মা বলতো বাবা নাকি তারার ভিড়ে আছে
লেখাপড়া করি যদি নেমে আসবে কাছে।
তারায় তারায় বাবা খুঁজি তারার ছড়াছড়ি
আমার মায়ের মিথ্যে বলার প্রথম হাতে খড়ি।

পাড়া পড়শি বলল এসে এই বয়সেই রাঢ়ি !
একা একা এতটা পথ কেমনে দিবে পাড়ি।
ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে কর আবার
মা বলল, ওসব শোনে ঘিন্না লাগে আমার।
একা কোথায় খোকন আছে, বিয়ের কী দরকার
ওটা ছিল আমার মায়ের চরম মিথ্যাচার।
রাত্রি জাগে সেলাই মেশিন, চোখের কোণে কালি
নতুন জামায় ঘর ভরে যায় মায়ের জামায় তালি।
ঢুলু ঢুলু ঘুমের চোখে সুই ফুটে মা’র হাতে
আমি বলি শোও তো এবার কী কাজ অত রাতে?
মা বলত ঘুম আসে না শুয়ে কী লাভ বল?
ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা কথার ছল।
স্কুল থেকে নিতে আসা গাড়ী ঘোড়ার চাপে
আমার জন্য দাঁড়ানো মা কড়া রোদের তাপে।
ঘামে মায়ের দম ফেটে যায়, দুচোখ ভরা ঝিম
ভানিটি ব্যাগ খুলে আমায় দিত আইসক্রিম।
মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলতাম একটু নাও
মলিন হেসে মা বলত খাও তো বাবা খাও।
আমার আবার গলা ব্যথা, ঠাণ্ডা খাওয়া মানা
ওটা ছিল আমার মায়ের নিঠুর মিথ্যা-পনা।
বড় হয়ে চাকুরী নিয়ে শহর বড় শহর আসি
টুকটুকে বউ ঘরে আমার বউকে ভালবাসি।
পশ এলাকায় বাসা নিয়ে ডেকোরেটর ধরে
সাজিয়ে নিলাম মনের মত অত্যাধুনিক করে।
মা তখনো মফস্বলে কুশিয়ারার ঢালে
লোডশেডিং এর অন্ধকারে সন্ধ্যা বাতি জ্বালে।
নিয়ন বাতির ঢাকা শহর আলোয় ঝলমল
মাকে বলি গঞ্জ ছেড়ে এবার ঢাকা চল।
মা বলল এই তো ভাল খোলা মেলা হাওয়া
কেন আবার তোদের ওই ভিড়ের মধ্যে যাওয়া?
বদ্ধ ঘরে থাকলে আমার হাঁপানি ভাব হয়
ওটা ছিল আমার মায়ের মিথ্যা অভিনয়।
তারপর আমি আরো বড় , স্টেটস এ অভিবাসী
বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞ সুনাম রাশি রাশি।
দায়িত্বশীল পদে আমার কাজের অন্ত নাই
মায়ের খবর নিব এমন সময় কমই পাই।অ্যা
মা বিছানায় একলা পড়া খবর এল শেষে
এমন অসুখ হয়েছে যার চিকিৎসা নেই দেশে।
উড়ে গেলাম মায়ের কাছে অনেক দূরের পথ
পায়ে পড়ে বলি মাকে এবার ফিরাও মত
একা একা গঞ্জে পড়ে কী সুখ তোমার বল,
আমার সংগে এবার তুমি এমেরিকা চল।
এসব অসুখ এমেরিকায় কোন ব্যাপার নয়
সাত দিনের চিকিৎসাতেই সমূল নিরাময়।
কষ্ট হাসি মুখে এনে বলল আমার মা
প্লেনে আমার চড়া বারণ তুই কি জানিস না ?
আমার কিছু হয় নি তেমন ভাবছিস অযথা
ওটাই ছিল আমার মায়ের শেষ মিথ্যা কথা।
ক’দিন পরেই মারা গেল নিঠুর মিথ্যাবাদী
মিথ্যাবাদী মায়ের জন্য আজো আমি কাঁদি।





 আমার মা – রেদোয়ান মাসুদ


 মায়া ভরা হৃদয়টি যার
সে আমার মা।
কত স্নেহ করতো আমায়
মনে পড়ে তা।
মনে কোন কষ্ট থাকলেও
বুঝতে দিত না।
হাসি ভরা মুখটি তার
দেখলে জুড়াত গা।
হাত এগিয়ে বলত আমায়
আয়রে কোলে খোকা।
মুখে দু’টি চুমো দিয়ে
বলত কত কথা।
অসুখ-বিসুখ হলে কোন সময়
টিপে দিত হাত-পা।
সরিষার তেল মেখে আমার
গরম করত গা।
ছেলের কোন কষ্ট দেখলে মায়ের মুখে
হাসি থাকত না।
সারা রাত পাশে বসে থাকত
ঘুম আসত না।
সারা দিন কত পরিশ্রম
করত আমার মা।
শত পরিশ্রমের পরেও মায়ের
ক্লান্তি আসত না।
এত কাজের পরেও মা
নামাজ মিস করত না।
নামাজ পড়ে আবার কাজে
ভিজে যেত সমস্ত গা।
কোথায় গেলি আয়রে খোকা
ভাত খেয়ে যা।
যতক্ষণ না আসতাম খেতে
ডাক থামতো না।
পাশে বসে খাওয়াত ভাত
আর একবার কর হা।
পেট ভরে খেলে ভাত
অসুখ করবে না।
হাটে থেকে ফিরত বাবা
বাজারের ব্যাগ নিয়ে।
সকল বাজার রেখে আবার
বাবাকে বাতাস করত মা।
হাত মুখ ধুয়ে এসো
ক্ষুধা লাগছে না?
বাবাকে ভাত খেতে দিয়ে আবার
ফিরেতে বসে থাকত মা।
যতক্ষণ না ভাত খাওয়া হত বাবার
কোথাও যেত না।
কান্নায় যখন চোখ ভিজাতাম
দৌড়ে আসত মা।
আচল দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলত
কি হয়েছে খোকা?
হাসি ভরা মুখে তখন
চুমো দিত মা।
মায়ের আদর পেয়ে তাই
কান্না থাকত না।
আজকে শুধু পরছে মনে
মায়ের সকল কথা।
এত আদর কোথায় পাব
মায়ের হাত ছাড়া।
মায়ের কথা লিখব কত আর
শেষ হবে না।
পুরো শরীরের চামড়া উঠিয়ে দিলেও
শোধ হবে না।
যাহার কাছে এত ঋণী
সে আমার মা।
চোখ ভেসে যায় জলে আমার
কান্না থামে না।




আমাদের মা –
................হুমায়ুন আজাদ

আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।




 দুঃখবতী মা
…..তসলিমা নাসরিন


মা'র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,
যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও
ঘুমটি ঘরের বারান্দায়, কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ইতলায়।
সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে
দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়তো বুড়িছোঁয়া খেলা।
.
দুঃখরা মা'কে ছেড়ে কলতলা অব্দি যায়নি কোনওদিন।
যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা;
কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে-ভালুকে খাবে, দুষ্ট জিনেরা গাছের মগডালে
বসিয়ে রাখবে মা'কে-
দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলত...
কে জানে কী সব কথা
.
মা'কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত।
দুঃখগুলোকে পিঁড়ি দিত বসতে,
লেবুর শরবত দিত, বাটায় পান দিত,
দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত...
ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে
বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে অজুর পানি চাইত,
জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মধ্যিখানে।
দুঃখগুলো মা'র কাছ থেকে একসুতো সরেনি কোনওদিন।
.
ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর
তেলাপোকার সঙ্গে তেলোপোকা আর
নেপথলিনের সঙ্গে ওদের পুরে রাখি।
ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে না,
ভাসিয়ে দেব একদিন
কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা
চলে যাবে কুচবিহারের দিকে...
ইচ্ছে ছিল
.
দুঃখগুলো মা'র সঙ্গে শেষ অব্দি কবর অব্দি গেছে,
তুলে নিয়ে কোথাও পুঁতে রাখব অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার মতো ছুড়ব
রেললাইনে, বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে। হল কই?
মা ঘুমিয়ে আছেন, মা'র শিথানের কাছে মা'র দুঃখগুলো আছে,
নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।




মা ভাগ হয় না
বেণু দত্তরায় 
 
পাসপোর্ট ও ভিসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি
আমার চোখে কোনো জল নেই
মাটি ভাগ হয় মা ভাগ হয় না
এ সত্য জেনেছি
আমার জন্মদায়িনী মা
সুখ-দুঃখের শেতলপাটিতে বসে থাকে
খালে-বিলে ফুটে থাকে শাপলা-শালুক
মৌটুসি পাখির ঝাঁক আকাশে ওড়ে
ছাতিমতলার পুকুরে বৌডুবির খালে
আমাদের কথা-কিংবদন্তি জড়িয়ে থাকে
অবিনাশী জ্যোৎস্না
শ্মশানের মাটিতেও কুসুম-কুসুম গন্ধ
দাওয়া থেকে তাকিয়ে দেখি
আকাশে উঠেছে ইন্দ্রধনু
আমাদের সখের ডিঙায়
দৌলত কাজী ও আলাওলেরা গান গায়
কৃত্তিবাস ও কাশীরামের ভিটে ছাড়িয়ে
উজান বয় নৌকো
আমাদের মধুমালতীর গাথা পীরের গান...
মহুয়া-মলুয়া-কাজলরেখারা
হাত ধরাধরি করে উঠে দাঁড়িয়েছে...
মৃতের পিদিম জ্বলে রাত্রি হলে
আমাদের দাদিমার চোখ...
ঠাকুমার মকরমুখী-বালা
আমার মায়ের দু'হাত জড়িয়ে
চন্দ্রসূর্য
কতবার ঝড় এল
ঘর ভাঙল এখানে
বর্ষার হানায় মৃত্যুর উজানে
বন্যায় খরায়
কতবার বর্গী এল বর্গী এল দেশে
ধান ফুরাল পান ফুরাল খাজনা দেব কী
মায়ের মুখের হাসি তবু পুরবো হয় না
খেজুর গাছের সারি ছাড়িয়ে
চলেছে গরুর গাড়ি...
ঈশ্বরীর মতো নদীরা... গাছপালা...
গাঁ-গঞ্জ উঠোন-ঘরবাড়ি...
মহরমের তাজিয়ায় পদ্মাপুরাণ গানের বাজনায়
দুর্গাপ্রতিমার মতো হাসি মা-র মুখে
পাসপোর্ট ও ভিসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি
কাঁটাতারের বেড়া ছাড়িয়ে
আমার চোখে কোনো জল নেই
মাটি ভাগ হয় - মা ভাগ হয় না।













Friday, February 21, 2020

দেশ ও স্বাধীনতা

জন্মভূমি 
- গোবিন্দচন্দ্র দাস

জননী গো জন্মভূমি তোমারি পবন
দিতেছে জীবন মোরে নিশ্বাসে নিশ্বাসে!
সুন্দর শশাঙ্কমুখ, উজ্জ্বল তপন,
হেরেছি প্রথমে আমি তোমারি আকাশে।
ত্যাজিয়ে মায়ের কোল, তোমারি কোলেতে
শিখিয়াছি ধূলি‐খেলা, তোমারি ধূলিতে।

তোমারি শ্যামল ক্ষেত্র অন্ন করি দান
শৈশবের দেহ মোর করেছে বর্ধিত।
তোমারি তড়াগ মোর রাখিয়াছে প্রাণ,
দিয়ে বারি, জননীর স্তন্যের সহিত।
জননীর করাঙ্গুলি করিয়া ধারণ,
শিখেছি তোমারি বক্ষে বাড়াতে চরণ। 

তোমারি তরুর তলে কুড়ায়েছি ফল,
তোমারি লতার ফুলে গাঁথিয়াছি মালা।
সঙ্গীদের সঙ্গে সুখে করি কোলাহল,
তোমারি প্রান্তরে আসি করিয়াছি খেলা।
তোমারি মাটিতে ধরি জনকের কর,
শিখেছি লিখিতে আমি প্রথম অক্ষর।

ত্যাজিয়া তোমার কোল যৌবনে এখন,
হেরিলাম কত দেশ কত সৌধমালা।
কিন্তু তৃপ্ত না হইল এ দগ্ধ নয়ন,
ফিরিয়া দেখিতে চাহে তব পর্ণশালা।
তোমার প্রান্তর নদী, পথ, সরোবর,
অন্তরে উদিয়া মোর জুড়ায় অন্তর।

তোমাতে আমার পিতা পিতামহগণ,
জন্মেছিল একদিন আমারই মতন।
তোমারি এ বায়ু তাপে তাঁহাদের দেহ
পুষেছিলে, পুষিতেছ আমায় যেমন।
জন্মভূমি জননী আমার যথা তুমি,
তাঁহাদেরও সেইরূপ তুমি—মাতৃভূমি। 

তোমারি ক্রোড়েতে মোর পিতামহগণ
নিদ্রিত আছেন সুখে জীবলীলা‐শেষে
তাঁদের শোণিত, অস্থি সকলি এখন
তোমার দেহের সঙ্গে গিয়েছে মা মিশে। 
তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার
তোমার ধূলিতে কালে মিশাবে আবার।

আমার সোনার বাংলা 
- মহাদেব সাহা

আমি যে দেশকে দেখি সে কি এই স্বপ্নভূমি থেকে জেগে ওঠা
বহুদূরব্যাপী কল্লোলিত, সে কি রূপসনাতন
সে কি আমার সোনার বাংলা, কোনো রূপকথা নয়!
তার চক্ষুদ্বয় তবে এমন কোটরাগত কেন, মুখ জুড়ে সূর্যাস্তের
কালোছায়া,
কেন তার সবুজ গাছের দিকে সহসা তাকালে দেখি
ধূসর পিঙ্গল বর্ণ, নেমেছে তুষার আর মাছে সারি সারি
কুয়াশার তাঁবু
লোকশ্রুত এই কি সোনার বাংলা শোনা যায় শুধু শোকগাথা!
কেউ কেউ দেশের বদলে তাই মানচিত্র দেখায় কেবল
বলে, এখানে গোলাপ চাষ হয়, এখানে অধিক খাদ্য ফলে
গান শোনে টেপরেকর্ডার বাংলার চিরন্তন মুগ্ধ ভাটিয়ালি
আর বারোমাস পাখির কূজন
তারও কিছু সামান্য নমুনা এই পেটে
যেন মেপে মেপে দেশের মডেল একখানি
অপরূপ কাসকেটে তুলে রাখা আছে!
মৃদু টেপে এখানে পাখিরও গান শোনা যায়, ম্যাপের রেখায় মূত্য
স্নিগ্ধ নদী, শেস্যক্ষেত, সবুজলালিত ঘন পার্ক
সুচারু ফোয়ারা থেকে ঝরে জল পান করে পাথরের
পীতাভ হরিণ
চেয়ে আছে স্বপ্নময় বাংলাদেশ ট্যুরিস্টের মনোরম ম্যাপের পাতায়।
আমি যে দেশকে দেখি সে যে এই স্বপ্নভূমি থেকে উঠে আসা
আপাদমস্তক ভিন্নভিন্ন
সে যে আজো জয়নুলের দূর্ভিক্ষের ছিন্নভিন্ন
সে যে আজো জয়নুলের দুর্ভিক্ষের কাক
আজো বায়ান্নর বিক্ষুব্ধ মিছিল
আজো আলুথালু, আজো দুঃখী,
আজো ক্ষুন্ন পদাবলী!
তার কনকচাঁপার সব ঝাড় কেটে আজ সেখানেই বারুদ
শুকানো হয় রোদে
আর চন্দ্রমল্লিকার বনে আততায়ীদের কী জমাট আড্ডা বসে গেছে,
নিষ্পত্র নিথর লেকালয় দুঃখ-অধ্যুষিত
সেই পিকাসোর বেয়াড়া ষাঁড়টি যেন তছনছ করে এই নিকানো
উঠোন ঘরবাড়ি
লোকশ্রুত এই কি সোনার বাংলা, এই কি সোনার বাংলা!






স্বাধীনতার বাঁশিওয়ালা- ১
মুহম্মদ জাইদুল ইসলাম 


৭ই মার্চ ১৯৭১,
বিক্ষুব্ধ জনতার ঢাকামুখী স্রোতে উন্মাতাল
বাংলার পথ ঘাট সবুজ প্রান্তর।
নিপীড়িত জনতার ঢল নেমেছে রেসকোর্স ময়দানে।
জনতার রায়ে সিংহাসনের মালিক হয়েও
কতকাল বাঙালি থাকবে সিংহাসনচ্যুত, মুকুটহীন, ভিখারির মত?
কতকাল বাঙ্গালী থাকবে স্বাধীন দেশে পরাধীন প্রজা সেজে?
কতকাল পাক জান্তার বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে
বাঙ্গালি মরবে তিলে তিলে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে?
আর কতকাল?
বাংলার আকাশ বাতাস আজ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে।
সাগরের ক্রোধমত্ত ঊর্মিমালা ফুলে ফেঁপে তেড়ে আসছে।
পাখিদের সুমিষ্ট কণ্ঠধ্বনি গলা ছেড়ে গান 

গাওয়ার অধিকার আদায়ের বজ্র নিনাদে ফেটে পড়ছে।
বাংলার শিক্ষক, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, কুলি, মজুর, মেথর, চাকুরে-
সবাই অধিকার আদায়ে জেগে উঠেছে।
সবাই আজ এক স্বার্থে, এক দাবিতে-
প্রাণের সাথে প্রাণ মিশিয়ে, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে 

স্বাধীনতার প্রিয় মঞ্চে সমবেত হয়েছে।
আহা! ফাল্গুনের প্রচণ্ড তাপদাহে ঘামে ভিজে নদী হওয়া বুকগুলো,
শত মাইল পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়া জবুথবু পা গুলো,
আর্তনাদে ভরা গগণ বিদারি চিৎকারে শুকিয়ে কাঠ হওয়া গলাগুলো;
সব আড়ষ্টতা ঠেলে অপেক্ষায় উন্মুখ-
ঐ বুঝি এলো স্বাধীনতার বাঁশিওয়ালা!
দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বঞ্চিত সত্তাগুলো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে
"বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধরো; বাংলাদেশ স্বাধীন করো"
"পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তোমার আমার ঠিকানা"
"জয় বাংলা" "জয় বাংলা" ধ্বনিতে
কাঁপিয়ে দিচ্ছে সমগ্র রেসকোর্স ময়দান;
কেঁপে উঠছে সারা বিশ্ব।
পথে পথে গণমানুষের ভালবাসার স্পর্শ গায়ে মেখে
মুক্তিকামী জনতার মুক্তির বার্তা নিয়ে
স্বাধীনতার মঞ্চে এলেন স্বাধীনতার বাঁশিওয়ালা।
সম্মোহনী বাঁশির বিপ্লবী সুরে মাত্র আঠারো মিনিটে সাত কোটি 

বাঙ্গালির অন্তঃপ্রকোষ্ঠে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র 
এঁকে দিলেন নিপুণ দক্ষতায়।
বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,
"প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো;
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে
শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।"
"রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো;
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।"
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম;
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
অতঃপর;
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধে
দুই লক্ষ নিষ্পাপ ফুল পাকি জানোয়ারের লালসার শিকার হয়েছে।
বাংলার চির সবুজ প্রান্তর ৩০ লক্ষ শহীদের
টকটকে লাল রক্তে ভেসেছে।
আমরা পেয়েছি লাল সবুজের প্রিয় নিশান
আমরা পেয়েছি চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার অমৃত স্বাদ।







স্বাধীনতার মানে -
 ভবানীপ্রসাদ মজুমদার 


যে ছেলেটা বস্তা কাঁধে কাগজ কুড়োয় পাড়ায় পাড়ায়
যে ছেলেটা রোজ বাজারে মুরগি কাটে , পালক ছাড়ায়,
যে ছেলেটা রেস্তোরাঁতে ধুচ্ছে থালা-গেলাস-বাটি
যে ছেলেরা সারাজীবন খায় লাথি-কিল-চড় ও চাঁটি !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো, ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" কাকে বলে , স্বাধীনতার সঠিক মানে ?
যে মেয়েটা ভোর না হতেই মায়ের সাথে যাচ্ছে কাজে
যে মেয়েটা পরের বাড়ি কাপড় কাচে , বাসন মাজে,
যে মেয়েটা গোবর কুড়োয় , ঘুঁটেও দেয় , কয়লা বাছে
যে মেয়েরা পায়না আদর সারাজীবন কারোই কাছে !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো , ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" দেখতে কেমন ? স্বাধীনতার সঠিক মানে?
যে ছেলেরা রাস্তা ঘাটে করছে পালিশ পরের জুতো
যে ছেলেরা ট্রেনের হকার , খাচ্ছে রোজই লোকের গুঁতো ,
লজেন্স খাওয়ার বয়স যাদের , করছে তারাই লজেন্স ফেরি
যাদের বুকে সূর্য ওঠার , গোলাপ ফোটার অনেক দেরি !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো , ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" জিনিসটা কি ? স্বাধীনতার সঠিক মানে?
স্বাধীনতার মানে বোঝে নীল আকাশের বন্ধু পাখি
স্বাধীনতার মানে বুঝেই চাঁদ তারাদের পরায় রাখি,
স্বাধীনতার মানে বোঝে পাহাড়-সাগর-ঝর্না-নদী
স্বাধীনতার মানে বুঝেই বইছে বাতাস নিরবধি ।
স্বাধীনতার সঠিক মানে কজন স্বজন সত্যি জানে
স্বাধীনতার সংজ্ঞা খুঁজো শেকল ছেঁড়া পাখির গানে !





তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা 

শামসুর রাহমান


তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে  ব’লে হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে,হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে,হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে,ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে  ব’লে,বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে,হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা,তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা,তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন -তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক,বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা,তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়রি এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে
নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা,তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী,শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস,জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া,মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে
রুস্তম শেখ,ঢাকার রিকশাওয়ালা,যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম  হ’তে চলেছে —
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে,হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উডিয়ে,দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে,হে স্বাধীনতা।




স্বাধীনতা তুমি 

– শামসুর রাহমান


স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।





চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
রফিক আজাদ



স্পর্শকাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,-
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি?
প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না ক’রে ওঠে?
– চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে।
বৃক্ষদের সাহচার্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব সুখে আছে।
চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের
কারু-কারু মনে,
কেউ-কেউ এখনো তো পোষে
বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া।
চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ জানে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু-
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়- শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে।
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না।
রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।
চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক্।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ’রে তোলা হোক।
চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।
চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করে:
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।




রিপোর্ট ১৯৭১
- আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটেরক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে



আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-  
আবু জাফর বিঃ
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি একাত্তর,সাড়ে সাতকোটি মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলন,
শুনেছি রেসকোর্সে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণ।
দেখেছি রাজাকার পাঞ্জাবী মিলে, করেছে কতনা অবিচার,
অসহায় লাখো মা-বোনেরা সেদিন হয়েছে নির্যাতনের শিকার।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি সারা দেশে জুলুম নিপিড়ন নির্যাতন আর হাহাকার,
শতশত বীরাঙ্গনা নারীর আকাশ কাঁপানো আত্মচিৎকার।
দেখেছি স্বামী-সন্তান হারা বাংলা মায়ের কত যে আর্তনাদ,
মুক্তিযুদ্ধে কত শহীদ পরিবারের জীবন হয়ে গেছে বরবাদ।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি গ্রামের কত বাড়ী-ঘর আগুন জ্বলছে দাউ-দাউ করে,
গৃহহারা মানুষ শরণার্থী হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ওপারে।
দেখেছি আষাঢ় শ্রাবণ মাস, তুমুল বৃষ্টি আর হাটুসমান কাদা,
হেটে চলেছে দলবেধে সবে, যেতে পারিনি কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি মটার, সেল, গ্রেনেড, রাইফেল আরো কত আগ্নেঅস্ত্র,
যুদ্ধের বিমান, ট্রাঙ্ক, কামান, পাক হানাদার বাহিনী সশস্ত্র।
মুক্তিবাহিনীর মাথায় টোকা, কৃষানের কাজ করছে অস্ত্র সেরে,
হায়েনা পাঞ্জাবী সারিসারি গ্রামে ঢুকতেই দিচ্ছে ধ্বংস করে।

আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি অমাবস্যা রাতে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আলোক উজ্জ্বল আকাশ,
ঠাশ-ঠুশ ডেডা-ডেডা শব্দ আর বারুদের গন্ধে ভরা বাতাস।
দেখেছি বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মনে ছিল কত স্বপ্ন আঁকা,
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা, সবুজের মাঝে লাল পতাকা।
------------------








স্মৃতিস্তম্ভ
- আলাউদ্দিন আল আজাদ
 
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
          চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো ! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
          পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে
          যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।
           ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক ! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
           চারকোটি পরিবার ।
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার ? কেবল সেতার
হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার
পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল ?
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক । একটি মিনার গড়েছি আমরা
           চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।
           পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
            শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।
            তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
            শপথের ভাস্কর ।





স্বাধীনতা

জাহিদুল ইসলাম  (শ্যামলী ,ঢাকা।)

স্বাধীনতা আমার
পিতাহীন জননীর সন্তান!
স্বাধীনতা আমার
কিশোরী বোনের ধর্ষিত মুখ!
স্বাধীনতা আমার
বিধবা মায়ের চোখের জল!
স্বাধীনতা আমার
পঙ্গু  বাবার হুইল চেয়ার।
স্বাধীনতা তুমি
বিকেলের আকাশে ধবল বক,
স্বাধীনতা তুমি
নিশ্চিন্তে উড়া সোনালি-ডানা চিল।
স্বাধীনতা তুমি
কোকিলের কণ্ঠে মিষ্টি সুর,
স্বাধীনতা তুমি
ভোরের আকাশে সোনাঝড়া রোদ্দুর।
স্বাধীনতা তুমি
বিদ্রোহী কবি নজরুলের চির উন্নত-মম-শীর,
স্বাধীনতা তুমি
জাদুঘরে ঝুলে থাকা রক্তমাখা আসাদের শার্ট!
স্বাধীনতা আমার
বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলার অধিকার,
স্বাধীনতা আমার
কোটি বাঙালী’র জেগে উঠার উদ্যম গতি।
স্বাধীনতা তুমি
২১শে ফেব্রুয়ারি’র প্রভাত ফেরির গান,
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে ফুলের সমাহার।
স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের ভালবাসার সোনার বাংলা,
স্বাধীনতা তুমি
জীবনানন্দ’র ধানসিড়ির তীরে ফিরে আসার আর্তনাদ।
স্বাধীনতা তুমি
কিশোরির হাতে বর্ষাবরণ কদম ফুল,
স্বাধীনতা তুমি
গ্রীষ্মের দুপুরে জ্বলে উঠা কৃষ্ণচূড়া’র আগুন।
স্বাধীনতা আমার
সবুজ ঘাসের চাদরে রক্তমাখা পতাকা,
স্বাধীনতা আমার
কোটি বাঙালীর হৃদয় জুড়ানো ভালবাসা।
স্বাধীনতা তুমি
কাঁশফুলের শুভ্র ঝড়,
স্বাধীনতা তুমি
আমার হৃদয়ে চির অমর।



এই পতাকার সূর্য সাক্ষী

 / আল মাহমুদ

দ্যাখো আজ পতাকা দেখারই দিন।
কলরব করে ওঠো, উচ্চারণ কর
মুক্তির ভাষা। আমিও তোমাদের সাথে দেখতে থাকি।

 

তোমাদের সাথে আমার অপরিচ্ছন্ন দৃষ্টির অশ্রুসজল
চোখ দু’টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকি। কী লাল, সবুজ
পতাকার মধ্যে গোল হয়ে বসে আছে,
মনে হয় যেন পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের
রক্তের লোহিত কণায় অঙ্কিত হয়েছে এ সূর্য।

আমার ভেতরে কলরব করে ওঠে কত মুখ
কত আকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টি। যারা আর
ফিরে আসেনি।
একজনের কথা মনে পড়ছে। মনতলা স্টেশনের
পাশ দিয়ে বামটিয়া বাজারের দিকে চলে গেছে যে পথ
সেখানে ছিল তার ক্যাম্প। ট্রেনিং নিতে গিয়ে
তার কুনুই থেকে রক্ত ঝরে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল।
ফেরেনি সে। তার মাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা বা শব্দ
বাংলা ভাষার অবিধানে ছিল না। কিন্তু তার মার
সামনে দাঁড়িয়ে আমি যে ইংগিতে কথা বলেছিলাম
তাতে মহিলা শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে
ওই গোল সূর্যের মধ্যে তার পূত্রকে দেখেছিল,
অশ্রুসজল চোখে।

আরো একজনকে জানতাম- সে কুমিল্লা থেকে
বেরিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের দিকে। গুলিটা লেগেছিল
তার কোমরে। আগরতলা হাসপাতালে আমি তাকে
দেখতে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বিষাক্ত শিশার টুকরো
নিখুঁতভাবে বের করতে পারলেও সে আর হাঁটতে পারেনি।
তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম
মুক্তির উৎসবে। ওই পতাকার লাল অংশে তার খানিকটা
রক্ত আছে। আমি সব সময় দেখি আর তার কথা ভাবি।
কী অবলীলায় তার নাম বাদ দিয়ে লেখা হয়ে যায়
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস! সে ছিল কুমিল্লার একটি
হিন্দু পরিবারের মেয়ে। তার পিতার উপজীব্য ছিল
সংগীত। আমি সাক্ষ্য দেই যে, পতাকার ঐ লাল অংশে
তার রক্তের লোহিত কণিকা মিশ্রিত আছে।
হে ইতিহাস, লেখো তার নাম।

 কুষ্টিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছেলেটি।
কুষ্টিয়ার কাস্টম কলোনির পাশে, সে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল শত্রুদের জিপকে উড়িয়ে দিতে।
খন্ড খন্ড হয়ে উড়ে গিয়েছিল তার বাহু, উরু ও
পিঠের কিছু অংশ। হাসিবুল ইসলাম
আল্লাহু আকবার বলে সে আক্রমণ করেছিল।
তার বুক থেকে কলজে উড়ে গিয়ে ওই
পতাকায় লেগে আছে।
লেখো তার শেষ উচ্চারণ আল্লাহু আকবার।

কলরবমুখর হে ঢাকা মহানগরী
তোমাকে লিখতে হবে ওই রক্ত গোলকে
আসাধারণ বিবরণ। দেখতে হবে ইতিহাস নির্মাণ
করে কারা? আর কারা কেড়ে নেয় বীরত্বের পদকচিহ্ন!

দ্যাখো আজ পতাকা দেখারই দিন
কলরব করে ওঠো, উচ্চারণ কর-
মুক্তির ভাষা। আমিও তোমাদের সাথে দেখতে থাকি।

 

 কমলের চোখ
---আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।

.
কমলকে চেন তুমি !
সুন্দর সুঠাম দেহ, প্রদীপ্ত চোখ
দুপুর রোদের মতো তীব্র প্রখর।
একটা বুলেট
কমলের ডান চোখ
ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।

কমল আমার বন্ধু, বিদগ্ধ সচেতন
হৃৎপিণ্ড যার
কুকুর শেয়াল খেয়ে আজ পলাতক।
আরো বহু, আমার তোমার
বন্ধু কি প্রিয়জন
ধমনী যাদের ছিলো কৃষ্ণচুড়ার মতো
তাজা সোচ্চার,
রক্তের কোলাহলে স্তব্ধ এখন।

কমলের চোখ, রক্ত হৃৎপিণ্ড
ওরা কেন দিলো?
যে প্রশ্ন করিনি তো।

সম্প্রতি মাতা তার
ছোট শিশু বেচেছে, কেননা
চাল প্রয়োজন। তুলসীর ঘাটে
নগণ্য প্রাণ এক শাশুড়ি আত্মঘাতি।
কারণ সুবর্ণ গ্রাম গিয়েছ কি?
তবে একবার ঘুরে দেখে আস।
চেয়ে দেখ উঠোনে দাওয়ায়, কিংবা
পুকুর ঘাটে, রমণীর নগ্ন শরীর
জ্যোৎস্নায় প্লাবিত
অন্ধকারে তার আশ্রয়, নতুবা
গলায় ফাঁসি।

কমলের চোখ, রক্ত হৃৎপিণ্ড
ওরা কেন দিলো?
সে প্রশ্ন তোমার নিকট।

 

 

যদি রাজদণ্ড দাও
-অসীম সাহা
 
যদি রাজদণ্ড দাও---আমি মাথা পেতে নেবো।
ক্ষমার অযোগ্য যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে,
আর সেই ভুলের জন্যে যদি বদলে যায় ভৌগোলিক সীমা,
যদি আত্মজের নিক্ষিপ্ত তীর শূন্যতায় উড়ে গিয়ে
শক্তিশেল হয়ে বেঁধে তোমার শরীরে---
তুমি তবে কোন্ দণ্ড দেবে ?
যদি রাজদণ্ড দাও---আমি মাথা পেতে নেবো।
পিতা, একদিন তুমি ছিলে স্বপ্নের ভেতরে,
তোমার স্বপ্নের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম
আমার অখণ্ড নীলাকাশ;
কিন্তু তুমি তো জানো পিতা, স্বচ্ছ সুন্দর সেই নীলাকাশকে
ঢেকে দেয় যে-শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ
আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকা যে-বজ্রের হুংকার
উদ্ধত আক্রোশে গর্জে উঠে পৃথিবীকে ভস্মীভূত করে,
আমি সেই গর্জনের অগ্নি থেকে জেগে ওঠা বিভ্রান্ত বালক
কিছুতেই বুঝতে পারিনি
আমি তোমাকে আঘাত করে
আমারই অস্তিত্বের মূলে আঘাত করেছি।
তার জন্যে আমাকে এখন যে শাস্তি দেবে দাও---
আমি মাথা পেতে নেবো।
যদি রাজদণ্ড দাও---যদি নির্বাসন দিয়ে দাও
আফ্রিকার দুর্গম গহন অরণ্যে
আমি মেনে নেবো, এ-আমার আত্মঘাতী বিনাশের যোগ্য পুরস্কার।
পিতা, যদি জানতাম, আমারই ভুলের জন্যে
এতো রক্ত, এতো ক্লেদ জমা হবে পিতৃভূমিতে,
যদি জানতাম, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে তোমারই বুকের রক্তে
রঞ্জিত হয়ে যাবে মানচিত্র আমার,
যদি জানতাম, মধ্যরাতে তোমারই ছায়ারা এসে
তোমাকেই বধ করবে নির্মম দু’হাতে;
যদি জানতাম, তোমার নিথর দেহ রক্তাপ্লুত পড়ে থাকবে
উপবাসী সিঁড়ির ওপরে;
যদি জানতাম, তোমার বক্ষ থেকে সিঁড়ি বেয়ে
নেমে যাবে সাত কোটি রক্তের ধারা---
তা হলে এই হাতের প্রতিটি আঙুল দিয়ে
আমি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতাম আমার উদ্ভ্রান্ত আত্মাকে,
আমি আমার চোখে বিঁধিয়ে দিতাম
অভ্রভেদী শিমুলের কাঁটা।
আমার বক্ষবিদীর্ণ আর্তচিৎকারে যদি তোমার ঘুম ভাঙতো
তুমি দেখতে পেতে, করজোড়ে তোমারই পায়ের কাছে
পড়ে আছে নতজানু তোমার সন্তান।
তুমি কী করে তাকে ক্ষমাহীন দুই হাতে ফেরাতে তখনি?
আমি জানি, পাহাড়ের অন্তরালে বয়ে যাওয়া
স্বচ্ছতরে ঝর্নাধারার মতো
তোমার হৃদয় ছিলো শান্ত স্নিগ্ধ নদী,
তোমার হৃদয় ছিলো বাউলের একতারা, ক্লান্ত ভাটিয়ালী।
পিতা, তুমি কি জানতে, তোমার হৃদয় থেকে উৎসারিত
এই জল একদিন সবকিছু ভুলে গিয়ে
তোমাকেই উগড়ে দেবে বঙ্গোপসাগরে?
তুমিহীন এই মাটি আর্তনাদ করে উঠবে
মধুমতী নদীটির তীরে?
যদি জানতে, যদি তুমি জানতে
পিতৃত্বের এই দায় তোমাকেই একদিন রক্তমূল্যে শোধ দিতে হবে;
তখনো কি তুমি এই স্বদেশের মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠে
পরাধীন মানুষের মুক্তিমন্ত্র হতে?
পিতা, এইখানে তুমি আজ নেই---তোমার ছায়ারা পড়ে আছে।
খুব ভোরে আকাশ বিদীর্ণ করে যে-রক্তিম সূর্য ওঠে পুবের আকাশে
সবুজ প্রকৃতির মধ্যে তার গাঢ় রং মিশে গিয়ে
যে-আশ্চর্য আভা ছড়িয়ে যায় দিগন্তে-দিগন্তে,
তার মধ্যে তোমাকে আমি দেখতে পাই।
আমার প্রতিমুহূর্তের নিশ্বাসের মধ্যে
তুমি চিরকালের বাতাস হয়ে ঢুকে যাও।
আমার সবটুকু অস্তিত্বের মধ্যে তোমার মৃত্যুহীন উপস্থিতি
আমাকেই তুমি করে তোলে;
তার মানে তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্বই নেই।
তবু তোমার উপস্থিতিহীন অস্তিত্বের ভয়ে শংকিত
একদল শিকারি তোমার ছায়ার ওপরে অন্ধকারে প্রলেপ
লাগিয়ে দিতে চায়;
একদিন তুমি যাদেরকে হৃদয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়েছিলে,
তারাই তোমার অস্তিত্বের অহংকারের ওপরে
লেপ্টে দিতে চায় পঁচিশের কালো অন্ধকার
তুমিহীন তোমার অস্তিত্ব এসে ভর করে বঙ্গভূমিতে!
মানুষই তো ভুল করে পিতা
আমার এই দেহখানি সে-ভুলেরই দাস।
যদি পারো ক্ষমা কোরো অধম সন্তানে।
আর যারা তোমারই রক্তের দামে কেনা এই স্বদেশের
মাটিকেই বদলে দিতে চায়,
লাল ও সবুজের মানচিত্রে আঁকতে চায় কলংকতিলক;
তোমার ক্ষমার হাত একদিন যদি ঐ জলে-স্থলে অন্তরিক্ষে
ছুটে চলে যায়
সেই দিন আমাকেও নির্বাসন দিও---
এ-পৃথিবী পার করে ফেলে দিও অন্য কোনো গহন অরণ্যে।
যদি রাজদণ্ড দাও---যদি ফাঁসিকাষ্ঠে স্তব্ধ হয় এ-দেহ আমার
সব আমি মাথা পেতে নেবো;
শুধু আমি কিছুতেই মানবো না
আমার বুকের ’পরে চেপে থাকা আগস্টের সম্মিলিত ঘাতক আঁধার।



মাতৃভূমির জন্য- -সৃজন সেন
 
আমার বয়স তখন কতোই বা !
চার কিংবা পাঁচ।
অথচ আমার স্মৃতিকে আজও অন্ধকার করে দেয়
সেই সময়ের এক রাশ কালো ধোঁয়া
কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে যে ধোঁয়া-
আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল,
আমাদের বাড়ির শেষপ্রান্তে
বুড়ো বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে
সবাই ভিড় করে সেই ধোঁয়া দেখছিল,
আমিও মায়ের কোলে চড়ে সেই ধোঁয়া দেখছিলাম,
সবাই আতঙ্কে ‘রায়ট লাগছে, রায়ট লাগছে’ বলে
ছোটাছুটি করছিল
এবং তার কদিন পরেই
সদ্য-বিবাহিত দাদা-বৌদির সঙ্গে
আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমার মাকে, আমার বাবাকে
আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমাদের সেই বুড়ো বটগাছ,
টিনের চালাওয়ালা গোবরলেপা বেড়ার ঘর,
বাড়ির পেছনের পুকুর,
পুকুরপাড়ের নোনা গাছ
এবং আমার প্রিয় কাজলা দিদিকে,
ছেড়ে এসেছিলাম আমার মাতৃভূমিকে,
আমার জন্মভূমিকে।
আর সেদিনের পর থেকে
একদিনের জন্যও আমি আর ওই জন্মভূমিতে
ফিরে যেতে পারিনি,
একবারের জন্যও না।
এখন আমার স্মৃতিতে সব কিছু ঝাপসা-
সেই ঘর, সেই গাছ, সেই কাজলাদিদি,
… সব, সব !
চাঁদপুর থেকে স্টিমারে,
স্টিমারে করে গোয়ালন্দ,
গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন,
দর্শনায় আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা ওলোট-পালট
এবং অবশেষে, এক সন্ধেবেলা শিয়ালদা স্টেশনে।
তারপর ঘোড়ার গাড়ি,
ঘোড়ার গাড়ি চেপে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট,
প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের সাড়ে তিন হাত চওড়া এক অন্ধ গলি
সেই অন্ধগলির এগারোর বি নম্বর বাড়িতে একটি ঘর
সেই ঘরের দাদাবৌদির সঙ্গে খাঁচায় বন্দি আমি।
আমি, যার মুখে তখনও নোয়াখাইল্যা ভাষার টান,
আমি, যাকে দেখলেই প্রাইমারি স্কুলের ছেলেরা
কানের উপর উপুড় হয়ে চিৎকার করে বলত-
‘বাঙালো রস খাইল ভাঁড় ভাঙিল,
পয়সা দিল… ও… না…’
সেই আমি চারদিকের ওই টিটকারির ভয়ে নিজের
বাঙালপনাকে গোপন করার জন্য
প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে
ধীরে ধীরে যখন অন্য মানুষ হয়ে উঠছিলাম
ঠিক তখনই আমার জন্মভূমি থেকে
বাবার একখানা চিঠি এসেছিল,
সবাই সে চিঠি নিয়ে
জোরে জোরে আলোচনা করছিল
এবং আমি শুনেছিলাম-
ঢাকায় নাকি গুলি চলেছে, গুলি !
বহু বছর পরে জেনেছিলাম
সেই গুলি চলেছিল তাদের ওপর
যারা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে
ওপার বাংলায় লড়াই শুরু করেছিল,
শুনেছিলাম-
তারা নাকি পুলিশের বন্দুকের সামনে
জামার বোতাম খুলে
চিৎকার করে গাইছিল-
“ওরা আমার মুখের কথা কাইড়্যা নিতে চায়”,
আর সেই ‘মুখের কথা’র গৌরব রক্ষা করতেই
তারা নাকি পুষ্পাঞ্জলির মতই
তাদের প্রাণকে সমর্পণ করেছিল।
আর এপার বাংলায় আমি
আমার সমস্ত বাঙালপনাকে ঝেড়ে ফেলে তখন
ধীরে ধীরে হয়ে উঠছি
কেতাদুরস্ত অন্য এক মানুষ,
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে
একটার পর একটা ক্লাস টপকে
আমি রণপায়ে এগিয়ে চলেছি,
ইংরাজিতে কথা বলায়, চালচলনে, আদব কায়দায়
আমি তখন সবাইকে মুগ্ধ করতে পারি,
রাম ব্যানার্জি লেনের বাড়ি ছেড়ে
আমরা উঠে এসেছি কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায়,
কেউ আর আমায়
‘বাঙাল’ বলতে সাহস পায় না,
বরং একটু সমীহ করেই চলে,
আমার দাদা-বৌদি
আমাকে নিয়ে গর্ব করে,
আমাদের ভূতপূর্ব বাঙাল জীবনকে
আমরা তখন রীতিমতো ঘৃণা করতে শিখে গেছি।
তারপর থেকে আমার জীবনে শুধুই চড়াই …
আমি এখন এক সাহেবি কোম্পানির
নামি অফিসার,
যে কোম্পানির অভিভাবক
এক নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানি,
সেই কোম্পানির স্বার্থে
আমি এখন দেশে-বিদেশে উড়ে বেড়াই,
অধিকতর বিদেশী ব্যবসা,
অধিকতর বিদেশী চুক্তি,
অধিকতর বিদেশী পরামর্শ, কমিশন ইত্যাদি
অর্জনের মধ্য দিয়েই
আমার আজকের বিকাশ, আমার প্রতিপত্তি।
আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে ‘ড্যাডি’ বলে ডাকে
মাকে ‘মাম্মি’,
আমার মত ওরাও এখন শুদ্ধ করে
বাংলায় বথা বলতে পারে না,
শুদ্ধ করে লিখতে পারে না
মাতৃভাষায় কয়েকটা লাইন,
আমার ছেলেমেয়েদের কাছে
বাংলা ভাষা একান্তই বিদেশী !
সেবার লন্ডনে
এক জাপানি শিল্পপতিকে
বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে
তার মাতৃভাষা জাপানিতে
অন্যদের সঙ্গে যখন অনর্গল কথা বলতে দেখেছিলাম
তখন আমার বুকের ভেতরে
কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছিল,
ইংরাজিতে কথা বলতে না পারার জন্য
ওই মানুষটির ভেতরে কোনও লজ্জা ছিল না,
বরং মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার অহমিকায়
মানুষটিকে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখেছিলাম,
আমার ভেতরে সেই অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা
একটা কান্না হয়ে গুমরে গুমরে উঠছিল,
আমার মনে হচ্ছিল-
আমার কোনও মাতৃভূমি নেই,
আমার কোনও মাতৃভাষা নেই,
আমি যেন এক শিকড়বিহীন চিরবিদেশী !
তাই-
মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দেয়
তারা কেমন মানুষ
আজ আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে,
আমার বুকের মধ্যে
সেই বাংলাদেশের জন্য
সেই বাংলা ভাষার জন্য
একটুখানি বাঙালী হয়ে ওঠার জন্য
একটা ভয়ংকর যন্ত্রণা টনটন করে ওঠে !



আমি কি বলতে পেরেছিলাম - মহাদেব সাহা
 
আমার টেবিলের সামনে দেয়ালে শেখ মুজিবের
একটি ছবি টাঙানো আছে
কোন তেলরঙ কিংবা বিখ্যাত স্কেচ জাতীয় কিছু নয়
এই সাধারণ ছবিখানা ১৭ মার্চ- এ বছর শেখ মুজিবের
জন্ম দিনে একজন মুজিব প্রেমিক আমাকে উপহার দিয়েছিলো
কিন্তু কে জানতো এই ছবিখানা হঠাৎ দেয়াল ব্যপে
একগুচ্ছ পত্র পুষ্পের মতো আমাদের ঘরময়
প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে রাত্রিবেলা
আমি তখন টেবিলের সামনে বসেছিলাম আমার স্ত্রী ও সন্তান
পাশেই নিদ্রামগ্ন
সহসা দেখি আমার ছোট্ট ঘরখানির দীর্ঘ দেয়াল জুড়ে
দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব;
গায়ে বাংলাদেশের মাটির ছোপ লাগানো পাঞ্জাবি
হাতে সেই অভ্যস্ত পুরনো পাই
চোষে বাংলার জন্য সজল ব্যাকুলতা
এমনকি আকাশকেও আমি কখনো এমন গভীর ও জলভারানত
দেখিনি।
তার পায়ের কাছে বয়ে যাচ্ছে বিশাল বঙ্গোপসাগর
আর তার আলুথালু চুলগুলির দিকে তাকিয়ে
আমার মনে হচ্ছিলো
এই তো বাংলার ঝোড়ো হাওয়ায় কাঁপা দামাল নিসর্গ
চিরকাল তার চুলগুলির মতোই অনিশ্চিত ও কম্পিত
এই বাংলার ভবিষ্যৎ!
তিনি তখনো নীরবে তাকিয়ে আছেন, চোখ দুটি স্থির অবিচল
জানি না কী বলতে চান তিনি,
হঠাৎ সারা দেয়াল ও ঘর একবার কেঁপে উঠতেই দেখি
আমাদের সঙ্কীর্ণ ঘরের ছাদ ভেদ করে তার একখানি হাত
আকাশে দিকে উঠে যাচ্ছে-
যেমন তাকে একবার দেখেছিলাম ৬৯-এর গণআন্দোলনে
তিনি তখন সদ্য ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসেছেন
কিংবা ৭০-এর পল্পনে আর একবার ৭১-এর ৭ই মার্চের
বিশাল জনসভায়;
দেখলাম তিনি ক্রমে উষ্ণ, অধীর ও উত্তেজিত হয়ে উঠছেন
একসময় তার ঠোঁট দুটি ঈষৎ কেঁপে উঠলো
বুঝলাম এক্ষুনি হয়তো গর্জন করে উঠবে বাংলার আকাশ,
আমি ভয়ে লজ্জায় ও সঙ্কোচে নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম।
আমার মনে হেলা আমি যেন
মুখে হাত দিয়ে অবনত হয়ে আছি
বাংলাদেশের চিরন্তন প্রকুতির কাছে,
একটি টলোমলো শাপলা ও দিঘির কাছে,
শ্রাবণের ভরা নদী কিংবা অফুরন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে
কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো অভিযোগ নিঃসরিত হলো না;
তবু আমি সেই নীরবতার ভাষা বুঝতে চেষ্টা করলাম
তখন কী তিনি বলতে চেয়েছিলেন, কী ছিলো তার ব্যাকুল প্রশ্ন
ব্যথিত দুটি চোখে কী জানার আগ্রহ তখন ফুটে উঠেছিলো!
সে তো আর কিছুই নয় এই বাংলাদেশের ব্যগ্র কুশলজিজ্ঞাসা
কেমন আছে আট কোটি বাঙালী আর এই বাংলা বাংলাদেশ!
কী বলবো আমি মাথা নিচু করে ক্রমে মাটির সাথে মিশে
যাচ্ছিলাম-
তবু তাকে বলতে পারিনি বাংরার প্রিয় শেখ মুজিব
তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি
তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,
দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না
বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের
গুলিতে উড়ে গেল কেন?
তোমাকে কিভাবে বলবো তোমার নিষ্ঠুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে
প্রথমে জয়বাংলা, তারপরে একে একে ধর্মনিরপেক্ষতা
একুশে ফেব্রুয়ারী ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্রত
হলো তারা,
এমনকি একটি বাঙালী ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্যত
হলো তারা,
এমনকি একটি বাঙালী ফুল ও একটি বাঙালী পাখিও রক্ষা পেলো না।
এর বেশি আর কিছুই তুমি জানতে চাওনি বাংলার প্রিয়
সন্তান শেখমুজিব!
কিন্তু আমি তো জানি ১৫ই আগষ্টের সেই ভোরবেলা
প্রথমে এই বাংলার কাক, শালিক ও খঞ্জনাই
আকাশে উড়েছিলো
তার আগে বিমানবাহিনীর একটি বিমানও ওড়েনি,
তোমার সপক্ষে একটি গুলিও বের হয়নি কোনো কামান থেকে
বরং পদ্মা-মেঘনাসহ সেদিন বাংলার প্রকৃতিই একযোগে
কলরোল করে উঠেছিলো।
আমি তো জানি তোমাকে একগুচ্ছ গোলাপ ও স্বণৃচাঁপা
দিয়েই কী অনায়াসে হত্যা করতে পারতো,
তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা
তুমি কি তাই টলতে টলতে টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে
বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির উপর পড়ে গিয়েছিলে?
শেখ মুজিব সেই ছবির ভিতর এতোক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে
মনে হলো এবার ঘুমিয়ে পড়তে চান
আর কিছুই জানতে চান না তিনি;
তবু শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাকে আমার বলতে
ইচ্ছে করছিলো
সারা বাংলায় তোমার সমান উচ্চতার আর কোনো
লোক দেখিনি আমি।
তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিন্তবাদক
বাংলাদেশ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলো আমি
আমার বুক-পকেট থেকে ভাঁজ-করা একখানি দশ
টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম
বলেছিলাম, দেখো এই বাংলাদেশ;
এর বেশি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না!
আমি কি বলতে পেরেছিলাম, তার শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার
আগে আমি কি বলতে পেরেছিলাম?
 
 
 
 
 
তোমাকে মনে পড়ে যায 
-মোহন রায়ান
 
মধুর কেন্টিনে যাই
অরুনের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার সেই সদা হাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট,
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি
সারাক্ষন চোখে চোখে ভাসে
বুঝি এখনই সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ দিবে তুমি
ওই তো, ওই তো সবার আগে তুমি মিছিলে
কি সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা
প্রতিটি পা ফেলছো কি দৃঢ় প্রত্যয়ে
কি উচ্চকিত তোমার কন্ঠের শ্লোগান
যেন আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে
হাত ঊঠছে হাত নামছে
মাথা ঝুকছে ঘাড় দুলছে চুল উড়ছে বাতাসে
ওই তো, ওই তো আমাদের ঐক্যের পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি
মধুর কেন্টিনে যাই
নিত্য নতুন প্রোগ্রাম, মিছিল সভা বটতলা
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দুর্জয় শপথ
সামরিক জান্তার ছোবল থেকে
শিক্ষাজীবন, শিক্ষাঙ্গনের স্বায়ত্বশাসন রক্ষার অঙ্গীকারে
ডাক দেই দেশবাসীকে
তোমারি মত নিরাপত্বাহীনতায়
প্রতিটি ছাত্রের দুর্বিষহ জিম্মীজীবন এখনো এ ক্যাম্পাসে
হলে গেটে গেটে পড়ে থাকে ভংকর বিস্ফোরন্মোখ তাজা বোমা
প্রতিদিন চর দখলের মত হল দখলের হিংস্র মহড়া
গুলি ও বোমা ফাটার শব্দ
এখনো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ
এ অস্ত্রের উৎস কোথায়?
মধুর কেন্টিনে যাই
প্রতিদিন আমাদের জীবন হাতের মুঠোয়
প্রতিদিন হামলা রুখতে হয়
বসু, আজ সেই প্রতিরোধের সারিতে তুমি নেই
আজ বড়ই অভাব অনুভব করছি তোমার
শিক্ষাভবন অভিমুখে সামরিক শাসন ভাঙ্গার প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারীর কাফেলায় তুমি ছিলে
৪ঠা আগস্ট সশস্ত্র দুবৃত্তদের কবল থেকে
আমাদের পবিত্র মাটি রক্ষা করার সম্মুখ সমরে তুমি ছিলে
এমন কোন ধর্মঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল আন্দোলন নেই যে তুমি ছিলে না
সেই নৃশংস ঘাতক রাতেও
তুমি অস্ত্রধারীদের দূর্গের দিকে অবিচল যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলে
ঘাতক বুলেট ভেদ করে গেছে তোমাকে
কিন্তু তুমি পিছু হটনি
তুমি বীর, তুমি সাহসী যোদ্ধা, তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান
যুগে যুগে সংগ্রামীদের অফুরান প্রেরণা

 
 
 কবিতাঃমুক্তিনিনাদ 
কবিঃমিন্টু রায় 
 
 ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে দেখাে— 
হয়তো আমাকে আজকে তোমরা দ্বিজ বলবে, 
হ্যাঁ, সনটি ছিলো ঊনিশ'শ সাতচল্লিশ। 
 
আমি জন্মাবো বলে — 
একখণ্ড সমতলভূমি প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিল আমার পূর্বপুরুষ; 
পাঁজর দিয়ে গড়েছিল দুর্ভেদ্য প্রতিরোধের মহাপ্রলয় , 
 ভেঙে ফেলেছিল টানা দু'শো বছরের শােষণ প্রাচীর! 
পরিশেষে আমার জন্ম। 
 
 সকলের চোখে মুখে ছিল বিজয়ের উচ্ছ্বাস,
 জন্মোৎসবের শঙ্খনিনাদ বাজতে না বাজতেই মুখোশধারী পাক দানবের দল —
 দু'পায়ে আমার পড়িয়েছিল বন্দিত্বের শিকল। 
অসহ্য যন্ত্রণা আর তীব্র চিৎকারেও বিন্দুমাত্র করুণা জাগাতে পারিনি ওদের, 
 আমার মুখের ভাষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে— 
বাহান্নয় ওদের হিংস্র হাত চেপে ধরেছিল আমার কন্ঠনালী। 
ওরা ছিল শকুনের গায়ের উঁকুনের চেয়েও নিকৃষ্ট, 
কামোন্মত্ত ষাঁড়ের মতো গন্ধ শুঁকে, মুখ উঁচিয়ে— 
 বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চলেছিল আমার বেহুলা মেয়েদের উপর। 
 
 পিতার প্রতিটি শিরা-উপশিরায়, হৃদপিন্ডের স্পন্দন স্পন্দনে,
 দাউ দাউ করত আমাকে মুক্ত করার দাবানল!
 স্নেহ বৎসল পিতা আমার, শিকল মুক্ত করতে আমাকে– 
 সমস্ত গ্লানি ঝেড়ে কতবার করেছে করুণ আর্তনাদ! 
তবু বিন্দুমাত্র করুণা জাগেনি ওই হায়েনাদের মনে। 
দিন, মাস, বছর গড়িয়ে আমি তখন চব্বিশে পা রেখেছি, 
বয়সে যদিও টগবগে যৌবন ; 
তবু পায়ে আমার শিকল জড়ানো দগদগে ঘা। 
নির্মম নির্যাতন আর অবহেলার সেই ঘা যেন বড় হতে হতে... 
হঠাৎ সংক্রামকে রূপ নিয়েছিল। 
 
 সংক্রমণ ঘটল প্রতিটি মানুষের শরীরে মেরুদন্ডে অন্ত্রনালী হতে মস্তিষ্কে, 
মুক্তির নেশায় প্রতিটি মানুষ 
নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে 
 তৈরি করেছিল যেন এক একটি গ্রেনেড। 
 ধান ভানার নামে ঢেঁকিতে পাড় রেখে
 শুরু হয়েছিল মায়েদের হাঁটুতে শক্তি সঞ্চার, 
দুগ্ধপোষ্য শিশুকে স্তন্যপান করাতে করাতে
 ইট ভাঙ্গার হাতুড়ি চালিয়ে বাহুর প্রতিটি শিরায়,
 ছলাৎ ছলাৎ প্রবাহিত হতে লাগল অগ্নিগোলা। 
 কৃষক-মজুর, তাঁতি থেকে টোকাই সকলের গায়ের ঘাম থেকে 
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদের গন্ধ! 
 
ফাঁসির মঞ্চ চুম্বন করে পিতা আমার 
ফাঁসির দড়ির মতো টান টান উত্তেজনা নিয়ে 
বজ্রকন্ঠে হুঙ্কারে দিল— 'এবারের সংগ্রাম,
 মুক্তির সংগ্রাম' সেদিন ছিল সূর্যস্নাত দুপুরোত্তর– 
ঊনিশ'শ একাত্তর। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চরম উত্তেজনায় 
ছিন্নভিন্ন করে ফেলি আমার পায়ে শিকল। 
 
 হ্যাঁ, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল, 
 রক্তের স্রোত রাঙিয়ে দিয়েছিল দিগ্বিদিক। 
অবশেষে রক্ত ঝরতে ঝরতে জমাট বেঁধেছিল সবুজ ঘাসের বুকে 
ঠিক পূর্বদিগন্তের ওই টকটকে লাল সূর্যের মতো। 
পিতার নির্দেশই পেলাম নতুন জীবন,
 বিশ্ব মানচিত্রে নতুন নাম বাংলাদেশ; 
 সেই থেকেই আমি মুক্ত, আমরা স্বাধীন।
 
     
     
     

    বত্রিশ নম্বর-

    কামাল চৌধুরী

     এই বাড়িটা জাতির পিতার, এই বাড়িটা সবার 
    এই বাড়িটা মুজিব নামে পলাশ, রক্তজবার 
    এই বাড়িটা অশ্রুলেখা শোকের আগস্ট মাস
     এই বাড়িটা পিতৃভূমির কান্না, দীর্ঘশ্বাস।
     
     এই বাড়িটা পদ্মা-মেঘনা, মধুমতির জল
     এই বাড়িতে চিরকালের সাহস অবিচল
     মুক্তিদাতা উন্নত শির-দীর্ঘদেহী ভোর 
    এই বাড়িটা অন্ধকারে তাড়ায় ঘুমঘোর।
     
     এই বাড়িটা একাত্তরে মুক্ত নীলাকাশ 
    হত্যাকারী, শত্রুসেনা, রাজাকারের ত্রাস 
    এই বাড়িটা সাহস দিলে আমরা জেগে থাকি 
    বাংলা মায়ের রক্তশপথ হাত উঁচিয়ে রাখি। 
     
    এই বাড়িটা হাজার বছর পলিমাটির ক্রোধে 
    লালসবুজে মহিমাময় আত্মত্যাগী রোদে 
    এই বাড়িটা ধুলো-কাদা, বৃষ্টিভেজা মাটি 
    মহাকালের বটের ছায়ায় আমরা সবাই হাঁটি। 
     
    এই বাড়িতে মুজিব আছেন, জাতির বাতিঘর
     রবি ঠাকুর, নজরুল তাঁর প্রাণের কণ্ঠস্বর
     এই বাড়িতে পাল উড়িয়ে মহামানব আসে
     জয়বাংলার স্রোতের মুখে নৌকোখানি ভাসে। 
     
    তর্জনীতে আকাশ কাঁপে, তর্জনীতে দেশ 
    এই বাড়িটা বজ্রকণ্ঠ-মুক্তি অনিঃশেষ
     এই বাড়িটা স্বাধীনতা, রক্ত দিয়ে লেখা 
    এই বাড়িতে বিশ্বজনের মহাসাগর দেখা।
     
     এই বাড়িটা স্মৃতিসত্তা, জাতির জাদুঘর 
    এই বাড়িতে জাতির পিতা, আছেন মুজিবর 
    এই বাড়িটা তোমার আমার আত্মপরিচয় 
    এই বাড়িটা বঙ্গবন্ধু, জাতির হিমালয়।
     
     
     
     
     
     আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু! 
    লুৎফর রহমান রিটন
     
     মামলার নাম ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং।'
     সংশোধিত নাম 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।' 
    আসামী সংখ্যা ৩৫। ১নম্বর আসামী শেখ মুজিব। 
     ওদিকে শেখ মুজিব বন্দী ছিলেন জেলখানায়, তাঁর ৩৪ সহযোদ্ধার সঙ্গে।
     আর এদিকে 'জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো'
     বলে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করছি আমরা পুরো পাকিস্তানকে। 
    পূর্ব এবং পশ্চিম। টালমাটাল পূর্ব পাকিস্তান। 
    তীব্র আন্দোলন ক্রমেই তীব্রতর। 
    পরাভূত সোকল্ড লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইউব খান। 
     
     অতঃপর মুক্তি পেয়েছেন বাংলা ও বাঙালির মুক্তিসনদ
     'ছয় দফা'র প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান। 
    অতঃপর তাঁকে আমরা ভালোবেসে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধীতে ভূষিত করেছি।
     শৃঙ্খলিত বাংলা ও বাঙালির মুক্তিদূতকে তো বঙ্গবন্ধু সম্বোধনেই ডাকতে হবে।
     
     তিনি আমাদের 'বঙ্গবন্ধু' হলেন। 
    তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখালেন। একটি দেশের স্বপ্ন। 
    একটি পতাকার স্বপ্ন। একটি মানচিত্রের স্বপ্ন।
     সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে স্তোত্রপাঠের মতো করে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন তিনি-- 
    'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। 
    এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' 
     
    ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঊর্মিমুখর একটি অকূল সমুদ্রের সামনে 
     তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে বললেন--'
    রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো।' আমরা রক্ত দিলাম। 
    আমাদের তিরিশ লক্ষ শহিদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠলো সমুদ্রটা।
     
     বাংলার আকাশ-বাতাস-মৃত্তিকা-পাহাড়-বৃক্ষ-নদী-পাখি-ফুল-প্রকৃতি 
    কোরাস গাইলো--'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে 
    বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।'
     
     কিন্তু আমরা তাঁদের ভুলে গেলাম। 
    আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট হলাম।
     আমরা কুলাঙ্গার ভুলে গেলাম আমাদের বঙ্গবন্ধুকে।
     আমরা কুলাঙ্গার হত্যা করলাম আমাদের জাতির জনককে।
     
     ছবি হয়ে গেলেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
     
     অতঃপর একদিন তাঁকে আমরা স্থাপন করলাম দেয়ালে দেয়ালে, মনের খেয়ালে।
     ফ্রেমবন্দী হয়ে গেলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু......। 
     
     বঙ্গবন্ধু উৎকীর্ণ ছিলেন ছবির ফ্রেমে। 
     আমরা তাতে ফুলের মালা পরিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছি। 
     
    তারপর একদিন কাগজের নোটে মুদ্রিত হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। 
    অতঃপর তাঁকে আমরা পকেটে পুড়েছি। 
     
    অতঃপর মুদ্রিত সেই নোটের লোভ আর মোহের কাছে পরাজিত হতে হতে 
    আমরা কুলাঙ্গার কল্পনাতীত কুলাঙ্গার হয়ে উঠি দিন দিন। 
     অবলীলায় আমরা ভুলে যাই আমাদের বঙ্গবন্ধুকে। 
     
     আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় বুকের মধ্যে। 
    আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় করোটির ভেতরে। 
    আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে লালন করতে হয় 
    প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের চিন্তায় চেতনায় মননে ও মেধায়। 
     
    বিস্মৃতির গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে উন্মত্ত নেশাতুর
     আমরা কেবলই সংগ্রহ করি কাগজের নোটে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুকে। 
    কেবলই সংগ্রহ করি কেবলই সংগ্রহ করি......। 
    আমাদের লিকলিকে ক্ষীণ ওয়ালেট-মানিব্যাগ ফুলে ওঠে পোটকা মাছের পেটের মতো। 
    দুধের ফেনার মতো উপচে পড়ে আমাদের ড্রয়ার-আলমিরা। 
    আমাদের বিছানার জাজিমের ভেতরে থরে থরে সাজানো থাকে কাড়িকাড়ি নোট। 
    কাগজের নোটে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা লুকিয়ে রাখি বালিশের তুলোর ভেতরে। 
     
     আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু। 
     
     আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আপনি আমাদের জন্যে এনে দিয়েছিলেন 'স্বাধীনতা' ।
     আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আপনি আমাদের জন্যে নির্মাণ করেছিলেন আলাদা ভূখণ্ড। 
    আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--রক্ত আর জীবনের সুঁই-সুতোয় সেলাই করে দিয়েছিলেন আপনি লাল সবুজের অপরূপ একটি পতাকা।
     আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন 
    মোহরের অধিক মোহর নিজস্ব মুদ্রা। 
    সেই মুদ্রায় হেসে উঠেছে বাংলা ভাষার অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণমালাসমূহ।
     
     কিন্তু সেই বর্ণমালাকে উপেক্ষা করি,অবজ্ঞা করি আমরা! 
    আপনার দেয়া মোহরগুলোকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে দিই বরফের দেশে!
     অপমান করি পতাকাকে! 
    পতাকার অপমানে কেঁদে ওঠে মৃত্তিকায় মিশে থাকা তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মা। 
    আপনার অর্জিত 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'কে ইজারা দিই শত্রুর কাছে! 
     এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র অনেক দাম দিয়ে কেনা
     'স্বাধীনতা'কে বিক্রি করে দিই নামমাত্র মূল্যে! 
    আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু।
     আপনি কি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু?
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...