Thursday, February 13, 2020

সৈয়দ শামসুল হক



কবিতাঃ আমার পরিচয় 

কবিঃ সৈয়দ শামসুল হক


 আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি, 
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি। 
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
 তেরশত নদী শুধায় আমাকে, 'কোথা থেকে তুমি এলে '? 

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে। 
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে। 
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে 
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

 এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে 
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির-বেদি থেকে। 
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
 এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে। 

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে 
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
 আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
 আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে। 

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে 
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে। 
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে 
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে। 

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে 
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। 
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে 
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ? 

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির বীজমন্ত্রটি শোনো নাই- 
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ 
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
 সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই। 

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
 কখনোই ভয় করিনিকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
 শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
 অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
 একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস; 
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস। 

 এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ? 
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান; 
তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি- 
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।






পনেরো আগস্ট
সৈয়দ শামসুল হক
এখনও রক্তের রঙ ভোরের আকাশে।
পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে
কবে থেকে ভাসছে বাতাসে।
অপেক্ষায়- শব্দের- শব্দেই হবে সে মুখর- আরো একবার
জয় বাংলা ধ্বনি লয়ে যখন সূর্যের আলো তার
পাখায় পড়বে এসে
ইতিহাস থেকে আরো কিছুক্ষণ পরে।
মানুষ তো ভয় পায় বাক্হীন মৃত্যুকেই,
তাই ওঠে নড়ে
থেকে থেকে গাছের সবুজ ডাল পাতার ভেতরে।
পাতাগুলো হাওয়া পায়,
শব্দ করে ওঠে আর খাতার পাতাও
ধরে ওঠে অস্থিরতা- কখন সে পাবে স্বর-
জয় বাংলা ঝড়- তাকে দাও
জন্মনাভি! বোঁটা থেকে দ্যাখো আজও
অভিভূত রক্ত যায় ঝরে
বাঙালির কলমের নিবের ভেতরে।
স্তব্ধ নয় ইতিহাস! বাংলাও সুদূরগামী
তেরোশত নদীর ওপরে ওই আজও তো নৌকোয়
রক্তমাখা জনকের উত্থান বিস্ময়!
টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে
কামাল চৌধুরী
কবরের নির্জন প্রবাসে
তোমার আত্মার মাগফেরাতের জন্য
যেসব বৃদ্ধেরা কাঁদে
আমাদের যেসব বোনেরা
পিতা, ভাই, সন্তানের মতো
তোমার পবিত্র নাম
ভালোবেসে হৃদয়ে রেখেছে
যেসব সাহসী লোক
বঙ্গোপসাগরের সব দুরন্ত মাঝির মতো
শোষিতের বৈঠা ধরে আছে
হে আমার স্বাধীনতার মহান স্থপতি
মহান প্রভুর নামে আমার শপথ
সেই সব বৃদ্ধদের প্রতি আমার শপথ
সেই সব ভাই বোন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি আমার শপথ
আমি প্রতিশোধ নেব
আমার রক্ত ও শ্রম দিয়ে
এই বিশ্বের মাটি ও মানুষের দেখা
সবচেয়ে মর্মস্পর্শী জঘন্য হত্যার আমি প্রতিশোধ নেব।
মাক্কুর ক্ষিপ্রতা ছেড়ে যে শ্রমিক এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে
কালো চামড়ায় তার অসহায় ঘামগুলো সাদা হয়ে আছে
আমি তার দেহ থেকে ক্লান্তিগুলো খুলে নিতে চাই
আমি তার দুই চোখে প্রশান্তির অশ্রুজল চাই।
তিনদিন খাইনি বলে যাকে আমি চিৎকার করতে দেখেছি
হাড্ডিসার সেই কৃষকের প্রতি আমার কামনা
আমার বিদ্রোহ যেন জন্মজন্মান্তরে তাকে ভাই বলে ডাকে।
যে পথ নিয়েছি বেছে, জানি, সে পথে তোরণ নেই
ফুল কিংবা জীবনের পুষ্পশয্যা নেই
সে পথে রক্তের দাগ
মৃত্যুর আর প্রলোভন মাখানো রয়েছে
মুক্তিযুদ্ধের মতোন
তুমি হও আমাদের দুরন্ত প্রেরণা
আমি সব অতিক্রম করে
তোমার নৌকোকে নেব আকাক্সিক্ষত নদীর কিনারে।
মহান মানব ছিলে তুমি- দেবতা তো কখনো ছিলে না
দেবতা বানিয়ে যারা স্তুতি করেছে তোমার
জনসভা সেমিনারে বহুবার জীবন দিয়েছে
তোমার মৃত্যুর পরে
তারা কেউ আমাদের সাথে নেই আজ
সেবাদাসীদের মতো তারা সব ঘিরে আছে নতুন মনিব
হায়, এ রকম অপকর্ম শুধু বুঝি বাঙালির সাজে।
তোমার নিকটে ছিল যারা সেইসব তোমার খুনিরা
তারা কি বাঙালি ছিল?
না কি কোন ষড়যন্ত্রী দেশের সেবক?
সাম্রাজ্যবাদের কাছে নিজেদের বিকিয়েছে যারা
আমাদের ভাই নয় তারা
আমাদের জাতিসত্তা প্রেম আর ঐতিহ্যের হাজারো কাহিনী
ভুলে গিয়ে তারা সব বিদেশের সেবক হয়েছে!
আমার সমস্ত ঘৃণা থুথু আর বুকের আগুন
বাঙালি নামক সেই ঘৃণ্য সব খুনিদের প্রতি।
তীব্র প্রতিশোধ আমি ছুড়ে দেই খুনিদের মুখে
দ্যাখো, আগুন জ্বলছে আজ শুদ্ধ সব বাঙালির বুকে
এখন স্বদেশে চাই, শুধু চাই
তোমার সৈনিক কিছু সবল গোলাপ।
যেখানে ঘুমিয়ে আছো, শুয়ে থাকো
বাঙালির মহান জনক
তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ
শৌর্য আর অমিত সাহস
টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো
তোমার সাহস নেবে।
নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা।



নুন-পূর্ণিমা
সৈয়দ শামসুল হক
 
মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন,
চিকন লিকলিকে একটা সাপ যেমন ছিদ্রপথ গলিয়ে
টুক করে খসে পড়ে ঘরের মেঝেয়,
ওই পঙ্​ক্তিটি হঠাৎ
হাসান চৌধুরীর করোটিতে হিলহিল করে ওঠে।
গভীর রাতের রাজপথ, জনমানুষ বলতে পথে একমাত্র,
রাতের এমন একটি নিশীথ আসে যখন মানুষের চেয়ে
আলোর ভিড় শতগুণ অধিক বলে মনে হয় রাজপথে;
হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল সে,
কবি ও সাংবাদিক বলেই তার মাথার ভেতরে
কাল ভোরের সংবাদপত্রের হেডলাইনগুলো—
সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুন, গ্রেফতার—
হঠাৎ সব প্লাবিত করে বহে গেল অবিশ্বাস্য নুন আর দুধ।
এই হাসানকে আমরা এক্ষুনি দেখতে পাব
বিজন খাঁ খাঁ ঘরে একা দাঁড়িয়ে,
অপেক্ষায়—
এই বুঝি ফিরে আসবে মায়মুনা। প্রতিরাতে এমন সে দাঁড়ায়।
ফেরে না মায়মুনা।
ফিরবে কি?
অপেক্ষা তবু।
অচিরেই তাকে দেখব তার বালক পুত্রের কাছে দাঁড়াতে।
তার চুলে সে রাখবে হাত।
ঠান্ডা ভাত রেখে গেছে বুয়া।
কোনো কোনো রাতে সেই ঠান্ডা ভাত চটকাতে চটকাতে
তার মনে হয় জীবনই এমত, একদা রন্ধিত,
এখন কড়কড়ে হিম, দলা দলা,
ছেনে ছেনে গ্রাসযোগ্য করে তোলা।
থেকে থেকে, বুকের ভেতরে ডাক—মায়মুনা! মায়মুনা!
শব্দ করে ডেকে উঠেছে কি? পাশ ফেরে মোহিত,
ঘুমের ভেতর থেকে মজ্জমান মানুষের মতো মাথা তোলে,
অস্পষ্ট জড়িত স্বরে সাড়া দেয়, বাবা।
খেয়েছিস? সাড়া নেই।
মা ফোন করেছিল?
ঘুমের ভেতরে আরও ডুবে যায় বালক মোহিত।
হাসান টেবিলে বসে, দ্রুত হাতে লিখে রাখে পঙ্​ক্তিটি—
হারিয়ে যাবার আগেই,
মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন।
তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কতকাল, দিন পরে দিন,
অক্ষর আসে না আর, শব্দ নেচে ওঠে না আঙুলে,
অভিধান বসে পড়ে যায়, দুধের নহর বহে, নুন উঠে আসে জিহ্বায়।
হাহাকার করে ওঠে কবিতার খাতা।
মায়মুনার মতো কবিতাও ত্যাগ করে চলে গেল তাকে?
ওই একটি পঙ্​ক্তির দিকে দিন পরে দিন আর রাত পরে রাত
বিস্ফারিত চোখ মেলে বসে থাকে হাসান চৌধুরী।
আমরা আবার তার দেখা পাব হরিষাল গ্রামে।
না জমিতে না পানিতে,
না সৌরমণ্ডলে না কৃষ্ণগহ্বরে,
না পাথরে না পলিতে,
না গোলাপে না কণ্টিকারিতে,
না পোশাকে না নগ্নতায়,
না গার্হস্থ্যে না লাম্পট্যে,
না আলোয় না অন্ধকারে,
না পাপে না পুণ্যে!
আমরা এসব যুগলের প্রতিটির মধ্যভাগে আছি
এক ধূসর দেশে বস্তুত
এবং আমাদের প্রামাণ্য জীবনকাহিনি বলতে এটাই।
রচনা করা যাবে না প্রশংসাগাথা,
কিংবা বর্ষণও করা যাবে না অভিশাপ—।
গত বছরের সংবাদপত্রে যেমন—
পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় পাশাপাশি
নববর্ষে মানুষের উৎফুল্ল মিছিলের রঙিন ছবি
আর বটতলায় বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন লাশ
সেটিও রঙিন।
যেন দুটোই উৎসব,
যেন দুটো নিয়েই উৎসব;
যেন উৎসব একটিই, তার আবশ্যিক অঙ্গ ওই দুটি।
এখন এই। এই আমাদের বাস্তবতা। এই আমাদের বিন্যাস।
কেউ যদি আমাদের কথা লিখতেই চায়,
সে যেন অবশ্যই অবহিত সতর্ক থাকে এই বিষয়ে।
এই অবধান ও সতর্কতা এ কাহিনির বর্ণনায়
ধারণ করে রাখতে হবে সারাক্ষণ—
লিখতে বসে বানান ও ব্যাকরণকে যেমন আমরা রাখি
ওপরস্তরে একেবারেই সচেতন না থেকে,
চোখ ফেলে রাখতে হবে পাথারে যেমন প্রাচীন বটের দিকে
পথের নির্দেশক রূপে অমাবস্যায় তো বটেই
ভরা জোছনায়, এমনকি খর দুপুরেও।
অন্ধকারেই কেবল পা ভুল পথে যায় কি? আমাদের
অধিকাংশ পতন ও স্খলন ঘটে আলোকিত মঞ্চেই।
আমরা এখন এসে যাই হরিষাল গ্রামে;
গ্রামটিতে আমরা প্রবেশ করি সতর্ক পায়ে।
না জমিতে না পানিতে, না সৌরমণ্ডলে না কৃষ্ণগহ্বরে।
প্রীতি, প্রমোদ, সুখ, আহ্লাদ, আনন্দ
যখন পূরিত করা যায় এক শব্দে
সে হয় হর্ষ।
আর এই হর্ষ থেকেই হর্ষিত বা প্রাচীন পদ্যে যেমন—হরষিত;
আর এই হরষিত-ই আঞ্চলিক রূপে বুঝি হরিষাল।
বাস্তব ও বাস্তবের বর্ণনা থাকে পরস্পর মুখ ফিরিয়ে
জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
ইতিহাসের মূল খেলাটিই হবে বাস্তব ও বর্ণনার বৈপরীত্যে—
এবং তেমনটিই দেখি হরিষালে।
হরষিত বা হর্ষিত সে নয় মোটেই—
এক বিষাদিত খর্বতা তার চারিত্র্য ও ধূসরতা তার অঙ্কনের রং।
তামাটে প্রান্তর মিশেছে ইস্পাতের মতো ধারালো আকাশে।




নিঃসঙ্গ কবি, নির্জন রেস্তোরাঁ 
– সৈয়দ শামসুল হক
 
মাথার ভেতরে লেখা। অদূরে রেস্তোরাঁ।
আষাঢ় সেজেছে খুব মেঘে মেঘে-মনে সে করাবে
বিরহ বিপন্ন দিন-রাস্তাঘাট আদ্যোপান্ত খোঁড়া।
মাটির পাহাড়গুলো কতদিনে কে জানে সরাবে!
এরই মধ্যে পথ করে নিতে হবে আজ।
অপেক্ষায় কবিতা ও কফি।
হঠাৎ বৃষ্টির শুরু, ধমকাল বাজ।
পিছলে পা পড়ে গেল কবি।
সমস্ত শরীরে কাদা। এভাবে কি যাওয়া যেতে পারে?
বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে কেটে যায় কাল।
তবুও কি প্রেম কিছু ছাড়ে?
বিরহেও রয়েছে বহাল!
যদিও পিছল পথ, জামা কাদা লেপা।
হেঁটে চলো, হেঁটে চলো, দাঁড়িয়ে থেকো না।
সময় যতই হোক বিরুদ্ধ বা খেপা-
কবিতাকে ঠেকিয়ে রেখো না।
কবিতা কি থেমে থাকবার!
দুর্গতির একশেষ, খাতা তবু শক্ত হাতে ধরা।
হাতছানি দেয় কফি, আলো রেস্তোরাঁর,
দুধের বদলে ্নৃতি, কালো কফি, শব্দের শর্করা ু
বৃষ্টিভেজা গন্ধ ছড়ায় ফুলদানিতে ফুল।
ঘটিয়ে দেয় ইন্দ্রজাল রাতের রেস্তোরাঁয়।
একলা বুকে আছড়ে পড়ে ও কার খোলা চুল।
আষাঢ় এলে পদ্মা পাগল-পেলেই ভূমি খায়!
আগুন ওঠে দপদপিয়ে, লাফাতে চায় খাড়া-
ভোলা তো খুব সহজ নয় চিরে ফেলার ধাঁচ।
অতীতও নয় গেছেন কবি নক্ষত্রের পাড়া,
সেদিন কবি জেনেছিলেন স্বর্গীয় তার আঁচ।
ফুলের সাথে চুলের গন্ধ এখন একাকার।
এখন শুধু গন্ধটুকুই-এবং অন্ধকার ু
কফির গরম গন্ধ। পেয়ালায় আঁকা দুটি ফুল
দীর্ঘ দুটি বৃন্তে তারা পরস্পর জড়িয়ে রয়েছে।
কত দীর্ঘদিন কবি রেস্তোরাঁয় এসেছে ও
একাকী সহেছে
বিরহ বিচ্ছেদ তার। আষাঢ়ের বৃষ্টিপাত হয়েছে তুমুল।
কবিতার খাতাটি পাশেই।
রেস্তোরাঁয় একা কবি চুমুকে চুমুকে
পান করে চলে কফি।
পৃথিবী বিপুল আর লেখার বিষয় তার
হতে পারে সবই।
কিন্তু আজ সেই মুখ-একটি সে মুখ ছাড়া
আর কিছু নেই।
ভোরের প্রথম আলো প্রতি ভোরে পড়ে সেই মুখে।
ফুরোয় না ভালোবাসা-কফি শেষ হয়ে যায়
চুমুকে চুমুকে
সে নেই, তবুও কবি আসে রেস্তোরাঁয়।
ধীরে কালো কফি ঢালে শাদা পেয়ালায়।
এই সে চেয়ার আর এই সে টেবিল।
জানালার পর্দা ওড়ে এখনো তো নীল।
শূন্যতার রং শাদা, মৃত্যু ঘন কালো।
যা ছিল জীবনব্যাপী-মুহূর্তে মিলাল।
এখনো টেবিলে ফুল-ছাইদান পড়ে।
কেবল সে নেই আর। স্মৃতি হয়ে ওড়ে
ছাইদানে ছাই আজ করুণ বাতাসে।
রেস্তোরাঁয় সেদিনের ফুলগন্ধ ভাসে।
স্মৃতির নদীতে নেভা আলোর বিকন।
কালির কলমে লেখা জলের লিখন






পরানের গহীর ভিতর-১ __সৈয়দ শামসুল হক



জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি – একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷


পরানের গহীন ভিতর-২




আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন কর কি তালাশ?
মেঘের ভিতর তুমি দ্যাখ কোন পাখির চক্কর?
এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?
সোনার সংসার থুয়া পাথারের পরে কর বাস?
কি কামে তোমার মন লাগে না এ বাণিজ্যের হাটে?
তোমার সাক্ষাৎ পাই যেইখানে দারুণ বিরান,
ছায়া দিয়া ঘেরা আছে পরিস্কার তোমার উঠান
অথচ বেবাক দেখি শোয়া আছে মরনের খাটে।
নিঝুম জঙ্গলে তুমি শুনছিলা ধনেশের ডাক?
হঠাৎ আছাড় দিয়া পড়ছিল রূপার বাসন?
জলপির গাছে এক কুড়ালের কোপের মতন
তাই কি তোমার দেহে ল্যাখা তিন বাইন তালাক?
এমন বৃক্ষ কি নাই, যার ডালে নাই কোন পরী?
এমন নদী কি নাই, যার বুকে নাই কোন তরী?



পরানের গহীন ভিতর-৩


সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক
নীল হয়া গ্যাছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ,
অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।
আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?
সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?
নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?
অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন?
তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম, নাকি ধুতুরার?
কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাষ সীমানায়
আদাড় বাদার দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে,
কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়,
এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।
তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?



পরানের গহীন ভিতর-৪ 



আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।




পরানের গহীন ভিতর-৫



তোমার দ্যাশের দিকে ইস্টিশানে গেলেই তো গাড়ি
সকাল বিকাল আসে, এক দন্ড খাড়ায়া চম্পট,
কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি-
আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুন সংকট।
আসুম? আসার মতো আমি কোনো ঘর দেখি নাই।
যামু যে? কোথায় যামু, বদলায়া গ্যাছে যে বেবাক।
কেমন তাজ্জব সব পাল্টায়া যায় আমি তাই
দেইখাছি চিরকাল। পরানের ভিতরে সুরাখ-
সেখানে কেবল এক ফরফর শব্দ শোনা যায়,
পাখিরা উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া, এখন বিরান,
এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান,
সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে? আর কি সে খায়?
সকাল বিকাল গাড়ি, চক্ষু আছে তাই চক্ষে পড়ে;
পলকে পলকে গাড়ি সারাদিন মনের ভিতরে।।



পরানের গহীন ভিতর-৬ 



তোমার খামাচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,
এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,
চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,
তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।
হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।
দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে
আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,
আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।
আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।
বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।



পরানের গহীন ভিতর-৭



নদীর কিনারে গিয়া দেখি নাও নিয়া গ্যাছে কেউ
অথচ এই তো বান্ধা আছিল সে বিকাল বেলায়।
আমার অস্থির করে বুঝি না কে এমন খেলায়,
আমার বেবাক নিয়া শান্তি নাই, পাচে পাছে ফেউ।
পানির ভিতরে য্যান ঘুন্নি দিয়া খিলখিল হাসে
যত চোর যুবতীরা, গ্যারামের শ্যাষ সীমানায়
বটের বৈরাগী চুল, ম্যাঘে চিল হারায় বারায়,
বুকের ভিতরে শিস দিয়া সন্ধা হাঁটে আশেপাশে।
এখন কোথায় যাই, এইখানে বড় সুনসান,
মানুষের দুঃখ আছে, জগতের আছে কিনা জানি না-
জগৎ এমনভাবে হয়া যায় হঠাৎ অচিনা।
মনে হয় আমার থিকাও একা বৃক্ষের পরান,
আমার থিকাও দুঃখী যমুনার নদীর কিনার।
আমার তো গ্যাছে এক, কত কোটি লক্ষ গ্যাছে তার।।



পরানের গহীন ভিতর-৮



আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন
তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়
মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,
অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?
নদীরে জীবন কই, সেই নদী জল্লাদের মতো
ক্যান শস্য বাড়িঘর জননীর শিশুরে ডুবায়?
যে তারে পরান কই, সেই ব্যাক্তি পাইকের মতো
আমার উঠানে ক্যান নিলামের ঢোলে বাড়ি দ্যায়?
যে পারে উত্তর দিতে তার খোঁজে দিছি এ জীবন,
দ্যাখা তার পাই নাই, জানা নাই কি এর উত্তর।
জানে কেউ? যে তুমি আমার সুখ, তুমিই কি পারো
আমারে না দুঃখ দিয়া? একবার দেখি না কেমন?
কেমন না যায়া তুমি পারো দেখি অপরের ঘর?-
অপর সন্ধান করে চিরকাল অন্য ঘর কারো।।


পরানের গহীন ভিতর-৯


একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?
জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া তুমি কর ঘর?
আঙিনার পাড়ে ফুলগাছ দিলে কি সোন্দর হয়,
দুঃখের কুসুম ঘিরা থাকে যার, জীয়ন্তে কবর।
পাথারে বৃক্ষের তরে ঘন ছায়া জুড়ায় পরান,
গাঙের ভিতরে মাছ সারাদিন সাঁতরায় সুখে,
বাসরের পরে ছায়া য্যান দেহে গোক্ষুর জড়ান,
উদাস সংসারে ব্যথা সারাদিন ঘাই দেয় বুকে।
তবুও সংসার নিয়া তারে নিয়া তুমি কি পাগল,
তোলো লালশাক মাঠে, ফসফস কোটো পুঁটিমাছ,
সাধের ব্যাঞ্জন করো, রান্ধো ক্ষীর পুড়ায়া আঞ্চল,
বিকাল বেলায় কর কুঙ্কুমের ফোঁটা দিয়া সাজ।
ইচ্ছা করে টান দিয়া নিয়া যাই তোমারে রান্ধুনি,
তোমার সুতায় আমি একখান নীল শাড়ি বুনি।।


পরানের গহীন ভিতর-১০ 



কে য্যান কানতে আছে- তার শব্দ পাওয়া যায় কানে,
নদীও শুকায়া যায়, আকালের বাতাস ফোঁপায়,
মানুষেরা বাড়িঘর বানায় না আর এই খানে,
গোক্ষুর লতায়া ওঠে যুবতীর চুলের খোঁপায়।
বুকের ভিতর থিকা লাফ দিয়া ওঠে যে চিক্কুর,
আমি তার সাথে দেই শিমুলের ফুলের তুলনা,
নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর,
আগুন লাগায়া দিবে, হবে খাক, তারি এ সূচনা।
অথচ আমারে কও একদিন এরও শ্যাষ আছে-
আষাঢ়ের পুন্নিমার আশা আর এ দ্যাশে করি না,
চক্ষু যে খাবলা দিয়া খায় সেই পাখি বসা গাছে,
অথচ খাড়ায়া থাকি, এক পাও কোথাও নড়ি না।
সকল কলস আমি কালঘাটে শূণ্য দেইখাছি,
তারে না দেইখাছি তাই দ্যাখনের চক্ষু দিতে রাজি।।



পরানের গহীর ভিতর-১১



কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানী আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।




পরানের গহীন ভিতর-১২



উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,
শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,
পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,
তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,
আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,
গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,
গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,
দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।
একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?
একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে
যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?
যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,
এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?







No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...