গল্প.........
=====================
গল্পের নাম: এক কাপ চা
লেখক: তাসনীম ফারজানা প্রমী
- হ্যালো মুনা, কেমন আছেন?
মুনা কারোর কন্ঠে নিজের নাম শুনে পেছন ফিরে তাকালো। কী বলবে মনে হয় বুঝতে পারছে না , ভারী কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারলাম মুনা অবাক হয়ছে এখনও সে আমাকে চিনতে পারেনি।
.
আমি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল মানুষ। ধৈর্য্যসহকারে তাকে পরিচয় দিলাম,
.
- সেদিন দেখা হয়েছিলো ক্যাম্পাসে জারুলতলার সামনে, মনে নেই আপনার?
মুনা নামের মেয়েটা এখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার মানে এখনো সে মনে করতে পারে নাই সেদিনের কথা , মুনা কি আমায় চিনে ফেলবে?
মুনা বোকার মত ডানে বামে মাথা নাড়লো তারমানে এখনো চিনতে পারে নাই। আমি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল একটা মানুষ। ধৈর্য্য সহকারে আবারো তাকে ব্যাখ্যা দিলাম।
- আমি রিজুর বন্ধু, তমাল। কম্পিউটার সাইন্স ফোর্থ ইয়ার। রিজুদের সাথে একদিন ক্যাম্পাসে পরিচয় হইছিলো। এখনো চিনতে পারেননি?
.
আমি মুনার চশমার ভেতর দিয়ে দেখছি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। বড় বড় চোখের সাইজ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল।নাকি ওর চশমাটাই এমন কে জানে! আচ্ছা মুনা কি ভয় পেয়ে গেল নাকি! নাকি বিরক্ত হচ্ছে? চলে যাব নাকি? জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় এবার মুনা মুখ খুললো ,
- আমার আসলে চেহারা মনে থাকে না , ভুলোমনা স্বভাবের। তাই আপনার চেহারাটা ঠিক আসলে কোথাও দেখেছি কিনা মনে করতে পারছিলাম না। দুঃখিত আসলে চিনতে পারছি না।
- তো ভালো আছেন, আপনি?
- হুম ভালো। আপনি?
- ভালো।
- ও , রিজু কোথায়?
- রিজু আজ আসে নাই। আপনাদের ক্লাস শেষ?
- হুম।
- তারমানে চলে যাবেন এক্ষুণি?
- হুম।
- ও হহ! আরেকটু পরে গেলে সমস্যা হবে?
- কেন? কোনো দরকার ছিল?
- এক কাপ চা খাব আপনার সাথে।
- চা! এখন?
- হুম
- এই অবেলায়? দুপুরে ?
- হুমম, যদি না আপনার আপত্তি থাকে।
.
আমি মুনার দিকে তাকিয়ে অনুরোধটা এমনভাবে করলাম যাতে এতে ভদ্রতাও থাকে আবার অধিকার খাটানোও থাকে তবে জানি মেয়েটা বুঝতে পারবে না। মুনা দুই সেকেন্ড কী যেন ভাবলো তারপর আমি রিজুর বন্ধু বলায় ভদ্রতা করে বললো,
- আচ্ছা চলুন।
আমি মুনা নামের আমার দেখা কোঁকড়া চুলের সবচেয়ে সুন্দর রূপবতী মেয়েটার সামনে বসে আছি। মুনার দিকে সরাসরি তাকাতেও পারছি না, মুনা কেমন জড়তা নিয়ে বসে আছে।
এখন বরং আমার চা খেতে অস্বস্তিবোধই হচ্ছে, মুনা চুপ করে বসে চা খাচ্ছে। খাচ্ছে বললেও ভুল হবে বড় বড় করে চুমুক দিচ্ছে যাতে জলদি চা শেষ হয়ে যায়।
আমার ইচ্ছে করছে মুনাকে আরো কয়েক যুগ আমার সামনে বসিয়ে রাখি। মুনাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম শাটলে, ক্লাস করে ক্লান্তসান্ত চেহারায় দরজায় দাঁড়িয়ে যেতে। হুম, সাড়ে পাঁচটার শাটলে। তখন ছিল শীতকাল জলদি সন্ধ্যে নামতো। ট্রেন যখন অন্ধকার পথটা শব্দ তুলে পাড়ি দিচ্ছিলো আমি তখন মুনার খুব কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মুনার চোখে জোনাক পোকার উড়াউড়ি দেখছিলাম। তখনো নাম জানতাম না , তারপর মুনার সাথে আবার দেখা পহেলা বৈশাখে কলা ভবনের ঝুপড়ি হতে কে যেন মুনা বলে ডাক দিলো তারপর থেকে আমি কাটা পাহাড়ের অজস্র ভীড়ে , স্টেশনের অচেনা মুখে মুনাকে
মুনা নামের রূপবতী মেয়েটাকে খুঁজে বেড়াই।
মুনাকে নিয়ে এক লাইনের একটা চিঠি লিখা কাগজ নিয়ে আমি পুরো ১০১ দিন পর মুনার সামনে বসে আছি। মুনা সে কাগজটা পড়ে কেমন চমকে যাবে ভেবেই কেমন জানি ঘাবড়ে যাচ্ছি। এবার কাগজটা দেবার পালা কিন্তু কীভাবে দিব ভেবেই পাচ্ছি না।
- আপনার চা তো দেখছি শেষ।
- হ্যাঁ, উঠবো এবার।
- শুনুন, একটা অনুরোধ ছিল, যদি রাখতেন।
- কী?
- এই কাগজটা আপনার জন্য।
- কীসের কাগজ? প্রেমপত্র?
- প্লিজ, আমার সামনে কাগজটা খুলবেন না, পরে পড়ে নিবেন, উত্তর দেয়াটাও জরুরি না।
- যদি না নিই?
- সেটা আপনার ইচ্ছে তবে নিলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না এতটুকু গ্যারান্টি দিচ্ছি।
মুনা কাগজটা নিবে নাকি ছুঁড়ে ফেলে দিবে আমি জানি না। আমি আপাতত পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাগজ খুঁজায় ব্যস্ত, না কাগজটা পাচ্ছি না কোথায় গেল!
হঠাৎ মনে পড়লো, কাগজটা কোথায় রেখেছি। মুনার দিকে না তাকিয়ে আমার কুঁচকানো হাতা গুটানো শার্টের বুকপকেট থেকে কাগজটা বের করলাম। মুনার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে একপলক তাকালাম দেখি মুনা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কাগজটা হাতে নিতেই আমি বিদায় নিয়ে রিক্সায় উঠে গেলাম।
আমি জানি কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তা একবার হলেও মুনা কৌতুহলবশত খুলে দেখবে এবং খুলে মুনা অবাক হবে যখন দেখবে পুরো কাগজ জুড়ে শুধু ১০১ বার
" মুনা মুনা মুনা মুনা মুনা মুনা ...... মুনা শুভ জন্মদিন "
আমি হতভাগা কারণ আমি মুনা নামের সেই রূপবতী মেয়েটার অবাক হওয়া ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা দেখতে পাবো না। কারণ আমি আসলে কোনো রিজুকে চিনি না, মুনাকে আমার খুব ভালো লাগে।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল মুনার সাথে ভরদুপুরে এককাপ চা খাওয়ার। চা খাওয়াটা আমার এমন কোনো নেশা না যে তাই মুনার সাথে খাচ্ছি। জানি মুনার এই অদ্ভুত কাজটাই অনেকদিন মনে থাকবে হয়তো বহু মাস বা বহুবছর, বারবার মনে করবে, কারণে অকারণে মনে করবে। কোনো মেয়ে অবাক হওয়া কাজ সহজে ভুলতে পারে না ইচ্ছে করেই অন্য আরেকজনকে বলবে। হয়তো রিজুকেও জিজ্ঞেস করবে কিন্তু যখন জানতে রিজুর তমাল নামে কোনো বন্ধুই নেই তখন কী হবে সেটা কেবল নিয়তিই জানে।
হয়তো মুনার মেজাজ খারাপ হবে কিন্তু সে মেজাজ খারাপের পরও মুনা ব্যাপারটা অকারণে মনে রাখবে।
পৃথিবীতে সেই ভাগ্যবান পুরুষ যে কোনো মেয়েকে চমকে দিতে পেরেছে।
মুনাও বারবার নিজেকে প্রশ্ন করবে, "কেন ছেলেটা এমন করলো! সে কি আমাকে অনুসরণ করতো? সে কি আমাকে পছন্দ করতো?"
হয়তো ভাবতে ভাবতে আনমনে আয়নায় নিজেকে দেখবে, মনে মনে হাসবে। এই অদ্ভুত শখের বশে তার সাথে চা খাবার জন্যই ইচ্ছে করে তার বন্ধুর নাম বলে চালিয়ে দিলাম,অবশ্য এ নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই কারণ আমি অসম্ভব ধৈর্য্যশীল মানুষ। আর আমার পরিচয়? 😀 তাতেই বা কী এসে যায়। আমি তমাল না রিসান কে জানে।
মুনার সাথে আজই আমার শেষ দেখা, রূপবতী মেয়েদের আশেপাশে বেশিক্ষণ থাকতে নেই, দীঘির জলে টলমল শীতল বাতাসের মত মন জুড়ানো অতৃপ্ত মায়া পড়ে যায় আর এ মায়া বড্ড ভয়ংকর জিনিস, চাইলেও এ মায়ার জাল এড়ানো যায় না, অক্টোপাসের মত পেঁচিয়ে মারে।
++++++
কত রাত এখন তোমার ওখানে? আকাশে তারাদের আলোক সজ্জা দেখতে ঘুম ভাঙা চোখে উঁকি দাও আকাশে?
কোন এক চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় প্রথমবার পড়া শাড়িতে জবুথবু আমাকে মনে পড়ে? তোমার পরনে ছিল জলপাই রঙ এর পাঞ্জাবী, ওই রঙ যেন চোখে জ্বালা ধরাচ্ছিল। তারপর ও ভিড়ের ভেতরে আমার চোখ দুটো শুধু তোমার খোঁজে ফেলুদা হয়ে এদিক ওদিক ফিরছিল।
গান শেষে আমরা সবাই নেমে এলাম আর তুমি এগিয়ে এসে ঠিক আমার সামনে দাঁড়ালে। সবে মাত্র উনিশে পা দেয়া আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। এক কাপ ঠান্ডা চা আমার হাতে দিয়ে বললে,' নাও ধরো সেই কবে থেকে চায়ের কাপ ধরে বসে আছি, চা জুড়িয়ে শরবত হয়েছে। 'একদম অচেনা কারোর এমন উদ্ভট আপন করা ব্যবহারে চমকে উঠেছিলাম কিন্তু তাতে একরাশ ভাল লাগাও ছিল।
সেই শুরু, এরপর নানা বাহারী রঙ এর পাঞ্জাবী পরে সময়ে অসময়ে চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে ঘুর ঘুর করতে। টর্নেডো হয়ে আসতে আবার উল্কার গতিতে হারিয়ে যেতে। সব সময়ই মনে হত তোমার অনেক তাড়া। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে ছিল তোমার এত্ত এত্ত বন্ধু । তবে কোন বান্ধবী ছিল না দেখে স্বস্তি পেতাম। মাঝেমাঝে হঠাত আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে দুই তিন লাইন রুটিন মাফিক কথা বলতে। 'কেমন আছো? পড়াশোনা কেমন চলছে এসব। ' কোন এক অদ্ভূত কারণে তুমি আমায় কৃষ্ণচূড়া নামে ডাকতে। আমি প্রথম কবার নামটা শুধরে দিয়ে পরে বুঝেছি ওই নামটা তোমার দেয়া।
আমি চুপচাপ থাকা একজন মানুষ, বেলী, কাঁঠালচাঁপা ডাকলেও মানিয়ে যেত। অমন টকটকে বখাটে রঙ এর ফুলের নামে কেন ডাকতে আমায়, তুমিই জান।
তোমার সব কথার উত্তর খুব সংক্ষেপে দিতাম। মাঝে মাঝে আমার হাসিতেই তুমি বুঝে নিতে। কেন যেন তোমার সামনে কখনই স্বাভাবিক থাকতে পারতাম না। তবে তুমি চলে গেলে সেদিন সন্ধ্যায় বা রাতে যখন সবাই শুয়ে পড়ত, তখন তোমার সাথে আমি একান্তে মন খুলে কথা বলতাম। কল্পনার আমি ছিলাম উচ্ছল ঝরনার মতন আর তুমি সবুজ পাহাড়।
এক দুপুরে ক্লাস শেষে বারান্দায় এসে দেখি তুমি দাঁড়িয়ে। মনে হল কারো জন্যে অপেক্ষায় আছো। আমার দিকে এগিয়ে এসে টুকটাক কথার ফাঁকে হঠাৎ ই খুব সরল গলায় বললে তোমার চোখদুটো খুব সুন্দর, টলমলে শিশিরের মতন। সেই রাতে তোমার বলা প্রতিটি শব্দকে রেশমের চাদরে জড়িয়ে বুকে টেনে নিলাম। আহ কি সুখ, কি সুখ।
এভাবে কেটে গেল বহু বহুদিন৷ তারপর এল সেই দিন টি। প্রায় বুধবার তুমি আসো, তাই সেইদিনটাতে মুখে আলগা পাউডারের পরশ, কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চুল টা আলগা করে খুলে রাখা। বাতাস আর চুলের দড়ি লাফ চলছে, মন জুড়ে শুধুই তুমি।
কে যেন পেছন থেকে কাঁধে টোকা দিল। ঘুরে দাঁড়ালাম। তুমি দাঁড়িয়ে। সেদিন পড়েছিলে লাল টকটকে পাঞ্জাবী, আমি ঠোঁটে হাল্কা হাসি ধরে রেখে চেয়ে রইলাম। তোমার চোখের ভাষায় কি যেন ছিল তাই একটু ভাল করে তাকাতেই দেখলাম তোমার পাশে ম্যাথস ডিপার্টমেন্টের মিষ্টি চেহারার রুবা আপু দাঁড়িয়ে। সেই চির পরিচিত আপু কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিলে তুমি। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে জানো। তুমি উচ্ছল হাসি দিয়ে বলেছিল ' এই যে নাও তোমার হবু ভাবী, আমার পুরো পৃথিবীর সম্রাজী ও'। আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু আমার চারপাশে বিশাল শব্দে ভেংে পড়ছিল কল্পনায় সাজানো ছোট্ট পৃথিবীটা। বুকটা হু হু, কষ্টের জলে ভেজা ভারী বাতাসে ছিল না একবিন্দু অক্সিজেন। ফিস উইদাউট ওয়াটার কথাটি শুনেছি বহুবার সেদিন সত্যিকার ভাবে বুঝেছি তা কত কষ্টের হতে পারে।
তবে কি তুমি এত এত টা দিন আমার ভাই হয়ে ছিলে? আমি বুদ্ধু, কিভাবে তাকে ভুল বুঝেছিলাম বলতে পারো।
জানি না আমার চোখে তুমি কতটুকু ভাংচুর দেখেছিলে, এরপর থেকে তোমার দেখা মেলেনি আর। আজ পঁচিশ বছর কেটে গেল। একটা সময় পর্জন্ত চেষ্টা করেছি সব ভুলে যেতে। কিন্তু এখন সে মূহুর্ত গুলো কে খুব যত্নে গুছিয়ে রাখি। সময় পেলেই ওদের খুলে আদরের আঙুল বুলাই, তোমার বলা প্রতিটি কথা একের পর এক গেঁথে মালার মতন গলায় পরি। আমার বাড়ির সামনে একটা বিশাল কৃষচূড়া গাছ। সে গাছে কান পেতে তোমার ডাক শুনি। অতো সুন্দর মায়া মেখে আমায় আর কেউ ডাকেনি। আমার পৃথিবীতে তুমি আছো বলেই তো আমি বুঝি ভালোবাসায় কোন বাঁধন থাকে না। কোন ঘুমহীন রাতে বুকের ভেতরে চিন চিনে অনুভূতি জানান দেয় তুমি আছো, ভালবাসারা আছে। আমার খুব খুব কাছে।
তোমার কৃষ্ণচূড়া
( লিখেছেন - কাজী রাহনুমা নূর)
( অণু গল্প)
+++++++++++++++++++++
পাতারা রঙ বদলাচ্ছে,বাতাসে কুচি হিম। ওই যে মেয়েটা ছোট্ট দুই হাত অবিরাম ঘসে ওম হাতড়ে চলে,তার টিমটিমে শরীরে একফালি কাপড়, কোন এক সময় রাজার দুলালীর টি শার্ট ছিলো।এখন আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে ক্ষয়ে যাওয়া সুতোর গিঁটে ওই শীর্ণ শরীরের তাপ টুকু বেঁধে রাখতে। বখে যাওয়া বাতাসের সাথে পেরে উঠছে না ।
ক'বছর আগেও টি শার্টটি আয়না ঢাকা কাবার্ডের মখমলে মোড়া হ্যাংগারে দোল খেতো, বাতাসে ছড়িয়ে থাকতো মিষ্টি গন্ধ, না কোন ফুলের গন্ধ নয়, কখনো স্ট্রবেরী, কখনো বা অরেঞ্জ। মাঝে মাঝে কাবার্ডে এলাচ এলাচ গন্ধ ও পেতো। প্রথম কিছুদিন ওর খুব কদর ছিলো। মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে পার্কে, বীচে কত্ত ঘুরে বেরিয়েছে।
শুনেছে কারো কারো কপালে সুখ সয়না।তার ও সইলো না। কয়দিন পর ঝুপ করে ঠান্ডা নামলো, আর কাবার্ডের মাঝ থেকে সরে ওর জায়গা হলো ছোট্ট এক কোণে । দূর থেকে তাকিয়ে দেখতো বাহারী শীতের পোশাক। পার্পেল রঙের চমৎকার কাটের কোটটার কলারে গেঁথে থাকা মুক্তোটার নাক উঁচু
ভাব দেখে গা জ্বলে যেতো।শীতের পোশাক গুলোর টিপ টপ সাজগোজ দেখে মাঝেমাঝে নিজকে খুব ছোট মনে হতো। খুব নিসংগ ছিলো সেই দিন গুলো, অবহেলার তীক্ষ্ণ সুঁচের খোঁচা খেয়েই কাটতো রাত দিন।
এমনই এক শীতের সকালে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলো সে, হঠাতই গোলাপী গালের মিষ্টি মেয়েটা ওকে টেনে হাতে তুলে নিলো। আহ কতদিন পর ওর স্পর্শ পেলো,আবেগে মনটা ভিজে উঠতে না উঠতেই ওকে ছুঁড়ে ফেলা হলো কুচকুচে কালো ব্যাগে।চারদিকে অন্ধকার, আরো নানান আকারের কাপড়ের ভেতর ও গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো।
পাশেই একটা কাপড় নাকি সুরে বিলাপ জুড়েছে। দুলুনি থেকে টি শার্টটি বুঝতে পারছিলো ওদের গাড়ী করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সেই শুরু, এরপর যে কত কত গাড়ী আর জাহাজে চড়ে কত শত হাত গলে কত কত দেশ ঘুরে বেড়ালো। একদিন সে এসে পৌঁছুলো এক অদ্ভুত দেশে। এ দেশের বাতাস শুকতেই বুকের ভেতরটায় একটা টান অনুভব করলো। এখন তার পড়ন্ত বেলা, শরীরের এখানে সেখানে বয়সের হলদেটে ছাপ। দিনের বেশিটা সময় ঘুমিয়েই কাটে। কিন্তু এই নতুন দেশের মাটিতে নামার সাথে সাথে শরীরে এক রকম জোর পাচ্ছে যেন। দুইদিন পর জানতে পারলো এ দেশটির নাম বাংলাদেশ, এ যে তার জন্মভূমি। আহা শেকড়ের টান বুঝি একেই বলে।
এর ক'মাস পর সময়টা এখন ও মনে আছে, পূবে সুর্য সবে উঠি উঠি করছে, টি শার্টটি পড়ে ছিলো এক গাদা ময়লা কাপড়ের বাক্সে। হঠাত খসখস শব্দে তার ঘুম ভাঙে। একটা কালচে হাত তাকে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো, এরপর ওর গায়ে হাত বুলিয়ে হাত দুটো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আহা মায়ের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। সেই মায়াবতি মা কে সবাই মমতাজের মা বলে ডাকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। সেদিন ও কাজেই যাচ্ছিলো, ভাগ্যগুণে তাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিয়েছিলো। শেষ বাড়িতে কাজ করার সময় বেগম সাহেবের অনুমতি নিয়ে মমতাজের মা ওকে খুশবু মাখা সাবান দিয়ে সুন্দর করে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিয়েছিল। তার সারাটা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ভালোবাসা আর মায়া।
শেষ কবে গোসল করেছিলো মনে নেই। আর সেই গোসল মানে তো এত্ত বড় মেশিনে একগাদা দুর্গন্ধ যুক্ত কাপড়ের সাথে ডিগবাজি আর একগাদা নোংরা পানিতে নাকানী চুবানী। প্রতিবার ধোয়া শেষে টিশার্ট টি অসুস্থ হয়ে পড়তো। অথচ সেদিন মমতাজের মায়ের হাতের জাদুতে সে তো ঘুমিয়েই পড়েছিলো। ঘুম ভাংতেই দেখলো ও একটা ছোট্ট মেয়ের শরীরে ঝুলছে। সেই থেকে তার নতুন জীবনের শুরু। ছোট্ট মমতাজ তাকে কক্ষনো একা রেখে কোত্থাও যায় না। ওকে নিয়ে সে কত কি যে খেলে, মাঝে মাঝে মেয়েটা দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে, সে ও সংগ দেয়।
অথচ আজ ছোট্ট মমতাজ ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছে কিন্তু টি শার্টি তার দুমড়ে যাওয়া বুড়ো শরীর দিয়ে বাচ্চাটাকে এক টুকরো ওম দিতে পারছে না। কষ্টে তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে টি শার্টটি খনখনে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো
" সূর্য দেব এক মুঠো রোদ্দুর দাও, মেয়েটার গায়ে মাখিয়ে বাকিটা জীবন শুধু তোমারই বন্দনা করবো। দয়া করো প্রভূ, চাই এক ছটাক ওম ।"
তার হাহাকার বাতাসের দেয়ালকে ছোবল দিয়ে আবার তার কাছেই ফিরে এলো।
সূর্য ঘুমিয়ে আছে।
হরি ঘোষের উপাখ্যান
ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা-
------হুমায়ুন কবির ববি
হরিঘোষকে এ শহরটার যারা আদি বাসিন্দা তারা প্রায় সবাই চেনে।
একটা বদ্ধ পাগল, কতদিন স্নান করে না কে জানে।
হরির বাবার মত হরি, এই শহরটা যখন ছোট ছিল তখন থেকে গরুর মত কাঁধে জোয়াল নিয়ে চিৎকার করে "ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা" বলে বলে ছোট্ট শহরটার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বাড়ি বাড়ি ঘোল আর রসগোল্লা বেঁচে বেড়াতো।
৭১ এ ওর বাবা মাকে হত্যা করলো, বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে হরিকে ধরে মারতে থাকে।
হরি রাজাকার কমান্ডার খালেক মেম্বরের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, হুজুর আমাদের মারবেন না।
মেম্বর এর মাথায় কি এলো বললো, মুসলমান হয়ে আমাদের সাথে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিলে তোরে মারবো না।
আর আমার বাড়ির পাশের যে জমিটা ঐখানে থাকবি তোরা।
- সাহেব আপনি যা বলবেন সব করবানে, শুধু আমারে আর বউডারে ছাইড়ে দ্যান।
মেম্বরের বাড়ি থাকতো, সকালে তার সাথে রাজাকার ক্যাম্পে আসতো। রাজাকারের খাতায় তার নাম উঠায়ে দিয়েছিল, মাস গেলে ৭০ টাকা বেতন আর ১৫ কেজি চাল, ১০ কেজি আটা, তেল লবন পেত। মেম্বর কখনো বাড়িতে নামাজ পড়ত না, ক্যাম্পে যখন থাকতো তখন হরিকে নিয়ে নামাজ পড়তো। জুম্মার দিন মেম্বর বয়ান দিত ইসলাম আর পবিত্র ভূমি রক্ষায় মুসলমানদের আজ কি কাজ।
হরির নাম দিয়েছিল রহমত আলী, আর বউয়ের নাম আয়শা। মেম্বর নামাজের সময় ডাকতো "রহমত আলী "
- এইতো হুজুর
- চল নামাজে যায়।
- জি হুজুর চলেন।
কোন কোন রাতে হরি ওরফে রহমত আলীকে ক্যাম্পের নাইট ডিউটি দেয়া হত। সে রাতে সুরমা চোখে আর আতরের সুগন্ধি মেখে মেম্বর আয়শা বিবির ঘরে রাত কাটাতো। দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন আয়শা বিবির ছয় মাস। মেম্বর পালিয়ে গেছে, রহমত আলী হরি হয়ে ছয়মাসের পোয়াতি বউ শিমুলকে ৫৭০ সাবান ঘসে নিজের বাপের ছোট্ট ভিটেতে ওঠে আর চিৎকার করে " ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা"।
৩ মাস যেতে শিমুল রাজাকারের বাচ্চা পয়দা করতে যেয়ে মরে যায়। হরি বাচ্চাটাকে ধরে আছাড় মারতে গিয়ে, কোলে জড়ায়ে ধরে হাসতে থাকে আর বলতে থাকে এই রাজাকারের বাচ্চা এবার তুই কোথায় যাবি? আমি তোর নাম দিলাম নমশূদ্র ঘোষ, তুই রোজ মন্দিরে যাবি আর হরিনাম করবি।
সেই থেকে মাথাটা খারাব হয়ে যায় হরির।
কদিন পর কোন এক বিদেশি সংস্থার লোক এসে ছেলেটাকে নিয়ে যায় হরি তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করে। তাতেও হরির ভাল হবার লক্ষ্মণ না দেখে পাগলা গারদে ভর্তি করে দেয়। আশির দশকে একটু ভাল হলে হরি বাড়ি ফিরে দেখে তার জমিতে নতুন পাকা বাড়ি। নতুন রাজনীতির পান্ডা জাল দলিল করে তার চৌদ্দ পুরুষের ভিটায় নতুন কি সুন্দর বাড়ি বানায়েছে। ভাল লাগে বাচ্চাদের নিয়ে এক সুন্দরী নারীকে খেলা করতে দেখে।
গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে, ধেয়ে আসে বাড়ির দারোয়ান বের হয়ে যেতে বলে।
- এটা আমার জমি
- পাগল কি বলে
হরি বের হতে না চাইলে পিটিয়ে বের করে দেয়। সে সময় মাথায় আঘাত লাগে, হরি রাস্তায় পড়ে থাকে। হুশ হলে চিৎকার করে বলতে থাকে
"আমি মুসলমান হয়ে যাব মেম্বর হুজুর, আমার বউয়ের পেটে আপনি আবার রাজাকারের বাচ্চা জন্ম দেবেন। হা হা হা---"।
তারপর থেকে রাস্তায় হরি, হরি পাগলা। রাস্তায় থাকে, রাস্তায় ঘুমায়, রাস্তায় খাই। ছেড়ে যাওয়া ময়লা পোষাক, ছালা জড়ানো বাচ্চাদের ইট, ঠাট্টা, মানুষের অবহেলায় পার করে দেয় জীবনের ৭২ বছর।
হরি তার নাম কি মনে করতে পরেনা, হরিঘোষ নাকি রহমত আলী, তার ধর্ম কি সে সনাতনী না মুসলমান। তার দেশটার নাম কি পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশ,
না না সে কিছু মনে করত পারেনা।
হরির আজ কদিন কেমন গা ছম ছম করছে।
রাস্তায় চকরা বকরা পোষাকের অস্ত্রধারীরা ঘুরছে সাথে পুলিশ। মাইক দিয়ে কি সব বলছে তারা, বাড়ি যেতে বলছে। বাড়ি গেলে নাকি কিসের থেকে মুক্ত থাকা যাবে। সবার মুখে কি যেন বাঁধা। হরি বাড়ি যাবে কি করে, তার বাড়ি কোথায়, তারতো কোন বাড়ি নেই। রাত নামতে হরির কেন যেন ৭১ এর রাতের নিস্তব্ধতার কথা মনে হয়। তবে একটা বড় পার্থক্য তখন রাত বাড়ার সাথে সাথে গুলির আওয়াজ বাড়তো। কিন্তু এখন শুনশান, এ যেন মৃতপুরি, কোন মাতালো মাতলামি করতে করতে রাস্তা পার হয়না।
সকাল হলে হরি রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা কাপড় টুকরো ঐ গতকাল রাস্তার সবার মুখে বাঁধা দেখেছিল পড়ে থাকা দেখে কুড়িয়ে নিয়ে মুখে বাঁধে। সারাদিন তেমন কোন খাবার জোটেনা, গা গরম যেন বুঝতে পারে হরি, হাচ্চি হতে থাকে। এতদিন রাস্তায় রাস্তায় তার শরীর তেমন অসুস্থ হয়না শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায়।
৩/৪ দিন পর কাশতে থাকে হরি, গলার মধ্যে কেমন যেন চেপে ধরে দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় ৭১ এ মেম্বর রাজাকার কমান্ডারের নির্দেশে এক রাজাকার তার গলা পাড়িয়ে ধরলে তার যেমন দমবন্ধ হয়ে এসেছিল ঠিক তেমন দমবন্ধ হয়ে আসে। প্রচন্ড কাশি জ্বর,হরি জরের ঘোরে চিৎকার করতে থাকে।
"হুজুর আমায় মারবেন না, আমার বউডারে ছেড়ে দ্যান, আমি আপনি যা বলবেন তাই করবানে"। "ঘোল লাগবে ঘোল, রসোওগোল্লা "। "এই রাজাকারের বাচ্চা এবার তোর নাম দেব, এবার এবার"-----
বলতে বলতে হরির নিঃশাষ বন্ধ হয়ে যায়।
৭ এপ্রিল ২০২০।।
২২, টুটপাড়া প্রধান সড়ক, খুলনা
প্রতিশ্রুতি
অলভ্য ঘোষ
===================
ইন্দ্র, ২৭ তারিখ রাত একটায় ঠাকুরানী বাঁশ বাগানে আমার সাথে দেখা করো।
ইতি- সুস্মিতা
ওকি আবার নতুন করে ভালবাসবে আমায়।তবে কেন আমায় এভাবে ঘোরালো এতদিন।ফোনটা পাবার পর থেকে প্রতি কটা সেকেন্ড আমার মনে হয়েছে ভারী দীর্ঘ, কাটতেই চায়না।আজ চার বছর ওর মুখ থেকে একটিবারও ইন্দ্র ডাক শুনিনি।যতবারই ওর কাছে গেছি আমাকে চিনতে চায়নি ও।আমার ইচ্ছে করছে আবার নতুন করে বাঁচতে।তিলে তিলে ফুরিয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
১২.৩০ পৌঁছে গেছি ঠাকুরানী বাগানে।আসলে ওকে কাছে পাওয়ার প্রবল আকর্ষণ আমায় টানছিল, আমি আর ঘরে থাকতে পারছিলাম না।
চারিদিকে জোনাকির হাট।দূরে খড়ের চালের বাড়ির জানালা দিয়ে অর্থ বিকশিত তেলের বাতির আলো।আকাশে গোটা চাঁদ, বাঁশ বাগান টিকে আবছা আলোর অবগুণ্ঠনে মুড়ে রেখেছে।আজো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এই অজ গ্রামে।কলকাতা থেকে প্রায় চার ঘণ্টার রাস্তা।পূর্ণিমার এক সন্ধ্যায় সবার চোখের অলক্ষ্যেই আমার সাইকেলে চড়ে বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এই ঠাকুরানী তে এসেছিল সুস্মিতা।আমরা দুজনে মফস্বল গ্রামে মানুষ। ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়েছিল, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম-
-“তোমার ভয় করছে না”।
ও নির্বিকার-ভাবে বলেছিল- “কিসের ভয়”
আমি বলেছিলাম-
“এই নির্জনে একা------”।
-“কে। ......... কে বলল একা, তুমি তো কাছে আছো।”
এরপর কেউ আর কোন কথা বলতে পারিনি। দুজনেই চেয়েছিলাম দুজনের দিকে। ও আমার
কাছে এগিয়ে এলো, সপে দিল নিজেকে আমার বুকে।আলিঙ্গন বদ্ধ এক দীর্ঘ চুম্বন।
বেসামাল হয়ে গেছিল সুস্মিতা। আমার হাতে মেলে দিচ্ছিল নিজেকে।ইচ্ছে করলে
আরও বহু দূর এগোতে পারতাম, কিন্তু এগুইনি। কারণ সত্যিই আমি ওকে ভালোবাসি।ওর
কোন ক্ষতি আমি চাইনি কোনদিনই।এই মূল্য পেলাম, আমার ভালোবাসার।মেডিকেল
কলেজে ও যখন এমবিবিএস পড়ছে। দিনের পর দিন কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে
থাকতাম ওর জন্য।ওর বন্ধুরা নাকি হাসাহাসি করত, তাই বন্ধ হল ওখানে
দাঁড়ানো।বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় ওর সাথে দেখা করতাম।আর যেদিন দেখা হতো
না, ভীষণ মন খারাপ করত।পরের দিন অভিমান দেখিয়ে বলতাম-
"একটা ছাপোষা সাধারণ ছেলেকে এমবিবিএস ডাক্তার মেয়ে পাত্তা দেবে কেনও ------"
কথাটা শেষ করার আগেই আমার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরত সুস্মিতা।
“চুপ করো। আমি তোমার কাছে শুধুই তোমার। আর কিছু না………… কিছু না।”
ভালবাসার সমুদ্রে নিমজ্জিত আবেগের তরঙ্গে আচ্ছাদিত প্রত্যেক প্রেমিকাই হয়তো এ কথা বলে থাকে।তারপর যখন, আবেগের আচ্ছাদন হয় অপসারিত, সেই মানুষগুলো হারিয়ে যায়।কথা গুলো রয়ে যায়।কথাগুলো বিবর্ণ মনের মধ্যে প্রতিটা মুহূর্তে আঘাত করে চলে।
কথা দিয়ে তুমি রাখতে পারলে না সুস্মিতা। চার চারটে বছর আমি হন্যে হয়ে তোমার জন্য ঘুরছি।তুমি ভুলে গেছো আমাকে।নাম যশ, খ্যাতি তে তোমার সমকক্ষ নই।আমার বাড়ি নেই, গাড়ী নেই, নেই মোটা ব্যাংক-ব্যালেন্স।তাই আমার ভালোবাসার আজ মূল্য ও নেই তোমার কাছে।কেন সেদিন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমাকে? এই চার বছরে আমি যতবার তোমার সাথে দেখা করতে গেছি;তুমি আমার সাথে অপরিচিতার নাটক করেছ। নিজের সম্মান বাঁচাতে অস্বীকার করছ আমাদের সম্পর্ককে।লোক দিয়ে আমাকে তোমার ডিসপেনসারির বাইরে বার করে দিয়েছ ।আমার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, কারণ তুমি সবার চোখে এখন ডঃ সুস্মিতা ব্যানার্জী।তবে কেনও আমায় ডেকে আনলে এই নির্জনে।তবে কি তোমার মনে পড়লো প্রতিশ্রুতির কথা।
ঘড়ির দিকে তাকায় ইন্দ্র।
ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় একটা।তোমার দেখা নেই।এবারেও হয়তো তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রাখবে না।ভীষণ স্বার্থপর তুমি; নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝ না বুঝতে চাও না।তুমি আর একবার আমাকে ঠকালে সুস্মিতা।তুমি তো সব পেয়েছ আমাকে ঠকিয়ে; তবুও আশা মেটে না।শেষবার তোমার কাছ থেকে যেদিন অপমানিত হয়ে গলা ধাক্কা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম;ঠিক করেছিলাম; তিলে তিলে নিজেকে শেষ করব। রাত দিন বেপরোয়া মদ খেতে শুরু করলাম।এ পৃথিবীটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল।তুমি আমার জীবন টাকে বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছ। বাঁচার সবটুকু সম্বল কেড়ে নিয়েছ।
প্রাণহীন একটা লাশের মত জীবন কাটছিল।ঠিক সেইসময় এই ফোনটা যেন মৃত শরীরে আবার প্রাণের সঞ্চার ঘটাল।প্রলোভন দেখাল নতুন করে বাঁচার।
বোকার মত বকে চলে ইন্দ্র,শ্রোতা এই নির্বাক বাঁশ বাগান,মাঠ,রাতের আকাশ,চাঁদ।কোথায় সুস্মিতা?বেডরুমে স্বামীর বুকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়তো এখন।
একটা আলো ইন্দ্রর পিঠ স্পর্শ করল।বাঁশঝাড়ের গায়ে
প্রতিফলিত ইন্দ্রর ছায়াটা ক্রমে ক্রমে ছোট হয়ে এলো।গাড়ির আওয়াজে পিছন
ফিরল ইন্দ্র।
সাদা একটা প্রাইভেট কার আস্তে আস্তে মাটির রাস্তা বেয়ে
এগিয়ে এলো।কালো চাদর মোড়া অস্পষ্ট মুখ।বাঁ হাতে একটা ব্রিফকেস,মাঝারি
দৈর্ঘ্য-প্রস্থর একটি দেহ ইন্দ্রর কাছে এসে দাঁড়ালো।ইন্দ্রর চেনা,পুরানো
সেই গলা।যার বর্ণনা ইন্দ্র কোনদিন খুঁজে পাইনি।খুঁজে পায়নি তার সমতুল্য
বিকল্প কিছু।
-সরি একটু দেরি হয়ে গেল।
সুস্মিতা এসেছে,ইন্দ্রর জন্যও এসেছে।ইন্দ্রর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে প্রবল আনন্দে।
-আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না,এবারও তোমার কথা রাখবে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে উভয়ে।
-“একা ড্রাইভ করে এলে।”
- “ফাঁকা রাস্তা খুব একটা অসুবিধা হয়নি”।
-“তোমার স্বামী জানেন? ”
-“না। ”
-“আজ চার বছর বারবার চিনতে অস্বীকার করেছো।তবে হঠাৎ আবার এমন।রাত একটায় এই নির্জনে তোমার আসাটা ঠিক হয়নি । ”
বেদনার্ত সুস্মিতা;
-“তোমার কাছে একটু সুখ ভিক্ষা চাইবো।তুমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করো
ইন্দ্র।ভুলে যাও আমাকে।এই মাঝ রাতে স্বামী পুত্র কে লুকিয়ে চোরের মত এখানে
এসেছি অতীতের কোন ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে।”
ইন্দ্র অবরুদ্ধ প্রায়। কথার মাঝে প্রবল ব্যঙ্গ।
-“ও তাই বলুন। ভুল তাহলে আপনারাও করেন ডঃ ব্যানার্জী।”
সুস্মিতার কণ্ঠে রুক্ষতা প্রস্ফুটিত হল;
-“বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই।ভোর হবার আগেই আমায় বাড়ি ফিরতে হবে।”
-“বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?”
-“একটু শান্তি!আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।তোমার জ্বালায় আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।আমি কি পাপ করেছিলাম বলতো?কোন এক সময় তোমায় ভালবেসেছিলাম।তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু পারলাম না;বাবা মায়ের চাপে পড়ে………।”
ইন্দ্রর উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ টা যেন গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। -"মিথ্যে……… সব মিথ্যে।”
-“না মিথ্যে নয়,বিশ্বাস করো,এ বিয়েতে আমার মত ছিল না।দাদা বাবা জোর করে ধরে বেঁধে বিয়েটা দিয়ে দিল। তুমি-তো জানো ওরা চাইত না তোমার সঙ্গেই আমার......... "
ইন্দ্রর কাটা জায়গায় সুস্মিতা যেন নুন ছিটিয়ে দিল;
-"জানি আমি এফ,আর, সি. এস.এম.বি.বি.এস নই।যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সামান্য একটা এম.এ...."
-"কিন্তু তুমি তো তুমি চাইলেই তো। ......."
বাধা দেয় ইন্দ্র;
-"থাক!"
-"কেন থাকবে,সেদিন ওভাবে কাপুরুষের মত পালিয়ে গিয়েছিলে কেন?"
-“পালিয়ে গিয়েছিলাম?তুমিই তো বলেছিলে জলপাইগুড়ির চাকরিটা নিতে!"
-"কারণ তোমার স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজন ছিল।তবলে একটা ফোন নয় চিঠি নয়।"
-"কোথায় ফোন করবো। কোথায় চিঠি পাঠাব।(উল্লেখ্য এই গল্প যখন লেখা তখন কেবল ল্যান্ড ফোন উপলব্ধ ছিল।)তোমার বাড়ির লোকজন..!মাস তিনেকের মধ্যে সেটেল হয়ে তোমাকে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম।"
-"জীবনটা ইন্দ্ররা বিকাশ পত্র নয়। সবকিছু ভেবে চিন্তে হবে না।চাকরিটা ছাড়লে কেন?"
-"যার জন্য চাকরি সে যখন....."
-"জীবনে তোমার কোন এম নেই। "
-"ছিল এখন লক্ষ্য ভ্রষ্ট।"
– "আচ্ছা তোমার ইচ্ছা হয় না আমাকে দেখে? আমার মত সুখী হতে মন চায় না?লোকে তোমাকে সাইকিয়াস্টিক পেশেন্ট বলে মনে করে!"
-“তবে আজ চলে আসো আমার কাছে ”।
-“আমার স্বামী সন্তান সব ফেলে।"
-“ সবকিছু ছেড়ে নতুন করে”।
-“ তা আর হয় না ইন্দ্র।”
-“কেন হয় না?এই তো বললে জীবন হিসেবের খাতা নয়।"
-“সলিল যে আমায় ভীষণ ভালবাসে।"
-আমি পারবো না সলিল কে ঠকাতে,ফুটফুটে বাচ্চা টা কে মাহারা করতে।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সুস্মিতা।
আবার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ প্রকাশ পায় ইন্দ্রের ভাষায়।
-“কাঁদছেন ডক্টর ব্যানার্জী বলতে পারেন আমাকে কেন ঠকালেন।জানেন আপনাকে হারিয়ে প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার কেমন কেটেছ।”
-“জানি ইন্দ্র,আমি জানি। কিন্তু সলিল ও যে আমায় ভালবাসে,ওর স্বচ্ছ ভালোবাসা কে কি করে ঘোলা করে দিই বলও।”
-“বা কি বিচার আপনার। ভালবাসার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটা লোককে দলা মোচড়া করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আবর্জনার মতো।তাকেই আবার বলছেন স্বচ্ছ ভালোবাসার গল্প।”
-“আমি জানি ইন্দ্র তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না।আমি এই ব্রিফকেসে কিছু টাকা এনেছি।তুমি দূরে কোথাও চলে যাও।এখানকার মাঠ-ঘাট আকাশ,রাস্তা সবই যে একদিন আমাদের প্রেমের…।”
-“এটা কি আপনার প্রায়শ্চিত্ত।”
-“না ইন্দ্র না!তোমাকে আমি এভাবে তিলে তিলে নষ্ট হয়ে যেতে দেখতে পারবো না।তোমার আমার সম্পর্ক আমি অস্বীকার করলেও, লোকে তা নিয়ে রসালো গল্প জুড়েছে।সলিল আমায় বিশ্বাস করে তাই কথাটার এখনো কোনও গুরুত্ব দেয়নি।একদিন সেই বিশ্বাসটাও নষ্ট হয়ে যাবে।তুমি এভাবে দিনের পর দিন আমার ক্লিনিকে যেতে থাকলে।আমি সলিল কে কষ্ট দিতে চাই না। ”
-“তা দেবেন কেন, আমার মত একটা ফালতু লোক তো তিনি নন।আপনি আমার ভালোবাসার মূল্য দিতে এসেছেন।কিন্তু মিসেস ব্যানার্জী ওই ব্রিফকেসের টাকায় যে তার ছিটে ফোঁটাও বেচতে আমি রাজি নোই।”
-“কি চাও তবে তুমি?”
-“আমি আপনাকে চাই।যে প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি আপনার জন্য নিজেকে শেষ করেছি তার মাশুল শুধুমাত্র আপনি।”
পাগল হয়ে গেলে ইন্দ্র এগিয়ে চলল সুস্মিতার দিকে।চোখ দুটো বিস্ফোরিত প্রায়।
-“একি;অমনভাবে আমার দিকে এগিয়ে এসো না ইন্দ্র। পাগলামি করো না। আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো।”
-“হ্যাঁ আমি আপনাকে ভালোবাসি।তাই আমার ভালোবাসা কে আর কারো হতে দেবো না। এখানেই তোমার গলা টিপে শেষ করে দেবো।”
-“ না তুমি তা পারো না ইন্দ্র, কখনোই পারো না, কখনো না।"
উদ্যত ইন্দ্র কে দেখে ভীত সুস্মিতা পিছু হাটে,পিঠ ঠেকে প্রাইভেট-কারে।
-“ইন্দ্র,আর এগিয় না।আমার কাছে রিভলভার আছে।”
ইন্দ্র এগিয়ে চলে, সুস্মিতা কাঁধের ব্যাগ থেকে রিভলভারটা বার করে।
-“আমি তোমায় গুলি করে দেবো।"
হেসে ওঠে ইন্দ্র,আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে।
-“করো গুলি করো, মরতে আমি ভয় পাই না।”
-“প্লিজ,আর এগিয় না ইন্দ্র”।
ব্রিফকেস ফেলে দুহাতে রিভলভারটা শক্ত করে ধরে সুস্মিতা।ইন্দ্র প্রবল গতিতে ওর হাতটা চেপে ধরে।এক সময় হাত মুচড়ে কেড়ে নেয় রিভলভারটা।
-“এবার সুস্মিতা ব্যানার্জী । ”
রিভলভারের মুখ সুস্মিতার দিকে।ইন্দ্র হাসতে থাকে;
-"আমি কথা দিলাম বহুদূর চলে যাব, আর কখনো আসবো না তোমার কাছে, কখনো না।আমার প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ হবে না,আমার প্রেম ব্যর্থ নয়----।”
ট্রিগারে ইন্দ্রর আঙ্গুলটা আস্তে আস্তে চেপে বসছে;চোখ বন্ধ করে দুহাতে সুস্মিতা মুখ ঢেকে নিলো। গুড়ুম একটা আওয়াজ।একটা গুলি চলেছে যার প্রতিধ্বনি রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে চারিদিকে কাঁপিয়ে রক্তের ফোয়ারা হয়ে ছুঁয়েছে সুস্মিতার শরীর।সুস্মিতা চিৎকার করে উঠল। না গুলিটা তার বুকে চলেনি,চলেছে ইন্দ্রের মাথায়,মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে ইন্দ্র।
রক্তাক্ত ইন্দ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সুস্মিতা। চোখ বুজল ইন্দ্র।
-“না, ইন্দ্র আমি এ চাইনি।আমি চেয়েছিলাম তোমার কাছে প্রার্থনা করবো নতুন করে জীবন শুরু করো তুমি,সম্পূর্ণ নতুন ভাবে দূরে কোথাও-----।ভেবেছিলাম তুমি যদি তবুও আমার প্রার্থনা গ্রহণ না করো,আর বাড়ি ফিরব না শেষ করে দেবো নিজেকে।কারণ সলিল আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।আমি যে ওর বিশ্বাসের জায়গাটা ঝাঁজরা হয়ে যেতে দেখতে পারবো না।সব ওলট পালট হয়ে গেল।তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারলে না। যে ভয় আজ চার বছর ধরে আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছে তাকে আরও সত্যি করে দিলে তুমি।যে রিভলভারের গুলিতে তোমার মাথা রক্তাক্ত হল;কাল তার লাইসেন্স পাওয়া যাবে আমার বেডরুমের ড্রয়ারে।সলিলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার আমার সম্পর্কের সত্যতা।আমি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হব।তোমার মত অও আমায় বলবে প্রতারক।কেউ বুঝবে না আমাকে।কেউ বোঝেনি আমাকে।তুমি না সলিল না। কেউ না।ইন্দ্র তুমি চাও সব ছেড়ে সলিলকে ছেড়ে মুন্না কে ছেড়ে আমি তোমার কাছে আসি।তাই আসছি আমি।আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো ইন্দ্র।আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো।
পুনর্বার একটা আওয়াজ আবার রাতের আকাশ জেগে উঠল।ইন্দ্রর বুকে মুখ গুজে পড়ে রইলো ডক্টর সুস্মিতা ব্যানার্জীর বডি টা। পূর্ণিমার চাঁদ যেন কোথায় যেন আবছা হতে হতে লুকিয়ে পড়েছে। পূবের আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে।অন্ধকার কাটিয়ে আসছে দিন। চারিদিকে পাখির ডাক।ইন্দ্র আর সুস্মিতা দীর্ঘ প্রতীক্ষার সময় কাটিয়ে গভীর নিদ্রায় ঘুমাচ্ছন্ন।
No comments:
Post a Comment