নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজি হতে শতবর্ষ-পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে-
আজি হতে শতবর্ষ-পরে।
আজি নব বসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ-
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ-পরে।।
তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে-
একদিন শতবর্ষ-আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্ স্বর্গ হতে ভাসি
নিখিলের মর্মে আসি লাগে,
নবীন ফাল্গুনদিন সকল-বন্ধন-হীন
উন্মত্ত অধীর-
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দেয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ-আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে হৃদয় মগন গানে,
কবি এক জাগে-
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ-আগে। ।
আজি হতে শতবর্ষ-পরে
এখন করিছে গান সে কোন্ নুতন কবি
তোমাদের ঘরে!
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে-
হৃদয়স্পন্দনে তব, ভ্রমরগুঞ্জনে নব,
পল্লব মর্মরে,
আজি হতে শতবর্ষ-পরে।।
হঠাৎ দেখা
-------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু --
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় --
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
"কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, "বলব।"
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, "থাক্, এখন যাও ও দিকে।"
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।
অনন্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে—
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি—
সকল কালের সকল কবির গীতি |
চিরায়মানা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।
.
যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,
নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।
কাঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।
যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।।
এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।
ভয় কোরো না - অলক্তরাগ মোছে যদি মুছিয়া যাক,
নূপুর যদি খুলে পড়ে নাহয় রেখে এলে।
খেদ কোরো না মালা হতে মুক্তা খসে গেলে।
এসো দ্রুত চরণদুটি তৃণের 'পরে ফেলে।
হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।
ও পার হতে দলে দলে বকের শ্রেণী উড়ে চলে,
থেকে থেকে শূন্য মাঠে বাতাস ওঠে জেগে।
ওই রে গ্রামের গোষ্ঠমুখে ধেনুরা ধায় বেগে।
হেরো গো ওই আঁধার হল, আকাশ ঢাকে মেঘে।।
প্রদীপখানি নিবে যাবে, মিথ্যা কেন জ্বালো?
কে দেখতে পায় চোখের কাছে কাজল আছে কি না আছে,
তরল তব সজল দিঠি মেঘের চেয়ে কালো।
আঁখির পাতা যেমন আছে এমনি থাকা ভালো।
কাজল দিতে প্রদীপখানি মিথ্যা কেন জ্বালো?।
এসো হেসে সহজ বেশে, আর কোরো না সাজ।
গাঁথা যদি না হয় মালা ক্ষতি তাহে নাই গো বালা,
ভূষণ যদি না হয় সারা ভূষণে নাই কাজ।
মেঘ মগন পূর্বগগন, বেলা নাই রে আজ।
এসো হেসে সহজ বেশে, নাই-বা হল সাজ।।
- শেষের কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল
তুলে নিল দ্রুত রথে
দুঃসাহসী ভ্রমনের পথে
তোমা হতে বহু দূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চূড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে তোমার প্রাণের প্রাণে,
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সবচেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় -
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলাম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু বিদায়।
তোমায় হয়নি কোনো ক্ষতি।
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত মুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি
হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষ্ণার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবদ্যের থালে।
তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত'ষায়
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে বচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু বিদায়।
মোর লাগি করিয়ো না শোক-
আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উ'কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সে ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে
সে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,
ওগো নিরূপম,
হে ঐশ্বর্যবান
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু বিদায়।
"প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস"
প্রহরশেষের আলোয়
রাঙা সেদিন চৈত্রমাস–
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ।।
এ সংসারের নিত্যখেলায়
প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়
বাটে ঘাটে হাজার লোকের
হাস্য-পরিহাস–
মাঝখানে তার তোমার
চোখে আমার সর্বনাশ।।
আমের বনে দোলা লাগে,
মুকুল প’ড়ে ঝ’রে–
চিরকালের চেনা গন্ধ
হাওয়ায় ওঠে ভ’রে।
মঞ্জরিত শাখায় শাখায়, মউমাছিদের পাখায় পাখায়,
ক্ষণে ক্ষণে বসন্তদিন
ফেলেছে নিশ্বাস–
মাঝখানে তার তোমার
চোখে আমার সর্বনাশ।
**কৃপণ**
আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম
গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে
তোমার স্বর্ণরথে।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম
লাগতেছিল চক্ষে মম--
কী বিচিত্র শোভা তোমার,
কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবেতেছিলেম,
এ কোন্ মহারাজ।
আজি শুভক্ষণে রাত পোহালো
ভেবেছিলেম তবে,
আজ আমারে দ্বারে দ্বারে
ফিরতে নাহি হবে।
বাহির হতে নাহি হতে
কাহার দেখা পেলেম পথে,
চলিতে রথ ধনধান্য
ছড়াবে দুই ধারে--
মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব,
নেব ভারে ভারে।
দেখি সহসা রথ থেমে গেল
আমার কাছে এসে,
আমার মুখপানে চেয়ে
নামলে তুমি হেসে।
দেখে মুখের প্রসন্নতা
জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা,
হেনকালে কিসের লাগি
তুমি অকস্মাৎ
"আমায় কিছু দাও গো' বলে
বাড়িয়ে দিলে হাত।
মরি, এ কী কথা রাজাধিরাজ,
"আমায় দাও গো কিছু'!
শুনে ক্ষণকালের তরে
রইনু মাথা-নিচু।
তোমার কী-বা অভাব আছে
ভিখারী ভিক্ষুকের কাছে।
এ কেবল কৌতুকের বশে
আমায় প্রবঞ্চনা।
ঝুলি হতে দিলেম তুলে
একটি ছোটো কণা।
যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজাড় করি-- এ কী!
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো
সোনার কণা দেখি।
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে--
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।
**অপমানিত**
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান |
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ||
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে |
বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের-দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান |
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ||
তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তিরে তব নির্বাসন দিলে অবহেলে |
চরণে দলিত হয়ে ধুলায় সে যায় বয়ে-
সে নিম্নে নেমে এসো, নহিলে নাহি রে পরিত্রাণ |
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান ||
যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমার বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমার পশ্চাতে টানিছে |
অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গরিছে সে ঘোর ব্যবধান |
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান ||
শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার,
মানুষের নারায়নে তবুও কর না নমস্কার |
তবু নত করি আঁখি দেখিবারে পাও না কি
নেমেছে ধুলার তলে হীনপতিতের ভগবান |
অপমানে হতে হবে সেথা তোরে সবার সমান ||
দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদ্যুত দাঁড়য়েছে দ্বারে-
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকার-এ |
সবারে না যদি ডাকো, এখনো সরিয়া থাকো,
আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান-
মৃত্যু-মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান ||
ভারত তীর্থ ## রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর। হে মোর চিত্ত,পূণ্য তীর্থেজাগো রে ধীরে–এই ভারতের মহামানবেরসাগরতীরে।হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়েনমি নর-দেবতারে,উদার ছন্দে পরমানন্দেবন্দন করি তাঁরে।ধ্যান-গম্ভীর এই যে ভূধর,নদীজপমালাধৃত প্রান্তর,হেথায় নিত্য হেরো পবিত্রধরিত্রীরেএই ভারতের মহামানবেরসাগরতীরে।কেহ নাহি জানে কার আহ্বানেকত মানুষের ধারাদুর্বার স্রোতে এল কোথা হতেসমুদ্রে হল হারা।হেথায় আর্য, হেথা অনার্যহেথায় দ্রাবিড়, চীন–শক-হুন-দল পাঠান মোগলএক দেহে হল লীন।পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,সেথা হতে সবে আনে উপহার,দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবেযাবে না ফিরে,এই ভারতের মহামানবেরসাগরতীরে।রণধারা বাহি জয়গান গাহিউন্মাদ কলরবেভেদি মরুপথ গিরিপর্বতযারা এসেছিল সবে,তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজেকেহ নহে নহে দূর,আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতেতারি বিচিত্র সুর।হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো,ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজো,বন্ধ নাশিবে, তারাও আসিবেদাঁড়াবে ঘিরেএই ভারতের মহামানবেরসাগরতীরে।হেথা একদিন বিরামবিহীনমহা ওংকারধ্বনি,হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রেউঠেছিল রনরনি।তপস্যাবলে একের অনলেবহুরে আহুতি দিয়াবিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিলএকটি বিরাট হিয়া।সেই সাধনার সে আরাধনারযজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার,হেথায় সবারে হবে মিলিবারেআনতশিরে–এই ভারতের মহামানবেরসাগরতীরে।সেই হোমানলে হেরো আজি জ্বলেদুখের রক্ত শিখা,হবে তা সহিতে মর্মে দহিতেআছে সে ভাগ্যে লিখা।এ দুখ বহন করো মোর মন,শোনো রে একের ডাক।যত লাজ ভয় করো করো জয়অপমান দূরে থাক।দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসানজন্ম লভিবে কী বিশাল প্রাণ।পোহায় রজনী, জাগিছে জননীবিপুল নীড়ে,এই ভারতের মহামানবেরসাগরতীরে।এসো হে আর্য, এসো অনার্য,হিন্দু মুসলমান।এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,এসো এসো খৃস্টান।এসো ব্রাহ্মণ শুচি করি মনধরো হাত সবাকার,এসো হে পতিত করো অপনীতসব অপমানভার।মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরামঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা,সবারে-পরশে-পবিত্র-করাতীর্থনীরে।আজি ভারতের মহামানবেরসাগরত দেবতার গ্রাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে
মৈত্র মহাশয় যাবেন সাগরসংগমে
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি
কত বালবৃদ্ধ নরনারী, নৌকা দুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে।।
পুণ্য লোভাতুর
মোক্ষদা কহিল আসি, ‘হে দাদাঠাকুর,
আমি তব হব সাথি।’ বিধবা যুবতী,
দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
কেবল মিনতি করে-অনুরোধ তার
এড়ানো কঠিন বড়ো ‘স্থান কোথা আর’
মৈত্র কহিলেন তারে। ‘পায়ে ধরি তব’
বিধবা কহিল কাঁদি, স্থান করি লব
কোনোমতে এক ধারে।’ ভিজে গেল মন;
তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাহ্মণ,
‘নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?’
উত্তর করিল নারী, ‘রাখাল? সে রবে
আপন মাসির কাছে। তার জন্ম-পরে
বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে,
বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন
আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন
মানুষ করেছে যতেœ- সেই হতে ছেলে
মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে।
দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন
কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
মার চেয়ে আপনার মাসির বুকে।’
সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর
প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর,
প্রণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে
ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে।
ঘাটে আসি দেখে-সেথা আগেভাগে ছুটি
রাখাল বসিয়া আছে তরী-’পরে উঠি
নিশ্চিন্ত নীরবে। ‘তুই হেথা কেন ওরে’
মা শুধালো; সে কহিল, ‘যাইব সাগরে।’
‘যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে,
নেমে আয়।’ পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে
সে কহিল দুটি কথা, ‘যাইব সাগরে।’
যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে
রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে
ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে,
‘থাক্ থাক্ সঙ্গে যাক্।’ মা রাগিয়া বলে
‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!’
যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে
অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে
বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
‘নারায়ণ নারায়ণ’ করিল স্মরণ।
পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে
করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে।
মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়,
‘ছি ছি ছি এমন কথা বলিবার নয়।’
রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা-
অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা
ছুটে আসি বলে, ‘বাছা, কোথা যাবি ওরে!’
রাখাল কহিল হাসি, ‘চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসি!’ পাগলের প্রায়
অন্নদা কহিল ডাকি, ‘ঠাকুরমশায়,
বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
কে তাহারে সামালিবে? জন্ম হতে তার
মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও-
কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।’
রাখাল কহিল, ‘মাসি, যাইব সাগরে,
আবার ফিরিব আমি।’ বিপ্র স্নেহভরে
কহিলেন, ‘যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
তোমার রাখাল লাগি কোনো ভয় নাই।
এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ,
অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ
কিছু নাই; -যাতায়াত মাস-দুই কাল-
তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।’
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি
দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে
ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।
যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হল মেলা।
তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্নবেলা
জোয়ারের আশে। কৌতূহল অবসান,
কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ
মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।
মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর
খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা
ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক,
অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন,
সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন
শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে
অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে
অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে
দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে!
চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
অধীর উৎসুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে,
‘ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?
সহসা স্তিমিত জলে আবেগসঞ্চার
দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে
কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দগীতে
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে-
আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি
ত্বরিত উত্তর-মুখে খুলে দিল তরী।
রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে,
‘দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?’
সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
উত্তর-বায়ুর বেগ ক্রমে ওঠে বেড়ে।
রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর
সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর
জোয়ারের ¯্রােতে আর উত্তরসমীরে
উত্তাল উদ্দাম। ‘তরণী ভিড়াও তীরে’
উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল।
কোথা তীর? চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল
আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি
ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা
অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা,
অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিং¯্র বারিরাশি
প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
উদ্ধত বিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল
মূঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে
মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্,
কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ে ঊর্ধ্বডাক
ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
চক্ষু মুদি করে জপ। জননীর বুকে
রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে।
তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে,
‘বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ-
যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ-
অসময়ে এ তুফান! শুন এই বেলা,
করহ মানত রক্ষা, করিয়ো না খেলা
ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।’ যার যত ছিল
অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল
না করি বিচার। তবু তখনি পলকে
তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে।
মাঝি কহে পুনর্বার, ‘দেবতার ধন
কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন্।’
ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি
মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, ‘এই সে রমণী
দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে
চুরি করে নিয়ে যায়।’ ‘দাও তারে ফেলে’
এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর
যাত্রী সবে। কহে নারী, ‘হে দাদাঠাকুর,
রক্ষা করো, রক্ষা করো!’ দুই দৃঢ় করে
রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।
ভর্ৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ,
‘আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশ্চেতন
মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে,
শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে!
শোধ্ দেবতার ঋণ; সত্য ভঙ্গ করে
এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে!’
মোক্ষদা কহিল, ‘অতি মূর্খ নারী আমি,
কী বলেছি রোষবশে-ওগো অন্তর্যামী,
সেই সত্য হল: সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর?
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা?
শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?’
বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি
বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি
মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি
দন্তে দন্তে চাপি বলে। কে তারে সহসা
মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা-
দংশিল বৃশ্চিকদংশ। ‘মাসি! মাসি! মাসি!’
বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
চীৎকারি উঠিল বিপ্র, ‘রাখ্ রাখ্ রাখ্?!’
চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে প’ড়ে
মোক্ষদা চরণে তাঁর, মুহূর্তের তরে
ফুটন্ত তরঙ্গমাঝে মেলি আর্ত চোখ
‘মাসি’ বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক
অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি,
বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
‘ফিরায়ে আনিব তোরে’ -কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে-
আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।
বাঁশি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিনু গোয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
পথের ধারেই।
লোনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধ্ব’সে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে শ্যাঁতা-পড়া দাগ।
মার্কিন-থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গণেশের
দরজার পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাৎ আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব।
বেতন পঁচিশ টাকা
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানী।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি;
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে দশ বেজে যায়।
তারপরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।
ধলেশ্বরী-নদী তীরে পিসিদের গ্রাম।
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া-
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
বর্ষা ঘন ঘোর।
ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে পচে ওঠে
আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
মাছের কান্কা,
মরা বেড়ালের ছানা,
ছাইপাঁশ আরো কত কী যে!
ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
মাইনের মতো,
বহু ছিদ্র তার।
আপিসের সাজ
গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
বাদলের কালো ছায়া
স্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
কলে-পড়া জন্তুর মতন
মূর্ছায় অসাড়।
দিন রাত মনে হয়, কোন্ আধমরা
জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।
গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু,
যতেœ-পাট-করা লম্বা চুল,
বড়ো বড়ো চোখ,
শৌখিন মেজাজ।
কর্নেট বাজানো তার শখ।
মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
এ গলির বীভৎস বাতাসে–
কখনো গভীর রাতে,
ভোরবেলা আধো অন্ধকারে,
কখনো বৈকালে
ঝিকিমিকি আলোয় ছায়ায়।
হঠাৎ সন্ধ্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
সমস্ত আকাশে বাজে
অনাদি কালের বিরহবেদনা।
তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
এ গলিটা ঘোর মিছে,
দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো।
হঠাৎ খবর পাই মনে
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে।
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী;
তীরে তমালের ঘন ছায়া;
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
পৃথিবী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে॥
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্দ্বে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রুপে;
দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর র্দুমূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।
তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছ প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম,
ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক।
জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি-
সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।
তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ,
ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে॥
তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের প্রতাপ ছিল দুর্জয়-
সে পরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়
তার অঙ্গুলি ছিল স্থুল, কলাকৌশলবর্জিত;
গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত;
অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশ।
জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি,
প্রাণের ’পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা॥
দেবতা এলেন পরযুগে,
মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের-
জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;
জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।
ঊষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,
পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট॥
নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব,
তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।
ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃক্সক্ষলতা-
তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে।
তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি।
দেবতার মন্ত্র উঠছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে
দিনে রাত্রে
উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে।
তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে ফনা তুলে-
তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করছ আঘাত,
ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে॥
শুভে-অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে,
তোমার প্রচন্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে
আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত জীবনের প্রণতি।
বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর, গুপ্ত সঞ্চার তোমার যে মাটির তলায়
তাকে আজ স্পর্শ করি, উপলব্ধি করি সর্ব দেহে মনে।
অগণিত যুগযুগান্তরের অসংখ্য মানুষের লুপ্তদেহ পুঞ্জিত তার ধূলায়।
আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্ঠি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদুঃখের শেষ পরিণাম-
রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল পরিচয়-গ্রাসী
নিঃশব্দ ধূলিরাশির মধ্যে॥
অচল অবরোধ আবদ্ধ পৃথিবী মেঘলোকে উধাও পৃথিবী,
গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্না পৃথিবী,
নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গে কমলন্দ্রমুখরা পৃথিবী,
অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তা তুমি ভীষণা।
এক দিকে আপক্বধান্যভারনম্র তোমার শস্যক্ষেত্র-
সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু
কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে;
অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী
‘আমি আনন্দিত’।
অন্যদিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্রে
পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য।
বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল
কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়-
সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ;
তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু ক’রে
হতাশ বনস্পতি ধূলায় পড়ল উবুড় হয়ে;
হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল
শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো।
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে
অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে॥
স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা,
অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে
সংখ্যাগণনার-অতীত প্রত্যুষে;
তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ
শত শত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ;
বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তোমার বর্জিত সৃষ্টি
অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে॥
জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ
তোমার খন্ডকালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে,
তারই মধ্যে সব খেলার সীমা, সব কীর্তির অবসান॥
আজ আমি কোন মোহ নিয়ে আসিনি তোমার সম্মুখে;
এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে
তার জন্যে অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে।
তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্য প্রদক্ষিণের পথে
যে বিপুল নিমেষগুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে
তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো-একটি আসনের
সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি,
জীবনের কোনো-একটি ফলবান্ খন্ডকে
যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে
তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে;
সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে
যে রাতে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে॥
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি॥
ক্যামেলিয়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নিচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।
এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই-
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোন সম্বন্ধ না থাক
ও তো আমার সহযাত্রিনী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝক্ ঝক্ করছে যেন।
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোন সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি-
রাস্তার মধ্যে একটা কোন উৎপাত,
কোন-একজন গুন্ডার স্পর্ধা।
এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়োরকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে-
না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রন, না রাজহাঁসের।
একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়,
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোন ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললাম, ‘ফেলো চুরট।’
যেন পেলেই না শুনতে,
ধঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ করে,
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল-খেলায়,
বেশ একটু চওড়াগোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বললে, ‘বেশ করেছেন মশায়’
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।
পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে
আমাকে কোন দরকারই ছিল না।
আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলে ডোবা-
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম, ভুল শোধরাতে হবে।
খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া-
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মোহনলাল-
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, ‘তনুকা আমার বোন,
কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে।’
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু-
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের ’পরে তাই এত অদ্ভূত ভক্তি-
মনে করলে, আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!
যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
‘একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা-
একটি ফুলের গাছ।’
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যতেœ বাঁচে।’
জিগেস করলেম, ‘নামটা কী?’
সে বললে, ‘ক্যামেলিয়া।’
চমক লাগল-
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, ‘ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে, খুশিও হল।
চললেম, টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা গেল, পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিনীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে।
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।
পূজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগনায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে-
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্থ-দল এ জায়গার খবর জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন
শালবনের ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়-
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি কোথাও নেই,
তাই তাঁবু পাতালেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।
কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ওপারে,
সেখানে শিশুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।
একদিন দেখি, নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।
ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে-
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।
দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক-
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরোট খাচ্ছে
আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।
মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।
সময় হয়েছে আজ
যে আনে আমার রান্নার কাঠ
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে।’
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে আবার জিগেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে।’
আমি বললেম, ‘এই জন্যেই।’
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি
রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে। সোনার তরী
যত চাও তত লও তরণী-’পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই—
ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
দুই পাখি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে বনের পাখি ছিল বনে।একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে।বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোঁহে মিলে।খাঁচার পাখি বলে-- বনের পাখি, আয় খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।' বনের পাখি বলে-- "না,আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।' খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,আমি কেমনে বনে বাহিরিব!'বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি বনের গান ছিল যত,খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার-- দোঁহার ভাষা দুইমতো।বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই, বনের গান গাও দিখি।খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,খাঁচার গান লহো শিখি। বনের পাখি বলে-- না,আমি শিখানো গান নাহি চাই।' খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,আমি কেমনে বন-গান গাই।' বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল, কোথাও বাধা নাহি তার।'খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি কেমন ঢাকা চারি ধার।'বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও মেঘের মাঝে একেবারে।'খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে বাঁধিয়া রাখো আপনারে!' বনের পাখি বলে-- "না,সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!' খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই!'এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে তবুও কাছে নাহি পায়।খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে, নীরবে চোখে চোখে চায়।দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বুঝাতে নারে আপনায়।দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা, কাতরে কহে, "কাছে আয়!' বনের পাখি বলে--না,কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার। খাঁচার পাখি বলে--হায়,মোর শকতি নাহি উড়িবার। শাহাজাদপুর ১৯ আষাঢ় ১২৯৯
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণমঞ্জীরে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি
তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে
মনে করে সখী বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী
তোমার কনককঙ্কণে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো
তোমার অলকবন্ধনে
আমার স্মরণ শুভ সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো
তোমার ললাটচন্দনে
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো
তোমার অঙ্গসৌরভে
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো
তোমার অতুল গৌরবে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়।
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই
তরে এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল,
সুনীল আকাশ, শ্যামল
কানন, বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়,
হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন,
না জানে সাধের যাতনা যত।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে
আলোকসাগরে আকাশের তারা
তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে।
আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান
শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি
কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া
সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা॥
ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
আমি--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরযখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনাবন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে -আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়,ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায় -আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।যখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,কাটবে গো দিন যেমন আজও দিন কাটে।ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সেদিন উঠবে ভরি,চরবে গোরু, খেলবে রাখাল ওই মাঠে।আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি।নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি।আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।।
হোরিখেলা
রাজস্থান
পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁ'রে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী--
"লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া--
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী।'
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে--
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী,
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুন্গুনিয়ে আপন-মনে-মনে
ঘুরেঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুন পুরে দলে দলে আজি
পাঠান-সেনা হোরি খেলতে এল।
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকিবেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মুলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি--
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরিখেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
ডাহিন হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচকারি,
বামহস্তে গুলাব-ভরা ঝারি--
সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে
কেসর তবে কহে কাছে আসি,
"বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি,
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি!'
শুনে রানীর শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্টহাসি।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি।
শুরু হল হোরির মাতামাতি,
উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব বরন ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে--
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি,
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
তেমন ক'রে কাঁকন বাজছে না!
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
মনে মনে ভাগছে কেসর খাঁ।
পাঠান কহে, "রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা!
বাহুযুগল নয় মৃণালের মতো,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত--
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।'
পাঠান ভাবে দেহে কিম্বা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালীতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুণ্ডলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালীতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।
কেসর কহে, "তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা!'
রানী কহে, "আমারো সেই দশা।'
একশো সখী হাসিয়া বিবশা--
পাঠান-পতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠান-পতির চক্ষু হল কানা।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝন্ঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু-তলে-তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কে রে
বাহির হল নারী-সজ্জা ছেড়ে,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্নসম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন-রাতে কুঞ্জবিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল-বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
শেষ চিঠিরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে হচ্ছে শূন্য বাড়িটা অপ্রসন্ন,অপরাধ হয়েছে আমারতাই আছে মুখ ফিরিয়ে।ঘরে ঘরে বেড়াই ঘুরে,আমার জায়গা নেই–হাঁপিয়ে বেরিয়ে চলে আসি।এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে যাব দেরাদুনে।অমলির ঘরে ঢুকতে পারি নি বহুদিনমোচড় যেন দিত বুকে।ভাড়াটে আসবে, ঘর দিতেই হবে সাফ ক’রে,তাই খুললেম ঘরের তালা।একজোড়া আগ্রার জুতো,চুল বাঁধবার চিরুনি, তেল, এসেন্সের শিশিশেলফে তার পড়বার বই,ছোটো হার্মোনিয়ম।একটা অ্যালবাম,ছবি কেটে কেটে জুড়েছে তার পাতায়।আলনায় তোয়ালে, জামা, খদ্দরের শাড়ি।ছোটো কাঁচের আলমারিতে নানা রকমের পুতুল,শিশি, খালি পাউডারের কৌটো।চুপ করে বসে রইলেম চৌকিতে।টেবিলের সামনে।লাল চামড়ার বাক্স,ইস্কুলে নিয়ে যেত সঙ্গে।তার থেকে খাতাটি নিলেম তুলে,আঁক কষবার খাতা।ভিতর থেকে পড়ল একটি আখোলা চিঠি,আমারি ঠিকানা লেখাঅমলির কাঁচা হাতের অক্ষরে।শুনেছি ডুবে মরবার সময়অতীত কালের সব ছবিএক মুহূর্তে দেখা দেয় নিবিড় হয়ে–চিঠিখানি হাতে নিয়ে তেমনি পড়ল মনেঅনেক কথা এক নিমেষে।অমলার মা যখন গেলেন মারাতখন ওর বয়স ছিল সাত বছর।কেমন একটা ভয় লাগল মনে,ও বুঝি বাঁচবে না বেশি দিন।কেননা বড়ো করুণ ছিল ওর মুখ,যেন অকালবিচ্ছেদের ছায়াভাবীকাল থেকে উল্টে এসে পড়েছিলওর বড়ো বড়ো কালো চোখের উপরে।সাহস হ’ত না ওকে সঙ্গছাড়া করি।কাজ করছি আপিসে বসে,হঠাৎ হ’ত মনেযদি কোনো আপদ ঘটে থাকে।বাঁকিপুর থেকে মাসি এল ছুটিতে–বললে, “মেয়েটার পড়াশুনো হল মাটি।মুর্খু মেয়ের বোঝা বইবে কেআজকালকার দিনে।’লজ্জা পেলেম কথা শুনে তার,বললেম “কালই দেব ভর্তি করে বেথুনে’।ইস্কুলে তো গেল,কিন্তু ছুটির দিন বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে।কতদিন স্কুলের বাস্ অমনি যেত ফিরে।সে চক্রান্তে বাপেরও ছিল যোগ।ফিরে বছর মাসি এল ছুটিতে;বললে, “এমন করে চলবে না।নিজে ওকে যাব নিয়ে,বোর্ডিঙে দেব বেনারসের স্কুলে,ওকে বাঁচানো চাই বাপের স্নেহ থেকে।’মাসির সঙ্গে গেল চলে।অশ্রুহীন অভিমাননিয়ে গেল বুক ভরেযেতে দিলেম বলে।বেরিয়ে পড়লেম বদ্রিনাথের তীর্থযাত্রায়নিজের কাছ থেকে পালাবার ঝোঁকে।চার মাস খবর নেই।মনে হল গ্রন্থি হয়েছে আলগাগুরুর কৃপায়।মেয়েকে মনে মনে সঁপে দিলেম দেবতার হাতে,বুকের থেকে নেমে গেল বোঝা।চার মাস পরে এলেম ফিরে।ছুটেছিলেম অমলিকে দেখতে কাশীতে–পথের মধ্যে পেলেম চিঠি–কী আর বলব,দেবতাই তাকে নিয়েছে।যাক সে-সব কথা।অমলার ঘরে বসে সেই আখোলা চিঠি খুলে দেখি,তাতে লেখা–“তোমাকে দেখতে বড্ডো ইচ্ছে করছে’।আর কিছুই নেই।
দেবতার গ্রাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে
মৈত্র মহাশয় যাবেন সাগরসংগমে
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি
কত বালবৃদ্ধ নরনারী, নৌকা দুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে।।
পুণ্য লোভাতুর
মোক্ষদা কহিল আসি, ‘হে দাদাঠাকুর,
আমি তব হব সাথি।’ বিধবা যুবতী,
দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
কেবল মিনতি করে-অনুরোধ তার
এড়ানো কঠিন বড়ো ‘স্থান কোথা আর’
মৈত্র কহিলেন তারে। ‘পায়ে ধরি তব’
বিধবা কহিল কাঁদি, স্থান করি লব
কোনোমতে এক ধারে।’ ভিজে গেল মন;
তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাহ্মণ,
‘নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?’
উত্তর করিল নারী, ‘রাখাল? সে রবে
আপন মাসির কাছে। তার জন্ম-পরে
বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে,
বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন
আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন
মানুষ করেছে যতেœ- সেই হতে ছেলে
মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে।
দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন
কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
মার চেয়ে আপনার মাসির বুকে।’
সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর
প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর,
প্রণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে
ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে।
ঘাটে আসি দেখে-সেথা আগেভাগে ছুটি
রাখাল বসিয়া আছে তরী-’পরে উঠি
নিশ্চিন্ত নীরবে। ‘তুই হেথা কেন ওরে’
মা শুধালো; সে কহিল, ‘যাইব সাগরে।’
‘যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে,
নেমে আয়।’ পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে
সে কহিল দুটি কথা, ‘যাইব সাগরে।’
যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে
রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে
ব্রাহ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে,
‘থাক্ থাক্ সঙ্গে যাক্।’ মা রাগিয়া বলে
‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!’
যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে
অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে
বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
‘নারায়ণ নারায়ণ’ করিল স্মরণ।
পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্বদেহে
করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে।
মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়,
‘ছি ছি ছি এমন কথা বলিবার নয়।’
রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা-
অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা
ছুটে আসি বলে, ‘বাছা, কোথা যাবি ওরে!’
রাখাল কহিল হাসি, ‘চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসি!’ পাগলের প্রায়
অন্নদা কহিল ডাকি, ‘ঠাকুরমশায়,
বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
কে তাহারে সামালিবে? জন্ম হতে তার
মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও-
কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।’
রাখাল কহিল, ‘মাসি, যাইব সাগরে,
আবার ফিরিব আমি।’ বিপ্র স্নেহভরে
কহিলেন, ‘যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
তোমার রাখাল লাগি কোনো ভয় নাই।
এখন শীতের দিন শান্ত নদীনদ,
অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ
কিছু নাই; -যাতায়াত মাস-দুই কাল-
তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।’
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি
দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে
ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।
যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হল মেলা।
তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্নবেলা
জোয়ারের আশে। কৌতূহল অবসান,
কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ
মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।
মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর
খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা
ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক,
অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন,
সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন
শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে
অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে
অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে
দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে!
চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
অধীর উৎসুক কণ্ঠে শুধায় ব্রাহ্মণে,
‘ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?
সহসা স্তিমিত জলে আবেগসঞ্চার
দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে
কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দগীতে
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে-
আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি
ত্বরিত উত্তর-মুখে খুলে দিল তরী।
রাখাল শুধায় আসি ব্রাহ্মণের কাছে,
‘দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?’
সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
উত্তর-বায়ুর বেগ ক্রমে ওঠে বেড়ে।
রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর
সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর
জোয়ারের ¯্রােতে আর উত্তরসমীরে
উত্তাল উদ্দাম। ‘তরণী ভিড়াও তীরে’
উচ্চকণ্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল।
কোথা তীর? চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল
আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি
ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা
অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা,
অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিং¯্র বারিরাশি
প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
উদ্ধত বিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল
মূঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে
মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্,
কেহ বা ক্রন্দন করে ছাড়ে ঊর্ধ্বডাক
ডাকি আত্মজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
চক্ষু মুদি করে জপ। জননীর বুকে
রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে।
তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে,
‘বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ-
যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ-
অসময়ে এ তুফান! শুন এই বেলা,
করহ মানত রক্ষা, করিয়ো না খেলা
ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।’ যার যত ছিল
অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল
না করি বিচার। তবু তখনি পলকে
তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে।
মাঝি কহে পুনর্বার, ‘দেবতার ধন
কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন্।’
ব্রাহ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি
মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, ‘এই সে রমণী
দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে
চুরি করে নিয়ে যায়।’ ‘দাও তারে ফেলে’
এক বাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর
যাত্রী সবে। কহে নারী, ‘হে দাদাঠাকুর,
রক্ষা করো, রক্ষা করো!’ দুই দৃঢ় করে
রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।
ভর্ৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ,
‘আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশ্চেতন
মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে,
শেষকালে আমি রক্ষা করিব তাহারে!
শোধ্ দেবতার ঋণ; সত্য ভঙ্গ করে
এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবি সাগরে!’
মোক্ষদা কহিল, ‘অতি মূর্খ নারী আমি,
কী বলেছি রোষবশে-ওগো অন্তর্যামী,
সেই সত্য হল: সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর?
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা?
শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা?’
বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি
বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি
মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি
দন্তে দন্তে চাপি বলে। কে তারে সহসা
মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা-
দংশিল বৃশ্চিকদংশ। ‘মাসি! মাসি! মাসি!’
বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
চীৎকারি উঠিল বিপ্র, ‘রাখ্ রাখ্ রাখ্?!’
চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে প’ড়ে
মোক্ষদা চরণে তাঁর, মুহূর্তের তরে
ফুটন্ত তরঙ্গমাঝে মেলি আর্ত চোখ
‘মাসি’ বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক
অনন্ততিমিরতলে; শুধু ক্ষীণ মুঠি,
বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
‘ফিরায়ে আনিব তোরে’ -কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাহ্মণ মুহূর্তমাঝে ঝাঁপ দিল জলে-
আর উঠিল না। সূর্য গেল অস্তাচলে।
বাঁশি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কিনু গোয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
পথের ধারেই।
লোনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধ্ব’সে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে শ্যাঁতা-পড়া দাগ।
মার্কিন-থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গণেশের
দরজার পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাৎ আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব।
বেতন পঁচিশ টাকা
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানী।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধ্যেটা কাটিয়ে আসি;
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে দশ বেজে যায়।
তারপরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।
ধলেশ্বরী-নদী তীরে পিসিদের গ্রাম।
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া-
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
বর্ষা ঘন ঘোর।
ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে পচে ওঠে
আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
মাছের কান্কা,
মরা বেড়ালের ছানা,
ছাইপাঁশ আরো কত কী যে!
ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
মাইনের মতো,
বহু ছিদ্র তার।
আপিসের সাজ
গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
বাদলের কালো ছায়া
স্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
কলে-পড়া জন্তুর মতন
মূর্ছায় অসাড়।
দিন রাত মনে হয়, কোন্ আধমরা
জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।
গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু,
যতেœ-পাট-করা লম্বা চুল,
বড়ো বড়ো চোখ,
শৌখিন মেজাজ।
কর্নেট বাজানো তার শখ।
মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
এ গলির বীভৎস বাতাসে–
কখনো গভীর রাতে,
ভোরবেলা আধো অন্ধকারে,
কখনো বৈকালে
ঝিকিমিকি আলোয় ছায়ায়।
হঠাৎ সন্ধ্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
সমস্ত আকাশে বাজে
অনাদি কালের বিরহবেদনা।
তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
এ গলিটা ঘোর মিছে,
দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো।
হঠাৎ খবর পাই মনে
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে।
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী;
তীরে তমালের ঘন ছায়া;
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
পৃথিবী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে॥
মহাবীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্দ্বে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রুপে;
দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর র্দুমূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।
তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছ প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম,
ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক।
জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি-
সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।
তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ,
ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে॥
তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের প্রতাপ ছিল দুর্জয়-
সে পরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়
তার অঙ্গুলি ছিল স্থুল, কলাকৌশলবর্জিত;
গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত;
অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশ।
জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি,
প্রাণের ’পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা॥
দেবতা এলেন পরযুগে,
মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের-
জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;
জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে।
ঊষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়,
পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট॥
নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব,
তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।
ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃক্সক্ষলতা-
তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে
হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে।
তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি।
দেবতার মন্ত্র উঠছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে
দিনে রাত্রে
উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে।
তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে ফনা তুলে-
তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করছ আঘাত,
ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে॥
শুভে-অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে,
তোমার প্রচন্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে
আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত জীবনের প্রণতি।
বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর, গুপ্ত সঞ্চার তোমার যে মাটির তলায়
তাকে আজ স্পর্শ করি, উপলব্ধি করি সর্ব দেহে মনে।
অগণিত যুগযুগান্তরের অসংখ্য মানুষের লুপ্তদেহ পুঞ্জিত তার ধূলায়।
আমিও রেখে যাব কয়-মুষ্ঠি ধূলি, আমার সমস্ত সুখদুঃখের শেষ পরিণাম-
রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল পরিচয়-গ্রাসী
নিঃশব্দ ধূলিরাশির মধ্যে॥
অচল অবরোধ আবদ্ধ পৃথিবী মেঘলোকে উধাও পৃথিবী,
গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্না পৃথিবী,
নীলাম্বুরাশির অতন্দ্র তরঙ্গে কমলন্দ্রমুখরা পৃথিবী,
অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তা তুমি ভীষণা।
এক দিকে আপক্বধান্যভারনম্র তোমার শস্যক্ষেত্র-
সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু
কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে;
অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী
‘আমি আনন্দিত’।
অন্যদিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্রে
পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য।
বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল
কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়-
সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ;
তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু ক’রে
হতাশ বনস্পতি ধূলায় পড়ল উবুড় হয়ে;
হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল
শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো।
আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিণে হাওয়া
ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রকুলের গন্ধে;
চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা;
বনের মর্মরধ্বনি বাতাসের স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে
অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে॥
স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা,
অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে
সংখ্যাগণনার-অতীত প্রত্যুষে;
তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ
শত শত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ;
বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তোমার বর্জিত সৃষ্টি
অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে॥
জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ
তোমার খন্ডকালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে,
তারই মধ্যে সব খেলার সীমা, সব কীর্তির অবসান॥
আজ আমি কোন মোহ নিয়ে আসিনি তোমার সম্মুখে;
এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে
তার জন্যে অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে।
তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্য প্রদক্ষিণের পথে
যে বিপুল নিমেষগুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে
তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো-একটি আসনের
সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি,
জীবনের কোনো-একটি ফলবান্ খন্ডকে
যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে
তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে;
সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে
যে রাতে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে॥
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি॥
ক্যামেলিয়া
![]() |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নিচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।
এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই-
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোন সম্বন্ধ না থাক
ও তো আমার সহযাত্রিনী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝক্ ঝক্ করছে যেন।
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোন সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি-
রাস্তার মধ্যে একটা কোন উৎপাত,
কোন-একজন গুন্ডার স্পর্ধা।
এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়োরকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে-
না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রন, না রাজহাঁসের।
একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়,
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোন ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললাম, ‘ফেলো চুরট।’
যেন পেলেই না শুনতে,
ধঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ করে,
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল-খেলায়,
বেশ একটু চওড়াগোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বললে, ‘বেশ করেছেন মশায়’
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।
পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে
আমাকে কোন দরকারই ছিল না।
আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলে ডোবা-
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম, ভুল শোধরাতে হবে।
খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া-
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মোহনলাল-
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, ‘তনুকা আমার বোন,
কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে।’
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু-
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের ’পরে তাই এত অদ্ভূত ভক্তি-
মনে করলে, আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!
যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
‘একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা-
একটি ফুলের গাছ।’
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যতেœ বাঁচে।’
জিগেস করলেম, ‘নামটা কী?’
সে বললে, ‘ক্যামেলিয়া।’
চমক লাগল-
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, ‘ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে, খুশিও হল।
চললেম, টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা গেল, পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিনীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে।
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।
পূজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগনায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে-
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্থ-দল এ জায়গার খবর জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন
শালবনের ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়-
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি কোথাও নেই,
তাই তাঁবু পাতালেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।
কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ওপারে,
সেখানে শিশুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।
একদিন দেখি, নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।
ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে-
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।
দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক-
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরোট খাচ্ছে
আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।
মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।
সময় হয়েছে আজ
যে আনে আমার রান্নার কাঠ
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, ‘বাবু, ডেকেছিস কেনে।’
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে আবার জিগেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে।’
আমি বললেম, ‘এই জন্যেই।’
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
সোনার তরী
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই—
ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণমঞ্জীরে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি
তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে
মনে করে সখী বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী
তোমার কনককঙ্কণে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো
তোমার অলকবন্ধনে
আমার স্মরণ শুভ সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো
তোমার ললাটচন্দনে
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো
তোমার অঙ্গসৌরভে
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো
তোমার অতুল গৌরবে
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে
সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়।
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই
তরে এমন দুখের আশ ।
আমার চোখে তো সকলই শোভন,
সকলই নবীন, সকলই বিমল,
সুনীল আকাশ, শ্যামল
কানন, বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল—
সকলই আমার মতো।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়,
হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়—
না জানে বেদন, না জানে রোদন,
না জানে সাধের যাতনা যত।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে,
জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে
আলোকসাগরে আকাশের তারা
তেয়াগে কায় ।
আমার মতন সুখী কে আছে।
আয় সখী, আয় আমার কাছে—
সুখী হৃদয়ের সুখের গান
শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি
কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া
সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা॥
ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
হোরিখেলা
রাজস্থান
পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁ'রে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী--
"লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া--
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী।'
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে--
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী,
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আমের বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুন্গুনিয়ে আপন-মনে-মনে
ঘুরেঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুন পুরে দলে দলে আজি
পাঠান-সেনা হোরি খেলতে এল।
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকিবেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মুলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি--
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরিখেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
ডাহিন হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচকারি,
বামহস্তে গুলাব-ভরা ঝারি--
সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিনে বাতাসে।
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে
কেসর তবে কহে কাছে আসি,
"বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি,
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি!'
শুনে রানীর শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্টহাসি।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি।
শুরু হল হোরির মাতামাতি,
উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব বরন ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে--
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি,
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
তেমন ক'রে কাঁকন বাজছে না!
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা
মনে মনে ভাগছে কেসর খাঁ।
পাঠান কহে, "রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা!
বাহুযুগল নয় মৃণালের মতো,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত--
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।'
পাঠান ভাবে দেহে কিম্বা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালীতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুণ্ডলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন-ভূপালীতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।
কেসর কহে, "তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা!'
রানী কহে, "আমারো সেই দশা।'
একশো সখী হাসিয়া বিবশা--
পাঠান-পতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠান-পতির চক্ষু হল কানা।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝন্ঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু-তলে-তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কে রে
বাহির হল নারী-সজ্জা ছেড়ে,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্নসম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন-রাতে কুঞ্জবিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল-বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
No comments:
Post a Comment