Saturday, February 15, 2020

নারী বিষয়ক কবিতা



পাহাড়ি মেয়ে
--সৌমেন অনন্ত

সেই মেয়েটার আকাশ কালো চুল ছিলো
খোপায় গোঁজা মাতাল করা ফুল ছিলো,
সেই মেয়েটার কাল সকালে স্কুল ছিলো,
আজ মেয়েটা সিলিং ফ্যানে ঝুলছিল
ঐ মেয়েটার মেয়ে হওয়াটাই ভুল ছিলো।
এই মেয়েটা নারী হতেই বাড়ছিলো,
ওদের ভাষায় তার রুপেতে ধার ছিলো।
নদীর শরীর-খুব স্বাভাবিক বাঁক ছিলো,
নদীর পাড়ে সেই সে লোভী কাক ছিলো।
এই মেয়েটা মাংস ছিল জানতো না,
জানলে কি আর মায়ের কথা মানতো না?
এই মেয়েটার মানুষ হবার পণ ছিলো,
এই মেয়েটার শরীরটা তার ভুল ছিলো।
হায়েনাগুলো উঠিয়ে নিলো জোড় করে
ফিরিয়ে দিলো " রাত্রি কালো" ভোর করে,
সেই মেয়েটা শুণ্য চোখের দৃষ্টিতে
রক্তে ভিজে আকাশ দেখে বৃষ্টিতে।
এই মেয়েটার কেউ ছিলনা তার পরে,
মানুষ মরে একবারে সে রোজ মরে।
কুকুরগুলো দেখলে তাকে রোজ হাসে,
সেই দোষি হায় হাঁপায় সমাজ নাগপাশে।
এই মেয়েটার প্রতিটা দিন খুব ভারি
সব ফেলে তাই মুক্তি ছিল দরকারি।
এই মেয়েটার নিজেরও এক ঘর ছিলো
শেষ বেলাতে সেই ঘরে সে পর ছিলো।
সেই মেয়েটার স্বাস ছিল, কাল ঝুলছে আজ!
আমার কি তায়? ব্যস্ত আমি অনেক কাজ।
এই মেয়েটার আজ সকালে স্কুল ছিলো,
এই মেয়েটার মেয়ে হওয়াটাই ভুল ছিলো।





কেউ দেখেনি
______ অর্জুন মিত্র


কৃষ্ণকলি কেউ বলে না তাকে
কালো তাকে বলে পাড়ার লোক
মেঘলা কোথা, সব ক'টা দিন খরা
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।
বাপের তার নেইকো টাকা মোটে
অর্থ ছাড়া পাত্র কোথা জোটে?
কালো তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।
লোডসেডিং-এ আধার হলো দেখে
পাত্র পক্ষ করছিলো যাই যাই
কালো মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
ভেতর হতে ত্রস্তে এলো তাই
ছেলের বাবা কোঁচকালো তার ভুরু
মেয়ের বুক কাঁপলো দুরু দুরু
কালোই - তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।
পূবে বাতাস এলো হঠাৎ ধেয়ে
বোগেন ভিলায় খেলিয়ে গেলো ঢেউ
জানলা ধারে দাঁড়িয়ে মেয়ে একা
রাস্তা ধারে ছিলো অনেক কেউ
তার পানে কেউ দেখলো কিনা চেয়ে
শংকা বুকে ট্যারিয়ে দেখে মেয়ে
কালোই - তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।
পার হয়ে যায় মাসির কালো মেয়ে
জৈষ্ঠ মাসে কয়েক হাজার পণে
কোথায় একা কাকার মেয়ে কাজল
আষাঢ় মাসে পালায় সংগোপনে।
যখন একা শ্রাবণ রজনীতে
কোন ভাবনা ঘনায় মেয়ের জিতে?
কালো তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখে না কালো হরিণ চোখ।
কৃষ্ণকলি কেউ বলে না তাকে
কালো তাকে বলে পাড়ার লোক
দেখেছিলেম সিলিং থেকে ঝোলা
কালো মেয়ের বিস্ফোরিত চোখ।
কিচ্ছু বোঝার দেয়নি অবকাশ
শাড়িই খানি হলো গলার ফাঁস
কালোই - তা সে যেমন কালো হোক
কেউ দেখেনি কালো হরিণ চোখ।







কবিতা - কাজী রাহনুমা নূর
আবৃত্তি - কাজী রাহনুমা নূর

 মিষ্টি স্বপ্ন গুলোকে ছোঁবে বলে
টলো মলো পায়ে
সিঁড়ি টপকাচ্ছে মেয়েটা
কখনো বাবার হাত ধরে
 কখনো বা মায়ের
এরপর এলো বন্ধুদের
 হাত বাড়াবার পালা

সকুল, কলেজ ,কবিতা , গান বিতর্ক
কত কত স্বপ্নের হাতছানি
 হই হুল্লুর চাঁদের গাড়ি
কু ঝিক ঝিক চুড়ি শাড়ি
চা সিঙ্গারা শিল্পকলা
দু আঙুলে শিস বাজিয়ে
 দম না ফেলে কথা বলা।
জীবন এক ছট্ফটে ঘাস ফড়িং।

এক সকালে মেয়েটি
বৃষ্টি শূণ্য আকাশে দেখলো রংধনু
"যাবি রে মেয়ে আমার সাথে
মন নদীতে আসছে জোয়ার
দৃষ্টি আঠায় আটকে পড়া
মাকড়শাটা দিনে রাতে
বুনছে সুতো গুনছে প্রহর
তোর আঙুলে আঙুল ছোঁয়ার।"

রংধনুর রঙ্গে পা পিছলে
গড়িয়ে পড়তে পড়তে
 মেয়েটি দেখলো সাজানো ঘর
 ফ্রিজ ভরা ঠান্ডা পানি
নানান নামের চাদরে ঢাকা
কিছু প্রিয় মুখ
রাতজাগা চোখে
কালো মেঘের তুলি

তুলতুলে ছোট বড় হাতের জাদুতে
পুরনো ওই হাতগুলো
কোথায় যে মিলিয়ে গেলো
তার সাথে হারালো স্বপ্ন সিড়ির ম্যাপটি ও
 মেয়েটি পরাবাস্তবতার জীবন ছেড়ে
নারী হয়ে উঠলো।
+++++++++++++






আমি মেয়ে
সংগৃহীত••••••

যে দিন জন্মেছিলাম,
ঠাকুমা তুলসী তলায় মাথা ঠুকেছিল,
গতরাতে নিজের হাতে তৈরি নাড়ু
ফেলে দিয়েছিল গরুর ডাবায়। বাবার মুখ
ছিল গম্ভীর
মায়ের মুখে এক পাপবোধ। প্রতিবেশীরা
সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল,
পরেরবার, নিশ্চয়ই ঠাকুর মুখ তুলে চাইবে।
বুজেছিলাম, আমি পরিবারে আনন্দ নিয়ে
আসি নি।
আমার বয়স এখন চার,
আজ আমার একটা ভাই হয়েছে। সারা
বাড়ী জুড়ে সে কি আনন্দ! কেবল নাড়ু নয়,
বাবা মিষ্টি বিলি করেছে।
সব্বাই বলছে, ভগবান এতদিন বাদে মুখ
তুলে চাইল।
চার বছরের আমি শুধু উত্তর পাই নি,
আমার জন্মের দিনটা কেন অন্যরকম ছিল?
সেই আমি এখন ষোল বছরের। ঠাকুমা,
বাবার হুকুম হয়েছে আর স্কুল নয়,
বই, খাতা, রঙ, পেনসিল ছেড়ে এবার
শিখতে হবে সংসারের কাজ। সময়
হয়েছে, এ বাড়ী ছেড়ে
আর এক বাড়ী যাওয়ার।
ভাই স্কুলে যায়,
বাবার ইচ্ছে ও যতদূর পারে পড়ুক। আমার
কেন পড়া হবে না,
না, এর কোন উত্তর পাই নি। আমার বয়স
এখন আঠাশ।
বিয়ে হয়ে গেছে এগারো বছর আগে। একটি
মেয়ে, একটি ছেলে।
মেয়ে হওয়ার পড়, শ্বশুরবাড়ীর কেউ
কয়েকদিন আমার সাথে কথা বলে নি।
কেন? না এরও কোন উত্তর পাই নি। সেই
আমি আজ পঞ্চাশের গোড়ায় বাপের
বাড়ীতে এসেছি।
বাবার আর কয়েক মুহূর্ত,
ভাই চাকরী করে
সময় পায় নি আসার।
শেষ সময়ে আমি দিয়েছিলাম বাবার মুখে
দুফোঁটা জল। সব্বাই বলেছিল, লোকটার
কপাল খারাপ,
শেষ সময়ে ছেলের হাতের জলটুকুও পেল
না।
আমার দেওয়া জলে দোষ কোথায়, না, এরও
কোন উত্তর পাই নি। আমি এখন
পঁচাত্তরের বৃদ্ধা জীবনের শেষকটি ক্ষণ
আর বাকি। আমার ছেলেটি বড় ব্যস্ত।
চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে, লোক জোগাড়
করছে।
আর, আমার মেয়েটি
চুপচাপ, নীরবে আমার পায়ের সামনে বসে
আছে।
ওর যে কোন স্বাধীনতা নেই। সমাজের
সকলের মন জুগিয়ে যে ওকে চলতে হয়।
নীরবে দুচোখের কোণ দিয়ে কেবল গড়িয়ে
পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। মেয়ে ছেলে
কেন এত তফাৎ
এর কোন উত্তর পাই নি।
আমি আবার জন্মাতে চাই, জন্মাতে চাই
একজন মেয়ে হয়ে। পুরুষের চোখে জগৎ
দেখব বলে নয়, জগৎ দেখব একজন মেয়ের
চোখে।






নরপিশাচ
+++++
কাজী রাহনুমা নূর


স্তব্ধতার নিজস্ব ভাষা আছে
অন্ধকারের ও আছে মন কেমন করা আলো
বেশ কিছুক্ষণ হলো সে আলোর স্নিগ্ধতা জড়িয়ে
নি:শব্দতার মচমচে ফিসফাস শুনছিলো ।
মেঝেতে ডান কাঁধ হয়ে শুয়ে ছিলো মেয়েটি,
কে জানে কতক্ষণ,
ঘাড়ের কাছটায় একটা অসহ্য চিনচিনে ব্যথা;
হঠাত ই ওর মনে হলো তাকে নিয়েই চলছে ফিসফাস
ভাবনাটা মাথায় আসতেই হাল্কা শব্দ করে হেসে উঠলো,
তার মতন এত্ত সাদামাটা মেয়েকে নিয়ে কথা বলে
শুধুই রবি ঠাকুর। সাধারণ মেয়ে কবিতাটি 

তাদের মতন মেয়েদের নিয়েই তো লেখা, 
মালতীর নরেশশুধুই স্বপ্নের ফেরী ওয়ালা,
মনের ঘরে ভাড়া ছাড়াই তাদের বসবাস ,
বাঁধনহীন তরী তীরে ভেড়ে না কখনো।

চারপাশ খাঁ খাঁ , দূরে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দে
আঁধারের গায়ে যেন বাজ পড়লো
সেই শব্দের তীক্ষতা কে ছাপিয়ে কানে এলো
প্রচন্ড ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
সূর্যাস্তের রঙ মেখে জেগে উঠলো পূবের উঠোন।
সে আলোয় মেয়েটি দেখলো কয়েকটা
ছোট বড়ো নেকড়ে খুবলে খাচ্ছে কিছু একটা,
একটু ভালো করে দেখতেই বুঝলো
ওটা একটা নারী শরীর ,আপ্রাণ যুঝে যাচ্ছে শরীরটা,
তার কতটা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আর কতটা
নারীত্ব রক্ষায়, কে জানে?
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি,
পা চলছেনা তবু গায়ের সমস্ত শক্তি এক করে এগোলো।
বাঁচাতে হবে ওকে
নারী শরীর টা আর পেরে উঠছে না,
এতক্ষণ চেঁচাচ্ছিলো এখন সেটি ফোঁপানো তে নেমেছে,
সাথে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে
কোন সুরা কি? আয়াতুল কুরসী?
পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে
ঘুরে তাকালো জানোয়ার গুলো
মেয়েটা দেখলো নেকড়ের চেয়েও হিংস্র কিছু নরপিশাচ।
তাদের চোখের মণিতে জ্বলছে নগ্ন কামুকতা
নখের কোণে চিক চিকে তাজা রক্ত
রক্তের গন্ধে নয় মাংসের গন্ধে ওদের লালা ঝরে
বিষাক্ত ক্ষুধা লাথি দেয় তলপেটে,
নপুংশক নরপিশাচ গুলো দলবেঁধে চার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে,
রক্তাক্ত হয় তরুণী, বৃদ্ধা, কন্যা; রক্তাক্ত হয় মানব জন্ম।
মেয়েটি সমস্ত শক্তি এক করে চেঁচিয়ে উঠলো
" ছেড়ে দে ওকে। এই নারী, তোর মা, বোন, শিশু,
এই নারী তোর আশ্রয় স্থল; হাসি, কান্না, ভালোবাসা
ওর শরীরেই বেড়ে উঠেছিস তুই, তোর অস্থি মজ্জা
 চামড়ায় মিশে আছে প্রসূতির গর্ভ বেদনা,।
ওকে খুবলে নিজকেই উলঙ্গ করছিস বারবার,
থাম তুই মাংশাসী পিশাচ। স্টপ!
কেউ শুনলো না ওকে, শিশু যেমন খেলা শেষে খেলনা
ধুলোয় ফেলে যায় সে ভাবেই ছুঁড়ে ফেললো নিথর শরীরটা,
চারপেয়ে পিশাচ গুলো দু পায়ে হেঁটে দূরে সরে যাচ্ছে,
ঘাড় বেঁকে পড়ে আছে মেয়েটা,
ওর স্নিগ্ধ শরীরের প্রতি বাঁকে মুখ লুকাচ্ছে
কুমারীর লজ্জ্বা।







 মেয়ে ভ্রূণ বলছি
কাজী রাহনুমা নূর
------------------

একটি মেয়ে ভ্রুণ পৃথিবীর আলো দেখবে
তাই সৃষ্টিকর্তার অনুমতি চাইলো।
সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে দারুন ভালোবাসেন,
তাদের মন রক্ষাই তাঁর একমাত্র ব্রত।
মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকা মেয়ে ভ্রুণ টির
জন্ম কুন্ডুলি নামানো হলো, কিন্তু সে কি?
কুন্ডুলির ঠিক মাঝ বরাবর দগদগে দশ ক্ষত।
কারণ জানতে এগিয়ে এলো ফেরেশতারা শত।
কি হয়েছে কিসের আঘাত?
নিষ্ঠুরতার সহস্র দাঁত ।
সৃষ্টিকর্তার আদেশ মতই চললো তদন্ত কাজ।
রিপোর্ট এলো, সকল নারীর কুন্ডুলিতেই
লাল কালো আর হলুদ রঙের ভাঁজ।
সে ভাঁজ খুলে মলম মাখাও যত
তবু
ফিনকি দিয়ে কষ্ট গুলো ছিটকে বেরোয় অবিরত।
স্রষ্টা তখন আদেশ করেন
সৃষ্টির ঠিক প্রথম থেকে সব নারীদের করো জড়ো
নানান দেশের, নানান বেশের নারী এলো
কারো আলোয় চাঁদটা রূপোর জোছনা পেলো
কারো চোখের মায়ায় ক্রোধরা স্বর্গে গেলো ।

কোমল স্বরে স্রষ্টা তাদের প্রশ্ন করেন -
'ভয় পেয়োনা সৃষ্টি আমার
একটা কথা ছিলো জানার।
কে খুঁড়ছে তোমার বুকে বিষন্নতার ক্ষত?'
নারীরা সব ঠোঁট কামড়ে করলো মাথা নত।
চারিদিকে নিস্তব্ধতার সাদা কালো ধুপ
স্রষ্টা দেখেন একই নারীর কত শত রুপ
কেউ মা, কেউ সেবাদাসী, বারবণিতা
প্রেমিকা কেউ, আবার কেউ বা স্বাধীনচেতা
তবু ও ওদের সবার বুকেই কষ্ট আঁকা
মনের ভেতর
সংশয় আর অবিশ্বাসের ঘুরছে চাকা।
কারণ টা তার খুঁজে পাওয়া নয়তো সোজা
সব নারীর ই হাতে পায়ে জীভের ডগায়
অদৃশ্য সব শেকল গোঁজা ।
ঠিক তখনই মেয়ে ভ্রুণ টি উঠলো বলে
'জন্ম থেকেই অমন যদি কাঁদতে হবে
বাড়তে হবে নয়ে ছয়ে সকল সয়ে
অযুত 'না' এর সংগে ভাবের চুক্তি বয়ে
জন্ম আমার না হোক তবে।'
স্রষ্টা বলেন, "আমার সেরা সৃষ্টি মানব
সে মানবের জন্ম দেয় কোন মহা মানব?
সে তুই নারী,
তোর বিরহে আকাশ ফেটে নামবে জোয়ার
তোর পায়েতেই সব মানবের স্বর্গ দুয়ার
নারীর জন্ম বন্ধ যদি করি তবে
আমার সেরা মানব জন্ম কেমনে লবে ?"
ভ্রূণটি বলে ভারী বুকে কষ্ট ধরি
স্রষ্টা তোমার মানবকে আজ প্রশ্ন করি ,
'ওরে মানব তোর বাহুতে শক্তি ধরিস
সেই গর্বে আমার বুকে বারুদ ভরিস ?
আমরা নারী , আমারাই মা
নিজের জীবন তুচ্ছ করে ধরছি
পেটে দানবের ছা
মা যদি তোর জন্ম নিতেই মারবি ওরে
জন্মাস তুই হায়না , কুকুর, গাভীর ঘরে।'



ও মেয়ে তোর বয়স কত--শতাব্দী রায়
 
ও মেয়ে তোর বয়স কত?
-কি জানি গো! মা থাকলে বলে দিত।
সেই যে বারে দাঙ্গা হলো, শ’য়ে শ’য়ে লোক মরলো।
হিন্দুদের ঘর জ্বললো, মুসলমানের রক্ত ঝরলো।
তখন নাকি মা পোয়াতি!
দাঙ্গা আমার জন্মতিথি।
ও মেয়ে তোর বাবা কোথায়?
-মা বলেছে গরীবদের বাবা হারায়,
কেউ তো বলে বাপটা আমার হারামি ছিল।
মায়ের জীবন নষ্ট করে অন্য গাঁয়ে ঘর বাঁধলো।
মা বলতো শিবের দয়ায় তোকে পেলাম।
শিবকেইতাই বাপ ডাকলাম।
ও মেয়ে তোর প্রেমিক আছে?
ছেলেরা ঘোরে ধারে কাছে?
-প্রেমিক কী গো? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে!
স্বপ্ন দেখায় দিন-দুপুরে! চুরি-কাজল মেলাতে কেনায়,
ঝোপের ধারে জামা খোলায়!
এসব নন্দ কাকা করেছে দু’বার,
প্রেমিক ওকেই বলবো এবার।
ও মেয়ে তোর পদবি কি?
-বাপই নাকি দেয় শুনেছি!
পদবি থাকলে ভাত পাওয়া যায়?
বাপের আদর কাঁদায় হাঁসায়!
ওটা কি বাজারে মেলে? কিনবো তবে দু-দশে দিলে।
দামী হলে চাই না আমার,
থাক তবে ও বাপ-ঠাকুরদার।
ও মেয়ে তুই রুপসী?
-লোকে বলে ডাগর গতর সর্বনাসী।
রুপ তো নয় চোখের ধাঁ ধাঁ,
যৌবনেতে কুকুরী রাধা।
পুরুষ চোখের ইশারা আসে,
সুযোগ বুঝে বুকে পাছায় হাতও কষে।
রুপ কি শুধুই মাংসপেশী?
তবে তো আমি খুব রুপসী।
ও মেয়ে তোর ধর্ম কী?
-মেয়ে মানুষের ধর্ম কী গো?
সব কিছু তো শরীর ঘিরে!
সালমা বলে ধর্ম ওই মানুষ বানায়।
সন্ধেবেলায় যখন দাঁড়ায়,
কেউ তো বলে না হিন্দু নাকি?
সবাই বলে কতয় যাবি!
বিছানা নাকি ধর্ম মেলায়,
শরীর যখন শরীর খেলায়।
তাই ভাবছি এবার থেকে
ধর্ম বলবো শরীর বা বিছানাকে।
 
 
 
 
কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী -ফরহাদ মজহার
 
আমি তোমার সামনে আবার নতজানু হয়েছি, নারী
না, প্রেমে নয়, আশ্লেষে নয়,
ক্ষমা চেয়ে
তোমার দয়া দিয়ে আমার হৃদয় ধুয়ে দেবার প্রার্থনায়
আমার ভেতরে যে পুরুষ তাকে আমি চাবুক মেরে শাসন করেছি
তাকে হাঁটু মুড়ে বসতে বলেছি তোমার সামনে
আমি ক্ষমা চাই, ক্ষমা করে দাও
শুধু আমাকে নয়
সমস্ত পুরুষকে তুমি ক্ষমা কর
আমি আজ সমস্ত পুরুষের হয়ে তোমার ক্ষমাপ্রার্থী
পুরুষ তোমার সামনে আবার
নতজানু হয়েছে নারী,
তাকে ক্ষমা করে দাও।
গৃহপালিত পশুর মতো তোমাকে ব্যবহার করেছে পুরুষ
আখমাড়াইয়ের কারখানার মতো তোমার জানু চেপে
তারা উৎপাদন করেছে সন্তান
টেলিভিশন বাক্সের মতো তোমার ভেতর তারা ঠেসে দিয়েছে
তাদের জগত
নীলাভ শিখার মতো জ্বলতে জ্বলতে তুমি তা প্রতিদিন
প্রচার করে যাচ্ছ-
ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের মতো অপ্রাণীবাচক তোমার অস্তিত্ব
প্লাস্টিকের পুতুলের মতো প্রাণহীন
তোমার নাম হতে পারত কাঠকয়লা
তোমার নাম হতে পারত হাতুড়ি
তোমার নাম হতে পারত শেলাইকল
তোমার নাম হতে পারত মাদীকুকুর
নরবানরেরা ঠাট্টা করে তোমার নাম রেখেছে নারী
এইসব জেনে তোমার সামনে আমি
নতমুখে এসে দাঁড়িয়েছি, নারী
আমি পুরুষ
আমাকে ক্ষমা কর।
প্রতিদিন কেউ-না-কেউ স্বামী তার স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করে
প্রতিদিন কেউ-না-কেউ পশুস্বভাবী কামুক
তোমার মুখে এসিড ছুঁড়ে মারে
প্রতিদিন ১১ বছর বয়সী বালিকাকে
ধর্ষণ করে ১১জন পুরুষ
কেনাবেচা চলছে তোমাকে নিয়ে
যেন তুমি শাকশব্জি
আলুপটল
খাসীর মাংস
তোমার স্তন তারা মাপছে ফিতে দিয়ে
তোমার কোমর তারা মাপছে ফিতে দিয়ে
তোমার উরু তারা মাপছে ফিতে দিয়ে
দাঁড়িপাল্লা ঝুলিয়ে ওজন করছে তোমাকে
তোমার দাঁত চুল নখ পরখ করে সাব্যস্ত করছে
তোমার মূল্য
তোমার নাম হতে পারত মোগলাই পরোটা
তোমার নাম হতে পারত জাপানি হোন্ডা
তোমার নাম হতে পারত ডানহিল সিগারেট
তোমার নাম হতে পারত পুষিবিড়াল
অর্ধসভ্য মানুষ তোমার নাম রেখেছে অর্ধাঙ্গিনী
এইসব জেনে তোমার সামনে আমি
নতমুখে এসে দাঁড়িয়েছি, নারী
আমি পুরুষ
আমাকে ক্ষমা কর।
তুমি প্রজননযন্ত্র তাই তোমার নাম জননী
তুমি রমণযোগ্য তাই তোমার নাম রমণী
ঘোড়াশালে ঘোড়া হাতিশালে হাতির মতো মহলে মহলে থাকো
তাই তোমার নাম মহিলা
গৃহে গৃহে আসবাবপত্রের মত শোভা পাও
তাই তোমার নাম গৃহিণী
আমি পুরুষ শব্দের সমান অর্থবহ উচ্চারণে,
তোমার নামকরণ করতে চাই, নারী
কিন্তু পারি না
অক্ষম লজ্জায় আমি তোমার সামনে
অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছি
আমি পুরুষ
আমাকে ক্ষমা কর।
আজ আমি তোমাকে বলতে এসেছি
পুরুষ শব্দের অর্থ হচ্ছে কর্তৃত্ব
এবং তোমার কর্তৃত্ব গ্রহণ করার সময় হয়েছে, নারী
পুরুষকে গ্রহণ কর।
 
 
 
 
 
আমিই সেই মেয়ে
- কবিতা সিংহ
আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়ে
যার জন্মের সময় কোন শাঁখ বাজেনি
জন্ম থেকেই যে জ্যোতিষীর ছঁকে বন্দী
যার লগ্ন রাশি রাহু কেতুর
দিশা খোঁজা হয়েছে না, তার নিজের জন্য নয়
তার পিতার জন্য আর ভাই এর জন্য
তার স্বামীর জন্য তার পুত্রের জন্য
কিন্তু যার গর্ভ থেকে আমার জন্ম
সেই মায়ের কথা বলেনি কেউ।
আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়েটি
যে জন্ম থেকেই বিবাহের
জন্য বলি প্রদত্ত
যার বাইরের চেহারা
চোখ – নাক-মুখ- ত্বক- চুল – রঙ
নিয়েই দর কষাকষি
কাল না ফর্সা
খাঁদা না টিকালো
লম্বা না বেঁটে
খুতখুতে না টানা টানা
যার মাথার বাইরেটা নিয়েই সকলের ভাবনা
মাথার ভিতরটা নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই
আমিই সেই মেয়েটি যে ছোটবেলা থেকে শুনেছে
জোরে জোরে কথা বলতে নেই
ছুটতে নেই -চেঁচাতে নেই- হাসতে নেই
এমন কি কাঁদলেও তা লুকিয়ে লুকিয়ে
আমিই সেই মেয়েটি যাকে বলতে নেই –
খিদে পেয়েছে – ঘুম পেয়েছে – ইচ্ছে করছেনা-
ক্লান্ত লাগছে -আর পারছিনা — আর পারছিনা।
আমিই সেই মেয়েটি খেলার জন্য যার
হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুতুল
পুতুলের আদল পাবার জন্য
পুতুলের সংসার বানাবার জন্য।
আমিই সেই মেয়েটি যে গত কোন
শতাব্দী তে পাঁচ বছর বয়সে মালা দিয়েছে –
গঙ্গা যাত্রীর গলায়
কুলীন ব্রাম্মন এর তিনশো পঁয়ষট্টি তম স্ত্রীর
অন্যতমা হয়ে স্বামীর গরবে হয়েছি গরবিনী
একাদশীর দিন অবুজ দশমীর বালিকার তৃষ্ণায় –
আটক ঘরের মাটি লেহন করতে করতে প্রান ত্যাগ করেছি
সন্তানের পর সন্তান জন্ম দিতে দিতে যন্ত্রণায়
মুখ থুবড়ে পরেছি সূতিকাগারে
জ্বলে পুড়ে মরেছি সতীদাহে।
আমি বুঝতে পারিনি যে চাকরীর জায়গায়
নিজের কাজের কুশলতা দেখাতে নেই
আমি বুঝতে পারিনি যে আমার প্রেমিককে
তার প্রেম পত্রের বানান ভুল গুল ধরিয়ে দেওটাই
আমার ভুল হয়ে ছিল
আমি বুঝতে পারিনি আমি যদি কবি হতে চাই
আমার বন্ধুরা বলবে ''ওটা কবিতা হয়নি পদ্য হয়েছে''
আমি বুঝতে পারিনি যে বিংশ শতাব্দীর শেষ সীমানায় এসে দাড়িয়েও
এইপুরুষ শাসিত সমাজ বুদ্ধিমতিদের জন্য অপ্রস্তুত
আমি সেই মেয়েটি যে দেখেছে একটি নারী
কেমন করে নিছক মেয়েছেলে বনে যায়
চরিত্রের উলটো দিকে হেঁটে যায় সফল স্বামীদের গিন্নীরা
শিক্ষার চেয়ে উজ্জলতা পায় বেনারসি সাড়ীর ফুলকি
বুদ্ধির চেয়ে দিপ্তিমান হয়ে ওঠে অন্ধকারে হীরা পান্না
আমি সেই মেয়েটি জানেন আমি সেই মেয়েটি
যে জীবনের কয়েকটি বছর ভুলের পরে ভুল
পুনরুপি ভুল করে চলেছি
অন্ধকারের দিনে ফিরতে পারিনা বলেই কি
আমি অপমানের জলন্ত কয়লার উপর দিকে হেঁটে যেতে চাই
যেতে চাই দুঃখের দিকে
আমি প্রনাম জানাই সেই প্রথম আগুনকে
যার নাম বর্ণপরিচয়
সেই অগ্নি সুদ্ধ পরম্পরাকে সেইসব পুরুষ রমণীকে
যারা উনবিংশ শতাব্দীর অন্ধকারের হাতলে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে
এক জন্মে আমাকে জন্ম জন্মান্তরের দরজা খুলে দিয়েছে।
আমি আজ প্রেমের জন্য ফেলে যাচ্ছি আরাম-
শোকার্জিত শাকান্নের জন্য ফেলে যাচ্ছি ক্রীতদাসের চর্ব্যচোষ্য
জেগে থাকার জন্য ফেলে যাচ্ছি ভাত ঘুম,
যন্ত্রণার জন্য ফেলে যাচ্ছি সুখ –
জ্ঞানের জন্য ফেলে যাচ্ছি অন্ধতা
আনন্দের জন্য ফেলে যাচ্ছি সাফল্য
অমৃতের জন্য ঐশ্বর্য।
আমার হাতে জ্বলছে দিশারীদের শিক্ষার মহান আগুন
আমিই সেই মেয়েটি———
আপনারা নিজের দর্পণে দেখে আমাকে চিনুন
আমাকে চিনুন – আমাকে চিনুন।।
 
 
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...