স্বাধীনতার বাঁশিওয়ালা- ১
মুহম্মদ জাইদুল ইসলাম
৭ই মার্চ ১৯৭১,
বিক্ষুব্ধ জনতার ঢাকামুখী স্রোতে উন্মাতাল
বাংলার পথ ঘাট সবুজ প্রান্তর।
নিপীড়িত জনতার ঢল নেমেছে রেসকোর্স ময়দানে।
জনতার রায়ে সিংহাসনের মালিক হয়েও
কতকাল বাঙালি থাকবে সিংহাসনচ্যুত, মুকুটহীন, ভিখারির মত?
কতকাল বাঙ্গালী থাকবে স্বাধীন দেশে পরাধীন প্রজা সেজে?
কতকাল পাক জান্তার বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে
বাঙ্গালি মরবে তিলে তিলে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে?
আর কতকাল?
বাংলার আকাশ বাতাস আজ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে।
সাগরের ক্রোধমত্ত ঊর্মিমালা ফুলে ফেঁপে তেড়ে আসছে।
পাখিদের সুমিষ্ট কণ্ঠধ্বনি গলা ছেড়ে গান
গাওয়ার অধিকার আদায়ের বজ্র নিনাদে ফেটে পড়ছে।
বাংলার শিক্ষক, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, কুলি, মজুর, মেথর, চাকুরে-
সবাই অধিকার আদায়ে জেগে উঠেছে।
সবাই আজ এক স্বার্থে, এক দাবিতে-
প্রাণের সাথে প্রাণ মিশিয়ে, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে
স্বাধীনতার প্রিয় মঞ্চে সমবেত হয়েছে।
আহা! ফাল্গুনের প্রচণ্ড তাপদাহে ঘামে ভিজে নদী হওয়া বুকগুলো,
শত মাইল পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়া জবুথবু পা গুলো,
আর্তনাদে ভরা গগণ বিদারি চিৎকারে শুকিয়ে কাঠ হওয়া গলাগুলো;
সব আড়ষ্টতা ঠেলে অপেক্ষায় উন্মুখ-
ঐ বুঝি এলো স্বাধীনতার বাঁশিওয়ালা!
দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বঞ্চিত সত্তাগুলো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে
"বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধরো; বাংলাদেশ স্বাধীন করো"
"পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তোমার আমার ঠিকানা"
"জয় বাংলা" "জয় বাংলা" ধ্বনিতে
কাঁপিয়ে দিচ্ছে সমগ্র রেসকোর্স ময়দান;
কেঁপে উঠছে সারা বিশ্ব।
পথে পথে গণমানুষের ভালবাসার স্পর্শ গায়ে মেখে
মুক্তিকামী জনতার মুক্তির বার্তা নিয়ে
স্বাধীনতার মঞ্চে এলেন স্বাধীনতার বাঁশিওয়ালা।
সম্মোহনী বাঁশির বিপ্লবী সুরে মাত্র আঠারো মিনিটে সাত কোটি
বাঙ্গালির
অন্তঃপ্রকোষ্ঠে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র
এঁকে দিলেন নিপুণ দক্ষতায়।
বজ্র কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,
"প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো;
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে
শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।"
"রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো;
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ।"
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম;
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
অতঃপর;
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধে
দুই লক্ষ নিষ্পাপ ফুল পাকি জানোয়ারের লালসার শিকার হয়েছে।
বাংলার চির সবুজ প্রান্তর ৩০ লক্ষ শহীদের
টকটকে লাল রক্তে ভেসেছে।
আমরা পেয়েছি লাল সবুজের প্রিয় নিশান
আমরা পেয়েছি চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার অমৃত স্বাদ।
স্বাধীনতার মানে -
ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
যে ছেলেটা বস্তা কাঁধে কাগজ কুড়োয় পাড়ায় পাড়ায়
যে ছেলেটা রোজ বাজারে মুরগি কাটে , পালক ছাড়ায়,
যে ছেলেটা রেস্তোরাঁতে ধুচ্ছে থালা-গেলাস-বাটি
যে ছেলেরা সারাজীবন খায় লাথি-কিল-চড় ও চাঁটি !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো, ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" কাকে বলে , স্বাধীনতার সঠিক মানে ?
যে মেয়েটা ভোর না হতেই মায়ের সাথে যাচ্ছে কাজে
যে মেয়েটা পরের বাড়ি কাপড় কাচে , বাসন মাজে,
যে মেয়েটা গোবর কুড়োয় , ঘুঁটেও দেয় , কয়লা বাছে
যে মেয়েরা পায়না আদর সারাজীবন কারোই কাছে !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো , ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" দেখতে কেমন ? স্বাধীনতার সঠিক মানে?
যে ছেলেরা রাস্তা ঘাটে করছে পালিশ পরের জুতো
যে ছেলেরা ট্রেনের হকার , খাচ্ছে রোজই লোকের গুঁতো ,
লজেন্স খাওয়ার বয়স যাদের , করছে তারাই লজেন্স ফেরি
যাদের বুকে সূর্য ওঠার , গোলাপ ফোটার অনেক দেরি !
ওদের কাছে প্রশ্ন কোরো , ওরা কি কেউ সত্যি জানে
"স্বাধীনতা" জিনিসটা কি ? স্বাধীনতার সঠিক মানে?
স্বাধীনতার মানে বোঝে নীল আকাশের বন্ধু পাখি
স্বাধীনতার মানে বুঝেই চাঁদ তারাদের পরায় রাখি,
স্বাধীনতার মানে বোঝে পাহাড়-সাগর-ঝর্না-নদী
স্বাধীনতার মানে বুঝেই বইছে বাতাস নিরবধি ।
স্বাধীনতার সঠিক মানে কজন স্বজন সত্যি জানে
স্বাধীনতার সংজ্ঞা খুঁজো শেকল ছেঁড়া পাখির গানে !
তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা
শামসুর রাহমান
তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে,হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে,হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে,ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে,বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে,হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুডি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা,তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা,তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুডো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন -তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক,বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা,তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়রি এক বিধবা দাঁডিয়ে আছে
নডবডে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা,তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী,শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস,জেলেপাডার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া,মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝডে
রুস্তম শেখ,ঢাকার রিকশাওয়ালা,যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুডে বেডানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে —
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে,হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উডিয়ে,দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে,হে স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা তুমি
– শামসুর রাহমান
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া
রফিক আজাদ
স্পর্শকাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,-
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি?
প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না ক’রে ওঠে?
– চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে।
বৃক্ষদের সাহচার্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব সুখে আছে।
চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের
কারু-কারু মনে,
কেউ-কেউ এখনো তো পোষে
বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া।
চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ জানে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু-
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়- শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে।
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না।
রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।
চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক্।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ’রে তোলা হোক।
চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।
চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে।
চুনিয়া বিশ্বাস করে:
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।
রিপোর্ট ১৯৭১
- আসাদ চৌধুরী
প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটেরক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
আবু জাফর বিঃ
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি একাত্তর,সাড়ে সাতকোটি মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলন,
শুনেছি রেসকোর্সে জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর অগ্নিঝরা ভাষণ।
দেখেছি রাজাকার পাঞ্জাবী মিলে, করেছে কতনা অবিচার,
অসহায় লাখো মা-বোনেরা সেদিন হয়েছে নির্যাতনের শিকার।
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি সারা দেশে জুলুম নিপিড়ন নির্যাতন আর হাহাকার,
শতশত বীরাঙ্গনা নারীর আকাশ কাঁপানো আত্মচিৎকার।
দেখেছি স্বামী-সন্তান হারা বাংলা মায়ের কত যে আর্তনাদ,
মুক্তিযুদ্ধে কত শহীদ পরিবারের জীবন হয়ে গেছে বরবাদ।
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি গ্রামের কত বাড়ী-ঘর আগুন জ্বলছে দাউ-দাউ করে,
গৃহহারা মানুষ শরণার্থী হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ওপারে।
দেখেছি আষাঢ় শ্রাবণ মাস, তুমুল বৃষ্টি আর হাটুসমান কাদা,
হেটে চলেছে দলবেধে সবে, যেতে পারিনি কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি মটার, সেল, গ্রেনেড, রাইফেল আরো কত আগ্নেঅস্ত্র,
যুদ্ধের বিমান, ট্রাঙ্ক, কামান, পাক হানাদার বাহিনী সশস্ত্র।
মুক্তিবাহিনীর মাথায় টোকা, কৃষানের কাজ করছে অস্ত্র সেরে,
হায়েনা পাঞ্জাবী সারিসারি গ্রামে ঢুকতেই দিচ্ছে ধ্বংস করে।
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি-
দেখেছি অমাবস্যা রাতে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আলোক উজ্জ্বল আকাশ,
ঠাশ-ঠুশ ডেডা-ডেডা শব্দ আর বারুদের গন্ধে ভরা বাতাস।
দেখেছি বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মনে ছিল কত স্বপ্ন আঁকা,
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা, সবুজের মাঝে লাল পতাকা।
------------------
স্মৃতিস্তম্ভ
- আলাউদ্দিন আল আজাদ
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো ! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটকা ধুলায় চূর্ণ যে পদ-প্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য ।
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক ! ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার ।
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠেনা কান্না, ঝরেনা অশ্রু ?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ-কোন মৃত্যু ? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার ? কেবল সেতার
হয় প্রপাতের মোহনীয় ধারা, অনেক কথার
পদাতিক ঋতু কলমেরে দেয় কবিতার কাল ?
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক । একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি কারিগর
বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায় ।
পলাশের আর
রামধনুকের গভীর চোখের তারায় তারায়
দ্বীপ হয়ে ভাসে যাদের জীবন, যুগে যুগে সেই
শহীদের নাম
এঁকেছি প্রেমের ফেনিল শিলায়, তোমাদের নাম ।
তাই আমাদের
হাজার মুঠির বজ্র শিখরে সূর্যের মতো জ্বলে শুধু এক
শপথের ভাস্কর ।
স্বাধীনতা
জাহিদুল ইসলাম (শ্যামলী ,ঢাকা।)
স্বাধীনতা আমার
পিতাহীন জননীর সন্তান!
স্বাধীনতা আমার
কিশোরী বোনের ধর্ষিত মুখ!
স্বাধীনতা আমার
বিধবা মায়ের চোখের জল!
স্বাধীনতা আমার
পঙ্গু বাবার হুইল চেয়ার।
স্বাধীনতা তুমি
বিকেলের আকাশে ধবল বক,
স্বাধীনতা তুমি
নিশ্চিন্তে উড়া সোনালি-ডানা চিল।
স্বাধীনতা তুমি
কোকিলের কণ্ঠে মিষ্টি সুর,
স্বাধীনতা তুমি
ভোরের আকাশে সোনাঝড়া রোদ্দুর।
স্বাধীনতা তুমি
বিদ্রোহী কবি নজরুলের চির উন্নত-মম-শীর,
স্বাধীনতা তুমি
জাদুঘরে ঝুলে থাকা রক্তমাখা আসাদের শার্ট!
স্বাধীনতা আমার
বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলার অধিকার,
স্বাধীনতা আমার
কোটি বাঙালী’র জেগে উঠার উদ্যম গতি।
স্বাধীনতা তুমি
২১শে ফেব্রুয়ারি’র প্রভাত ফেরির গান,
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে ফুলের সমাহার।
স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের ভালবাসার সোনার বাংলা,
স্বাধীনতা তুমি
জীবনানন্দ’র ধানসিড়ির তীরে ফিরে আসার আর্তনাদ।
স্বাধীনতা তুমি
কিশোরির হাতে বর্ষাবরণ কদম ফুল,
স্বাধীনতা তুমি
গ্রীষ্মের দুপুরে জ্বলে উঠা কৃষ্ণচূড়া’র আগুন।
স্বাধীনতা আমার
সবুজ ঘাসের চাদরে রক্তমাখা পতাকা,
স্বাধীনতা আমার
কোটি বাঙালীর হৃদয় জুড়ানো ভালবাসা।
স্বাধীনতা তুমি
কাঁশফুলের শুভ্র ঝড়,
স্বাধীনতা তুমি
আমার হৃদয়ে চির অমর।
এই পতাকার সূর্য সাক্ষী
/ আল মাহমুদ
দ্যাখো আজ পতাকা দেখারই দিন।
কলরব করে ওঠো, উচ্চারণ কর
মুক্তির ভাষা। আমিও তোমাদের সাথে দেখতে থাকি।
তোমাদের সাথে আমার অপরিচ্ছন্ন দৃষ্টির অশ্রুসজল
চোখ দু’টি মেলে দাঁড়িয়ে থাকি। কী লাল, সবুজ
পতাকার মধ্যে গোল হয়ে বসে আছে,
মনে হয় যেন পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের
রক্তের লোহিত কণায় অঙ্কিত হয়েছে এ সূর্য।
আমার ভেতরে কলরব করে ওঠে কত মুখ
কত আকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টি। যারা আর
ফিরে আসেনি।
একজনের কথা মনে পড়ছে। মনতলা স্টেশনের
পাশ দিয়ে বামটিয়া বাজারের দিকে চলে গেছে যে পথ
সেখানে ছিল তার ক্যাম্প। ট্রেনিং নিতে গিয়ে
তার কুনুই থেকে রক্ত ঝরে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল।
ফেরেনি সে। তার মাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা বা শব্দ
বাংলা ভাষার অবিধানে ছিল না। কিন্তু তার মার
সামনে দাঁড়িয়ে আমি যে ইংগিতে কথা বলেছিলাম
তাতে মহিলা শুধু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে
ওই গোল সূর্যের মধ্যে তার পূত্রকে দেখেছিল,
অশ্রুসজল চোখে।
আরো একজনকে জানতাম- সে কুমিল্লা থেকে
বেরিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের দিকে। গুলিটা লেগেছিল
তার কোমরে। আগরতলা হাসপাতালে আমি তাকে
দেখতে গিয়েছিলাম। ডাক্তাররা বিষাক্ত শিশার টুকরো
নিখুঁতভাবে বের করতে পারলেও সে আর হাঁটতে পারেনি।
তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম
মুক্তির উৎসবে। ওই পতাকার লাল অংশে তার খানিকটা
রক্ত আছে। আমি সব সময় দেখি আর তার কথা ভাবি।
কী অবলীলায় তার নাম বাদ দিয়ে লেখা হয়ে যায়
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস! সে ছিল কুমিল্লার একটি
হিন্দু পরিবারের মেয়ে। তার পিতার উপজীব্য ছিল
সংগীত। আমি সাক্ষ্য দেই যে, পতাকার ঐ লাল অংশে
তার রক্তের লোহিত কণিকা মিশ্রিত আছে।
হে ইতিহাস, লেখো তার নাম।
কুষ্টিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছেলেটি।
কুষ্টিয়ার কাস্টম কলোনির পাশে, সে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল শত্রুদের জিপকে উড়িয়ে দিতে।
খন্ড খন্ড হয়ে উড়ে গিয়েছিল তার বাহু, উরু ও
পিঠের কিছু অংশ। হাসিবুল ইসলাম
আল্লাহু আকবার বলে সে আক্রমণ করেছিল।
তার বুক থেকে কলজে উড়ে গিয়ে ওই
পতাকায় লেগে আছে।
লেখো তার শেষ উচ্চারণ আল্লাহু আকবার।
কলরবমুখর হে ঢাকা মহানগরী
তোমাকে লিখতে হবে ওই রক্ত গোলকে
আসাধারণ বিবরণ। দেখতে হবে ইতিহাস নির্মাণ
করে কারা? আর কারা কেড়ে নেয় বীরত্বের পদকচিহ্ন!
দ্যাখো আজ পতাকা দেখারই দিন
কলরব করে ওঠো, উচ্চারণ কর-
মুক্তির ভাষা। আমিও তোমাদের সাথে দেখতে থাকি।
কমলের চোখ
---আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।
.
কমলকে চেন তুমি !
সুন্দর সুঠাম দেহ, প্রদীপ্ত চোখ
দুপুর রোদের মতো তীব্র প্রখর।
একটা বুলেট
কমলের ডান চোখ
ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
কমল আমার বন্ধু, বিদগ্ধ সচেতন
হৃৎপিণ্ড যার
কুকুর শেয়াল খেয়ে আজ পলাতক।
আরো বহু, আমার তোমার
বন্ধু কি প্রিয়জন
ধমনী যাদের ছিলো কৃষ্ণচুড়ার মতো
তাজা সোচ্চার,
রক্তের কোলাহলে স্তব্ধ এখন।
কমলের চোখ, রক্ত হৃৎপিণ্ড
ওরা কেন দিলো?
যে প্রশ্ন করিনি তো।
সম্প্রতি মাতা তার
ছোট শিশু বেচেছে, কেননা
চাল প্রয়োজন। তুলসীর ঘাটে
নগণ্য প্রাণ এক শাশুড়ি আত্মঘাতি।
কারণ সুবর্ণ গ্রাম গিয়েছ কি?
তবে একবার ঘুরে দেখে আস।
চেয়ে দেখ উঠোনে দাওয়ায়, কিংবা
পুকুর ঘাটে, রমণীর নগ্ন শরীর
জ্যোৎস্নায় প্লাবিত
অন্ধকারে তার আশ্রয়, নতুবা
গলায় ফাঁসি।
কমলের চোখ, রক্ত হৃৎপিণ্ড
ওরা কেন দিলো?
সে প্রশ্ন তোমার নিকট।
যদি রাজদণ্ড দাও
-অসীম সাহা
যদি রাজদণ্ড দাও---আমি মাথা পেতে নেবো।
ক্ষমার অযোগ্য যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে,
আর সেই ভুলের জন্যে যদি বদলে যায় ভৌগোলিক সীমা,
যদি আত্মজের নিক্ষিপ্ত তীর শূন্যতায় উড়ে গিয়ে
শক্তিশেল হয়ে বেঁধে তোমার শরীরে---
তুমি তবে কোন্ দণ্ড দেবে ?
যদি রাজদণ্ড দাও---আমি মাথা পেতে নেবো।
পিতা, একদিন তুমি ছিলে স্বপ্নের ভেতরে,
তোমার স্বপ্নের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম
আমার অখণ্ড নীলাকাশ;
কিন্তু তুমি তো জানো পিতা, স্বচ্ছ সুন্দর সেই নীলাকাশকে
ঢেকে দেয় যে-শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ
আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকা যে-বজ্রের হুংকার
উদ্ধত আক্রোশে গর্জে উঠে পৃথিবীকে ভস্মীভূত করে,
আমি সেই গর্জনের অগ্নি থেকে জেগে ওঠা বিভ্রান্ত বালক
কিছুতেই বুঝতে পারিনি
আমি তোমাকে আঘাত করে
আমারই অস্তিত্বের মূলে আঘাত করেছি।
তার জন্যে আমাকে এখন যে শাস্তি দেবে দাও---
আমি মাথা পেতে নেবো।
যদি রাজদণ্ড দাও---যদি নির্বাসন দিয়ে দাও
আফ্রিকার দুর্গম গহন অরণ্যে
আমি মেনে নেবো, এ-আমার আত্মঘাতী বিনাশের যোগ্য পুরস্কার।
পিতা, যদি জানতাম, আমারই ভুলের জন্যে
এতো রক্ত, এতো ক্লেদ জমা হবে পিতৃভূমিতে,
যদি জানতাম, নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে তোমারই বুকের রক্তে
রঞ্জিত হয়ে যাবে মানচিত্র আমার,
যদি জানতাম, মধ্যরাতে তোমারই ছায়ারা এসে
তোমাকেই বধ করবে নির্মম দু’হাতে;
যদি জানতাম, তোমার নিথর দেহ রক্তাপ্লুত পড়ে থাকবে
উপবাসী সিঁড়ির ওপরে;
যদি জানতাম, তোমার বক্ষ থেকে সিঁড়ি বেয়ে
নেমে যাবে সাত কোটি রক্তের ধারা---
তা হলে এই হাতের প্রতিটি আঙুল দিয়ে
আমি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতাম আমার উদ্ভ্রান্ত আত্মাকে,
আমি আমার চোখে বিঁধিয়ে দিতাম
অভ্রভেদী শিমুলের কাঁটা।
আমার বক্ষবিদীর্ণ আর্তচিৎকারে যদি তোমার ঘুম ভাঙতো
তুমি দেখতে পেতে, করজোড়ে তোমারই পায়ের কাছে
পড়ে আছে নতজানু তোমার সন্তান।
তুমি কী করে তাকে ক্ষমাহীন দুই হাতে ফেরাতে তখনি?
আমি জানি, পাহাড়ের অন্তরালে বয়ে যাওয়া
স্বচ্ছতরে ঝর্নাধারার মতো
তোমার হৃদয় ছিলো শান্ত স্নিগ্ধ নদী,
তোমার হৃদয় ছিলো বাউলের একতারা, ক্লান্ত ভাটিয়ালী।
পিতা, তুমি কি জানতে, তোমার হৃদয় থেকে উৎসারিত
এই জল একদিন সবকিছু ভুলে গিয়ে
তোমাকেই উগড়ে দেবে বঙ্গোপসাগরে?
তুমিহীন এই মাটি আর্তনাদ করে উঠবে
মধুমতী নদীটির তীরে?
যদি জানতে, যদি তুমি জানতে
পিতৃত্বের এই দায় তোমাকেই একদিন রক্তমূল্যে শোধ দিতে হবে;
তখনো কি তুমি এই স্বদেশের মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠে
পরাধীন মানুষের মুক্তিমন্ত্র হতে?
পিতা, এইখানে তুমি আজ নেই---তোমার ছায়ারা পড়ে আছে।
খুব ভোরে আকাশ বিদীর্ণ করে যে-রক্তিম সূর্য ওঠে পুবের আকাশে
সবুজ প্রকৃতির মধ্যে তার গাঢ় রং মিশে গিয়ে
যে-আশ্চর্য আভা ছড়িয়ে যায় দিগন্তে-দিগন্তে,
তার মধ্যে তোমাকে আমি দেখতে পাই।
আমার প্রতিমুহূর্তের নিশ্বাসের মধ্যে
তুমি চিরকালের বাতাস হয়ে ঢুকে যাও।
আমার সবটুকু অস্তিত্বের মধ্যে তোমার মৃত্যুহীন উপস্থিতি
আমাকেই তুমি করে তোলে;
তার মানে তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্বই নেই।
তবু তোমার উপস্থিতিহীন অস্তিত্বের ভয়ে শংকিত
একদল শিকারি তোমার ছায়ার ওপরে অন্ধকারে প্রলেপ
লাগিয়ে দিতে চায়;
একদিন তুমি যাদেরকে হৃদয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়েছিলে,
তারাই তোমার অস্তিত্বের অহংকারের ওপরে
লেপ্টে দিতে চায় পঁচিশের কালো অন্ধকার
তুমিহীন তোমার অস্তিত্ব এসে ভর করে বঙ্গভূমিতে!
মানুষই তো ভুল করে পিতা
আমার এই দেহখানি সে-ভুলেরই দাস।
যদি পারো ক্ষমা কোরো অধম সন্তানে।
আর যারা তোমারই রক্তের দামে কেনা এই স্বদেশের
মাটিকেই বদলে দিতে চায়,
লাল ও সবুজের মানচিত্রে আঁকতে চায় কলংকতিলক;
তোমার ক্ষমার হাত একদিন যদি ঐ জলে-স্থলে অন্তরিক্ষে
ছুটে চলে যায়
সেই দিন আমাকেও নির্বাসন দিও---
এ-পৃথিবী পার করে ফেলে দিও অন্য কোনো গহন অরণ্যে।
যদি রাজদণ্ড দাও---যদি ফাঁসিকাষ্ঠে স্তব্ধ হয় এ-দেহ আমার
সব আমি মাথা পেতে নেবো;
শুধু আমি কিছুতেই মানবো না
আমার বুকের ’পরে চেপে থাকা আগস্টের সম্মিলিত ঘাতক আঁধার।
মাতৃভূমির জন্য- -সৃজন সেন
আমার বয়স তখন কতোই বা !
চার কিংবা পাঁচ।
অথচ আমার স্মৃতিকে আজও অন্ধকার করে দেয়
সেই সময়ের এক রাশ কালো ধোঁয়া
কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে যে ধোঁয়া-
আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল,
আমাদের বাড়ির শেষপ্রান্তে
বুড়ো বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে
সবাই ভিড় করে সেই ধোঁয়া দেখছিল,
আমিও মায়ের কোলে চড়ে সেই ধোঁয়া দেখছিলাম,
সবাই আতঙ্কে ‘রায়ট লাগছে, রায়ট লাগছে’ বলে
ছোটাছুটি করছিল
এবং তার কদিন পরেই
সদ্য-বিবাহিত দাদা-বৌদির সঙ্গে
আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমার মাকে, আমার বাবাকে
আমি ছেড়ে এসেছিলাম আমাদের সেই বুড়ো বটগাছ,
টিনের চালাওয়ালা গোবরলেপা বেড়ার ঘর,
বাড়ির পেছনের পুকুর,
পুকুরপাড়ের নোনা গাছ
এবং আমার প্রিয় কাজলা দিদিকে,
ছেড়ে এসেছিলাম আমার মাতৃভূমিকে,
আমার জন্মভূমিকে।
আর সেদিনের পর থেকে
একদিনের জন্যও আমি আর ওই জন্মভূমিতে
ফিরে যেতে পারিনি,
একবারের জন্যও না।
এখন আমার স্মৃতিতে সব কিছু ঝাপসা-
সেই ঘর, সেই গাছ, সেই কাজলাদিদি,
… সব, সব !
চাঁদপুর থেকে স্টিমারে,
স্টিমারে করে গোয়ালন্দ,
গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন,
দর্শনায় আমাদের বাক্স-প্যাঁটরা ওলোট-পালট
এবং অবশেষে, এক সন্ধেবেলা শিয়ালদা স্টেশনে।
তারপর ঘোড়ার গাড়ি,
ঘোড়ার গাড়ি চেপে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট,
প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের সাড়ে তিন হাত চওড়া এক অন্ধ গলি
সেই অন্ধগলির এগারোর বি নম্বর বাড়িতে একটি ঘর
সেই ঘরের দাদাবৌদির সঙ্গে খাঁচায় বন্দি আমি।
আমি, যার মুখে তখনও নোয়াখাইল্যা ভাষার টান,
আমি, যাকে দেখলেই প্রাইমারি স্কুলের ছেলেরা
কানের উপর উপুড় হয়ে চিৎকার করে বলত-
‘বাঙালো রস খাইল ভাঁড় ভাঙিল,
পয়সা দিল… ও… না…’
সেই আমি চারদিকের ওই টিটকারির ভয়ে নিজের
বাঙালপনাকে গোপন করার জন্য
প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে
ধীরে ধীরে যখন অন্য মানুষ হয়ে উঠছিলাম
ঠিক তখনই আমার জন্মভূমি থেকে
বাবার একখানা চিঠি এসেছিল,
সবাই সে চিঠি নিয়ে
জোরে জোরে আলোচনা করছিল
এবং আমি শুনেছিলাম-
ঢাকায় নাকি গুলি চলেছে, গুলি !
বহু বছর পরে জেনেছিলাম
সেই গুলি চলেছিল তাদের ওপর
যারা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে
ওপার বাংলায় লড়াই শুরু করেছিল,
শুনেছিলাম-
তারা নাকি পুলিশের বন্দুকের সামনে
জামার বোতাম খুলে
চিৎকার করে গাইছিল-
“ওরা আমার মুখের কথা কাইড়্যা নিতে চায়”,
আর সেই ‘মুখের কথা’র গৌরব রক্ষা করতেই
তারা নাকি পুষ্পাঞ্জলির মতই
তাদের প্রাণকে সমর্পণ করেছিল।
আর এপার বাংলায় আমি
আমার সমস্ত বাঙালপনাকে ঝেড়ে ফেলে তখন
ধীরে ধীরে হয়ে উঠছি
কেতাদুরস্ত অন্য এক মানুষ,
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে
একটার পর একটা ক্লাস টপকে
আমি রণপায়ে এগিয়ে চলেছি,
ইংরাজিতে কথা বলায়, চালচলনে, আদব কায়দায়
আমি তখন সবাইকে মুগ্ধ করতে পারি,
রাম ব্যানার্জি লেনের বাড়ি ছেড়ে
আমরা উঠে এসেছি কলকাতার এক অভিজাত পাড়ায়,
কেউ আর আমায়
‘বাঙাল’ বলতে সাহস পায় না,
বরং একটু সমীহ করেই চলে,
আমার দাদা-বৌদি
আমাকে নিয়ে গর্ব করে,
আমাদের ভূতপূর্ব বাঙাল জীবনকে
আমরা তখন রীতিমতো ঘৃণা করতে শিখে গেছি।
তারপর থেকে আমার জীবনে শুধুই চড়াই …
আমি এখন এক সাহেবি কোম্পানির
নামি অফিসার,
যে কোম্পানির অভিভাবক
এক নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানি,
সেই কোম্পানির স্বার্থে
আমি এখন দেশে-বিদেশে উড়ে বেড়াই,
অধিকতর বিদেশী ব্যবসা,
অধিকতর বিদেশী চুক্তি,
অধিকতর বিদেশী পরামর্শ, কমিশন ইত্যাদি
অর্জনের মধ্য দিয়েই
আমার আজকের বিকাশ, আমার প্রতিপত্তি।
আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে ‘ড্যাডি’ বলে ডাকে
মাকে ‘মাম্মি’,
আমার মত ওরাও এখন শুদ্ধ করে
বাংলায় বথা বলতে পারে না,
শুদ্ধ করে লিখতে পারে না
মাতৃভাষায় কয়েকটা লাইন,
আমার ছেলেমেয়েদের কাছে
বাংলা ভাষা একান্তই বিদেশী !
সেবার লন্ডনে
এক জাপানি শিল্পপতিকে
বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে
তার মাতৃভাষা জাপানিতে
অন্যদের সঙ্গে যখন অনর্গল কথা বলতে দেখেছিলাম
তখন আমার বুকের ভেতরে
কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছিল,
ইংরাজিতে কথা বলতে না পারার জন্য
ওই মানুষটির ভেতরে কোনও লজ্জা ছিল না,
বরং মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার অহমিকায়
মানুষটিকে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখেছিলাম,
আমার ভেতরে সেই অভিজ্ঞতার যন্ত্রণা
একটা কান্না হয়ে গুমরে গুমরে উঠছিল,
আমার মনে হচ্ছিল-
আমার কোনও মাতৃভূমি নেই,
আমার কোনও মাতৃভাষা নেই,
আমি যেন এক শিকড়বিহীন চিরবিদেশী !
তাই-
মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দেয়
তারা কেমন মানুষ
আজ আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে,
আমার বুকের মধ্যে
সেই বাংলাদেশের জন্য
সেই বাংলা ভাষার জন্য
একটুখানি বাঙালী হয়ে ওঠার জন্য
একটা ভয়ংকর যন্ত্রণা টনটন করে ওঠে !
আমি কি বলতে পেরেছিলাম - মহাদেব সাহা
আমার টেবিলের সামনে দেয়ালে শেখ মুজিবের
একটি ছবি টাঙানো আছে
কোন তেলরঙ কিংবা বিখ্যাত স্কেচ জাতীয় কিছু নয়
এই সাধারণ ছবিখানা ১৭ মার্চ- এ বছর শেখ মুজিবের
জন্ম দিনে একজন মুজিব প্রেমিক আমাকে উপহার দিয়েছিলো
কিন্তু কে জানতো এই ছবিখানা হঠাৎ দেয়াল ব্যপে
একগুচ্ছ পত্র পুষ্পের মতো আমাদের ঘরময়
প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে রাত্রিবেলা
আমি তখন টেবিলের সামনে বসেছিলাম আমার স্ত্রী ও সন্তান
পাশেই নিদ্রামগ্ন
সহসা দেখি আমার ছোট্ট ঘরখানির দীর্ঘ দেয়াল জুড়ে
দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব;
গায়ে বাংলাদেশের মাটির ছোপ লাগানো পাঞ্জাবি
হাতে সেই অভ্যস্ত পুরনো পাই
চোষে বাংলার জন্য সজল ব্যাকুলতা
এমনকি আকাশকেও আমি কখনো এমন গভীর ও জলভারানত
দেখিনি।
তার পায়ের কাছে বয়ে যাচ্ছে বিশাল বঙ্গোপসাগর
আর তার আলুথালু চুলগুলির দিকে তাকিয়ে
আমার মনে হচ্ছিলো
এই তো বাংলার ঝোড়ো হাওয়ায় কাঁপা দামাল নিসর্গ
চিরকাল তার চুলগুলির মতোই অনিশ্চিত ও কম্পিত
এই বাংলার ভবিষ্যৎ!
তিনি তখনো নীরবে তাকিয়ে আছেন, চোখ দুটি স্থির অবিচল
জানি না কী বলতে চান তিনি,
হঠাৎ সারা দেয়াল ও ঘর একবার কেঁপে উঠতেই দেখি
আমাদের সঙ্কীর্ণ ঘরের ছাদ ভেদ করে তার একখানি হাত
আকাশে দিকে উঠে যাচ্ছে-
যেমন তাকে একবার দেখেছিলাম ৬৯-এর গণআন্দোলনে
তিনি তখন সদ্য ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসেছেন
কিংবা ৭০-এর পল্পনে আর একবার ৭১-এর ৭ই মার্চের
বিশাল জনসভায়;
দেখলাম তিনি ক্রমে উষ্ণ, অধীর ও উত্তেজিত হয়ে উঠছেন
একসময় তার ঠোঁট দুটি ঈষৎ কেঁপে উঠলো
বুঝলাম এক্ষুনি হয়তো গর্জন করে উঠবে বাংলার আকাশ,
আমি ভয়ে লজ্জায় ও সঙ্কোচে নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম।
আমার মনে হেলা আমি যেন
মুখে হাত দিয়ে অবনত হয়ে আছি
বাংলাদেশের চিরন্তন প্রকুতির কাছে,
একটি টলোমলো শাপলা ও দিঘির কাছে,
শ্রাবণের ভরা নদী কিংবা অফুরন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে
কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো অভিযোগ নিঃসরিত হলো না;
তবু আমি সেই নীরবতার ভাষা বুঝতে চেষ্টা করলাম
তখন কী তিনি বলতে চেয়েছিলেন, কী ছিলো তার ব্যাকুল প্রশ্ন
ব্যথিত দুটি চোখে কী জানার আগ্রহ তখন ফুটে উঠেছিলো!
সে তো আর কিছুই নয় এই বাংলাদেশের ব্যগ্র কুশলজিজ্ঞাসা
কেমন আছে আট কোটি বাঙালী আর এই বাংলা বাংলাদেশ!
কী বলবো আমি মাথা নিচু করে ক্রমে মাটির সাথে মিশে
যাচ্ছিলাম-
তবু তাকে বলতে পারিনি বাংরার প্রিয় শেখ মুজিব
তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি
তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,
দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না
বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের
গুলিতে উড়ে গেল কেন?
তোমাকে কিভাবে বলবো তোমার নিষ্ঠুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে
প্রথমে জয়বাংলা, তারপরে একে একে ধর্মনিরপেক্ষতা
একুশে ফেব্রুয়ারী ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্রত
হলো তারা,
এমনকি একটি বাঙালী ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্যত
হলো তারা,
এমনকি একটি বাঙালী ফুল ও একটি বাঙালী পাখিও রক্ষা পেলো না।
এর বেশি আর কিছুই তুমি জানতে চাওনি বাংলার প্রিয়
সন্তান শেখমুজিব!
কিন্তু আমি তো জানি ১৫ই আগষ্টের সেই ভোরবেলা
প্রথমে এই বাংলার কাক, শালিক ও খঞ্জনাই
আকাশে উড়েছিলো
তার আগে বিমানবাহিনীর একটি বিমানও ওড়েনি,
তোমার সপক্ষে একটি গুলিও বের হয়নি কোনো কামান থেকে
বরং পদ্মা-মেঘনাসহ সেদিন বাংলার প্রকৃতিই একযোগে
কলরোল করে উঠেছিলো।
আমি তো জানি তোমাকে একগুচ্ছ গোলাপ ও স্বণৃচাঁপা
দিয়েই কী অনায়াসে হত্যা করতে পারতো,
তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা
তুমি কি তাই টলতে টলতে টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে
বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির উপর পড়ে গিয়েছিলে?
শেখ মুজিব সেই ছবির ভিতর এতোক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে
মনে হলো এবার ঘুমিয়ে পড়তে চান
আর কিছুই জানতে চান না তিনি;
তবু শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাকে আমার বলতে
ইচ্ছে করছিলো
সারা বাংলায় তোমার সমান উচ্চতার আর কোনো
লোক দেখিনি আমি।
তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিন্তবাদক
বাংলাদেশ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলো আমি
আমার বুক-পকেট থেকে ভাঁজ-করা একখানি দশ
টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম
বলেছিলাম, দেখো এই বাংলাদেশ;
এর বেশি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না!
আমি কি বলতে পেরেছিলাম, তার শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার
আগে আমি কি বলতে পেরেছিলাম?
তোমাকে মনে পড়ে যায
-মোহন রায়ান
মধুর কেন্টিনে যাই
অরুনের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার সেই সদা হাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট,
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি
সারাক্ষন চোখে চোখে ভাসে
বুঝি এখনই সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ দিবে তুমি
ওই তো, ওই তো সবার আগে তুমি মিছিলে
কি সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা
প্রতিটি পা ফেলছো কি দৃঢ় প্রত্যয়ে
কি উচ্চকিত তোমার কন্ঠের শ্লোগান
যেন আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে
হাত ঊঠছে হাত নামছে
মাথা ঝুকছে ঘাড় দুলছে চুল উড়ছে বাতাসে
ওই তো, ওই তো আমাদের ঐক্যের পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি
মধুর কেন্টিনে যাই
নিত্য নতুন প্রোগ্রাম, মিছিল সভা বটতলা
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দুর্জয় শপথ
সামরিক জান্তার ছোবল থেকে
শিক্ষাজীবন, শিক্ষাঙ্গনের স্বায়ত্বশাসন রক্ষার অঙ্গীকারে
ডাক দেই দেশবাসীকে
তোমারি মত নিরাপত্বাহীনতায়
প্রতিটি ছাত্রের দুর্বিষহ জিম্মীজীবন এখনো এ ক্যাম্পাসে
হলে গেটে গেটে পড়ে থাকে ভংকর বিস্ফোরন্মোখ তাজা বোমা
প্রতিদিন চর দখলের মত হল দখলের হিংস্র মহড়া
গুলি ও বোমা ফাটার শব্দ
এখনো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ
এ অস্ত্রের উৎস কোথায়?
মধুর কেন্টিনে যাই
প্রতিদিন আমাদের জীবন হাতের মুঠোয়
প্রতিদিন হামলা রুখতে হয়
বসু, আজ সেই প্রতিরোধের সারিতে তুমি নেই
আজ বড়ই অভাব অনুভব করছি তোমার
শিক্ষাভবন অভিমুখে সামরিক শাসন ভাঙ্গার প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারীর কাফেলায় তুমি ছিলে
৪ঠা আগস্ট সশস্ত্র দুবৃত্তদের কবল থেকে
আমাদের পবিত্র মাটি রক্ষা করার সম্মুখ সমরে তুমি ছিলে
এমন কোন ধর্মঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল আন্দোলন নেই যে তুমি ছিলে না
সেই নৃশংস ঘাতক রাতেও
তুমি অস্ত্রধারীদের দূর্গের দিকে অবিচল যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলে
ঘাতক বুলেট ভেদ করে গেছে তোমাকে
কিন্তু তুমি পিছু হটনি
তুমি বীর, তুমি সাহসী যোদ্ধা, তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান
যুগে যুগে সংগ্রামীদের অফুরান প্রেরণা
কবিতাঃমুক্তিনিনাদ
কবিঃমিন্টু রায়
ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে দেখাে—
হয়তো আমাকে আজকে তোমরা দ্বিজ বলবে,
হ্যাঁ, সনটি ছিলো ঊনিশ'শ সাতচল্লিশ।
আমি জন্মাবো বলে —
একখণ্ড সমতলভূমি প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিল আমার পূর্বপুরুষ;
পাঁজর দিয়ে গড়েছিল দুর্ভেদ্য প্রতিরোধের মহাপ্রলয় ,
ভেঙে ফেলেছিল টানা দু'শো বছরের শােষণ প্রাচীর!
পরিশেষে আমার জন্ম।
সকলের চোখে মুখে ছিল বিজয়ের উচ্ছ্বাস,
জন্মোৎসবের শঙ্খনিনাদ বাজতে না বাজতেই মুখোশধারী পাক দানবের দল —
দু'পায়ে আমার পড়িয়েছিল বন্দিত্বের শিকল।
অসহ্য যন্ত্রণা আর তীব্র চিৎকারেও বিন্দুমাত্র করুণা জাগাতে পারিনি ওদের,
আমার মুখের ভাষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে—
বাহান্নয় ওদের হিংস্র হাত চেপে ধরেছিল আমার কন্ঠনালী।
ওরা ছিল শকুনের গায়ের উঁকুনের চেয়েও নিকৃষ্ট,
কামোন্মত্ত ষাঁড়ের মতো গন্ধ শুঁকে, মুখ উঁচিয়ে—
বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে চলেছিল আমার বেহুলা মেয়েদের উপর।
পিতার প্রতিটি শিরা-উপশিরায়,
হৃদপিন্ডের স্পন্দন স্পন্দনে,
দাউ দাউ করত আমাকে মুক্ত করার দাবানল!
স্নেহ বৎসল পিতা আমার, শিকল মুক্ত করতে আমাকে–
সমস্ত গ্লানি ঝেড়ে কতবার করেছে করুণ আর্তনাদ!
তবু বিন্দুমাত্র করুণা জাগেনি ওই হায়েনাদের মনে।
দিন, মাস, বছর গড়িয়ে আমি তখন চব্বিশে পা রেখেছি,
বয়সে যদিও টগবগে যৌবন ;
তবু পায়ে আমার শিকল জড়ানো দগদগে ঘা।
নির্মম নির্যাতন আর অবহেলার সেই ঘা যেন বড় হতে হতে...
হঠাৎ সংক্রামকে রূপ নিয়েছিল।
সংক্রমণ ঘটল প্রতিটি মানুষের শরীরে মেরুদন্ডে অন্ত্রনালী হতে মস্তিষ্কে,
মুক্তির নেশায় প্রতিটি মানুষ
নিজের জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে
তৈরি করেছিল যেন এক একটি গ্রেনেড।
ধান ভানার নামে ঢেঁকিতে পাড় রেখে
শুরু হয়েছিল মায়েদের হাঁটুতে শক্তি সঞ্চার,
দুগ্ধপোষ্য শিশুকে স্তন্যপান করাতে করাতে
ইট ভাঙ্গার হাতুড়ি চালিয়ে বাহুর প্রতিটি শিরায়,
ছলাৎ ছলাৎ প্রবাহিত হতে লাগল অগ্নিগোলা।
কৃষক-মজুর, তাঁতি থেকে টোকাই সকলের গায়ের ঘাম থেকে
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদের গন্ধ!
ফাঁসির মঞ্চ চুম্বন করে পিতা আমার
ফাঁসির দড়ির মতো টান টান উত্তেজনা নিয়ে
বজ্রকন্ঠে হুঙ্কারে দিল— 'এবারের সংগ্রাম,
মুক্তির সংগ্রাম'
সেদিন ছিল সূর্যস্নাত দুপুরোত্তর–
ঊনিশ'শ একাত্তর।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চরম উত্তেজনায়
ছিন্নভিন্ন করে ফেলি আমার পায়ে শিকল।
হ্যাঁ, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল,
রক্তের স্রোত রাঙিয়ে দিয়েছিল দিগ্বিদিক।
অবশেষে রক্ত ঝরতে ঝরতে জমাট বেঁধেছিল সবুজ ঘাসের বুকে
ঠিক পূর্বদিগন্তের ওই টকটকে লাল সূর্যের মতো।
পিতার নির্দেশই পেলাম নতুন জীবন,
বিশ্ব মানচিত্রে নতুন নাম বাংলাদেশ;
সেই থেকেই আমি মুক্ত, আমরা স্বাধীন।
বত্রিশ নম্বর-
কামাল চৌধুরী
এই বাড়িটা জাতির পিতার, এই বাড়িটা সবার
এই বাড়িটা মুজিব নামে পলাশ, রক্তজবার
এই বাড়িটা অশ্রুলেখা শোকের আগস্ট মাস
এই বাড়িটা পিতৃভূমির কান্না, দীর্ঘশ্বাস।
এই বাড়িটা পদ্মা-মেঘনা, মধুমতির জল
এই বাড়িতে চিরকালের সাহস অবিচল
মুক্তিদাতা উন্নত শির-দীর্ঘদেহী ভোর
এই বাড়িটা অন্ধকারে তাড়ায় ঘুমঘোর।
এই বাড়িটা একাত্তরে মুক্ত নীলাকাশ
হত্যাকারী, শত্রুসেনা, রাজাকারের ত্রাস
এই বাড়িটা সাহস দিলে আমরা জেগে থাকি
বাংলা মায়ের রক্তশপথ হাত উঁচিয়ে রাখি।
এই বাড়িটা হাজার বছর পলিমাটির ক্রোধে
লালসবুজে মহিমাময় আত্মত্যাগী রোদে
এই বাড়িটা ধুলো-কাদা, বৃষ্টিভেজা মাটি
মহাকালের বটের ছায়ায় আমরা সবাই হাঁটি।
এই বাড়িতে মুজিব আছেন, জাতির বাতিঘর
রবি ঠাকুর, নজরুল তাঁর প্রাণের কণ্ঠস্বর
এই বাড়িতে পাল উড়িয়ে মহামানব আসে
জয়বাংলার স্রোতের মুখে নৌকোখানি ভাসে।
তর্জনীতে আকাশ কাঁপে, তর্জনীতে দেশ
এই বাড়িটা বজ্রকণ্ঠ-মুক্তি অনিঃশেষ
এই বাড়িটা স্বাধীনতা, রক্ত দিয়ে লেখা
এই বাড়িতে বিশ্বজনের মহাসাগর দেখা।
এই বাড়িটা স্মৃতিসত্তা, জাতির জাদুঘর
এই বাড়িতে জাতির পিতা, আছেন মুজিবর
এই বাড়িটা তোমার আমার আত্মপরিচয়
এই বাড়িটা বঙ্গবন্ধু, জাতির হিমালয়।
আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু!
লুৎফর রহমান রিটন
মামলার নাম ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং।'
সংশোধিত নাম 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।'
আসামী সংখ্যা ৩৫। ১নম্বর আসামী শেখ মুজিব।
ওদিকে শেখ মুজিব বন্দী ছিলেন জেলখানায়, তাঁর ৩৪ সহযোদ্ধার সঙ্গে।
আর এদিকে 'জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো'
বলে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করছি আমরা পুরো পাকিস্তানকে।
পূর্ব এবং পশ্চিম।
টালমাটাল পূর্ব পাকিস্তান।
তীব্র আন্দোলন ক্রমেই তীব্রতর।
পরাভূত সোকল্ড লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইউব খান।
অতঃপর মুক্তি পেয়েছেন বাংলা ও বাঙালির মুক্তিসনদ
'ছয় দফা'র প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান।
অতঃপর তাঁকে আমরা ভালোবেসে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধীতে ভূষিত করেছি।
শৃঙ্খলিত বাংলা ও বাঙালির মুক্তিদূতকে তো বঙ্গবন্ধু সম্বোধনেই ডাকতে হবে।
তিনি আমাদের 'বঙ্গবন্ধু' হলেন।
তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখালেন।
একটি দেশের স্বপ্ন।
একটি পতাকার স্বপ্ন।
একটি মানচিত্রের স্বপ্ন।
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে স্তোত্রপাঠের মতো করে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন তিনি--
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঊর্মিমুখর একটি অকূল সমুদ্রের সামনে
তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে বললেন--'
রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো।'
আমরা রক্ত দিলাম।
আমাদের তিরিশ লক্ষ শহিদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠলো সমুদ্রটা।
বাংলার আকাশ-বাতাস-মৃত্তিকা-পাহাড়-বৃক্ষ-নদী-পাখি-ফুল-প্রকৃতি
কোরাস গাইলো--'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যাঁরা, আমরা তোমাদের ভুলবো না।'
কিন্তু আমরা তাঁদের ভুলে গেলাম।
আমরা স্মৃতিভ্রষ্ট হলাম।
আমরা কুলাঙ্গার ভুলে গেলাম আমাদের বঙ্গবন্ধুকে।
আমরা কুলাঙ্গার হত্যা করলাম আমাদের জাতির জনককে।
ছবি হয়ে গেলেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
অতঃপর একদিন তাঁকে আমরা স্থাপন করলাম দেয়ালে দেয়ালে, মনের খেয়ালে।
ফ্রেমবন্দী হয়ে গেলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু......।
বঙ্গবন্ধু উৎকীর্ণ ছিলেন ছবির ফ্রেমে।
আমরা তাতে ফুলের মালা পরিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছি।
তারপর একদিন কাগজের নোটে মুদ্রিত হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু।
অতঃপর তাঁকে আমরা পকেটে পুড়েছি।
অতঃপর মুদ্রিত সেই নোটের লোভ আর মোহের কাছে পরাজিত হতে হতে
আমরা কুলাঙ্গার কল্পনাতীত কুলাঙ্গার হয়ে উঠি দিন দিন।
অবলীলায় আমরা ভুলে যাই আমাদের বঙ্গবন্ধুকে।
আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় বুকের মধ্যে।
আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হয় করোটির ভেতরে।
আমরা বিস্মৃত হই--একজন বঙ্গবন্ধুকে লালন করতে হয়
প্রাত্যহিক যাপিত জীবনের চিন্তায় চেতনায় মননে ও মেধায়।
বিস্মৃতির গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে
উন্মত্ত নেশাতুর
আমরা কেবলই সংগ্রহ করি কাগজের নোটে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুকে।
কেবলই সংগ্রহ করি
কেবলই সংগ্রহ করি......।
আমাদের লিকলিকে ক্ষীণ ওয়ালেট-মানিব্যাগ ফুলে ওঠে পোটকা মাছের পেটের মতো।
দুধের ফেনার মতো উপচে পড়ে আমাদের ড্রয়ার-আলমিরা।
আমাদের বিছানার জাজিমের ভেতরে থরে থরে সাজানো থাকে কাড়িকাড়ি নোট।
কাগজের নোটে মুদ্রিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা লুকিয়ে রাখি বালিশের তুলোর ভেতরে।
আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আপনি আমাদের জন্যে এনে দিয়েছিলেন 'স্বাধীনতা' ।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আপনি আমাদের জন্যে নির্মাণ করেছিলেন আলাদা ভূখণ্ড।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--রক্ত আর জীবনের সুঁই-সুতোয় সেলাই করে দিয়েছিলেন আপনি লাল সবুজের অপরূপ একটি পতাকা।
আমরা যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই--আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন
মোহরের অধিক মোহর নিজস্ব মুদ্রা।
সেই মুদ্রায় হেসে উঠেছে বাংলা ভাষার অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণমালাসমূহ।
কিন্তু সেই বর্ণমালাকে উপেক্ষা করি,অবজ্ঞা করি আমরা!
আপনার দেয়া মোহরগুলোকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করে দিই বরফের দেশে!
অপমান করি পতাকাকে!
পতাকার অপমানে কেঁদে ওঠে মৃত্তিকায় মিশে থাকা তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মা।
আপনার অর্জিত 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল'কে ইজারা দিই শত্রুর কাছে!
এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র অনেক দাম দিয়ে কেনা
'স্বাধীনতা'কে বিক্রি করে দিই নামমাত্র মূল্যে!
আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু।
আপনি কি আমাদের ক্ষমা করবেন বঙ্গবন্ধু?
No comments:
Post a Comment