Wednesday, February 19, 2020

শামসুর রাহমান



বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
-শামসুর রাহমান

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের পুত প্রদেশের শ্যামলিমা
তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই।
কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে শিউলী-শৈশবে
'পাখি সব করে রব' বলে মদনমোহন তর্কালঙ্কার
কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক।
তুমি আর আমি অবিচ্ছিন্ন পরষ্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে, যেখানে কুসুমকলি সবই ফোটে
জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।
আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে আমারই বন্দরে।
গলিত কাঁচের মতো জলে ফাৎ না দেখে দেখে
রঙিন মাছের আশায় ছিপ ধরে কেটে গেছে বেলা।
মনে পড়ে, কাঁচি দিয়ে নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি 'হাসি খুশি'র খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদ্বীপে কম্পাস বিহনে।
তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন বিশাল গাছের কোঠর থেকে লাফাতে লাফাতে
নেমে আসো, আসো কাঠবিড়ালীর রূপে, ফুল্ল মেঘমালা থেকে
চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ মুখের মতোই
দুলে দুলে ওঠো বার বার কিংবা টুকটুকে লঙ্কা-ঠোঁট টিয়ে হয়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।
আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখি-তারা।
যুদ্ধের আগুনে, মারীর তাণ্ডবে
প্রবল বর্ষায় কি অনাবৃষ্টিতে
বারবণিতার নূপুর নিক্বনে
বণিতার শান্ত বাহুর বন্ধনে
ঘৃণায় ধিক্কারে, নৈরাজ্যের এলোধাবাড়ি চিৎকারে
সৃষ্টির ফাল্গুনে, হে আমার আঁখিতারা
তুমি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে কী থাকে আমার ?
উনিশশো' বাহান্নোর কতিপয় তরুণের খুনের পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী। সে ফুলের একটি পাপড়িও আজ
ছিঁড়ে নিতে দেব না কাউকে।
এখন তোমাকে ঘিরে ইতর বেলেল্লাপনা চলছে বেদম।
এখন তোমাকে নিয়ে খেংরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষমাস।
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।





অভিশাপ দিচ্ছি –
শামসুর রাহমান

না আমি আসিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই, তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা পুঁতেছিল
আমাদেরই আপন জনেরই লাশ দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এ পাড়া ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না চিনতে কখনো;
অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য,
বিশ্রামের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা।
 প্রেতায়িত সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি...
অভিশাপ দিচ্ছি,....
অভিশাপ দিচ্ছি....



বন্দী শিবির থেকে-
 শামসুর রাহমান-
ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও,
ফুর্তি করো সবান্ধব
সেজন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতো শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সেসব কবিতাবলী, যেন রাজহাঁস
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।

অথচ এদেশে আমি আজ দমবদ্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ, ফুল, পাখি
এমনকি নারী ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।

স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।

অথচ জানেনা ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।
 
 
ধন্য সেই পুরুষ
শামসুর রাহমান

ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;
ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে
প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়;
ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে সে উঠে আসে
রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।
ধন্য সেই পুরুষ, কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে
ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।
ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূর দিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসো
আর তোমারই প্রতীক্ষায়
ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ
জলধারার জন্যে। তোমার বুক ফুঁড়ে অহঙ্কারের মতো
ফুটে আছে রক্তজবা, আর
আমরা সেই পু®েপর দিকে চেয়ে থাকি, আমাদের
চোখের পলক পড়তে চায় না,
অপরাধে নত হয়ে আসে আমাদের দুঃস্বপ্নময় মাথা।
দেখ, একে একে সকলেই যাচ্ছে বিপথে অধঃপাত
মোহিনী নর্তকীর মতো
জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে,
বিশ্বস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে
সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন
কুমোরের ভাঙা পাত্রের মতো,
চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি,
দেখ, যে কোন ফলের গাছ
সময়ে-অসময়ে ভরে উঠেছে শুধু মাকাল ফলে।
ঝল্সে-যাওয়া ঘাসের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা
দেখ, এখানে আজ
কাক আর কোকিলের মধ্যে কোন ভেদ নেই।
নানা ছল-ছুতোয়
স্বৈরাচারের মাথায় মুকুট পরাচ্ছে ফেরেবক্ষাজের দল।
দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা
তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
তোমাকে হারিয়ে
আমরা সন্ধ্যায় হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো
হয়ে যাচ্ছিলাম,
আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিলো শোকের পোশাকে,
তোমার বিচ্ছেদের সঙ্কটের দিনে
আমরা নিজেদের ধক্ষংসস্তূপে ব’সে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে ব্যথিত
করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে
রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেঁননা জেনেছি
জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে
চিরকাল, গান হয়ে
নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর
কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয়
জ্যোৎস্নার সারস,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধক্ষনি।



বাইবেলের কালো অক্ষর
-শামসুর রাহমান
জো, তুমি আমাকে চিনবে না।
আমি তোমারই মতো একজন কালো মানুষ
গলার সবচেয়ে উঁচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান,
যে গানে তোমার দিলখোলা সুরও লাগছে।
জো, যখন ওরা তোমার চামড়ায় জ্বালা-ধরানো
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হো হো করে হেসে ওঠে,
তখন কাল সেঠে পড়ে সভ্যতার পিঠে
যখন ওরা বুট জুতো মোড়া পায়ে মারে তোমাকে,
তখন ধূলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
জো, যখন ওরা তোমাকে হাত পা বেঁধে নির্জন রাস্তায় গার্বেজ ক্যানের পাশে ফেলে রাখে,
তখন ক্ষ্যাপাটে অন্ধকারে ভবিষ্যৎ কাতরাতে থাকে, গা’ ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্যে।
যদিও আমি তোমাকে কখনো দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালো অক্ষরের মতো তোমার দুফোঁটা চোখ
তোমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে,
তোমার বেদনা এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপ্ত,
জো, আমি একজন ফাঁসির আসামীকে জানতাম
যিনি মধ্যরাতে আবৃতি করতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা
আমি এক সুদর্শন যুবাকে জানতাম যে দৈতার মান রাখার জন্যে
জান কবুল করেছিল আমাদের একাত্তুরের মুক্তিযুদ্বে
আমি একজন যাব্বজীবন কারাবন্দীকে ত্যাজী নেতাকে জানতাম
দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে যিনি কোন কোন রাতে
তার শিশু কন্যাকে একটু স্পর্শ করার জন্যে,
ওর মাথার ঘ্রান নেয়ার জন্যে উদ্বেল আর ব্যাকুল হয়ে আঁকড়ে ধরতেন কারাগারের শিক ।
আমি এমন এক তরুনের কথা জানতাম
যে তার কবিতার আলালের ঘরের দুলাল
মেনিমুখো শব্দাবলী ছেড়ে ফেলে ,অপেক্ষা করতো সে দিনের জন্যে
যে দিন তার কবিতা হবে সুর্যোমুখী ভাসনের মত ।
যখন তাদের কথা মনে পড়ে
তখন তোমার কথা নতুন করে ভাবি জো,
জো, যখন তোমার পাঁচ বছরের ছেলের বুক থেকে রাস্তায় ওরা ছড়ায় টকটকে লাল রক্ত
যেমন পিরিছে ডেলে দেয় কফি ,
জো,যখন তোমার পোয়াতি বউ হায়েনাদের দৃষ্টি থেকে পালানোর জন্যে দৌড়তে দৌড়তে মাঝ পথে হুমরি খেয়ে পড়ে
জো,যখন তোমার সহোদরকে ওরা লটকিয়ে দেয় ফাসিতে
তখন কাঁচা দুধের ফেনার মত
ভোরের সাদা আলোয়
বাইবেলের কালো অক্ষর ঘুলো আর্তনাদ করতে করতে হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠে ।



-কখনও আমার মাকে--
(শামসুর রাহমান)
 
কখনও আমার মাকে কোন গান গাইতে শুনিনি৷
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনও ঘুম পাড়াতেন কিনা আজ মনেই পড়ে না৷
যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনও কোন গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়৷ এবং স্বামীর
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়, বড় বেশি নেপথ্যচারিণী৷ যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাকে করেনি দখল
কোনদিন৷ মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসনকোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোন গান গেয়েছেন কিনা
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি৷
যেন তিনি সব গান দুঃখজাগানিয়া কোন কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!
-




যদি তুমি ফিরে না আসো
কবি শামসুর রাহমান
------------------------ -----------
যদি তুমি ফিরে না আসো
তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি
আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো
আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো
তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তুহীন উদ্যানের পথ, দেখছো
তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল
আমি ভাবতেই পারি না।
যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি
আমাকে ভুলে যেতে পারো,
যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া
কোনো উপন্যাস, তখন ভয়
কালো কামিজ প’রে হাজির হয় আমার সামনে,
পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখন
একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে,
আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে
অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন
ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।
বিদায় বেলায় সাঝটাঝ আমি মানি না
আমি চাই ফিরে এসো তুমি
স্মৃতি বিস্মৃতির প্রান্তর পেরিয়ে
শাড়ীর ঢেউ তুলে,সব অশ্লীল চিৎকার
সব বর্বর বচসা স্তব্দ করে
ফিরে এসো তুমি, ফিরে এসো
স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়
মিশে যাও স্পন্দনে আমার।
কোথায় আমাদের সেই অনুচ্চারিত অঙ্গীকার?
কোথায় সেই অঙ্গীকার
যা রচিত হয়েছিলো চোখের বিদ্যুতের বর্ণমালায়?
আমরা কি সেই অঙ্গীকারে দিইনি এঁটে
আমাদের চুম্বনের সীলমোহর?
আমি ভাবতেই পারি না সেই পবিত্র দলিল ধুলোয় লুটিয়ে
দুপাশে মাড়িয়ে, পেছনে একটা চোরাবালি রেখে
তুমি চলে যাবে স্তব্ধতার গলায় দীর্ঘশ্বাস পুরে।
আমার চোখ মধ্যদিনের পাখির মতো ডেকে বলছে- তুমি এসো,
আমার হাত কাতর, ভায়োলিন হয়ে ডাকছে- তুমি এসো,
আমার ঠোঁট তৃষ্ণার্ত তটরেখার মতো ডাকছে- তুমি এসো।
যদি তুমি ফিরে না আসো
গীতবিতানের শব্দমালা মরুচারী পাখির মতো
কর্কশ পাখসাটে মিলিয়ে যাবে শূন্যে,
আর্ট গ্যালারীর প্রতিটি চিত্রের জায়গায় জুড়ে থাকবে
হা-হা শূন্যতা,
ভাস্করের প্রতিটি মুর্তি পুনরায় হয়ে যাবে কেবলি পাথর,
সবগুলো সেতার, সরোদ, গীটার, বেহালা
শুধু স্তুপ স্তুপ কাষ্ঠখন্ড হয়ে পড়ে থাকবে এক কোণে।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
গরুর ওলান থেকে উধাও হবে দুধের ধারা,
প্রত্যেকটি রাজহাঁসের পালক ঝরে যাবে,
পদ্মায় একটি মেয়ে ইলিশও আর ছাড়বে না ডিম।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ত্রাণ তহবিলে একটি কনাকড়িও জমা হবে না,
বেবী ফুডের প্রত্যেকটি কৌটায় গুড়ো দুধ নয়
কিলবিল করবে শুধু পোকামাকড়।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
দেশের প্রত্যেক চিত্রকর বর্ণের অলৌকিক ব্যাকরণ
ভুল মেরে বসে থাকবেন, প্রত্যেক কবির খাতায়
কবিতার পংক্তির বদলে পড়ে থাকবে রাশি রাশি মরা মাছি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
এ দেশের প্রতিটি বালিকা
থুত্থুরে বুড়ি হয়ে যাবে এক পলকে,
এ দেশের প্রত্যেকটি যুবক খাবে মৃত্যুর মাত্রায়
ঘুমের বড়ি কিংবা গলায় দেবে দড়ি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ভোরের শীতার্ত হাওয়ায় কান্না-পাওয়া চোখে নজরুল ইসলাম
হতদন্ত হয়ে ফেরি করবেন হরবোলা সংবাদপত্র।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
সুজলা বাংলাদেশের প্রতিটি জলাশয় যাবে শুকিয়ে,
সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশের
প্রতিটি শস্যক্ষেত্র পরিণত হবে মরুভূমির বালিয়াড়িতে,
বাংলাদেশের প্রতিটি গাছ হয়ে যাবে পাথরের গাছ,
প্রতিটি পাখি মাটির পাখি।

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...