তোমার চোখ এত লাল কেন
– নির্মলেন্দু গুণ
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক।আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেক্ট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।
আমি চাই কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করুক:
আমার জল লাগবে কিনা, নুন লাগবে কিনা।
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না।
এঁটো বাসন গেজ্ঞি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক।কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক: ’তোমার চোখ এত লাল কেন?’
ওটা কিছু নয় –
নির্মলেন্দু গুণ
একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,
-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।
সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,
ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয় ।
অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।
মানুষ – নির্মলেন্দু গুণ
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।
আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।
আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।
মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।
আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।
মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।
আবার যখনই দেখা হবে
– নির্মলেন্দু গুণ
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।
এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।
‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।
শুধু তোমার জন্য
– নির্মলেন্দু গুণ
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু
একদিন চাদঁ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলোমৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয়বন্ধু হবে
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।
একদিন চুল কাটতে যাবোনা সেলুনে
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো
একদিন কালো চুলগুলো খসে যাবে, একদিন
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।
একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে
ট্রেনের টিকিট কেটে
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না
একদিন পরাজিত হবো।
একদিন কোথাও যাবো না, শূণ্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাবো।
একদিন সারাদিন কোথাও যাবো না।
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।
এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা।
ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব,
শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে।
আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব,
তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়।
আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।
পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে,
চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে।
আমার কিসের ভয় ?
কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর,
শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ,
আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে
জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে।
আমার কিসের ভয় ?
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও
এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর,
ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে।
আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি;
আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখ আগ্নেয়াস্ত্র,
কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ,
উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা।
আমার কিসের ভয় ?
তোমার পায়ের নিচে আমিও কবর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।
টেলিফোনে প্রস্তাব
আমি জানি, আমাদের কথার ভিতরে এমন কিছুই নেই,অনর্থ করলেও যার সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আমাদের
দুর্বলতা প্রমাণ করা সম্ভব। আমিও তো তোমার মতোই
অসম্পর্কিত-জ্ঞানে এতদিন উপস্থাপন করেছি আমাকে।
তুমি যখন টেলিফোন হয়ে প্রবেশ করেছো আমার কর্ণে-
আমার অপেক্ষাকাতর হৃৎপিণ্ডের সামান্য কম্পনও আমি
তোমাকে বুঝতে দিই নি। দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় পাছে।
তুমিও নিষ্ঠুর কম নও, তুমি বুঝতে দাওনা কিছু। জানি,
আমার কাছেই তুমি শিখেছিলে এই লুকোচুরি করা খেলা।
কিন্তু এখন, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমাদের বেলা,
তখন ভেতরের চঞ্চলতাকে আমরা আর কতটা লুকাবো?
অস্ত যাবার আগে প্রবল সূর্যও চুম্বন করে পর্বত শিখর,
আর আমরা তো দুর্বল মানুষ, মিলনে বিশ্বাসী নর-নারী।
কার ভয়ে, কী প্রয়োজনে আমরা তাহলে শামুকের মতো
স্পর্শমাত্র ভিতরে লুকাই আমাদের পল্লবিত বাসনার শূঁড়।
তার চেয়ে চল এক কাজ করি, তুমি কান পেতে শোনো,
তুমি শুধু শোনো, আর আমি শুধু বলি, বলি, ভালবাসি।
আমি চলে যাচ্ছি
– নির্মলেন্দু গুণ
তখন আমার আর বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি যাই।
তোমরা পানপাত্র হাতে হোয়াং হো রেস্তোঁরার নির্জনতায়
মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি যাই।
মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন আমি যাই,
ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি।
সূর্য ওঠে রূপসী বাংলায়, আবার কখনো যদি ফিরে পাই
আমার যৌবন, যদি পাই অনন্ত স্বপ্নের মতো নারী, কবি
না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি।
সুচিত্রা সেনের মতো অপরূপা, বিদুষী-সুন্দরী ছিল তারা,
তাদের দেহে স্বর্গের লাবণ্য ছিল কিন্তু হৃদয় ছিল ঘাস।
আমার প্রেম নিয়ে তারা কত রকমের যে রহস্য করেছে-
গাধা ভেবে কেউবা নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দিয়েছে মুলো;
কেউবা উরাত দেখিয়ে-দেখিয়ে কাটিয়েছে কাল। তারপর
একদিন সর্পচর্মবৎ আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে
দূরে। আমি নিঃস্ব গৃহকোণে, তারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে।
অথচ তাদের কথা ভেবে আমি কেঁদেছি নিদ্রায়-জাগরণে।
এখন আমারও হৃদয়ে আর প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই,
বাসনার আলোড়ন নেই, আজ আমারও হৃদয়ে শুধু ঘাস,
শুধু স্মৃতি, শুধু স্মৃতি, শুধু স্মৃতি আর স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস।
তখন আর আমার বসে থেকে কী প্রয়োজন? আমি আর
কতো ভালোবাসবো? আর কার জন্যে অপেক্ষা আমার?
তার চেয়ে এই কি যথার্থ নয়? আমি খুব দূরে চলে যাই।
সূর্য ওঠে নিষ্ঠুর বাংলায়, আবার কখনও যদি ফিরে পাই
আমার যৌবন, যদি পাই আমার স্বপ্নের সেই নারী, কবি
না হয়ে, অন্য যা-কিছু হয়ে আমি ফিরে আসতেও পারি।
মৃদু আলোর নিচে বসে মৃদুলের গান শোনো, আমি চলি।
মহাদেব-নীলা-অসীম-অঞ্জনা-কবীর-বদরুন, আমি যাই,
ইয়াহিয়া, আমি চললাম। এই-যে নাসরিন, আমি আসি।
সেই রাত্রির কল্পকাহিনী
নির্মলেন্দু গুণ
তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রঙ,
তারপর তোমার জন্মসহোদর, ভাই শেখ নাসের,
তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী,
আমাদের নির্যাতিতা মা।
এরই ফাঁকে একসময় ঝরে গেছে তোমার বাড়ির
সেই গরবিনী কাজের মেয়েটি, বকুল।
এরই ফাঁকে একসময় প্রতিবাদে দেয়াল থেকে
খসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের দরবেশ মার্কা ছবি।
এরই ফাঁকে একসময় সংবিধানের পাতা থেকে
মুছে গেছে দু’টি স্তম্ভ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
এরই ফাঁকে একসময় তোমার গৃহের প্রহরীদের মধ্যে
মরেছে দু’জন প্রতিবাদী, কর্ণেল জামিল ও নাম না-জানা
এক তরুণ, যাঁর জীবনের বিনিময়ে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।
তুমি কামান আর মৃত্যুর গর্জনে উঠে বসেছো বিছানায়,
তোমার সেই কালো ফ্রেমের চশমা পরেছো চোখে,
লুঙ্গির উপর সাদা ফিনফিনে ৭ই মার্চের পাঞ্জাবী,
মুখে কালো পাইপ, তারপর হেঁটে গেছো বিভিন্ন কোঠায়।
সারি সারি মৃতদেহগুলি তোমার কি তখন খুব অচেনা ঠেকেছিলো?
তোমার রাসেল? তোমার প্রিয়তম পত্নীর সেই গুলিবিদ্ধ গ্রীবা?
তোমার মেহেদীমাখা পুত্রবধুদের মুজিবাশ্রিত করতল?
রবীন্দ্রনাথের ভূলুন্ঠিত ছবি?
তোমার সোনার বাংলা?
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার আগে তুমি শেষবারের মতো
পাপস্পর্শহীন সংবিধানের পাতা উল্টিয়েছো,
বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে এক মুঠো মাটি তুলে নিয়ে
মেখেছো কপালে, ঐ তো তোমার কপালে আমাদের হয়ে
পৃথিবীর দেয়া মাটির ফোঁটার শেষ-তিলক, হায়!
তোমার পা একবারও টেলে উঠলো না, চোখ কাঁপলো না।
তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।
কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।
তুমি হাত উঁচু করে দাঁড়ালে, বুক প্রসারিত করে কী আশ্চর্য
আহবান জানালে আমাদের। আর আমরা তখন?
আর আমরা তখন রুটিন মাফিক ট্রিগার টিপলাম।
তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করে হাজার হাজার পাখির ঝাঁক
পাখা মেলে উড়ে গেলো বেহেশতের দিকে…।
… তারপর ডেডস্টপ।
তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে, গড়াতে
আমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামলো।
– কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামলো না।
সিঁড়ি ডিঙিয়ে, বারান্দার মেঝে গড়িয়ে সেই রক্ত,
সেই লাল টকটকে রক্ত বাংলার দূর্বা ছোঁয়ার আগেই
আমাদের কর্ণেল সৈন্যদের ফিরে যাবার বাঁশি বাজালেন।
আফ্রিকার প্রেমের কবিতা
নির্মলেন্দু গুণ
সে বয়সে তুমি
ভালোবেসেছিলে তোমার মাতৃভূমি, দক্ষিন আফ্রিকাকে।
যে বয়সে পুরুষ প্রার্থনা করে প্রেয়সীর বরমাল্য,
সে বয়সে
তোমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়েছে ফাঁসির রজ্জুতে
যে বয়সে
পুরুষের গ্রীবা আকাঙ্খা করে
রমনীয় কোমাল বাহুর ব্যগ্র-মুগ্ধ আলিঙ্গন;
সে বয়সে
তোমাকে আলিঙ্গন করেছে
মৃত্যুর হিমশীতল বাহু।
তোমার কলম নিঃসৃত প্রতিটি পঙ্ক্তির জন্য
যখন তোমার প্রাপ্য ছিল প্রশংসার হীরকচুম্বন,
তখন তোমার প্রাপ্য হয়েছে মৃত্যুহীরক বিষ।
তোমার কবিতা আমরা একটিও পড়িনি আগে,
কিন্তু যেদিন
ওরা তোমাকে রাতের অন্ধকারে
ফাঁসিতে ঝোলালো-
তার পরদিন
সারা পৃথিবীর ভোরের কাগজে
ছাপা হলো তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
আমরা জানলাম,
কী গভীরভাবেই না তুমি
ভালোবেসেছিলে তোমার প্রিয়তম মাতৃভূমিকে।
আমরা জানলাম,কালো আফ্রিকার
শ্বেত-শত্রুদের বিরুদ্ধে কী ঘৃণাই না ছিল
তোমার বুক জুড়ে, শোণিতে, হৃদয়ে।
আমরা জানলাম
শুধু শব্দ দিয়ে নয় ,শুধু ছন্দ দিয়ে নয়
কখনো কখনো মৃত্যু দিয়েও লিখা হয় কবিতা ।
তুমি কবি, বেঞ্জামিন মোলয়েস,
তুমি মৃত্যু দিয়ে
কবিতাকে বাঁচিয়ে দিয়েছো তার মৃত্যুদশা থেকে।
বেঞ্জামিন মোলয়েস, তুমি এখন সারা-বিশ্বের কবি,
তোমার মা এখন পৃথিবীর তাবৎ কবিদের জননী।
তোমার জন্মভূমি,দক্ষিন আফ্রিকা এখন পৃথিবীর
তাবৎ কবিদের শৃংখলিত মাতৃভূমি।
কারাগারের ফটকে নেলসন ম্যান্ডেলার পত্নী
যখন তোমার শোকাতুরা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন,
তখন,মোলয়েস,তখন তোমার মায়ের পুত্রশোকদগ্ধ
বুকের উদ্দেশে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ট কবিতাগুলি ছুটে গিয়েছিল;
এবং মাথা নত করে ফিরে এসেছিল
লজ্জায়, তোমার সাহসের যোগ্য হয়ে উঠবে বলে।
তোমার ভালবাসার যোগ্য হয়ে উঠবে বলে ।
আমার সমস্ত কবিতাগুলি তোমার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতে
আজ সারাদিন মাথা নত করে নীরবতা পালন করেছে।
মধ্যরাতেও আমাকে কলম হাতে জাগিয়ে রেখেছো তুমি।
বেঞ্জামিন মোলয়েস,
তুমি একটুও ভেবো না,তোমার অপূর্ণ
স্বপ্নসমূহ বুকে নিয়ে আমরা জেগে আছি এশিয়ায়-;
তুমি আফ্রিকার মাটিতে ঘুমাও।
‘‘তুলনামূলক হাত’’
নির্মলেন্দু গুণ
তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই
আমার শরীর৷
তোমার চুলের ধোয়া জল
তুমি যেখানেই
খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;
আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ
আর
চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে,
অথবা ফিরি না ঘরে,
তোমার
চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷
তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই
কান থেকে
খুলে রাখো দুল, কন্ঠ
থেকে খুলে রাখো হার,
সেখানেই শরীর আমার
হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷
তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই
আমার চুম্বন
তোমার শরীর থেকে প্রবল
অযত্নে ঝরে যায়৷
আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো
তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন
খেলা করে যাই,
ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷
তুমি শাড়ির আঁচল
দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে
আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই
দ্বৈরথে বসে থাকি
তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত
রাখো
আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷
আমি যেখানেই
হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা,
তুমি নেই৷
দন্ডকারণ্য - নির্মলেন্দু গুণ
________________________
আজ প্রায় ত্রিশ বছর পর রেখার চিঠি পেয়ে আমি তো অবাক।
পাছে চিনতে ভুল করি, তাই নিজের পরিচয় দিয়েই রেখা
শুরু করেছে তার চিঠিঃ
‘আমি রেখা। জানি, আমাকে চিনতে তোমার কষ্ট হবারই কথা।
সে তো আজকের কথা নয়, সে যে হলো কতো কাল!
আমি ছিলাম তোমার ছোটবেলার খেলার সাথী,
এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে আজ পুনর্বার অনুভব করলুম,
লজ্জা নামক মেয়েলি বোধটা একেবারে উবে যায় নি তোমার এই
পোড়ামুখী বোনটার রক্ত থেকে। পাছে পোড়া-খাওয়া এই বুকে
প্রেম নিবেদনের তৃষ্ণা জেগে ওঠে, তাই শুরুতেই বলি, তুমি কবি
হয়েছো বলেই আমাদের রক্তের সম্পর্ক যায় নি ছোট হয়ে।
আমি বকুল মাসির মেয়ে যে, এবার মনে পড়লো?”
‘তুমি কবি হয়েছো, জানলাম এবং পড়লাম তোমার কবিতা কিছু।
পড়তে পড়তে বুকের ভিতর হা হা করে উঠলো হাজার তারের বীণা,
আহা, ভালোবাসা তো দূরের কথা; একটু ঘৃণাও বুঝি থাকতে নেই
আমাদের জন্য? না, আমার বিয়ে হয় নি।
দন্ডকারণ্য থেকে মানা, আর মানা থেকে দন্ডকারণ্য ছুটতে ছুটতে
ফুটতে পারে নি বিয়ের ফুল আমার, কিন্তু তার পাপড়ি গেছে ঝরে।
কংস পাড়ের এই বঙ্গ-দুহিতার বুকে বসেছে কালো মৌমাছিদের মেলা,
তাতে মিটেছে ভারতের লাম্পট্যের তৃষ্ণা-;
কিন্তু আমার ঘর জোটেনি ভাই।
এখন আর স্বপ্ন দেখি না।
কখনো কখনো দুঃস্বপ্নের ঘোরে যে ভাষায় কথা বলে উঠি,
তাতে বৃদ্ধ পিতার চোখ আর্দ্র হয় বটে, কিন্তু হিন্দিতে অনুবাদ
না করে দিলে শ্রীমোরারজী দেশাই তা বুঝতেও পারেন না।
কিন্তু তোমার তো বোঝার কথা, ভাষা কি বদলে গেছে খুব?
দুঃখ কি এতই দেশজ? এতই কি নিষ্ঠুর রাজনীতি?
এতই কি প্রবল জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধানও?
ফিরতে চেয়েছিলাম জ্যোতিবাবুর রাজত্বে, কোলকাতায়,
ছোটোমামা মৃত্যু-শয্যায়, তাঁকে দেখবো, কিন্তু ফেরা হয় নি আমার।
আরো কয়েক হাজার পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পাড়ের রেখার মতোই
আমাকে নামিয়ে দেয়া হলো খড়গপুর রেল স্টেশনের চির-অন্ধকারে।
জ্যোতিবাবু গেছেন শ্রীদেশাই-এর সঙ্গে আলাপ করতে;
আমি এক শিখের গাড়িতে চড়ে বসেছি। না, আমার বিয়ে হবে না।
ভারতবর্ষের দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেনগুলি আমাদের জন্য নয়।
তোমাকে এসব কথা লিখে লাভ নেই জানি, ভারতের মতো বিশাল
দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তুমি হস্তক্ষেপ করবে কোন্ সাহসে?
কিন্তু তুমি তো কবি, না-ই বা হলে আমার ভাই তুমি, তাই বলে
তোমার কবিতা থেকে আমরাই বা বঞ্চিত হবো কোন্ অপরাধে?
না হয় তোমার ছোটোবেলার রেখাকে নিয়ে লিখো একটা
যেমন তেমন কবিতা; আজকের হাজার রেখার অশ্রু
না হয় না-ই মোছালে তুমি!’
প্রথম অতিথি
নির্মলেন্দু গুণ
এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখনি তুমি।
মুহূর্তে সবুজ ঘাস পুড়ে যায়;
ত্রাসের আগুন লেগে লাল হয়ে জ্বলে ওঠে চাঁদ।
নরোম নদীর চর হা-করা কবর হয়ে
গ্রাস করে পরম শত্রুকে;
মিত্রকে জয়ের চিহ্ন, পদতলে প্রেম,
ললাটে ধূলোর টিপ এঁকে দেয় মায়ের মতন;
এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখনি তুমি।
নদীর জলের সঙ্গে মানুষের রক্ত মিশে আছে,
হিজল গাছের ছায়া বিপ্লবের সমান বয়সী।
রূপসী নারীর চুল ফুল নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ শোকের প্রতীক,
বাংরাদেশ আজ যেন বাংলাদেশ নয়;
এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখনি তুমি।
কখনো দেখেনি কেউ।
বাতাস বাতাস শুধু নয়,
ত্রিশ লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাসময়
আকাশ আকাশ শুধু নয়,
এরকম বাংলাদেশ বাংলাদেশ নয়।
এখানে প্রাণের মূল্যে
নদীর জলের মধ্যে আসে বান,
টর্পেডো-টাইফুন-ঝড়,
কাল-বৈশাখীর দুরন্ত তুফান।
কোকিল কোকিল শুধু নয়,
পাখি শুধু পাখি নয় গাছে,
বাউলের একতারা উরুর অস্থির মতো
যেন আগ্নেয়াস্ত্রে বারুদের মজ্জা মিশে আছে।
আজকাল গান শুধু গান নয়, সব গান অভিমান,
প্রাণের চিৎকার বলে ক্রুদ্ধ মনে হয়।
এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখেনি কেউ,
তুমি তার প্রথম অতিথি।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
– নির্মলেন্দু গুণ
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। সমবেত সকলের মতো
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
হুলিয়া
- নির্মলেন্দু গুণ
আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না৷
বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনলো না৷
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷
সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷
আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷
অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷
পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷
হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷
সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷
পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে – -৷
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম,— “মা’৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷
মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে
ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷
মা পুকুর থেকে ফিরছেন, সন্ধ্যায় মহকুমা শহর থেকে
ফিরবেন বাবা, তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি৷
সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,
পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে৷
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
– আমাদের ভবিষ্যত্ কী?
– আইয়ুব খান এখন কোথায়?
– শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?
– আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?
আমি কিছুই বলবো না৷
আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে
বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্য়্ত্কে চেয়ে চেয়ে দেখবো৷
উত্কন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিত্কার করে
কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:
‘আমি এসবের কিছুই জানি না,
আমি এসবের কিছুই বুঝি না৷’
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ
– নির্মলেন্দু গুণ
নেকাব্বর জানে তাঁর সম্পত্তির হিসাব চাইতে আসবে না
কেউ কোনোদিন।
এই জন্মে শুধু একবার চেয়েছিল একজন, ‘কী কইরা
পালবা আমারে,
তোমার কী আছে কিছু তেনা?’
সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে ফাতেমাকে জড়িয়ে দু’হাতে বুকে পিষে
বলেছিল নেকাব্বর;
‘আছে, আছে, লোহার চাককার মতো দুটা হাত,
গতরে আত্তীর বল – আর কীডা চাস্ মাগী।’
‘তুমি বুঝি খাবা কলাগাছ?’
আজ এই গোধুলিবেলায় প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালা চোখে নিয়ে
নেকাব্বর সহসা তাকালো ফিরে সেই কলাবাগানের গাঢ় অন্ধকারে।
তিরিশ বছর পরে আজ বুঝি সত্য হলো ফাতেমার মিষ্টি উপহাস।
পাকস্থলি জ্বলে ওঠে ক্ষুধার আগুনে, মনে হয় গিলে খায়
সাজানো কদলীবন,’
যদি ফের ফিরে পায় এতটুকু শক্তি দুটি হাতে, যদি পায়
দাঁড়াবার মতো এতটুকু শক্তি দুটি পায়ে।
কিন্তু সে কি ফিরে পাবে ফের?
ফাতেমার মতো ফাঁকি দিয়া সময় গিয়েছে ঢের চলে।
কারা যেন ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছে সব শক্তি তার।
বিনিময়ে দিয়ে দেছে ব্যাধি, জরা, দুর্বলতা, বক্ষে ক্ষয়কাশ-
অনাদরে, অনাহারে কবরে ডুবেছে সূর্য, ফাতেমার তিরিশ বছর।
এখন কোথায় যাবে নেকাব্বর?
হয়তো গিলেছে নদী তার শেষ ভিটেখানি, কবর ফাতেমা-
কিন্তু তার শ্রম. তার দেহবল, তার অকৃত্রিম নিষ্ঠা কারা নিলো?
আজ এই গোধুলিবেলায় এই যে আমার পৃথিবীকে মনে হলো পাপ,
মনে হলো হাবিয়া দোজখ – কেউ কি নেবে না তার এতটুকু দায়?
মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চায় না সুদুরে চলে যেতে, নেকাব্বর ভাবে,
অজানা অচেনা স্বর্গে বুঝি মেটে বাস্তবের তৃষ্ণা কোনোদিন?
তবু যারা চায়, তারা কেন চায়? তারা কেন চায়? কেন চায়?
নেকাব্বর শুয়ে আছে জীবনের শেষ ইস্টিশনে। তার পচা বাসী শব
ঘিরে আছে সাংবাদিক দল। কেউ বলে অনাহারে, কেউ বলে অপুষ্টিতে,
কেউ বলে বার্ধক্যজনিত ব্যাধি, – নেকাব্বর কিছুই বলে না।
অনন্ত বরফবীথি
– নির্মলেন্দু গুণ
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।যদি শিমুলের তুলা হতাম, বাতাসে উড়িয়ে দিতে বলতাম,
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাতাসের চেয়ে হালকা নই।
আমাকে তোমরা কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না,
কিংবা মাটি খুঁড়ে কবর দিও না আজিমপুর বা বনানীতে।
বর্জ্যপদার্থের মতো আমি চাই না মাটিতে মিশে যেতে।
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যাতে জলপথে ভাসতে-ভাসতে, ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছুতে পারি পৃথিবীর নব-নব দেশে।
জাপান-সাগরের মালবাহী জাহাজের সাথে পাল্লা দিয়ে
আমি ঢেউয়ের চূড়ায় ভেসে বেড়াবো, প্রাণহীন রাজর্হাস।
তার আগে ডান দিকে ঘুরে, আমি একটু বিশ্রাম নেবো
সিডনি বন্দরে, যদি সেখানে হঠাৎ মৈত্রেয়ীর দেখা পাই।
ভারত বনাম নিউজীল্যাণ্ডের একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ
দেখতে আমি দু’দিনের জন্য থামবো ডুনেডিনে।
একরাত্রির জন্য ইচ্ছে আছে সায়গন নদীতে যাবার।
রেড রিভারে রঙিন মাছের সঙ্গে খেলা করবো এক দিন।
একদিন লস এঞ্জেলেসে হঠাৎ চুম্বন হয়ে ভেসে উঠবো
এক প্রিয়দর্শিনী নাসিমার হাসিমাখা মুখের লজ্জায়।
তারপর কোনো এক গভীর নিশিথে আমি ধরা পড়বো
ক্যালিফোর্নিয়ায়, সান ডি আগোর বৃদ্ধ জেলের জালে।
বলিভিয়ার জঙ্গলে ক্ষিপ্র-চিতার হরিণ শিকার দেখবো
একদিন, একদিন পেরুর অরণ্যঘেরা নির্জন দ্বীপে যাবো,
একদিন অলিভিয়ার সোনালি দাঁতের হাসি দেখার জন্য
ভাসতে-ভাসতে চলে যাবো এন সালভাদর।
আমার আফ্রিকান বন্ধুদের দেখতে দক্ষিণ আটলান্টিকের
জলে ভেসে ভেসে আমি কেপটাউন আর এডেন বন্দর ছুঁয়ে
কয়েকদিনের জন্য যাবো ঘানা, জিম্বাবুই আর জাম্বিয়ায়।
তারপর নিউ ইয়র্ক বন্দরের পথে আমি একটু জিরিয়ে নেবো
নিউ ফাইণ্ডল্যাণ্ডের তুষার-শীতল সবুজ শ্যাওলার নিচে।
বাল্টিমোর, মেরীল্যাণ্ড হয়ে পূরবীর হারানো স্মৃতির টানে
শুধু একরাত্রির জন্য আমি যাবো ফিলাডেলফিয়ায়।
এন্টার্কটিকায় যখন পেঙ্গুইন পাখিদের সঙ্গে দেখা হবে,
আমি তাদের কাছে বলবো আমার যাত্রাপথের গল্প।
তাদের আমি আবৃত্তি করে শোনাবো আমার কবিতাগুলো
তাদের আতিথ্যে মহানন্দে কাটিয়ে দেবো কয়েক বছর।
হ্যাঁ, আমি ইউরোপেও যাবো, যাবো ভার্সেই, বুদাপেষ্ট।
রাইন-দানিয়ুব-ভলগা-লেনার জলে ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছাবো দূর-প্রাচ্যে, খাবারভক্সে, সাইবেরিয়ায়।
ভেঙে-যাওয়া সোভিয়েট ইউনিয়ন আর আমার দোভাষিকা
সুন্দরী লেনা দোব্রাভ্স্কায়ার কথা ভাবতে-ভাবতে,
মেঘের মশারি টানিয়ে বৈকাল হ্রদের জলে দেবো দীর্ঘ ঘুম।
জাগবো না, যতক্ষণ না ইস্রাফিলের শিঙার ধ্বনিতে
গলতে শুরু করে অনন্ত বরফবীথি; যতক্ষণ না
পদার্থের বিক্রিয়ায় স্থলভাগ স্থান বদল করে
জল-ভাগের সঙ্গে।
আমি বিষ খাচ্ছি, অনন্ত
- নির্মলেন্দু গুণ
আমি বিষ খাচ্ছি অনন্ত, আমি বিষ খাচ্ছি ।
তুই একটু অপেক্ষা কর ।
বাইরে এমন চাঁদ, এমন জ্যোৎস্না,
তোর বুঝি ভালো লাগছে না,
কী যে ভালো লাগছে আমার !
অনন্ত, তুই তার কিছুই জানলি নে,
কিচ্ছু জানলি নে । বড় সুখ, বড় ব্যথা ।
তুই যে ফিরতে বলিস,কোথা যাবি?
ঘর কোথা? কোথা পাবি এরকম
পল্লবিত বিষের ভান্ডার?
কোথাও পাবিনা ।
চলে যাসনে অনন্ত, শোণ, এই দ্যাখ
আর মাত্র একটি গেলাস...
আর মাত্র একটি চুমুক ।
এ-চুমুকে নেশা হবে, তারপর,তারপর,
আমরা দু'জনে মিলে ফিরে যাবো ।
সত্যি ফিরে যাবো ।
ঘরে বুঝি খুব শান্তি? খু-ব ভালোবাসা?
সেই ভালো, একটু তাড়াতাড়ি পা চালা,
অনন্ত, একটু তাড়াতাড়ি চল...।
একটি খোলা কবিতা
- নির্মলেন্দু গুণ
আসুন আমরা আগুন সম্পর্কে বৃথা বাক্য
ব্যয় না করে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি
জ্বালিয়ে দিয়ে বলিঃ 'এই হচ্ছে প্রকৃত আগুন ।
মীটসেফ খোলা রেখে, বিড়ালকে উপদেশ দিয়ে
অযথা সময় নষ্ট ক'রে লাভ নেই, আসুন
আমরা মীটসেফের দরোজাটা বন্ধ করে দেই ।'
পুঁজিবাদী শোষণের পথ খোলা রেখে
সম্ভব নয় প্রকৃত মুক্তির স্বপ্ন দেখানো ।
ফুঁটো চৌবাচ্চায় জল থাকবার কথা নয়,
সে বেরিয়ে যাবেই; ওটাই জলের ধর্ম ।
আমাদের ধর্ম ভিন্ন হলেও টাকার ধর্ম একই ।
বুদ্ধিমান কৃষক তাই আগাছা উপড়ে ফেলে সময়মত,
নইলে তার কষ্ট-কর্ষিত জমিতে কি ফলতো ফসল?
পরগাছার আক্রমণ থেকে ফলবান বৃক্ষকে
রক্ষা করতে হয় পরগাছার গোড়া কেটে দিয়ে ।
রক্তচোষা জোঁকের মুখে দিতে হয় থুথু, অথবা চুন,
প্রচন্ড আঘাত ছাড়া
পৃথিবীতে কবে কোন দেয়ার ভেঙেছে?
পরশ্রমভোগী ধনিক শ্রেণীর সর্বনাশ ছাড়া দরিদ্রের
পুষ্টিসাধনের সংকল্প হচ্ছে চমৎকার অলীক কল্পনা ।
সুফল লাভ কি সম্ভব সুকর্ম ব্যতিরেকে?
কিংবা শস্য ভূমিকর্ষণ ছাড়া?
হাতুড়ে বৈদ্য গাংরিন সারাতে চান
ক্ষতস্থানে পুরনো ঘি মালিশ করে,
শিক্ষিত ডাক্তার পরামর্শ দেন অপারেশনের ।
তাতে কিছু রক্তপাত হয় বটে,
হয়তো কেটে ফেলতে হয় কোন প্রিয় অঙ্গ--
কিন্তু ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য ওটা এমন কিছু নয় ।
এর কোনো সহজ বিকল্প নেই । এটাই নিয়ম ।
কথার ফুলঝুড়িতে চিড়ে ভিজানোর ব্যর্থ চেষ্টায়
সময় নষ্ট না করে আসুন আমরা জলের কথাই বলি ।
দাসবংশ
কোনো কাজকর্ম তো নাই, খাচ্ছেন দাচ্ছেন, আর
যখন যা চাচ্ছেন হাতের কাছে তাই পেয়ে যাচ্ছেন।
স্প্যানিশ অলিভ অয়েল মালিশ করে পালিশ করছেন
বেগম সাহেবার পাছা, আর নিজের বীচির চামড়া।
আর আমরা আমাগো হুগায় মাখছি ভেরেণ্ডার তেল।
আপনগো দিন যায় মহানন্দে, ভিসিআরে, টিভির পর্দায়।
আমরা মাঠের লোক, বস্তিবাসী, পথের মানুষ, মেধাহীন
কৃমিকীট আর পোকামাকড়ের মতো আপনাগো নেতৃত্বের
আকাশছোঁয়া দালানের আন্ডারগ্রাউন্ড ফাউন্ডেশনটাকে
পাকাপোক্ত করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে, জননীর চর্বিহীন
অপুষ্ট জরায়ু ছিঁড়ে এই সুমহান বঙ্গদেশে জন্ম নিয়েছি।
আপনাগো ব্যাংক ব্যালেন্স আর চর্বির চিকনাই যত বাড়ে,
আনুপাতিক হারে ততই আমগো গায়ের চর্ম ঠেকে হাড়ে।
আপনারা আছেন, থাকবেন, এ-কথা জানলি পরে
এই বঙ্গদেশের পবিত্র ভূমিতে জন্ম নিতো কোন্ হালায়?
আমাগো বাবারা হুগলার চাটাই বিছাই আমাগো মায়েরার
কানে কানে কুমন্ত্রণা দেয়, বঙ্গ-সংস্কৃতির চর্চা করে, বলে :
‘হায়াৎ-মউত, রিজিক-দৌলত- সবই তো আল্লাহর হাতে,
বুজলা জমিলা বিবি, আহ, কাছে আহ, ভয় পাও কেরে?’
পরের বছরে আমাগো জন্ম হয়, আদর কইরা আমাগো
বাপে আমগো নাম রাহে আবদুল, রামচন্দ্র, বাদশা মিঞা,
মাইকেল, মামা চিং– আরও কত্তো রঙবাহারি নাম!
একটু বড় অওনের পরে বুঝি, বাদশা মিঞা অওনের চাইতে
আপনাগো বাড়ির পালা কুত্তা অওনও অনেক ভালা আছিল।
এই বঙ্গদেশে আপনেরা ঠিকই দাসবংশ জিইয়ে রেখেছেন,
বুঝি আপনাগো সমাজ ব্যবস্থার নিশ্চিদ্র ব্যাংক-লকারে
আমাগো মায়েরার জরায়ু গচ্ছিত। কী চমেৎকার ব্যবস্থা।
খালি চোখে দেখাই যায় না, চোখে পড়ে ২৫তলা শিল্পব্যাংক,
২০তলা সেকেটারিয়েট, শেরেবাংলা নগরের সঙসদ ভবন,
ও নগরে-নগরে তীর-চিহ্ন পোতা সদা-সতর্ক কেণ্টনমেন্ট।
কৃষকের হাড্ডি জল-করা পিঠের চামড়া-পোড়ানো পাট,
আর ম্যান পাওয়ারের ছদ্মবেশে অগণিত সহজলভ্য দাস
বিদেশে পাচার করে, তেল চকচক গাড়ি, ফ্রীজ, রঙিন-টিভি
ও অলিভ অয়েল এনে মালিশ করেন যখন যেখানে খুশি
মন চায়; ভয় নাই, আমরা আছি, দাস বংশ, নফর গোলাম,
মেধাহীন কৃমিকীট আপনাগো দ্বীনের সেবায়।
পৃথিবী - নির্মলেন্দু গুণ
তুমি ডেকেছিলে, আমি চলে এসেছিলাম একা ।
কোনো কিছু সঙ্গে নিইনি, সঙ্গে করে নিইনি পানীয়,
তিল-তিসি-তামা বা বিছানা বালিশ, তুমি বলেছিলে
সব পাওয়া যাবে, --এ শহর নেশার ও নারীর ।
তুমি ডেকেছিলে, জননীর কোমল বিছানা ছেড়ে
চলে এসেছিলাম, শুধু তোমার ডাকে ।
পেছন থেকে অদৃশ্য নিয়তি এসে পাপের পিচ্ছিল লেজ
টেনে ধরেছিল । সর্বশেষ স্পর্শের আনন্দে উন্মাতাল
মায়ের বিছানা জড়িয়ে ধরেছিল তার শিশুকে ।
দীর্ঘশ্বাসের শব্দে এলোমেলো হয়েছিল জন্মের প্রথম চুল,
সাজানো ভুবন ফেলে চলে এসেছিলাম একা;
শুধু তোমার ডাকে । -শুদু তোমার ডাকে ।
তুমি ডেকেছিলে, পরীর বাগান ছেড়ে চলে এসেছিলাম ।
তুমি ডেকেছিলে, কোমল কিচেন ছেড়ে চলে এসেছিলাম ।
তুমি ডেকেছিলে, শুঁড়িখানার মাতাল আনন্দ ছেড়ে
চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে ।
তুমি মাটির ফোঁটার একটি তিলক দিয়ে
আমাকে ভোলাতে চাও?
আমি খাদ্য চাই ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মতো, দ্রৌপদীর মতো
বস্ত্র চাই, চাই সর্বগ্রাসী প্রেম, চাই শূর্পণখার মতো নারী,
চাই আকন্ঠ নিমগ্ন নেশা, চাই দেশী মদ ।
আমার সমস্ত ক্ষুধা তোমাকে মিটাতে হবে, হে পৃথিবী,
তুমি বলেছিলে অভাব হবে না, এ-পৃথিবী নেশা ও নারীর,
আমি চলে এসেছিলাম একা, শুধু তোমার জন্যে ।
১৬-৬-৮৪ - নির্মলেন্দু গুণ
হয় নিদ্রা আসুক, না হয় এক্ষুনি অবসান হোক
এই অসহ রাত্রির । আমি আর সইতে পারছি না ।
আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে নির্ঘুমতা ।
এই রাত্রি এখন আমার সহ্যসীমার বাইরে ।
দুঃখে-ক্ষোভে, অভিমানে আমার বুকের ভিতর থেকে
বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস, যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে
শূন্য হাতে উঠে আসা কোনো ব্যর্থ ডুবুরী ।
চোখের ভিতরে হুল ফুটিয়ে বলি, একটু ঘুমাও,
আর কতক্ষণ, আর কতদিন এভাবে চলবে?
লক্ষীসোনা, মণি আমার, একটু ঘুমাও ।
মনকে বলি, এখন তো ছোট্ট ছেলেটি তুমি নও,
যে তোমাকে শোনাবে কেউ ঘুমপাড়ানিয়া গান ।
এখন তোমার ঘুমের জন্য কোন গান নেই ।
ভালোবাসার সাঁকো বেয়ে তুমি পৌছে গেছো এক
চির-নির্ঘুম দেশে, যেখানে দাউদাউ অগ্নিকুণ্ডে
জ্বলন্ত পৃথিবী; যেখানে নিদ্রা এক অচেনা প্রসঙ্গ ।
একশ' থেকে উল্টোদিকে শূণ্য পর্যন্ত গুনে
সেই কখন শেষ করেছি, তবু ঘুম আসে না ।
চিৎকার করে বলি, একশ এতো কম কেন?
২
দুঃখ আমাকে জাগিয়ে রাখে ।
আনন্দের সাধ্য কী সে পাল্লা দেবে
দুঃখের সঙ্গে, দুঃখ খুব জাগরণ ভালোবাসে ।
হায় আমার দিনগুলি রাতের সঙ্গে, আর
রাতগুলি দিনের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ।
একটি দিনকে অন্যদিন থেকে পৃথক করে যে-নিদ্রা,
সে-ই যদি অন্তর্হিত হয়, তবে কীভাবে আমি
অনুভব করি আমার সপ্রাণতা?
আমার কাঁধে চেপে বসেছে অখণ্ড সময়ের বোঝা ।
চিৎকার করে বলি, 'এ বোঝা আমার নামাও ।'
তুমি কি কিছু শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছো?
প্রত্যাশা করছো কেউ তোমাকে কিছু বলবে?
কেউ তোমাকে কিচ্ছু বলবেনা, লক্ষীসোনা ভাই,
আমি বলছি, তুমি ঘুমাও । আরও একটু ভাবো,
বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করো তোমার অস্তিত্ব;
'ভালোবাসা' শব্দিটিকে নাড়াচাড়া করে দেখো ।
হয়তো একটু হলেই রহস্যের সূত্র পেয়ে যাবে,
চোখের সামনেই খুলে যাবে অন্ধকারের তালা,
আর তুমি পেয়ে যাবে তোমার ঘুম-নগরীর চাবি ।
বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নকল নিদ্রা নয়,
তাকে তুমি ভিতর থেকে জাগাও ।
৩
আমার খোলা আকাশের মতো চোখে
উড়ে বেড়ায় হরেক রঙের পাখি ।
আমার মস্তিষ্কের গভীর গোপন কুঠুরিতে
আজস্র পরীর দল প্রলয় নৃত্যে মাতে ।
স্বপ্ন-প্রেম, কামনা-বাসনা, স্মৃতি-বিস্মৃতির
জটাজলে বন্দী আমার রাত্রির পৃথিবী ।
আমি সেই জট খুলতে খুলতে ক্লান্ত হই,
ক্লান্ত হই; কিন্তু আমার ঘুম আসে না ।
আমার আত্মার অন্তর্ভেদী আর্তনাদে
ঘরের দেয়ালগুলি কাঁপে ।
রাতজাগা টিকটিকি ও আরশোলার মতো
আমি দেয়ালে-দেয়ালে অস্থির ছুটে যাই ।
শেষবারের মতো রাতের উদ্দেশে
আমার শেষ-তর্জনী তুলে বলি;
'হয় অবসান হোক এই দুঃসহ রাত্রির,
না হয় নিদ্রা আসুক ।'
আমেরিকা: আপডেটেড – নির্মলেন্দু গুণ
আমেরিকা, কলম্বাস কর্তৃক আবিস্কৃত
হে মহান গণতন্ত্রের দেশ -,
মানবাধিকারের হে অতন্দ্র প্রহরী!
তোমাকে সালাম, তোমাকে নমস্কার।
আমি ভেবেছিলাম ,
সোভিয়েত ইউনিয়নহীন এ-পৃথিবীতে
ক্রমশ দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে তুমি ।
তোমার দৈত্যদন্তগুলো ফেলে দিয়ে,
ক্রমশ ভালো মানুষ হয়ে উঠবে তুমি।
মানুষ কেন তার নিজ-জীবনের চেয়ে
ভালোবাসবে তোমার ক্ষতিকে?
ভেবেছিলাম, নাইন ইলিভেনের পর,
ঘৃণার উৎস সন্ধানে ব্রতী হবে তুমি।
ভেবেছিলাম, অতঃপর আত্মঘাতী
প্রাণের গভীরে প্রবেশ করে তুমি
বুঝতে চেষ্টা করবে তার ব্যথা।
কিন্তু আমেরিকা, শক্তিমদমত্ত বিশ্বপ্রভু,
ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহন না করে,
ইতিহাসকেই শিক্ষা দিতে চাইছ তুমি।
তাই, তোমার সন্দেহতাড়িত শক্তি,
অঢেল সম্পদের দম্ভ তোমার দৃষ্টিকে
আচ্ছন্ন করেছে, মদ যে রকম মাতালকে।
আমেরিকা, তুমি বুঝতে পারছো না-,
নির্বান্ধবতার অন্ধ আবর্তের দিকে
কীভাবে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছো তুমি।
আমেরিকা, তুমি বুঝতে পারছো না –,
কীভাবে ক্রমশ তুমি পরিণত হচ্ছো
পাপ আর অন্যায়ের উৎসভূমিতে ।
প্রপিতামহের সঙ্গে জোট বেঁধে –
জাতিসংঘকে বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে,
ধর্মনিরপেক্ষ ইরাককে ধ্বংস করে
তুমি তোমার নিজের গণ বিধ্বংসী
দৈত্যমূর্তিকেই উলঙ্গ করেছো।
সাদ্দাম হোসেনের পুত্ররা
কী ক্ষতি করেছিল বুশ-কন্যাদের?
তুমি তাদের হত্যা করেছো কেন?
আফগানিস্তান ও ইরাকের অগণিত
শিশু-নারী আর নিরীহ মানুষকে
তুমি হত্যা করেছো -, তুমি খুনি।
তুমি বিন-লাদেনকে শিখন্ডি বানিয়ে
বিশ্বগ্রাসের যে নাটক সাজিয়েছো,
নিপাতনে সিদ্ধ হবে তার যবনিকা।
মানুষকে সহজেই বধ করা সম্ভব,
কিন্তু ভয় দেখিয়ে – মানুষ কেন?
কুকুরকেও বশ করা যায় না।
ভয় হচেছ ভূতের এজেন্ডা,
ইমপিরিলিজমের লিগেসি।
আমেরিকা, তুমি শোনো, আমি চাই -
তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ো,
আর সদাপ্রভু দয়াল যিশুর নামে
শুদ্ধচিত্তে তুমি পাঠ করো বাইবেল।
ট্রিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার খরচ করে
যে লৌহবাসর তৈরি করছো তুমি-
তাতে,- তাতে আর যাই থাক,
মিলনের আনন্দ থাকবে না।
আমেরিকা, তুমি একা হয়ে যাবে,
একা হয়ে যাবে,-বড় বেশি একা।
অ্যালেন গিন্সবার্গ বেঁচে থাকলে
এ কথাই তোমাকে বলতেন;
আর দুঃখ পেতেন বুশের বিজয়ে।
কাল সে আসিবে - নির্মলেন্দু গুণ
আর কিছু নয়, রাজ্য চাই না,
চাই না তিলক, চাই না তালুক;
চাই শুধু মন-মানুষে মিলুক
কবিতা আমার। সেই বিশ্বাসে
যারা কাছে আসে, আর মাঝে মাঝে
অপমানিতের হয়ে কথা বলি ।
বাঁশি যে বাজায় সে তো কংকাল,
প্রাণের ভিতরে আপনি সে গায়;
আপনার মাঝে নিজেকে সাজায় ।
শোনাতে চায় না, তবু যারা শোনে,
চারপাশে যারা শ্রম ঘামে বুনে
পৃথিবী সাজায়, তাদের পারি না
উপেক্ষা করে পায়ের দলে পিষে
নির্মল বিষে নিমগ্ন হতে ।
এই গ্রন্থটি লেখা হয়ে যাক,
গান শোনে যারা তারা কিছু পা'ক
আমার জন্য অশেষ না থাক
রেশটা তো রবে, তাই দিয়ে হবে
তোমার অর্ঘ্য তোমার উত্তরীয় ।
ঘৃণা করে যারা তারা পিছু যায়,
ভালোবেসে যারা তারা কিছু পায় ।
এই স্বাভাবিক, আমি তবু ঠিক
কুলকলরব যে নদী হারায়;
তার স্তবগানে হই না মুখর ।
খর-বৈশাকে আমি আনি ঝড়,
আমি ভালোবাসি সাহসের স্বর ।
প্রতিঘাতময় মুখর জীবন
সোনামুখী সূচে শিল্প সীবন ।
আর কিছু নয়, আমার গগন-
চুম্বী বাসনা মেলিয়াছে ডানা
গানের ভিতরে, তার ভাষা চাই ।
আশা দিয়ে রোজ যে-মুখ সাজাই
তার কাছে পাই যেটুকু শ্রান্তি
ত্রুর কাল এসে তার সে ভ্রান্তি
ধুয়ে মুছে দেয়, চিহ্ন রাখে না ।
এই ভেবে কত প্রেম ফেলে দেই
আপন ভাবিয়া বুকে তুলে নেই
অপরের ব্যথা, কতো ব্যর্থতা
পায়ে দলে চলি সমুখের ডাকে;
গতিচঞ্চল জীবনের বাঁকে
তবু বহু ভুল থেকে যায় জানি ।
সতর্ক চিতে যতো যতি টানি,
মানুষের লাগি যতো গীত ভানি
কাল সে আসিবে, মুখখানি তার
যতই দেখিব ভালোবাসিবার
বাসনা জাগিবে চিতে, আসিবে না
জানি, কাল চিরকালে ধরা দিতে ।
আগামী কালের সতনু শিখাটি
পোড়াবে আমার শ্রেষ্ঠ লিখাটি ।
তবু কথা লিখি, তবু গান গাই,
মনের ভিতরে যে মানুষ চাই
তার কিছু পাই গূঢ়-চেতনায়
অন্ধ প্রাণের বন্ধ বন্দী কূপে-;
কিছু রেখে যাই ব্যর্থ-শিল্পরূপে ।
নিরঞ্জনের পৃথিবী-( নির্মলেন্দু গুণ )
ছিন্নপত্র
নির্মলেন্দু গুণ
মৃত্যুর বোধই যে বোধ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে পবিত্রতম
আমার মতো একজন জীবন বাদী প্রেমিক কবিকে
সেই বোধের উপযুক্ত বাহক মনে করিয়া,
তুমি কেনো যে আমাকে বার বার ভ্রূপল্লবের চটুর ইঙ্গিতে
অনন্তের অরণ্যে ডাকিয়া ফিরিতেছো?
তাহা ভাবিয়া আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত না হইয়া পারিনা।
মৃত্যু কখনো কখনো জীবনকে গৌরবান্বিত করে বটে,
তাই বলিয়া সেতো জীবনের চাইতে বড় নহে,
সেতো জীবনেরই জাতক,আমার ভালোবাসার মধ্যে
যখন তুমি মরিতে চাহ,তখন বুঝিতে পারি,
তোমার জন্য আমার ভালোবাসা কতযে অপরিহার্য্য।
তুমি তাহা এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছো।
সুতরাং আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করা কিংবা
অনুভব না করা কিংবা অতিক্রম করা কিংবা অবজ্ঞা করা
কিংবা স্বীকার না করা যে,প্রকারন্তরে নিজেরই জীবনের
সত্য ও সুন্দরের উপলব্ধির বিরোধিতা করা, তাহা বলাই বাহুল্য।
তোমার অন্তরের কথাই যেহেতু আপন অন্তরে জানিতে পাই।
তোমার মুখের বাক্যে অতঃপর তাই আর ভুল করিতে রাজি নই।
তুমি মুখে যাহাই বলোনা কেন,তোমার বুকের ভিতরে আমার নাম,
অনন্তের শ্বেত পাথরে লেখা হইয়াছে।
আগামীর অজস্র প্লাবনেও তাহা মুছিবার নহে।
তোমার আপাতঃ কঠোর হৃদয় যে কি গভীর ভাবে আমার
ভালোবাসার স্পর্শে প্রতিদিন দ্রবীভূত হইতেছে।
আমার ভালোবাসার অমৃত ধারায় স্নাত হইয়া তুমি যে
অভ্যন্তরে তৃপ্ত হইতেছ তাহার বহিঃপ্রকাশ কে সর্বদা
লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা যে তোমার পক্ষে আজকাল
কত দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে, তোমার গৌড়চিক্কন পবিত্র
মুখশ্রীর প্রতি দৃষ্টি মেলিয়া আমি অতি সহজেই তাহা অনুভব
করিতে পারি। আর সে আহরিত প্রেমের অনুভবকে
আমি যখন তোমার ভিতরে প্রত্যর্পন করি তুমি তখন নব নব
ছলনার আড়ালে তাহার আনন্দকে পুরোপুরি গ্রহণ করিয়া ও
বাঙ্গচ্ছলে খিল খিল করিয়া হাসিয়া ওঠো বটে।
কিন্তু আমি বেশ বুঝিতে পারি আমার প্রেমের মধ্যে
তোমার প্রেম কি গভীরভাবেই না মিলিয়া একাকার হইলো।
আর সেই মুহূর্তেই তুমি তোমার হৃদয়ের দুর্বলতাকে অতিক্রম
করিবার জন্য আমার প্রতি আপাতঃ হিংস্র ব্যাবহারে প্রবৃত্ত হও।
এই অধম মূর্খ গর্ধব কবিটি তাহা সবসময় সঠিক বুঝিতে না পারিয়া
মাঝে মাঝে কত যে অন্যায় আচরণ করিয়া বসে।
সেজন্য রাত্রির নিদ্রা রোধ করিয়া,তুমি তাহাকে এই যে শাস্তি দিতেছ ,
তবুওকি তাহার এতটুকু শিক্ষা হইলো?
করজোড়ে নিবেদন এইযে,অদ্য হইতে এই অমার্জিত মূর্খ প্রেমিকটিকে
যেন ভালোবাসার কিছু সহজ পাঠ শেখানো হয়।
সকল মানুষের চাইতে যদি আলাদা ভাবতে পারতাম নিজেকে,
আতাহলে সম্ভবত জন্ম-মৃত্যুর উর্দ্ধে নিজেকে এক সুরম্য স্বপ্নের
কাঁচ কেটে বসিয়ে রেখে তার খোলসটুকু নিয়ে অপরের সঙ্গে
জীবন-মৃত্যুর অভিনয় করিতে পারতাম।
আমার মধ্যে যদি অস্তিত্বহীনতার অভয় মন্ত্র ধ্বনিত হতো,
তোমার মতো,আমি আমার জীবন কে কতো সহজেইনা
তুলে দিতে পারতাম,মৃত্যুর সাজানো খেলায়।
তুমি যখন আমাকে মৃত্যুর কাছে ডাকো,
আমি তখন সায় দিতে পারিনে,এবং এই সায় দিতে না পারার কষ্ট
আমাকে সারাক্ষন কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
ভেতর থেকে আমার জীবনকে নিঃশেষ করে।
তুমি হয়তো নিজের মধ্যে অস্তিত্বহীন হয়ে ওঠার কৌশল টুকু জানো,
সম্ভবত তুমি সাধারণের চাইতে পৃথক। আমার কল্পনাই যে অশরীরি
আত্মার ধারণা আছে তুমি হয়তো তাই।
তোমার প্রাণ হয়তো অন্য কোথাও বাঁধা,হয়তো মৃত্যু তোমার
প্রাণের ছদ্দবেশ।ফলে, মৃত্যুর খোলসটুকু ভেঙে ফেলে অফুরন্ত প্রেমের প্রভায়
মিশে যাওয়ার উন্মাদনা,তোমার রক্তকে সারাক্ষন মাতাল করে রাখে।
সেই খোলস ভাঙার খেলায় তুমি চাও আমাকে ক্ষণকালের
সঙ্গী হিসেবে পেতে।তোমার কর্ণকুহরে প্রকৃত প্রেমের ডাক আসে
নদীর ওপর থেকে,অর্থাৎ জীবনের কাছ থেকে।
মৃত্যু তোমার কাছে তাই প্রকৃত জীবনে প্রবেশ করার পূর্ব শর্ত,
মৃত্যু তোমার জন্মের মাধ্যম। ফলে, আমার কাছে তোমার পরিচয়
অসহ্য হয়েও অনতিক্রম্য,স্বল্পকালের হয়ে ও চিরকালের।
আমার অস্তিত্বহীন কোনো অস্তিত্ব নেই।আমার প্রাণ আমার সঙ্গেই।
নদীর ওপারের যে হাত ছানি আমি দেখি আমার কাছে তা আজও
ভয়ঙ্কর ও অসহ্য মনে হয়। তোমার কাছে মৃত্যু মানে মৃত্যুর মৃত্যু,
আমার কাছে মৃত্যু মানে জীবনের মৃত্যু। আমি বুঝতে পারিনা
আমাকে তুমি এত ছলনার মধ্যে জড়ালে কেন ?
কোন বর্তমানের ইঙ্গিতে অবর্তমানের বোধ আজ আমাকে তাড়া
করে ফিরছে, বলতে পারো। তোমাকে ভালোবাসা নাবাসা
আজ তাই আর আমার একার বিষয় নয়।
তুমি যখন আমার প্রেমে সস্নিগ্ধ হয়ে উঠো, আমিও সস্নিগ্ধ না হয়ে পারিনা
যখন তুমি স্বীকার করো আমার প্রেম আমি এত সুখ পাই কেন?
তোমার মধ্যে আমার এই বাঁধা পড়াকে আমি আমার পরম ভাগ্য
বলে মেনেছি। তাই আমার সলক স্পৃহাকে আমি তুলে দিয়েছি তোমার
হাতে। তোমার পায়ের তলায়। তুমি যেভাবে তাকে মাড়াতে চাও
সেভাবেই সে নিষ্পেষিত হবে। তোমার কাছে এইটুকু প্রার্থনা আমার।
তুমি বেঁচে থাকবে অন্তত যতদিন আমি বাঁচি। লক্ষী আমার তোমাকে
আমার বড় ভয়। কথা দাও তুমি অপেক্ষা করবে আমার জন্য।
ব্যার্থতার ভাগগুলোকে নিয়ে যে মানবকুলের জন্ম,
ব্যার্থতা তার জীবনের এক মৌলিক সত্য। তবু একটি ক্ষেত্র রয়েছে
যেখানে সে তার ভাগ্যের এই দুর্নিবার ক্ষতকে অতিক্রম করে দাঁড়াইয়।
সে অন্ধকারে আলোর মুখোমুখি হয়। অপার বেদনার বিষে জর্জরিত
চিত্তে ও সে তখন তার দলিত আত্মার মধ্যে আনন্দের সমুদ্রে অবগাহনের
তৃপ্তিকে অনুভব করে। যে বোধ সেই অনিন্দ আনন্দের সন্ধান দেয়,
যুগে যুগে মানুষ তাকেই ভালোবাসা বলে স্বীকার করেছে।
এই একটি মাত্র শব্দই মানুষকে চিরকালের সুতোয় ফুলের মালার মতো
গেঁথে রেখেছে। সেই ভালোবাসার বরমাল্য গলায় পরেই আমি মানুষকে
বার বার প্রিয়তার মধ্যে আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়েছি।
No comments:
Post a Comment