পুর্ণেন্দু পত্রী'র কথোপকথন সমগ্র
কথোপকথন – ১ -পূর্ণেন্দু পত্রী
-তোমার পৌঁছুতে এত দেরী হলো ?
-পথে ভিড় ছিল ?
-আমারও পৌঁছুতে একটু দেরী হলো
সব পথই ফাটা ।
-পথে এত ভিড় ছিল কেন ?
-শবযাত্রা ? কার মৃত্যু হল ?
কথোপকথন – ২-পূর্ণেন্দু পত্রী
এতো দেরী করলে কেন? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।
– কি করবো বলুন ম্যাডাম? টিউশনি শেষ করে
বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। আমার জন্যে তো আর গেইটের বাইরে মার্সিডিজ দাঁড়িয়ে
থাকে না যে ড্রাইভারের কুর্নিশ নিতে নিতে হুট করে ঢুকে পড়বো। তাই ঝুম
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, কাদা-জল ভেঙ্গে, গরীবের গাড়ি মানে দু’পায়ের উপর
ভরসা করেই আসতে হয় আপনার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। তবে আজ রিক্সায় করে এসেছি
নইলে একেবারে কাকভেজা হয়ে যেতাম। রিক্সা খুঁজে পেতেই যা দেরী হলো।
: ইস্ বেশ ভিজে গেছো দেখছি। কাছে এসো তো, রুমাল দিয়ে মুছে দিই।
– ওহো, আমি তো ভেবেছিলাম তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেবে। ঠিক আছে, রুমালই সই।
: না মিস্টার, ওটা ভবিষ্যতের জন্য জমা থাকুক। যখন তোমার বউ হবো তখন ইচ্ছেটা পূরণ হবে।
– আচ্ছা। আর যদি তা না হও, তবে আমি বুড়ো
বয়েসে পান চিবোতে চিবোতে কোন এক বাদলঘন দিনে বসে বসে রোমন্থন করবো আজকের
এই রুমালি ভালোবাসাময় সময়টাকে। নাতিপুতিকে তখন প্রথম প্রেমিকা আর এই
রুমালটার গল্প শোনাবো।
: প্লিজ, এভাবে বলো না। কেন আমি তোমাকে পাবো না? তুমি কি আমাকে চাও না? আমাকে ভালোবাসো না?
– উত্তরটা আসলে একটু কঠিন। তোমাকে চাই আবার চাই না। ভালোবাসি আবার বাসি না।
: হেয়াঁলি রাখো। আমি স্পষ্ট জানতে চাই।
– তবে শোন। আমার প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের
নির্মম বাস্তবতা তোমার জানা নেই। সেই জীবনে তুমি কখনো অভ্যস্ত হতে পারবেও
না। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
: হ্যাঁ, করো।
– একটু আগে একটা টং-এর দোকানের ছাউনিতে গা
বাচিয়ে রিক্সা খুঁজছিলাম। খুব শীত শীত লাগছিলো, তখন চা খেয়েছিলাম ভাঙ্গা
কাপে। আধধোয়া সে কাপে লেগেছিলো অনেক মেহনতি মানুষের ঠোঁটের ছোঁয়া,
লেগেছিলো থুতুও যা এখনো আমার ঠোঁটে লেগে আছে। তুমি কি পারবে সেই ঠোঁটে চুমু
খেতে?
কথোপকথন –৩ – পূর্ণেন্দু পত্রী
তোমার বন্ধু কে ? দীর্ঘশ্বাস ?
আমার ও তাই ।
আমার শূন্যতা গননাহীন ।
তোমার ও তাই ?
দুরের পথ দিয়ে ঋতুরা যায়
ডাকলে দরোজায় আসে না কেউ ।
অযথা বাশি শুনে বাইরে যাই
বাতাসে হাসাহাসি বিদ্রুপের ।
তোমার সাজি ছিল, বাগান নেই
আমার ও তাই ।
আমার নদী ছিল, নৌকা নেই
তোমার ও তাই ?
তোমার বিছানায় বৃষ্টিপাত
আমার ঘরদোরে ধুলার ঝড় ।
তোমার ঘরদোরে আমার মেঘ
আমার বিছানায় তোমার হিম ।
কথোপকথন -৪ -পুর্ণেন্দু পত্রী
– যে কোন একটা ফুলের নাম বল
– দুঃখ ।
– যে কোন একটা নদীর নাম বল
– বেদনা ।
– যে কোন একটা গাছের নাম বল
– দীর্ঘশ্বাস ।
– যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
– অশ্রু ।
– এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
– বলো ।
– খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
– সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
– না ।
– তবে ?
– স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।
কথোপকথন ৫ – পূর্ণেন্দু পত্রী
আমি তোমার পান্থপাদপ
তুমি আমার অতিথশালা ।
হঠাৎ কেন মেঘ চেঁচালো
– দরজাটা কই, মস্ত তালা ?
তুমি আমার সমুদ্রতীর
আমি তোমার উড়ন্ত চুল ।
হঠাৎ কেন মেঘ চেঁচালো
– সমস্ত ভুল , সমস্ত ভুল ?
আমি তোমার হস্তরেখা
তুমি আমার ভর্তি মুঠো ।
হঠাৎ কেন মেঘ চেঁচালো
– কোথায় যাবি, নৌকো ফুটো ?
কথোপকথন ৬ – পূর্ণেন্দু পত্রী
কালকে এলে না, আজ চলে গেল দিন
এখন মেঘলা, বৃষ্টি অনতি দূরে !
ভয়াল বৃষ্টি, কলকাতা ডুবে যাবে ।
এখনো কি তুমি খুঁজছো নেলপলিশ ?
শাড়ি পরা ছিল ? তাহলে এলে না কেন ?
জুতো ছেঁড়া ছিল ? জুতো ছেঁড়া ছিল নাকো ?
কাজল ছিল না ? কি হবে কাজল পরে
তোমার চোখের হরিণকে আমি চিনি ।
কালকে এলে না, আজ চলে গেল দিন
এখন গোধূলি, এখুনি বোরখা পরে
কলকাতা ডুবে যাবে গাঢ়তর হিমে ।
এখনো কি তুমি খুঁজছো সেফটিপিন ?
কালকে এলে না, আজ চলে গেল দিন
এখন মেঘলা, বৃষ্টি অনতি দূরে !
ভয়াল বৃষ্টি, কলকাতা ডুবে যাবে ।
এখনো কি তুমি খুঁজছো নেলপলিশ ?
শাড়ি পরা ছিল ? তাহলে এলে না কেন ?
জুতো ছেঁড়া ছিল ? জুতো ছেঁড়া ছিল নাকো ?
কাজল ছিল না ? কি হবে কাজল পরে
তোমার চোখের হরিণকে আমি চিনি ।
কালকে এলে না, আজ চলে গেল দিন
এখন গোধূলি, এখুনি বোরখা পরে
কলকাতা ডুবে যাবে গাঢ়তর হিমে ।
এখনো কি তুমি খুঁজছো সেফটিপিন ?
কথোপকথন – ৭ – পুর্ণেন্দু পত্রী
– দেখ, ওই কচুপাতার ওপর জমে থাকা পানি
কী স্বচ্ছ, আর কেমন স্থির!
গতরাতের বৃষ্টির পরে
যতটুকু জল গড়িয়ে পড়লো নদী বা পুকুরে
তার থেকে ঢের স্বল্প হয়েও দৃষ্টিকারে
যেন জলের সৌন্দর্য মুক্তোর মত হবে…
– আমিও বেশ দেখি, বৃষ্টির পরে
সবুজে চোখ ফিরিয়ে আনি; সেদিন যখন
দৃষ্টিসীমায় পেয়ে গেছি কচুপাতা আশ্চর্য!
সে পাতাটায় জল ছিল না জানো?
তবে মুক্তোর মত মনে হলেও
ওই জলোমুক্তোয় মালা হবে না জেনো।
– বুঝলাম! মালা গাঁথবার স্বাদ
সে কখনও হয়নি আমার তবু
যদি কখনও গাঁথবার আকাঙ্খা পেয়ে বসে তখন
তোমার কথা যা হারিয়ে যাচ্ছে, যায় ক্রমাগত
তাকেই উপকরণ করে নেবো মালা গেঁথে…
– হু! কতহাজার জনের কতশত মালা, বুঝবে?
বুঝবে কোনটা কার?
– বুঝতে চাইব কেন?
যাকে চিনি না কিংবা যে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে
তাকে আর কেন হাতরিয়ে খোঁজা
মনের শত আকাশে আকাশে
কেন বল তবে পিচ্ছলে পড়া!
– পিচ্ছলে তুমি পড়বে মনে রেখো..
– না পড়লে হাত বাড়াবে কে, বল!
– থাক বাবা আর না, ওই কচুপাতাটা আনো
দেখো জল যেন না পড়ে যায়, সাবধানে- হ্যাঁ
– জল ধরে রাখবার ইচ্ছে আমার প্রবল
সে তুমি জানো, আর তাতেই দু’জনের তৃপ্তি
– তুমি না-অসভ্য!
– দেখ, ওই কচুপাতার ওপর জমে থাকা পানি
কী স্বচ্ছ, আর কেমন স্থির!
গতরাতের বৃষ্টির পরে
যতটুকু জল গড়িয়ে পড়লো নদী বা পুকুরে
তার থেকে ঢের স্বল্প হয়েও দৃষ্টিকারে
যেন জলের সৌন্দর্য মুক্তোর মত হবে…
– আমিও বেশ দেখি, বৃষ্টির পরে
সবুজে চোখ ফিরিয়ে আনি; সেদিন যখন
দৃষ্টিসীমায় পেয়ে গেছি কচুপাতা আশ্চর্য!
সে পাতাটায় জল ছিল না জানো?
তবে মুক্তোর মত মনে হলেও
ওই জলোমুক্তোয় মালা হবে না জেনো।
– বুঝলাম! মালা গাঁথবার স্বাদ
সে কখনও হয়নি আমার তবু
যদি কখনও গাঁথবার আকাঙ্খা পেয়ে বসে তখন
তোমার কথা যা হারিয়ে যাচ্ছে, যায় ক্রমাগত
তাকেই উপকরণ করে নেবো মালা গেঁথে…
– হু! কতহাজার জনের কতশত মালা, বুঝবে?
বুঝবে কোনটা কার?
– বুঝতে চাইব কেন?
যাকে চিনি না কিংবা যে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে
তাকে আর কেন হাতরিয়ে খোঁজা
মনের শত আকাশে আকাশে
কেন বল তবে পিচ্ছলে পড়া!
– পিচ্ছলে তুমি পড়বে মনে রেখো..
– না পড়লে হাত বাড়াবে কে, বল!
– থাক বাবা আর না, ওই কচুপাতাটা আনো
দেখো জল যেন না পড়ে যায়, সাবধানে- হ্যাঁ
– জল ধরে রাখবার ইচ্ছে আমার প্রবল
সে তুমি জানো, আর তাতেই দু’জনের তৃপ্তি
– তুমি না-অসভ্য!
কথোপকথন ১০ – পুর্ণেন্দু পত্রী
-কাল বাড়ি ফিরে কি করলে?
-কাঁদলাম। তুমি?
-লিখলাম।
-কবিতা? কই দেখাও।
-লিখেই কুচিকুচি।
-কেন?
-আমার আনন্দের ভিতরে অনর্গল কথা বলছিল আর্তনাদ।
আর্তনাদের ভিতরে গুনগুন ভাঝছিল অদ্ভুত এক শান্তি
আর শান্তির ভিতরে সমুদ্রের সাঁইসাঁই ঝড়
যে সব অক্ষর লিখলেই লাল হওয়ার কথা
তারা হয়ে যাচ্ছিল সাদা।
যে সব শব্দ সাদা কাশবন হয়ে দুলবে
তাদের মনে হচ্ছিল শুকনো ঝাউপাতার উড়াউড়ি
বুঝলাম সে ভাষা আমার জানা নেই
যার আয়নায় নিজের মুখ দেখবে ভালবাসা।
-তাই বলে ছিড়ে ফেললে?
-বাতাস থেকে একটা অট্টহাসি লাফিয়ে উঠে বললে
পিদিমের সলতে হয়ে আরো কিছুদিন পুড়ে খাক’হ।
পুড়ে খাক’হ।
কথোপকথন ১১ – পুর্ণেন্দু পত্রী
– তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছ শুভন্কর।
– এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি…
কিন্তু তার বদলে??
–বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো?
– খেয়েছি।
কিন্তু আমার খিদের কাছে সে সব নস্যি।
কলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি,
আকাশটাকে ওমলেটের মতো চিরে চিরে,
নক্ষত্রগুলোকে চিনেবাদামের মতো টুকটাক করে,
পাহাড়গুলোকে পাঁপর ভাজার মতো মড়মড়িয়ে,
আর গঙ্গা?
সে তো এক গ্লাস সরবত।
–থাক। খুব বীরপুরুষ।
–সত্যি তাই…
পৃথিবীর কাছে আমি এই রকমই ভয়ংকর বিস্ফোরণ।
কেবল তোমার কাছে এলেই দুধের বালক,
কেবল তোমার কাছে এলেই ফুটপাতের নুলো ভিখারি,
এক পয়সা, আধ পয়সা কিংবা এক টুকরো পাউরুটির বেশী আর কিছু ছিনিয়ে নিতে পারিনা।
–মিথ্যুক..।
–কেন?
–সেদিন আমার সর্বাঙ্গের শাড়ি ধরে টান মারনি?
– হতে পারে।
ভিখারিদের কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না একদিনও??
কথোপকথন – ১২ – পুর্ণেন্দু পত্রী
কাল বিকেলে
তোমার ঘাড়ে চিবুক রেখে প্রকাণ্ড
বাঘ কি খুঁজছিল
দেখতে পেলে?
-জানি জানি খুঁজছিল তার সুখের নদীর উৎস
এবং পারাপারের
শেষ পারানি
-সমস্ত রাত
নিজের বুকের পাথর খুড়ে বইয়েছে
কাল ক্ষতিকারক
জলপ্রপাত।
-লক্ষী সোনা,
আমি তোমার রৌদ্র ছায়ায় সর্বক্ষনই
সংগে হাটি
সমুদ্র তীর কষ্ট দিলে বিছোই বালির
শীতল পাটি
বুকের কাছে নেই তবুও তোমার
বুকেই বসতবাটি
ভুল কোরো না।
কথোপকথন –১৩ – পুর্ণেন্দু পত্রী
-তোমার মধ্যে অনন্তকাল বসবাসের ইচ্ছে
তোমার মধ্যেই জমিজমা ঘরবাড়ি, আপাতত একতলা
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?
-একতলা আমার এক বিন্দু পছন্দ নয়
সকাল সন্ধে চাঁদের সাথে গপ্পো গুজব হবে
তেমন উচু নাহলে আবার বাড়ি নাকি?
-আচ্ছা তাই হবে
চাঁদের গা ছুঁয়ে বাড়ি,
রহস্য উপন্যাসের মতো ঘোরানো প্যাচানো সিড়ি
বাঁকে বাঁকে সোনালী সাজানো স্বপ্নদৃশ্য
শিং সমেত মায়া হরিণের মুণ্ডু
হাসছো কেন ? বলো হাসছো কেন?
-কাটা হরিণ দেয়ালে ঝুলবে অসহ্য।
হরিণ থাকবে বনে বন থাকবে আমাদের,
খাট পালংকের চারধারে
খাট পালংকের নিচে ছোট্ট একটি পাহাড়
পাহাড়ের পেটচিরে ঝর্ণা।
-আচ্ছা তাই হবে
পাহাড় চিরে ঝর্ণা, ঝর্ণার উপরে কাশ্মিরী কার্পেট
সিলিং এ রাজস্থানী-ঝাড়ঝলে ঝাঝরীর মতো উপুর করা।
জানালার গায়ে মেঘ, মেঘের গায়ে ফুরফুরে আদ্দির
পাঞ্জাবী
পাঞ্জাবীর গায়ে লক্ষ্ণই চিকনের কাজ
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?
-মেঘ রোজ রোজ পাঞ্জাবী পরবে কেন?
এক একদিন পরবে বালুচরী কিংবা
খাটাও এর পাতলা প্রিন্ট
মাথায় বাগান-খোপা-খোপায় হীরের প্রজাপতি
-আচ্ছা তাই হবে।
মেঘ সাজবে জরি পাড় সাড়িতে
আর তখনই নহবতখানার সানাই এ জয়জয়ন্তী
আর তখনই অরণ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনো জানোয়ারের হাকডাক।
খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জেগে উঠবে জলপ্রপাত
শিকারের জন্য তীর ধনুক, দামামা দুন্দুভি
হাসছো কেন? বলো হাসছো কেন?
-তুমি এমন ভাবে বলছো
যেন ভালবাসা মানে সাপে নেউলো ভয়াভহ
একটা যুদ্ধ।
ভয় লাগছে
অন্য গল্প বলো।
কথোপকথন – ১৪ – পুর্ণেন্দু পত্র
আমরা কথা বলছি
অথচ কোনো কথায় শেষ হল না এখনও।
একটা লাল গোলাপের কান্নার গল্প
শোনাবে বলেছিলে
কবে বলবে?
– চলো উঠি। বড্ড গরম এখানে।
– দেখ, অনন্তকাল শুকনো বাঁশপাতার মতো
আমরা ঘুরছি
অথচ কেউ কাউকে ছুঁতে পারলুম না এখনো।
একটা কালো হরিনকে কোজাগরী উপহার
দেওয়ার কথা ছিল
কবে দেবে?
– চলো উঠি। বড্ড ঝড়ঝাপটা এখানে।
কথোপকথন – ২১ – পুর্ণেন্দু পত্রী
– তোমাদের ওখানে এখন লোডশেডিং কি রকম
– তুমি তখন কি করো?
– দরজা খুলে দিই।
জানলা খুলে দিই।
পর্দা খুলে দিই।
আজকাল হাওয়াও হয়েছে তেমনি ফন্দিবাজ।
যেমনি অন্ধকার, অমনি মানুষের ত্রিসীমানা ছেড়ে দৌড়।
– তুমি তখন কি করো?
– গায়ে জামা-কাপড় রাখতে পারি না।
সব খুলে দিই,
চোখের চশমা, চুলের বিনুনি, বুকের আঁচল, লাজ-লজ্জা সব।
– টাকা থাকলে তোমার নামে নতুন ঘাট বাঁধিয়ে দিতুম কাশী মিত্তিরে
এমন তোমার উথাল-পাতাল দয়া।
তুমি অন্ধকারকে সর্বস্ব, সব অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খুলে দিতে পার কত সহজে।
আর শুভঙ্কর মেঘের মত একটু ঝুঁকলেই
কি হচ্ছে কি?
শুভঙ্কর তার খিদে তেষ্টার ডালপালা নাড়লেই
কি হচ্ছে কি?
শুভঙ্কর রোদে-পোড়া হরিনের জিভ নাড়ালেই
কি হচ্ছে কি?
পরের জন্মে দশদিগন্তের অন্ধকার হবো আমি।
কথোপকথন – ২৮ – পুর্ণেন্দু পত্রী
– কেন বাসব না? অনেক।
বিষবৃক্ষের ভ্রমর
যোগাযোগের কুমু
পুতুলনাচের ইতিকথার কুসুম
অপরাজিত-র…..
– ইয়ার্কি করো না। সত্যি কথা বলবে।
– রোগা ছিপছিপে যমুনাকে ভালোবেসেছিলাম বৃন্দাবনে
পাহাড়ী ফুলটুংরীকে ঘাটশিলায়
দজ্জাল যুবতী তোর্সাকে জলপাইগুড়ির জঙ্গলে
আর সেই বেগমসাহেবা, নীল বোরখায় জরীর কাজ
নাম চিল্কা
– আবার বাজে কথার আড়াল তুলছ?
– বাজে কথা নয়। সত্যিই।
এদের কাছ থেকেই তো ভালবাসতে শেখা।
অনন্ত দুপুর একটা ঘাস ফড়িং-এর পিছনে
এক একটা মাছরাঙ্গার পিছনে গোটা বাল্যকাল
কাপাসতুলো ফুটছে
সেইদিকে তাকিয়ে দুটো তিনটে শীত-বসন্ত
এইভাবেই তো শরীরের খাল-নালায়
চুইয়ে চুইয়ে ভালবাসার জল।
এইভাবেই তো হৃদয়বিদারক বোঝাপড়া
কার আদলে কি, আর কোনটা মাংস, কোনটা কস্তুরী গন্ধ।
ছেলেবেলায় ভালবাসা ছিল
একটা জামরুল গাছের সঙ্গে।
সেই থেকে যখনই কারো দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই
জামরুলের নিরপরাধ স্বচ্ছতা ভরাট হয়ে উঠেছে
গোলাপী আভার সর্বনাশে,
অকাতর ভালবেসে ফেলি তৎক্ষণাৎ
সে যদি পাহাড় হয়, পাহাড়
নদী হয়, নদী
কাকাতুয়া হলে, কাকাতুয়া
নারী হলে, নারী।
কথোপকথন – ৩০ – পুর্ণেন্দু পত্রী
– তুমি আমার সর্বনাশ করেছ শুভঙ্কর।জ্বলন্ত উনোনে ভিজে কয়লার ধোঁয়া আর শ্বাসকষ্ট
ঘিরে ফেলেছে আমার দশদিগন্ত।
এখন বৃষ্টি নামলেই কানে আসে নদীর পাড় ভাঙার অকল্যাণ শব্দ
এখন জ্যোৎস্না ফুটলেই দেখতে পাই
অন্ধকার শশ্মানযাত্রীর মত ছুটে চলেছে মৃতদেহের খোঁজে।
কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। কিচ্ছু না।
আগে আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা সাজগোজ
পাউডারে, সাবানে, সেন্টে, সুর্মায়
নিজেকে যেন কেচে ফর্সা করে তোলার মত সুখ।
এখন প্রতিবিম্বের দিকে তাকালেই
সমস্ত মুখ ভরে যায় গোলমরিচের মতো ব্রণে, বিস্বাদে, বিপন্নতায়।
এখন সমস্ত স্বপ্নই যেন বিকট মুখোশের হাসাহাসি
দুঃস্বপ্নকে পার হওয়ার সমস্ত সাঁকো ভেঙে চুরমার।
কিচ্ছু ভালো লাগে না আমার। কিচ্ছু না।
– তুমিও কি আমার সর্বনাশ করনি নন্দিনী?
আগে গোলমরিচের মতো এতটুকু ছিলাম আমি।
আমার এক ফোঁটা খাঁচাকে তুমিই করে দিয়েছ লম্বা দালান।
আগাছার জমিতে বুনে দিয়েছ জ্বলন্ত উদ্ভিদের দিকচিহ্নহীন বিছানা।
এখন ঘরে টাঙানোর জন্যে একটা গোটা আকাশ না পেলে
আমার ভাল লাগে না।
এখন হাঁটা-চলার সময় মাথায় রাজছত্র না ধরলে
আমার ভালো লাগে না।
পৃথিবীর মাপের চেয়ে অনেক বড় করে দিয়েছ আমার লাল বেলুন।
গোলমরিচের মতো এই একরত্তি পৃথিবীকে
আর ভালো লাগে না আমার।
কথোপকথন – ৩১ – পুর্ণেন্দু পত্রী
যতক্ষন পাশে থাকো, যতক্ষন ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকি
আমি যেন মেঘে জলে মেশা কোনো আত্মহারা পাখি।
বলতো কি পাখি?
শুভঙ্কর –
যতক্ষন পাশে থাকো, যতক্ষন ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা
উল্কার স্ফুলিঙ্গ দিয়ে অন্ধকারে দীর্ঘ ছবি আঁকা।
বলতো কি ছবি?
নন্দিনী –
যতক্ষন কথা বলো, হাসো ও ঝরাও ধারাজল
বীজ থেকে জেগে ওঠে অফুরন্ত গাছ, বনতল।
বলতো কি গাছ?
শুভঙ্কর –
যতক্ষন পাশে থাকো ভূমিকম্প, সুখের সন্ত্রাস
পৌঁছে যাই সেখানে, যেখানে বসন্ত বারোমাস।
বলতো কি দেশ?
কথোপকথন – ৩৩ – পুর্ণেন্দু পত্রী
ব্যাগে ভরে নাও টাকাগুলো।
আজ সমস্ত কিছুর দাম দেবো আমি।
– কি হচ্ছে কি শুভঙ্কর? কেন এমন পাগলামির ঢেউয়ে দুলছ?
এইজন্যই তোমার উপর রাগ হয় এমন।
মাঝে মাঝে অর্থমন্ত্রীদের মতো গোঁয়ার হয়ে ওঠো তুমি।
কাল কতবার বলেছিলুম, চলো উঠি, চলো উঠি।
আকাশ আলকাতরা হয়ে আসছে, চলো, উঠি।
এখুনি সেনাবাহিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়বে বৃষ্টি, চলো উঠি।
তুমি ঘাসের উপর বুড়ো বটগাছ হয়ে বসে রইলে।
কলকাতা ডুবল, তুমিও ডুবলে
আমাকেও ডোবালে।
কেন আমার কথা শোনো না বল তো?
আমি কি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি
যে সিংহাসনের হাতলে হাত রাখলেই হারিয়ে যাবে স্মৃতিহীন অন্ধকারে?
কলের জলের মতো
ক্যালেন্ডারের তারিখের মতো
বন্যার গায়ে গায়ে খরার মতো
আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি। এবং থাকবো।
তাহলে কেন আমার কথা শোনো না শুভঙ্কর?
কথোপকথন – ৩৫ – পুর্ণেন্দু পত্রী
ছুঁচ দিয়ে লেখো কবিতা।
– গোয়েন্দা নাকি? আমার যা কিছু লুকানো
জানতে হবে কি সবই তা?
– তর্ক কোরো না জুড়ে দেবে কিনা এখুনিই
হৃৎপিন্ডের ক্ষতটা।
– দিতে পারি তবে মজুরি পড়বে বিস্তর
জোগাতে পারবে অতটা?
– কাজ যদি হয় নিখুঁত,পাবেই মজুরী,
ভেবেছো পালাবো গর্তে?
– হৃৎপিন্ডের ভিতরে থাকে যে ঝর্ণা
দিতে হবে স্নান করতে।
কথোপকথন – ৩৬ – পুর্ণেন্দু পত্রী
এমন করে কি ভাসাতাম ডিঙ্গি নৌকো?
ভাসাতাম?
তুমি চলে যাবে সমুদ্রে আগে বলনি
তাহলে কি গায়ে মাখাতাম ঝড়-ঝঞ্ঝা?
মাখাতাম?
নুড়িতে-পাথরে নূপুর বাজিয়ে ছোট্ট
জলরেখা ছিলে দুই হাত দিয়ে ধরেছি।
ধরা দিয়েছ।
এখন দুকুল ভরেছে প্রবাহে প্লাবনে
উঁচু মাস্তুলে জাহাজ এসেছে ডাকতে।
ওকে সাড়া দাও।
কথোপকথন – ৩৭ – পুর্ণেন্দু পত্রী
নন্দিনী! এসব কথা তোমার কখনো মনে হয়?
চক্রান্তের মত যেন, সারা গায়ে অপরাধপ্রবনতা মেখে
একটি যুবক আজ যুবতীর কাছাকাছি এসে
সাদা রুমালের গায়ে ফুলতোলা শেখে।
যেন এই কাছে আসা সমাজের পক্ষে খুব বিপজ্জনক।
যেন ওরা আগ্নেয়াস্ত্র পেয়ে গেছে মল্লিকবাগানে
যেন ওরা হাইজ্যাকের নথিপত্র জানে
এসেছে বারুদ ভরে গোপন কামানে।
একটি যুবক যদি প্রতিদিন পাখি-রং বিকেলবেলায়
তার কোনো নায়িকার হাতে রাখে হাত
যেন এই কলকাতার মারাত্মক ক্ষতি করে দেবে বজ্রপাত।
কলকাতায় জঙ্গল গজাবে
কলকাতাকে সাপে-খোপে খাবে।
এই সব ফিসফাস, চারিদিকে অবিরল এই সব
ছুঁচোর কেত্তন,
একটি যুবক এসে যুবতীর কাছাকাছি বসেছে যখন।
নন্দিনী! তোমার মনে পড়ে?
মামাশ্বশুরের মত বিচক্ষন মুখভঙ্গি করে
একবার এক বুড়ো হাড় এসে প্রশ্ন করেছিল,
মেয়েটির সঙ্গে কেন এত মাখামাখি
মেয়েটির মধ্যে কোন গুপ্তধন আছে-টাছে নাকি?
লুকনো এয়ারপোর্ট আছে?
জাল-নোট ছাপাবার কারখানা আছে?
আন্তর্জাতিক কোন পাকচক্র আছে?
তাহলে কিসের জন্যে ছুঁচ ও সুতোর মত
শীত-গ্রীষ্ম এত কাছে কাছে?
কথোপকথন – ৩৮ – পুর্ণেন্দু পত্রী
কোনও একদিন বুঝি জ্বর হবে ,দরজা দালান ভাঙ্গা জ্বর
তুষার পাতের মত আগুনের ঢল নেমে এসে
নিঃশব্দে দখল করে নেবে এই শরীরের শহর বন্দর।
বালিশের ওয়াড়ের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে ফেলা তুলো
এখন হয়েছে মেঘ,উঁড়ো হাস, সাঁদা কবুতর।
সেই ভাবে জ্বর এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে অন্য কোন ভুমন্ডলে
নন্দিনী! আমার খুব ভয় করে ,বড় ভয় করে।
– বাজে কথা বকে বকে কি যে সুখ পাও শুভঙ্কর।
সত্যি বুঝি না।
কার জন্যে ছুরি নিয়ে খেলায় মেতেছো?
তুমি কি আমার চোখে রক্তদৃশ্য এঁকে দিতে চাও?
– ছুরি কই? ছুরি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি জঙ্গলে
খাঁ খাঁ দুপুরের মত লম্বা ছুরি ছিল বটে কিছুদিন আগে।
তখন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল
তখন যে যুদ্ব দাঙ্গা লুটপাট ডাকাতির সম্ভাবনা ছিল
এখন ভীষন ভয় ছাড়া অন্য কোন প্রতিপক্ষ নেই ।
যুদ্ব নেই কামানের তোপ নেই , অসুখ বিসুখ কিছু নেই
ভয় ছাড়া অন্য কোন বীজানুর মারাত্মক আক্রমন নেই ।
– আমার যা কিছু ছিল সবই তো দিয়েছি,শুভঙ্কর।
তোমার বাঘের থাবা তাও ভরে দিয়েছি খাবারে।
চাঁদোয়ার মত ঘন বৃক্ষ ছায়া টাঙ্গিয়ে দিয়েছি
মাথার উপরে,ঠিক আকাশের মাপে মাপে বুনে।
তবুও তোমার এত ভয়?
তবুও কিসের এত ভয়?
-সেই ছেলেবেলা থেকে যা ছুয়েছি সব ভেঙ্গে গেছে।
প্রকান্ড ইস্কুলবাড়ি কাচের চিমনির মত ঝড়ে ভেঙ্গে গেল।
একান্নবর্তীর দীর্ঘ দালান-বারান্দা ছেড়া কাগজের
কুচি হয়ে গেল।
কচি হাতে রুয়ে রুয়ে সাজিয়ে ছিলাম এক উৎফুল্ল বাগান
কুরে কুরে খেয়ে গেছে লাল পিঁপড়ে,পোকা ও মাকড়।
একটা পতাকা ছিল, আকাশের অদ্বিতীয় সুর্যের মতন
তর্কে ও বিতর্কে তাও সাত আটটা টুকরো হয়ে গেল ।
গাঁয়ের নদীকে ছুঁয়ে কী ভুল করেছি
নদীর ব্রীজ কে ছুঁয়ে কী ভুল করেছি
কাগজ ও মুদ্রাযন্ত্র ছুয়ে আমি কি ভুল করেছি?
নন্দিনী!
তোমাকে যদি বাগান,পতাকা,ব্রীজ,কাগজের মতন হারাই?
কথোপকথন – ৪০ – পুর্ণেন্দু পত্রী
শুধু তার তোলপাড় ঢেউ গুলো আজন্ম আমার
বুকের সোনালি ফ্রেমে পেইন্টিং এর মতো রয়ে গেল।
এবং তা ধীরে ধীরে ধুলোয়, ধোঁয়ায়, কুয়াশায়
পোকামাকড়ের সুখী বাসাবাড়ি হয়ে যায় যদি?
– ধরো কোন একদিন যদি খুব দূরে ভেসে যাই
আমারও সোনার কৌটো ভরা থাকবে প্রতিটি দিনের
এইসব ঘন রঙে, বসন্ত বাতাসে, বৃষ্টি জলে।
যখন তখন খুশি ওয়াটার কালারে আঁকা ছবি গুলো
অম্লান ধাতুর মতো ক্রমশ উজ্জ্বল হবে সোহাগী রোদ্দুরে।
– তার মানে সত্যি চলে যাবে?
– তার মানে কখনো যাবো না।
স্বপ্নের বিছানা – পুর্ণেন্দু পত্রী
আর নীল রঙের একটা বালব টাঙিয়ে রাখা ভালো।
অন্ধকারে গায়ে নীল রঙের জামা পরিয়ে দিলে
স্বপ্ন দেখার দরজা খুলে দেয় সে।
মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক খাটে
স্বপ্ন দেখার আলাদা কোনো বিছানা-বালিশ নেই।
অবিকল স্বপ্নের মতো নারীরও শুয়ে নেই কোনো খাটে।
স্বপ্নের মধ্যে ছাড়া আর কোথায়
আকাশময় উলুউলু?
গায়ে-হলুদের গন্ধে আকাশ পাতাল জুড়ে ফুলশয্যা?
স্বপ্নের মধ্যেই বুক-পিঠের অসুখ-বিসুখে সরিয়ে
অবিরল জলপ্রপাতে অবিবেচকের মতো কেবল ঝরে যাওয়া
নানান নদীতে।
স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব।
সব ধুলোবালি খোলামকুচি, সব উড়ে-যাওয়া আঁচল
রঙীন পরকলা জুড়ে জুড়ে আঁকা সব মুখচ্ছবি
বৃষ্টি বাদলের ভিজে গন্ধের ভিতরে লুকিয়ে কাঁদার সুখ।
স্বপ্নেই শুধু আরেকবার অগাধ জলের ভিতর থেকে
মুখ তুলে তাকায় ছেলেবেলার লাল শালুক।
মোহিনী কলসগুলি যতদূর ভেসে যেতে চায়
ততদূর স্বপ্নের বিছানা।
কোনো কোনো যুবক যুবতী – পূর্ণেন্দু পত্রী
সেকালের মোমমাখা ঝাড়লন্ঠন স্তম্ভ ও গম্বুজ দেখা যায়।
দেখে হিংসা জাগে।
মানুষ এখন যেন কোনো এক বড় উনোনের
ভাত-ডাল-তরকারির তলপেটে ডাইনীর চুলের
আগুনকে অহরহ জ্বালিয়ে রাখার
চেলা কাঠ, কাঠ-কয়লা-ঘুটে।
মানুষ এখন তার আগেকার মানুষ-জন্মের
কবচ, কুণ্ডল, হার, শিরস্ত্রাণ, বর্ম ও মুকুট
বৃষের মতন কাঁধ, সিংহ-কটি, অশ্বের কদম
পিঠে তৃণ, চোখে অহংকার
সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা গগলস্ পেয়ে খুশি।
প্লাসটিকের মানিব্যাগ, নাইলনের জামা পেয়ে খুশি।
বোবা টেলিফোন পুষে তরতাজা বিল পেয়ে খুশি।
চারকোণা সংসারের চতুর্দিকে গ্রীল এটেঁ খুশি।
বনহংসী উড়ে যায়, সে বাতাসে কাশের কথুক
এয়ারকুলারে সেই বাতাসের বাসী গন্ধ পেয়ে বড় খুশি।
একালের কোনো কোনো যুবক বা যুবতীকে দেখে
অতীতের রাজশ্রীর, হর্ষবর্ষনের মতো লাগে।
দেখে হিংসা জাগে।
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল –পুর্ণেন্দু পত্রী
কবেকার শুকনো গোলাপ ।
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন
মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার
পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই ।
স্মৃতি কি আমারও আছে ?
স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত,
লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত
থাকে গান, আলাপচারীতা ?
আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল,
দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি,
ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়,
গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী ।
আকাঙ্খার
ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের
অভ্রে ও আবীরে
আগুনের
দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত
ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম
মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের
ভিতরের নীলে ।
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার
বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের
আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর ।
অথচ কাল বা পরশু
কে ডেকে গোলাপ দিল
কিছুতে বলবে না ।
ফেরারি ফৌজ – পুর্ণেন্দু পত্রী
সুমের,আক্কাড আর গাঢ় পীত হোয়াংহোর তীরে।
বারবার নানা শতাব্দীর আকাশ উঠেছে জ্বলে
ঝলসিত যাদের উষ্ঞীষে,
সেইসব সেনাদের চিনি, আমি চিনি।
–সূর্যসেনা তারা;
রাত্রির সাম্রাজ্যে আজও সন্তর্পণে ফিরিছে ফেরারি।
মাঝরাতে একদিন বিছানায় জেগে উঠে বসে
সচকিত হয়ে তারা শুনেছে কোথায় শিঙা বাজে।
–””সাজো, সাজো”” ডাকে কোন অলঙঘ্য আদেশ।
জনে জনে যুগে যুগে বার হয়ে এসেছে উঠানে;
আগামী দিনের সূর্য দেখেছে আঁধারে
গুঁড়ো গুঁড়ো করে সারা আকাশে ছড়ানো।
সহসা জেনেছে তারা-
এইসব সূর্যকণা তিল তিল করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে কালের প্রান্তরে,
রাত্রির শাসনভাঙা ভয়ংকর চক্রান্তের গুপ্তচর রূপে।
একএকটি সূর্যকণা তুলে নিয়ে বুকে
দুরাশার তুরঙ্গে সওয়ার,
দুর্গম দুরন্তমরু পার হবে বলে
তারা সব হয়েছে বাহির।
সুদূর সীমান্ত হায় তারপর সরে গেছে প্রতি পায়ে পায়ে।
গাঢ় কুজ্ঝটিকা এসে মুছে দিয়ে গেছে সব পথ।
ভয়ের তুফানতোলা রাত্রির ভ্রূকুটি হেনেছে হিংসার বজ্র,
দিগ্বিদিক ভুলানো আঁধারে
কে কোথায় গিয়েছে হারিয়ে,
রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনো অটুট।
ছড়ানো সূর্যের কণা জড়ো করে নিয়ে
যারা জ্বালাবে নুতন দিন,
তারা আজও পলাতক, দলছাড়া, ঘোরেফেরে দেশে আর কালে।
তবু সূর্যকণা বুঝি হারাবার নয়,
কত ম্লান শতাব্দীর প্রহর ধাঁধিয়ে
থেকে থেকে ঝলসিত
কোথা কোন লুকানো কৃপাণে,
ফেরারি সেনার।
এখনো ফেরারি কেন?
ফেরো সব পলাতক সেনা,
সাতসাগরের পারে ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো।
— আনো সব সূর্যকণা রাত্রিমোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তরে।
এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হল ফেরারি ফৌজের।।
বুকের মধ্যে।
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের
আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার
ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার
ঢেউ
সেই সব স্পর্শ, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে
ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে
ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার
হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে
বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং
কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল
আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির
টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধকার খুপরীর
থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
-পূর্ণেন্দু পত্রী
একএকটি সূর্যকণা তুলে নিয়ে বুকে
দুরাশার তুরঙ্গে সওয়ার,
দুর্গম দুরন্তমরু পার হবে বলে
তারা সব হয়েছে বাহির।
সুদূর সীমান্ত হায় তারপর সরে গেছে প্রতি পায়ে পায়ে।
গাঢ় কুজ্ঝটিকা এসে মুছে দিয়ে গেছে সব পথ।
ভয়ের তুফানতোলা রাত্রির ভ্রূকুটি হেনেছে হিংসার বজ্র,
দিগ্বিদিক ভুলানো আঁধারে
কে কোথায় গিয়েছে হারিয়ে,
রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনো অটুট।
ছড়ানো সূর্যের কণা জড়ো করে নিয়ে
যারা জ্বালাবে নুতন দিন,
তারা আজও পলাতক, দলছাড়া, ঘোরেফেরে দেশে আর কালে।
তবু সূর্যকণা বুঝি হারাবার নয়,
কত ম্লান শতাব্দীর প্রহর ধাঁধিয়ে
থেকে থেকে ঝলসিত
কোথা কোন লুকানো কৃপাণে,
ফেরারি সেনার।
এখনো ফেরারি কেন?
ফেরো সব পলাতক সেনা,
সাতসাগরের পারে ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো।
— আনো সব সূর্যকণা রাত্রিমোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তরে।
এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হল ফেরারি ফৌজের।।
বুকের মধ্যে।
___পূর্ণেন্দু পত্রী
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের
আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার
ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার
ঢেউ
সেই সব স্পর্শ, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে
ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে
ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার
হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে
বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং
কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল
আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির
টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধকার খুপরীর
থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
মাধবীর জন্যে
- পূর্ণেন্দু পত্রী
আয়নার পাশে একটু অন্ধকার ছায়া এঁকে দাও।
ব্যথিত দৃশ্যের পট জুড়ে থাক চিত্রিক আঁধার।
দেয়ালের ছবিটাকে একটু সরাতে হবে ভাই।
ওটা নয়, এই ছবিটাকে।
জুলিয়েট জ্যেৎস্নার ভিতরে
রক্তে উচ্চকিত তৃষ্ণা রোমিওর উষ্ণ ওষ্ঠাধরে।
ব্যাস, ব্যাস।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, আসুন।
একটা ক্লোজআপ নেব।
এখানে দাঁড়ান, একটু বা দিক ঘেষে প্লীজ।
মনিটার…
মাধবী বলুন-
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
না। অত স্পষ্ট নয়।
আরেকটু নির্জন স্বরে
নিজের আত্মার সঙ্গে কথোপকথন।
যেন মনে হয়
ওষ্ঠ হতে উচ্চারিত কয়েকটি শীতল বাক্য নয়।
মনে হবে সন্ধ্যাবেলা সারা ধরাতলে
অবসন্ন কুসুমের ঝরিতেছে বনবীথিতলে নীরব রোদনে।
মনে হবে নীরব বোদনে
যেন আপনি বলতে চান
মনে রেখো, মনে রেখা সখা,
যেন কেহ কোনোদিন মনে রাখে নাই
মনে আর রাখিবে না।
জ্যেৎস্নার ভিতরে কোথাও আহ্বান নেই আর,
উষ্ণ ওষ্ঠাধর দুটি গোলাপের মহিমায় ফুটে
এখন অপেক্ষমান
কবে পাখি বলে যাবে, রাত্রি হলো অবসান বনবীথিতলে।
দৃষ্টি আরও নত হবে
সম্মূখে কোথাও কোনো দেখিবার মতো দৃশ্য নাই।
নিবন্ত ধূপের সাদা ছাই
রজনী পোয়ানো কিছু মৃত গোলাপের দীর্ঘশ্বাস
হাঁ-করা নেকড়ের মুখে দগ্ধ সিগারেট
এইটুকু দৃশ্যে শুধু পড়ে আছে কাঠের টেবিলে।
লাইটস্ বার্ণিং।
মাধবী, মেক-আপ্, আলো,
এবার টেকিং
মাধবী, নিশ্চয় মনে আছে সংক্ষিপ্ত সংলাপটুকু
কিছু লাভ আছে মনে রেখে?
-পূর্ণেন্দু পত্রী
তোমার চোখে জল কেন?
ভালবেসেছি বলে।
তোমার চোখে নেই?
শুকিয়ে গেছে।
তারপর, কি করলে এতদিন?
কাঁদলাম। তুমি?
লেখালেখি।
কবিতা? কই শুনাও।
শুনবে? তবে বলি-
'আমি যেন আর আমি নেই,
ভোর হয় আগের মতই
শুধু আমি জেগে থাকি'
কেন?
তোমাকে না কতবার রাত জাগতে বারণ করেছি।
অমাবশ্যার খেয়ালি চাঁদ, আমাকে
জাগিয়ে রাখে সারারাত।
তোমাকে ও কি তাই?
জানিনা,
তবে, আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে
তুমি ও কি তাই?
আমি বিলীন হয়ে গেছি।
কবে?
বুঝতে পারিনি,
শুধু বুঝেছে আমার ঘুমহীন দু'চোখ, আর
জেগে থাকা ঐ পাখিটা,
সাথিহারা বেদনায় যে
ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠে।
তাই? আমার সময় কাটে অস্তিরতায়।
কেন?
বুকের প্রতিটি স্পন্দন,
ভালবাসি ভালবাসি বলে চেঁচায়।
তোমার ও কি তাই?
আমি মরি নিদারুণ ঘোরে,
মনের অজান্তে ভালবেসেছি যারে,
হৃদয় পুড়ে প্রত্যহ তার তরে।
ভালবেসেছ তবে,
জানতে পেরেছ কবে?
আমি জানিনে,
শুধু জানে আমার
শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়,
যেখানে ক্ষণে ক্ষণে আর্তি বেরোয়।
রহস্যময় স্বভাব তোমার,
একি তবে সত্য, নাকি ভেবে নেব
এও তোমার নিছক খেলা?
আমার বলার নেই কিছুই,
শুধু বলব,
জোনাকী'দের কাছে জেনে নিও
প্রতিটি সন্ধ্যেবেলা।।
No comments:
Post a Comment