Saturday, January 25, 2020

মহাদেব সাহা







একবার ভালোবেসে দেখো – মহাদেব সাহা

তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
এই মুখে কবিতা ফুটবে না,
এই কণ্ঠ আবৃতি করবে না কোনো প্রিয় পঙ্‌ক্তিমালা
তাহলে শুকিয়ে যাবে সব আবেগের নদী।
আমি আর পারবো না লিখতে তাহলে
অনবদ্য একটি চরণ, একটিও ইমেজ হবে না রচিত,
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো তবে
কবিতার পান্ডুলিপি জুড়ে দেখা দেবে ঘুরে ঘুরে অনাবৃষ্টি, খরা।
তুমি যদি না তাকাও এই চোখ দেখবে না কিছু
উজ্জ্বল আলোর ভোর ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাবে,
সন্ধ্যাতারা মনে হবে মৃত নিষ্পলক চোখ
যদি ফিরে না তাকাও মর্মে আর পল্লবিত হবে না কবিতা।
তুমি যদি না দাও চুম্বন এই মুখে ফুটবে না ভাষা
মরা গাঙে জাগবে না ঢেউ, দুই তীরে প্রাণের স্পন্দন,
হবে না শস্যের মাঠে শ্রাবণের ব্যাপক বর্ষণ
হৃদয়ে হৃদয়ে আর অঙ্কুরিত হবে না কবিতা, বাজবে না গান।
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
প্রকৃতই আমি আগের মতন পারবো না লিখতে কবিতা
আমার আঙুলে আর খেলবে না জাদুর ঝিলিক,
এই শাদা পৃষ্ঠা জুড়ে ফুটবে না জুঁই আর চাঁপা।
একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো
আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লক্ষ একটি গোলাপ
অনায়াসে কীভাবে আবার অনুভূতি করি সঞ্চারিত,
একবার ভালোসেবে দেখো আবার কীভাবে লিখি দুহাতে কবিতা।








তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশী ভালোবেসে ফেলি – মহাদেব সাহা

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো
বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই
দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি,
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ
জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না।
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে
যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই
তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের
সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই
বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার
ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো
বেশি ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে
আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ
থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে
প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার
মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও
জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো
ভালোবেসেছি তোমাকে।







আর কোনোদিন হইনি এমন মর্মাহত 

– মহাদেব সাহা

এর আগে আর কোনোদিন আমি
হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন তোমার চোখে প্রথম দেখেছি আমি জল,
অকস্মাৎ মনে হলো নিভে গেলো সব পৃথিবীর আলো
গোলাপবাগান সব হয়ে গেলো রুক্ষ কাঁটাবন।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি
মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম পথে দেখলাম অনাথ কিশোর এক
ক্ষুধায় কাতর কেঁদে মরে,
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীতে কোথাও
তেমন আর সুখ কিছু নেই
ফুলের দোকানগুলি হয়ে গেছে অস্ত্রের গুদাম।
আমি আর কোনোদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম দেখি
ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় রক্ত লেগে আছে,
যেদিন প্রথম সবুজ বৃক্ষের দিকে চেয়ে দেখলাম
সেখানে লুকিয়ে আছে বিষধর সাপ, নদীর গভীরে
চোখ ফেলে দেখি এই জলে দূষণের বিষ, হাঙর-কুমির
তখনই দুহাতে ঢেকে মুখ বুঝলাম কতোখানি দুঃখী
এই কাছের পৃথিবী।
যেদিন প্রথম আমি আকাশেল দিকে চেয়ে দেখলাম
মেঘে বজ্র, ক্রূর ঘূর্ণিঝড়
অরণ্যে ভীষণ সব পশু, লোকালয়ে খুনী আততায়ী
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীর আলো অস্তমিত।
এর আগে আমি আর কোেেনাদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম শুনি প্রেমিক অক্লেশে বসিয়েছে ছুরি প্রেমিকার বুকে
তখন বুঝেছি পৃথিবীতে দুঃখ ছাড়া চাষবাস হবে না কিছুই।
এর আগে কোনোদিন এমন হইনি মর্মাহত
যেদিন বৃক্ষের কাছে গিয়ে দেখলাম রক্ত ঝরে বৃক্ষের শরীরে
নদীর নিকটে গিয়ে দেখি নেই তার বুকে এতোটুকু তৃষ্ণারও জল

তখনই বুঝেছি কতোটা নির্দয় হতে পারে এই ভালোবাসার পৃথিবী।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন দেখেও তুমি চোখ তুলে ফিরে তাকালে না।






এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না

 -মহাদেব সাহা

এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর

… কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।







মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস 

– মহাদেব সাহা


কেউ জানেনা একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর
দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন
প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল
সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস,
এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর
কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ
যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান
সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ
সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ,
তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস
যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই
মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু
দেখা যায় না;
মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস,
জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত
হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে।
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
একেকটি মানুষ নিজের
মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়, হায়, কেউ জানে না!







চিঠি দিও
- মহাদেব সাহা
 

করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল, পাখি, সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখর মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে।
এক কোণে শীতের শিশির দিও একফোঁটা, সেন্টের শিশির চেয়ে
তৃণমূল থেকে তোলা ঘ্রাণ
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!
ওই তো রাজার লোক যায় ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে,কাঁধে ব্যাগ,
হাতে কাগজের একগুচ্ছ জীজন ফ্লাওয়ার
কারো কৃষ্ণচূড়া, কারো উদাসীন উইলোর ঝোপ, কারো নিবিড় বকুল
এর কিছুই আমার নয় আমি অকারণ
হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি, আমার কি কোনো কিছু নাই?
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি।









শুদ্ধ করো আমার জীবন 

– মহাদেব সাহা 

তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি প্রতিটি ভোরের মতো
আবার নতুন হয়ে উঠি,
হই সূর্যোদয়
আমার জীবন তুমি পরিশুদ্ধ করো, আমি প্রস্ফুটিত হই
আমি বহুদিন ঝরা ব্যথিত বকুল অন্ধকারে, আমি বহুদিন
বিষন্ন বিধুর ;
একবার আমার মাথায় হাত রাখো, সুপ্রসন্ন হও
এই দগ্ধ বুকে করো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ
আমি শ্যামল সবুজ বৃক্ষ হয়ে উঠি ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হই সূর্যোদয়,
আমি হই উদিত আকাশ
আমি হয়ে উঠি প্রতিটি শিশুর হাতে প্রথম বানান শেখা বই,
হয়ে উঠি ভোরবেলাকার পাখিদের গান ;
আমার জীবন তুমি শুদ্ধ করো, আমি হই নতুন সবুজ
কোনো দ্বীপ,
আমি হই বর্ষাকাল, আমি হই বরষার নব জলধারা
আমি বহুদিন ব্যথিত বিষাদ, আমি বহুদিন একা
ঝাউবন ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হয়ে উঠি সদ্যফোটা ফুল
আমি হয়ে উঠি সকালের ঘুমভাঙ্গা চোখ ।







একবার ভালোবেসে দেখো

 – মহাদেব সাহা

তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
এই মুখে কবিতা ফুটবে না,
এই কণ্ঠ আবৃতি করবে না কোনো প্রিয় পঙ্‌ক্তিমালা
তাহলে শুকিয়ে যাবে সব আবেগের নদী।
আমি আর পারবো না লিখতে তাহলে
অনবদ্য একটি চরণ, একটিও ইমেজ হবে না রচিত,
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো তবে
কবিতার পান্ডুলিপি জুড়ে দেখা দেবে ঘুরে ঘুরে অনাবৃষ্টি, খরা।
তুমি যদি না তাকাও এই চোখ দেখবে না কিছু
উজ্জ্বল আলোর ভোর ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাবে,
সন্ধ্যাতারা মনে হবে মৃত নিষ্পলক চোখ
যদি ফিরে না তাকাও মর্মে আর পল্লবিত হবে না কবিতা।
তুমি যদি না দাও চুম্বন এই মুখে ফুটবে না ভাষা
মরা গাঙে জাগবে না ঢেউ, দুই তীরে প্রাণের স্পন্দন,
হবে না শস্যের মাঠে শ্রাবণের ব্যাপক বর্ষণ
হৃদয়ে হৃদয়ে আর অঙ্কুরিত হবে না কবিতা, বাজবে না গান।
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
প্রকৃতই আমি আগের মতন পারবো না লিখতে কবিতা
আমার আঙুলে আর খেলবে না জাদুর ঝিলিক,
এই শাদা পৃষ্ঠা জুড়ে ফুটবে না জুঁই আর চাঁপা।
একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো
আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লক্ষ একটি গোলাপ
অনায়াসে কীভাবে আবার অনুভূতি করি সঞ্চারিত,
একবার ভালোসেবে দেখো আবার কীভাবে লিখি দুহাতে কবিতা।





মন ভালো নেই
- মহাদেব সাহা--
 

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।








-বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ
- মহাদেব সাহা--


আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
টেপ করে রাখলে
পৃথিবীর যে-কোনো গীতি কবিতার
শ্রেষ্ঠ সঙ্কলন হতে পারতো;
হয়তো আজ তার কিছুই মনে নেই
আমার মনে সেই বাক্যালাপগুলি নিরন্তর
শিশির হয়ে ঝরে পড়ে,
মৌমাছি হয়ে গুনগুন করে
স্বর্ণচাঁপা আর গোলাপ হয়ে ঝরতে থাকে;
সেই ফুলের গন্ধে, সেই মৌমাছির গুঞ্জনে
আর কোকিলের গানে
আমি সারারাত ঘুমাতে পারি না, নিঃশ্বাস ফেলতে
পারি না,
আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
আমার বুকের মধ্যে
দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনির চেয়েও
বড়ো স্বর্ণখনি হয়ে আছে-
আমি জানি এই বাক্যালাপগুলি গ্রথিত করলে
পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের
কবিতা হতে পারতো;
সেইসব বাক্যালাপ একেকটি
হীরকখণ্ড হয়ে আছে,
জলপ্রপাতের সঙ্গীত মূর্ছনা হয়ে আছে,
আকাশে বুকে অনন্ত জ্যোৎ্লারাত্রির
স্নিগ্ধতা হয়ে আছে;
এই বাক্যালাপের কোনো কোনো অংশ
কোকিল হয়ে গেয়ে ওঠে,
কেনো কোনো অংশ ঝর্না হয়ে নেচে বেড়ায়
আমি ঘুমাতে পারি না, জেগে থাকতেও পারি না,
সেই একেকটি তুচ্ছ শব্দ আমাকে কেন যে
এমন ব্যাকুল করে তোলে,
আপাদমস্তক আমকে বিহ্বল, উদাসীন,
আলুথালু করে
তোলে;
এই কথোপকথন, এই বাক্যালাপগুলি
হয়তো পাখির বুকের মধ্যে পেট করা আছে,
নদীর কলধ্বনির মধ্যে ধরে রাখা আছে
এর চেয়ে ভালো প্রেমের কবিতা আর কী
লেখা হবে!

একটি বিষণ্ন চিঠি, মাকে
- মহাদেব সাহা--
 
তোমাকে ডাকার মাগো বড়ো ইচ্ছা করে
বড়ো সাধ জাগে আজ মা তোমাকে একবার ডেকে কথা বলি
কিন্তু কেন উত্তর মেলে না, নৈঃশব্দ্য আমাকে বিদ্ধ করে?
আমি তো করিনি কোনো দোষ, না বলে যাইনি কোনোখানে
তোমার অবাধ্য হয়ে একাকী নদীতে নেমে কাটিনি সাঁতার,
তবু কেন অযথা এমন ক্ষমাহীন ক্রোধে তুমি ফিরিয়েছো মুখ?
এমন তো হয়নি কখনো ঘরে ফিরে
তোমাকে ডেকেও আমি পাই নাই সাড়া,
বাড়ির উঠোনে আমি পা দিয়েই যতোবার তোমাকে ডেকেছি
যেখানেই থাকো তুমি আমার একটি ডাকে
ঝরেছে তোমার কন্ঠে অপার করুণাধারা যেন
সেই তুমি আজ কেন পাষাণের স্তব্ধতা এমন?
মন চায় আজ শুধু তোমাকেই প্রাণ ভরে ডাকি
কিন্তু দেখো মানুষের এতোই সময় কম, মাকেও ডাকার তার
সময় মেলে না

তোমাকে ডাকার পালা শে হয়ে গেলো,
আর আজো আমি ভালো করে কথাই শিখিনি।
তুমি কি ভেবেছো আমি বড়োসড় হয়ে গেছি খুবই,
তোমাকে এখন আর ব্যাকুল শিশুর মতো ডাকবো না আমি?
কিন্তু মা এখনো আমি তোমার কোলের সেই শিশু রয়ে গেছি।
আজো তো তেমনি মাগো বয় পায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা পায়
কেউ একবিন্দু জলও দেয় না;
তুমি তো জানোই মাগো একলা আঁধার ঘরে
কী ভীষণ ভয়ে জড়সড় তোমারই বুকে লুকাতাম মুখ
আজ আঁধারের চেয়েও আঁধার চারদিকে
সামান্য মেঘের ডাকে যার ঘুম ভেঙে যেতো
আজ তরই মাথায় মাগো ভেঙে পড়ে বাজ,
তবু কারো এতোটুকু সরে না আঙুল;
ইঁদুরের শব্দে পাশে ভয় পাই তাই ঘুম পাড়িয়েছো তোমার কোলেই
আজ শ্বাপদসঙ্কুল এই অরন্যে বাস করি;
মাগো, তুমি নেই, তাই কেউ নেই
ভয়ার্ত শিশুর মতো আজো আমি সবটুকু শক্তি দিয়ে
যতোই তোমাকে শুধু ডাকি,
দেখি এই শব্দময় পৃথিবীতে বিশাল মৌনতা এসে গ্রাস করে
কেবল আমাকে।
 
নখরে জ্বালিয়ে রাখি লক্ষ্যের দীপ্র ধনুক
যেন এক শব্দের নিষাদ এই নির্মল নিসর্গে বসে কাঁদি, তবু
সেই নির্মম শব্দাবলী ছিঁড়ে আনতে পারি না বলে
সুতীক্ষ্ণ অনুযোগ হতে অব্যাহতি দিন; এই
শোকের শহরে আমি যার কাছে চাই ফুল, কিছু মনোরম
শোভা, যেসবের বিসতৃত বর্ণনা আমি আপনাকে লিখতে পারি, সে
আমার হাতে শুধু তুলে দেয় দুঃখের বিভিন্ন টিকিট।

আমি চাই প্রত্যহ আপনাকে লিখতে চিঠি, আমি চাই প্রতিদিন
লিখতে এই রক্তের গভীর ইচ্ছে, মর্তান্তিক অনুভবগুলি
আমার সবুজ সুখ, কোমল আনন্দ, নির্জন কান্নার স্বর
একাকী হাঁটতে পথে যেসব দুঃখ দিয়ে ভরে নিই যমজ পকেট
ঢাকার এইসব রঙিন দোকান হতে কিনতে পারিনে আমি
একেকটি সুখের সংসার, কাঠের ঘোড়া, সোনালি
চাবুক, তাই কাঁদি শৈশবের শ্যামল নদীর উপাখ্যান
ভেবে, যে স্বরে কাঁদি আমি সঙ্গিহীন মধ্যরাতে সরকারী গোরস্থানে কিংবা

আমার গোপন ঘরে ফিরে এসে জ্বালাই
দিব্যমোম, শোকের গর্তে শুয়ে কাঁদি, কিংবা যখন
পার্কের বেঞ্চে বসে ফেরেববাজ আড্ডা দিই, ফালতু ফক্কর
মিলে অনেকক্ষণ অযথা হাসি, টিটকিরি দিই, অনগৃল বিদ্রূপের
থুথু ছুঁড়ে উল্লসিত হই, তবু কিছুতেই
পারিনে আমি এইসব সুখদুঃখে আপনাকে লিখতে
চিঠি ; শুনুন জনক, আমি চিরদিন শব্দের কাঙাল।

আজীবন তাই আপনাকে লিখি শুধু একই চিঠি, ভালো
আছি, ইত্যাকার
কুশল সংবাদ অথচ প্রতিদিন ভুগি শিরপীড়া,
বুকে কাশি, অবিরাম জ্বর- আমার রুক্ষ চুলে বিলি কাটে
দুঃস্বপ্নের হাত, এসব খবর কি দৈনন্দিন
লেখা যায়! কী করে লিখবো বলুন, ঘরে একা
দুঃসংবাদে কাঁদবে জননী। আজীবন লিখেছি তাই
একই চিঠি, সেই মিথ্যে মর্মহীন একই চিঠি!
হে জনক, সেই নির্র্মম শব্দ নেই এখানে, যা দিয়ে
বাজাতে পারি কান্নার করুণ কণ্ঠ, নক্ষত্রবীথির সুদূর
নীলিমা হতে আমি
তুলে আনতে পারিনে অমল শব্দের বিভা, অন-রঙ্গ ধ্বনি
আত্মার নিঃসঙ্গ স্বর তাই আমি বোঝাতে পারিনে,
হে জনক, পূজনীয় জনক আমার, ইচ্ছের একটি চিঠি
আজো আমি লিখতে পারিনি।
 
 
 প্রেমের কবিতা
---মহাদেব সাহা।

.
আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
টেপ করে রাখলে
পৃথিবীর যে-কোনো গীতি কবিতার
শ্রেষ্ঠ সঙ্কলন হতে পারতো;
হয়তো আজ তার কিছুই মনে নেই
আমার মনে সেই বাক্যালাপগুলি নিরন্তর
শিশির হয়ে ঝরে পড়ে,
মৌমাছি হয়ে গুনগুন করে
স্বর্ণচাঁপা আর গোলাপ হয়ে ঝরতে থাকে;
সেই ফুলের গন্ধে, সেই মৌমাছির গুঞ্জনে
আর কোকিলের গানে
আমি সারারাত ঘুমাতে পারি না, নিঃশ্বাস ফেলতে
পারি না,
আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি
আমার বুকের মধ্যে
দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত সোনার খনির চেয়েও
বড়ো স্বর্ণখনি হয়ে আছে-
আমি জানি এই বাক্যালাপগুলি গ্রথিত করলে
পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ প্রেমের
কবিতা হতে পারতো;
সেইসব বাক্যালাপ একেকটি
হীরকখণ্ড হয়ে আছে,
জলপ্রপাতের সঙ্গীত মূর্ছনা হয়ে আছে,
আকাশে বুকে অনন্ত জ্যোৎ্লারাত্রির
স্নিগ্ধতা হয়ে আছে;
এই বাক্যালাপের কোনো কোনো অংশ
কোকিল হয়ে গেয়ে ওঠে,
কেনো কোনো অংশ ঝর্না হয়ে নেচে বেড়ায়
আমি ঘুমাতে পারি না, জেগে থাকতেও পারি না,
সেই একেকটি তুচ্ছ শব্দ আমাকে কেন যে
এমন ব্যাকুল করে তোলে,
আপাদমস্তক আমকে বিহ্বল, উদাসীন,
আলুথালু করে
তোলে;
এই কথোপকথন, এই বাক্যালাপগুলি
হয়তো পাখির বুকের মধ্যে পেট করা আছে,
নদীর কলধ্বনির মধ্যে ধরে রাখা আছে
এর চেয়ে ভালো প্রেমের কবিতা আর কী
লেখা হবে!
 
 
 
 
আমি কি বলতে পেরেছিলাম - মহাদেব সাহা
 
 
আমার টেবিলের সামনে দেয়ালে শেখ মুজিবের
একটি ছবি টাঙানো আছে
কোন তেলরঙ কিংবা বিখ্যাত স্কেচ জাতীয় কিছু নয়
এই সাধারণ ছবিখানা ১৭ মার্চ- এ বছর শেখ মুজিবের
জন্ম দিনে একজন মুজিব প্রেমিক আমাকে উপহার দিয়েছিলো
কিন্তু কে জানতো এই ছবিখানা হঠাৎ দেয়াল ব্যপে
একগুচ্ছ পত্র পুষ্পের মতো আমাদের ঘরময়
প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে রাত্রিবেলা
আমি তখন টেবিলের সামনে বসেছিলাম আমার স্ত্রী ও সন্তান
পাশেই নিদ্রামগ্ন
সহসা দেখি আমার ছোট্ট ঘরখানির দীর্ঘ দেয়াল জুড়ে
দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিব;
গায়ে বাংলাদেশের মাটির ছোপ লাগানো পাঞ্জাবি
হাতে সেই অভ্যস্ত পুরনো পাই
চোষে বাংলার জন্য সজল ব্যাকুলতা
এমনকি আকাশকেও আমি কখনো এমন গভীর ও জলভারানত
দেখিনি।
তার পায়ের কাছে বয়ে যাচ্ছে বিশাল বঙ্গোপসাগর
আর তার আলুথালু চুলগুলির দিকে তাকিয়ে
আমার মনে হচ্ছিলো
এই তো বাংলার ঝোড়ো হাওয়ায় কাঁপা দামাল নিসর্গ
চিরকাল তার চুলগুলির মতোই অনিশ্চিত ও কম্পিত
এই বাংলার ভবিষ্যৎ!
তিনি তখনো নীরবে তাকিয়ে আছেন, চোখ দুটি স্থির অবিচল
জানি না কী বলতে চান তিনি,
হঠাৎ সারা দেয়াল ও ঘর একবার কেঁপে উঠতেই দেখি
আমাদের সঙ্কীর্ণ ঘরের ছাদ ভেদ করে তার একখানি হাত
আকাশে দিকে উঠে যাচ্ছে-
যেমন তাকে একবার দেখেছিলাম ৬৯-এর গণআন্দোলনে
তিনি তখন সদ্য ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসেছেন
কিংবা ৭০-এর পল্পনে আর একবার ৭১-এর ৭ই মার্চের
বিশাল জনসভায়;
দেখলাম তিনি ক্রমে উষ্ণ, অধীর ও উত্তেজিত হয়ে উঠছেন
একসময় তার ঠোঁট দুটি ঈষৎ কেঁপে উঠলো
বুঝলাম এক্ষুনি হয়তো গর্জন করে উঠবে বাংলার আকাশ,
আমি ভয়ে লজ্জায় ও সঙ্কোচে নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম।
আমার মনে হেলা আমি যেন
মুখে হাত দিয়ে অবনত হয়ে আছি
বাংলাদেশের চিরন্তন প্রকুতির কাছে,
একটি টলোমলো শাপলা ও দিঘির কাছে,
শ্রাবণের ভরা নদী কিংবা অফুরন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে
কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো অভিযোগ নিঃসরিত হলো না;
তবু আমি সেই নীরবতার ভাষা বুঝতে চেষ্টা করলাম
তখন কী তিনি বলতে চেয়েছিলেন, কী ছিলো তার ব্যাকুল প্রশ্ন
ব্যথিত দুটি চোখে কী জানার আগ্রহ তখন ফুটে উঠেছিলো!
সে তো আর কিছুই নয় এই বাংলাদেশের ব্যগ্র কুশলজিজ্ঞাসা
কেমন আছে আট কোটি বাঙালী আর এই বাংলা বাংলাদেশ!
কী বলবো আমি মাথা নিচু করে ক্রমে মাটির সাথে মিশে
যাচ্ছিলাম-
তবু তাকে বলতে পারিনি বাংরার প্রিয় শেখ মুজিব
তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি
তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,
দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না
বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের
গুলিতে উড়ে গেল কেন?
তোমাকে কিভাবে বলবো তোমার নিষ্ঠুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে
প্রথমে জয়বাংলা, তারপরে একে একে ধর্মনিরপেক্ষতা
একুশে ফেব্রুয়ারী ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্রত
হলো তারা,
এমনকি একটি বাঙালী ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্যত
হলো তারা,
এমনকি একটি বাঙালী ফুল ও একটি বাঙালী পাখিও রক্ষা পেলো না।
এর বেশি আর কিছুই তুমি জানতে চাওনি বাংলার প্রিয়
সন্তান শেখমুজিব!
কিন্তু আমি তো জানি ১৫ই আগষ্টের সেই ভোরবেলা
প্রথমে এই বাংলার কাক, শালিক ও খঞ্জনাই
আকাশে উড়েছিলো
তার আগে বিমানবাহিনীর একটি বিমানও ওড়েনি,
তোমার সপক্ষে একটি গুলিও বের হয়নি কোনো কামান থেকে
বরং পদ্মা-মেঘনাসহ সেদিন বাংলার প্রকৃতিই একযোগে
কলরোল করে উঠেছিলো।
আমি তো জানি তোমাকে একগুচ্ছ গোলাপ ও স্বণৃচাঁপা
দিয়েই কী অনায়াসে হত্যা করতে পারতো,
তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা
তুমি কি তাই টলতে টলতে টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে
বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির উপর পড়ে গিয়েছিলে?
শেখ মুজিব সেই ছবির ভিতর এতোক্ষণ স্থির তাকিয়ে থেকে
মনে হলো এবার ঘুমিয়ে পড়তে চান
আর কিছুই জানতে চান না তিনি;
তবু শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে তাকে আমার বলতে
ইচ্ছে করছিলো
সারা বাংলায় তোমার সমান উচ্চতার আর কোনো
লোক দেখিনি আমি।
তাই আমার কাছে বার্লিনে যখন একজন ভায়োলিন্তবাদক
বাংলাদেশ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলো আমি
আমার বুক-পকেট থেকে ভাঁজ-করা একখানি দশ
টাকার নোট বের করে শেখ মুজিবের ছবি দেখিয়েছিলাম
বলেছিলাম, দেখো এই বাংলাদেশ;
এর বেশি বাংলাদেশ সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না!
আমি কি বলতে পেরেছিলাম, তার শেষবার ঘুমিয়ে পড়ার
আগে আমি কি বলতে পেরেছিলাম?
 
 
 
 
 
একুশের গান,
-মহাদেব সাহা
একুশ মানেই আসছে
সালাম ফিরে আসছে, বরকত ফিরে আসছে
তাজুল ফিরে আসছে….
একুশ মানেই মুক্তিযুদ্ধ ফিরে আসছে
সেই সাহসে বুক-পেতে-দেয়া তারুণ্য ফিরে আসছে
তারুণ্যের চোখে দুর্জয় শপথ ফিরে আসছে,
শহীদেরা ফিরে আসছে
স্বাধীনতা ফিরে আসছে
বাংলাদেশ ফিরে আসছে;
এই পদ্মা-মেঘনার দেশে আবার ’৫২ আসছে
’৬৯ আসছে
’৭১ ফিরে আসছে,
একুশ মানেই আসছে, স্বপ্ন আসছে, ভবিষ্যৎ আসছে
একুশ মানে অতীত নয়, আগামী
মৃত্যু নয়, জন্ম
একুশ মানে শ্বাশ্বত বাংলার হিজল-তমাল
ভাটিয়ালি গান শাপলা-ফোটা দিঘি
পদ্মানদীর মাঝি
ঢাকার উন্মুক্ত রাজপথ, দীর্ঘ মিছিল
নগ্ন পায়ে হাঁটা
সারাদিন ‘আমি কি ভুলিতে পারি’।
একুশ মানে আসছে
সালাম আসছে, বরকত আসছে
তাজুল আসছে…
মায়ের অশ্রুভেজা চোখে
আবার আশার ঝিলিক ফিরে আসছে
পিতার তপ্ত বুকে
আবার বিশ্বাস ফিরে আসছে
সন্তানের ম্লান চোখে
আবার স্বপ্ন ফিরে আসছে,
একুশ মানে আসছে, আসছে, আসছে…
এই একুশে তাজুল ফিরে আসছে
শোষণের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিবাদ আসছে
সম্মিলিত সংগ্রাম আসছে
পুঁজিবাদের জন্য চরম আঘাত আসছে;
একুশ মানে আসছে
বাংলা ভাষার দিন আসছে.
কৃষ্ণচুড়া পলাশের দিন আসছে,
দুনিয়া-কাঁপানো দিন আসছে;
এই একুশ মানে মাঠভরা পাকা ধানের গন্ধ
নদীতে রূপালী মাছ
পালের নৌকা;
একুশ মানে দিগন্তজোড়া আগামী দিনের স্বপ্ন
একুশ মানে জয়নুলের ছবি,
নজরুলের কবিাত
হৃদয়মথিত রবীন্দ্রনাথের গান;
একুশ মানে আমর সোনার বাংলা
একুশ মানে শহীদের পায়ের শব্দ
একুশ মানে অজর, অমর, অবিনশ্বর।
একুশ মানে আসবে
একুশ মানে আসছে,
শহীদেরা আসছে
স্বাধীনতা আসছে
বাংলাদেশ আসছে;
একুশ মানে আসছে
সালাম আসছে, বরকত আসছে,
তাজুল আসছে,,,,,
 
 
 
 মেঘ দেখার দুঃখ, গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
 – মহাদেব সাহা
 
 
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার
ব্যাকুলতা-
কিন্তু আমিও যখন মেঘের দিকে তাকাই দেখি কালিদাসই
দেখছেন বিরহী যক্ষকে,
হঠাৎ মন ভরে যায় বহু যুগের ওপার থেকে আসা বর্ষণে:
এই গোলাপ দেখর কথা আমার হয়তো বলাই হবে না
কিন্তু যখন গোলাপের দিকে তাকাই দেখি ব্লেক
তাকিয়ে আছেন গেলোপের রুগ্নতার দিকে,
কিংবা রিলকে আয়ত্ত করে চলেছেন একটি শ্বেতগোলাপ,
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,
বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক
কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসে ওঠে
রিলকের মুখটি,
এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কাউকে বলাই হবে না ;
আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ
দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী
সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায় -
এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।
যখন মানুষের শুদ্ধতার কথা ভাবি দেখি দাঁড়িয়ে আছেন
ব্যথিত বোদলেয়ার
শহরের রাত্রির দিকে তাকালে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ দেখছেন
লিবিয়ার জঙ্গল,
যখন একজন বিপ্লবীর দিকে তাকাই দেখি দুচোখে
মায়াকোভস্কির স্বপ্ন
আর্ত স্বদেশের দিকে তাকিয়ে আমিও নেরুদার কথাই ভাবি,
কেউ জানে না একটি ফুলের মৃত্যু দেখে, একটি পাখির ক্রন্দন দেখে
আমারও হৃদয় পৃথিবীর আহত কবিদের মতোই হাহাকার
করে ওঠে।
একটি ফুল দেখে আমিও একজন প্রেমিকের মতোই পরাজিত
হতে ভালোবাসি
একটি ঝরাফুলের দুঃখ বুকে নিয়ে যে-কোনো ব্যথিত কবির
মতোই সারাদনি ঘুরে বেড়াই,
আসলে সে-কথাগুলোই বলা হয়নি, বলা হয়নি;
মানুষের সমাজে এই বৈষম্য দেখে আমিও একজন
বিপ্লবীর মতোই শ্রেনীসংগ্রামের জন্য তৈরি হই,
এই জরা বার্ধক্য দেখে কতোবার বুদ্ধের মতোই
ব্যথিত হয়ে উঠি;
কিন্তু কী করে বলবো এইসব মেঘ দেখার দুঃখ, এইসব
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!

 
 
আমার জীবন
-মহাদেব সাহা
 
আমার জীবন আমি ছড়াতে ছড়াতে
এসেছি এখানে,
আমি কিছুই রাখিনি-
কুড়াইনি তার একটিও ছেঁড়া পাতা,
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো
সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্মৃতি,
আমি এই হারানো জীবন আর খুজি নাই
সেই ফেলে আসা পথে;
ছেঁড়া কাগজের মতো ছড়াতে ছড়াতে এসেছি আমাকে।
পথে পড়ে থাকা ছিন্ন পাপড়ির মতো
হয়তো এখানো পড়ে আছে
আমার হাসি ও অশ্রু,
পড়ে আছে খেয়ালি রুমাল, পড়ে আছে
দুই এক ফোঁটা শীতের শিশির;
এখনো হয়তো শুকায়নি কোনো কোনো অশ্রুবিন্দুকণা,
বৃষ্টির ফোঁটা
চঞ্চল করুণ দৃষ্টি, পিছু ডাক,
হয়তো এখনো আছে সকালের মেঘভাঙা রোদে,
গাছের ছায়ায়
পদ্মাপকুরের স্থির কালো জলে,
হয়তো এখনো আছে হাঁসের নরম পায়ে
গচ্ছিত আমার সেই হারানো জীবন
সেই সুখ-দুঃখ
গোপন চোখের জল।
এখনো হয়তো পাওয়া যাবে মাটিতে
পায়ের চিহ্ন
সেসব কিছুই রাখিনি আমি
ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে এখানে এসেছি;
আমি এই জীবনকে ফ্রেমে বেঁধে রাখিনি কখনো
নিখুঁত ছবির মতো তাকে আগলে রাখা হয়নি আমার,
আমার জীবন আমি এভাবে ছড়াতে ছড়াতে এসেছি।
আমার সঞ্চয় আজ কেবল কুয়াশা, কেবল ধূসর মেঘ কেবল শূন্যতা
আমি এই আমাকে ফ্রেমে বেঁধে সাজিয়ে রাখিনি,
ফুটতে ফুটতে ঝরতে ঝরতে আমি এই এখানে
এসেছি;
আমি তাই অম্লান অক্ষুণ্ন নেই, আমি ভাঙাচোরা
আমি ঝরা-পড়া, ঝরতে ঝরতে
পড়তে পড়তে
এতোটা দীর্ঘ পথ এভাবে এসেছি
আমি কিছুই রাখিনি ধরে কোনো মালা, কোনো ফুল,
কোনো অমলিন স্মৃতিচিহ্ন
কতো প্রিয় ফুল, কতো প্রিয় সঙ্গ, কতো উদাসীন
উদ্দাম দিন ও রাত্রি
সব মিলে হয়ে গেছে একটিই ভালোবাসার মুখ,
অজস্র স্মৃতির ফুল হয়ে গেছে একটিই স্মৃতির গোলাপ
সব নাম মিলে হয়ে গেছে একটিই প্রিয়তম নাম;
আমার জীবন আমি ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে এখানে এসেছি।
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...