Friday, January 24, 2020

শুভ দাশগুপ্ত

প্রেম – শুভ দাশগুপ্ত


তখন বিকেল ঘনিয়ে আসছে। বাতাসে শীতের আমেজ।
১০ই অক্টোবর তাদের দীর্ঘক্ষণ কথা হল টেলিফোনে।
সেদিন ছেলেটি নতুন কেনা টব’এ গোলাপের চারা লাগাল।
৩০শে অক্টোবর রেস্টুরেন্টের নিরালা কেবিনে
ছেলেটি বলল—
তোমাকে আমি ভালবাসি।
মেয়েটি লজ্জায় মাথা নিচু করে টেবিলে আঁকিবুকি কাটল।
১২ই ডিসেম্বর গোলাপগাছে কুঁড়ি ধরল।
মেয়েটি রেস্টুরেন্টে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল—
—কেন ভালবাস আমায়? আমি সুন্দরী, তাই?
—তোমার চেয়েও সুন্দরী আছে কত…
—আমার বাবার প্রচুর অর্থ—তাই?
—তোমার বাবার চেয়ে বড়োলোক এখানে কম আছে?
—তাহলে?
—ভালবাসি ভালবাসি। তার আবার কারণ হয় নাকি?
মেয়েটি বাড়ি ফিরে বন্ধুদের টেলিফোনে অনেক আলোচনা
করল। সবাই একবাক্যে বুঝিয়ে দিল—- ভালো যখন বাসে—তখন
একটা কিছু কারণ তো আছে বটেই। সেটা না বুঝে বেশি এগোস না।
বিজ্ঞাপন
৩রা জানুয়ারি মেয়েটি বললো :
—আমার কাছে কী চাও?
—কই, চাইনি তো কিছু।
—ভালোবাস অথচ চাওনা—তাহলে?
—না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
তেওয়াগিলে আসে হাতে…
—এতো গান।
—শুধুই গান?
—তা ছাড়া কী?… কিছুই যদি না চাও, তবে ভালোবাস কেন?
—ভালোবাসি, তাই ভালোবাসা দিতে চাই। চাইব কেন?
—তুমি সত্যিই অদ্ভূত!
১০ই ফেব্রুয়ারি দুজনের দেখা হল মেট্রো স্টেশনের পাতালে।
ছেলেটি বললো :
—আমি কাল সারারাত বাঁশি বাজিয়েছি। সারারাত সেই সুরের
মায়াবী আলোয় তুমি নাচছিলে। অসামান্য অনন্য সে নাচ।
—ধ্যাৎ। কাল সারারাত আমি ঘুমিয়েছি।
—আমি কিন্তু তোমার নাচই দেখে গেছি সারারাত।
—তোমার বাঁশি একদিন শুনতে হবে
১২ই মার্চ ছেলেটি বাঁশি বাজালো। মেয়েটি শুনলো। সময় থমকে রইল অনেকক্ষণ।
বাঁশি যখন থামল, মেয়েটির দুচোখ ভরা
জলে। বললো—
—বাঁশি শুনতে শুনতে আমার ঘুম এল আবেশে। আমি দেখলাম
আমি নাচছি। মেঘের মাঝখানে, তারাদের পাশে আমি নাচছি। আকাশে ফুলের
গন্ধ।
—ডাক্তার আমায় বাঁশি বাজাতে নিষেধ করেছেন।
—সেকি? কেন?
—বাঁশি আমায় টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নের মধ্যে। ডাক্তার বলেছে
স্বপ্ন দেখে আমার মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় জট
পাকিয়ে যাচ্ছে।
—তাহলে?
—ভাবছি।
১৬ই এপ্রিল মেয়েটি বললো :
— আমার বন্ধুরা বলেছে— তুমি খুউব ভালো। অসাধারণ, কিন্তু তুমি
সৃষ্টি ছাড়া। তোমার স্বপ্ন সব অর্থহীন।
—আমি জানি।
স্বপ্ন-টপ্ন ছেড়ে দিতে পারো না তুমি?
—-না।
—তাহলে… তুমি তো আমাকে হারাবে।
—তোমায় পাইনি তো কখনও!
৫ই মে ছেলেটির মস্তিষ্কে অপারেশন হল। একটু সুস্থ হতে মেয়েটি
এসে বললো :
—ভাল আছ তো? এখন আর স্বপ্ন দেখছ না তো?
—দেখছি। আরও সুন্দর সব স্বপ্ন।
—তাহলে তো দেখছি operationটা আদৌ সফল হয়নি!
বাড়ি ফিরে বন্ধুদের ফোন করল মেয়েটি।
বন্ধুরা একবাক্যে বলল : বাঁশি বাজানো, স্বপ্ন দেখা, সবই backdated
সৃষ্টিছাড়া। তুই আর লোক পেলি না? তুই এত রূপসী।
তোর এত উজ্জ্বল prosppect। ভালো যদি চাস তাহলো শিগগির
বিয়ে করে ফেল তোর দাদার সেই বন্ধুকে—। উনিতো শুনলাম
কানাডাতেই settle করবেন।
৭ই জুলাই মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো : —
—তুমি সত্যিই কী চাও বলতো?
—তুমি আরও সার্থক, আরও সুন্দর হয়ে ওঠো।
—ব্যাস! আর কিছু না
—আর! চাই স্বপ্ন দেখতে।
—ও : স্বপ্ন তাহলে তুমি ছাড়তে পারবে না?
—না।
—তাহলে থাকো তুমি স্বপ্ন নিয়ে।
১২ই আগস্ট গোলাপ গাছে ফুল ফুটলো অনেক। সেদিন দুপুরে
ছেলেটির মস্তিষ্কে আবার অপারেশন হল।
১৩ই সেপ্টেম্বর ছেলেটি মারা গেল।
১৪ই সেপ্টেম্বর মেয়েটির শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হল কানাডাগামী
সেই পাত্রের সঙ্গে।
২০শে সেপ্টেম্বর গোলাপ গাছটি হঠাৎ ঝড়ে উপড়ে গেল।
সেদিন সন্ধ্যার বিমানে মেয়েটি হানিমুনে গেল—।
যাবার আগে বন্ধুদের বলে গেল। স্বপ্নের চেয়ে বাস্তব অনেক ভাল।
অনেক মধুর। স্বপ্ন দেখে কেবল বোকারা।
৪ঠা অক্টোবর ছেলেটির মা ঝরে পড়া গোলাপ গাছটিকে
সযত্নে তুলে ফেলে দিলেন।
শূন্য টবে তখন কয়েকটা পোকা, কয়েকটা মাছি।
আমরা কেউ জানিনা
ওগুলো পোকা-মাছি-না কি
ছেলেটির স্বপ্ন।
আমরা ঠিক জানিনা।
আমরা কেউই জানিনা।

 

 









আমিই সেই মেয়ে – শুভ দাশগুপ্ত

আমিই সেই মেয়ে।
বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন
যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি
আপনি রোজ দেখেন।
আর
আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন।
স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন।
আমিই সেই মেয়ে।
বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের আলোয় যার ছায়া মাড়ানো
আপনার ধর্মে নিষিদ্ধ, আর রাতের গভীরে যাকে বস্তি থেকে
তুলে আনতে পাইক বরকন্দাজ পাঠান আপনি
আর সুসজ্জিত বিছানায় যার জন্য অপেক্ষায় অধীন হয়
আপনার রাজকীয় লাম্পট্য
আমিই সেই মেয়ে।
আমিই সেই মেয়ে- আসামের চাবাগানে ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে
যাকে আপনি নিয়ে যেতে চান সাহেবি বাংলোয় মধ্যরাতে
ফায়ার প্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় মদির চোখে দেখতে চান
যার অনাবৃত শরীর
আমি সেই মেয়ে।
রাজস্থানের শুকনো উঠোন থেকে পিপাসার জল আনতে যাকে আপনি
পাঠিয়ে দেন দশ মাইল দূরে সরকারি ইঁদারায়- আর কুড়ি মাইল

হেঁটে কান্ত বিধ্বস্ত যে রমণী ঘড়া কাঁখে ঘরে ফিরলেই যাকে বসিয়ে দেন
চুলার আগুনের সামনে আপনার রুটি বানাতে
আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- যাকে নিয়ে আপনি মগ্ন হতে চান গঙ্গার ধারে কিংবা
ভিক্টোরিয়ার সবুজে কিংবা সিনেমা হলের নীল অন্ধকারে, যার
চোখে আপনি একে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া
সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো
গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে-
কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা
আমিই সেই মেয়ে।
আমিই সেই মেয়ে- এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার
আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান
আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে
বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে। আত্মজকে।
আমিই সেই মেয়ে।
সংসারে অসময়ের আমিই ভরসা।
আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়।
আমার বাড়তি রোজগারে ভাইয়ের বই কেনা হয়।
আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
কালো আকাশ মাথায় নিয়ে
আমি ছাতা হয়ে থাকি।
ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।
আপনি
আপনারা
আমার জন্য অনেক করেছেন।
সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে
মা বলে পুজো করেছেন।
প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন- আর
শহর গঞ্জের কানাগলিতে
ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন।
হ্যা, আমিই সেই মেয়ে।
একদিন হয়ত
হয়ত একদিন- হয়ত অন্য কোন এক দিন
আমার সমস্ত মিথ্যে পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে
আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা !
খোলা চুল মেঘের মত ঢাকবে আমার খোলা পিঠ।
দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন।
কপাল-ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি।
হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ।
দুপায়ের নুপুরে বেজে উঠবে রণদুন্দভি।
নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ।
দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন
মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং।
বীভৎস দাবানলের মত
আমি এগোতে থাকবো ! আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে
মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে-
সভ্যতার দেহ
প্রগতির দেহ-
উন্নতির দেহ-
সমাজের দেহ
হয়ত আমিই সেই মেয়ে ! হয়ত ! হয়ত বা।

 

 









জন্মদিন – শুভ দাশগুপ্ত


আজ পয়লা শ্রাবণ।
খোকন, আজ তোর জন্মদিন।
তুই যখন জন্মেছিলি, আমরা তখন যাদবপুরে
নতুন গড়ে ওঠা কলোনীর টালির ঘরে
তোর ইস্কুল মাস্টার বাবা
সেই হ্যারিকেনের আলো জ্বলা ঘরেই
আনন্দে আর খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছিলেন
তুই আসার পর। তোর নাম রেখেছিলেন- সুকল্যাণ।
মানুষটার মনটা ছিল শিশুর মতন
অভাবে অনটনে, বেঁচে থাকার নানা দুর্বিপাকেও
ভেঙ্গে পড়তেন না কখনও। সকলের ভাল চাইতেন মন থেকে।
বলতেন দেখো একদিন এই দেশের মানুষ
ঠিক খুঁজে পাবে মুক্তির পথ। শোষণ থেকে মুক্তি
দারিদ্র থেকে মুক্তি অশিক্ষা থেকে মুক্তি…
আজ পয়লা শ্রাবণ
খোকন, আজ তোর জন্মদিন।
ছোটবেলায়, তোর মনে আছে? আমাদের ভাঙ্গা মেঝেতে
বাক্স থেকে বার করা মেজো-মাসীর হাতে তৈরি আসনটা
পেতে দিতাম। সামনে রাখতাম ঠাকুরের আসনের প্রদীপখানা।
তুই বসতিস বাবু হয়ে চুপটি করে।
তোকে আমরা একে একে ধান দুব্বো মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ করতাম।
বাবা বলতেন বড় হও মানুষ হও।
তোর বাবার সেই বন্ধু-ঘোষ কাকা তিনি বলতেন
বেঁচে বর্তে থাকো।
তুই জিগ্যেস করতিস-মা, বর্তে মানে কি মা?
আমি শুধু তোর মাথায় ধান-দুব্বোই দিতাম।
বলতাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বলতাম
ঠাকুর, আমার খোকনকে মস্ত বড় মানুষ করে তোলো
আমার খোকন যেন সত্যিই মানুষ হয়।
ওর যেন কখনো কোনো বিপদ না হয় ঠাকুর।
অভাবের সংসারে ওই একটা দিন-পয়লা শ্রাবণ
কষ্টের পয়সায় একটু বাড়তি দুধ নিতাম।
পায়েস রান্না করে দিতাম তোকে।
তুই খুব ভালবাসতিস পায়েস খেতে।
তোর বাবা বাসস্টান্ডের দোকান থেকে নিয়ে আসতেন
তোর প্রিয় মিষ্টি ছানার গজা।
সামান্য ইস্কুল মাস্টারিতে কীই বা আয় হত;
ঘরে বসে ছাত্র পড়িয়ে আসতো কিছু।
দাউ দাউ অভাবের আগুনে সে রসদ পুড়তে সময় লাগত না।
তোর বাবার জামা সেলাই করতাম আর বার বার বলতাম
আসছে মাসে একটা জামা বানিয়ে নিও।
উনি হেসে উঠে বলতেন; বাদ দাও তো, খোকন বড় হচ্ছে।
ওর জন্য ভাবছি দুধ রাখতে হবে আরো আধসের-
দুধে শক্তি বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। শক্তি আরে বুদ্ধি না হলে
তোমার খোকন মস্ত বড় মানুষ হয়ে উঠবে কি করে?
ভাবছি আরো দুটো টিউশনি নেব।
ছাত্র পড়িয়ে পড়িয়ে মানুষটা দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যেতেন।
বারান্দার ধার ঘেঁষে যখন রাতের অন্ধকারে জোনাকির ব্যস্ততা,
আর ঘরে তোর পড়া মুখস্থ করার একটানা সুর
আমাদের কলোনীর ভাঙ্গাচূড়া বাড়িটাকে জীবন্ত করে রাখতো-
তখন বলতেন আমায়; খাওয়া দাওয়া একটু করো- তোমার চেহারাটা
বড় ভেঙ্গে পড়ছে দিন দিন… শাড়িটাও তো দেখছি বেশ ছিঁড়েছে-
কালই আমি ফেরার পথে একটা শাড়ি নিয়ে আসব। ধারেই আনব।
আমি বলতাম-ধুর। সামনে খোকনের উঁচু ক্লাস-
কত বই পত্তর কিনতে হবে- কত খরচ।
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যেতেন।
জোনাকিরা নিঃশব্দ অদৃশ্য আলোর আলপনা আঁকত
উঠনের আগাছার ঝোপে।
আবহ সঙ্গীতের মত তুই ভেতরে বসে বসে পড়া মুখস্থ করতিস।
ইতিহাস, ভূগোল, গ্রামার।
ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করেননি।
তুই কত বড় হলি।
সব পরীক্ষায় কত ভাল ফল হল তোর।
বাবা বললেন; আরও পড়। উচ্চ শিখাই উচ্চ সম্মানের
এক মাত্র পথ। তুই আরও পড়লি।
তারপর…
তোর চাকরি হল কত বড় অফিসে
মনে আছে খোকা? প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়েই
তুই কত কী কিনে এনেছিলি?
তখন তো আমরা উঠে এসেছি শ্যামবাজারে।
দু’কামরার বেশ সাজানো ঘোচানো গোছানো বড় ফ্লাট।
তোর অফিস থেকেই তো দিয়েছিল।
সেই বাড়ি সেই ঘর সেই বেলকনি- কত স্মৃতি- কত ছবি!
ঐ বাড়িতেই তো
আশ্বিনের ঝড়ো বিকেলে- তোর মনে আছে খোকন?
তোর বাবা যেদিনটাতে চলে গেলেন- মনে আছে?
তুই বাবার বুকের ওপর পড়ে যখন কাঁদছিলি হাপুস নয়নে
সদ্য স্বামীহারা, আমি সেদিন তোর সেই অসহায় মুখ দেখে
আরো বেশি করে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।
তোকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম ছোটবেলার মত।
বলেছিলাম-
কাঁদিস না খোকা। আমিতো আছি।
আজ পয়লা শ্রাবণ
কলকাতা থেকে অনেক দুরে মফস্বলের এই বৃদ্ধাশ্রমে
আমি একেবারে একা, খোকন।
তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে।
তোকে, বৌমাকে আর ছোট্ট বিল্টুকে।
তোরা এখন কত দুরে-
সল্ট-লেকের মার্বেল বসানো ঝকঝকে বাড়িতে।
আজ তোর জন্মদিনের নিশ্চয়ই খুব বড় পার্টি হচ্ছে-
তাই নারে খোকন? লোকজন, হৈচৈ, খাওয়া-দাওয়া।
খুব ভাল, খুব ভাল।
খোকন, আজ পয়লা শ্রাবণ
আমার বড় মনে পড়ছে যাদবপুরের ভাঙ্গা ঘরে রাত্রে
তুই আমার পাশে শুয়ে মাঝে মধ্যে হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে
জড়িয়ে ধরতিস আমাকে। আমি বলতাম, ভয় কী রে?
আমি তো আছি। মা তো আছে খোকনের। যার মা থাকে
তাকে কী ভুতে ধরে?
তুই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তিস আমার বুক জুড়ে।
তোর আধুনিক সংসারে
এই বুড়িটার একটু ঠাই হল নারে?
প্রতিমাও তো মা। ওরও তো আছে আমার খোকনেরই মত
কোল আলো- করা এক চাঁদের টুকরো।
কিন্তু সময়ের কী আশ্চর্য পরিবর্তন!
খোকন!
তুই বোধহয় আর এখন পায়েস খাস না- তাই নারে?
তুই জানিস না খোকন
আজ আমি সকালে পায়েস রান্না করেছি। হ্যাঁ
তোরই পাঠানো টাকায়।
সারাদিন সেই পায়েসের বাটি সামনে নিয়ে বসে আছি রে।
এখানে এই বৃদ্ধাশ্রমে
আমার একলা ঘরে
আর কেউ নেই।
তুই একবার আসবি খোকন।
একবার.. শুধু
একবার।

 

 

 









ট্রেন – শুভ দাশগুপ্ত

চার বুড়ো মানুষ
রোজ বিকেলে আগরপাড়া স্টেশনের
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে
অলস বসে থাকে, গল্প করে,
একদিন যখন বয়স কম ছিল, কাজ ছিল
তখনকার গল্প, স্মৃতি।
ট্রেন আসে, ট্রেন যায়
ভিড় ঠাসা ট্রেন হাজার মানুষ বুকে নিয়ে
চলে যায় রাণাঘাট, শান্তিপুর, নৈহাটি, কৃষ্ণনগর॥
প্রথম বুড়ো ভাবেঃ
একদিন বয়স ছিল। রোজ সকালে ধরতাম
আটটা বিয়াল্লিশ। ট্রেনের কামরায়
ডেলি প্যাসেঞ্জারির আড্ডা। তাস, রাজনীতি
মাঝে মধ্যে সদলে বিয়ে বাড়ি অথবা পিকনিক
আজো আটটা বিয়াল্লিশ আসে যায়।
আমারই নাম নেই আর॥
দ্রিতীয় বুড়ো ভাবেঃ
পূজোর সময় তখন কেমন যেতুম প্রতি বছর বেড়াতে।
বউ বাচ্চা নিয়ে পুরী, জয়পুর, আগ্রা, মথুরা।
কতকাল আর যাইনা কোথাও। যাওয়া হয় না॥
তৃতীয় বুড়ো ভাবেঃ
ভালই আছি। ছেলে আর ছেলের বউ যত্ন-আত্তি করে।
তবু ছেলের মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ালেই মনে পড়ে
বড়দিনের সময় বেশ কবার নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে
কলকাতার সাহেবপাড়ায়। ট্যাক্সি করে ঘুরিয়েছিলাম
পার্ক স্ট্রিট। চৌরঙ্গী—
কতকাল কলকাতা দেখি না। বাতের ব্যথাটাো বেড়েছে॥

চতুর্থ বুড়ো ভাবেঃ
কয়লার ইঞ্জিন ছিল। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ
রাখলে চোখে কয়লার গুঁড়ো ঢুকত। তবে, ভারি
সুন্দর ছিল সেই আওয়াজ—ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক
কোথায় যে গেল সেই সব দিন॥
চার বুড়ো বিকেলের নিভে আসা আলোর নীচে
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে
প্রতিদিন ভাবে—
প্রতিদিন ট্রেন যায়, ট্রেন আসে॥
কাল দেখলাম তিন বুড়ো
সত্যিকারের ট্রেন এক বুড়োকে নিয়ে গেছে
অচেনা
ইস্টিশানের দিকে।
তিন বুড়োর কানে বাজছে
ঝিক ঝিক…







বাঁশি
শুভ দাসগুপ্ত 


আমার কলেজের বন্ধু সত্য দারুন বাঁশি বাজাতো।
উত্তাল সেই সত্তরের কোনো এক বৃস্টি ধোঁয়া সন্ধ্যায়
সত্য খুন হলো।
বাঁশি বাজানোর সাথে সত্য রাজনীতিও করতো।
আমি কিছু করতাম না।
পারতামও না।
শুধু মন দিয়ে পড়াশুনা করতাম।
সত্য বাঁশি বাজাতে পারতো।
অদ্ভুত স্বপ্নের মতো সুর সোনাতো আমাদের।
ওর বাঁশি আমাকে খুব টানতো।
সেই সত্য খুন হয়ে গেলো।
খবর পেয়েও গলাকাটা সত্যর
লাস আমি দেখতে যাইনি,
যেতে পারিনি।
কিন্তু তারপর থেকে ঘুম-ভেঙে যাওয়া
কত রাতে যে আমি সত্যর বাঁশি শুনতে পেয়েছি !
সত্য বলতো মামা কাকা না থাকলে
এদেশে চাকরি হয় না।
সব সালা খালি স্বজনপোষন........
কলেজ জীবন শেষ হবার পর মামার দৌলতে
আমি একটা ভালো চাকরি পেয়ে গেলাম।
যথা সময়ে আমার বিয়ে হলো।
বন্ধুরা বরযাত্রী হয়ে সঙ্গে গেল।
খুব হৈ-চৈ আনন্দ হল।
বৌভাতের দিন সাদা শাড়ী পরে সুপর্ণা এসেছিলো।
শীতের সেই সন্ধ্যায় ওর গায়ে
শাল বা কার্ডিগান ছিলোনা।
কাঁধে ছিল।
ঝোলা ব্যাগ-এক সময় যা সত্যর
চওড়া কাঁধে ঝুলতো।
এখন আমি ভালো চাকরিতে
আরও ভালো পদে আসীন।
নিজের বাড়ি হয়েছে।
গাড়িও কিনেছি।
সত্যর রাজনীতির বন্ধু যারা
তাদের অনেকেও পরে দেখেছি
দিব্বি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তাদের পতাকার রং লেগেছে তাদের গালে।
আজকাল আমি কবিতাটা বেশ লিখি।
লোকে বেশ প্রসংশা করে।
বই-টইও চাপা হচ্ছে।
নাম ডাকও হয়েছে।
আমি এখন ঐ যাকে বলে প্রায় সেলিব্রেটি আর কি !
আমার বউয়ের গয়না আর শাড়ির উজ্জ্বলতা
ঐ যাকে বলে পড়শীর ঈর্ষা-ওনার্স প্রাইড
আমার ছেলে নামী ইংরাজী স্কুলে পড়ে।
উজ্জ্বল ছাত্র।
ওর মায়ের ইচ্ছে ওকে বিদেশে পাঠাবো
উচ্চ শিক্ষার জন্য !
একদিন তখন শ্রাবন মাস।
সারা দুপুর একটানা বৃস্টি হয়েছে।
সেদিন ছুটি ছিল।
বিছানায় শুয়ে ঘুম এসে যাচ্ছিলো।
সেই আধো ঘুমে আমি সত্যকে দেখতে পেলাম।
দেখলাম ভীষণ বৃস্টি পড়ছে।
ঝাপসা হয়ে গেছে চারিদিক।
সেই ভীষণ চেনা বহুবার সোনা
স্বপ্নের মতো একটা সুর।
বৃস্টিতে সত্য ভিজে যাচ্ছে।
তবু সে বাঁশি বাজিয়েই যাচ্ছে।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা দারুন জোরে শব্দ হল।
দেখলাম একটা লোক খুব কাছে এসে
সত্যকে গুলি করল।
সত্যর বুকটা ফুটো হয়ে গল গল করে
রক্ত ঝরতে লাগল,
সত্য কিন্তু হাসছিলো।
আর বাঁশিও বাজ্জাছিল......
বৃস্টির শব্দকে ছাপিয়ে সত্যর বাঁশি
রক্তের প্রচন্ড স্রোতকে ছাপিয়ে সত্যর বাঁশি....
আমার ঘুম ভেঙে গেল।
কিন্তু কী আশ্চার্য কে বাঁশি বাজাচ্ছে !
ঐ তো, স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
কে ? কে ? কে বাজাচ্ছে বাঁশি ?
আমি চিৎকার করে উঠলাম।
ছুটে এসে ঘরে ঢুকলো আমার স্ত্রী।
-একি ?
অমন চ্যাঁচাচ্ছ কেন ?
কে বাজালো বাঁশি ?
-কে আবার আমাদের বুবান।
-বুবান ?
আমাদের ছেলে ?
আমার মাথায় হঠাৎ রক্ত চড়ে গেল।
বললাম , না বাঁশি বাজাবে না ওকে বারণ করো।
ওকে বারণ করো......
বলতে বলতে আমি কেমন ক্ষেপে উঠলাম।
তখন বুবান এসে সামনে দাঁড়িয়েছে।
ওর হাতে বাঁশি।
অবাক হয়ে ও আমায় দেখছে।
আমি ঝড়ঝড় করে কেঁদে ফেললাম।
ছেলের হাত দুটো ধরে বললাম,
" না বাবা বাঁশি বাজাসনা "
তুই সেতার শেখ সরোদ শেখ।
বাঁশি নয়।
বাঁশি বাজালে এ দেশে তার গলা কেটে নেয়া হয়।
বলতে বলতে আমার গলার স্বর কান্নায় বুজে এলো।
আমার একমাত্র সন্তান অবাক হয়ে আমার দিকে
চেয়ে রইল তার চোখে সংখ্যাহীন প্রশ্ন....।




মেঘ বললো

 শুভ দাসগুপ্ত 

মেঘ বললো যাবি?
অনেক দূরের গেরুয়া নদী
অনেক দূরের একলা পাহাড়
অনেক দূরের গহন সে বন
গেলেই দেখতে পাবি।
যাবি?
জানলা দিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে
বললো সে মেঘ—যাবি?
আমার সঙ্গে যাবি?
দিন ফুরিয়ে রাত ঘনাবে
রাত্রি গিয়ে সকাল হবে
নীল আকাশে উড়বে পাখি
গেলেই দেখতে পাবি।
যাবি?
শ্রাবণ মাসের একলা দুপুর
মেঘ বললো যাবি।
আমার সঙ্গে যাবি?

কেমন করে যাবো রে মেঘ, কেমন করে যাবো?
নিয়ম বাঁধা জীবন আমার
নিয়ম ঘেরা এধার ওধার
কেমন করে নিয়ম ভেঙে এ-জীবন হারাবো?
কেমন করে যাব রে মেঘ কেমন করে যাবো?

মেঘ বললো—দূরের মাঠে বৃষ্টি হয়ে ঝরবো।
সবুজ পাতায় পাতায় ভালবাসা হয়ে ঝরবো।
শান্ত নদীর বুকে আনবো জলোচ্ছ্বাসের প্রেম
ইচ্ছে মতন বৃষ্টি হয়ে ভাঙব, ভেঙে পড়বো,
এই মেয়ে তুই যাবি?
আমার সঙ্গে যাবি?

যাব না মেঘ পারবো না রে যেতে—
আমার আছে কাজের বাঁধন—কাজেই থাকি মেতে।
কেবল যখন ঘুমিয়ে পড়ি—
তখন আমি যাই।—সীমার বাঁধন ডিঙিয়ে দৌড়ে
একছুটে পালাই।—তখন আমি যাই,
স্বপ্নে আমার সুনীল আকাশ
স্বপ্নে আমার দূরের পাহাড়
সব কিছুকে পাই
জাগরণের এই যে
আমি—ক্রীতদাসের মতন
জাগরণের এই যে আমি
এবং আমার জীবন
কাজ অকাজের সুতোয় বোনা
মুখোশ ঘেরা জীবন।

তবু রে মেঘ যাবো
একদিন ঠিক তোরই সঙ্গে
শ্রাবণ হাওয়ায় নতুন রঙ্গে
যাবো রে মেঘ যাবো।
সেদিন আমিই শিমুল পলাশ—
ভিজবে বলে যাবো।
পাগল হাওয়ায় উতল ধারায়
আমায় খুঁজে পাবো।
যাবো রে মেঘ যাবো।
যাবো রে মেঘ যাবো।



ছুটি

শুভ দাসগুপ্ত 

কিছু একটা করেন স্যার আজ চারদিন হয়ে
গেল আমার ছোট্ট মেয়েটা ঐ নোংরা
বারান্দায় পড়ে আছে ।
জুতার দোকানের সামান্য মাইনের কর্মাচারী নিকুঞ্জ ।
তার আদরের মেয়ে মা মনির কঠিন অসুখ ।
ডায়ালিসিস করতে হবে । পাড়ার এম এল এ
দয়ালু হাতে চিঠি দিয়েছেন মন্ত্রীর সি এ কে ।
তিনি চিরকুট পাঠিয়েছেন আরেক আমলাকে ।
আমলা নোট পাঠিয়েছেন হাসপাতালের সুপারকে।
কিন্তু গত কদিনে নিকুঞ্জের সমস্ত উদ্বেগ আর উৎকন্ঠাকে তুচ্ছ করে
সে নোট পৌছায়নি হাসপাতালে। নোট গেলে বিনা খরচে
মা মনির ডায়ালিসিস করা হবে ।
গরিব নিকুঞ্জ সারাদিন দোকানে
মানুষের পায়ে জুতা পড়ায় ।
অন্য মনস্ক কাজে ভুল হয়ে যায় বারবার
মালিক ধমক লাগায় , এক একটা নধর পায়ে জুতা পরাতে পরাতে
নিকুঞ্জের ইচ্ছা হয় ,পয়সাওয়ালা খদ্দেরের পা দুটো চেপে ধরে বলেঃ
-স্যার,আমার একমাত্র মেয়ে পয়সার অভাবে
হাসপাতালের নোংরা বারান্দায় একা পড়ে রয়েছে ।
তার চিকিৎসা হচ্ছে না । দিন না স্যার কয়েক হাজার টাকা ।
আমি সারা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকবো।
দুটোর সময় ছুটি নিয়ে কলকাতার ডাকসাইটে জ্যাম ডিঙ্গিয়ে
অসংখ্য মানুষের ভীড় এড়িয়ে নিকুঞ্জ
রাইটার্সের পৌঁছায় হাঁফাতে হাফাঁতে ।
কেরানী বাবুর টেবিলের সামনে দাঁড়ায় চোরের মত
বাবুর্টি বললেন
-আজ আর হবে না দাদা,
– কেন ?
-জানেন না ? নাগাল্যন্ডের পশুমন্ত্রীর মৃত্যুতে
আজ আমাদের হাফ ছুটি ঘোষনা করা হয়েছে ।
-ও তাহলে কাল ?
-কালও হবে না । কাগজ পড়েন না নাকি ?
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে কাল পুর্ন দিবস ছুটি ।
– তাহলে পরশু ? নিকুঞ্জ ব্যস্ত হয়ে উঠে ।
– পরশু শনিবার, তারপর রবিবার ,আপনি একবারে সোমবার আসুন ।
সোমবার মানে আরও চারটি দিন বাকি ?
তলিয়ে যেতে থাকে নিকুঞ্জ ।
যেতে যেতে তার কানে বারবার ভেসে আছে মা মনির কন্ঠস্বরঃ
বাবা আমার কবে ছুটি হবে ?
আমি কবে বাড়ি যাবো বাবা ?
হঠাৎ নিকুঞ্জর মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠে,
দুর্বল অভুক্ত শীর্ন শরীরে হঠাৎই যেন জ্বলে উঠে ভয়ংকর তেজ ।
রাইটার্সের বারান্দা দিয়ে ছুটতে থাকে নিকুঞ্জ ।
আর ছুটতে ছুটতে সোজা গিয়ে নিকুঞ্জ ডুকে
ডালহাউসী পাড়ার প্রাচীন এক বন্দুকের দোকানে ।
আগুন জ্বলছে তখন নিকুঞ্জুর মাথায় । ধুমকেতুর মত
নিকুঞ্জ চিৎকার করে বলতে থাকে
-আমাকে একটা বন্দুক দিন,আমাকে একটা বন্দুক দিন ,
যা থেকে হাজার হাজার গুলি বের হবে ।
আমি সমস্ত নেতা,প্রাক্তন মন্ত্রী, কর্তাদের গুলি করে মেরে ফেলব
তারপর, সারাদেশে একদিনই রাষ্ট্রীয় শোক,একদিনই ছুটি ।
আর তারপর আমার মা-মনির ডায়ালিসিস।
দোকানের দারোয়ান ঘাড় ধরে নিকুঞ্জকে বের করে দেয়।
নিকুঞ্জ ছুটতে ছুটতে হাফাঁতে হাফাঁতে হাসপাতাল ।
হঠাৎ ঝপ করে লোডশেডিং এর মত নিকুঞ্জ’র চোখের সামনে
সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায় ।মা-মনির বিছানাটা খালি ।
মা- মনি কোথায় ? কোথায় আমার মা-মনি ?
অনেক রাতে….
ভাড়া করা ম্যাটাডোরে একটা খাটিয়ায় মা-মনি কে শুইয়ে
দূর মফস্বলের বাড়ীর পথ ধরে নিকুঞ্জ ।
সারাটা রাস্তা পুর্নিমার চাঁদ আলো ধরলো মা-মনির মুখে ।
এক আকাশ নক্ষত্র আর তারা আলো বিছিয়ে রাখলো
মা-মনির ঘরে ফেরার পথে ।
আর নিকুঞ্জ শুনতে পেল নক্ষত্র চাঁদ তারা সবাই বলছে
আমাদের ছুটি নেই নিকুঞ্জ,আমরা আলো জ্বেলে রেখেছি
তোমার মা-মনির জন্য আমরা আলো জ্বেলে রেখেছি ।
ভোরের আলো তখন সবে ফুটছে ।
ম্যাটাডোর ভ্যান এসে থামলো নিকুঞ্জ’র
ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায় । নিকুঞ্জ’র বউ পাগলের মত ছুটে এল
-এনেছো ? আমার মেয়েকে এনেছো ?
পাথর হয়ে যাওয়া নিকুঞ্জ তুমুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে
আর বার বার বলতে লাগল
-“তোমার মা-মনির ছুটি হয়ে গেছে ”
“তোমার মা-মনির ছুটি হয়ে গেছে ”






ভারতে স্বাধীনতার ৬১

শুভ দাসগুপ্ত 

সার্থক জন্ম
যে ছেলেটা চায়ের দোকানের এঁটো কাপ ধুচ্ছে রাস্তার ধারে, তাকে ডাকুন ।
তার কানে কানে বলুন সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং
হ্যাঁ, বেশ সুন্দর করে বলুন,যে মেয়েটা চাকরির নাম করে
বনগাঁ কিংবা চাকদা থেকে রোজ সকালের ট্রেনে সেজেগুজে
শহরে আসছে, শরীর বেচে চাল, ডাল, নুন কিনতে, তাকে ডাকুন,
তার কানে কানে সুরেলা কন্ঠে বলুন, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
যে ছেলেটি লটারির টিকিট নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরছে আর বলছে
বিশ্বাস করুন, আমি ভদ্রলোক, আজ ১০ বছর হল আমার
কারখানা বন্ধ, লক-আউট, তাকে ডাকুন, তার কানে কানে
বলুন, বল বল বল সবে শতবীণা বেণুরবে ভারত আবার
জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ।
রাতের আকাশ-কাঁপিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে, যে মা
আজও লন্ঠন হাতে টালির ঘরের দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন
তাঁর খোকন ফিরে আসবে বলে । যে খোকনকে এমনই
এক বর্ষায় উন্মত্ত রাতে কালো গাড়ির পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল
আর বরানগরের রাস্তায় ভোরের ঘুম-ভাঙা
কুকুর প্রথম দেখেছিল যার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ,
সেই মাকে ডাকুন, তাঁর কানে কানে বলুন,
হাম বুলবুলি হ্যায় ইসকি ইয়ে গুলিস্তা হামারা, সারে যাঁহা……হামারা ।
সবাইকে সব বলা শেষ হলে, সুনসান শীতের রাতে
পাঁচমাথার মোড়ে ঘোড়ায় চড়ে বসা সেই মহাবিপ্লবীর
পায়ের সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান
ফাঁকা রাস্তায় রাতের বাতাসে কান পাতুন
শুনতে পাবেন সেই বিপ্লবী পুরুষের বজ্রকণ্ঠ
আমি তোমাদের কাছে রক্ত চেয়েছিলাম
তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব বলে, আমি পারিনি
কিন্তু আমি আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছি ।
আর তোমরা ? — তোমরা ??






আঁচল
-- শুভ দাশগুপ্ত
আমি তার মন চেয়েছিলাম।
সে তার মন সতেরো টুকরো করে সতেরো জায়গায়
ছড়িয়ে রেখেছিল।
বললঃ সবগুলো টুকরো গুছিয়ে নিয়ে আঁচল বেঁধে
একদিন দেব তোমায়- অপেক্ষা কোরো।
আমি অপেক্ষা করেছিলাম।
বৈশাখের ঝড় গেল- সে বললো ঝোড়ো হাওয়ায়
কিছুতেই গুছোতে পারছিনা টুকরোগুলো - ধৈর্য ধরো।
শ্রাবণে সে বললো আবার
বড় বৃষ্টি হচ্ছে- এত ঝড়জলে পৌঁছতেই পারছি না
সব টুকরোগুলোর কাছে- তুমি আরও অপেক্ষা করো।
শিউলি ঝরা এক শারদ ভোরে
আমি অপলক তার মুখের দিকে চেয়েছিলাম।
সে আমার চোখের ভাষায় কিছু হয়ত বুঝলো-
বললো
একটা টুকরোকে ধরি তো অন্যটা পালায়-
আমি আর পেরে উটছি না।
এরপর অনেকদিন আমি অসুস্থ ছিলাম। দেখা হয়নি।
অঘ্রাণের শীতে আমার জন্মদিনের রোগশয্যায় সে এল।
বললো-
রাগ কোরোনা- টুকরোগুলো বাড়তে বাড়তে এখন প্রায়
একান্নটার মত হয়েছে। এত টুকরো আমার আঁচলে ধরবেনা
তাই-
তুমি বরং আমার একটি চুম্বন নাও।
আমি জানি তুমি এতে খুশি হবে।
আমি বরাবরের মত নরম স্বরে তাকে
বলেছিলাম
আমি তোমার মন চেয়েছিলাম।... তুমি যাও।
আর কখনো এসোনা এখানে।
সে আর আসেনি।
কাল কাগজে তার সাক্ষাৎকার পড়লাম-
প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছে
অনেক ঝড় ঝাপটায় তার মনের টুকরোগুলো
উড়ে পুড়ে ধুয়ে মুছে গেছে
একটা ছোট্ট টুকরো এখন আছে তার কাছে।
কিন্তু তার আঁচল ছিঁড়ে গেছে।




শারদীয়া – কবিতা
শুভ দাশগুপ্ত (কবি)
গেরুয়া নদীর পাড় ঘেষে সেই ছোট্ট আমার গ্রাম
ছেলেবেলার ছেলেখেলার সেই আনন্দধাম।
আকাশ ছিল সুনীল উদার রোদ্দুরে টান টান,
গেরুয়া নদীর পাড় ঘেষে সেই ছোট্ট আমার গ্রাম
গেরুয়া নদীর পাড় ঘেষে সেই গ্রামের শেষ পাড়া,
নবীন কাকার কুমোর বাড়ি, ঠাকুর হত গড়া।
সাত পাড়াতে বেজায় খ্যাতি, নবীন তালেবর,
নবীন কাকার হাতের ঠাকুর অপূর্ব সুন্দর।
এক এক বছর এক এক রকম ঠাকুর তৈরি হতো,
সেসব ঠাকুর দেখতে মানুষ বেজায় ভিড় জমাতো।
স্কুল পালানো দুপুর ছিলো, ছিলো সঙ্গী সাথী,
চোখ জুড়ানো মূর্তি দেখতে ভীষণ মাতামাতি।
শারদীয়ার দিন গড়াতো শিউলি গন্ধে দুলে,
রোজই যেতাম ঠাকুর গড়া দেখতে সদলবলে।
নবীন কাকা গরিব মানুষ, সদাই হাসিমুখে,
নিবিষ্ট মন, ব্যস্ত জীবন, আপন ভোলা সুখে।
হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হতো লক্ষ্মী, গণেশ, পেঁচা,
দূর গাঁয়ে তার ছোট্ট বাড়ি, ঠাকুর গড়েই বাঁচা।
সে বছর কি হলো বলি, শোনো দিয়ে মন,
বন্যা হলো ভীষণরকম ভাসলো যে জীবন।
কত মানুষ ঘর হারালো, প্রাণ হারালো কত,
গোটা গ্রামের বুকটি জুড়ে হাজার আঘাত ক্ষত।
ধানের জমি পাটের ক্ষেতে জল থৈ থৈ বান,
সর্বনাশের কান্না ঘেরা হাজার নিঃস্ব প্রাণ।
বর্ষা শেষে বন্যা গেল, জাগলো শারদ আলো,
নীল আকাশে পুজোর ছুটি দিব্যি ডাক পাঠালো।
কাশফুলেরা উঠল দুলে, শিউলি ঝরা দিন,
পুজো আসছে রোদ্দুরে তাই বাজলো খুশির বীণ।
নবীন কাকার টালির ঘরে হচ্ছে ঠাকুর গড়া,
গেরুয়া নদীর পাড় ঘেঁষে গ্রাম জাগলো খুশির সাড়া।
আমরা যত কচিকাঁচা, আবার জড়ো হয়ে,
ঠাকুর দেখতে গেলাম ছুটে মাঠ ঘাট পেরিয়ে।
সেবার মাত্র গুটিকয়েক ঠাকুর টালির ঘরে,
পুজোর আয়োজন তো সেবার নমোনমো করে।
তারই মধ্যে একটি ঠাকুর টালির চালের কোনে,
নবীন কাকা ভাঙেন, গড়েন নিত্য আপন মনে।
অন্য ঠাকুর দেখতে চাইলে বাধা দিতেন না,
ওই ঠাকুরটি দেখতে চাইলে না শুধু না।
কৌতূহলে দিন গড়ালো পুজো এলো কাছে,
মহালয়ার দিন টি এলো পুজোর খুশির সাজে।
আমরা কয়জন রাত থাকতে উঠেছি ঘুম ছেড়ে,
পুবের আকাশ মলিন, আলো ধীরে উঠছে বেড়ে।
অন্ধকারে চুপিসারে গুটিগুটি পায়ে,
আমরা হাজির নবীন কাকার ঘরের কিনারায়।
চুপ্টি করে দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে,
দেখি কাকা চোখ আঁকছেন সমস্ত মন দিয়ে।
চোখ আঁকা যেই সাঙ্গ হল, নিথর নবীন কাকা,
অঝোর ধারে কেঁদেই চলেন দুহাতে মুখ ঢাকা।
কাঁদছে শিল্পী, নিরব বিশ্ব, কুপির আলো ঘরে,
নবীন কাকার পাষাণ হৃদয় কান্না হয়ে ঝরে।
রাত ফুরোনো ভোরের আকাশ, কৃপণ অল্প আলো,
মুখ দেখলাম সেই ঠাকুরের, প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
কিন্তু একি? এ মুখ তো নয় দুর্গা বা পার্বতী?
এ যেন এক ঘরের মেয়ে, চেনা জানা অতি।
নবীন কাকার সামনে গিয়ে কি হয়েছে বলি,
কেঁদে বলেন নবীন কাকা সবই জলাঞ্জলি।
শ্রাবণ মাসে বন্যা হলো, গেল অনেক কিছু,
মারণব্যাধি এলো তখন বানের পিছু পিছু।
ভাদ্র মাসের পূর্ণিমাতে সেই ব্যধি যে ধরল,
মেয়ে আমার অনেক কষ্টে যন্ত্রনাতে মরল।
ঠাকুর গড়ি, দু হাত আমার অবশ হয়ে আসে,
সব প্রতিমার মুখ জুড়ে ওই মেয়ের মুখটি ভাসে।
দ্যাখ্ না তোরা, দ্যাখ্ না সবাই, চোখ আঁকা শেষ হলো,
দ্যাখ্ না এইতো মেয়ে আমার হাসছে ঝলোমলো।
কোথায় গেলি মা রে আমার? কোথায় তোকে পাই?
মূর্তি গড়ে খুঁজি তোকে মূর্তিতে তুই নাই।
ষষ্ঠী এলে বোধন, দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে,
জাগবে ঠাকুর, কিন্তু আমার মেয়ে ফিরবে কবে?
কেউ কি কোন মন্ত্র জানো মৃন্ময়ী এই মেয়ে,
বাবার চোখের জল মোছাতে উঠবে হেসে গেয়ে?
আমরা অবাক! মহালয়ায় ভোরের শিউলি ঝরে,
কি নিদারুণ ঠাকুর পুজো নবীন কাকার ঘরে!




দিদি
-শুভদাশ গুপ্ত
তোর নতুন ফ্লাট থেকে ঘুরে এসে মাকে  বললাম সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
তোর ঝকমকে মোজাইক মেঝে। ইমালসান লাগানো দেয়াল,
আধুনিক ডাইনিং টেবিলে , জানালা দরোজায় ঝোলানো দামি পর্দা
এমনকি তোর ব্যালকনিতে রাখা বাহারী পাতার টব.....
সব কিছুই বললাম মাকে।
নগেন দত্ত লেনে আমাদের এই আলো বাতাসহীন
একতলার ভাঙা ঘরে বসে মা সব শুনলেন চোখ বুজে।
শুনতে শুনতে মার মুখে ফুটে উঠছিল হাসি আর
চোখে আসছিলো জল।
তোর ব্যালকনিতে দাঁড়ালে,ছড়িয়ে থাকা শহরটাকে
অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়,
বসবার ঘরের দেয়ালে নতুন কেনা একটা সুন্দর পেইন্টিং
ঘরটাকে কী গাম্ভীর্যে ভরিয়ে তুলেছে
এসব কিছুও মাকে বললাম।
চোখ বুজেশুনতে শুনতে মার মুখে ফুটে উঠছিল হাসি
আর চোখে আসছিলো জল।
তোর চেহারাটা আগের চেয়ে অনেক ঝকঝকে সুন্দর হয়েছে।
ফর্সা হয়ে গেছিস অনেকটা।
যদিও তোর হাসিটা আছে ঠিক সেই ছেলেবেলারই মত।
জামাইবাবুর মুখে শুনলাম সামনের পুজোয় তোরা নাকি
একেবারে পুরো দক্ষিনভারতটাই বেড়িয়ে আসবি।
মা নগেন দত্ত লেনের অন্ধকার ভাঙা চোরা ঘরে বসে
এইসব শুনতে শুনতে হেসেছে 'আর 'কেন জানিনা
মার চোখে এসেছে জল।
সবকিছুই বলেছি দিদি  .....
শুধু তোর ডাইনিং স্পেসে রাখা দুধ সাদা রঙের
ঐ  ফ্রীজ টার কথা মাকে বলিনি।


তোর বিবাহ বার্ষিকীর উজ্জ্বল সন্ধ্যায় তুই যখন
গা-ভর্তি গয়নাই অপুরূপা  হয়ে
 ফ্রিজের মাথায় হাত রেখে হাসছিলি
তখন যে তোকে কি দারুন সুন্দর লাগছিল---
মাকে  বলিনি সে কথাও।
বিবাহবার্ষিকীর সন্ধ্যায় তোদের আনন্দ উজ্জ্বল এপার্টমেন্টে
 তুই আর জামাইবাবু  যখন ঐ ফ্রীরজটার পশে দাঁড়িয়ে
হাসি হাসি মুখে মালা বদল করছিলি----
বাবুদের রসিক বন্ধুদের অনুরোধে
আর ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝিলিক দিয়ে উঠছিল
উপচেপড়া খুশির মোত -----
তখন, ঠিক তখনি দিদি
আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল
হাসপাতালের করিডোরে বাবার ভেঙে পড়া মুখ। 
ভেতরে মা তখন অপারেশনের পর অচৈতন্য। 
ডাক্তার এসে বাবাকে বললেন।
চোখটা বোধহয় আর বাঁচানো গেলো না।
তাও একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন---মাদ্রাজে--যদিও
সে অবশ্য অনেক টাকার ব্যাপার।
হাঁড়িকাঠে আটকে পড়া অসহায় পশুর মত 
করুন দেখাচ্ছিল বাবার মুখটা।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে  আসতে আসতে বাবা
আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন---
কমলাকে সারা জীবন শুধু দুঃখকষ্টই দিলাম।
সুখ দিতে পারলামনা।
আর ওর চোখ দুটোও চলে গেল। 
 সবই আমার কপাল । 

দিদি
অনেক দর দস্তুর আর চাপাচাপির পর
তোর বিয়েটা যখন আরো  কয়েক ভরি শোনা
আর একটা ফ্রিজের দাবিতে
আটকে পড়েছিল অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে
বাবা তখন কাউকে না জানিয়ে
চড়া সুদে ধার করেছিলেন অনেক টাকা।
সামান্য মাইনের প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি করা বাবা
বেঁচে থাকতে থাকতে অন্তত একটা মেয়েকে পার করার
দুরন্ত আসায় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলেন অনেকটা।
চোখের জল আর রজনীগন্ধার সৌরভকে পেছনে  ফেলে
তুই চলে গালি।
পরে রইলাম আমরা, মা আর আমি।
আর পরে রইলো নগেন দত্ত লেনের অন্ধকার ঘরে
বাড়তে থাকা সুদের বোঝার চাপে  তলিয়ে যাওয়া
একটা সৎ মানুষ।
তোর বাবা।
আমার বাবা।

দিদি
তোর গাভর্তি গয়না আর ঐ দুধ সাদা ফ্রিজের কথা।
 মাকে  বলা হয়নি কিছুতেই।
দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে বসা মাকে বাবা বলেননি কিছুই।
শুধু অসহায়ের মত খুঁজতেন
মার্ মুখে একটু হাসি।
বড় মেয়ের ভাল ঘরে বিয়ে হবার  একটু তৃপ্তি।
সে হাসি খুঁজতে  খুঁজতে  ক্লান্ত বাবা চলে  গেছেন।
এখন নগেন দত্ত লেনের ভাঙা ঘরে বসে
মা আর আমি আনন্দেই আছি।
একটা আনন্দই বোধহয় সবচেয়ে বড়ো--
এ বাড়িতে আর কোনোদিন সানাই বাজবেনা সাহানায়
সানাই। রজনীগন্ধা।বেনারসি। হৈ-চৈ-এইসব
অপ্রাসংগিক হয়েই থেকে যাবে চিরকাল।  



ফিরে এসো আগুন
-শুভ দাশগুপ্ত
 
পরম আকাঙ্ক্ষিত আগুন,বহুদিন ঘরছাড়া তুমি।
কতবার ,কতভাবে চেষ্টা করেছি, তোমার খোঁজ পেতে।
পাইনি, তুমি জানোনা কত চিঠি লিখেছি তোমার নামে
কতবার কাতর ডাক পাঠিয়েছি তোমার উদ্দেশে
আগুন,
তুমি থেকে গেছ ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এই শ্রান্ত দেহমনের ক্লান্ত ছায়া থেকে,
বহুদূরে-প্রিয়তম আমার,
আজ তোমাকে আহ্বান করছি আমার হৃদয়ে,
আমাদের হৃদয়ে।
তোমাকে ডাক পাঠাচ্ছে আমার সময় -স্বজন -স্বদেশ।
বহুদিন কোনো খবর পাই না তোমার।
কোথায় হারালে আগুন? কোথায়?
মহাবিশ্বের মহাকাশের সৃষ্টির প্রথমতম মুহূর্তের ক্রান্তিলগ্নে
তোমাকে দেখেছি।
সূর্য সম্ভূত এক প্রাণময় মর্ত্যলোকের জন্মমুহূর্ত থেকে,
দেখেছি তোমাকে।
প্রবলতম উত্তাপে, ভীষণতম বিধ্বংসী উন্মত্ততায়,
নিবিড়তম সৃজনের দূর প্রভাবী ছন্দে, দেখেছি তোমাকে আগুন।
তিনভাগ চোখের জল আর একভাগ বেঁচেবর্তে থাকার আনন্দিত সবুজ নিয়ে
আমাদের এই জীবন নামের নাট্যশালায় তুমিই প্রথম আলোক সম্পাত
মনে পড়ে
অদূর অতীতের সেই আর্তনাদক্লিষ্ট শ্মশানভূমি,
জ্বলছে চিতা, জ্বলছে মৃত মানুষ,
আর চারপাশের ঢাক -ঢোল -কাঁসর -ঘন্টার উন্মত্ত উল্লাসের নেপথ্যে জ্বলছে
জড়ো হওয়া একপাল মানুষের পাশব লোভ।
আর সেই উন্মাদ কালবেলায় নিদারুণ চিৎকারে
আকাশ ফাটিয়ে জ্বলে উঠছে,
নিরীহ এক সদ্যবিধবার অনিচ্ছুক দেহ।
মনে পড়ে আগুন, প্রাকৃতিক আগ্নেয় -বীভৎসতাকে তুচ্ছ করে
সেদিন সেই হতভাগ্য পরাধীন দেশ দেখেছে এক দুর্নিবার মানবিক আগুন
সে আগুনের নাম রামমোহন।
বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কুলীনপ্রথার
বর্বরোচিত দানবীয়তায় যখন ঢেকেছিল মানুষের মুখ,
তখন সারা দেশে দৃপ্ত তেজে
দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া এক আগুনকে
আমরা আজও মাথানত করে জানাই প্রণাম,
সে আগুন...... ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
আগুন,
তোমাকে দেখেছি ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাইএর
শোনিত পিপাসু তরবারির ঝলকে।
তোমাকে দেখেছি তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার দুর্দমনীয় দুঃসাহসে।
তোমাকে দেখেছি জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতায়।
কখনও তুমি বুড়িবালামের তীরে জ্বলে ওঠা বাঘাযতীন।
কখনও তুমি রাইটার্স বিল্ডিং কাঁপিয়ে দেওয়া রিভলভারের প্রচন্ড শব্দে
বিনয় -বাদল -দীনেশ।
কখনও তুমি বহুদূর বিদেশের মাটি থেকে হাজার হাজার।
সৈন্যের নেতৃত্ব দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল চুরমার করতে এগিয়ে আসা
নেতাজী সুভাষ।
তোমাকে দেখেছি আগুন, বারবার সুজলা সুফলা এই মায়াময় দেশের
ঘাসে ঘাসে, নদী-পাহাড়ে-অরণ্যে-শহরে-গ্রামে-গঞ্জে-হাটে।
প্রিয় আমার,
শিকাগো বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তুমি হিরন্ময় হয়ে উঠেছিলে
স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বজয়ী বেশে।
. . . “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে” . . . বলে বজ্র কণ্ঠে
দীপ্যমান তুমি বিশ্বকবি রূপে।
তোমাকে দেখেছি স্বাধীন মাটিতে,
খাদ্যের দাবীতে গ্রাম শহরের গরীব মানুষের,
লাঠি গুলি বেয়নেটের খাদ্যে পরিণত হওয়া মিছিলে।
তোমাকে দেখেছি তেভাগায়, তোমাকে দেখেছি তেলেঙ্গানায়,
তোমাকে দেখেছি আগুন বারবার অসংখ্যবার, হে আমার প্রিয়,
বহুদিন আর দেখা হয় না তোমার সাথে,
চারপাশের গাঢ় অন্ধকার ক্রমশ গাঢ়তর।
শেষবার তোমায় দেখেছিলাম,
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার গান গাইতে গাইতে
উত্তাল সত্তরের উন্মাদ স্বদেশে, শহরে, গ্রামে কাছে দূরে,
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ঘূর্ণিঝড়ের বেগে পৌঁছে গিয়েছিলে
বীরভূম, বাঁকুড়া, বিহার, অন্ধ্র, আসাম...। আর দেখা হয়নি,
বহুদিন আর দেখা হয়নি, চারপাশে গাঢ় অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে উঠছে।
আমার সময়, আমার স্বজন, আমার স্বদেশ
তোমায় খুঁজছে, ভীষণভাবে খুঁজছে।
ফিরে এসো আগুন
ফিরে এসো।
ফিরে এসো।



ছেলেটি এবং মেয়েটি
- সুবোধ সরকার
 
মেয়েটি এবং ছেলেটি একদিন বাড়ি থেকে পালালো
তারা আপাততঃ একটি অরণ্যের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু সারা শহরে -
ছেলেটির বাবা খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটির বাবাকে
ছেলেটির মা খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটির মাকে
ছেলেটির দাদা খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটির দাদাকে
একটা কিছু হবে। কোনও একজনের লাশ পড়বে।
ওদিকে ছেলেটি আর মেয়েটি একটি গহন অরণ্যের ভেতর।
ছেলেটি মেয়েটিকে চুম্বন করছে।
আপাততঃ মেয়েটির নাম আত্মহারা
ছেলেটির নাম উদভ্রান্ত।
কিন্তু সারা শহর ছেলেটির বাবা
খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটির বাবাকে
সত্যি সত্যি তাদের দেখা হয়ে গেল একদিন
দুই বাবার সংলাপ:
: আপনার মেয়েটি একটা জিনিস
: আপনার ছেলেটি একটা বাঁদর
: আপনার মেয়েটি একটা চিড়িয়া
: আপনার ছেলেটি একটা নকশাল
ওদিকে বিহার উড়িষ্যা ছাড়িয়ে ওরা তখন অন্ধ্রের দিকে
ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরল
মেয়েটি ছেলেটির কোমর ধরল।
তরপর তিনদিন তিনটে বাংলা কাগজে স্টোরি
কীভাবে তারা পালিয়েছে, কোন কলেজে পড়ে
মেয়েটির চরিত্র কেমন,
ছেলেটিকে লোকাল কমিটি ডেকেছিল কেন
কিন্তু ওরা তখন অন্ধ্রপ্রদেশের সূর্যাস্ত দেখেছে।
বাবা-মা, থানা-পুলিশ এবং সংবাদপত্র
আপনারা পারেন কিন্তু, অসীম আপনাদের ক্ষমতা
পৃথিবীর কোথাও যখন কোনও ভালোবাসা নেই
দিন না, ছেলেমেয়ে দুটোকে একটু ভালোবাসতে।



সার্থক জনম - কবি-শুভ দাশগুপ্ত
=============
যে ছেলেটা চায়ের দোকানের এঁটো কাপ ধুচ্ছে রাস্তার ধারে, তাকে ডাকুন ।
তার কানে কানে বলুন সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং
হ্যাঁ, বেশ সুন্দর করে বলুন,যে মেয়েটা চাকরির নাম করে
বনগাঁ কিংবা চাকদা থেকে রোজ সকালের ট্রেনে সেজেগুজে
শহরে আসছে, শরীর বেচে চাল, ডাল, নুন কিনতে, তাকে ডাকুন,
তার কানে কানে সুরেলা কন্ঠে বলুন, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
যে ছেলেটি লটারির টিকিট নিয়ে দরজায় দরজায় ঘুরছে আর বলছে
বিশ্বাস করুন, আমি ভদ্রলোক, আজ ১০ বছর হল আমার
কারখানা বন্ধ, লক-আউট, তাকে ডাকুন, তার কানে কানে
বলুন, বল বল বল সবে শতবীণা বেণুরবে ভারত আবার
জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ।
রাতের আকাশ-কাঁপিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে, যে মা
আজও লন্ঠন হাতে টালির ঘরের দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন
তাঁর খোকন ফিরে আসবে বলে । যে খোকনকে এমনই
এক বর্ষায় উন্মত্ত রাতে কালো গাড়ির পুলিশ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল
আর বরানগরের রাস্তায় ভোরের ঘুম-ভাঙা
কুকুর প্রথম দেখেছিল যার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ,
সেই মাকে ডাকুন, তাঁর কানে কানে বলুন,
হাম বুলবুলি হ্যায় ইসকি ইয়ে গুলিস্তা হামারা, সারে যাঁহা......হামারা ।
সবাইকে সব বলা শেষ হলে, সুনসান শীতের রাতে
পাঁচমাথার মোড়ে ঘোড়ায় চড়ে বসা সেই মহাবিপ্লবীর
পায়ের সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যান
ফাঁকা রাস্তায় রাতের বাতাসে কান পাতুন
শুনতে পাবেন সেই বিপ্লবী পুরুষের বজ্রকণ্ঠ
আমি তোমাদের কাছে রক্ত চেয়েছিলাম
তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব বলে, আমি পারিনি
কিন্তু আমি আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছি ।
আর তোমরা ? --- তোমরা ??



আমরা -শুভ দাশগুপ্ত
 
ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে
আমার ছেলে ডাক্তার হবে।
আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, নিদেনপক্ষে --
সরকারী অফিসার।
ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে
আমার ছেলে দেশ চালাবে। দেশ শাসন করবে।
গাড়ি চাপবে। সামনে ড্রাইভার
পেছনে চাপরাশি আর্দালি
গরমে কুলু মানালী। শীতে কোবালাম বীচ।
ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে।
দেশের জন্য লড়াই করবে ও পাড়ার ওরা--
আমার ছেলে ঘাড় গুঁজে ক্যারিয়ার বানাবে,
বিজ্ঞান শিখবে। অঙ্ক শিখবে, কবিতা শিখবে।
বড় বড় মণীষীদের জীবনী পড়বে।
দেশের জন্য মুখের রক্ত তুলবে ও পাড়ার ওরা
আমার ছেলে আমার রক্ত জল করা পয়সা
সুদে আসলে উসুল করবে।
নেতাজী সুভাষ হয়ে দুরন্ত দুঃসাহসে ঘর ছাড়বে
অন্য কেউ। আমার ছেলে নেতাজীর জীবনী লিখে
এ্যাওয়ার্ড পাবে।
ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে।
আমরা তামাকে এবং দুধে,
রসে এবং বশে, সুখে এবং আরামে
দিন কাটাবো।
দেশের মুক্তি, প্রাণের মূল্য কিনে আনবে অন্য কেউ।
আমরা মুক্ত স্বদেশে
ঘাড়ে পাউডার লাগিয়ে গদ গদ কন্ঠে
গণসঙ্গীত গাইবো।




ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা - শুভদাস গুপ্ত
ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা, ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার তৈরী করে …….
তারা প্রথমে, গাঁয়ে-মফস্বলে, হরিপ্রসন্ন স্কুলে, 
গেঁয়ো বন্ধুদের সাথে লেখাপড়া শেখে ।
তারপর — ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে সকলকে চমকে দেয় ।
তারপর তারা উচ্চতর শিক্ষার জন্য চলে যায় ……
ব্যাঙ্গালোর কিংবা দিল্লী, কিংবা পুণে …….
সেখানে গিয়ে তারা বড় বড় নম্বর পায় ! পজিশন পায় !
তারপর সেই নম্বর প্লেট গলায় ঝুলিয়ে তারা মস্ত মস্ত
 কোম্পানীতে ভালো ভালো চাকরি পায় !
প্রচুর স্যালারি ! দামি ফ্ল্যাট ! ভালো গাড়ী ……. !
ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা ….. এরপর বিদেশের বিমানে গিয়ে বসে ।
পৌঁছে যায় আমেরিকা, জার্মানি কিংবা আবুধাবী …. 
অথবা সিঙ্গাপুর কিংবা কানাডা !
ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের, ঐ সব দেশ টপাটপ কিনে নেয় ।
ঐ সব ব্রিলিয়ান্ট দেশ, আমাদের ব্রিলিয়ান্টদের জন্য বিলাসবহুল বাড়ি – গাড়ি
আর প্রচুর ডলারের ব্যবস্থা করে দেয় ….
সেখানে আমাদের ব্রিলিয়ান্টরা সুখে থাকে ।
সুখে থাকতে থাকতে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা ভুলে যায় তাদের দেশ গাঁয়ের কথা,
হরিপ্রসন্ন স্কুলের কথা —
গাঁয়ের বন্ধুদের কথা ক্রমে ভুলে যেতে থাকে !
ভাংগা বাড়িতে পড়ে থাকা কেরানী বাপ কিংবা অসুস্থ মায়ের কথা ভূলে যেতে থাকে।
মনে রাখতে পারে না —– খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো সব অসফল ভাই বোনেদের কথা ।
ব্রিলিয়ান্টদের জগতে ইমোশন নেই ! প্রোমোশন আছে ।
ব্রিলিয়ান্টদের অতীত নেই ! কেবল ভবিষ্যৎ, কেবল ফিউচার ।
ছোট চেয়ার থেকে বড় চেয়ার ……নন এসি থেকে এসি ।
ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা বাবা- মা কে মাঝে মধ্যে টাকা পাঠায় ….অ -নে -ক টাকা !!!!
সেই টাকা হাতে পেয়ে ব্রিলিয়ান্টদের বাবার মুখে ফুটে ওঠে হাসি।
মায়ের চোখ ভরে ওঠে জলে।
ব্রিলিয়ান্টরা এই ন্যাস্টি ইন্ডিয়াতে আর ফিরে আসতে চায় না।
এত ভিড় ! এত ধুলোকাদা ! এত কোরাপশন !
এসবের মধ্যে তাদের গা ঘিনঘিন করে
তবু যদি কখনও আসে ……..
অনেক অনেক ফরেইন জিনিস নিয়ে আসে ।
মায়ের জন্য ইতালির চাদর , 
বাবার জন্য ফ্রান্সের সিগারেট .. সঙ্গে জাপানি লাইটার ,
আলো জ্বললেই যা থেকে টুং টাং করে বাজনা বেজে ওঠে ।
ব্রিলিয়ান্টদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা ……..
ব্রিলিয়ান্টদের ব্রিলিয়ান্ট বানিয়ে তুলতে
কেরানী বাবাকে যে কতদিন কর্মক্লান্ত দুপুরে টিফিনে একটা চাপা কলা কিংবা
একটাকার শুকনো মুড়িতে পেট ভরিয়েছেন ……
কতকাল যে মা কোনো নতুন শাড়ী কেনাকে বিলাসিতা মনে করে
ছেঁড়া শাড়ীতে দিন কাটিয়েছেন !!!
এসব তথ্য ব্রিলিয়ান্টদের ল্যাপটপে থাকেনা।
 ব্রিলিয়ান্টদের ল্যাপটপে নায়াগ্রার দূরন্ত জলোচ্ছ্বাস, কিংবা
ভিসুভিয়াসের ছবি থাকে …….
এই শ্যামল বাংলার নদী গাছ , বর্ষার মেঘ —–
এসব হাবিজাবি সেখানে ইনসার্ট করা যায় না।
ব্রিলিয়ান্টরা সদা ব্যস্ত! ভীষণ ব্যস্ত …… !
তারা সঙ্গীত শোনেনা, তারা গল্প বা কবিতা পড়ে সময় নষ্ট করেনা।
তারা আকাশ দেখে না , বৃষ্টিতে তাদের মন খারাপ হয় না।
তারা কেবল কাজ করে ,কেবল ব্যাস্ততায় ডুবে থাকে।
বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙ্গে …….শ্রাবণ মাস।
মা মৃত্যুশয্যায় …..বাড়ি ভর্তি নানা লোকজন।
অসুস্থ বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন শূন্য চোখে ……
ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছেন ….গোটা বাড়িতে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা !!!
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে মা জিজ্ঞেস করছেন ….. খোকন এলো ? খো – ক – ন ………….!
ব্রিলিয়ান্ট খোকন তখন ফ্লাইটে …..
সবাই মা কে বোঝাচ্ছে ঐ তো ঐ তো খোকন এলো বলে!
কিন্তু সে ফ্লাইট চলে যাচ্ছে কানাডায়।
কানাডায় কোম্পানীর নতুন শাখা উদ্বোধন।
খোকন যাচ্ছে আরও বড়ো দায়িত্ব নিয়ে , আরও বেশী ডলার ……..
এখানে এই পোড়া দেশে ব্রিলিয়ান্ট খোকনের মা
ছেলের মুখ না দেখেই শেষ বারের মতো চোখ বুঁজলেন …..।।
আমরা এখন ঘরে ঘরে সবাই —— এমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে গড়ে তুলতেই ব্যস্ত…….।
সক্কলে …………..!!!!!!




আমি সুভাষ বলছি – শুভ দাশগুপ্ত
 
তোমার পাথরে দিয়েছি মালা
এত মালা, এত ফুল, তুমিই ঢাকা পড়ে গেছ
তুমি পাথর না হলে রাগ করতে
ছাপ্পান্ন বছর আগের এক মধ্যরাতে
এলগিন রোডের তিন তলার ঘরে আলো জ্বলছিল
চাদর গায়ের এক ছায়ামূর্তি পায়চারি করছিল অবিরাম
বাইরের রাস্তায় ইংরেজ পুলিশের চর
সতর্ক সজাগ চোখে দেখছিল
তার সব সতর্কতাকে বুদ্ধু বানিয়ে
তুমি তখন অন্ধকার চিরে ছুটে চলেছ আলোর পথে
দেশের মানুষ, কাকপক্ষী কেউ টের পায়নি।
তুমি চলে যাবার পর
ছাপ্পান্নটা শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম উধাও, তুমিও
সেই থেকে প্রত্যেক জানুয়ারিতে
পৃথিবীর এপাড়া, ও পাড়া সব মাটিতে
তোমার অনশ্বর পায়ের ছাপ
সব রাইফেলে তোমার বুকের বারুদ
সব কুচকাওয়াজে তোমার সেনার ছন্দ
পরশ পাথরের মত স্বাধীনতাকে খুঁজেছে
তোমার অন্তরে লুকিয়ে থাকা খ্যাপা
তোমার গন্থব্য ছিল স্বাধীনতা
তোমার পথ ছিল স্বাধীনতা
তোমার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা
তোমার প্রেম ছিল স্বাধীনতা
তুমি রক্ত চেয়েছিলে স্বাধীনতার জন্য, তুমি তাই পাথর
যারা স্বাধীনতার আড়ালে চেয়েছিল গদি, চেয়েছিল সিংহাসন
ইংরেজের ছেড়ে জাওয়া লুটের রাজ্যপাট, তারা রইল সুখে
ভারতবর্ষের টাকায় তাদের সুখ, তোমার নয়
ভারতবর্ষের অফিসে, আদালতে তাদের ছবি, তোমার নয়
ভারতবর্ষের সংবিধানে তাদের সই-সাবুদ, তোমার নয়
ইংরেজ গরীব মানুষকে পায়র নীচে রাখত
আমরা বড়লোকদের মাথায় করে রেখেছি
স্মাগলার কিম্বা ডাকাতকে জোড় হাতে সভাপতির আসনে আহ্বান করেছি
ইংরেজ এদেশের ধন সম্পত্তি লুট করত
আমরা দেশটাকে বেচে দিচ্ছি
ইংরেজ দিয়েছে চাবুক, লাঠি, গুলি
আমরা দিয়েছি মাস্তান, মাফিয়া, নেতা আর বুলি
ইংরেজ দিয়েছে কালাপানি, সেলুলার জেল
আমরা দিয়েছি টিভিতে সুপারহিট মোকাবিলা
আর আইনসভায় আয়ারাম, গয়ারামের খেল
ছাপ্পান্ন বছর আগের এক মধ্যরাতে
পরাধীন এই দেশ ছেড়ে তুমি চলে গিয়াছিলে
স্বাধীন এক স্বদেশে ফিরে আসার স্বপ্ন নিয়ে, তুমি ফিরে আসনি
স্বাধীনতা এসেছে, তার কাঁধে ঝুলি ভরে নিয়ে এসেছে
ভোট নামক রাজস্যূয় যজ্ঞ
গণতন্ত্র নামক চিরায়ত মাত্স্যন্যায়
প্রগতি নামক লোক-ঠকানো স্ট্যাটিসটিক্স
সংহতি নামক বিস্ফোরণের চুরমার
ঐতিহ্য নামক মন্দির-মসজিদের ঝগড়া
আর আসমুদ্র হিমাচল ভরিয়ে দেওয়া
ভাষণ-ভাষণ আর ভাষণ
ছাপ্পান্ন বছর ধরে তুমি পাথর হয়ে আছ
ছাপ্পান্ন বছর ধরে ভারতবর্ষ অধীর অপেক্ষায় কান পেতে আছে
ইথার-তরঙ্গে কবে হঠাৎ শোনা যাবে
স্বাধীনতার নিজস্ব কণ্ঠস্বর
আমি সুভাষ বলছি।


জীবন
– শুভ দাশগুপ্ত
১৯৭০ :
— তোমাকে না দেখলে এক মুহুৰ্তও ভালো লাগেনা।
— আমারও।
১৯৮০ :
— অনেকদিন হল, এবার বিয়েটা করা দরকার।
— যাক, সেটা বুঝেছ তাহলে। আমিও আর এভাবে
দূরে দূরে থাকতে পারছিনা।
১৯৯০ :
— মেয়েটা বড় হচ্ছে। তোমার কোনো পরিবর্তন নেই।
এখনও কি আর আগের মত রোজ অমন…..
— বাজে কথা বোলোনা তো। এমন কিছু বয়স হয়নি
আমাদের। তুমি বড় বেরসিক হয়ে পড়ছ।
২০০০ :
— হাঁটুর ব্যথাটা ক্রমেই বাড়ছে। কোমরটাও। তুমি
আবার এর মধ্যে এত আদিখ্যেতা কোরনা তো,
— এখনই বুড়ো হয়ে পড়লে? জানো, কত লোক ষাটের পর
বিয়ে করছে? কাগজ টাগজ পড়োনা নাকি?..একটু
ভালবাসবে–তার আবার অত অজুহাত কেন!
২০১০ :
— আজ মেয়ের ফুলশয্যা । উঃ! ভাবলেই রোমাঞ্চ লাগে। এই
সেদিন জন্মালো!
— নিজের ফুলশয্যার কথা মনে পড়ছে বুঝি?
২০২০ :
— ………?………।
— ………?………।
 
 
 
 
জানো
শুভ দাশগুপ্ত
 
জানো,
একদিন জিলিপি খাওয়ার দুরন্ত লোভে
বেদম মার খেয়েছিলাম কাকিমার হাতে
অকালে বাপ – মা মরা
সেই আমার অবুঝ ছেলে বেলায়? জানো?
চাঁদা দিতে পারিনি বলে কতবার আমাকে নেয়নি
পাড়ার ছেলেরা ওদের হৈ হৈ পিকনিকে?
জানো।
বুকের নদীতে যার জন্য ঢেউ জেগেছিল দুরন্ত একুশে
বাইশ আসার আগেই
বুদ্ধিমতির মত হরিণ চোখে সে গেঁথে নিয়েছিল
এক অন্য পুরুষ !
অথচ জানো –
সে সবুজ ভালোবাসতো বলে আমি
ঘাসের উপর সন্তর্পনে হাটতাম
সে নীল দেখতে চাইতো বলে
মেঘ করলেই আমি অস্থির হয়ে পড়তাম
সে লাল পছন্দ করত বলে
করণে অকারণে নিজেকে রক্তাক্ত করে তুলতাম!
এবং জানো –
শিশুকাল থেকে আমি কেবল পুড়েছি।
জিলিপির আমোঘ লোভে
সবান্ধব হুল্লোড়ের অনিবার্য ইচ্ছায়
যৌবনের বাসন্তী আগুনে
আমি পুড়তে পুড়তে
কয়লার মত নিরেট নিকষ কালো হয়েগেছি
তবু জানো?
আমায় চিনতেই পারেনি আমার সময়
আমার জীবন
আমার জন্ম!
 
 
 
 
 
 
আমার রবীন্দ্রনাথ
শুভ দাশগুপ্ত
পরমারাধ্য কবিবরেষু,
মাননীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহোদয়,
ধরা-ছোঁয়ার অনেক উর্দ্ধে এখন আপনি।
আমাদের জীবনের প্রত্যহিকতায়,
কলকাতা কিংবা বোলপুরের শান্তিনিকেতনে,
ইংল্যান্ডে কিংবা মংপুতে, কোথাও আর আপনার
মানবিক চলাফেরার চিহ্নটুকুও নেই।
যে মানচিত্রকে আপনি ভারতবর্ষ বলে দেখেছিলেন
আপনার প্রস্থানপর্বের অনতিবিলম্বে সে মানচিত্র
বদলে গেছে অনেকখানি।
পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠার সিন্ধু
এখন পরদেশ,
সেখানে যেতে গেলে এখন পাসপোর্ট লাগে।
মান্য কবিবর,
সেই বদলে যাওয়া মানচিত্রের রক্তাক্ত পটভূমিতে
দাঁড়িয়ে আমি একজন সামান্য মেয়ে।
আমাদের মতো মেয়েদের জীবনে আপনি এক
আশ্চর্য স্বপ্নময় দ্বীপভূমি।
যেখানে যাবার স্বপ্ন আমাদের উদ্দীপ্ত করে,
আর যেখানে পৌঁছতে না পারার চিরকালীন গ্লানি
আমাদের বিদীর্ণ করে, বিদ্ধ করে।
দেশভাগের মর্মান্তিক যন্ত্রণা কে সম্পত্তি করে
আমাদের ধ্বস্ত পরিবার একদিন এসে বাসা বেঁধেছিলো
টালির ঘরে, শহর থেকে বহুদূরের গ্রামে।
বাবা কখনো দোকানদারী, কখন ছাত্র-পড়ানো,
কখনো এটা-সেটা ক’রে প্রখর জীবনস্রোতে
বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে আজীবন চেষ্টা করেছেন
ভেসে থাকতে, বেঁচে থাকতে।
তাঁর সম্বল বলতে কিছু ছিল না,
না টাকা-পয়সা, না আশা-ভরসা,
ছিল সাহস, আর ছিলেন আপনি।
হ্যাঁ, উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে
কথায়-কথায় বাবা বলতেন আপনার কথা,
আপনার কবিতা আর গানের কথা,
আপনার নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা,
আপনার নাইটহুড ত্যাগের কথা,
আপানার গোরা-চোখের বালি-যোগাযোগের কথা,
গীতাঞ্জলী-ছিন্নপত্রের কথা।
আর এসব কথা যখন বলতেন
দারিদ্রলাঞ্ছিত সেই দীনহীন মানুষটির
সমস্ত চোখ মুখ ভ’রে জ্বলে উঠতো আলো।
আমরা যারা শুনতাম – আমি,দাদা, মা,
আমাদের দৃষ্টির চেনা পরিধির সীমা ডিঙিয়ে
অসীম এক আকাশ উঠতো জেগে,
যে উদার নীলিমায় কেবল গান, কেবল ছবি, কেবল প্রশান্তি।
দারিদ্র আর অসাফল্যের টানাপোড়েনে বোনা
আমাদের উদ্বাস্তু জীবনে আপনি ছিলেন
এক অশেষ মাধুরী।
কবি, আপনার জানার কথা নয়, আমরা জানি,
আমরা, দেখেছি অনটন আর নিরুপায় দারিদ্র
কি ভয়ঙ্কর আগ্নেয় শক্তিতে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে
আমাদের নিরন্ন জীবনকে।
তবু যখন দিনগত পাপক্ষয়ের উপান্তে এসে
একটুখানি মাটির দাওয়ায় বাবা বসতেন
চৈত্রের সন্ধ্যার বাতাস কপালে নিয়ে,
তখন নুয়ে-পড়া দুমড়ে-যাওয়া সেই হতমান মানুষটি
কি বিশ্বাসে যে গেয়ে উঠতেন –
“নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার।”
গাইতেন, আর তাঁর গাল বেয়ে নেমে আসত
ব্যথার পরশ-লাগা অশ্রুধারা।
সব হারিয়েও বাবার বুক জুড়ে ছিলেন আপনি,
আমরা তখন অবোধ শিশু।
সেদিন ছিল শ্রাবণের এক অবিরাম বৃষ্টির রাত,
আমাদের ভাঙা ঘরের চাল ফুটো
হয়ে ঝরছিল স্রোতধারা,
আকাশে সেদিন ঘন দুর্যোগ।
মাত্র সাতদিনের জ্বরে আমার বিদ্ধস্ত মা
তখন শেষ পথের যাত্রী।
জ্বরে পুড়ে-যাওয়া মায়ের গায়ে বাবা
তখন হাত রেখেছেন একটু শান্তির স্পর্শ দিতে,
চোখে জল, মা বললেন – ছেলে মেয়েরা রইলো।
বলতে বলতে মা’র চোখ বন্ধ হয়ে এলো,
বাজে পড়লো কাছেই কোথাও, তীব্র আলোর ঝলক তুলে
ঘরের প্রদীপ গেলো নিভে, তারপর অন্ধকার।
প্রবল বর্ষণে ভেসে যাচ্ছে সবুজ গ্রাম
হু-হু করে বইছে ঝোড়ো মাতাল হাওয়া,
তখন সেই শ্মশানলগ্নে বাবা কাঁদছেন
আর মৃদু স্বরে আবৃত্তি করছেন –
“শেষ স্পর্শ নিয়ে যাবো যবে ধরণীর
বলে যাবো তোমার ধূলির তিলক পরেছি ভালে
দেখেছি নিত্যের জ্যোতি, দুর্যোগের মায়ার আড়ালে
সত্যের আনন্দ রূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মূরতি,
এই জেনে ধুলায় রাখিনু প্রণতি”।
স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে অন্যরকম
হাওয়া-বাতাসে বড়ো হতে-হতে
আমার দুরন্ত দামাল দাদা
জীবনযুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিল
অল্প বয়স থেকেই।
দাদা আমার নির্ভীক কণ্ঠে গাইতো গান,
আপনারই গান,
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরে
দাদা এক-একদিন আমায় শোনাতে চাইতো
আপনার কবিতা।
দৃপ্ত হিরন্ময় কণ্ঠে সে আবৃত্তি করতো –
“হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমাপানে চেয়ে কতবার
প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে”।
খিদিরপুরের এক কারখানায়
দাদার সামান্য চাকরি।
শিক্ষিত এক স্বাধীন ভারতীয় যুবক
কাজ না পেয়ে দুমুঠো ভাতের আশায়
হাতুড়ি পেটাতো গনগনে বয়লারের
সামনে দাঁড়িয়ে, ঘামে ভিজে যেত তার শরীর।
তবু যখন সে মানি-অর্ডার পিঠাতো
চিলতে একটুখানি জায়গাতেও সে লিখতো –
বোন, গানটা ছাড়িস না।
গান আমার হয় নি কবি,
আসলে বেঁচে থাকাটাই হলো না ঠিকভাবে।
এখনো ছাত্র পড়াই,
টিম-টিম করে জ্বলে কেরোসিনের সান্ধ্য-আলো,
জীবন ছুটে চলেছে তার আধুনিক প্রগতির গাড়িতে চেপে,
আমি, আমরা পড়ে রয়েছি বহুদূর পথের পাশে, উপেক্ষায়।
পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে
শহরে-শহরে কত গান, কত কবিতা, কত নৃত্যনাট্য।
বড়োলোকের সুসজ্জিত ড্রইংরুমের ঝকঝকে আলমারিতে
আপনার অমূল্য রচনা সম্ভার।
তবু কবি, কেন জানি না, বার বার মনে হয়,
ওই বৈভবের হাজারদুয়ারীতে আপনি নেই,
আপনি আছেন এইখানে,
এই মর্ত্যমাটির একেবারে কাছে
সবুজে-শ্যামলে ধুলোতে-মাটিতে,
এই শীর্ণশ্রোতা নদীর ঢেউয়ে
এই ভাঙা ঘরের দরিদ্র সকালে,
এই ঝোপঝাড়ের জোনাকি ভরা
অনাড়ম্বর সন্ধ্যায়।
দশবছর কারখানা বন্ধ থাকার নিদারুণ যন্ত্রণায়
দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গিয়েছিলো
আমার দাদার সব স্বপ্ন।
ধীরে, অথচ অনিবার্যভাবে দাদা
এগিয়ে গিয়েছিলো আত্মহননের পথে।
কলকাতা থেকে যখন দাদার মৃত্যুসংবাদ এলো
ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে,
গঙ্গার তীরবর্তী শ্মশানে দাঁড়িয়ে হু-হু করে কান্নায়
ভেসে গিয়েছিলো আমার বুক।
একা, একবারে একা মনে হয়েছিল
নিজেকে সারা পৃথিবীতে।
আর ঠিক আশ্চর্য গোধূলিলগ্নে
প্রকৃতির সবটুকু মায়াকে সাক্ষী রেখে
ওপারে দূরে বেজে উঠেছিল তোমার গান –
“ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি”।
ওমনি আমার সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত বেদনা-গ্লানি
যেন কোথায় দূরে হারিয়ে যেতে লাগলো,
জীবনের কি এক আশ্চর্য বিশ্বাস
তখন এসে স্পর্শ করলো আমায়।
হু-হু করা করা সে সন্ধ্যায়, মনে আছে কবি,
বুকের গভীরতম অনুভব থেকে গেয়ে উঠেছিলাম –
“আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে,
দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে”।
কবি, আজও তুমি আছো, প্রতিদিন আছো
এই হতভাগ্য দেশের অগণিত মানুষের চিন্তায়-চেতনায়,
আছো প্রতিদিনের দুঃখ-সুখের ধ্বস্ত দিনলিপিতে।
পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণের শহুরে আড়ম্বরে নয়,
তুমি বেঁচে আছো, বেঁচে থাকবে চিরদিন, চিরকাল।
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...