Sunday, January 26, 2020

চিঠি




” না পাঠানো চিঠি”

                     আইরিন আক্তার



প্রিয় মেঘ,
বরাবরের মতোই ভালো আছো নিশ্চই।
আমিও বেশ আছি। কতকাল চিঠি লেখা হয়না তোমাকে। প্রায়শই ভাবি তোমাকে একটা চিঠি লিখি, আর পাঠিয়ে দিই।
মনের অব্যক্ত কথা গুলো খুব ঘটা করে বলবো, শোনাবো। হয়তো সেই সময়টুকুও হয়ে ওঠেনা তোমার, নয়তো দুজনের। কিছু কথা মুখে না বলে চিঠিতে দিলেই ভালো হয়।
মেঘ, তোমার কি মনে আছে, একদিন তোমাকে রান্না করে খাওয়াবো বলে কতোই না আয়োজন করেছিলাম। তুমি আসবে বলেও আসোনি। একদিন বলেছিলে, “শাড়ি পড়ে তৈরি থেকো আজ তোমাকে জোছনার আলোতে দেখবো”। শাড়ি, চুড়ি, লালটিপ কতো কিছুই না পড়েছিলাম সেদিন, তুমি সেদিনও আসোনি। কিঞ্চিৎ পরিমাণ অভিমানও করেছিলাম। তুমি কতোই না অবুঝ ছিলে, অভিমানে ভরা রক্তচক্ষুর ভাষাটুকুও বুঝতে পারতে না তখন। তবে এখন বেশ ভালো বুঝো।
সেদিন দেখলাম বৈশাখি মেলায় দিব্বি বান্ধবীর হাতটি ধরে হাটছো। খুব নিকটেই ছিলাম তোমার হয়তো চোখে পড়েনি। অথচ একটি সময় ছিলো আমাকে না দেখলে তোমার নাকি ভালো ঘুমই হতোনা। আমি শুভ রাত্রি না বললে ঘুমের ঘরে যেতে না, শুভ সকাল না বললে তোমার সকাল হতো না। আজকাল তুমি ওই দূর আকাশের গল্প হয়ে গেছো, আর আমি?
শত আভিমানের স্তুপের মেঘেঢাকা চাঁদ
আমি কখনোই চাইনি ভুলে যাও। ভালোবাসা নাইবা থাকুক আমাদের মাঝে, তবুও তুমি পাশে থাকো এটুকুই তো চাওয়া ছিলো আমার। বলতে,”ভালোবাসি অনেক বেশি”, তোমার সেই কথার প্রতিধ্বনি গুলো এখনো কানে বাজে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, তুমি বলতে, “যদি সম্ভব হতো তোমাকে নিয়ে চাঁদে পাড়ি জমাতাম”। আরও বলতে আমি নাকি তোমার অভাবী সংসারের আলুভর্তা। আমি হেসে বলতাম কি বাজে বকছো তুমি। সেদিন হয়তো তোমার অভাবী সংসারের আলুভর্তা বলার মূল্যটা বুঝতে পারিনি,তবে এখন বুঝি।
জানো মেঘ, আমি এখন আর আকাশের চাঁদ দেখতে পারিনা, কারণ ওই চাঁদ আমাকে তোমার ছায়ায় পৌছে দেয়।তুমিতো অন্য কারো আলোকিত গল্প হয়ে গেছো, আমি এখনো আধারেই পড়ে রয়েছি। তুমি ঠিকই বলেছিলে,আমি মোহদাসীও বটে। তোমার স্মৃতি গুলো জেকিয়ে ধরে আজ অব্ধি বেঁচে আছি।
আর তো কিছুদিন………….
সে ক’টা দিনও না হয় তোমার স্মৃতিতেই বাঁচিয়ে রেখো। ঔষুধের সাথে ভয়ানক শত্রুতা ছিলো, তবে আজকাল বেশ সখ্যতা হয়ে উঠেছে আমার। সূঁচের নোখ গুলো এখন আর শিরায় আঘাত করতে পারেনা,
হৃদয়ের আঘাতের কাছে এই ব্যথা গুলোকে পিঁপড়ের কামড়ের মতো মনে হয়। একদিন তোমার ডায়েরীতে লেখা “না বলা ভালোবাসা” নামক কবিতাটি চুপিচুপি পড়ছিলাম বলে খুব রাগ করেছিলে,
আজ আমার ডায়েরীর প্রতিটি পাতায় পাতায় তুমি মিশে আছো।
না পাঠানো চিঠি হয়ে আছো ডায়েরীর ভাঁজে, তবে আমার বিশ্বাস একদিন ঠিকই তুমি এই চিঠি গুলো পড়বে। মনে রেখো, আমার সবটুকু জীবন তুমিময় ছিলো, তুমিময়ই থাকবে। ভালো থেকো প্রিয়, অনেক অনেক ভালো থেকো।
ইতি
তোমার, মেঘে ঢাকা চাঁদ….





 "রঞ্জিনীকে লেখা আমার চিঠি"
-শ্রীজাত।
.
রঞ্জু সোনা,
তোমার ই-মেল পড়ি না আর। এই অসীমে
হপ্তা পিছু দশ টাকা যায় ট্যাঁক থেকে
ইংলিশ বাদ। বাংলা চালু। শহরে সব রাস্তা ঢালু
গড়াই, আবার ফিরেও আসি এক ঠেকে।
.
আকাশ ভরা সূর্য তারা, হাওয়ায় তখন কী আস্কারা
বুঝিনি, তাও এগিয়ে গেছি চোখ বুঁজে
ঠেকতে ঠেকতে এখন জানি, দুধ কা দুধ-- পানি কা পানি
জীবনে সব স্টেপ নিতে হয় লোক বুঝে।
.
কে কোন চুলোয় ঘাপটি মেরে কার কফিনে ঠুকছে পেরেক
কে কার ঘাড়ে নল রেখেছে বন্দুকের....
তবু তো প্রেম সর্বনাশী, পুজোর চাঁদা তুলতে আসি
সাহস পেতে সঙ্গে রাখি বন্ধুকে।
.
অসীম কালের যে-হিল্লোলে তোমার বাবা দরজা খোলে
দেখেই আমার প্রাণ উবে যায়,রঞ্জিনী
বিকেল করে ঘুরতে বেরোই,স্টিমার চেপে গঙ্গা পেরোই
আমি... তুমি... দাশকেবিন আর মঞ্জিনিস।
.
বেকার ছেলে প্রেম করে আর পদ্য লেখে হাজার হাজার
এমন প্রবাদ হেব্বি প্রাচীন অরণ্যে
কিন্ত তার আড়ালের খবর? জবরদখল? দখলজবর?
হাজারবার মরার আগে মরণ নেই।
.
কান পেতেছি চোখ মেলেছি যা দেখেছি চমকে গেছি
থমকে পাড়ার মোড়ে রাতদুপুর
ঝাপটাতে ঝাপটাতে ডানা পাখি পায় দৈনিক চারানা
কাপড় কিনলে হয় না মুখের ভাতটুকু।
.
প্রাতঃকৃত্য করছি বসে, এই সময় কে জমিয়ে কষে
লাথ ঝেড়েছে কাজলকালো পশ্চাতে
একেই দু- দিন হয় না, শক্ত, তার ওপরে চোটের রক্ত--
খুব লেগেছে। কিন্তু আমি, বস, তাতে
রাগ করিনি। ক্ষমাই ধর্ম শঙ্খ ঘোষের 'কবির বর্ম'।
গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরছি কলকাতায়
ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছি ....হাত- পা দিয়ে ঘুম তাড়াচ্ছি...
বেঁচে ফিরছি, সেটাই তো আসল কথা।
.
টাকা খুঁজছি নোংরা হাতে, ঠান্ডাঘরে, কারখানাতে
তুমি হতাশ,আমিও শালা বিরক্ত
দেয়াল দেখে খিস্তি করি... কোলবালিশ জড়িয়ে ধরি.....
কান্না আসে। এ কোনদেশি বীরত্ব?
.
বাড়ির লোকের উত্তেজনা-- 'কেন কিছু একটা করছ না'?
যেন আজো বেকার আছি শখ করে।
তবু এমন দেশপ্রেম,যে এমপ্লয়মেন্ট- এক্সচেঞ্জে
নাম লিখেছি সোনাবরণ অক্ষরে।
.
তুমি বরং সেটল করো-- গঙ্গারামকে পাত্র ধরো
ফরেন কাটো। দুঃখ পাব, সামান্যই....
আমায় নিয়ে খেলছে সবাই, সুযোগ পেলেই মুরগি জবাই
তুমি তোমার। আমি তো আর আমার নই।
.
ঢপের আকাশ,সূর্য, তারা.... স্বপ্নগুলো বাস্তুহারা
এবার থেকে নৌকো বুঝে পাল তুলো
আজ এটুকুই। সামলে থেকো, আমায় ছাড়াই বাঁচতে শেখো-
আদর নিও--
.
ইতি
তোমার,
ফালতু লোক।।।







সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম  থেকে সংগৃহিত
১৬/০১/২০
মিরপুর, ঢাকা।
প্রিয় সৌমেন/চৈতালি,
ঢাকা ফিরেই আপনাদেরকে লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু কোথা হতে কিভাবে শুরু করা যায় বুঝতে পারছিলাম না। মানুষের প্রাপ্তি প্রত্যাশাকে ভীষণ ভাবে ডিঙ্গিয়ে গেলেই বোধহয় এমনটি হতে পারে।
ঠিক কতদিন আগে শেষ চিঠি পেয়েছি বা লিখেছি, মনে করতে পারিনা। কলকাতা আমাদের স্বপ্নের শহর। সেখানে থাকবো, ঘুরবো- এ সাধ প্রাণের গভীরে লালিত, বুহুদিন ধরে। কিন্তু আত্মীয়-পরিজনহীন সেই শহরে এমন অভ্যর্থনা, আতিথেয়তা সে ছিল আশাতীত। আমরা অভিভূত, বহুকাল পর! বলছি এ জন্য যে, ব্যস্ততা শুধু ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাচ্ছে এমন নয়, সমহারে কমিয়েও দিচ্ছে আমাদের আন্তরিকতা একের প্রতি অন্যের, প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। সচরাচর চারপাশে যে উচ্ছ্বসিত আন্তরিকতা আমরা দেখতে পাই, তা যেন স্বাভাবিক নয়, তার আড়ালে থাকে অজস্র প্রত্যাশা, দিতে যেটুকু চাই, পেতে চাই তার ঢের বেশি। আপনাদের কাছে যা পেয়েছি তা আশাতীত।
অলোকদা, বলাকাদী, সৃজিতা যাঁদের সাথে দেখা হয়নি কোনদিন, তাঁদের কাছেও যে ভীষণ রকমের আন্তরিকতা পেয়েছি তা অভাবনীয়। আমাদের সকলের অংশগ্রহনে সেই সন্ধ্যা অ’মলিন হয়ে থাকবে, যতদিন বাঁচি।
বোনটির নাম ভুলে গেছি। হয়তোবা তাঁর আন্তরিকতা আর আতিথেয়তায় ঢাকা পড়েছে নাম, সাময়িক। মাসিমা’র পরিণত হাস্যজ্জল মুখশ্রী ভুলবার নয় কোনদিন।
সময় সল্পতায় দেখা হয়নি তবুও টেলিফোনে সেই আন্তরিক আহ্বান কাকা আর কাকিমার! সে শুধু অন্তঃস্থল হতেই সম্ভব।
আবারও ফিরে যাবার বাসনা লালন করছি মনের গভীরে। প্রাণের গভীর থেকে শুভকামনা সকলের জন্য।
ইতি।
আপনাদের গুণমুগ্ধ
আমিনুর




কুর্চিকে লেখা পৃথুদার চিঠি — বুদ্ধদেব গুহ

 

কুর্চি
তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীতের সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনলো। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে, বিবাগী হচ্ছে ভোগী । রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের ধুতির মত এলো এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসিত সমস্ত সবুজ চিৎকারের মত। তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খুত ক্ষমা করে দিও। কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?
সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুম ভাঙ্গলো বড় এক চমকে। এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি- এক জোড়া স্কারলেট মিনি-ভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়।আমার ঘুম ভাঙ্গানিয়া পাখিরা- আহা রোজই যদি আসতো। আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভালো যাবে আমার।
বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা কিছু ইচ্ছা তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহিত থাকে। থাকে না? আজ চিঠি লিখবোনা তোমাকে, তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি, লেখক , কবি না তবুও তার নাম গোপন থাক। কি যে দেখেছিলাম তোমার ঐ মুখটিতে কুরচি। এত যুগ ধরে কত মুখইতো দেখলো এই পোড়া চোখ দু’টি। কিন্তু, কিন্তু এমন করে আর কোনো মুখ’এইতো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেনি। ভালো না বাসলেই ভালো…… বড় কষ্ট ভালোবাসায়।
ভালোবাসাতো কাউকে পরিকল্পনা করে বাসা যায় না। ভালোবাসা হয়ে যায়, ঘটে যায়। এই ঘটনার ঘটার অনেক আগের থেকেই মনের মধ্যে প্রেম পোকা কুড়তে থাকে। তারপর হঠাত’ই এক সকালে এই দুঃখ সুখের ব্যাধি দূরারোগ্য ক্যান্সারের মতই ধরা পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রনার সংগে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন। কেউ যেনো কাউকে ভালো না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পরে। …। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রণার সংগে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন। কেউ যেনো কাউকে ভালো না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পরে। হুস থাকলে এমন মূর্খ্যামী কেউ কি করে, বলো? সে জন্যে বোধহয়, হুসের মানুষদের কপালে ভালোবাসা জোটে না। যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তাঁরাই ভালোবেসে সব হারাতে পারে। অথবা অন্যদিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, যাকিছুই সে পেয়েছিলো বা তাঁর ছিলো, সেই সমস্ত কিছুকেই অর্থবাহী করে তোলে ভালোবাসা। যে ভালোবাসেনি তাঁর জীবন বৃথা। তবুও বড় কষ্ট ভালোবাসায়। এমন মহা বোধ আর কি আছে?
স্বপ্নহার,
তোমায় পাঠাই….
নীল নদীটির নিবিড় পাড়ে,
ঘুম পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে অলস পায়ে,
যখন হাটে মাঘী মাঠের ন্যবা ধরা শুন্যতাতে
ঠিক তখনই আমার বুকের গভীর থেকে
স্বপ্নগুলো ঝাপটে ডানা
অস্ফুটে কি কইতে কইতে নড়েচড়ে!
….
স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়,
আমার স্বপ্ন; সবার স্বপ্ন।
তবুও আমি স্বপ্ন দেখি
রুপের রাজা, গুনের গুনীন,
মুঠির মাঝে মুক্ত মলিন,
সব পাখিদের মুগ্ধ করা মন্ত্র নিয়ে
আসবো ফিরে বারে বারে।
আমার কিছু স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন নিয়ে মালা গাঁথি
স্বপ্ন মালা।
ছিপছিপে সেই মেয়ে, ছিপছিপে সে।
শ্যামলা বরণ প্যাঁচ গুছি শাড়ি
তার স্বপন পুরে বাড়ি, আমার সংগে আড়ি।
স্বপ্নে দেখা নারী, প্যাঁচ গুছি শাড়ির আঁচল
ঠোটের কনে তিল, স্বপ্ন মালায় গেঁথে গেল
হরিণ চিতা চিল।
স্বপ্নে আমি ভেবেছিলাম অনেক কিছুই-
ভেবেছিলাম এটা করবো, সেটা করবো।
বাড়ি করবো, পাহাড় চুড়ায় স্বপ্ন এবং সুখের কুটো দিয়ে।
পায়ের কাছে বইবে নদী নারীর মত, সাধের নারী
বাধ্যতা আর নাব্যতা’তে নীল।
স্বপ্ন উড়ে স্বপ্ন উড়ে বারে বারে।
কুর্চি, দেখি কি করতে পারি? তোমার সাথে বেড়াতে যাবার। ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। এই জীবনে ক’টি ইচ্ছে পুণ্য হয় বলো? কারই’বা হয়? এমনিতে আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে আর কষ্ট বাড়িও না। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেঁচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক বিবশ হলেই বাঁচি।
ভালো থেকো
তোমার পৃথুদা


(মাধুকরী উপন্যাস থেকে সংকলিত)







চিঠি 

 ফয়সাল


প্রিয়তম মননের মায়াবতি,
যখনি মনের মাঝে নদীর স্রোতের প্রবাহ প্রকট হয়, তুমি যেন পূর্ণিমার আলো হয়ে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করার সর্বোচ্চ কাজটাই করো তখন। আজো হয়তো তেমনি এক লগ্নে তোমায় আবার বারবার করে মনে পড়ছে আমার। আচ্ছা, তোমারো কি এমনি করে আমায় মনে পড়ে? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, আগের মতো এখনো কি মাঝেই মাঝেই তোমার মন খারাপ হয়? প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে তোমার কি আজো হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, প্রকৃতিরি বুকে? এখনো মাঝে মাঝে কি জানালার পাশে উদাস হয়ে বসে থাকো?

আচ্ছা, তোমার জানালার ধারে গাছের ডালে বসে ঘুমানো সেই পাখিটা কি আজো আছে সেখানে? সে কি এখনো ডানার মাঝে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে? তুমি কি এখনো মায়া ভরা চোঁখ নিয়ে তার ঘুমের মাঝে সৌন্দর্য্য খুঁজে পাও? তোমার কি মনে পড়ে, আমি তোমাকে বলেছিলাম পাখিটার জোড়াটা কে খুজে বের করার জন্যে? তুমি তখনি চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু পাওনি। আজো কি মাঝে মাঝেই সেই জোড়াটাকে খুজতে ইচ্ছে হয়?
হয়তো হয়, হয়তো হয়না অথবা হোক এটা তুমি আজ আর চাওনা। আমিই বা কেমন করে তোমায় আজো আগের মত তেমন করে ভাবি, যেমন করে ভালবেসে ফুলটা দেখি, চাঁদটা খুজি অথবা মাতাল হাওয়ায় ভালবাসার গল্পবুনি। তুমি হয়তো তেমনটি নেই, যেমন ছিলে একটা সময়। আমিও যে তার জন্যে খুব হতাশ, বিশ্বাস কর তা কিন্তু নয়! আমি বরং বিশ্বাস পেয়েছি, কোন কিছু দূরে চলে না গেলে তা কতখানি কাছে ছিলো তা কখনো জানাই হয়না। তেমনি করে তোমাকে আরো অধিক পেয়েছি যেন আমার প্রতিটি ভাবনায়। পেয়েছি বলছি কেন, পাচ্ছিইতো। অনবরত আমায় আমার মাঝের তুমিকে জানান দিচ্ছো তুমি। বাহ, চমৎকার পারোতো! কেমন করে যত্নকরে আমায় এত কষ্টে রাখো?
প্রিয়মুগ্ধ, তোমায় আমি যেমন করে সহজভাবে মনের কথা বলতে পারি তেমন করে আর কাউকে নয় কেন? সেটাই আমার বড় ভাবনা। পথ চলি, কাব্যকথার ঝোলা খুলি, কথার পিঠে কথা বলি। তবু মনেহয়, সে কথাগুলো আর বলা হবেনা যে কথাগুলো বলা হয়ে গেছে। নতুন কথা আর কি নিয়ে হয়, প্রেমের জন্যে প্রেমইতো চাই নাকি? চঞ্চল মন কাউকে চুপ করিয়ে জমানো আসরে বসিয়ে রাখার চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে, বল? ভয়ানক ক্ষুধার্ত একজন মানুষ খাবার সামনে পরিবেশিত দেখেও যদি তা গ্রহন করতে সংকোচ বোধ করে, তবে তার মনের জাতটাকে তুমি কোথায় ফেলবে? স্বস্তি না পেলে কি শ্রান্তি লাভের যৌক্তিকতা আছে বল?
ভালবাসলে নাকি নারীরা হয়ে যায় নরম নদী, পুরুষরা হয়ে যায় জ্বলন্ত কাঠ। আমি হয়তো জ্বলা-পোড়া ক্ষেপা কাঠই ছিলাম, না হয় ভালবাসা প্রাপ্তির জেদ আমায় ধরেই বসেছিলো। ধরেনিলাম, ক্ষেপা জ্বলন্ত আগুনে কেউ নাহয় তখন আরেকটূ কেরসিনের ঝাপটা দিয়ে গেছে। যার ফলে হয়তো, পোড়া কাঠটাও ধপ করে আবার জ্বলে উঠলো। এই মায়ারাণী, তুমি কি জনতেনা যে ক্ষেপা মানুষকে কিভাবে শান্ত করা যায়? তোমার মাঝে কি নরম জল ছিলো না? তুমি কি ভালবেসে নরম নদী হওনি? তবে কেন তোমার মায়ার জলে ভাসালেনা আমায়?
ক্ষেপা কাঠ, কেরোসিনের প্রকোপে অস্থির হয়ে জ্বলতে জ্বলতে দেখে সে আবার শুকনো কাঠটাই আছে। কেরোসিন তার ভেতরে আসেনি, তার আগুনটাকে বাড়িয়েছে মাত্র…
জানো মায়াবতি, মাঝে মাঝে একা হয়ে গেলে আমি পাগল বুনে যাই! সব আজব সত্য দার্শনিক তত্বগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। মাঝে মাঝে নিজেকেই নিজে বকাবকি করি, এমন অপ্রিয় সত্যগুলো সমাজে প্রকাশ করে দেয়া মানেই মানবের চরিত্র হননের সমতুল্য। গতকয়দিন আগে এক ভাবনা এলো মনে, দেখলাম পৃথিবীতে প্রেম-ভালবাসা বলতে নর-নারীর জন্যে কিচ্ছু নেই সবই কথা-গান-কাব্য কিংবা সাহিত্যের ফুলঝুড়ি মাত্র। আসল প্রেমটা হল……. আচ্ছা, থাক অনেক নিষ্ঠুর রকমের কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। আমি কোন নিষ্ঠুরতার মাঝে নেই, কথা-গান-কাব্য কিংবা সাহিত্যের প্রেমটাই আমি তোমা হতে চাই। সত্যিও যদি না ভালবাসতে পারো, তবে করুনা করে একখানা পত্রোত্তর দিও। তোমার মায়া নদীর শীতল জলে মনের জ্বালাগুলো আমি মেটাতে চাই। যদি ভালবাসা পাই, আবার শুধরে নেবো জীবনের ভূলগুলি…
দহনযোগ্য আগুনের শেষ কাঠ

তোমার কবি।




সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম  থেকে সংগৃহিত 

 বধুর জন্য


প্রিয়তম প্রেয়সী আমার,
তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি এটা জানার কৌশল হিসেবেই তুমি আমার কাছে একখানি চিঠি চেয়ে বসলে কি-না আমি জানি না, তবে আমি এতটুকু জানি তুমি ঠিক হাতিয়ারটিই ব্যবহার করেছো। চিঠি এমন একটি উপায়, যেখানে ভেতরের কথাগুলো আর ভেতরের থাকে না, প্রতিটি অক্ষর প্রকাশ করে দেয় হৃদয়ের রূপকে। তোমায় লেখা এটিই বোধহয় আমার প্রথম পত্র, কেবল পত্র বলছি কেন? অবশ্যই প্রেমপত্র লিখছি।☺️
প্রিয়তম বধু আমার, আমি তোমাকে অতীতে কতটুকু ভালোবেসেছি আমি জানি না। তবে এতটুকু জানি, যতটুকু বেসেছি আমার সামর্থের অতি অল্পই তা! এর চেয়ে অনেক বেশিগুণ তীক্ষ্ণ ও তীব্র প্রেম লালন করি আমি। আমার কোমল প্রেম পাচ্ছো তুমি গত বছর খানেক, জানিনা কতটুকু কোমল উষ্ণতা অনূভব করেছো বা করছো। আর তীব্র প্রেমগুলো অপেক্ষা করছে তোমার সামনের দিনগুলোকে রাঙাতে, হলি খেলতে জানোতো বউ?
তুমিতো জানো, আমি আমার আপন স্বভাবে চলি। প্রশ্ন করতেই পারো- বিয়ের বয়স প্রায় পাঁচ পেরোয়, এখনো নাকি আসল প্রেমের সূত্রপাতই হয়নি! তাহলে এতদিন তুমি পেয়েছোটা কি?
ঠকেছো হয়তো!
আরে আরে এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নাই!! এতদিনে আমার আদর্শগুলোতো বুঝেছো? সেই ভালো, এবার আমার আসল প্রেমের রূপটাকে বুঝবে, খারাপ কি? জানোইতো আমি সাধারনত্বকে ধারন করি না, হয় অসাধারন কিছু পাবে নয়তো অতি সাধারন কিছু, তবু সাধারনের মত নয়। নিকট ভবিষ্যতে কি পাবে এটা নিয়ে যদি এখনি তোমার মধ্যে টেনশন কাজ করা শুরু করে, তবে তোমাকে শিতল কিংবা আশাবাদী হওয়ার মত একটা জবাব দিচ্ছি- এতদিন তুমি কিছুই পাওনি!
প্রিয় অর্ধাঙ্গী আমার, তুমি দিনে দিনে আরো পরিপক্ক বধু হয়ে উঠছো। সংসার করছো, এমন গোঁয়ার স্বামী এবং ডায়নামিক সংসার সামলাচ্ছো। তুমি আসলেই পরিনিতা হয়ে গেছো? তুমি কি শরৎ বাবুর গল্পের পরিনিতা না তার চেয়েও ডের জীবন্ত আমার অর্ধাঙ্গী পরিনিতা?
তুমি নিশ্চয় জানো, আমি ঠোঁট কাঁটা মানুষ। এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি কাকে বিশ্বাস করি জানো? আমার নিজেকে! আর আমিই তোমাকে বলছি- আমি তোমাকে অত্যন্ত বেশি ভালোবাসি, অনেক অনেক বেশি। যা আগের তোমার চেয়ে কয়েক কোটি গুণ বেশি!
অতি প্রকাশ প্রেমের মূল্যবোধ নষ্টকরে, এর চেয়ে বেশি প্রকাশ করা যৌক্তিক মনে করছি না। আশির্বাদ করি আমৃত্যু আমার বামবুক শুধুমাত্র এবং কেবলমাত্র তোমার জন্যই যেন থাকে, পৃথিবীর সমস্ত সুগন্ধি ফুলের সমাবেশ যে বাগানে হয় সে বাগানেই সৃষ্টিকর্তা যেন তোমার আমার শেষ জীবন দান করেন। তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে উঠো আমার 
 জীবনের প্রতিটি সকালে।

ইতি— তোমার একমাত্র প্রেমিক পুরুষ।




কাজী রাহনুমা নূর
চিঠি
****
বহুদিন পর আবারো লিখতে বসলাম। ঘুম আসছে না। এইতো কবছর আগেও ঘুমহীন রাত মানেই, তুমি ছিলে। চাপা গলায় ফোনে ফিসফাস, রাগ অভিমান, মা বাবা জানলে কি কি হতে পারে এসব নানান ভাবনায় ঘুম যে কোথায় পালাতো। অথচ সকালে নির্ঘুম রাতের কোন ক্লান্তি চেপে ধরতো না। তোমায় কল্পনায় ছুঁয়ে থাকার মাঝেই কি এক অদ্ভূত বিশ্রাম ছিলো। মুখ ধুতে গিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখতাম ওখানে তুমি, মিটিমিটি হাসছো। রুটির প্লেটে আলু ভাজা গুলোর পাশেও তুমি, আদর করে আমায় খাইয়ে দিচ্ছো, চুল আঁচড়ানোর চিরুনীটার প্রতি দাঁতে ও তুমি, জট লাগানো চুল গুলো নিবিড় মমতায় খুলে দিচ্ছো। তুমি ছিলে আমার পুরো ঘর জুড়ে। পড়ার টেবিলে, পর্দার ঝুলে, সিলিং ফ্যানের ঘুর্ণিতে এমন কি আমার বইয়ের প্রতি পাতা জুড়ে। কিন্তু অন্য শহরে থাকা এই তুমি টা যখন সামনে এসে দাঁড়াতে তখন তোমার চোখে চোখ রাখা কি যে কঠিন পরীক্ষা ছিলো। পৃথিবীর সব লজ্জা আমার চোখের পাপড়ি, কানের দুল আর ঠোঁটের কিনারটা ধরে দোল খেতো। এত এতদিন যে দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম সে দিন টি, সেই মূহুর্তটি তেই কেন যে অমন উদ্ভট আচরণ করতাম আমি? তা ভেবে আজো কষ্ট পাই খুব।
মনে পড়ে? ডিসি হিলের জিলাপি পাহাড়ে কলেজ ফাঁকি দিয়ে দেখা করতে গেলাম যেবার, তুমি একটা হাল্কা নীল শার্ট পড়েছিলে,আমার প্রিয় রঙ। কি যে ভালো দেখাচ্ছিলো তোমায়। হাতে হাত রেখে পুরো একটা ঘন্টা আমরা এদিক ওদিক হেঁটেছি, চিনাবাদাম, চানাচুর আর ঝাল মুড়ি আমাদের আপন করে নিলো। কোন কথা হয়নি সেদিন, তবু ওইদিন টাতেই আমি তোমাকে সবচেয়ে কাছে পেয়েছিলাম। আমাদের আঁকড়ে ধরে থাকা হাত দুটো মনের আনন্দে বলে গেছে সব না বলা কথাগুলো। রবি ঠাকুর কি এমন কোন মূহুর্তেই লিখেছিলেন 'অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলি। '
মনে পড়ে, শেষ জন্মদিনে তুমি তেরোটা লাল গোলাপ নিয়ে হাজির হয়েছিলে কলেজের গেইটে। সে গোলাপ হাতে নিয়ে আমি দিশেহারা , বুঝছিলাম না কাকে লুকাই, তোমাকে না আমার হাতে ধরে থাকা লাল গোলাপ গুলোকে। সারা শরীর জুড়ে তখন হাজার পাখির কিচির মিচির, বুক ঢিপ ঢিপ, গলা শুকিয়ে কাঠ ।
এখন প্রায় ভাবি তুমি কেন সে বছর ঠিক তেরো টা গোলাপ দিয়েছিলে? তুমি কি জানতে নভেম্বরের তেরোতে আমি অন্য কারো হয়ে যাবো? তুমি কি জানতে সেই তেরোটা গোলাপ, তুমি হয়ে সারাজীবন আমার কবিতার বইয়ের পাতায় লেপ্টে থাকবে?
দুজন দুজন কে না পেলে বাঁচব না এমন টাই তো ভাবতাম। অথচ দেখো এই আমি, সংসার গুছিয়ে চুল বাঁধি, পরম মমতায় প্রিয় কারো পাতে ভাত তুলে দিই। কাছের মানুষদের অমঙ্গল চিন্তায় কেঁপে কেঁপে উঠি।
তবে খোঁপায় কারো নামে আর বেলী ফুলের মালা জড়ানো হয় না, অকারণে মায়ের সাথে মিথ্যে বলা হয় না। আয়নায় তাকিয়ে আধ পাকা চুলের হেরে যাওয়া এই আমিকে ই দেখি কেবল, সেখানে তুমি নেই, নেই সেই মিটমিটে হাসি।
রাত তিনটা বাজে। আজ কতদিন পর তোমায় ভেবে রাত জাগা, তোমায় ভেবে এলোমেলো লেখালেখি, তোমায় ভেবে মরু চোখটায় অসময়ের বন্যা।
কোথায় আছো তুমি?
কোন নির্ঘুম রাতে মনে পড়ে আমায়?
পড়ে মনে?
তোমার রোদ্দুর

++++রাহনুমা






একটি চিঠি (কবিগুরুকে লেখা “খোলা চিঠি”)




প্রিয়তম,
আমার একান্ত আপন, আমার একাত্ম ছন্দ । তোমার মনে পরে ? মুখের কথা ফোটার সাথে সাথে তোমার হাত ধরে আমার চলা ।
এইতো সেদিন আমরা তখন ছোটো , তোমার সঙ্গে তোমার গানে ছন্দে ছন্দে নেচে চলেছি  মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি…’ কি অসাধারণ ছুটি উপভোগ ।
শহরের মেয়ে আমি, আমাকে কত সহজ করে নদী চিনিয়ে দিলে তুমি ‘আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে…’ , এঁকে ও লিখে ।
তুমি না হলে যে আমার দিন শুরু হয় না । তোমাকে বুকে নিয়ে আমার অলস দুপুর… তোমার কবিতা আমার চলার পথের পাথেয় ।
যখন স্কুলে পড়ি আমার উদাত্ত কন্ঠ, আমি আবৃত্তি করছি ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রানের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান ’…আকুন্ঠ প্রশংসা পেয়েছি, হাত তালি কুড়িয়েছি। মুর্খ আমি, ভুলে গেছি, এ আমার কৃতিত্ব নয়, এ যে আমার দেবতার দান । তাঁরই সম্পদ, আমি ভাঙ্গিয়েছি।
আমি অক্ষম আঁতুর , তুমি আমার জীবনের অক্সিজেন আমার বেঁচে ইচ্ছা ।
আমি যাইনি শেলী, কিটস্’দের দলে । আমার নাটকের ঘাত প্রতিঘাত তুমি, প্রেমের আলিঙ্গনে তুমি, বিরহের মাধূর্যে তুমি ।
‘আমার মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি / তোমার লাগিয়া তখনি বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি ।’
ওগো প্রেমিক,ওগো চির বসন্ত,বাকি আমি রাখব না কিছুই – তোমার চলার পথে পথ ছেয়ে দেব ভুঁই’’।
‘মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন তব চরণ তলে শুভ লগন গেল চলে,’… ।
‘বাণী মোর নাহি,স্তব্ধ হৃদয় বিছায়ে চাহিতে শুধু জানি ’।
তুমি জান না তুমি কিচ্ছু জান না , তোমার গান আমার মোহন বাঁশি, বাজিয়ে চলেছো শয়নে জাগরনে , বিরহে ব্যথায় , ক্লান্তিতে শক্তিতে , একাকিত্তের পূজায় , জন্মতে মৃত্যুতে।
মহাভারত সম তোমার রচনাবলী আমার হাতে দিয়ে গেলে , সময় কোথায় যে স্মরন মনন করবো, আমি যে বাঁচার লড়াইয়ে হাতিয়ারহীন সৈনিক ।
মধ্যদিনের সূর্য গন গন করছে , একা আমি…তৃষ্ণার শ্রান্তি তুমি…হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চল…গোধুলির দিকে ।
আমরা আবার গান গাইসেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনা
ওগো কবি আমার কাঙাল মন যে কেঁদে কেঁদে বলে‘দূ্রে কোথায় দূ্রে দূরে আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে । যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে ।’ আমার তনুতে অনুত, শুধু তোমার পরশ, শুধু তোমার উপস্থিতি ।
হে আমার হৃদয়ের দেবতা কবি রবীন্দ্রনাথ তুমি চিরকাল সমারোহে থাক । তোমার শুভ জন্মের দেরশ বছরের ও বেশি আমরা পেড়িয়ে এসেছি । আরও শত শত বছর পরেও তোমার ঔজ্জ্বল্ ম্লান হবে না সে আমার দৃঢ় বিশ্বাস । যুগে যুগে তোমার সুর তোমার রচনা সর্বলোকে দাপিয়ে বেড়াবে ।
আমি ক্ষীণ তৃণ, তোমাকে অবলম্বন করে পৃথিবীর বাকি কটা দিন নাহয় কাটিয়ে যাব । নিজেকে দৃঢ় করে, বলব‘নিবিড় ঘন আঁধারে জলিছে ধ্রুবতারা মন রে মোর পাথারে হোসনে দিশেহারা ।’
ওগো জীবনবল্লভ শক্তি দাও । অন্তকালে যেন বলতে পারিমরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান ’।
তোমার পায়ে সহস্র শুভ্র কুসুম নিবেদনের সাথে সহস্র প্রনামান্তে
ভাগ্যহীনা ..রিয়া

#চিঠি

ফারহানা নীলা

শুভঙ্কর,
তোর মনের ঠিক কোন কোণাটায় আমার বসত! সেটা জানার জন্য আমি কতটা পথ হেঁটে এসেছি একা! ওখানে সরু পথের দুধারে ঝুলে ঝুলে আছে রক্ত করবী, জারুল, সোনালু, সোনাইল আর কৃষ্ণচূড়া। সব রঙ একেএকে জড়িয়ে নিজেকে আমার রঙধনু মনে হয়। বিশাল আকাশে ক্ষণিক রঙের রেখা; রোদ আর জলের আলপনা আঁকা। হঠাৎ মিলিয়ে যায় রঙধনু, ঠিক যেমনটি আমি হারিয়ে যাই তোর মনের অলিতে গলিতে! আমার তো জানা হলো না শুভঙ্কর! কোন কোণাটায় আমার বাস।
জানিস শুভঙ্কর আজকাল আমার বড্ড জল হতে মন চায়। কেন বল তো? জলের বহমান ধারায় আমি লিখে রাখি তোর কথা, আমার কথা, আমাদের কথা। সৈকতে পা ভিজিয়ে আমি জলের কল্লোলে চিৎকার করে কথা বলি.... না বলা কথাগুলো সাগরের গর্জনে ক্রমশ ফুঁসে ওঠে। ফুসমন্তরে আমি জল আর আকাশের সঙ্গমস্থলে পৌঁছে যাই। অথবা মরা ইছামতির কানে কানে বলি একদিন ঢেউ ছিল, জল ছিল, ভাঙনের কান্না ছিল। হয়তো ইতিহাসের বুক চিড়ে টেনে আনি জলোচ্ছ্বাস ; জীবনের বাকী গল্প! আবার কখনো পাহাড়ের কান্না ছুঁয়ে ঝর্ণাজলের স্বচ্ছতা নিয়ে টলমল করি!

এমনটাই তো তুই চেয়েছিলি শুভঙ্কর! এটাই তো বোধ করি চেয়েছিলি! নিত্যপূজা আমার জলেই হোক; আরতি আমার জলেই হোক!
আমি বয়ে বেড়াই শ্রাবণ শোক!
জলের কাছে রেখে এলাম আমার ঠিকানা, জলের বুকে এঁকে এলাম আমার গোপন ব্যথা; তোর অজানা!
আজকাল আমি জল হয়ে যাই শুভঙ্কর, আমি জল হয়ে যাই।
জলে কোনো দাগ থাকে না,
জলে কোনো শেকড়ের টান থাকে না।
বহতা জলে কোনো কিছুর ছাপ থাকে না; জলের ধারা নিম্নগামী জেনেছি যখন.... তখন থেকেই আমি জল হয়ে যাই শুভঙ্কর!

জলের নিনাদ, জলেই বিবাদ, জলের কাছেই আমার নিত্যপূরাণ!
জলেই ভাসি, জলেই ডুবি, জলেই কাঁদি; জলের কাছেই আমার বুকভাসান!
জল জল হাহাকারে তবুও আমি প্রদক্ষিণরত তোর চারিপাশে; এত জল ধরেছি এই বুকে, কত জল রেখেছি এই চোখে.... একবার এসে মেপে যাস শুভঙ্কর! মরবি না তুই, মরবি না ডুবে.... ডুবোজলে! তবে নোনতা স্বাদে হয়তো তোর বিস্বাদ হতেও পারে! শুভঙ্কর তোর জন্য আজ আমি কেবলই জল, জল হতে হতে হতে...
থাক নাই বা বলি এসব! বরঞ্চ আয় জলের বুকে আঁকিবুকি কাটি.... ভয় নেই কোনো দাগ, কোনো ছাপ থাকবে না ওখানে। পাছে কেউ দেখে ফেলে; ভাবছিস বুঝি! জল তো বয়ে যায়, বেয়ে যায়.... আমারই মতন, আমারই মতন!

ইতি...
নন্দিনী

#নীল_কথন
১৫/০৭/২০১৯
©ফারহানা নীলা



এই তো বেশ আছি
-শরৎ কুমার
বন্ধুবরেষু সুকুমার,
তোর চিঠি পেলাম,
সাথে দু’কপি ফটোগ্রাফ।
আইফেল টাওয়ারের পাশে বসে
তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে দিয়েছিস।
উন্নত দেশের হাওয়ায়
তোর গাল দুটো ফুলে গেছে,
তা বেশ আছিস- বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না।
আমার দেশটাকে তোর কখনও ভালো লাগেনি,
তাইতো অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পাড়ি জমালি ওপারে।
সিটিজেনশীপ হওয়ার পর তেত্রিশ ইঞ্চি বুকটা
বেয়াল্লিশের মত লাগছে। বেয়াল্লিশ মাইনাস তেত্রিশ
বাকি নয় ইঞ্চি মনে হয় অহংকার।
আমরা আছি শরৎবাবুর মহেশের মত।
উপোষ থাকি, ঘরের চালের খড় খাই
বাবুদের বাগান তছনছ করে খোয়াড়ে যাই।
আমাদের গফুর আছে, আমিনা আছে।
এখন আমিনাদের দেহ পাটকলে খোয়া যায় না
বড় বড় ফার্ম, অফিস কিংবা ফাইভস্টার হোটেলেও।
না আমার চাকরি হয়নি।
রোজকার মত ব্যাংকড্রাফ্ট সমেত দরখাস্ত লিখছি
আর মামা খালুহীন ভাইবা নাটকে বরখাস্ত হচ্ছি।
পাড়ার মোড়ের অনিলের দোকেনের বিখ্যাত পানসে চা
আর পাতার বিড়ি টেনে সময়ের জাবর কাটি।
শালা অনিলটাও ফালতু হয়ে গেছে জানিস
চা’য়ে একটু চিনি দুধ চাইলেই বলে কিনা-
‘আগে মালপানি ছাড়ুন দাদা, বাকী আর কত দেবো’।
তুই বল এ বয়সে মা’র আঁচল কেটে আর কত বের করা যায়।
সতীশটা এখন বেশ আছে। রাজনীতি করে।
সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতার একটা হাত।
ডান বা বাম বুঝি না, নেতাদের তো অনেক হাত,
মা দুর্গার চেয়েও… এতে সতীশের নাম্বার কত বলা মুশকিল।
তবে এটুকু দেখি মহল্লার পঞ্চায়েতে ওর ডাক আসে।
নিউ মার্কেটে এপাশ ওপাশ করলেই ফাঁকা ব্যাগটি
স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে জৌলুসে।
বুড়ো হাবড়াগুলোও নমস্কার জানায় মাথা নুয়ে।
কঞ্জুস অনিলটাও একটা ফাইভ ফিফটি ফাইভ ধরিয়ে দিয়ে
কেবলা হেসে বলে-‘দাদা কড়া একখানা চা করে দিই’।
কাপ আর চামিচের টুংটাং শব্দ ঢেউ তুলে চা সমুদ্রে।
ধুমায়িত গরম চা খেতে খেতে সতীশ বঙ্কিম ঠোঁটে
আমাকে বলে-‘কি রে এবার একটু সাবালক হ,
ওসব তো এখন ফাইভ সিক্সের ছেলেরা টানে-টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে’।
পাতার বড়ির সাথে সাবালকের কি সম্পর্ক তা আমি জানি না।
সতীশরা আমাদের এভাষায় কথা বলে।
গত মাসের ২৫ তারিখে মন্টুদা’র শবদাহ হলো
মৃত্যুদূত এ কর্মটি সম্পদান করতে পারেনি।
তবে ভাবছিস-হত্যা, তাই না? না হত্যা নয়, আত্নহত্যা।
পৃথিবীর দুই সফল মানুষ নীল আর্মষ্ট্রং এবং কবি বায়রন
একজন দেখেছে চাঁদ অপরজন নারী।
এমন জীবন্ত পূর্ণিমা শশী, লাবন্যময়ী দেবযানি
ওরা কি দেখেছে- যিনি সহধর্মিণীরূপে
শোভা বর্ধন করে মিন্টুদা’র বাহুডোরে?
সেদিন প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো ওরা
পিস্তলের মুখে ছিনতাই হলো বউদি।
নিমগাছের তলায় পালা করে ওরা ঠেকিয়ে রাখল মন্টুদাকে
বৌদিকে ফেরত দিলো ঘন্টা খানেক পরে।
নিথর নিস্তব্ধ মন্টুদা যেন একখন্ড বরফ টুকরো।
যাবার সময় গুন্ডাগুলো মন্টুদার নাদুস নুদুস গালদুটো
টেনে বলেছিল-‘এমন খাসা মালের স্বত্বধিকারি হতে হলে
পুরুষ হতে হয় বুঝলে খোকা বাবু’?
লজ্জায় ঘৃনায় সেই বরফ টুকরো
এত হিম-শীতল হয়েছিল যে
তাকে গলাতে শ্মশানের চিতায় পোড়াতে হলো।
আমি জানি না এতে মিন্টুদা পুরুষ হলো, না কি কাপুরুষ?
তুই চিঠিতে লিখেছিস এদেশে থেকে সস্তা জীবনের
বস্তাপঁচা স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট না করে
ইংলান্ড যাবার চেষ্টা করি,
সব রকম সাহায্য তুই করবি।
আমি জানি, তুই আমার জন্য সব করবি।
কিন্তু সুকুমার, তোদের ইংলান্ডেও
বোমা বিস্ফোরণে মানুষের মৃত্যু হয়।
সিকিয়্যূরিটির দুর্বলতায়
আমেরিকার টুইনটাওয়ার পর্যন্ত ধ্বংস হয়,
উন্নত দেশের আগ্রাসননীতিতে
শোষিত হয় ছোট দেশগুলো,
বিদ্ধস্ত হয় ইরাক আফগানিস্তান। তোরাও দূর্নীতি করিস,
ইলেক্ট্রনিক মিডীয়া ফল্ট করে ভোটে জিতিস।
তোদের দেশেও মিন্টুদা’রা আত্নহত্যা করে,
বৌদিরা হয় ধর্ষিতা,
আর সতীশরা হয় হন্তারক চাঁদাবাজ।
সারা বিশ্ব যখন একই, তখন কি লাভ
অন্যদের পোষ্যপুত্র হয়ে বেঁচে থাকা?
আমার এ পোড়া দেশটাতে এইতো বেশ আছি;
এখানে মানুষ অরণ্যে-
আমি মানুষ খুঁজে বেড়াই-মানুষ হবার জন্য।
মা’র আঁচল কাটি, অনিলের দোকানের পানসে চা খাই, আর
পাতার বিড়ি টেনে টেনে সতীশের ভাষায় সাবালক হতে হতে
শ্মশানটাই হোক আমার শেষ গন্তব্য।
 
 
 
 
 

পুনশ্চঃ আমি মরে গেলে,আমাকে তুমি ‘আকাশ’ বলে ডেকো।
রাবেয়া
খোকা,
গত পরশু সন্ধ্যাবেলা পৌঁছেছি এখানে । ষ্টাশনে স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট এসেছিলেন নিজেই । ভারী ভালো মানুষ । সারাক্ষনই মা মা বলে ডাকছেন । তাঁর নিজের টাকার স্কুল, নিজের জমির উপর দোতলা স্কুল ঘর । নিজের সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দিয়েছেন বলেই প্রতিটি জিনিসের ওপর অসাধারন মমতা । আর যেহেতু আমি স্কুলের একজন কাজেই তাঁর ভালোবাসার পাত্রী ।
ট্রেন থেকে খুব ভয়ে ভয়ে নেমেছিলাম । নতুন জায়গা কাউকে চিনি না, জানি না । কিন্তু তাঁকে দেখে সব ভয় কেটে গেলো । কাউকে কাউকে দেখলে মনে হয় যেন অনেক দিন আগে তার সঙ্গে গাঢ় পরিচয় ছিল, ঠিক সে রকম । তিনি প্রথমে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন । বাসায় তিনি আর সুরমা এই দু’টি মাত্র প্রানী । সুরমা তাঁর মেয়ে । রাতের খাওয়া সেরে তিনি আমাকে হোস্টেলে পৌছে দিলেন । সতেরোজন ছাত্রী থাকে সেখানে । আমি হয়েছি তাদের হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট । ছোট্ট একটা লাল ইঁটের দালান । সামনে গাঁদা ফুলের এক টুকরো বাগান । পেছনেই পুকুর । সমস্ত মন জুড়িয়ে গেছে আমার ।
খোকা, তোদের সঙ্গে যখন থাকতাম তখন এক ধরনের শান্তি পেয়েছি, এ অন্যধরনের । এখানে মনে হচ্ছে জীবনের সমস্ত বাসনা কামনা কেন্দ্রিভূত হয়ে গেছে । আর বেশি কিছু চাইবার নেই । কাল রাতে ছাদে বসে ছিলাম একা একা । কেন যেন মনে হলো একটু কাঁদি নির্জনে । মার কথা ভেবে, রুনুর কথা ভেবে দু’এক ফোঁটা চোখার পানি ফেলি । কিন্তু একটুও কান্না আসলোনা ! কেন কাঁদবো বল ? প্রচুব দুঃখ আছে আমার । এত প্রচুর যে কোন দিন কেউ জানতেও পারবে না । কিন্তু তবুও আমি খোকার মতো ভাই পেয়েছি, কিটকির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে যে ভাই আমাকেই সান্ত্বনা দিতে আসে । রুনু, ঝুনু, মন্টু, নিনু এরা আমার পারুল বোন চম্পা ভাই । চারদিকে এমন চাঁদের হাটে কি কোন দুঃখ থাকে ? মন্টু একটি কবিতার বই উৎসর্গ করেছে আমাকে । সবগুলো কবিতা হতাশা আর বেদনা নিয়ে লেখা । আমার ভেতরের সবটুকু সে কি করে দেখে নিল ভেবে অবাক আমি । সেই সে দু’টি লাইনঃ
দিতে পারো একশো ফানুস এনে ?
আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই ।
যেন আমার বুকের ভতরের সুপ্ত কথাটিই সে বলে গেছে, দোয়া করি মস্ত বড় হোক সে ।
এমন কেন হলো খোকা ? সব এমন উল্টে পাল্টে গেলো কেন ? রুনুটার স্মৃতি কাঁটার মতো বিঁধে আছে । আমাদের হোষ্টেলের একটি মেয়ে সুশীলা পুরকায়স্থ, অবিকল রুনুর মতো দেখতে । তাকে কাল ডেকে অনেকক্ষন আদর করেছি, মণ্টুর কবিতার বই পড়তে দিয়েছি । সে বেচারী ভারী অবাক হয়েছে । সেতো জানেনা, তাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে সারারাত কাঁদবার কি প্রচন্ড ইচ্ছাই না হচ্ছে!
নিনুটার কথাও মনে হয় । এতো অল্প বয়সে কি ভারিক্কি হয়েছে দেখেছিস? আমি যেদিন চলে আসবো সেদিন দুপুরে সে গম্ভীর হয়ে একটা সুটকেস আমার বিছানায় রাখলো । আমি বললাম,
কিরে নিনু সুটকেসে কি ?
কিছু নয় । আমার কাপড়-চোপড় আর বই । এটিও তুমি সঙ্গে নেবে ।
সে কি!এটা নিয়ে কি করবো ?
বাহ আমিওতো থাকবো তোমার সঙ্গে ।
কান্ড দেখলি মেয়ের? কাউকে কিচ্ছু বলে নি । নিজে নিজে সমস্ত গুছিয়ে তৈরি হয়ে রয়েছে । আমার সঙ্গে যাবে । এ সমস্ত দেখলেই মন জুড়িয়ে যায় । মনে হয় কিসের দুঃখ কিসের কি? মমতার এমন গভীর সমুদ্রে দুঃখতো টুপ করে ডুবে যাবে । হাসছিস মনে মনে , না? আমিও কবি হয়ে গেলাম কিনা ভেবে । সব মানুষই তো কবিরে বোকা । বাবার কথাই মনে করনা কেন । রাতের বেলা একা একা কলতলায় বসে গান গাইতেন ‘ও মন মনরে……’। আমি ঠাট্টা করে বলতাম ‘নৈশ সঙ্গীত’ ।
কাজেই আমি বলি সব মানুষই কবি । কেউ কেউ লিখতে পারে কেউ কেউ পারেনা না ।
তোর খুব বড়লোক হবার শখ ছিল তাই না খোকা? ঠিক ধরেছি তো? আমি তোকে বড় লোক করে দি কেমন? রেজিষ্ট্রি করে একটা চেক পাঠাচ্ছি । দু এক দিনের ভতরে পেয়ে যাবি । কত টাকা আন্দাজ করতো? তুই যত ভাবছিস তারচে অনেক বেশি । চেক পেয়েই জানবি । নারে ঠাট্টা করছিনা । আগের মত কি আর আছি? ঠাট্টা তামাশা একটুও পারিনা এখন । টাকাটা আমি তোকে দিলাম খোকা । আমার আর দেবার মতো কি আছে বল? তোর খুব ধনী হওয়ার শখ ছিল । সেই শখ মিটাতে পারছি বলে ভারী আনন্দ হচ্ছে । খুব যখন ছোট ছিলি তখন একবার ফুটবল কেনার শখ হলো তোর । মার কাছে সাহস করেতো কিছু চাইতি না । আমাকে এসে বললি কানে কানে । আমি টাকা পাবো কোথায়? যা কষ্ট লাগলো । এখন পর্যন্ত বাচ্চা ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখলে বুক ব্যথায় টন টন করে । তোর নিশ্চই মনে নেই সে সব । সোনা ভাই আমার এ টাকাটা সমস্তই তোর, যে ভাবে ইচ্ছে খরচ করিস । নিনু, ঝুনু, মন্টু, আর বাবাকে ভাগ করে দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু তাদের দেয়া আর তোকে দেয়া একই ভেবে দেই নি । কোত্থেকে পেয়েছি? তুই কি ভাবছিস আগে বল?
নারে চুরি করিনি! আমাকে কেউ ভিক্ষাও দেয়নি । এ আমার নিজের টাকা । মার কথা সময় হলে বলবো বলেছিলাম না? এখন বলছি তাহলেই বুঝবি কি করে কি হয়েছে । বাবার সঙ্গে বিয়ের আগে তাঁর আবিদ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল । তাঁদের একটি মেয়েও হয়েছিল, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । কি জন্যে তা তোর জানার দরকার নেই । বাবা মাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন পরপরই । বুঝতেই পারছিস আমি হচ্ছি সেই মেয়ে । খুব অবাক না? আমার সেই বাবা ভদ্রলোক এতদিন ঢাকাতেই ছিলেন । সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে কিছুদিন হলো বাইরে চলে গেছেন । যাবার আগে এই টাকাটা দিয়ে গেছেন আমাকে । সেই লোকটিও ভালো ছিলরে । আসতো প্রায়ই আমাদের বাসায় । দেখিসনি কোন দিন? নীল রঙের কোট পরতো, গলায় টকটকে লালরঙের টাই । আমাকে ডাকতো ‘ইমা’ বলে । গল্পের মতো লাগে, না?
এগারো বছর বয়স থেকেই আমি জানি সব । কেমন লাগে তখন বলতো? তোদের যিনি বাবা, আমি নিজে তাঁকে বাবা বলেই ভাবছি আর তিনি একটুও বুঝতে দেন নি কিছু । সেই যে একবার কলেজে আমাকে মা কালী ডাকলো তোরা সবাই দুঃখিত হলি, বাবা কি করলেন বলতো? তিনি রাতের বেলা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন বারান্দায় । ইতস্তত করে বললেন,
ইয়ে মা রাখতো এটা ।
কি বাবা?
না ইয়ে একটা ক্রীম, খুব ভালো, বিশ টাকা দাম ।
তাকিয়ে দেখি চ্যপ্টা মুখের বোতল একটা । মুখের উপর লেখা Seven day beauty programme. চোখে পানি এসে গেল আমার । সেই কৌটাটা এখনো আছে আমার কাছে, ভারী মুল্যবান সেটি যেন বাবা বিশ টাকায় এক কৌটা ভালোবাসা দিনে এনেছেন । জন্মে জন্মে এমন লোককেই বাবা হিসাবে পেতে চাই আমি । মানুষ তো কখনো বেশি কিছু চায়না, আমি নিজেও চাই নি । মাঝে মাঝে মনে হয় না চাইতেই তো অনেক পেয়েছি ।
কিটকি ভুল করলো । কি করবি বল? ভুলে যেতে বলি না । ভুলবি কেন? ভালোবাসা কি ভুলবার জিনিস? রুনুকে কি আমরা ভুলতে পারি? না ভোলা উচিত? কিটকি ভারী ভালো মানুষ । মেয়েটি যেন সুখী হয় । এখনোতো তার বয়স হয়নি, বুঝতে শিখেনি কিছু । কষ্ট লাগে ভেবে।
মার কথা তোর মনে পড়ে খোকা? চেহারা মনে করতে পারিস? আমি কিন্তু পারিনা, স্বপ্নেও দেখিনা বহুদিন । খুব দেখতে ইচ্ছে হয় । জানি মার প্রতি তোদের সবার একটা অভিমান আছে । তোদের ধারনা মা কাউকে ভালোবাসতে পারেনি । হয়তো সত্যি, হয়তো সত্যি নয় । ছোট খালা একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
শিরিন তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের একটুও দেখতে পারো না!
মা জাবাবে হেসে বলেছেন, ‘এদের এমন করে তৈরী করে দিচ্ছি যাতে ভালোবাসার অভাবে কখনো কষ্ট না পায়’ ।
মা বড় দুঃখী ছিলরে খোকা! মেয়ে মানুষের দুঃখতো বলে বেড়াবার নয়, ঢেকে রাখবার, চিরদিন তিনি তাই রেখে গেছেন । তোরা জানতেও পারিস নি । এতো গান পাগলা মা তেইশ বছর একটি গানও গাইলো না । প্রথম স্বামীকে ভুলতে পারে নি । যদি পারতেন তবে জানতেন সুখের স্বাদ কত তীব্র । যাই হোক যা চলে গেছে তা গেছে । যারা বেঁচে আছে তাদের কথাই ভাবি ।
কিছুক্ষন আগে নিচে ঘন্টা দিয়েছে, খেতে যাবার সংকেত । আমার খাবার ঘরেই দিয়ে যায় । তবু নিচে গিয়ে একবার দেখে আসি । আজ আর খাবো না । শরীরটা ভালো নেই । একটু যেন জ্বর জ্বর লাগছে । মাঝে মাঝে অসুখ হলে মন্দ লাগে না । অসুখ হলেই অনেক ধরনের চিন্তা আসে যেগুলি অন্য সময় আসে না ।
হোষ্টেলের খুব কাছে দিয়ে নদী বয়ে গিয়েছে । সুন্দর নাম । এই মুহুর্তে মনে আসছেনা । রাতের বেলা সার্চ লাইট ফেলে ফেলে লঞ্চ যায়, বেশ লাগে দেখতে । দেখতে পাচ্ছি লঞ্চ যাচ্ছে আলো ফেলে । তোরা ঢাকায় থেকেতো এসব দেখবিনা ।
আজ এই পর্যন্ত থাক । শরীরের দিকে লক্ষ রাখিস । বাজে সিগারেট টানবিনা । কম খাবি কিন্তু দামী হতে হবে । টাকার ভাবনাতো নেই । ছোট বেলা চুমু থেতাম তোর কপালে। এখনতো বড় হয়ে গেছিস । তবু দূর থেকে চুমু খাচ্ছি ।
তোর, রায়েয়া আপা
 
 
 
 
 
প্রিয় বিভাস,
আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটি আমি আর উল্টাতে চাইনা। তোমরা হয়তো ওদের শাস্তির বিধান করতে পারবে । কিন্তু পারবে কি সবকিছু আগের মত করে দিতে ?
তোমাকে যখন লিখছি, তখন বিকেল । অথচ বিকেলটা আর আগের মত নেই । নিয়তীর টেনে দেয়া অবগুন্ঠণতলে সেটা শুধুই এক বিমর্ষ প্রহর । এই তো সেদিন- তোমার সাথে বুড়িগঙ্গায় পুরোটা বিকেল কী অসহ্য আনন্দে কাটিয়েছি । চৈতালীর অকৃপণ ছোঁয়া,দূরাগত স্টিমারের হুইসেল, ঝিরিঝিরি বর্ষার উদাসী আমন্ত্রণ - সবকিছু এই ক'টা দিনে এমন মিথ্যে হয়ে যাবে, কে ভেবেছিল ?
জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল যে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া, সেটা যদি আগেই জানতাম - তোমাদের প্রেম,ঘৃণা কিংবা লালসার পাত্র হয়ে ওঠার আগেই এই কন্ঠে ঢেলে দিতাম মুক্তির নিষ্কন্টক সুধা ।
বিভাস, আমায় ভুল বুঝো না । তুমি হয়তো বলবে, এভাবে চলে যাওয়াই শেষ কথা নয় । কিন্তু জীবন যেখানে জীবনের প্রতিভূ নয় । মানুষ যেখানে স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়ে ফেলে, মিথ্যা যেখানে রাজত্ব করে সত্যের উপর, সেখানে মৃত্যু ছাড়া মুক্তির পথ আর কী হতে পারে ?
না, আর কোন মিথ্যা আশ্বাস নয় । আমার অস্তিত্বের অবিনশ্বরতা আমি চাই না । আমি চাই না আমাকে নিয়ে প্রশংসা স্তুতিবাক্যে পুরোদেশ উতলা হোক । চাই না মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হোক রাজপথ । শুধু চাই, আমার চেতনার দিকে ছুঁড়ে দেয়া বিষাক্ত এসিডে জর্জরিত হয়ে নির্বান্ধব তোমাদের মাঝ থেকে চলে যেতে ।
ইতি, তোমার নীরা ।
(নীরার শেষ চিঠি : মৃন্ময় মিজান)
 
 
 
 মা কে না পাঠানো চিঠি
 
জানো মা, এখন আমি অনেক সকালে উঠি। আগে যখন তুমি বলতে "বিয়ের পর দেখবো বেলা দশটা অব্দি কত পড়ে পড়ে ঘুমোতে দেয় শ্বশুরবাড়িতে...." তখন ঠিক বুঝতাম না। আসলে ঘুমোতে দেয় না বললে ঠিক ভুল হবে.. দেওয়া বা না দেওয়ার প্রশ্ন আসার আগেই উঠে পড়ি। কারণ একটাই.. ওই যে.. 'শ্বশুর-বাড়ি'.. আমার তো বাড়ি না। তাই চক্ষুলজ্জায় উঠে পড়ি।
হ্যাঁ, ভালো শ্বশুরবাড়ি।রান্না না করলে হয়তো কিছু বলবে না ঠিকই.. কিন্তু বলা না বলার প্রশ্ন আসার আগেই নিজে এগিয়ে যায়। কারণ একটাই.. 'শ্বশুর -বাড়ি' আমার বাড়ি তো নয়। মনে হয় কিছু না করে শুধু শুধু বসে বসে খাব!! ভাবতেই পারি না.. কিন্তু দু'মাস আগে অব্দি তুমি রান্না করে খাওয়াতে.. তখন তো মনে হয়নি এসব। তুমি নেহাত অসুস্থ হয়ে পড়লে তবেই রান্নাঘরে পা দিতাম। তা ছাড়া না.... মাঝে মাঝে তুমি বিকেলবেলা বলতে "এক কাপ চা করে দেওয়ারও কেউ নেই।" এখন আমি প্রায় রোজই বিকেলে চা করি। খুব ইচ্ছে করে যদি তোমাকেও গিয়ে এক কাপ দিয়ে আসতে পারতাম....!
কত্ত কা..জ নিজে পারলেও তোমাকে জ্বালিয়ে খেয়েছি। যেমন "মা মোবাইলটা চার্জ থেকে খুলে দাও" বা "বুক শেলফ থেকে অমুক বইটা এনে দাও" ইত্যাদি নানাঅাঅা রকম..। বকাঝকা দিয়ে আবার করেও দিয়েছো কাজটা। মুখ ফুটে "পারবোনা" বলতে পারোনি!! আমি তো কতবার তোমাকে বলতাম "পারবোনা", যখনই কিছু করতে বলতে..। আজ আমার নিজেরটা তো করিই.. মাঝে মাঝে বরও বলে মোবাইলটা এনে দাও। ভাবি ও নিজের বাড়িতে আছে বলেই হয়তো এখনো আব্দার করা ছাড়েনি। আমার বাড়ি তো না। বরের বাড়ি.. ওর বাবার বাড়ি.. আমার শ্বশুর বাড়ি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই কথাগুলো কাউকে বলি.. বোঝাই..
কিন্তু আবার ভাবি লোকে আমাকে পাগল বলবে। এগুলো তো খুব সাধারন ব্যাপার, সবাই করে, আমিও করবো.. এটাই তো স্বাভাবিক। না করলেই বরং অস্বাভাবিক।
আচ্ছা মা, বিয়ের আগে এত স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক ভাবতে হত না কেন! তুমিও কি বিয়ের আগে ভাবতে না? আর বিয়ের পর আমরা এসে স..ব ওলট-পালট করে দিয়েছি।
এখন বুঝি, রাতে শোয়ার আগে তোমাকে ক্রিম মাখতে বললে তুমি কেন বলতে লাগবে না। কারণ ওই সময়টুকু রেষ্ট পেলেই বোধহয় তোমার বেশি কাজে লাগতো। যার মনের কোন চর্চা কেউ করে না তার আবার রূপচর্চা!!!!
মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধীও মনে হয়, জানো মা!! তোমার কাজগুলো একটু ভাগ করে নিতেও তো পারতাম। তুমিই বা বুঝিয়ে বলো নি কেন? তুমিও তোমার মায়ের সাথে এমনটাই করেছিলে.. তাই কি বলতে পারেনি?? আমিও হয়তো ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের বোঝাতে পারবো না। তবে তারাও একদিন বুঝবে.. যেমন এখন আমি বুঝছি....।
তবে, আমি ভালো আছি মা.. তুমি চিন্তা কোরো না। বুঝিয়ে নিয়েছি নিজেকে.. বিয়ের পর মেয়েদের কি কি করতে হয় আর কি করতে নেই। তবে কি কি করতে নেই সেই লিস্টটাই বড়.. নিজের ইচ্ছেমতো ড্রেস পরতে নেই, সবার আগে খেয়ে নিতে নেই (তাতে যতই ভালোলাগার জিনিস হোক), খুব জোরে হাসতে নেই, জোরে কথা বলতে নেই, কেউ ভুল হলেও তাকে ভুল বলতে নেই, যখন খুশি শুতে নেই, আগে যেমন ল্যাদ খেতাম এখন তেমন ল্যাদ খেতে নেই, সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে নেই, আরো কত কি ছোটখাটো বিষয় মানা.. মোদ্দা কথা- নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবতে নেই, অন্যদের নিয়ে ভাবতে হয়। তবেই ভালো বউ.. ভালো বৌমা। কিন্তু যতই ভালো বউ হই না কেন তবু এই বাড়িটা 'শ্বশুর বাড়ি'ই থাকবে.... আমার বাড়ি কোনদিনই হবে না। আর ওটা তো এখন আমার 'বাপের বাড়ি'.. কথায় কথায় লোকে বলে। তবে 'আমার বাড়ি' কোনটা মা???? তোমার বাড়িই বা কোনটা??
তুমি ভালো থেকো মা.. আর পরের জন্মে আবার আমার মা হয়ে এসো। পরের জন্মে প্রথম থেকেই তোমার কষ্টগুলো ভাগ করে নেব।।
ইতি - তোমার মেয়ে
( যে তোমায় মাতৃত্বের সুখ ছাড়া আর কোনো সুখ হয়তো দিতে পারেনি)।
 
 
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...