Sunday, January 26, 2020

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়



কেউ কথা রাখেনি
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ
কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান
হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো,
কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড়
হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল
দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার
মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স
দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির
ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের
গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ
পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস,
একদিন, আমরাও…
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই
রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল
রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ
নিয়েছি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন
করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই
মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী।
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ
কথা রাখে না!









না-পাঠানো চিঠি
--- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মা, তুমি কেমন আছো ?
আমার পোষা বেড়াল খুনচু , সে কেমন আছে
সে রাত্তিরে কার পাশে শোয়
দুপুরে যেন আলি সাহেবদের বাগানে না যায়
মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে ?
তুলিকে আমার ডুরে শাড়িটা পরতে বলো
আঁচলের ফেঁসোটা যেন শেলাই করে নেয়
তুলিকে কত মেরেছি, আর কোনোদিন মারবো না
আমি ভালো আছি , আমার জন্য চিন্তা করো না
মা আমাদের .......
মা, তোমাদের ঘরের চালে নতুন খড় দিয়েছো ?
এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব
তরফদারবাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে ?
কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু ?
একবার মেঘের ডাক শুনে কই মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়
আমি আমগাছ তলায় দুটো কই মাছ ধরেছিলাম
তোমার মনে আছে, মা ?
মনে আছে, আলি সাহেবের বাগানের সেই নারকোল
চুরি করে আনিনি , মাটিতে পড়ে ছিল , কেউ দেখেনি
নারকোল বড়ার সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে ।
আলি সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করতো
বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল আমাকে
আমার কি দোষ , কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি ?
আমার পিঠে এখনো সেই দাগ আছে
আমি সাহাবদের বাগানে আর কোনোদিন যাইনি
আমি আর কোনো বাগানে যাই না
সেই দাগটায় হাত বুলিযে বাবার কথা মনে পড়ে
বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়
আমি ভালো আছি , খুব ভালো আছি
বাবা যেন আমার জন্য একটুও না ভাবে
তুমি কি এখনো ভূতের ভয় পায় ?
তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলা বউ দেখেছিলাম
সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হলো
দাদা সেই কলাগাছটা কেটে ফেললো
আমি কিন্তু ভয় পাইনি, তুলিকে কত ক্ষেপিয়েছি
আমার আবার মাঝরাত্রে সেই কলাবউ দেখতে ইচ্ছে করে
হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদা কোনো কাজ পেয়েছে ?
নকুড়বাবু যে বলেছিল বহরমপুরে নিয়ে যাবে
দাদাকে বলো ওর ওপর আমি রাগ করিনি
রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট
আমার শরীরে আর রাগ নেই, আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না
মা, আমি রোজ দোকানের খাবার খাই
হোটেল থেকে দু বেলা আমার খাবার এনে দেয়
মাংস মুখে দি ই আর তুলির কথা, কালু-ভুলুর কথা মনে পড়ে
আমাদের .........
তোমাদের গ্রামে পটল পাওযা যায় না
আমি আলু পট্লের তরকারি খাই, পটল ভাজাও খাই
হোটেলে কিন্তু কক্ষনো শাক রান্না হয় না
পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক্
কী ভালো, কী ভালো . বিনা পয়সায়
কোনোদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জুটবে না
জোর হাওয়া দিলে তালগাছের পাতা সরসর করে
ঠিক বৃষ্টির মতন শব্দ হয়
এই ভাদ্দর মাসে তাল পাকে , ঢিপ ঢিপ করে তাল পড়ে
বাড়ির তাল গাছ দুটো আছে তো ?
কালু তালের বড়া বড় ভালোবাসে, একদিন বানিয়ে দিও
তেলের খুব দাম জানি , তবু একদিন দিও
আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ হাজার টাকা পেয়েছিলে
তা দিয়ে একটা গরু কেনা হয়েছে তো ?
সেই গরু টা ভালো দুধ দেয় ?
আমার মতন মেয়ের চেয়ে গরুও অনেক ভালো
গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারে সুসার হয়্
গরুর বাছুর হয় , তাতেও কত আনন্দ হয়
বিড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা
দু বেলা ভাত দাও রে , শাড়ি দাও রে, বিয়ের জোগাড় করো রে
হাবলু, মিজান, শ্রীধরদের থাবা থাকে মেয়েকে বাঁচাও রে
আমি কি বুঝি বা, সব বুঝি
কেন আমায় বিক্রি করে দিলে , তাও তো বুঝি
সেই জন্যই তো আমার কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই
আমি তো ভালোই আছি , খেয়ে পরে আছি
তোমরা ঐ টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিও ঠিকঠাক
কালু-ভুলুকে ইস্কুলে পাঠিও
তুলিকে ব্র্জেন ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ো
তুমি একটা শাড়ি কিনো , বাবার জন্য একটা ধুতি
দাদার একটা ঘড়ির শখ, তা কি ও টাকায় কুলোবে ?
আমি কিছু টাকা জমিয়েছি , সোনার দুল গড়িয়েছি
একদিন কী হলো জানো, মা
আকাশে খুব মেঘ জমেছিল , দিনের বেলা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার
মনতা হঠাৎ কেমন কেমন করে উঠলো
দুপুর বেলা চুপি চুপি বেরিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম্
স্টেশনে নেমে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিকশা
খুব ইছে হলো, একবার আমাদের.... বাড়িটা দেখে আসি
রথতলার মোড়ে আসতেই কারা যেন চেঁচিয়ে উঠলো
কে যায় , কে যায় ?
দেখি যে হাবলু-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা
আমাকে বললো,হারামজাদী,কেন ফিরে এসেছিস ?
আমি ভয় পেয়ে বললাম , ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি
একবার শুধু দেখতে এসেছি
হাবলু বলল, এতা একটা বেবুশ্যে মাগী
কী করে জানলো বলো তো, তা কি আমার গায়ে লেখা আছে ?
আর একটা ছেলে, চিনি না, বললো, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম
হাবলু রিকশাঅলাকে চোখ রাঙিয়ে বললো, ফিরে যা
আমি বললাম,দাদা, আমি মায়ের জন্য ক টা টাকা এনেছি
আর তুলির জন্য ...
দাদা টেনে এক চড় কষালো আমার গালে
আমাকে বিক্রির তাকা হক্কের টাকা
আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা
দাদা সেই পাপের তাকা ছোঁবে না , ছিনিয়ে নিল শ্রীধর
আমাকে ওরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল
আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি
দাদ তো ঠিকই করেছে, আমি তো আর দাদার বোন নই
তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই
আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যান হবে
না, না, আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো
গরুটা ভালো থাকুক্, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক
পুকুরে মাছ হোক ,খেতে ধান হোক্, ঝিঙে মাচায় ফুল ফুঁটুক
আর কোনোদিন ঐ গ্রাম অপবিত্র করতে যাবো না
আমি খাট্-বিছানায শুই , নীল রঙের মশারি
দোরগড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দূর্গার ছবি
আলমারি ভর্তি কাচের গেলাশ্
বনবন করে পাখা ঘোরে । সাবান মেখে রোজ চান করি
এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে
তা হলেই বুঝছো,কেমন আরামে আছি আমি
আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা
তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে, আমি আর মা পাবো কোথায় ?
সেই জন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা
তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে
তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দূর্বল
যতই অভাব হোক , তবু তুলিকে তোমরা ...
তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো
তুলিকেও যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়
যেমন করে হোক্, তুলির একটা বিয়ে দিও
ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার , একজন নিজের মানুষ্
আর যদি কোনোরকমেই ওর বিয়ে দিতে না পারো
ওকে বলো, গলায় দড়ি দিয়ে মরতে
মরলেও ও বেঁচে যাবে !
না,না,না, এ কী অলক্ষুনে কথা বলছি আমি
তুলি বাঁচে থাকুক , আর সবাই বেঁচে থাকুক্
তুলির বিয়ে যদি না হয় না হোক
হে ভগবান, গরিবের বাড়ির মেয়ে কি বিয়ে না হলে বাঁচতে পারে না ?
বিয়ে না হলেই তাকে গ্রামের সবাই ঠোকরাবে ?
দু পায়ে জোর হলে তুলি কোথাও চলে যাক
মাঠ পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে
আরও দূরে, আরও দূরে, যেদিকে দু ছখ যায়
এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে, কোথাও না কোথাও অছে
যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন
আঁচরে দেয় না, কামড়ে দেয় না,গায়ে ছ্যাঁকা দেয় না, লাথি মারে না
যেখানে একটা মেয়ে, শুধু মেয়ে নয় , মানুষের মত বাঁচতে পারে
মা, তুমি আমার মা, আমি হারিয়ে গেছি
তুলিকে তুমি...তুলি যেন... আমার মতন না হয় ।






আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি 

– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ 
 এই কি মানুষজন্ম?
 নাকি শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধেবেলা  
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা  
করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হ’য়ে ব’সে  
থাকি- তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো ব’লে। আমি আক্রোশে 
 হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হ’য়ে হাঁটি,  
মশা হ’য়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে;
খাঁটি  অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি দেশলাই জ্বেলে- 
 (ও-গাঁয়ে আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই)!- 

  আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে  
সেজে গেছি রঙ্গালয়ে, 
পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক 
 ঘামে ছিল না এমন গন্ধক 

  যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারি।
নিখিলেশ, তুই একে কী বলবি? 
আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত পেরেকে 
 বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম যীশুর কষ্ট খুব বেশি ছিল কি না; 
 আমি ফুলের পাশে ফুল হ’য়ে ফুটে দেখেছি, 
তাকে ভালোবাসতে পারি না। 
 আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম,  
আমি শ্মশানে গিয়ে ম’রে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। 
 নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি,
 তোর সঙ্গে জীবন বদল ক’রে কোনো লাভ হ’লো না আমার- 
একি নদীর তরঙ্গে ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?-
অথবা চশমা বদলের মতো কয়েক মিনিট আলোড়ন? 
অথবা গভীর রাত্রে সঙ্গমনিরত দম্পতির 
পাশে শুয়ে পুনরায় জন্ম ভিক্ষা? 
কেননা সময় নেই,         
আমার ঘরের দেয়ালের চুন-ভাঙা দাগটিও বড় প্রিয়। 
মৃত গাছটির পাশে উত্তরের হাওয়ার কিছুটা মায়া লেগে আছে।
 ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে 
 দেখে উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, 
তবুও অক্লেশে হলুদকে হলুদ ব’লে ডাকতে পারি। 
আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, 
একটি..., ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;        
 ইচ্ছে ছিলো না জানাবার এই বিশেষ কথাটা তোকে।
 তবু ক্রমশই বেশি ক’রে শীত, 
রাত্রে এ রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না,
 রোজ অন্ধকার হাতড়ে টের পাই তিনটি ইঁদুর। 
ইঁদুর না মুষিক? 
তা হলে কি প্রতীক্ষায় আছে অদূরেই সংস্কৃত শ্লোক? 
পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এ অবেলায় কিছুই মনে পড়ে না। 
আমার পূজা ও নারী হত্যার ভেতরে বেজে ওঠে সাইরেন। 
নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে  
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। 
আজকাল আমার নিজের চোখ দুটোও মনে হয় 
একপলক সত্যি চোখ।
এরকম সত্য পৃথিবীতে খুব বেশি নেই আর।





পাহাড় চূড়ায় 

– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটা নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।

কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই
কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই।
নদীটাও অবশ্য কিনেছিলামি একটা দ্বীপের বদলে।
ছেলেবেলায় আমার বেশ ছোট্টোখাট্টো,
ছিমছাম একটা দ্বীপ ছিল।
সেখানে অসংখ্য প্রজাপতি।
শৈশবে দ্বীপটি ছিল আমার বড় প্রিয়।
আমার যৌবনে দ্বীপটি আমার
কাছে মাপে ছোট লাগলো।
প্রবহমান ছিপছিপে তন্বী নদীটি বেশ পছন্দ হল আমার।
বন্ধুরা বললো, ঐটুকু
একটা দ্বীপের বিনিময়ে এতবড়
একটা নদী পেয়েছিস?
খুব জিতেছিস তো মাইরি!
তখন জয়ের আনন্দে আমি বিহ্বল হতাম।
তখন সত্যিই আমি ভালবাসতাম নদীটিকে।
নদী আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিত।
যেমন, বলো তো, আজ
সন্ধেবেলা বৃষ্টি হবে কিনা?
সে বলতো, আজ এখানে দক্ষিণ গরম হাওয়া।
শুধু একটি ছোট্ট দ্বীপে বৃষ্টি,
সে কী প্রবল বৃষ্টি, যেন একটা উৎসব!
আমি সেই দ্বীপে আর যেতে পারি না,
সে জানতো! সবাই জানে।
শৈশবে আর ফেরা যায় না।
এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের
কাছে থাকবে গহন অরণ্য,
আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু রুক্ষ
কঠিন পাহাড়।
একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কষ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না।
আমি ঈশ্বর মানি না,
 তিনি আমার মাথার কাছে ঝুঁকে দাঁড়াবেন না।
আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,
প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-
এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।
হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।
আমাকে ক্ষমা করো।



যদি নির্বাসন দাও

 – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভুমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘুরে
লুঠেরা, ফেরারী ।
শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর,
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্পোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল–
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।
কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দীঘির পারে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক ?
আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলার ওড়াওড়ি ?
মোষের ঘাড়ের মতো পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মতো বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ্ণ স্বর ?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো… ।




আছে ও নেই
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়---
 

হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে সেই পাগলটি
পৃথিবীর সমস্ত পাগলের রাজা হয়ে
সে উলঙ্গ, কেননা উম্মাদ উলঙ্গ হতে পারে, তাতে
প্রকৃতির তালভঙ্গ হয় না কখনো
পাশেই গম্ভীর ট্রেন, ব্যস্ত মানুষের হুড়োহুড়ি
সকলেই কোথাও না কোথাও পৌছুতে চায়
তার মধ্যে এই মূর্তিমান ব্যতিক্রম, ইদানীং
অযাত্রী, উদাসীন-
মাঝারি বয়েস, লম্বা, জটপাকানো মাথা
তার নাম নেই, কে জানে আমিত্ব আছে কিনা
অথচ শরীর আছে
সুতোহীন দেহখানি দেহ সচেতন করে দেয়
পেটা বুক, খাঁজ-কাটা কোমর, আজানুলম্বিত বাহু
এবং দীর্ঘ পুরুষাঙ্গ
চুলের জঙ্গলে ঘেরা
পুরুষশ্রেষ্টের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভিড়ে, যেন সদর্পে
সন্ন্যাসী হলেও কোনো মানে থাকতো, কেউ হয়তো প্রণাম জানাতো

কিন্তু এই শারীরিক প্রদর্শনী এত অপ্রাসঙ্গিক
টিকিটবাবুও তাকে বধা দেয় না
রেলরক্ষীরা মুখ ফিরিয়ে থাকে
ফিলমের পোস্টারের নারী-পুরুষদের সরে যাবার উপায় নেই
অপর নারী-পুরুষরা তাকে দেখেও দেখে না
তারা পাশ দিয়ে যেতে-যেতে একটু নিমেষহারা হয়েই
আবার দূরে চলে যায়
শুধু মায়ের হাত ধরা শিশুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে
একটি আপেল গড়ি েযায় লাইনের দিকে-
ঠিক সেই সময় বস্তাবন্দী চিঠির স’পের পাশ দিয়ে
এসে দাঁড়ায় দুটি হিজড়ে
নারীর বেশে ওরা নারী নয়, এবং সবাই জানে
ওদের বিস্ময়বোধ থাকে না
তবু হঠাৎ ওরা থমকে দাঁড়ায়; পরস্পরের দিকে
তাকায় অদ্ভুত বিহ্বল চোখে
যেন ওদের পা মাটিতে গেঁথে গেল
সার্চ লাইটের মতন চোখ ফেরালো পাগলটির শরীরে
সেই অপ্রয়োজনীয় সুঠাম সুন্দর শরীর,
নির্বিকার পুরুষাঙ্গ
যেন ওদের শপাং-শপাং করে চাবুক মারে
সূর্য থেকে গল-গল করে ঝরে পড়ে কালি
এই আছে ও নেই’-র যুক্তিহীন বৈষম্যে প্রকৃতি
দুর্দান্ত নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে
সেই দুই হিজড়ে অসম্ভব তীব্র চিৎকার করে ওঠে-
ধর্মীয় সঙ্গীতের মতন
ওরা কাঁদে,
দু’হাতে মুখ ঢাকে
বসে পড়ে মাটিতে
এবং টুকরো-টুকরো হয়ে মিশে যায়
নশ্বর ধুলোয়
অল্প দূরে, সিগারেট হাতে আমি এই দৃশ্য দেখি।।



ভালোবাসি, ভালোবাসি
---সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


ধরো কাল তোমার পরীক্ষা,
রাত জেগে পড়ার
টেবিলে বসে আছ,
ঘুম আসছে না তোমার
হঠাত করে ভয়ার্ত কন্ঠে উঠে আমি বললাম-
ভালবাসো?
তুমি কি রাগ করবে?
নাকি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....
ধরো ক্লান্ত তুমি,
অফিস থেকে সবে ফিরেছ,
ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত পীড়িত,
খাওয়ার টেবিলে কিছুই তৈরি নেই,
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে
ঘর্মাক্ত আমি তোমার
হাত ধরে যদি বলি- ভালবাসো?
তুমি কি বিরক্ত হবে?
নাকি আমার হাতে আরেকটু চাপ দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....
ধরো দুজনে শুয়ে আছি পাশাপাশি,
সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি
দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম
শতব্যস্ত হয়ে তোমাকে ডাক দিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে?
নাকি হেসে উঠে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....
ধরো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি দুজনে,
মাথার উপর তপ্ত রোদ,
বাহন পাওয়া যাচ্ছেনা এমন সময়
হঠাত দাঁড়িয়ে পথ
রোধ করে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি হাত সরিয়ে দেবে?
নাকি রাস্তার সবার
দিকে তাকিয়ে
কাঁধে হাত দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....
ধরো শেভ করছ তুমি,
গাল কেটে রক্ত পড়ছে,
এমন সময় তোমার এক ফোঁটা রক্ত হাতে নিয়ে যদি বলি- ভালবাসো?
তুমি কি বকা দেবে?
নাকি জড়িয়ে তোমার গালের রক্ত আমার
গালে লাগিয়ে দিয়ে খুশিয়াল গলায় বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....
ধরো খুব অসুস্থ তুমি,
জ্বরে কপাল পুড়েযায়,
মুখে নেই রুচি,
নেই কথা বলার অনুভুতি,
এমন সময় মাথায় পানি দিতে দিতে তোমার মুখের
দিকে তাকিয়ে যদি বলি-ভালবাসো?
তুমি কি চুপ করে থাকবে?
নাকি তোমার গরম শ্বাস আমার শ্বাসে বইয়ে দিয়ে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..
ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,
প্রচন্ড যুদ্ধে তুমিও অংশীদার,
শত্রুবাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময় পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম-
ভালবাসো?
ক্রুদ্ধস্বরে তুমি কি বলবে যাও....
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে, বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.......
ধরো দূরে কোথাও যাচ্ছ
তুমি,
দেরি হয়ে যাচ্ছে,বেরুতে যাবে,
হঠাত বাধা দিয়ে বললাম-ভালবাসো?
কটাক্ষ করবে?
নাকি সুটকেস ফেলে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি
ধরো প্রচন্ড ঝড়,উড়ে গেছে ঘরবাড়ি,
আশ্রয় নেই
বিধাতার দান এই পৃথিবীতে,
বাস করছি দুজনে চিন্তিত তুমি
এমন সময় তোমার
বুকে মাথা রেখে যদি বলি ভালবাসো?
তুমি কি সরিয়ে দেবে?
নাকি আমার মাথায় হাত রেখে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি..
ধরো সব ছেড়ে চলে গেছ কত দুরে,
আড়াই হাত মাটির নিচে শুয়ে আছ
হতভম্ব আমি যদি চিতকার করে বলি-
ভালবাসো?
চুপ করে থাকবে?
নাকি সেখান থেকেই
আমাকে বলবে,
ভালোবাসি, ভালোবাসি.....
যেখানেই যাও,যেভাবেই থাক,
না থাকলেও দূর
থেকে ধ্বনি তুলো,
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি..
দূর থেকে শুনব তোমার কন্ঠস্বর,
বুঝব তুমি আছ, তুমি আছ
ভালোবাসি,ভালোবাসি........!



-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

--কী চাও আমার কাছে?
--কিছু তো চাইনি আমি!
--চাওনি তা ঠিক।তবু কেন
  এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও?
-জানি না।ওদিকে দেখ
  রোদ্দুরে রুপোর মত জল
  তোমার চোখের মতো  দূরবর্তী নৌকো
চতুর্দিকে তোমাকেই দ্যাখা
--সত্যি করে বলো।কবি,কী চাও আমার কাছে
--মনে হয় তুমি দেবী
=আমি দেবী নই
-তুমি তো জানো না তুমি কে!
--কে আমি?
-তুমি সরস্বতী।শব্দটির মূল অর্থে
  যদিও মানবী,তাই কাছাকাছি পাওয়া
   মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
--হাসি পায় শুনে।যখন যা মনে আসে
  তাই বলো,ঠিক নয়?
--অনেকটা ঠিক।যখন যা মনে আসে-
  কেন মনে আসে?
--কী চাও ,বলো তো সত্যি? কথা ঘুরিইয়ো না
--আশীর্বাদ!
--আশীর্বাদ? আমার,না সত্যি যিনি দেবী
--তুমি তো সেই! টেবিলের ওই পাশে
  ফিকে লাল শাড়ি
আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
  উঠে এস
আশীর্বাদ দাও,মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
  খিমচে ধরো চুল,আমার কপালে
  নোখ দিয়ে চিরে দাও
--যথেষ্ট পাগল আছো! আরও হতে চাও বুঝি?
--তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম,নয়ত কেমন
  শান্তশিষ্ট
--না দেখাই ভালো তবে।তাই নয়?
--ভালো-মন্দ জেনে শুনে যদি এ জীবন
কাটাতুম
তবে সে জীবন ছিল শালিকের,দোয়েলের
বনবিড়ালের কিম্বা মহত্মা গান্ধীর
  ইরি ধানে,ধানের পোকায় যে জীবন
--যে জীবন মানুষের?
--আমি কি মানুষ না কি? ছিলাম মানুষ বটে
  তোমাকে দেখার আগে
--তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে?
--তোমার ভিতরে তুমি,শাড়ি সজ্জা খুলে ফেললে
  তুমি
  তার আড়ালেও যে তুমি
--সে কি সত্যি আমি? না তোমার নিজের কল্পনা
--শোন খুকি--
--এই মাত্র দেবী বললে--
--একই কথা! কল্পনা আধার যিনি,তিনি দেবী--  
তুই সেই নীরা
  তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
--সে আর এমন কি শক্ত? এক্ষুনি তা দিতে পারি
--তোমার অনেক আছে,কণা মাত্র দাও
--কী আছে আমার? জানি না তো
--তুমি আছ ,তুমি আছো,এর চেয়ে বড় সত্য নেই
--সিঁড়ির ওপরে সেই দ্যাখা
তখন তো বলোনি কিছু?
আমার নিঃসঙ্গ দিন,আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব--শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
--দেবে কি দুঃখের অংশভাগ?আমি
ধনী হবো
--আমার তো দুঃখ নেই--দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনও ভাগ হয় না
আমার আর কী আছে,কী দেব তোমাকে?
--তুমি আছো,তুমি আছো,এর চেয়ে বড় সত্য নেই!
তুমি দেবী,ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল,আশীর্বাদ...
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়,মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দুহাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে  ধরতে চায়
সিঙ্ঘিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
--পুরুষ দূরত্বে যাও,কবি কাছে এসো
তোমায় কি দিতে পারি?
কিছু নয়!
--অভিমান?
--নাম দাও অভিমান!
--এটা কিন্তু বেশ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান?
--কতটুকু দূরত্ব? কী,মনে পয়রে?
--কী করে ভাবলে যে ভুল্বো?
তুমি এই যে বসে আছ,আঙুলে ছোঁইয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি--
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না,নীরা
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে।
--সময় কি থেকে থাকবে? কী চাও আমার কাছে?
--মৃত্যু?
--ছিঃ,বলতে নেই
--তবে স্নেহ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
--পাওনি কি?
--বুঝতে পারি না ঠিক।বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
  শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ?
--ফের পাগলামি?
---দ্যাখা দাও !
--আমিও তোমায় দেখতে চাই !
  --না !
--কেন?
--বোলো না।কক্ষনো বোলো না আর ওই কথা
    আমি ভয় পাবো।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে? সামান্য,অতি নগন্য,কেউ না
তবু এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে--
--তুমি কবি
--তা কি মনে থাকে? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
--কী চাও আমার কাছে?
--কিছু নয়।আমার দু'চোখে যদি ধুলো পয়রে
  আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে?





সত্যবদ্ধ অভিমান
– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন পাপ করতে পারি ?
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে
ভীষণ জরুরী কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে….
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার,
যেন মায়াপাশ সত্যবদ্ধ অভিমান–চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর
কোনো মিথ্যে কি মানায় ?



নীরার দুঃখকে ছোঁয়া
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


কতটুকু দূরত্ব? সহস্র আলোকবর্ষ চকিতে পার হয়ে
আমি তোমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসি
তোমার নগ্ন কোমরের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলার আগে
অলঙ্কৃত পাড় দিয়ে ঢাকা অদৃশ্য পায়ের পাতা দুটি
বুকের কাছে এনে
চুম্বন ও অশ্রুজলে ভেজাতে চাই
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বুক কাঁপে
আমার সাঁইত্রিশ বছরের বাইরের জীবন মিথ্যে হয়ে যায়
বহুকাল পর অশ্রু বিস্মৃত শব্দটি
অসম্ভব মায়াময় মনে হয়
ইচ্ছে করে তোমার দুঃখের সঙ্গে
আমার দুঃখ মিশিয়ে আদর করি
সামাজিক কাঁথা সেলাই করা ব্যবহার তছনছ করে
স্ফুরিত হয় একটি মুহূর্ত
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে তোমার পায়ের কাছে…
বাইরে বড় চ্যাঁচামেচি, আবহাওয়া যখন তখন নিম্নচাপ
ধ্বংস ও সৃষ্টির বীজ ও ফসলে ধারাবাহিক কৌতুক
অজস্র মানুষের মাথা নিজস্ব নিয়মে ঘামে
সেই তো শ্রেষ্ঠ সময় যখন এ-সবকিছুই তুচ্ছ
যখন মানুষ ফিরে আসে তার ব্যক্তিগত স্বর্গের
অতৃপ্ত সিঁড়িতে
যখন শরীরের মধ্যে বন্দী ভ্রমরের মনে পড়ে যায়
এলাচ গন্ধের মতো বাল্যস্মৃতি
তোমার অলোকসামান্য মুখের দিকে আমার স্থির দৃষ্টি
তোমার রেজী অভিমানের কাছে প্রতিহত হয়
দ্যুলোক-সীমানা
প্রতীক্ষা করি ত্রিকাল দুলিয়ে দেওয়া গ্রীবাভঙ্গির
আমার বুক কাঁপে,
কথা বলি না
বুকে বুক রেখে যদি স্পর্শ করা যায় ব্যথাসরিৎসাগর
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি অসম্ভব দূরত্ব পেরিয়ে
চোখ শুকনো, তবু পদচুম্বনের আগে
অশ্রুপাতের জন্য মন কেমন করে!
 
 

ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
 
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
নিঃশব্দ রাত্রির দেশ, তার ওপরে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ
অদূরে খাজুরাহো মন্দিরের চূড়া
মিথুন মূর্তিগুলো দেয়াল ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠেছে আকাশে
নীল মখমলে শুয়ে নক্ষত্রদের মধ্যে চলেছে নৈসর্গিক প্রেম
আমি যে-কোনো দিকে যেতে পারি
অথচ আমার কোনো দিক নেই!
ভারতরর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
সেই দিনটি ছিল বর্ষণসিক্ত
মাঝে মাঝে এমন হয়, আকাশ নিচে নেমে আসে
গাছগুলি দুহাত বাড়িয়ে ডাকে, এসো, এসো
বোঝা যায় এখন এই পৃথিবী মানুষের জন্য নয়
বস্তু বিশ্বের মধ্যে চলেছে গভীর দেয়া নেয়া
বিদ্যুৎ শিখার মধ্যে রয়েছে গহন কোনো বাণী
রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে পায়ের তলার মাটি
এই রকম সময়ে দিক ঠিক করা সহজ নয়
আমি পা বাড়িয়ে থাকি,
কিন্তু কোন্ দিকে যাবো জানি না।
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
দিঘির জলে ভাসছে গোলাপি শাড়ি পরা বধূটির শব
তার পায়ের আলতা ধুয়ে যায়নি
তার হাত ভর্তি সবুজ কাচের চুড়ি
তার ওষ্ঠ ও অধর তীব্র বিষের দাহে নীল
যারা সহজে চিৎকার করে তারাও চারদিকে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ
যারা অপরের হাতে নিহত হবার জন্য প্রস্তুত
তারাও আজ একটু একটু খুনী
এই দিঘির কাছে সে প্রত্যেকদিন তার মনের কথা বলতে আসতো
তার তীব্র দুঃখ ছিল না, তার তীব্র সুখ ছিল না
সে শুধু চেয়েছিল মাঝারি ধরনের বেঁচে থাকতে
একটা কোনো জায়গা থেকে তো তার মৃত্যুর জন্য
উত্তর খুঁজে আনতে হবে
কোন দিকে? কোন দিকে?
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপরে দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
ঝাঁসী, হায়দ্রাবাদ, নাগপুর, কানপুর, এলাহবাদ
বিভিন্নমুখী বাস গোল হয়ে ঘিরে ফোঁস ফোঁস করছে
যে-কোনো একটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেই হয়
কিন্তু কেন আমি নাগপুর না গিয়ে এলাহাবাদ যাবো না
অথবা হায়দ্রাবাদ না গিয়ে ঝাঁসী না যাবার কোন্ যুক্তি আছে
ঠিক এক জায়গাতেই যাওয়ার গাড়ি-ভাড়া
আমাকে একবারের বেশি দু’বার সুযোগ দেওয়া হবে না
আমাকে পাঠানো হয়েছে মাত্র একটি জীবন কাটাবার জন্য
একটি জেলখানা থেকে বেরিয়ে শুধু একদিকে যাবার মুক্তি
চোখ বুজে ঝুলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে শুধু একটি কাগজের টুকরো
আমি চোখ বুজলাম
এইরকম সময়ে মানুষ চোখ বুজে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে
এবং বৃক্ষের মতন স্থাণু হয়।
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
চতুর্দিকে সব কিছুই অচেনা
দু’দিক দিয়ে মানুষ আসে যায়, কেউ থামে না
কেউ চোখের দিকে চোখ ফেলে না
কেউ আমার কথা বোঝে না, আমি কারুর কথা বুঝি না
কারুর হাতে উজ্জ্বল নীল রঙের বল, কারুর হাতে পাংশু রঙের থালা
কেউ মুঠো মুঠো বাতাস খায়, কেউ অ্যালকহল দিয়ে দাঁত মাজে
জীবন্ত যুবতীর বুকে শকুন এসে ঠোকরায়, তারা হাসে,
শিশু এসে মায়ের আদর কাড়তে চাইলে ,মা কাঁদে
পোশাকের দোকানে মানুষ ঝুলছে, অপর মানুষের কোনো পোশাক নেই
মাংসের দোকানে মানুষ ঝুলছে, অপর মানুষের কোনো মাংস নেই
এই ঘোর অচেনা রাজ্যে আমি একটু দাঁড়াবারও জায়গা পাই না
আমি কি এখানকার কেউ নয়
এ আমার দেশ, এ আমার দেশ বলে চিৎকার করে উঠি
কর্ণপাত করে না একজনও
এমনকি আমার দেশও কোনো উত্তর দেয় না!
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম
একটি ঠিকানাহীন চিঠি এসেছে, আমার যেতে হবে
যেমন ভাবে মৃত্যুর নির্ভুল চিঠি আসে
কিন্তু মৃত্যু কারুর জন্য অপেক্ষা করে না, আমার জন্য
একজন প্রতীক্ষায় বসে আছে
সে কোথায় জানি না, সে কি সমুদ্র কিনারে
কিংবা হিমালয়ের মর্মছায়ায়
সে কি বন্যায় ধুয়ে যাওয়া মাটির ওপর নতুন পলিতে দাঁড়িয়ে আছে
সে কি শুকনো জিভ বার করে ক্লান্ত জঙ্গলের মধ্যে একাকী শয়ান
সে কি কোনো বিশাল প্লাটফর্মের পাশের জটলার মধ্যে
বসে আছে জানু পেতে
সে আমার ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া সঙ্গী
সে আমার বড় বড় চোখ,বিস্ময়ের বিমূর্ত ছেলেবেলা
আমি মানচিত্রের গলি-ঘুঁজির মধ্যে ছোটাছুটি করি
আমায় যেতে হবে, যেতে হবে!
ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি
সেই ধানক্ষেতের জায়গায় এখন ধানক্ষেত নেই
সেই নদীর ভিতরে নেই নদী
নগর উড়ে গেছে শূন্যে, সেখানে সব ছাদ-খোলা মানুষ
সেই একই মানুষের মধ্যে অন্য মানুষ
রক্ত ছড়ানো গোধূলি আকাশের নিচে এক অলীক দেশ
একদিন যারা অনুসরণকারী ছিল
আজ তারাই পলাতক
মহাকূর্মের পিঠে এক অন্ধ লিখে যাচ্ছে ইতিহাস
এক জননী তার প্রতিটি সন্তানের জন্য
একটি করে মুর্গীর ডিমও প্রসব করতে পারেনি, এই তার খেদ
যেখানে স্থাপত্য ছিল, সেখানে আজ সুড়ঙ্গ
যেখানেই যাই, সেখানেই শুনি এখানে নয়, এখানে নয়
অথচ কোথাও তো হৃদয় থাকবে এবং তার মধ্যে ভালোবাসা
বিজন নদীর ধার দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি
উৎস কিংবা মোহনার দিকে!
 
 
 
স্বাধীনতা : স্বপ্ন ভঙ্গ ও নতুন স্বপ্ন
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
 
বাবা বলেছিলেন, উনিশ শো সাতচল্লিশের পনেরোই অগাস্ট
ভারত স্বাধীন হল, আর আমরা আমাদের দেশ
হারালাম
স্পষ্ট মনে পড়ে বাবার অপমানিত মুখ আর
ধরা ধরা গলা
আমি তখন তেরো, কথাটার মর্ম ঠিক বুঝিনি
মন ছটফট করছিল বাইরের হুল্লোড়ে গলা মেলাবার জন্য
প্রভাত ফেরীতে বাজছিল বিউগল, পাশের বস্তির বাচ্চারা
কী নিয়ে চেচামেচি করছিল কে জানে
মহাত্মা গান্ধী এই শহরেরই কোথায় খাটিয়ায় শুয়ে আছেন
কে জানি বলছিলেন, তিনি খুব কাঁদছেন
আমার মা-ও ছলছলে চোখে বলে উঠলেন, চাঁপা ফুলের
গাছটা আমি নিজের হাতে লাগিয়েছি
এ বছর সে গাছে ফুল ফুটবে, আমি আর দেখতে পাব না ?
লাহোর না এলাহাবাদ, কোন শহরের হোটেলের ঘরে বসে
গরমে ঘামতে ঘামতে র্যাডক্লিফ নামের এক ইংরেজ
কাটাকুটি খেলছেন ভারতের মানচিত্র নিয়ে
তিনি আমার মায়ের চাঁপাফুল গাছের কথা কিছুই জানেন না
ঝড়ে উড়ে যাবার মতন এক একটা গ্রাম চলে যাচ্ছে
সীমান্তের এপারে ওপারে
কারুর রান্নাঘর গিয়ে পড়ল নতুন দেশে, 
কোন গৃহস্থের গোয়ালঘর রয়ে গেল পুরনো রাজ্যে
অনেক নদীও দু'ভাগ হয়ে গেল
লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন তছনছ হয়ে গেল
স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে পাঞ্জাব ও বাংলা, যেখানকার ছেলেরা জীবন পণ
সবচেয়ে বেশি লড়াই করছে দেশের মুক্তির জন্য
সেই দুটো রাজ্যই কেটে ফেলে বইয়ে দেওয়া হল রক্তগঙ্গা!
 
 
 
 
 
 
দুটি আহ্বান
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 
 
ঠাণ্ডা ঘরে রিভলভিং চেয়ারে যে ধোপদুরস্ত মানুষটি
বসে আছে
টেবিলের নীচে তার খালি পা
গাঢ় ভুরু, কণ্ঠস্বরে প্রতিষ্ঠার স্ববিরোধ
চশমায় বিচ্ছুরিত ব্যক্তিত্ব, হাতের আঙুলে সিগারেট ধরার
অবহেলা
কেউ জানে না সকাল থেকে তার নিম্ন উদরে ধিকিধিকি ব্যথা
একটা আগুন, যা কিছুই পোড়ায় না, শুধু জ্বলে
একটা অন্যমনস্কতা, যা কোথাও যায় না, মনের চারপাশেই
ঘুর ঘুর করে
সে চোখ তুললে দুজন আগন্তুক, তখনই সে শুনতে পেল
রাত্রির সমুদ্রগর্জন!
সেদিন চাঁদ টেনেছিল সমুদ্রকে
সেদিন সমুদ্রের গর্ভ থেকে লাফিয়ে উঠেছিল এক
উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঝিনুক
বাতাসে পূর্বপুরুষদের দীর্ঘশ্বাসের কলরোল
আকাশ নেমে আসে খুব কাছাকাছি, কয়েক লহমার জন্য
তখনই একটা বিদ্যুতের হাত, এক ঝলকের তীব্র বাসনা
ছুঁড়ে দিল একটা মালা
ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে দুলতে দুলতে
আসবে কিংবা ফিরে যাবে, একবার গভীরে, একবার তীরের দিকে
কখনো দীপ্ত, কখনো অন্ধকারময়
কখনো কৈশোর স্মৃতি, কখনো সব হারানোর মতন রক্তিম…
বালির ওপরে অন্ধকারে বসে আছে এক বালির মূর্তি
একটু আগে প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেছে তাই মানুষেরা সব ছাদের নীচে
চলে গেছে
দিগন্ত শুধু, একজনেরই জন্য
সিন্ধু সারসেরা ট্রি ট্রি ডাকছে
প্রেমের চেয়েও তীব্র, মাতৃস্নেহের মতন আদিম একটা টান
জীবন বদলের একটা মুহূর্ত
খিদে-তেষ্টা তুচ্ছ করা এক অধীর অপেক্ষা
সব কিছুই অন্য রকম হয়ে যেতে পারে, অন্য রকম, অন্য রকম
বালির স্তূপ ভেঙে উঠে দাঁড়ানো বোম ভাঙা শার্ট
আর ছেঁড়া চটি পরা, দাড়ি কামানো মুখ, একটি তেইশ বছর
সে কি বাল্মীকি না রত্নাকর এখনো
পেছন থেকে ভেসে আসছে কাদের ডাক, কারা তার জামা ধরে
টানছে
সে ছুটে যেতে গেল জলের দিকে
কোনো নারী তার সামনে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়ালো না
তবু সে শেষ মুহূর্তে ঘুরে গেল অন্য দিকে
সমুদ্রের মালা মিলিয়ে গেল, হাওয়ায় উড়ে এলো একটি
খয়েরি খামের চিঠি…
সেই পাহাড়ের কোনো কৌলিন্য নেই
চূড়ায় নেই মন্দির, সানুদেশে নেই নিসর্গ লোভীদের
ব্যস্ততা
নাম-না-জানা বনের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা সরু পথ
সেই পথ, সেই পাহাড় এতদিন তাকে ডেকেছিল
এমন ডাক আসে ঘুমের মধ্যে, এমন ডাক আসে আকস্মিক অপমানের
প্রতিশোধের মতন
কেউ বলেছিল কয়লা খনিতে কালো হয়ে এসো
কেউ বলেছিল, স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে ধুলো কুড়িয়ে আনো
কেউ বলেছিল চোখের জল দিয়ে ওষুধ বানাও
ভাঙো অরণ্য, বিষ মেশাও শিশুদের শরীরে
শব্দ ও অক্ষরের মধ্যে বুনে দাও চকচকে রুপোলি লোভ
নারীকে দেবীর আসন দাও, তারপর তার গর্ভপাত করো
বসে থেকো না, দৌড়োও, সবাই দৌড়োচ্ছে, পায়ে পা দিয়ে ফেলে দাও
সামনের জনকে
সেই রকম একদিন হঠাৎ সে নিমন্ত্রণ পেল
সবুজ শাওলায় ঢাকা লোমশ একটি পাথর অপেক্ষা করছে
তার জন্য
ঘোর অপরাহ্নে তার জন্য প্রতীক্ষা করেছে
পাহাড়ে হেলান দেওয়া এক টিলা
অভিমুখী পথটিতে অনেক দিন কেউ যায় নি, তবু চিনতে
অসুবিধে নেই
দুপাশের বন তুলসীর ঝাড়ে বাল্য প্রেমের সৌরভ
প্রথম কোনো স্তন স্পর্শের মন কাঁপছে পৃথিবী
নভোলোকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে নিস্তব্ধতা
সেই পাথরের বেদী, একটি নিঃসঙ্গ শিমুল গাছ তাকে কিছু দেবে
যা অন্য কেউ পায় নি
সে জানে, সে জানে, সে ছুটে যাচ্ছে
তবু যাওয়া হলো না
জুতোর পেরেকে রক্তাক্ত হলো তার পা, সে বসে পড়লো মাটিতে
তখনই সে শুনতে পেল পাতা খেলানো বাঁশির শব্দ
পা ক্ষত বিক্ষত হলে সামনে যাওয়া যায় না, পেছন ফেরা যায়
অনায়াসে
সেই বাঁশির সুরে দুলতে লাগলো তার মাথা
সে কবে পোষা সাপ হয়ে গেছে সে নিজেই জানে না…
চেয়ারটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে, চোখ থেকে চশমা খুলে
সে বললো, এখন সময় নেই, ব্যস্ত আছি, ব্যস্ত আছি
খুব ব্যস্ত…
কাব্যগ্রন্থ : নীরা, হারিয়ে যেও না
 
 
 
 
প্রেমবিহীন – 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেমের কবিতা
 
শেষ ভালোবাসা দিয়েছি তােমার পূর্বের মহিলাকে
এখন হৃদয় শূন্য, যেমন রাত্রির রাজপথ
ঝকমক করে কঠিন সড়ক, আলােয় সাজানো, প্রত্যেক বাঁকে বাঁকে।
প্রতীক্ষা আছে আঁধারে লুকানো তবু জানি চিরদিন
এ-পথ থাকবে এমনি সাজানো, কেউ আসবে না, জনহীন, প্রেমহীন
শেষ ভালোবাসা দিয়েছি তোমার পূর্বের মহিলাকে !
রূপ দেখে ভুলি কী রূপের বান, তোমার রূপের তুলনা
কে দেবে? এমন মূঢ় নেই কেউ, চক্ষু ফেরাও, চক্ষু ফেরাও
চোখে চোখে যদি বিদ্যুৎ জ্বলে কে বাঁচাবে তবে ? এ হেন সাহস
নেই যে বলবো; যাও ফিরে যাও
প্রেমহীন আমি যাও ফিরে যাও
বটের ভীষণ শিকড়ের মতো শরীরের রস
নিতে লােভ হয়, শরীরে অমন সুষমা খুলো না
চক্ষু ফেরাও, চক্ষু ফেরাও; ফেরাও!
টেবিলের পাশে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালে তােমার
বুক দেখা যায়, বুকের মধ্যে বাসনার মতো
রৌদ্রের আভা, বুক জুড়ে শুধু ফুলসম্ভার,
কপালের নিচে আমার দু’চোখে রক্তের ক্ষত
রক্ত ছেটানো ফুল নিয়ে তুমি কোন্ দেবতার
পূজায় বসবে ? চক্ষু; ফেরাও, চক্ষু; ফেরাও, শত্রু তোমার
সামনে দাঁড়িয়ে, ভীরু জল্লাদ, চক্ষু ফেরাও !
তোমার ও রূপ মূর্ছিত করে আমার বাসনা, তবু প্রেমহীন
মায়ায় তোমায় কাননের মতো সাজাবার সাধ, তবু প্রেমহীন
চোখে ও শরীরে একে দিতে চাই নদী মেঘ বন, তবু প্রেমহীন
এক জীবনের ভালোবাসা আমি হারিয়ে ফেলেছি খুব অবেলায়
এখন হৃদয় শূন্য, যেমন রাত্রির রাজপথ।।
 
 
 
উনিশশো একাত্তর
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 
 
মা, তোমার কিশোরী কন্যাটি আজ নিরুদ্দেশ
মা, আমারও পিঠোপিঠি ছোট ভাইটি নেই
নভেম্বরে দারুণ দুর্দিনে তাকে শেষ দেখি
ঘোর অন্ধকারে একা ছুটে গেল রাইফেল উদ্যত।
এখন জয়ের দিন, এখন বন্যার মতো জয়ের উল্লাস
জননীর চোখ শুকনো, হারানো কন্যার জন্য বৃষ্টি নামে
হাতখানি সামনে রাখা, যেন হাত দৰ্পণ হয়েছে
আমারও সময় নেই, মাঠে কনিষ্ঠের লাশ খুঁজে ফিরি।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
একা একা হাহাকার; আজিজুর, আজিজুর, শোন—
আমার হলুদ শার্ট তোকে দেবো কথা দেওয়া ছিল
বেহেস্তে যাবার আগে নিলি না আমার দেহ ত্ৰাণ?
লিকলিকে লম্বা ছেলে যেন একটা চাবুক, চোয়ালে
কৈশোরের কাটা দাগ, মা’র চোখে আজও পোলাপান
চিরকাল জেদী! বাজি ফেলে নদীর গহ্বর থেকে মাটি তুলে আনতো
মশাল জ্বলিয়ে আমি ভাগাড়ের হাড়মুণ্ডে চিনবো কি তাকে?
মা, তোমার লাবণ্যকে শেষ দেখি জুলাইয়ের তেসরা
শয়তানের তাড়া খেয়ে ঝাঁপ দিল ভরাবষ নদীর পানিতে
জাল ফেলে তবুওকে টেনে তুললো, ছটফটাচ্ছে যেন
এক জলকন্যা
স্টিমারঘাটায় আমি তখন খুঁটির সঙ্গে পিছমোড়া বাঁধা।
ক’টা জন্তু নিয়ে গেল টেনে হিঁচড়ে, হঠাৎ লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে
তাকালো সবার চোখে, দৃষ্টি নয়, দারুণ অশনি
ঐটুকু মেয়ে, তবু এক মুহুর্তেই তার রূপান্তর ত্রিকাল-মায়ায়
কুমারীর পবিত্ৰতা নদীকেও অভিশাপ দিয়ে গেল।
মা, তোমার লাবণ্যকে খুঁজেছি প্রান্তরময়, বাঙ্কারে ফক্সহোলে
ছেঁড়া ব্ৰা রক্তাক্ত শাড়ি–লুষ্ঠিত সীতার মতো চিহ্ন পড়ে আছে
দূরে কাছে কয়েক লক্ষ আজিজুর অন্ধকার ফুঁড়ে আছে
ধপধাপে হাড়ে
কোথাও একটি হাত মাটি খিমচে ধরতে চেয়েছিল।
যে যায় সে চলে যায়, যারা আছে তারাই জেনেছে
বাঁ হাতের উল্টেপিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়
কবরে লুকিয়ে ঢোকে ফুল চোর, মধ্য রাত্রে ভেঙে যায় ঘুম
শিশুরা খেলার মধ্যে হাততালি দিয়ে ওঠে, পাখিরাও
এবার ফিরেছে।
 
 
 
 
 
মন্দির-কাহিনী
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 
 
ট্রামটা যখনই চারমাথা মোড় পেরোয়, অফিসবাবুরা
হাত দুটো তোলে কপালে যেদিকে কালী ঠাকুরের মন্দির
তিরিশ বছর আগে যা দেখেছি, এখনও ছবিটা তেমনি
সে সব অফিসবাবুরা অনেকে হাড় জুড়িয়েছে শ্মশানে
কিংবা ছেলের সংসারে আজ বিনা বেতনের ভৃত্য
হাত জোড় করে কী চেয়েছিলেন, কী বা পেয়েছেন কে জানে!
ছেলেরা এখন অফিসযাত্রী, একই রাস্তায় রজ যায়
ঠিক জায়গায় হাত জোড় করে, চোখ বুজে কিছু বিড় বিড় 
মন্দিরখানা প্রায় একই আছে, খসেছে কিছুটা চলটা
কালী মূর্তির স্তন খুঁটে যায় আরশোলা এক গন্ডাকলার 
খোসা ও রাশি রাশি বাসি ফুল পচা কটু গন্ধ
ধেড়ে ইঁদুরেরা রাজত্ব পেয়ে রাত্তিরে করে হুল্লোড়
গত বছরই তো চোর ঢুকেছিল, নিয়ে গেছে সব গয়না
পুলিশরা এসে ভোগ খেয়ে গেছে, ঢালাও মদ্য মাংস!
পুরুত মশাই কাঁদছেন, তার মেয়ের প্রেমিক খ্রিস্টান
 ছেলেটা দিব্যি বােমা বানাচ্ছে, বাড়িতে দেয় না পয়সা
মল্লিকবাবু সেবায়েৎ, তাঁর লিঙ্গেও বাঁধা মাদুলি
তবু গাঁটে গাঁটে বাতের বেদনা, বাঁজা রইলেন গিন্নি
মহাকাল থেকে ঝুরঝুর করে খসে পড়ে কিছু ময়লা
একটি বৃদ্ধা রােজ ভোরবেলা ঝাঁট দিতে দিতে ক্লান্ত 
তারই ফোকলা মুখের হাসিটি ধার চায় কালী মূর্তি
তিনটি ভিখিরি চট পেতে বসে, কুকুরটা করে ঘুর ঘুর
প্রথমেই আসে রুক্ষ নারীটি, প্রণামের ছলে কেঁদে যায়
অশ্রু ফোঁটায় প্রতিদিন শুরু হয় জীবনের গল্প...
 
 
 
সাঁকোটা দুলছে
''''''''''''''''''''''
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায
 
মনে পড়ে সেই সুপুরি গাছের সারি
তার পাশে মৃদু জ্যোৎস্না মাখানো গ্রাম
মাটির দেয়ালে গাথাঁ আমাদের বাড়ি
ছোট ছোট সুখে সিদ্ধ মনস্কাম ।
পড়শি নদীটি ধনুকের মতো বাঁকা
... ঊরু ডোবা জলে সারাদিন খুনশুটি
বাঁশের সাঁকোটি শিশু শিল্পীর আঁকা
হেলানো বটের ডালে দোল খায় ছুটি ।
এপারে ওপারে ঢিল ছুঁড়ে ডাকাডাকি
ওদিকের গ্রামে রোদ্দুর কিছু বেশি
ছায়া ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় ক'টি পাখি
ভরা নৌকায় গান গায় ভিন দেশি ।
আমার বন্ধু আজানের সুরে জাগে
আমার দু'চোখে তখনো স্বপ্নলতা
ভোরের কুসুম ওপারে ফুটেছে আগে
এপারে শিশির পতনের নীরবতা ।
আমার বন্ধু বহু ঝগড়ার সাথী
কথায় কথায় এই ভাব এই আড়ি
মার কাছে গিয়ে পাশাপাশি হাত পাতি
গাব গাছে উঠে সে-হাতেই কাড়াকাড়ি ।
আমার বন্ধু দুনিয়াদারির রাজা
মিথ্যে কথায় জগৎ সভায় সেরা
দোষ না করেও পিঠ পেতে নেয় সাজা
আমি দেখি তার সহাস্য মুখে ফেরা ।
আমাদের ছুটি মন-বদলের খেলা
আমাদের ছুটি অরন্যে খোঁজাখুঁজি
আমাদের ছুটি হাসি কান্নায় বেলা
আমাদের ছুটি ইঙ্গিতে বোঝাবুঝি ।
খেলায় খেলায় জীবন পৃষ্ঠা ওড়ে
খেলায় খেলায় ইতিহাস দেয় উকি
এদিকে ওদিকে পৃথিবীর পিঠ পোড়ে
কত না মানুষ ভুরু কুঁচকিয়ে সুখী ।
বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে
ভেঙে যায় গ্রাম, নদীও শুকনো ধু ধু
খেলার বয়স পেরোলেও একা ঘরে
বার বার দেখি বন্ধুরই মুখ শুধু ।
সাঁকোটির কথা মনে আছে আনোয়ার ?
এত কিছু গেল, সাঁকোটি এখনো আছে
এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার
সাঁকোটা দুলছে, এই আমি তোর কাছে ।
 
 
 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
(কাব্যগ্রন্থ) :বাংলা চার অক্ষর
কুসুমের গল্প
মাদারিহাটের চা-বাগানের কম্পাউন্ডার বাবুর মেয়ে, তার ডাকনাম কুসুম
চেহারা এমন আহা মরি কিছু নয়
বয়েসের তুলনায় বড়সড়, নাকটা একটু চাপা
শ্রাবণের মেঘের মতন গায়ের রং
তার চোখ দুটিতে পাহাড়ের লুকোনো ঝর্নার চঞ্চলতা
গান জানে না, কবিতা পড়ে না, শুধু কী করে যেন একটা নাচ শিখেছে
ইস্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানে ক্লাস টেনের সেই কুসুম
আর দুটি মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাচতে নাচতে
তালে ভুল করল তিনবার
ফিক করে হেসে ফেলল লজ্জায়
কী আশ্চর্য, তবু উত্তরবঙ্গে বেড়াতে আসা
এই বাগানের মালিকের ছেলের বন্ধু উজ্জ্বল নামে যুবকটি
মুগ্ধ হয়ে গেল তাকে দেখে
নাচ নয়, কুসুমের হাসিটাই বেশি পছন্দ হয়েছিল তার
শুধু কম্পিউটার দক্ষ নয়, সম্প্রতি পিতৃবিয়োগের পর
সে হরিয়ানার একটি কারখানার উত্তরাধিকারী হয়েছে
আপত্তির তো প্রশ্নই ওঠে না, এ যে অভাবনীয় সৌভাগ্য
তিনমাসের মধ্যে বিয়ে, কুসুমকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল
দিল্লির উপান্তে
কলেজে ভর্তি করানো হল কুসুমকে, তার উচ্চারণে
বড় বেশি ভুল
নাচ শিখতে পাঠানো হল সোনাল মানসিং-এর
কাছে সোনাল তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন তিন সপ্তাহ বাদে
তার পায়ে ছন্দ নেই
দেখতে দেখতে কেটে গেল চার বছর
উজ্জ্বল চলে গেল অন্য বাগানের ফুলের দিকে
তারপর পশ্চিম গোলার্ধের স্বর্ণ মরীচিকার হাতছানিতে।
হরিয়ানার কারখানার কোয়ার্টারের দোতলায় থাকে কুসুম
এমনি কোনো অসুবিধে নেই, টিভির বেলায় কাটে সারাদিন
আর প্রায় সর্বক্ষণ আঙুলে চাটে তেঁতুলের আচার
সেইজন্যই সে চিঠি লিখতে পারে না
এক এক রাতে সে উঠে আসে ছাদে
এখানে চা-বাগানের সবুজ ঢেউ নেই
দিগন্তে নেই পাহাড়ের রেখা
শুধু শুকনো ঊষর প্রান্তর, ডাঙা জমি আর কারখানার চিমনি
মাদারিহাট থেকে বোঁটা ছিঁড়ে আনা কুসুম কিছুতেই শুকিয়ে
ঝরে যেতে রাজি নয়
সোনাল মানসিং যাই বলুন, সে এখনো একা একা নাচে
আকাশের নীচে
মাঝে মাঝে একটু আধটু তালভঙ্গ হয় হোক, কেউ তো দেখবে না
স্কুলের ফাংশনে আর যে-দুটি মেয়ে নেচেছিল তারা এখন
কোথায়, কে জানে
তাদের নাম অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা নয়
কিন্তু কুসুমের বাবা-মা শখ করে তার ভালো নাম রেখেছিলেন
শকুন্তলা
নিজের তলপেটে হাত রাখে সে আনমনে
টের পায় একটু একটু নড়াচড়া
আসছে, একজন আসছে, সে খেলা করবে সিংহশিশুর সঙ্গে
এখনো অনেক কিছু ঘটবে!
 
 
 
 
 
 
 
 

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...