Friday, January 24, 2020

তসলিমা নাসরিন









এমন ভেঙ্গে চুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে – তসলিমা নাসরিন

কী হচ্ছে আমার এসব!
যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও
প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!
আমার বুঝি খুব মন বসছে সংসারকাজে?
বুঝি মন বসছে লেখায় পড়ায়?
আমার বুঝি ইচ্ছে হচ্ছে হাজারটা পড়ে থাকা কাজগুলোর দিকে তাকাতে?
সভা সমিতিতে যেতে?
অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,
অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।
মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।
মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।
সবারই হয়ত সবকিছু হয় না, আমার যা হয় না তা হয় না।
তুমি কাল জাগালে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে প্রেমের কথা শোনালে,
মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছি
স্বপ্নই তো, এ তো একরকম স্বপ্নই,
আমাকে কেউ এমন করে ভালোবাসার কথা বলেনি আগে,
ঘুমের মেয়েকে এভাবে জাগিয়ে কেউ চুমু খেতে চায়নি
আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন
এত প্রেম কেউ দেয়নি,
এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।
তুমি এত প্রেমিক কী করে হলে!
কী করে এত বড় প্রেমিক হলে তুমি? এত প্রেম কেন জানো? শেখালো কে?
যে রকম প্রেম পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, পাইনি

আর এই শেষ বয়সে এসে যখন এই শরীর খেয়ে নিচ্ছে একশ একটা অসুখ-পোকা
যখন মরে যাবো, যখন মরে যাচ্ছি — তখন যদি থোকা থোকা প্রেম এসে ঘর ভরিয়ে দেয়,
মন ভরিয়ে দেয়, তখন সবকিছুকে স্বপ্নই তো মনে হবে,
স্বপ্নই মনে হয়।
তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।
আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে
খুব ভালোবাসি
আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের
চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে
আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে
ভোর করতে পারি।








রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে লেখা চিঠি – তসলিমা নাসরিন

প্রিয় রুদ্র,
প্রযত্নেঃ আকাশ,
তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুড়ে থাকো? তুমি আকাশে উড়ে বেড়াও? তুলোর মতো, পাখির মতো? তুমি এই জগত্সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছো। তুমি আসলে বেঁচেই গেছো রুদ্র। আচ্ছা, তোমার কি পাখি হয়ে উড়ে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না? তোমার সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না, ইচ্ছে ঠিকই হয়, পারো না। অথচ এক সময় যা ইচ্ছে হতো তোমার তাই করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে – করতে। ইচ্ছে যদি হতো সারাদিন পথে পথে হাটতে – হাটতে। কে তোমাকে বাধা দিতো? জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিলো। এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছো। আমার ভেবে অবাক লাগে, জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। ওরা তোমাকে ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি রেখে এলো, তুমি প্রতিবাদ করতে পারোনি।
আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘ বছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলী খালার সাথে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন! তুমি আর কারো সঙ্গে প্রেম করছো, এ আমার সইতো না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম! তাই কি? যেন আমাকেই তোমার ভালোবাসতে হবে। যেন আমরা দু’জন জন্মেছি দু’জনের জন্য। যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেলো বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিলো। ঢাকা শহরটিকে এতো ফাঁকা আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এতো হাহাকারও আর কখনো জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। আমার ঘরে তোমার বাক্সভর্তি চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিলো চার বছরের। এতো বছর পরও তুমি কী গভীর করে বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে! সেদিন আমি টের পেয়েছি।
আমার বড়ো হাসি পায় দেখে, এখন তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরোচ্ছে। তারা তখন কোথায় ছিলো? যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙ্গারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছো। আমি না হয় তোমার বন্ধু নই, তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে। এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধ হয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়। যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝিনা তারা তখন কোথায় ছিলো?


শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিলো। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে … তুমি বোঝোনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। এই ভেবে যে, তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছো! তার গল্প শোনাচ্ছো ! ঠিক এইরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিলো তোমার! আজ আরেকজনের জন্য তোমার অস্থিরতা। নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বলো? তুমি শিমুলকে নিয়ে কি কি কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে! আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে, কেমন হয়েছে। আমি বললাম, খুব ভালো। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালোবাসো, যখন নিজেই বললে, তখন আমার কষ্টটাকে বুঝতে দেইনি। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয়।
আকাশের সঙ্গে কতো কথা হয় রোজ! কষ্টের কথা, সুখের কথা। একদিন আকাশভরা জোত্স্নায় গা ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের। তুমি দু চারটি কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে। “ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও”। মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে তুমি কার চিঠি চেয়েছিলে? আমার? নেলী খালার? শিমুলের? অনেক দিন ইচ্ছে তোমাকে একটা চিঠি লিখি। একটা সময় ছিলো তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। তুমিও লিখতে প্রতিদিন। সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনো মেটে না, তবু মানুষ আর বাঁচে ক’দিন বলো? দিন তো ফুরোয়। আমার কি দিন ফুরোচ্ছে না? তুমি ভালো থেকো। আমি ভালো নেই।
ইতি,
সকাল
পুনশ্চঃ আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি। কতোকাল ঐ ডাক শুনি না। তুমি কি আকাশ থেকে সকাল, আমার সকাল বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? নাকি আমি ভুল শুনি?











টোপ -তসলিমা নাসরিন

যেরকম ছিলে, সেরকমই তুমি আছ
কেবল আমাকে মাঝপথে ডুবিয়েছ
স্বপ্নের জলে উলটো ভাসান এত
আমি ছাড়া আর ভাগ্যে জুটেছে কার!


আগাগোড়া তুমি অবিকল সেই তুমি
বড়শিতে শুধু গেঁথেছ দু’চার খেলা
অলস বিকেল খেলে খেলে পার হলে
রাত্তিরে ভাল নিদ্রাযাপন হয়।
তুমি তো কেবলই নিদ্রার সুখ চেনো
একশো একর জমি নিজস্ব রেখে
এক কাঠা খোঁজো বর্গার তাড়নায়
বর্গার চাষ পৃথক স্বাদের কিনা!
স্বাদ ভিন্নতা পুরুষ মাত্র চায়
তুমি তো পুরুষই, অধিক কিছু নও।
পুরুষেরা ভাল চোখ খেতে জানে চোখ
আমার আবার কাজলের শখ নেই।

  বড়শিতে গাঁথা হৃদপিন্ডের আঁশ
ছিঁড়ে খেতে চাও, তুমি তো পুরুষই
খাবে।
সাঁতার জানি না, মধ্যনদীতে ডুবি
অন্ধকে টোপ দেবার মানুষ নেই।








শুনছো!
- তসলিমা নাসরিন


আমি তুমুল প্রেমে পড়েছি তোমার,
শুনছো, শুনতে পাচ্ছে!?
এমন প্রেমে অনেককাল আমি পড়িনি
এমন করে কেউ আমাকে অনেককাল আচ্ছন্ন করে রাখেনি।
এমন করে আমার দিনগুলোর হাত পা রাতের পেটে সেঁধিয়ে যায়নি
এমন করে রাতগুলো ছটফট করে মরেনি!
গভীর ঘুম থেকে টেনে আমাকে তুমি বসিয়ে দিলে–
এভাবে কি হয় নাকি?
আমি হাত বাড়াবো আর এখন তোমাকে পাবো না, রাতের পর রাত পাবো না!
আমি ঘুমোবো না, একফোঁটা ঘুমোবো না,
কোথাও যাবো না, কিছু শুনবো না, কাউকে কিছু বলবো না,
স্নান করবো না, খাবো না!
শুধু ভাববো তোমাকে, ভাবতে ভাবতে যা কিছুই করিনা কেন,
সেগুলো ঠিক করা হয়না–
ভাবতে ভাবতে আমি বই পড়ছি, আসলে কিন্তু পড়ছি না,
বইয়ের অক্ষরে চোখ বুলোনো ঠিকই হবে, পড়া হবে না
ভাবতে ভাবতে আমি সেন্ট্রাল স্কোয়ারে যাচ্ছি, যাচ্ছি কিন্তু যাচ্ছি না,
ঘণ্টা দুই আগে পেরিয়ে গেছি স্কোয়ার, আমি কিন্তু হাঁটছিই,
কিছুই জানি না কী পেরোচ্ছি, কোথায় পৌঁচোচ্ছি,
এর নাম হাঁটা নয়, কোথাও যাওয়া নয়,
এ অন্য কিছু, এ কারও তুমুল প্রেমে পড়া।

কিছু একটা করো, স্পর্শ করো আমাকে, চুমু খাও
শুধু ঠোঁটে নয়, সারা শরীরে চুমু খাও, তুমুল চুমু খাও
অত দূরে অমন করে বসে থেকো না, উড়ে চলে এসো, উড়ে এসে চুমু খাও।
আমার ঠোঁটজোড়া ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে আছে, তোমার উষ্ণতা কিছু দাও,
তুমি তো আগুন, আমার অমল অনল, এসো তোমাকে তাপাবো,
তোমাকে তাপাতে দাও।
শুনছো,
তুমুল প্রেমে তুমিও পড়ো না গো!







কারো কারো জন্য এমন লাগে কেন!
- তসলিমা নাসরিন


জানি না কেন হঠাৎ কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, কারও কারও জন্য খুব
অন্যরকম লাগে
অন্য রকম লাগে,
কোনও কারণ নেই, তারপরও বুকের মধ্যে চিনচিনে কষ্ট হতে থাকে,
কারুকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, পেতে ইচ্ছে হয়, কারুর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে
বসতে ইচ্ছে হয়,
সারাজীবন ধরে সারাজীবনের গল্প করতে ইচ্ছে হয়,
ইচ্ছে হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও ইচ্ছে হয়।

ইচ্ছের কোনও লাগাম থাকে না। ইচ্ছেগুলো এক সকাল থেকে আরেক সকাল পর্যন্ত
জ্বালাতে থাকে। প্রতিদিন।
ইচ্ছেগুলো পুরণ হয় না, তারপরও ইচ্ছেগুলো বেশরমের মত পড়ে থাকে,
আশায় আশায় থাকে।
কষ্ট হতে থাকে, কষ্ট হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও হতে থাকে,
সময়গুলো নষ্ট হতে থাকে।
কারও কারও জন্য জানি না জীবনের শেষ বয়সে এসেও সেই কিশোরীর মত
কেন অনুভব করি।
কিশোরী বয়সেও যেমন লুকিয়ে রাখতে হত ইচ্ছেগুলো, এখনও হয়।
কি জানি সে, যার জন্য অন্যরকমটি লাগে, যদি
ইচ্ছেগুলো দেখে হাসে!
সেই ভয়ে লুকিয়ে রাখি ইচ্ছে, সেই ভয়ে আড়াল করে রাখি কষ্ট।
হেঁটে যাই, যেন কিছুই হয়নি, যেন আর সবার মত সুখী মানুষ আমিও, হেঁটে যাই।
যাই, কত কোথাও যাই, কিন্তু তার কাছেই কেবল যাই না, যার জন্য লাগে।
কারও কারও জন্য এমন অদ্ভুত অসময়ে বুক ছিঁড়ে যেতে থাকে কেন!
জীবনের কত কাজ বাকি, কত তাড়া!
তারপরও সব কিছু সরিয়ে রেখে তাকে ভাবি, তাকে না পেয়ে কষ্ট আমাকে কেটে কেটে
টুকরো করবে জেনেও তাকে ভাবি। তাকে ভেবে কোনও লাভ নেই জেনেও ভাবি।
তাকে কোনওদিন পাবো না জেনেও তাকে পেতে চাই।







মুক্তি
তসলিমা নাসরিন


যদি ভুলে যাবার হয়, ভুলে যাও।
দূরে বসে বসে মোবাইলে, ইমেইলে হঠাৎ হঠাৎ জ্বালিয়ো না,
দূরে বসে বসে নীরবতার বরফ ছুড়ে ছুড়ে এভাবে বিরক্তও করো না।
ভুলে গেলে এইটুকু অন্তত বুঝবো ভুলে গেছো,
ভুলে গেলে পা কামড়ে রাখা জুতোগুলো খুলে একটু খালি পায়ে হাঁটবো,
ভুলে গেলে অপেক্ষার কাপড়চোপড় খুলে একটু স্নান করবো,
ভুলে গেলে পুরোনো গানগুলো আবার বাজাবো,
ভুলে গেলে সবগুলো জানালা খুলে একটু এলোমেলো শোবো।
রোদ বা জ্যোৎস্না এসে শরীরময় লুকোচুরি খেলে খেলুক, আমি না হয় ঘুমোবো,
ঘুমোবো ঘুমোবো করেও নিশ্চিন্তের একটুখানি ঘুম ঘুমোতে পারিনা কত দীর্ঘদিন!
কেবল অপেক্ষায় গেছে। না ঘুমিয়ে গেছে। জানালায় দাঁড়িয়ে গেছে।
কেউ আমাকে মনে রাখছে, কেউ আমাকে মনে মনে খুব চাইছে, সমস্তটা চাইছে,
কেউ দিনে রাতে যে কোনও সময় দরজায় কড়া নাড়বে,
সামনে তখন দাঁড়াতে হবে নিখুঁত, যেন চুল, যেন মুখ, যেন চোখ, ঠোঁট,
যেন বুক, চিবুক এইমাত্র জন্মেছে, কোথাও ভাঙেনি, আঁচড় লাগেনি, ধুলোবালি ছোঁয়নি।
হাসতে হবে রূপকথার রাজকন্যার মতো,
তার ক্ষিধে পায় যদি, চায়ের তৃষ্ণা পায় যদি!
সবকিছু হাতের কাছে রাখতে হবে নিখুঁত!
ভালোবাসতে হবে নিখুঁত!
নিমগ্ন হতে হবে নিখুঁত!
ক্ষুদ্র হতে হবে নিখুঁত!
দুঃস্বপ্নকে কত কাল সুখ নামে ডেকে ডেকে নিজেকে ভুলিয়েছি!
ভুলে যেতে হলে ভুলে যাও, বাঁচি।
যত মনে রাখবে, যত চাইবে আমাকে, যত কাছে আসবে,
যত বলবে ভালোবাসো, তত আমি বন্দি হতে থাকবো তোমার হৃদয়ে, তোমার জালে,
তোমার পায়ের তলায়, তোমার হাতের মুঠোয়, তোমার দশনখে।
ভুলে যাও, মুখের রংচংগুলো ধুয়ে একটু হালকা হই, একটুখানি আমি হই।





কিছুক্ষণ থাকো
         তসলিমা নাসরিন

কী হচ্ছে আমার এসব!
যেন তুমি ছাড়া জগতে কোনও মানুষ নেই, কোনও কবি নেই, কোনও পুরুষ নেই, কোনও
প্রেমিক নেই, কোনও হৃদয় নেই!
আমার বুঝি খুব মন বসছে সংসারকাজে?
বুঝি মন বসছে লেখায় পড়ায়?
আমার বুঝি ইচ্ছে হচ্ছে হাজারটা পড়ে থাকা কাজগুলোর দিকে তাকাতে?
সভা সমিতিতে যেতে?
অনেক হয়েছে ওসব, এবার অন্য কিছু হোক,
অন্য কিছুতে মন পড়ে থাক, অন্য কিছু অমল আনন্দ দিক।
মন নিয়েই যত ঝামেলা আসলে, মন কোনও একটা জায়গায় পড়ে রইলো তো পড়েই রইল।
মনটাকে নিয়ে অন্য কোথাও বসন্তের রঙের মত যে ছিটিয়ে দেব, তা হয় না।
সবারই হয়ত সবকিছু হয় না, আমার যা হয় না তা হয় না।

তুমি কাল জাগালে, গভীর রাত্তিরে ঘুম থেকে তুলে প্রেমের কথা শোনালে,
মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছি
স্বপ্নই তো, এ তো একরকম স্বপ্নই,
আমাকে কেউ এমন করে ভালোবাসার কথা বলেনি আগে,
ঘুমের মেয়েকে এভাবে জাগিয়ে কেউ চুমু খেতে চায়নি
আমাকে এত আশ্চর্য সুন্দর শব্দগুচ্ছ কেউ শোনায়নি কোনওদিন
এত প্রেম কেউ দেয়নি,
এমন ভেঙে চুরে ভালো কেউ বাসেনি।
তুমি এত প্রেমিক কী করে হলে!
কী করে এত বড় প্রেমিক হলে তুমি? এত প্রেম কেন জানো? শেখালো কে?
যে রকম প্রেম পাওয়ার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, পাইনি
আর এই শেষ বয়সে এসে যখন এই শরীর খেয়ে নিচ্ছে একশ একটা অসুখ-পোকা
যখন মরে যাবো, যখন মরে যাচ্ছি — তখন যদি থোকা থোকা প্রেম এসে ঘর ভরিয়ে দেয়,
মন ভরিয়ে দেয়, তখন সবকিছুকে স্বপ্নই তো মনে হবে,
স্বপ্নই মনে হয়।
তোমাকে অনেক সময় রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না,
হঠাৎ ঝড়ে উড়ে হৃদয়ের উঠোনে
যেন অনেক প্রত্যাশিত অনেক কালের দেখা স্বপ্ন এসে দাঁড়ালে।
আগে কখনও আমার মনে হয়নি ঘুম থেকে অমন আচমকা জেগে উঠতে আমি আসলে
খুব ভালোবাসি
আগে কখনও আমার মনে হয়নি কিছু উষ্ণ শব্দ আমার শীতলতাকে একেবারে পাহাড়ের
চুড়োয় পাঠিয়ে দিতে পারে
আগে কখনও আমি জানিনি যে কিছু মোহন শব্দের গায়ে চুমু খেতে খেতে আমি রাতকে
ভোর করতে পারি।





রাতগুলো 
  তসলিমা নাসরিন

একদিন অনেক রাতে ফোন করলে,
ঘুম থেকে জেগে সে ফোন ধরতে ধরতে অনেকটা সময় চলে গেল
ইস আরেকটু হলে তো রেখেই দিতে!
সেই থেকে কোনও রাতেই এখন আর আমি ঘুমোই না,
যদি ফোন করো!
যদি কথা বলতে ইচ্ছে করো!
অনেক অনেক কথা আমি মনে মনে মুখস্ত করে রাখি তোমাকে বলবো বলে,
যদি কোনওদিন কথা শুনতে ইচ্ছে করো!

দিনে তো ঘুমোইই না, দিনে তো হঠাৎ হঠাৎ ফোন করই তুমি,
দিনে কিন্তু তোমাকে আমি বলি না আমি যে রাত জেগে থাকি!
সব কথা তো আর তোমার জানার দরকার নেই,
কিছু কথা আমি একা জানলেই তো হল!
যদি আবার ফোন করো, ফোন বাজতে থাকে আর ধরতে ধরতেই রেখে দাও ওদিকে,
যদিও একবারই করেছিলে, সেই রাতের পর আর করোনি, কিন্তু যদি করে ফেলো হঠাৎ
কোনও রাতে! ঘুমোই না, জেগে থাকি ফোনটা হাতের কাছে নিয়ে।
আমার কিন্তু খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে ফোন করি,
যে কথা আমার বলতে ইচ্ছে করে, বলি।
কিন্তু ফোন করি না, বলি না, তুমি যদি আবার বলে বসো প্রেমে পড়ে আমার মাথাটা গেছে,
ণত্ব ষত্ব জ্ঞান নেই!
প্রেমেও পড়বো, মাথাও ঠিক থাকবে — এরকমটা ভালো জানো বলে
মাথাটা যে সত্যি সত্যি আমার গেছে তার কিছুই তোমাকে বুঝতে দিই না।
তার চেয়ে এই ভেবে ছাড়া ছাড়া সুখ পাও যে প্রেমে পড়েছি,
আজকালকার চালাকচতুর রমণীরা যেরকম প্রেমে পড়ে।
এই ভেবেই স্বস্তি পাও যে তুমি এখন আমাকে ছেড়ে গেলেও,
আমার খুব একটা কিছু যাবে আসবে না।



১৫০০ সাল কবিতা 
 তসলিমা নাসরিন

শতবর্ষ পরে এই কবিতাটি কেউ না কেউ পড়বে...
যে পড়বে সে যদি নারী হয়, সে কি তখনও কেবল নারীই?
ধরে নিচ্ছি নারী নয়, সে তখন আদ্যোপান্ত মানুষ’
সে আর চার দেওয়ালে বন্দি নেই, তার পায়ে যে সহস্র বছরের শেকল ছিল,
সে শেকল নেই
তার হাতে যে কুরশি-কাঁটা আর খুন্তি ছিল, নেই।
হাতে উঠেছে কলম, কাস্তে, কোদাল আর কলকবজা।
সে মানুষের মতাে হাঁটে, দৌড়ােয়, হা হা হাসে
মাছের মুড়াে খায়, দুধের সরও, তাকে আর ভুগতে হয় না পুষ্টিহীনতায়।
সে যদি নারী হয়,
তাকে কেউ পাঠশালায় না পাঠিয়ে
ঠেলে দিতে পারছে না জ্বলন্ত উনুনের কাছে, তাকে আর
পরাতে পারছে না বাল্যবিবাহের ফাঁস, তাকে আর
আবৃত করতে পারছে না ভুতুড়ে বােরখায়।
সে নিশ্চয় তখন দাবি করতে পারে সমান উত্তরাধিকার
সে নিশ্চয় তখন দাবি করতে পারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্মান
সে নিশ্চয় তখন দাবি করতে পারে জরায়ুর স্বাধীনতা, কন্যা জন্ম
সে নিশ্চয় তখন দাবি করতে পারে চাঁদ বা সূর্যের
নীচে তার অবাধ বসবাস!

যে পড়ছে এই কবিতা, সে নারী বা পুরুষ হোক
সে নিশ্চয় ধর্মের গ্রাস থেকে ইতিমধ্যে মুক্ত
তাকে আর পাঁচবেলা কপাল ঠুকতে হয় না মেঝেয়
তাকে আর প্রসাদ খেতে হয় না ঠাকুরের।
মসজিদ-মন্দির ভেঙে গজিয়ে গেছে মনোলোভা ফুলের বাগান।
জুসমে জুলুসে নেই, পিরের মাজার নেই, স্বৈরাচারের উৎপাত নেই, কাঁটাতার নেই
বদলে দিগন্ত অবধি রজনীগন্ধার ঘ্রাণ, মুগ্ধ ভালবাসা।
শতবর্ষ পর নেতার বাড়িতে, শিক্ষাঙ্গনে, শহরে, গ্রামে কি
দ্রিম দ্রিম বর্ষণ চলে গুলির? ককটেলের?
দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সন্ত্রাসের দেশে
অক্ষত আছে কি শহিদ মিনার, স্বােপার্জিত স্বাধীনতা,
অপরাজেয় বাংলা, জয়দেবপুরের মুক্তিযােদ্ধা, স্মৃতিসৌধ ?
তখনও কি একুশের ভােরে খালি গায়ে ফুল দিতে ভিড় করে অগণন বাঙালি?
তখনও কি বৈশাখে, শরতে, অঘ্রানে, ফাগুনে উৎসব হয়
প্রথম প্রভাতের, সাদা মেঘের, নবান্নের, ঝরাপাতার হাওয়ার...
তখনও কি মানুষ মানুষের জন্য গান গায়, কাঁদে?
যে তুমি পড়ছ এই কবিতা, তুমি কি জানাে শত বছর আগে
কী ভীষণ স্বপ্নহীন অন্ধকারে একাকী হেঁটেছিলাম
নত, ন্যুব্জ নষ্ট মানুষেরা ? দারিদ্রে, পারমাণবিক ধোঁয়ায়,
অশিক্ষায়, অজ্ঞতায়, জরায়, ব্যাধিতে ক্লান্ত ক্লিষ্ট...
তুমি বা তােমরা নিশ্চয় হাতের মুঠোয় নিতে পারো।
সততা ও সমতার আলোকিত ব্রহ্মাণ্ড ?
আমরা পারিনি।
এই সুফলা মাটির শরীর ফুঁড়ে ততদিনে নিশ্চয় জন্মেছেন আরেক রামমোহন ,
আরেক ঈশ্বরচন্দ্র, ক্ষুদিরাম, সুভাষ বসু, আরেক রবীন্দ্রনাথ,
জন্মেছেন সূর্য সেন, প্রীতিলতা, বেগম রােকেয়া, শেখ মুজিব,
জন্মেছেন নূর হােসেন। শতবর্ষ পরে সমৃদ্ধ বাংলায়,
আমার কবিতা যদি ধুলােয় লুটোয়, তবু
মাছ-ভাতে বাঙালি বাঁচুক,
গোলাপের গন্ধে বাঁচুক স্বপ্নবান মানুষ
শুদ্ধ স্নিগ্ধ ভালবাসায় বাঁচুক, বৃক্ষেরা সবুজ হোক আরও।






কথা রাখো 
 তসলিমা নাসরিন
 
কথা ছিল
থাকব অনেক দিন।
বসন্তে ফুল কুড়াবো
বর্ষায় ভিজব।
শীতে আরও কাছাকাছি
হতে চাইব
কথা ছিল।

সব কথা রাখা হয় না। হয়ে ওঠে না।
হাসপাতালের বিছানার ঠিক পাশেই
জানলা দিয়ে কথা বলে যে অশােক ফুলের ডালপালা,
আমি জানি
তারাও বুঝে গেছে,
কথা রাখা হয়ে উঠবে না এই মানুষটার।
রাত্রে
সব নিঃস্তব্ধ হয়ে এলে
অন্ধকার এসে কাঁধে হাত রাখে।
বিছানার এক পাশে চুপটি করে বসে।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়
তারপর
নরম স্বরে বলতে থাকে।
দুঃখ করিস না।
কথা তো কেউই রাখেনি। কেউ না।
কথা-
এই ভীষণ স্বার্থপর সময়ে, শুধুই কথা।
কথা মানে মোহ ,
কথা মানে মায়া।
কথা মানে সাজানো গোছানো মিথ্যা।
দুঃখ করিস না।
একজন কথা রাখবেই।
সে এসেই
এই স্যালাইন, এই ট্যাবলেট, এই ইঞ্জেকশন
সব দূর করে ফেলে দিয়ে বলবে -
চলো আমার হাত ধরো ধরো
আমি শেষ পর্যন্ত যাব।
শেষ পর্যন্ত।
আমি তোমার মেঘমালা নই।
আমার কোনো ছলনা নেই।
চলো ।
আমি আগুন পর্যন্ত যাব
আমি ছাই পর্যন্ত যাব।





#শেষ_চুম্বন
#তসলিমা_নাসরিন


ধরা যাক মেয়েটির নাম মেয়ে আর ছেলেটির নাম ছেলে।
সেই যে কোত্থেকে উড়ে এসে ছেলেটি হঠাৎ চুমু খেয়েছিল,
হঠাৎ মেয়েটিকে অবাক করে অবশ করে,
কোনও প্রেম ছাড়া, কাল দেখা হচ্ছে বা পরশু আসছি ছাড়া,
সেই যে গভীর করে চুমু খেয়েছিল, সেই যে চুরমার করে, 

টুকরো টুকরো করে,
সেই যে ভেঙে, ছিড়ে,
এক ঘর আলোয়,
সেই যে মেয়েটিকে আচমকা ডুবিয়ে ভাসিয়ে চুমু খেয়েছিল,
ছেলেটির তারপর থেকে দেখা নেই আর।

মেয়েটি জানে না ছেলেটি কে, কোথায় বাড়ি,
শুধু চোখদুটো দেখেছিল,
চোখদুটোয় দুটো মার্বেল ছিল,
যেন ছোটবেলার খেলার মাঠে পড়ে থাকা দুটো ঝকঝকে মার্বেল,
এত হুড়মুড় করে কৈশোর আসেনি দীর্ঘদিন,
কারও চোখের চাওয়ায় উতল হাওয়াও এত ছিল না কোনওদিন..
হঠাৎ চমকে উঠে মেয়েটি বলে, ছেলেটি কি সেই ছেলে?
নিজেকেই তারপর বারবার বলে,
 ছেলেটি তো সেই ছেলে যে ছেলে ঘুরন্ত লাটিম এনে
হাতের তালুতে দিত প্রতিদিন!
যতক্ষণ লাটিম ঘুরতো তালুতে,
মনে হতো পুরো জগত তার হাতের মুঠোয়।
মেয়েটির শিরশির করতো শরীর,
ছেলেটি মুগ্ধ চোখে দেখতো, খেলার মাঠে পড়ে থাকা
মার্বেলদুটো থেকে আলো ছিটকে এসে পড়তো সেই চোখে,
দুটো মার্বেল চোখ ছিল সেই মুগ্ধ চোখে।
ছেলেটি তবে কি সেই খেলার মাঠের ছেলে,
এই চুমু খাওয়া ছেলে?
ছেলেটি তবে কি ঘুরন্ত লাটিম ছেলে?
এই হঠাৎ আচমকা চুমু খাওয়া ছেলে?
কোনওদিন আবার আসবে কি না সে,
আবার চুমু খাবে না কি না, মেয়েটি জানে না।
মেয়েটি জানেনা,
সে রাতে আর কোথাও চুমু খাওয়ার কেউ ছিল না বলে
ছেলেটি চুমু খেয়েছিল, হাতের কাছে যাকে পেয়েছিল খেয়েছিল,
ঝড়বৃষ্টির রাতে, নির্জন রাতে, সাত পাঁচ না ভেবেই খেয়েছিল।
পরদিন নেশা কেটে গেলে ছেলেটি ভুলেও গেছে খেয়েছিল।
মেয়েটির স্বামী এসে সপ্তাহান্তের সঙ্গম সেরে যায়,
স্বামী চুমু খেতে গেলে মুখ ঠোঁট সরিয়ে নেয় মেয়ে,
 এই শরীর দিচ্ছি নাও, সঙ্গমে সারাদিন মেতে থাকো,
সারারাত থাকো,
চুল থেকে পায়ের নখ অবধি চাখো চোষো, শুধু চুমুটা খেও না।
শেষ চুম্বনের স্মৃতি টুকু বাঁচিয়ে রাখে মেয়ে।
ওই চুমু তার হাতের মুঠোয় গোটা একটা জগত দেয়।
ওই চুমু তাকে এক ঝাঁক কৈশোর দেয়,
ছেলেটির চেয়ে বড় হয়ে উঠতে থাকে ছেলেটির চুম্বন,
চুম্বনের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে থাকে মেয়েটির কৈশোর।
কৈশোরের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে থাকে কৈশোরের স্বপ্ন।
স্বপ্নগুলো হিরের মতো, ঠিকরে বেরোতে থাকে আলো।
 সেই আলোয় ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে
মার্বেল চোখের ছেলে, তার প্রতিরাতের নেশা,
তার যাকে তাকে চুমু খাওয়া,
তার ভুলে যাওয়া, তার না আসা।




মন উঠো - তসলিমা নাসরিন


মন তুমি ওঠো, ওঠো তুমি, তুমি ওঠো মন,
মন মন মন ওঠো মন ওঠো মন তুমি ওঠো ওঠো মন
মন ওঠো তুমি
ওঠো তুমি মন
মন মন মন
ওঠো, লক্ষ্মী মন, তুমি ওঠো এবার,
ওঠো ওই পুরুষ থেকে, মন ওঠো,
ওঠো তুমি, শেকল ছিঁড়ে ওঠো, ভালোবাসার শক্ত শেকলটা ছিঁড়ে এখন ওঠো
তুমি তোমার মত করে কথা বলো,
তুমি তোমার মত তাকাও
তোমার মত হাসো
আনন্দ তোমার মত করে করো। দুঃখ তোমার মত করো।
মন তুমি ওঠো, যতক্ষণ তুমি ওই পথে, পথিকে, ওই পতিতে, ওই পুরুষে,
পুরুষের পদাঙ্কে, পদাশ্রয়ে, ওই পাতে, পতনে,
যতক্ষণ তুমি পরজীবী, তুমি পরোপজীবী, যতক্ষণ পরায়ত্ত, পরাহত,
ততক্ষণ তুমি তুমি নও।
যতক্ষণ প্রণত, প্রচ্ছন্ন, ততক্ষণ তুমি প্রফুল্ল নও, প্রবল প্রখর নও, প্রতাপান্বিত নও
ওঠো, পরিত্রাণ পেতে ওঠো, প্রাণ পেতে ওঠো।
মন ওঠো মেয়ে, ও মেয়ে, ওঠো,
পুনর্জন্ম হোক, পুনরুত্থান হোক তোমার।
হৃদয়ে কখনও এমন আস্ত একটি পুরুষ পুরে রেখো না,
পুরুষ যখন ঢোকে, একা ঢোকে না, গোটা পুরুষতন্ত্র ঢোকে।
এই তন্ত্রের মগজ-মন্ত্রে মুগ্ধ হবে, প্রেমে প্রলুব্ধ হবে, মৃত্যু হবে তোমার তোমার।
ও মন তুমি ওঠো, নাচো, তোমার মত, তোমার মত করে বাঁচো।







বইমেলা
তসলিমা নাসরিন


সারা বছর বসে থাকি এই মেলাটি আসবে বলে।
এই মেলাটির অলি গলির ভিড়ের মধ্যে
নতুন বইয়ের গন্ধে ঘ্রাণে, ধুলোবালির ধুসর হাওয়ায়,
হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই মেলাটি আসবে বলে
আকাশপারের উতল হাওয়ায় ইচ্ছে মতো ঘুড়ি ওড়াই।
বছর বছর এই মেলাটি আসে বলেই স্যাঁতসেঁতে এক ঘরের কোণেও
খুব গোপনে ভীষণ সুখে, স্বপ্নসহ বেঁচে থাকি।

আমার তো আর পুজো-আচ্চা, ঈদ-বড়োদিন নেই,
আমার একটি মেলাই আছে, প্রাণের মেলা,
এই একটি মেলায় মানুষ দেখি কাছের মানুষ,
সাত-নদী-জল সাঁতরে তবু একটুখানি ছুঁতে আসে।
এই মেলাটিই ধর্মকর্ম, ধূপের কাঠি, ধানদুব্বো।
এই একটি পরব, একটি সুখ-ই, নিজের জন্য তুলে রাখি।
শিল্প-মেলায় আগ্রহ নেই, জুয়োর মাঠ, ব্যবসা পাতি,
সন্ধে হলে উৎসবে নেই, ককটেলে নেই।
এই একটি মেলাই একমাত্র।
এই মেলাটিই শৈশব দেয়, কৈশোর দেয়,
ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেসব এঁটেল মাটির আনন্দ দেয়।
এই মেলাটির সারা গায়ে মাতৃভাষা,
মাথার ওপর স্নেহসিক্ত মায়ের আঁচল।
এই মেলাকেই অন্য অর্থে জীবন বলি।
এটিও তুমি কেড়ে নিলে?
স্বদেশহারা স্বজনহারা
সামান্য এই সর্বহারার সবটুকু সুখ
বুকের ওপর হামলে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে
এক থাবাতে ছিনিয়ে নিতে পারলে তুমি ভারতবর্ষ?
দাঁত বসিয়ে কামড় মেরে ছিঁড়েই নিলে যা-ছিল-সব?
হৃদয় বলতে কিছুই কি নেই ভারতবর্ষ?
হৃদয় তবে কোথায় থাকে ভারতবর্ষ?




তুই কোথায় শেফালি
তসলিমা নাসরিন



আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তুই কোথায়
আমার খুব তোকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে
তোর সঙ্গে আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে
অনেকক্ষণ ধরে কথা, সারাদিন ধরে কথা, সারারাত ধরে কথা
.
আমার জানতে ইচ্ছে করছে অনেক কিছু
আমাকে একটু একটু করে, আমার খুব কাছে বসে, চোখে তাকিয়ে
চোখে না তাকিয়ে, হেসে, না হেসে, চুলে বিলি কেটে কেটে না কেটে কেটে
তুই বলবি সব, যে কথাগুলো বলার তোর কথা ছিল।
আমারও তো শোনার কথা ছিল শেফালি।
তুই কোথায় শেফালি?
যেখানে আছিস, সেখানে কি তোকে এখন দুবেলা খেতে দেয়?
তোকে জামা কাপড় দেয়, টাকা পয়সা দেয়?
নাকি তোকে কাপড় ধুতে পাঠিয়ে জলকলের মেশিনে হাত দিতে বলে,
যেন তুই জ্বলে যাস, যেন তুই ছাই হয়ে যাস!
যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা তোর আর্তনাদ শোনে, যেন হাত না বাড়ায়, যেন না বাঁচায়!
যেন দাঁডিয়ে দাঁড়িয়ে তারা তোর মরে যাওয়া দেখে!
.
তোর কিছু গোপন স্বপ্ন ছিল,
সেই স্বপ্নের কথা তুই বলবি বলেছিলি,
একটি ঘরের স্বপ্ন ছিল তোর, তোর নিজের ঘরের,
জন্মে তো কখনও নিজের কোনও ঘর দেখিসনি!
সেই স্বপ্ন, নিজেই নিজের জীবনের কর্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন।
খুব গোপন স্বপ্ন।
আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোকে,
কাছে বসে, আমাকে ছুঁয়ে না ছুঁয়ে, কেঁদে না কেঁদে
তুই সেইসব সর্বনাশা স্বপ্নের কথা, বেহায়া বেশরম সুরে বলবি, সারাদিন বলবি
.
চারদিকে কোথাও তুই নেই কেন, হাত শুধু ফিরে ফিরে আসে,
আমাকে পেতে দে তোকে, পেতে দে,
ফিরিয়ে দিস না শেফালি!





 ফিরে এসো
-তসলিমা নাসরিন


কোনও একদিন ফিরে এসো,
যে কোনও একদিন, যেদিন খুশি
আমি কোনও দিন দিচ্ছি না,
কোনও সময় বলে দিচ্ছি না, যে কোনও সময়।
তুমি ফিরে না এলে এই যে কী করে কাটাচ্ছি দিন
কী সব কাণ্ড করছি,
কোথায় গেলাম, কী দেখলাম
কী ভালো লেগেছে, কী না লেগেছে — কাকে বলবো!
তুমি ফিরে এলে বলবো বলে
আমি সব গল্পগুলো রেখে দিচ্ছি।
চোখের পুকুরটা সেচে সেচে খালি করে দিচ্ছি,
তুমি ফিরে এলে যেন
এই জগৎসংসারে দুঃখ বলে কিছু না থাকে।
তুমি ফিরে আসবে বলে বেঁচে আছি,
বেঁচে থেকে যেখানেই যা কিছু সুন্দর পাচ্ছি,
দেখে রাখছি,
তুমি এলেই সব যেন তোমাকে দেখাতে পারি।
যে কোনও একদিন ফিরে এসো,
ভর দুপুরে হোক, মধ্যরাত্তিরে হোক—
তোমার ফিরে আসার চেয়ে সুন্দর
এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডের সমস্ত সুন্দর জড়ো করলেও
তোমার এক ফিরে আসার সুন্দরের সমান হবে না।
ফিরে এসো, যখন খুশি।
নাও যদি ইচ্ছে করে ফিরে আসতে,
তবু একদিন এসো, আমার জন্যই না হয় এসো,
আমি চাইছি বলে এসো,
আমি খুব বেশি চাইছি বলে।
আমি কিছু চাইলে কখনও তো তুমি না দিয়ে থাকোনি !




ভাল নেই, ভাল থেকো – তসলিমা নাসরিন।

এতদিন জানতাম, এটা রুদ্র-ক্র লিখা তসলিমা নাসরিনের একটা চিঠি ছিলো। আজ দেখলাম, এটা আসলে এর চেয়ে বেশী কিছু ছিলো। এটা পোষ্ট করার উদ্দেশ্য একটাই, আমি যা জেনেছি অন্যরাও তা জানুক এবং বুঝুক। এটা একটা সাহিত্য বটে…


প্রিয় রুদ্র,
প্রযত্নে আকাশ
তুমি আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলেছিলে। তুমি কি এখন আকাশ জুড়ে থাকো? তুমি কি আকাশে উড়ে বেড়াও তুলোর মত? পাখির মত? আমারও খুব পাখি হতে ইচ্ছে করে। আমারও সারা আকাশ উড়ে উড়ে মেঘের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় ছাদে উঠে আকাশ দেখতাম খুব। রাতে তারা গুণতাম। সবাই আমাকে পাগল বলত, বলত পাগল ছাড়া আর কেউ তারা গোণে না। আমি যে কেন রাতভর তারা গুণতাম, বুঝি না। মাঝে মাঝে এত ঘোরের মধ্যে থাকতাম যে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতাম, যেন নাগাল পাওয়া যাবে, যেন আমি স্পর্শ করলেই নক্ষত্রগুলো ফুলের পাপড়ির মত আমার হাতে ঝরে পড়বে। এখনও ফাঁক পেলেই আকাশ দেখি। জানালার কাছে বিছানা পেতেছি। লেখার টেবিলটি এমন জায়গায় রেখেছি যেন আকাশ দেখা যায়। বাড়িতে গাছপালার ডাল ছড়ালে ছেঁটে দিই যেন আকাশ আবার ঢেকে না যায়। তুমি এই জগৎ সংসার ছেড়ে আকাশে চলে গেছ, তুমি আসলে বেঁচেই গেছ রুদ্র। আমরা যারা জলে ডাঙায় পড়ে আছি, তাদের যন্ত্রণা কিন্তু কম নয়। বেঁচে থেকে তুমিও তো যন্ত্রণা কম পোহাওনি।
আচ্ছা, তোমার কি এরকম ইচ্ছে হয় না আবার একদিন পাখি হয়ে উড়ে উড়ে ফিরে আসতে, যেখানে ছিলে সেখানে, সেই ইন্দিরা রোডের বাড়িতে, আবার সেই নীলক্ষেত, শাহবাগ, পরীবাগ, লালবাগ চষে বেড়াতে? ইচ্ছে তোমার হয় না – এ আমি বিশ্বাস করি না। ইচ্ছে ঠিকই হয়। পারো না। অথচ একসময় যা ইচ্ছে হত তোমার, তাই করতে। ইচ্ছে যদি হত সারারাত না ঘুমিয়ে গল্প করতে, করতে। ইচ্ছে যদি হত সারাদিন পথে পথে হাঁটতে, হাঁটতে। ইচ্ছে যদি হত মেথরপট্টি গিয়ে পেট ভরে মদ খেতে, খেতে। কে তোমাকে বাঁধা দিত ! জীবন তোমার হাতের মুঠোয় ছিল, এই জীবন নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলেছ। আমার ভেবে অবাক লাগে জীবন এখন তোমার হাতের মুঠোয় নেই। যারা তোমাকে একদিন ট্রাকে উঠিয়ে মিঠেখালি নিয়ে গেল মাটির তলায় পুঁতে রাখতে, তুমি তাদের বলতে পারোনি না যাব না। ঘুরে দাঁড়াতে পারোনি। মিঠেখালির সেই কবরখানার কথা বড় মনে পড়ে, একদিন তুমি বলেছিলে – এখানে আমার বড় মামা আছেন, সেজ মামাও, আমার নানু, নানা। কে জানত, এরপর তোমার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী তোমার মামা মামি মা খালাদের রেখে তুমি ওই কবরখানায় ঢুকবে ! আচ্ছা রুদ্র, তোমার শরীরখানাকে যখন মাটিচাপা দিল তখন কষ্ট হয়নি তোমার? মাঝে মধ্যে আমি মাটি চাপা কষ্ট অনুভব করি, মনে হয় আশেপাশের মানুষগুলো আমাকে আস্ত পুঁতে ফেলছে মাটিতে, আমার চোখে আলো পড়ছে না। আমি কথা বলতে পারছি না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মৃত্যুর আগেই এমন মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব আর কি কেউ করে? এদিক থেকে আমার বোধহয় লাভই হল, আমি যখন মরব, আমার কষ্ট অনেকটা কমে আসবে। বলতে পারো আমি কিভাবে মরব? আমি ঠিক জানি ওরা আমাকে মেরে ফেলবে একদিন, যেকোনও দিন দেখব মরে পড়ে আছি। হাত পায়ের রগ কাটা। আমাকে তুমি বলেছিলে – ‘আমার মরতে ইচ্ছে করে মিছিলে, গুলি খেয়ে।’ মৃত্যুর কথা শুনে আমার গা কাঁপত। জগতে মৃত্যুর মত ভয়ংকর আর কিছু নেই। মৃত্যু আছে জেনেও আমি বুঝি না মানুষ কি করে দীর্ঘস্থায়ী করে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ, বিচ্ছেদ! ভাবলে আমার অবাক লাগে এই পৃথিবীতে আমি আর থাকব না। আমিও তোমার মত হুট করে একদিন মরে যাব। তোমার মত দাঁত মাজতে মাজতে চমৎকার একটি দিন শুরু করব যখন, দেখব মুখ থুবড়ে পড়ে আছি বেসিনে। আচ্ছা, এরকম হতে পারে না প্রতি একশ বছর পর পর জন্ম নেব! তাতে একটি লাভ হবে, মানুষ কত সভ্য হল তা চোখে দেখতে পাব। এখন তো আমার প্রায়ই মনে হয় এদেশের মানুষ দিন দিন এমন অধঃপাতে যাচ্ছে, তাদের আর সভ্য হবার সম্ভাবনা নেই। আবার এও মনে হয় দেশ থেকে একদিন মৌলবাদ দূর হবে, ধর্ম দূর হবে, মানুষ সুস্থসুন্দর জীবন যাপন করবে, এরকম দিন নিশ্চয় একদিন আসবে, একবার দুচোখ মেলে সেই দিনটি আমার দেখতে ইচ্ছে করে। তুমি ধর্ম মানতে না, অথচ দেখ তোমার মৃত্যু উপলক্ষ্যে কোরানখানি মিলাদ মাহফিল কী না হল! তোমার যদি বাধা দেবার শক্তি থাকত, আমি জানি দিতে। মনে আছে তুমি আমি দুজন মিলে সন্ধানীতে চোখ দিয়েছিলাম, শরীর দিয়েছিলাম, যেন মৃত্যুর পর চোখ কোনও অন্ধকে আলো দেয়, যেন মেডিকেল কলেজের শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষে শরীর কেটে ছিঁড়ে ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে, অথচ তোমার চোখও নিল না কেউ, শরীরও নিল না! তুমি মুসলমানের মত লোবানের ধোঁয়ায় ভেসে চুপচাপ কবরে গেলে। আমার বড় মায়া হচ্ছিল দেখে। আমি যে কাউকে ডেকে বলব ‘ওকে নেবেন না, ও ওর শরীর দিতে চেয়েছে মেডিকেল কলেজে’….কিন্তু আমার কথা কে শুনবে ওখানে? আমি যখন দরজার বাইরে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে ছিলাম, মোহন নামের এক ছেলে তোমাকে আর্ট কলেজে পেটাতে চেয়েছিল একদিন, হুমকি দিয়েছিল তোমাকে যেন ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় আর না দেখে,সেই ছেলেই দেখলাম তুমি শুয়ে আছ, তোমার সবচেয়ে কাছে সে বসে আছে। কী অবাক কাণ্ড, তাই না? তুমি কি বেঁচে থাকলে ওকে এত কাছে বসতে দিতে? তুমি কি বেঁচে থাকলে দরজার বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দিতে আমাকে? খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর যেটুকু দেখা যায়, বড় শখ করে সাজানো আমার সংসারটি দেখছিলাম, ময়মনসিংহ থেকে দুজনে শোবার জন্য খাট বানিয়ে এনেছিলাম, বসবার জন্য চেয়ার, বই রাখবার আলমারি, কবিতা লিখবার টেবিল। স্বপ্নগুলো তখন টগবগে ঘোড়ার মতছিল, বাঁধ মানত না কিছু। আমার বাবা যখন আদেশ দিলেন ঘরের বাইরে যাওয়া চলবে না, আমি রুখে উঠলাম যাব ব’লে। মা এসে কেঁদে পড়লেন, আমি মাকে ঠেলে সরিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছিলাম। প্রেম বুঝি এমনই দুরন্ত হয়। যেদিন আমার বাবার বাড়ি থেকে বাবা মায়ের আদেশ নিষেধ তুচ্ছ করে তোমার তাজমহল রোডের বাড়িতে উঠেছিলাম, তুমি ছিলে না। পাগলের মত অপেক্ষা করেছি কখন ফিরবে, ফিরলে রাত একটায়, দরজা খুলে জড়িয়ে ধরতে যাব তোমাকে, দেখি তোমার মুখ থেকে ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে, আমি তখন মদ চিনি না, মাতাল চিনি না, ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম সারারাত। আহা,প্রেমিকের সঙ্গে যাপন করা আমার প্রথম সেই রাত!
আচ্ছা, তোমার লালবাগের সেই প্রেমিকাটির খবর কি, দীর্ঘবছর প্রেম করেছিলে তোমার যে নেলীখালার সঙ্গে? তার উদ্দেশ্যে তোমার দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা দেখে আমি কি ভীষণ কেঁদেছিলাম একদিন ! তুমি আর কারও সঙ্গে প্রেম করছ এ আমার সইত না। কি অবুঝ বালিকা ছিলাম, তাই না? যেন আমাকেই তোমার ভালবাসতে হবে, যেন আমরা দুজন জন্মেছিই দুজনের জন্য। যেন আর কেউ আমাদের হৃদয়ে ঠাঁই পেতে পারে না। আসলে কেউ কি কারও জন্য জন্মায়? আমি অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে এখন বুঝি মানুষ আসলে নিজের জন্য জন্মায়। তুমি যেদিন বললে তোমার নেলীখালার সঙ্গে তুমি শুয়েওছিলে, আমার ইচ্ছে হয়েছিল আত্মহত্যা করি। তখন আমি অপিয়ামের নাম জানি, যা খেলে খুব নীরবে মরে যায় মানুষ। যদি বুদ্ধি করে অপিয়াম এনে দিতে হাতে, ওর নির্যাসটুকু পান করে দিব্যি মরে যেতে পারতাম। এক রাতে নেলীখালা এসেছিল বাড়িতে, তুমি ব্যাকুল হয়ে উঠলে, তোমার চোখের তারায় ভালবাসা কাঁপছিল। আমার একা একা লাগছিল, যে আমি তোমাকে দুদণ্ড চোখের আড়াল করতে পারি না সেই আমাকে তুমি একা ঘরে ফেলে খালার সঙ্গে পাশের ঘরে দীর্ঘ-দীর্ঘ-ক্ষণ কাটিয়ে দিলে। মাঝে মধ্যে আমার মনে হত আমি বোধহয় খুব স্বার্থপর, তোমাকে আমি কারও সঙ্গে ভাগ করতে চাই না। তুমি তা বুঝেই হয়ত মুক্ত দাম্পত্যের কথা বলতে, যেন আমার জীবনে তোমাকে এত শক্ত করে না বাঁধি। তুমি বাঁধন আলগা করতে চাইতে কেবল নিজের বেলায়। আমার বেলায় কিন্তু নয়। একবার আমি ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম নয়াপল্টন, একা; বিকেলে ফিরে এলে বললে – ‘তুমি কারও সঙ্গে রিক্সায় কলাবাগানের দিকে গিয়েছ?’ বললাম – নাতো! – ‘তবে যে তোমার মত দেখলাম?’ বললাম – ‘ভুল দেখেছ।’ এই ভুল দেখা নিয়ে তুমি কিন্তু ছটফট কম করনি। আমি কারও সঙ্গে মিশেছি জানলে যদি তোমার কষ্ট হয় তবে তুমি কেব বুঝতে চাইবে না যে আমারও কষ্ট হয় তুমি যখন আমাকে একা রেখে লালবাগ যাও, বাণিয়াশান্তা যাও! আসলে দাম্পত্য মানেই বন্ধন, এ কখনও মুক্ত হয় না। মুক্ত হলে এটি আর দাম্পত্য থাকে না।
আমার সবচেয়ে ভাল লাগত ম্যাচবাক্স টোকা দিয়ে দিয়ে যখন গাইতে ‘আমার মনের কোণে বাউরি বাতাস…’ তখন আমার মনের কোণেও, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করতাম বাউরি বাতাস বইছে। তুমি কি এখন আর গান গাইবে না রুদ্র? সাকুরার কোণার টেবিলে বসে আমাদের কত গানের দুপুর কেটেছে! মাঝে মধ্যে সাকুরার সেই টেবিলটিতে বসি, এক দু পেগ ব্ল্যাক লেবেল পান করি, আর ভেবে খুব হাসি পায় মদ ব্যাপারটিকে একসময় কী ভীষণ ঘৃণা করতাম! তুমি মদ খেয়েছ শুনলে সারারাত বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতাম! বালিকা বয়সে সবাই বোধহয় ওরকমই হয়।
যেদিন ট্রাকে করে তোমাকে নিয়ে গেল বাড়ি থেকে, আমার খুব দম বন্ধ লাগছিল, ঢাকা শহরটিকে এত ফাঁকা আর কখনও লাগেনি। বুকের মধ্যে আমার এত হাহাকারও আর কখনও জমেনি। আমি ঢাকা ছেড়ে সেদিন চলে গিয়েছিলাম, ময়মনসিংহে আমার ঘরে বাক্স ভর্তি তোমার চিঠিগুলো হাতে নিয়ে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম। আমাদের বিচ্ছেদ ছিল চার বছরের, এত বছর পরও তুমি কী গভীর করে আমার বুকের মধ্যে রয়ে গিয়েছিলে, সেদিন আমি টের পেয়েছি। তোমার সঙ্গে শেষ দিকে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হত, একবার আমার আরমানিটোলার বাড়ি নিয়ে এলাম তোমাকে, আঙুল তোমার পচে যাচ্ছিল, সেটিকে মেডিকেলে নিয়ে পুঁজ রক্ত বার করে ব্যাণ্ডেজ করে দিলাম, বাড়ি এনে ভাত খাইয়ে দিলাম মুখে তুলে। তুমি শিশুর মত আদর নিলে। আদর পেলে তুমিও শরীর পেতে সেই আদর গ্রহণ কর, কিন্তু হঠাৎ তোমার কী হয় কে জানে, সব আদর পায়ে মাড়িয়ে চলে যাও। আমার এই দুঃখ কোনওদিন যাবে না, যে, তোমাকে আমি আমার করে কখনও পেতে পারিনি। শেষ দিকে ব্যবসা বাণিজ্যে মার খেয়ে গেলে বলেই হয়ত ওষুধ কিনবার পয়সাও তোমার পকেটে ছিল না, আমার বড় হাসি পায় দেখে এখন তোমার শয়ে শয়ে বন্ধু বেরোচ্ছে, তারা তখন কোথায় ছিল যখন পয়সার অভাবে তুমি একটি সিঙারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছ? আমি না হয় তোমার বন্ধু নই তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম বলে, এই যে এখন তোমার নামে মেলা হয়, তোমার চেনা এক আমিই বোধহয় অনুপস্থিত থাকি মেলায়,যারা এখন রুদ্র রুদ্র বলে মাতম করে বুঝি না তারা তখন কোথায় ছিল, কেন আমি তোমাকে ত্যাগ করবার পরও আমাকেই তোমার পকেটে টাকা গুঁজে দিতে হত? মাতম করা বন্ধুদের বেশির ভাগই যে কেবলই তোমার বাংলা-মদ-পানের পার্টনার ছিল, সে আমি জানি।
তুমি খুব চাইতে লেখাকে তোমার পেশা করতে। পারোনি। যারা তোমাকে চেনে না, যখন জিজ্ঞেস করত ‘আপনি কি করেন’, তুমি বলতে ‘লিখি’। ওরা অবাক হত শুনে। ভাবতো লেখা আবার কোনও পেশা হয় নাকি? লেখাকে শেষ অবদি পেশা করেছি আমি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির টেবিলে রেজিগনেশন রেখে চলে এসেছি প্রায় একবছর হল। এর মধ্যে কত কিছু ঘটে গেছে তুমি কি খবর রাখো? আকাশ থেকে তো সব দেখা যায়, তুমি কি দেখ? নাকি সবাইকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়! পিপীলিকার মত মানুষগুলো হাঁটছে দৌড়াচ্ছে, ঘরবাড়ি গড়ছে, স্বপ্ন দেখছে, মরে যাচ্ছে, তুচ্ছ এই জীবনের সুখের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে-মাঝে মধ্যে বেঁচে থাকবার জন্য মানুষের কাণ্ড দেখে এই জগতে দাঁড়িয়েও আমার হাসি পায়, তুমি কেন হাসবে না, বল! তুমি তো সকল সীমানার বাইরে চলে গেছ, আমাদের এই ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে অনেক দূরে। তবে কী জানো রুদ্র, মানুষের প্রতি মানুষের ঈর্ষা যে এত মারাত্মক হতে পারে তা সাহিত্য করবার আগে আমার জানা ছিল না। কলকাতা থেকে আমাকে আনন্দ পুরস্কার দিল, লোকে এ নিয়ে বড় রাগ করল, আমার বই বিক্রি হয় তাতেও ওদের রাগ, আমাকে ডুবিয়ে ভাসিয়ে পত্রিকা বিক্রি করল, হু হু করে বিক্রি হল সব, তাতেও ওদের রাগ কএম না, এখন ধুমসে বই লেখা চলছে আমাকে নিয়ে, কবে কাকে দুটো চিঠি লিখেছি সেই চিঠি নিয়ে বই। রেজাকে চিনতে না? আমার একটি চিঠির বই বার করছে। কেন এসব হয় বল তো, তুমি তো একবার পত্রিকায় লিখলে তোমার ওপর রাগ করে আমি যেন আর পুরুষমানুষদের বিরুদ্ধে না লিখি, যেন ক্ষমা করে দিই। পুরুষদের ক্ষমা তো আমি করতেই চাই, কিন্তু তুমি কি পারতে আমার জায়গায় হলে? আমার মত ভুগতে যদি পুরুষ দ্বারা, জানি, খুব ভালো করেই জানি তুমি ক্ষমা করতে না।
তোমার সঙ্গে আমি দেখেছি সবচেয়ে বেশি জমত সাহিত্যের গল্পে; সমাজ পরিবর্তনের জন্য তোমার ভাবনাগুলো, আমার ভাবনার সঙ্গে বড় মিলত। একবার মনে আছে ‘কালো কাঁচ গাড়ি’ নিয়ে তুমি আমি দুজনেই আধঘণ্টায় একটি কবিতা লিখব বলে স্থির করি। কবিতা লেখা শেষ করে দেখি তোমার আমার কবিতার বিষয় হুবহু এক, বর্ণনা শুধু ভিন্ন। সাহিত্যের আড্ডা যখন হয়, আমার বাড়িতেই মাঝে মাঝে আসর বসাই, তোমার অভাব খুব অনুভব করি, হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হয়ে যাই যে তুমি থাকলেবোধহয় সেই গানটি ধরতে, ‘আমার মনের কোণে বাউরি বাতাস…’। কতদিন আমার মনে বাউরি বাতাস বয় না, কতদিন আমি আর আবেগে আগের মত কাঁপি না, যেমন কেঁপে উঠতাম তোমার সামান্য স্পর্শে। সবচেয়ে যে জিনিসটি আমি বেশি চাইতাম দুজনের মধ্যে, তা নিখাদ ভালবাসা আর বিশ্বাস। তুমি দিন দিন লুকিয়ে লুকিয়ে সেটিরই খেলাপ করতে। তুমি করতে সে তোমার অক্ষমতা, তবে আমি কিন্তু মরতে দিইনি তোমার প্রতি আমার তীব্র ভালবাসাকে। আমি রাগ করেছি, তালাকনামা পাঠিয়েছি, কিন্তু আবেগ একফোঁটা কমেনি। একা একা বুকে করে সব বয়ে বেড়িয়েছি। এখনও তোমার পুরোনো চিঠিগুলোদেখলে হৃদয়ে ধুকপুক বাড়ে। মনে পড়ে তোমার এক একটি চিঠি আমাকে এক সমুদ্র সুখে ভিজিয়ে রাখত। কত কী যে ঘটে গেল, এখন আমার জীবন জুড়ে তুমি নেই তোমার চিঠি আছে, ‘তুমি নেই তোমার বন্ধন পড়ে আছে’র মত। চিঠিগুলো দুলাল নামের এক ছেলে চেয়েছিল ছেপে দেবার জন্য, দিইনি। একান্ত যা আমার, তা আমি সাত লোককে পড়াবো কেন?
শেষদিকে তুমি শিমুল নামের এক মেয়েকে ভালোবাসতে। বিয়ের কথাও হচ্ছিল। আমাকে শিমুলের সব গল্প একদিন করলে। শুনে, তুমি বোঝনি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই ভেবে যে তুমি কি অনায়াসে প্রেম করছ, তার গল্পও শোনাচ্ছ, ঠিক এরকম অনুভব একসময় আমার জন্য ছিল তোমার। আজ আরেক জনের জন্য তোমার অস্থিরতা, নির্ঘুম রাত কাটাবার গল্প শুনে আমার কান্না পায় না বল? তুমি শিমুলকে নিয়ে কী কী কবিতা লিখলে তা দিব্যি বলে গেলে, আমাকে আবার জিজ্ঞেসও করলে- কেমন হয়েছে? আমি বললাম – খুব ভাল। তুমি হঠাৎ হঠাৎ বড় অকপট ছিলে, যে জিনিসটি আমার বড় ভাল লাগত। শিমুল মেয়েটিকে আমি কোনওদিন দেখিনি, তুমি তাকে ভালবাসো যখন নিজেই বললে, জানি না আমার ওপর শোধ নেবার জন্যই বললে কি না, আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, যে কষ্ট তোমাকে আমি বুঝতে দিইনি। কারণ তোমাকে ছেড়ে কারও সঙ্গে এক ঘরে হয়ত আমি বাস করেছি কিন্তু ভালবাসতে পারিনি, ভালবাসা যে যাকে তাকে বিলোবার জিনিস নয় এ কথা তুমি যদি না বোঝ, পাছে আমাকে দোষী কর, তাই বলিওনি শত কোলাহলে ডুবে থেকেও আমার একাকীত্বের গল্প। কেবল তোমার গল্পই শুনে গেছি। শুনতে শুনতে হেসেছি, হাসতে হাসতে চোখ মুছেছি আঁচলে।
ঠাঁই ছিল না আমার সোনার তরীতে, এঘাটে ওঘাটে কেবল দিয়ে ফিরেছি, সব দিয়ে নিজের ঘাটে শূন্য তরী ভিড়িয়েছি। জীবন ভর সকলে কেবল দুহাত ভরে নিল। তা নিক, আমি যে দিতে পারি এই আমার সুখ। মানুষ তো শেষ অবধি মানুষের জন্যই।
তোমাকে ছাড়া আর দুটো পুরুষ ছুঁয়েছি বলে লোকে আমাকে চরিত্রহীন বলে। তুমি যে মালিটোলায়, লালবাগে, টানবাজারে, বাণিশান্তায় এত নারী ছুঁয়েছ তোমাকে কিন্তু কেউ চরিত্রহীন বলে না। মেয়েদের বেলায় যত ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার। মেয়েদের বেলায় যত ছিছি, যত আহা আহা, গেল গেল রব। মেয়েরা যত বড় কবি হোক, লেখক হোক, বিজ্ঞানী কী বৈমানিক হোক, আগে সতীত্বটা ঠিক রাখতে হবে তারপর সব। দিন দিন এমন হচ্ছে যে মেয়েরা সতী হবার চেষ্টাই প্রাণপণে করে যায়, অন্য কিছু হবারপেছনে সময় অত ব্যয় করে না। মেয়েরা আসলে সতীত্ব বেঁচে খায়। আর এই সতীত্ব বেঁচে খাওয়ায় পুরুষেরা বড় প্রীত থাকে মেয়েদের প্রতি, আর মেয়েরাও এমন নির্বোধ যে পুরুষদের আরও প্রীত করবার জন্য জীবনভর ব্যস্ত থাকে। অধিকাংশ মেয়েদের তো নিজের খাবার নিজে যোগাড় করার যোগ্যতা নেই, পরের ওপর খায়। পরনির্ভর মেয়েরা যখন সতীত্বের বড়াই করে, দেখে এত রাগ হয় আমার কী বলব!
আকাশের সঙ্গে কত কথা হয় রোজ। কষ্টের কথা, সুখের কথা। এখনও রাতের আকাশ পেলে কাজকম্ম ফেলে কিশোর-বেলার মত নক্ষত্র গুনি। একদিন আকাশ ভরা জ্যোৎস্নায় গা ভেসে যাচ্ছিল আমাদের, তুমি দুচারটে কষ্টের কথা বলে নিজের লেখা একটি গান শুনিয়েছিলে – ‘ভাল আছি ভাল থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ মংলায় বসে গানটি লিখেছিলে। মনে মনে কার চিঠি তুমি চেয়েছিলে? আমার? নেলীখালার? শিমুলের?
অনেকদিন ইচ্ছে তোমাকে একটি চিঠি লিখি। একটা সময় ছিল, তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম,তুমিও লিখতে প্রতিদিন। তোমার অনেকগুলো ঠিকানা ছিল, মংলার, মিঠেখালির, ঢাকার। আর সেবার আরমানিটোলার বাড়িতে বসে দিলে আকাশের ঠিকানা। তুমি পাবে তো এই চিঠি? আকাশের সঙ্গে আমারও বন্ধুত্ব ভাল। যে কোনও দিন হুট করে চলে যাব তুলোর মত উড়ে বেড়াতে। না পড়া বইগুলো ফেলে, গোছা গোছা স্বপ্ন ফেলে, প্রিয় মানুষ ফেলে, তুমি যেমন চলে গেছ, এমন তো আমিও যাব।নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে এক্কা দোক্কা খেলব। জগতের দিকে চোখ রেখে আমার কি তখন খানিকটা দুঃখ হবে এই ভেবে যে কিছুই দেখা হয়নি যা দেখার কথা ছিল! হবে হয়ত, জীবন এবং জগতের তৃষ্ণা তো মানুষের কখনও মেটে না। তবু মানুষ আর বাঁচে কদিন, বল? দিন তো ফুরোয়। আমারও কি দিন ফুরোচ্ছে না?
তুমি ভাল থেকো। আমি ভাল নেই।
ইতি
সকাল
পুনশ্চ- আমাকে সকাল বলে ডাকতে তুমি। কতকাল ওই ডাক শুনি না! তুমি কি আকাশ থেকে ‘সকাল, আমার সকাল’ বলে মাঝে মধ্যে ডাকো? নাকি আমি ভুল শুনি !

(গল্পগ্রন্থ “দুঃখবতী মেয়ে” থেকে সংকলিত)




বাবার কাছে চিঠি
--তসলিমা নাসরিন

বাবা তুমি কেমন আছো? এখন  কি আগের মত মর্নিং ওয়াক এ যাও? ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে?  ব্রহ্মপুত্রে তো জল নেই। তবে তুমি কার দিকে তাকাও? কাশফুল গাছগুলো তো আজকাল তেমন ফোটে না। তবে কি মানুষ দেখ? মানুষের ঢল নামে যে সার্কিট হাউসের মাঠে, সে মানুষ? মানুষেরা কি এখন তোমার দিকে এগিয়ে আসে আগের মতো? চেনা মানুষ বন্ধুরা, অথবা দু-চারজন পড়শি। নাকি ধর্মদ্রোহী কন্যা জন্ম দেবার অপরাধে তোমাকে হাঁটতে হয় মাথা নিচু করে! গাছগাছালির আড়ালে। মানুষের শেন দৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে।
হয়ত আজকাল morning walkও ছাড়তে হয়েছে ভোরের হাওয়া খেতে আসা মানুষগুলো তোমাকে আঙ্গুল তুলে শ্বাষায় বলে। তোমার জন্য আমার বড় মায়া হয়, বড় মায়া হয় আমার।
সেই ছোটবেলায় জুতোর  মচমচ শব্দ ঢুকতে যখন বাড়িতে এক্কা দোক্কার দাগ মুছে দৌড়ে যেতাম পড়ার টেবিলে ।
এখনো মনে আছে একদিন চুলার পাশে বসে কি একটা রান্না শিখছিলাম বলে উঠোনে  সজনে ডাটা ছিল তাই নিয়ে তারা করেছিলে যেন ঘরে যাই পড়তে বসি যেন মানুষ হই পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে দিনে 70 বার তোমার 'ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ' মন্ত্র শুনতে শুনতে।
মানুষ কতটুকু হয়েছি জানি না তবে এইটুকু জানি দূর্যোগ এলে মিথ্যের খোপের মধ্যে যখন তাবৎ লোকেরা লুকোয় তখন মেরুদন্ড শক্ত করে বেশ দাঁড়াতে পারি একা। সত্যগুলো জিভের আগুনে খইয়ের মতো ফোটে আর এ কারণে আজ আমাকে লক্ষ্য মিথ্যুকেরা খুঁজছে ফাঁসি দেবে বলে, আমি হুলিয়া মাথায় নিয়ে ছুটছি ঘোড় অন্ধকারে আলো নেই বুঝলে বাবা এতটুকু আলো নেই কোথাও। দেশ কি এভাবেই এরকম ভুতুড়ে অন্ধকারে ডুবে থাকবে? মানুষগুলো খোপের ভেতরে বোবা কালা অন্ধ স্বপ্নহীন বেঁচে থাকবে। দীর্ঘ আয়ু আর খাদ্য আর তসবির কৌটা আর লোভ আর মোহ-মাৎসর্য নিয়ে!
তুমিও কি চোখের সামনে বোঝো যে আলো নেই!
তুমিও কি পায়ের তলায় বোঝো যে মাটি নেই,
তুমিও কি হাতের কাছে বোঝে যে কোন বন্ধুর হাত নেই, তুমিও কি মাথার উপর বোঝা যে মেঘ জমছে!
এখনো কি নতুন বাজারের আরোগ্য বিতানে বসো? রোগী দেখ? গরিব রোগীরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেয়! এইযে তোমার উদার দরজা মানুষের সেবার জন্য খোলা তুমি কি জীবনের শেষ বয়সে এসে পারো? রোগীর নাড়ি দেখতে ঠিক ঠিক! নাকি ধর্মদ্রোহী কন্যা জন্ম দেওয়ার অপরাধে যারা তোমার মাথায় পাথর ছুঁড়ে মারে তারা তোমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় রোগীর কব্জি কেড়ে নেয় তোমার stethoscope, x-ray machine, microscope, scalpel, forcep ?
তুমি একা পড়ে থাকো। বড় একা। কপালের দুপাশে দপদপ শিরা দুটো দুহাতে চেপে তোমার জন্য বড় মায়া হয় আমার বড় মায়া।
একটু একটু করে যখন মানুষ হয়ে উঠছি রক্তে টগবগ করে ফুটছে যেন মানুষ হই তোমার সেই মন্ত্র। কোথায় তুমি সকালে ঘুম ভেঙে দেখবে গোলাপ যেমন পল্লবিত হয় তেমন অন্ধকার কেটে কেটে পড়েছে আমি দুহাতে ভরে আলো আনছি থোকা থোকা । তোমার জন্যে, আর 12 কোটি মানুষের জন্যে। তোমার তো ব্লাড প্রেসার বেশি, নিজের চিকিৎসায় তোমার কখনো মন নেই, জ্বরে গা পুড়ে গেলেও টলতে-টলতে তুমি চলে যাও রোগী দেখতে। বিনে পয়সার রোগী নিজের রক্ত বমি রেখে অন্যের অম্বল সারাও। এই তোমাকে আজ মাথা নত করে কাঁদতে হয় রাস্তায়, দেয়ালে পোস্টার পড়েছে ধর্মদ্রোহী কন্যার ফাঁসির দাবিতে। আমাদের বাড়ির দেয়ালেও নাকি বাবা? সেদিন ওরা তিন দফা ভাঙচুর করলো আমাদের বাড়িতে, তোমার চেম্বারে। ঐ ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে তোমার কি মনে হয়নি ধর্ম বেচে খায় এরা ধর্মই এদের মসনদে উঠার মসৃন সিঁড়ি? ধর্মকে তখন মনে হয়নি তোমার যে এটি আসলে বেঁচে খাওয়ায় এটি কেবল বোকা বানাবার অন্ধ বানাবার বধির বানাবার তেতো মিষ্ট ফল,আফিম?
তোমার জন্য মায়া হয় আমার, বড় মায়া। কতদিন দেখা হয়না তোমার সাথে। কত দীর্ঘদিন শেষ যখন দেখি, দেখে তোমাকে মনে হয়নি তুমি সেই আগের তুমি, আগের সেই ঋজু শরীর আর নেই, আগের সেই গমগম কন্ঠস্বর, আগের সেই জুতোর মচমচ শব্দ, আগের সেই ‌।
তুমিতো হেরেছ জীবনে অনেক, আমিও। কিন্তু তোমার গ্রামকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলে, চেয়েছিলে ধানে, পাটে, শাকে, সবজিতে, বৃক্ষের, ফলে ছেয়ে যাক তোমার শখের গ্রাম। এত সবুজের স্বপ্ন তুমি কি করে লালন করতে? তোমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে যতই উপরে উঠি, যতই উঠি কোন শীর্ষের নাগাল পাইনা এই কৌতূহলী আমিও । বিনিময়ে ঐ গ্রামের লোকেরাই তোমার মাথায় কুড়োলের কুপ বসালো। আর আমার স্বপ্নের ওপর দেশসুদ্ধ মানুষ ফেলে দিচ্ছে মন মন পাথর, গজারি কাঠ, হাতবোমা, আগুন, বিষাক্ত সাপ, পাখির দড়ি কি ভিষন তাণ্ডব চারিদিকে তাইনা বাবা? একটি মানুষকে হত্যা করবে বলে লক্ষ্য লক্ষ্য লোক তাড়া করছে, হন্যে হয়ে খুঁজছে। তুমি কি ভয় পাচ্ছ? বাবা ব্লাড প্রেসার কাটছে? না বাবা ভয় পেয়ো না, আমি ঠিকই দাঁড়াব। ওদের পাথর, বোমা, তলোয়ার, পিস্তলের সামনে আমি অনড় দাঁড়িয়ে থাকবো । এত অনড় দাঁড়াবো যে- ওরা হয়তো ওদের অস্ত্র নিক্ষেপ করে আমার দেহকে নির্মূল করবে। কিন্তু বিশ্বাস, বিশ্বাস তো নড়বে না জানি ছড়িয়ে দিয়ে গেছি হাজার মানুষের মাধ‍্যে।
তা মানুষ গোপনে হলেও রোপণ করবে ওতে জল দেবে আর যারা যদি বড় হতে হতে বৃক্ষ হয় মহীরুহ হয়, তবে জগতে কত কুড়ুল আছে যে কোপ বসাবে ওদের গায়ে? না হয় বসাক, মরা বৃক্ষের আনাচ-কানাচ থেকে আবার বীজের অঙ্কুরোদগম হয় না!হয়। বাবা, তুমি ভেঙ্গোনা, যেমন মেরুদন্ড গড়ে শক্ত করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলে আমাকে, তেমনি দাঁড়িয়ে থাকো।
আমরা হেরে গেছি বটে আজ, আজ মানুষ চাবুক মারছে আমাদের পিঠে। একদিন দেখো তোমার গ্রামও ধানে, পাটে, শাকে, সবজিতে, বৃক্ষের, ফলে সমৃদ্ধ হবে। একদিন দেখো আমার স্বপ্নগুলো ডালপালা মেলে বিকশিত হবে। মৃত্যু নেই মান নেই আমাদের বুকের ভেতর নিষ্কলুষ স্বপ্ন ছাড়া আর আছে কি বলো বাবা, আর আছে কী?




যদি যেতে চাও’
___তসলিমা নাসরিন
যদি যেতে চাও, এভাবেই যেও--
ঠিক যেভাবে গেছ
ঠিক যেভাবে, আলগোছে, টের
না পাই
দরজা আধখোলা রেখে
ফিরে আসবে ভেবে যেন কোনদিন
খিল না দিই।
যেও, যেতেই যদি হয়--
দু চারটা কাপড় ভুল
করে আলনায় ফেলে--
এভাবেই স্নানঘরে রেখে যেও তোয়ালে
এক জোড়া চপ্পল--
এভাবেই।
দমকা বাতাসও কড়া নাড়ে সময় সময়
কোনও
কোনও রাতে এরকমও ভেবে নেব,
বুঝি ফিরেছিলে বেঘোরে ঘুমিয়েছিলাম
বলে চলে গেছ।



তখন না হয় দেখা হবে
- তসলিমা নাসরিন
ডাকলেও আসো না যখন
কঠিন অসুখে একদিন শয্যাশায়ী হব।
খবর পেয়েই জানি কাগজের জঙ্গলে খুঁজবে
পাসপোর্ট। পেয়ে, ধুলো ঝেড়ে, ভিসার অফিসে যাবে
টিকিট কাটবে
বেয়াড়া ব্যস্ততাগুলো তুলোর মতন
উড়িয়ে কসমোপলিটন সিটির হাওয়ায়,
জটগুলো আলগোছে ঠেলে
ফার্স্ট ফ্লাইটেই জানি নামবে এখানে,
অবিন্যস্ত শহর ঢাকায়।
লাল গালিচা দেখতে পেতে রাখা বাড়ির সিঁড়িতে
ঘরে ঢুকে গন্ধ পাবে নাছোড় জ্বরের, ওষুধের
যদি বুক ভরে শ্বাস নাও আরও
একটু গন্ধ পাবে অচেনা ভালবাসার।
কঠিন অসুখ হোক
হাত-পা না হয় কাটা যাক ট্রাকের তলায়
লিভারে রাইফেলের গুলি
কিডনি অকেজো
পক্ষাঘাত, রক্তে ক্যান্সার
যে কোনও অসুখই মেনে নেব যদি আসো
কাছে বসে, স্নেহে যদি স্পর্শ করো শীর্ণ হাতখানি
দূর হবে দূরারোগ্য রোগ, মনে মনে সুস্থ হব,
দাঁড়াব, হাঁটব।
জানালার নীলে ছাওয়া আকাশ দেখব।
এত অসুখেও যদি পাথর না গলে
না হয় মৃত্যুই হোক
মৃত্যু হলে মুখাগ্নি করতে
তোমাকে তো আসতেই হবে। খোলা চোখ দুটো
ঢেকে দিতে অস্থির আঙুলে
পোড়াতে আগুনে--- তুমি কি না এসে পারো?



তবু ফিরব
-তসলিমা নাসরিন
আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর, নেত্রকোণা,
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব।
ফিরব ভিড়ে হট্টগোলে, খরায়, বন্যায়,
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা,
গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব।
পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে,
ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন,খায়রুন্নেসা,
অপেক্ষা করো ইদুল আরা,
আমি ফিরব।
ফিরব ভালবাসতে,হাসতে,জীবনের সুতোয় আবার
স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর,
অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারির বইমেলা,
আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে,
তাকে ক'ফোটা জল দিচ্ছি চোখের,
যেন গোল পুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে
একবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে,
ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড পাহাড়-
আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।

No comments:

Post a Comment

প্রেমের কবিতা

আমাকে ভালোবাসার পর – হুমায়ুন আজাদ আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার, যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো ন...