নিছক প্রেমের গল্প –
সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
চোদ্দো আনা সুখ
জানালাপারের গন্ধমাখা।
চম্পাবরণ মুখ
সেও যদি যায় ঝাপসা হয়ে
সমীকরণ স্পষ্ট
দু’আনা তার সুখ বাঁচে ‘আর
চোদ্দো আনা কষ্ট
কন্যে মুখে কিছুই বলাে না
কন্যে তােমার সকল ছলনা
--ডাইনির মতন চুল এলাে করে ওইভাবে জানালার পাশে বসে আছিস কেন?
কী হয়েছে তাের, রাগ? আধ ঘণ্টা বসে আছি।
চুপ করে। চলে যাব?
--রাগ করব কার উপরে?
--ঠিক এই কথাটাই আমি জানতে চাইছিলাম। রাগ করছিস কার উপরে?
--আমি রাগ করিনি। আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না, আর কিছু বলবি?
--না বলব না কিছু। আমি চললাম,
তাের রােদ পােহানাে দেখার জন্য আমি বসে থাকতে পারব না।
--কোথায় যাবি এখন?
--জাহান্নামে, তােকে বলব কেন?
--রাগলে তাের কানগুলাে বেগুনি হয়ে যায়, জানিস সেটা?
--বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
একটা কবিতা শােনাবি?
--পারব না।
--চম্পাবরণ রােদ নেমেছে ঠিক দুক্কুরবেলা
চম্পাবরণ কন্যে তােমার চক্ষে মেঘের খেলা
শাড়িটা পরে তােকে বেশ কেমন একটা ইয়ে লাগছে।
--ইয়েটা কী? জঘন্য লাগছে বলতে বাধছে বুঝি?
তাের মুখেও কিছু আটকায় তা হলে!
--জানিস না, বড়রা কি বলেছেন, “সত্যম ব্রুয়াত, প্রিয়ম বড়ুয়া”।
অপ্রিয় সত্য বলতে নেই আসলে।
--জঘন্য লাগছে তাে?
--আমি কি তাই বললাম? আসলে শাড়ি পরে তােকে অন্যরকম লাগছে।
বিকেলবেলার রােদটা সরে গেলে বােধ হয় তােকে আবার তাের মতন লাগবে।
--এখন কার মতন লাগছে?
--তাের মতনই, তবু যেন তুই নয়। আচ্ছা, তাের চুলগুলাে কি মেঘবরণ?
--রাজকন্যা বলছিস আমাকে?
-তাই কখনও বলতে পারি! রাজা-গজার খুব আকাল দেশে।
শেষ অবধি রাজপুত্তুর জোটাবি কোথা থেকে?
--রাখাল ছেলে কি জুটবে না এক-আধটা?
--ঠাকুরমার ঝুলি হাতড়ে দ্যাখ, পেতেও পারিস।
আসলে তোকে বোধ হয় খুব সুন্দর লাগছে।
--ট্রাম লাইনের উপরে, ওটা কী পাখি রে?
--কাক নয়, চড়ুই, শালিখও নয় দেখছি। এই শহরে পাখি বলতে আর একটাই।
--ওটা মন পাখি।
--চোখের কোণে মুকুতা দোলে হাসলে করে আলাে
নীলাম্বরী উপচানাে তার কেশের বরণ কালাে
--কনুইতে ব্যান্ড-এজ লাগিয়েছিস কেন?
--কেটে গেছে।
--কাটল কী করে?
--একটা কঠিন ক্যাচ নিতে গিয়ে।
--এখনও ক্রিকেট খেলে যাচ্ছিস? পরীক্ষার ক’টা দিন বাকি?
--পরীক্ষার সঙ্গে ক্রিকেটের সম্পর্ক যে ব্যস্তানুপাতিক সেটা জানা ছিল না তাে!
--সেভেনথ পেপারের প্রিপারেশন কেমন হয়েছে?
--ফেল করব ওটাতে।
--আর এইটথ পেপার?
--ডাহা ফেল।
--বলতে একটুও লজ্জা করছে না
--আমার মতন খারাপ ছাত্র কিছু না থাকলে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি যে লাটে উঠবে।
বছর বছর একজামিনেশন ফিজ দিয়ে টিকিয়ে রেখেছি তাে আমরাই।
--ক’ঘন্টা পড়ছিস দিনে?
--সারা রাত। সকালে প্রথম ট্রামটাকে রওনা করে দিয়ে তবে ঘুমােতে যাই।।
--সারা রাত পড়ছিস?
--সারা রাত জাগছি অন্তত।
--কী করিস, সারা রাত জেগে?
--ঘুমিয়ে পড়লে কলকাতা শহরকে খুব বােকা বােকা লাগে।
ল্যাম্পপােস্টগুলাে হাই তােলে মাঝে মাঝে।
আমার পড়ার টেবিলের সামনে যে জানলাটা,
ওটার ঠিক উল্টোদিকের রাস্তায় একটা টিউবওয়েল আছে।
ওইটা ঘুমের মধ্যে খুব কথা বলে। তখন নেড়িগুলো এসে ধমক লাগায় কী বলবো!
--সারা রাত এইসব পাগলামি?
--পাগলামি কেন হবে, এ ছাড়াও পরীক্ষায় পাস করার জন্য কত কসরত করি।
কাল রাতেই খাতা ভর্তি করে তাের নাম লিখেছি, প্রতি পাতায় ১০৮ বার।
--কেন?
--তাের মতন ভাল ছাত্রী আমাদের ডিপার্টমেন্টে আর আছেটা কে?
যদি তাের নাম জপ করে উতরে যাই কোনওমতে।
--শুধুই তাই?
--না, এছাড়াও আছে। তাের নামটা লিখলে বেশ লাগে দেখতে।
কন্যে কন্যে চম্পাবরণ
কাজল চক্ষু বশীকরণ।
পরীক্ষার পরে কী করবি?
--ইচ্ছে আছে জেএনইউতে পড়ার। তুই কিছু ভেবেছিস?
--ভাবার কিছু নেই তাে। পরের বার পরীক্ষা দেবার জন্য আবার তৈরি হব।
তুই সত্যি দিল্লি চলে যাবি?
--যদি সুযােগ পাই, যাব।
--পারবিই না যেতে। কাকু কিছুতেই তাের মতন একটা
পুঁচকে মেয়েকে দিল্লিতে একা থাকতে দেবেন না।
--আমি তাের থেকে তিন সপ্তাহের বড় বয়সে এটা মনে রাখিস।
আর দিল্লিতে একা থাকব কেন? মাসির বাড়ি আছে তাে।
--কেন, মাসি দিল্লিতে থাকেন কেন? আর জায়গা পেলেন না থাকার!
--মাসির দিল্লিতে থাকার কারণটা খুব সহজ।
মেসােমশাই থাকেন ওইখানে তাই। কিন্তু তাের এত রাগ কেন দিল্লির উপরে?
--তুই দিল্লিতে যেতে চাইছিস কেন?
--পড়াশুনাে করবার জন্য।
--পড়াশুনাে করার জন্য কলকাতা ছেড়ে চলে যাবি?
--হ্যাঁ যাব।
--তুই জানিস, তুই চলে গেলে কলকাতা শহর মুখ গােমড়া করে বসে থাকবে,
ভিক্টোরিয়ার পরি ঘুরবে না
আর ফুচকাওয়ালারা কবিরাজি ওষুধের কোঅপারেটিভ স্টোর খুলবে?
--আর তুই কী করবি?
--তাের সঙ্গে আমার কী? আমি কিছুই করব না।
করব নাই বা কেন? সারাদিন ক্রিকেট খেলব,
রােজ বিকেলে দুটো করে এগ রােল খাব সেনাপতির দোকান থেকে
আর সারা রাত্তির ফুটপাথের সাথে গল্প করব। যা ইচ্ছে করব,
যা খুশি করব। কী দরকার তাের এত পড়াশোনা করার শুনি?
--তুই সারাদিন ক্রিকেট খেলবি, সারা রাত ফুটপাথের সঙ্গে গল্প করবি,
বছর বছর পরীক্ষা দিবি, যা ইচ্ছে করবি। আমি যদি পড়াশােনা করে
চাকরি না করি, রােজ বিকেলে তােকে দু’টো করে এগ রােল খাওয়াবে কে?
লেখাঃTrishna Jannat
মেয়ে তুমি বাহিরটা না, ভেতরটা সুন্দর করো।
তোমার তেল চুপচুপ মাথার বেনিটাই থাকুক,
থাকুক না কোঁকড়া চুলগুলোর খোপা।
ওটাকে পার্লারে গিয়ে রিবন্ডিং নামক যাঁতাকলে পিষে সোজা করার দরকার নেই,
স্প্যা করা, প্রত্যেকদিন শ্যাম্পু কন্ডিশনার করে চুল সিল্কি রাখারও একদমই দরকার নেই।
মেয়ে তুমি ওভাবেই সুন্দর, যেভাবে তুমি সৃষ্টি।
তোমার গায়ের রংটা থাকুক না কালচে,
নাকটা বোঁচা'ই থাকুক,
ভ্রু'টা একদমই দেখতে ভালোনা-
দরকার নাই ভালোর, ওভাবেই থাকতে দাও।
হরিণ টানা চোখ দু'টো লাগবে না তো,
ঠোঁটের পাশে কি তিল থাকতেই হবে!
গােলে টোল পড়তেই হবে না তো।
তুমি যেমনটা আছো ওমনটা'ই সুন্দর,
বিশ্বাস করো তুমি ভীষণ সুন্দর।
দামি মেকাপের আড়ালে তোমার কালো ঢেকে রাখার দরকার'ই নেই,
নাকটাতেও অযথা মেকাপ দিয়ে সোজা দেখানোর চেষ্টা করো না,
ওটা ওভাবেই থাকুক,
তোমার চোখের জন্য ওই ভ্রুটা'ই সুন্দর,
দরকার নেই তো সুতোর ফাদে ফেলে ভ্রু সুন্দর করার,
লেন্স আর আইলাশের নিচে ঢেকে রেখো না চোখ দু'টোর আসল সৌন্দর্য।
কি দরকার বলো ঠোঁটের পাশে একটা মিথ্যে তিল করার!
লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট হতেই হবে কি?
প্রথম দেখায় একটা মানুষকে আরেকটা মানুষ কতটা বুঝতে পারে বলো?
তোমাকে জেনে যে তোমাকে ভালোবাসবে তার জন্য অপেক্ষা করো।
যে তোমাকে ঐ কালচে রঙে, বোঁচা নাকে, তেলা চুলে ভালোবাসবে।
যার জন্য তোমার হাই হিল পড়ে খাটো থেকে উচু হওয়ার চেষ্টা করতে হবে না,
তোমার মুখের ব্রণ ঢাকতে ছটফট করতে হবে না,
যে তোমার ঐ ভালো না দেখানো চোখ দু'টোর দিকে তাকিয়ে তোমার ভালো মন্দ সব পড়ে নিবে।
যার ভালোবাসা কোনো বন্ধ রুমে আবদ্ধ নয়,
খোলা আকাশের নিচে কিংবা নদীর ধারে গল্পেই জমে উঠবে।
রেস্টুরেন্টে নামি দামি খাবার কিংবা কফির মগে সীমাবদ্ধ নয়,
টংয়ের দোকানে চা অথবা বাদাম ছিলতে ছিলতেও হতে পারে।
তার কাছে তুমি তোমার স্বাভাবিকতায়'ই সুন্দর,
আলাদাভাবে নিজেকে সুন্দর করার চেষ্টা তোমার করতে হবে না।
ফর্সা রঙকে সুন্দর বলা হয় না পাগলী মেয়ে,
সুন্দর তো থাকে মনে,
যার মন সুন্দর সে'ই তো বেজায় সুন্দর।
হ্যাঁ তুমি চোখে কাজল পড়তে পারো,
ঠোঁটে লিপিস্টিক,
দু'হাতে রেশমি চুড়ির ঝনঝনানি,
তোমার ওই কোঁকড়া খোলা চুল,
কপালে না হয় একটা টিপ পড়লে,
আর নারীর সৌন্দর্য শাড়ি।
তোমাকে মডার্ন হতে হবে না,
তুমি বরং জীবনানন্দের বনলতা হও,
শরৎ, রবীন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকা হও।
বিংশ শতাব্দীতে তুমি অষ্টাদশ ও উনবিংশে না হয় ফিরে গেলে,
কেউ একজন তোমাকে ওভাবেই ভালোবাসবে।
বর্তমানের এই স্মার্টনেসের যুগে যেখানে একান্ত ভালোবাসা উপভোগের ছোড়াছুঁড়ি,
সেখানে কেউ একজন তোমার হাতটা ছুঁয়ে দেখার জন্য অপেক্ষা করবে,
বলতে চেয়েও লজ্জা আর ভয়ে বলতে পারবে না,
খুব সাহস নিয়ে একদিন হয়তো বলেও ফেলবে আর তোমার লজ্জা মাখা হ্যাঁ সূচক সম্মতিতে সে পৃথিবীর সুখের সন্ধান পাবে,
এই সুখেই সে সীমাবদ্ধ থাকবে, বাহিরের সুখ আর খুঁজতে যাবে না।
মেয়ে তুমি তোমার লজ্জা হারিয়ো না,
লজ্জা হারালে তুমি তোমার সৌন্দর্য খুঁজে পাবে না।
প্রতিযোগিতার যুগ থেকে বের হও,
নিজেকে নিজের মত করে ভাবতে শিখো,
দেখতে শিখো,
দেখাও,
তোমার জন্য কেউ একজন আছে,
যে তোমাকে তোমার মত করে দেখতে চায়,
তোমার বাহিরটা নয়, তোমার ভেতরটা জুড়ে তার সব মুগ্ধতা।
অপেক্ষাটা না হয় একটু বেশি'ই দীর্ঘ হবে,
হোক না হয় সে দীর্ঘ অপেক্ষা।
তবুও তুমি ভুল মানুষকে ভালোবেসে নিজেকে হারিয়ো না,
ঠিক মানুষটাকে নিয়েই ভালো থাকো।
বলি,
মানুষ তুমি বাহিরটা নয়, ভেতরটা সুন্দর করো।
সুন্দর'কে সুন্দর বলা শেখো ।
কবিতা - বসন্ত নয় অবহেলা
কবি- দর্পন কবির
বসন্ত নয়, আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিলো অবহেলা
ভেবেছিলাম, অনেকগুলো বর্ষা শেষে শরতের উষ্ণতা মিশে এলো বুঝি বসন্ত!
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালোবেসে এসেছে অবহেলা
মধ্য দুপুরের তির্যক রোদের মতো
অনেকটা নির্লজ্জভাবে আমাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম
আমার দীনদশায় কারো করুণা বা আর্তিব পেখম ছড়িয়ে আছে কি না
ছিলো না
বৃষ্টিহীন জনপদে খড়খড়ে রোদ যেমন দস্যুর মতো অদমনীয়
তেমনি অবহেলাও আমাকে আগলে রেখেছিলো নির্মোহ নিঃসংকোচিত
আমি অবহেলাকে পেছনে ফেলে একবার ভোঁ-দৌড় দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম
তখন দেখি আমার সামনে কলহাস্যে দাঁড়িয়েছে উপেক্ষা
উপেক্ষার সঙ্গেও একবার কানামাছি খেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের কোলাহল মুখর আনন্দ সভায়
কি মিলেছিলো?
ঠোঁট উল্টানো ভৎসনা আর অভিশপ্ত অনূঢ়ার মতো এক তাল অবজ্ঞা
তাও সয়ে গিয়েছিলো একটা সময়
ধরেই নিয়েছিলাম আমার কোনো কালেই হবে না রাবেন্দ্রিক প্রেম
তোমাদের জয়গানে করতালিতে নতজানু থেকেছিলো আমার চাপা আক্ষেপ লজ্জা
বুঝে গিয়েছিলাম জীবনানন্দময় স্বপ্ন আমাকে ছোঁবে না
জয়নুলের রঙ নিয়ে কল্পনার বেসাতি
হারানো দিনের গানের ঐন্দ্রালিক তন্ময়তা
বা ফুল, পাখি, নদীর কাব্যালাপে কারা মশগুল হলো, এ নিয়ে কৌতূহল দেখাবার দুঃসাহস আমি দেখাইনি কখনো
এত কিছু নেই জেনেও নজরুলের মতো বিদ্রোহী হবো, সেই অমিত শক্তিও আমার ছিলো না
মেনে নেয়ার বিনয়টুকু ছাড়া আসলে আমার কিছুই ছিলো না
শুধু ছিলো অবহেলা, উপেক্ষা আর অবজ্ঞা
হ্যাঁ, একবার তুমি বা তোমরা যেন দয়া করে বাঁকা চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে
তাচ্ছিল্য নয়, একটু মায়াই যেন ছিলো
হতে পারে কাঁপা আবেগও মিশ্রিত ছিলো তোমার দৃষ্টিতে
ওইটুকুই আমার যা পাওয়া
আমি ঝড়ে যাওয়া পাতা, তুমি ছিলে আকস্মিক দমকা হাওয়া
তারপরও অবহেলার চাদর ছাড়িয়ে
উপেক্ষার দেয়াল ডিঙিয়ে
ও অবজ্ঞার লাল দাগ মুছে জীবনের কোনো সীমারেখা ভাঙতে পারিনি আমি
এ কথা জানে শুধু অন্তর্যামী
অনেক স্বপ্নপ্রবণ হয়ে একবার ভেবেছিলাম
এই অবহেলা তুষারপাতের মুখচ্ছবি, উপেক্ষা কাচের দেওয়াল, অবজ্ঞা কুচকুচে অন্ধকার
এর কিছুই থাকবে না একটি বসন্তের ফুঁৎকারে
একটি ঝলমলে পোশাক গায়ে চড়িয়ে হাতের মুঠোয় বসন্ত নিয়ে অন্তত একটি সন্ধ্যাকে উজ্জ্বল করে নেবো
এমন ভাবাবেগও ছিলো আকাশের কার্নিশে লেপ্টে থাকা পেঁজা মেঘের মতো
ঐ মেঘ কখনো বৃষ্টি হয়ে নামেনি
তোমার বা তোমাদের নাগরিক কোলাহল কখনো থামেনি
অর্ধেক জীবন ফেলে এসে দেখি অনেক কিছু বদলে গেছে
সেকি!
কোথায় হারালো কৈশোরের দিনলিপি বিপন্ন করা অবহেলা
স্বপ্নকে অবদমনের স্বরলিপিতে আটকে ফেলা উপেক্ষা
আর তারুণ্যকে ম্রিয়মাণ করে রাখার অবজ্ঞা
ওরা আমাকে চোখ রাঙাতে পারে না ঠিক, তবে এখনো পোড় খাওয়া দিন বড্ড রঙিন
আমি আজ সমুদ্র জলে হাত রেখে বলে দিতে পারি
কোন ঢেউয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তোমাদের গোপন অশ্রুকণা
আকাশ পানে তাকিয়ে বুঝতে পারি কার দীর্ঘশ্বাসে ঝড়ে পড়ছে নক্ষত্র
এমনকি তুমি যে সম্রাজ্ঞীর বেশের আড়ালের মিহিন কষ্ট চেপে হয়েছো লাবণ্যময় পাষাণ, পাথর
এটাও দেখতে পাই অন্তরদৃষ্টি দিয়ে
আমি জানি, দীর্ঘশ্বাসে ভরা এ আখ্যান যদি পেতো কবিতার রূপ
সেই অবহেলা হতো বসন্ত স্বরুপ!!
প্রেম এল না
কবিতা সিংহ
বুকের ভেতর প্রেম এলোনা
প্রেমের জন্য দুঃখ এলো।
বৃক্ষ দিলে, পত্র দিলে
শাখায় শাখায় পুষ্প দিলে
পুষ্পে পুষ্পে মধুর ছিটে
বোঁটায় আসল ফল এলোনা।
ফল এলোনা, ফল এলোনা
ফলের জন্য দুঃখ এলো।
বুকের ভেতর প্রেম এলোনা
প্রেমের জন্য দুঃখ এলো।
বৃথায় তবে শরীর দিলে
শরীর জুড়ে আত্মা দিলে
বয়সকালের ইন্দ্রজালে
দেহের ভিতর বংশবৃদ্ধি
দেহের যত অন্ধি-সন্ধি
ঘুরে মরলাম, মাথা কুটলাম।
শরীর নিয়ে দুঃখ এলো
বুকের মধ্যে প্রেম এলোনা,
প্রেম এলোনা, দুঃখ এলো
প্রেম যে কেমন জানার জন্য, দুঃখ এলো
সব পেয়ে যা পাওয়া হলোনা
তারই জন্য কষ্ট হলো,
প্রেমের জন্য কষ্ট হলো।
প্রেম যে কেমন
কামড়ে দেখার ছুঁয়ে দেখার ছেনে দেখার
বুকে পেষার জন্য, বড়ো কষ্ট হলো।
প্রেমের জন্য বুকের মধ্যে কষ্ট হয়ে
প্রেম কি হলো?
বুকের ভেতর প্রেম এলোনা,
প্রেম এলোনা, দুঃখ এলো।
থাকবে মনে
আরণ্যক (পরিচয়) বসু
কবি, তোমার পরের জন্মে
এই মাটিতেই জন্ম নিও
আকাশছোঁয়া ধানের ক্ষেতে
সমস্ত রঙ ছড়িয়ে দিও
আমি যখন পঞ্চদশী
তুমি তখন ষোলই বোধ হয়
আমি যখন বন্যকুসুম
তুমি তখন কবিতাময়
ছাদের উপর মাদুর পাতা
আমার গলায় কান্ত কবি
দূরে কোথাও ট্রেনে যাচ্ছে
প্রহরজোড়া শান্ত ছবি
আমি তখন বর্ষা ব্যাকুল
মেঘলা বাতাস, রাই কিশোরী
তোমার যখন উড়ন্ত চুল
আমার ফ্রকে সলমা জরি
চিলেকোঠায় কেউ থাকেনা
পায়রাগুলোর ক্লান্ত প্রলাপ
দুটো ঠোঁটের প্রথম ছোঁয়া
আমি তখন ব্যগ্র গোলাপ
ভয়ে ,লজ্জায় , বুক দুর দুর
সেই শুরু , সেই অশান্তিময়,
তুমি তখন কলেজ, ক্রিকেট
আমি তখন স্তব্ধ সময়
সন্ন্যাসিনীর একি জ্বালা
পঞ্চশরের বর্ণচ্ছটায়
অন্তবিহীন হলুদ কুসুম
যা ইচ্ছে তাই গুজব রটায়!
রটাক গুজব নিন্দে করুক
দাঁড়িয়ে থাকি বিরল ভোরে
স্টেশন রোডের লাজুক হাওয়ায়
কখন তোমার রুমাল ওড়ে
হওয়ার কথা ব্যাকুল বাতাস
হওয়ার কথা ব্রজের ধূলি
মাধুকরীর জন্যে য়াওয়া
সাজবিহানের শূন্য ঝুলি
পরের জন্মে প্রথম দেখায়
লুটে নিও, ভাসিও দু-কুল
তোমায় দেখব পাগল বাউল
ভাঙ্গা পথের ছিন্ন মুকুল
আবার যদি ইচ্ছে কর
রাঙিয়ে দিও আমার আঁচল
সময় হবে মেঘ ঘনাবার
সময় হবে বৃষ্টি নামার
সময় রেখো হারিয়ে যাওয়ার
সময় রেখো দূরের বাসে
সময় রেখো গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোড
একটি সিটে তোমার পাশে
এ জন্মে যা বলা গেলো না
ও জন্মে তা ঠিক্ শুনবোই
কনে দেখা আলোয় ছাদে
কান পেতে রই , প্রাণ পেতে রই!
এ জন্মে তো ফুটলো শিমূল
লাগলো আগুন বনে বনে
ফুলের পোশাক পরিও আমায়
পরের জন্মে , থাকবে মনে!
তুমি তখন ষোলই বোধ হয়
আমি যখন বন্যকুসুম
তুমি তখন কবিতাময়
ছাদের উপর মাদুর পাতা
আমার গলায় কান্ত কবি
দূরে কোথাও ট্রেনে যাচ্ছে
প্রহরজোড়া শান্ত ছবি
আমি তখন বর্ষা ব্যাকুল
মেঘলা বাতাস, রাই কিশোরী
তোমার যখন উড়ন্ত চুল
আমার ফ্রকে সলমা জরি
চিলেকোঠায় কেউ থাকেনা
পায়রাগুলোর ক্লান্ত প্রলাপ
দুটো ঠোঁটের প্রথম ছোঁয়া
আমি তখন ব্যগ্র গোলাপ
ভয়ে ,লজ্জায় , বুক দুর দুর
সেই শুরু , সেই অশান্তিময়,
তুমি তখন কলেজ, ক্রিকেট
আমি তখন স্তব্ধ সময়
সন্ন্যাসিনীর একি জ্বালা
পঞ্চশরের বর্ণচ্ছটায়
অন্তবিহীন হলুদ কুসুম
যা ইচ্ছে তাই গুজব রটায়!
রটাক গুজব নিন্দে করুক
দাঁড়িয়ে থাকি বিরল ভোরে
স্টেশন রোডের লাজুক হাওয়ায়
কখন তোমার রুমাল ওড়ে
হওয়ার কথা ব্যাকুল বাতাস
হওয়ার কথা ব্রজের ধূলি
মাধুকরীর জন্যে য়াওয়া
সাজবিহানের শূন্য ঝুলি
পরের জন্মে প্রথম দেখায়
লুটে নিও, ভাসিও দু-কুল
তোমায় দেখব পাগল বাউল
ভাঙ্গা পথের ছিন্ন মুকুল
আবার যদি ইচ্ছে কর
রাঙিয়ে দিও আমার আঁচল
সময় হবে মেঘ ঘনাবার
সময় হবে বৃষ্টি নামার
সময় রেখো হারিয়ে যাওয়ার
সময় রেখো দূরের বাসে
সময় রেখো গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোড
একটি সিটে তোমার পাশে
এ জন্মে যা বলা গেলো না
ও জন্মে তা ঠিক্ শুনবোই
কনে দেখা আলোয় ছাদে
কান পেতে রই , প্রাণ পেতে রই!
এ জন্মে তো ফুটলো শিমূল
লাগলো আগুন বনে বনে
ফুলের পোশাক পরিও আমায়
পরের জন্মে , থাকবে মনে!
শুভম তোমাকে
- মল্লিকা সেনগুপ্ত
শুভম তোমাকে অনেকদিন পরে
হটাত দেখেছি বইমেলার মাঠে
গত জন্মের স্মৃতির মতন
ভুলে যাওয়া গানের মতন
ঠিক সেই মুখ , ঠিক সেই ভুরু
শুধুই ঈষৎ পাক ধরা চুল
চোখ মুখ নাক অল্প ফুলেছে
ঠোঁটের কোনায় দামি সিগারেট
শুভম তুমি কি সত্যি শুভম !
মনে পড়ে সেই কলেজ মাঠে
দিনের পর দিন কাটত
কিভাবে সবুজ ঘাসের মধ্যে
অন্তবিহীন সোহাগ ঝগড়া !
ক্রমশই যেন রাগ বাড়ছিল
তুমি চাইতে ছায়ার মতন
তোমার সংগে উঠবো বসবো
আমি ভাবতাম এতদিন ধরে
যা কিছু শিখেছি, সবই ফেলনা !
সব মুছে দেব তোমার জন্য?
তুমি উত্তম - ফ্যান তাই আমি
সৌমিত্রের ভক্ত হব না !
তোমার গোষ্ঠী ইস্টবেঙ্গল
আমি ভুলে যাব মোহনবাগান ।
তুমি সুচিত্রা , আমি কণিকার
তোমার কপিল , আমার তো সানি !
তোমার স্বপ্নে বিপ্লব তাই
আমি ভোট দিতে যেতে পারব না !
এমন তরজা চলত দুজনে
তবুও তোমার ঘাম গন্ধ
সস্তা তামাক স্বপ্নের চোখ
আমাকে টানত অবুঝ মায়ায়
আমার মতো জেদি মেয়েটিও
তোমাকে টানত প্রতি সন্ধ্যায়
ফাঁকা ট্রাম আর গঙ্গার ঘাটে ,
তারপর তুমি কম্পিউটার
শেখার জন্য জাপান চললে
আমিও পুনের ফিলমি কোর্সে
প্রথম প্রথম খুব চিঠি লেখা
সাত দিনে লেখা সাতটা চিঠি
ক্রমশ কমল চিঠির সংখ্যা
সপ্তাহে এক , মাসে একটা
ন মাসে ছ মাসে , একটা বছরে
একটাও না ... একটাও না ...
ডাকবাক্সের বুক খাঁ খাঁ করে
ভুলেই গেছি কতদিন হল ,
তুমিও ভুলেছ ঠিক ততদিন
তারপর সেই পৌষের মাঠে
হটাত সেদিন বইমেলাতে
দূরে ফেলে আসা গ্রামের মতো
তোমার মুখটা দেখতে পেলাম
শুভম , তুমি কি সত্যি শুভম !
দিনের পর দিন কাটত
কিভাবে সবুজ ঘাসের মধ্যে
অন্তবিহীন সোহাগ ঝগড়া !
ক্রমশই যেন রাগ বাড়ছিল
তুমি চাইতে ছায়ার মতন
তোমার সংগে উঠবো বসবো
আমি ভাবতাম এতদিন ধরে
যা কিছু শিখেছি, সবই ফেলনা !
সব মুছে দেব তোমার জন্য?
তুমি উত্তম - ফ্যান তাই আমি
সৌমিত্রের ভক্ত হব না !
তোমার গোষ্ঠী ইস্টবেঙ্গল
আমি ভুলে যাব মোহনবাগান ।
তুমি সুচিত্রা , আমি কণিকার
তোমার কপিল , আমার তো সানি !
তোমার স্বপ্নে বিপ্লব তাই
আমি ভোট দিতে যেতে পারব না !
এমন তরজা চলত দুজনে
তবুও তোমার ঘাম গন্ধ
সস্তা তামাক স্বপ্নের চোখ
আমাকে টানত অবুঝ মায়ায়
আমার মতো জেদি মেয়েটিও
তোমাকে টানত প্রতি সন্ধ্যায়
ফাঁকা ট্রাম আর গঙ্গার ঘাটে ,
তারপর তুমি কম্পিউটার
শেখার জন্য জাপান চললে
আমিও পুনের ফিলমি কোর্সে
প্রথম প্রথম খুব চিঠি লেখা
সাত দিনে লেখা সাতটা চিঠি
ক্রমশ কমল চিঠির সংখ্যা
সপ্তাহে এক , মাসে একটা
ন মাসে ছ মাসে , একটা বছরে
একটাও না ... একটাও না ...
ডাকবাক্সের বুক খাঁ খাঁ করে
ভুলেই গেছি কতদিন হল ,
তুমিও ভুলেছ ঠিক ততদিন
তারপর সেই পৌষের মাঠে
হটাত সেদিন বইমেলাতে
দূরে ফেলে আসা গ্রামের মতো
তোমার মুখটা দেখতে পেলাম
শুভম , তুমি কি সত্যি শুভম !
প্রথম প্রেমিকা
- তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
লাইব্রেরি থেকে ফিরছি তখন মুঠোয় জীবনানন্দ,
বুঁদ হয়ে আছি পয়ারের ঝোঁকে নির্জন চারপাশ,
বিকেল বেলায় গোধূলির ছোঁয়া লেগে চারদিক রক্তিম,
ঠিক সে সময় চোখে পড়ে গেল উদাসীন সেই কিশোরী
দাঁড়িয়ে রয়েছে, মুঠোভরা তার কাঁঠালিচাঁপার পাপড়ি,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, সেদিনই প্রথম চোখাচোখি;
মেয়েটিকে যেন কোথায় দেখেছি, অথবা কোথাও দেখিনি,
ফর্সা কপালে ছড়িয়ে ছিল যে চূর্ণচুলের আঁকিবুঁকি
চোখদুটি যেন ভরাট সায়র দু-ভুরু বাঁকানো ধনুকে
বিস্ময় কিছু থম্ হয়ে আছে, চিবুকে লাল্চে রশ্মি,
ফ্রকের বাইরে গমরঙা বাহু নিটোল লতিয়ে রয়েছে
সে ছিল আমর প্রথম প্রেমিকা, সেদিনই প্রথম পরিচয়;
পরিচয় ক্রমে রঙ ধরে ওঠে, সে রঙ ক্রমেই গাঢ় হয়,
কলেজ ফেরার পথে দেখি রোজ দাঁড়িয়ে রয়েছে একলা
কাঁঠালিচাঁপার পাপড়িও ঠিক রয়েছে দু-মুঠো ভর্তি
চুপিচুপি দিত কখন পকেটে, সারারাত তার সুবাসে
ঘুম ছুটে যেত, চোখ বুজলেই তার মুখখানা টলোমলো,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, ভালবাসা সে-ই শেখাল;
তার ও শরীরে অক্ষরমালা, অক্ষর গেঁথে শব্দ,
শব্দে শব্দ গেঁথে গেঁথে তার শরীরে পংক্তি জেগেছে,
শব্দব্রহ্মে হীরকদ্যুতিটি আমাকে কাঁপালো অবিরাম,
কখনো পয়ারে হেসে কথা বলে, কখনো মাত্রাবৃত্তে
চলনে-বলনে নিপুণ ছন্দ, কখনো গদ্যে উদাসীন,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম প্রেরণা সে-ই দেয়;
তার কাছে বাঁধা ছিল যে আমার কিশোরবেলার দিনগুলি,
ঠোঁটের দুকোণে মিষ্টি হাসিটি ঝড় তুলে যেত সহসা,
কখনো দুচোখে শ্রাবণ ঘনাত, কখনো মধুর ফাল্গুন
কাঁঠালিচাঁপায় মাখামাখি হয়ে এহেন কত না দিনক্ষণ
কেটে গেছে সুখে, আবেগ-উল্লাসে সেই সিরসির দিনগুলো,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম স্পর্শ সে-ই দেয়;
দুচোখে নিবিড় চাউনিটি ছিল, দুটি সুখী সাদা পায়রা,
তার ও শরীর মন্থন করে স্বর-ব্যঞ্জনবর্ণ,
সাদা পায়রার ডানাটি আমাকে টেনে নিয়ে গেল কদ্দূর
ক্রমশ যাচ্ছি লোকালয় ফেলে, পাহাড়, সাগর ডিঙিয়ে
সে এক নতুন অনুভূতি এল, সে এক নতুন বিশ্ব,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, অন্য জন্ম সে-ই দেয়;
তার বাবা হল বদলি হঠাৎ, মালদা কিংবা হুগলি,
সে-ও চলে গেল, কাঁঠালিচাঁপাকে করেছি দুহাতে টুকরো,
দু'চোখে উথালপাথাল অশ্রু, বৈশাখী এল ঝড় হয়ে
আলুথালু করে দিয়ে গেল সেই দ্বিধাথরোথরো কৈশোর
সেই শেষ দেখা, তারপরে কত দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম দুঃখ সে-ই দেয়;
চলে যাওয়া তার যাওয়া নয় যেন, সে এল আবার ফিরিয়া
ঘুমে জাগরণে কুরে কুরে খায়, পোড়ায়, ডোবায় প্লাবনে,
ধ্বংস করেছে পুরনো আমাকে, ধ্বংসের পর সৃষ্টি,
ফিনিক্স পাখিটি জেগে ওঠে, দেখে সামনে পৃথিবী উর্বর,
কেউ যেন তাকে উস্কে যাচ্ছে অন্তরীক্ষে ইশারায়,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম কবিতা সে-ই দেয়।
ফর্সা কপালে ছড়িয়ে ছিল যে চূর্ণচুলের আঁকিবুঁকি
চোখদুটি যেন ভরাট সায়র দু-ভুরু বাঁকানো ধনুকে
বিস্ময় কিছু থম্ হয়ে আছে, চিবুকে লাল্চে রশ্মি,
ফ্রকের বাইরে গমরঙা বাহু নিটোল লতিয়ে রয়েছে
সে ছিল আমর প্রথম প্রেমিকা, সেদিনই প্রথম পরিচয়;
পরিচয় ক্রমে রঙ ধরে ওঠে, সে রঙ ক্রমেই গাঢ় হয়,
কলেজ ফেরার পথে দেখি রোজ দাঁড়িয়ে রয়েছে একলা
কাঁঠালিচাঁপার পাপড়িও ঠিক রয়েছে দু-মুঠো ভর্তি
চুপিচুপি দিত কখন পকেটে, সারারাত তার সুবাসে
ঘুম ছুটে যেত, চোখ বুজলেই তার মুখখানা টলোমলো,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, ভালবাসা সে-ই শেখাল;
তার ও শরীরে অক্ষরমালা, অক্ষর গেঁথে শব্দ,
শব্দে শব্দ গেঁথে গেঁথে তার শরীরে পংক্তি জেগেছে,
শব্দব্রহ্মে হীরকদ্যুতিটি আমাকে কাঁপালো অবিরাম,
কখনো পয়ারে হেসে কথা বলে, কখনো মাত্রাবৃত্তে
চলনে-বলনে নিপুণ ছন্দ, কখনো গদ্যে উদাসীন,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম প্রেরণা সে-ই দেয়;
তার কাছে বাঁধা ছিল যে আমার কিশোরবেলার দিনগুলি,
ঠোঁটের দুকোণে মিষ্টি হাসিটি ঝড় তুলে যেত সহসা,
কখনো দুচোখে শ্রাবণ ঘনাত, কখনো মধুর ফাল্গুন
কাঁঠালিচাঁপায় মাখামাখি হয়ে এহেন কত না দিনক্ষণ
কেটে গেছে সুখে, আবেগ-উল্লাসে সেই সিরসির দিনগুলো,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম স্পর্শ সে-ই দেয়;
দুচোখে নিবিড় চাউনিটি ছিল, দুটি সুখী সাদা পায়রা,
তার ও শরীর মন্থন করে স্বর-ব্যঞ্জনবর্ণ,
সাদা পায়রার ডানাটি আমাকে টেনে নিয়ে গেল কদ্দূর
ক্রমশ যাচ্ছি লোকালয় ফেলে, পাহাড়, সাগর ডিঙিয়ে
সে এক নতুন অনুভূতি এল, সে এক নতুন বিশ্ব,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, অন্য জন্ম সে-ই দেয়;
তার বাবা হল বদলি হঠাৎ, মালদা কিংবা হুগলি,
সে-ও চলে গেল, কাঁঠালিচাঁপাকে করেছি দুহাতে টুকরো,
দু'চোখে উথালপাথাল অশ্রু, বৈশাখী এল ঝড় হয়ে
আলুথালু করে দিয়ে গেল সেই দ্বিধাথরোথরো কৈশোর
সেই শেষ দেখা, তারপরে কত দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম দুঃখ সে-ই দেয়;
চলে যাওয়া তার যাওয়া নয় যেন, সে এল আবার ফিরিয়া
ঘুমে জাগরণে কুরে কুরে খায়, পোড়ায়, ডোবায় প্লাবনে,
ধ্বংস করেছে পুরনো আমাকে, ধ্বংসের পর সৃষ্টি,
ফিনিক্স পাখিটি জেগে ওঠে, দেখে সামনে পৃথিবী উর্বর,
কেউ যেন তাকে উস্কে যাচ্ছে অন্তরীক্ষে ইশারায়,
সে ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা, প্রথম কবিতা সে-ই দেয়।
আমার কোনো বন্ধু নেই,
____ সাদাত হোসাইন
আমার কোনো বন্ধু নেই,
যার কাছে আমি নিজেকে ভেঙেচুরে,
খুচরো পয়সার মতো জমা রাখতে পারি।
যে আমাকে যত্ন করে সঞ্চয় করবে,
প্রয়োজনে ফিরিয়ে দেবে একটা একটা আধুলি।
সত্যি বলতে আমার কোনো বন্ধু নেই।
বন্ধু বলতে জেনেছি যাদের,
তারা কেবল পথ চলতে সঙ্গী ছিলো।
দূরের পথে ট্রেনে যেমন থাকে, পাশের সিটে।
গল্প হয়, দু পেয়ালা লেবু চায়ের দাম মেটাতে
'আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি' যুদ্ধ হয়।
সিগারেটের বাড়িয়ে দেয়া টুকরো ফুঁকে,
'এই যে নিন ফোন নম্বর,
এদিকটাতে আবার এলে ফোন করবেন',
বলা শেষে অচেনা এক স্টেশনে উধাও হয়।
এই যে আমি পথ হাঁটছি,
রোজ ঘাটছি বুকের ভেতর কষ্ট, ক্লেদ,
এই যে আমি ক্লান্ত ভীষণ,
বুকের ভেতর জমছে কেবল দুঃখের মেদ,
তবুও আমার নিজের কোনো বৃক্ষ নেই।
প্রবল দহন দিনের শেষে,
যার ছায়াতে জিরোবো ভেবে ফিরে আসার ইচ্ছে হয়,
তেমন একটা ছায়ার মতন,
আগলে রাখা মায়ার মতন আমার কোনো বন্ধু নেই।
একলা দুপুর উপুড় হলে বিষাদ ঢালা নদীর মতন,
একলা মানুষ ফানুশ হলে,
নিরুদ্দেশ এক বোধির মতন,
হাতের মুঠোয় হাত রাখবার একটা কোনো মানুষ নেই।
আমার কোনো বন্ধু নেই।
আমি কেবল কোলাহলে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যাই,
ভুল মানুষে, যত্নে জমা ফুলগুলো সব বাড়িয়ে যাই,
হাওয়ায় ভাসা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভেবে,
নির্বাসনের একটা জীবন মাড়িয়ে যাই।
আমার কোনো বন্ধু নেই,
যার কাছে আমি নিজেকে ভেঙেচুরে,
খুচরো পয়সার মতো জমা রাখতে পারি।
যে আমাকে যত্ন করে সঞ্চয় করবে,
প্রয়োজনে ফিরিয়ে দেবে একটা একটা আধুলি।
একলা মানুষ ফানুশ হলে,
নিরুদ্দেশ এক বোধির মতন,
হাতের মুঠোয় হাত রাখবার একটা কোনো মানুষ নেই।
আমার কোনো বন্ধু নেই।
আমি কেবল কোলাহলে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যাই,
ভুল মানুষে, যত্নে জমা ফুলগুলো সব বাড়িয়ে যাই,
হাওয়ায় ভাসা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভেবে,
নির্বাসনের একটা জীবন মাড়িয়ে যাই।
আমার কোনো বন্ধু নেই,
যার কাছে আমি নিজেকে ভেঙেচুরে,
খুচরো পয়সার মতো জমা রাখতে পারি।
যে আমাকে যত্ন করে সঞ্চয় করবে,
প্রয়োজনে ফিরিয়ে দেবে একটা একটা আধুলি।
ইতি, অপু
-পৃথ্বীরাজ চৌধুরী
পুলু, কেমন আছিস, ভাল?
বড় তাড়াতাড়ি নিভে যাচ্ছে এই কলমের আলো।
মাঘ কুয়াশার চেয়েও ঝাপসা হচ্ছে অক্ষর,
কোথা দিয়ে কেটে গেল রে এতগুলো বছর?
যেন রেলের চাকায় বেঁধেছিল কেউ দিনঘড়িটার কাঁটা,
অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি তোর ঠিকানাটা!
এই দেখ! পরিচয়টাই দেয়া হয় নি কথায় কথায়!
চিনতে পারছিস? রোল ফরটি-সিক্স, অপূর্ব কুমার রায়।
তোর সাথে শেষ দেখা, নাগপুর কোলীয়ারী।
তারপর জানিস? খুলনা গিয়েছিলাম অপর্ণাদের বাড়ি।
খুলনা তো এখন বাংলাদেশ। ওখানে কে থাকে,
আমি ছাড়া তোকে এখনও কেউ পুলু বলে ডাকে?
কাজল এখন বিয়ে করেছে, চাকরি করছে কলকাতায়।
সেসব যাক, এবার আসি যে জন্য চিঠি সেই কথায়।
জানি না, কোত্থেকে শুরু করব,
ঠিক কোন দুঃখ ভোগ?
তোর সাথে প্রায় ত্রিশ বছর পরে তো যোগাযোগ!
তুই বলবি আমার দোষ, রাখিস নি কেন যোগাযোগ?
যোগ আর যোগ রাখব কোথায়, আয়ুষ্কালে শুধুই বিয়োগ!
ছয়ে দিদি, দশে বাবা, সতেরোতে গেলেন মা!
আর বাইশ বছর ফাগুন মাস, যেদিন গেল অপর্ণা!
আর শুধু ওরাই নাকি?
কয়লার ট্রেন, দুঃখ পুকুর, গরুর গাড়িটাও ছেড়ে দিয়েছে কাশফুলে ঢাকা নিশ্চিন্দিপুর।
বাবার উপর টান বলতে, খুব রোগা আর পলকা দড়ি।
রোগা দড়ি হেটে নামত কাশিঘাটের চৌষট্টি সিঁড়ি।
বাবার আর লেখা হল না গ্রাম জাগানো মহৎ পালা!
দীর্ঘশ্বাসে চাপা সংলাপ, শুধু শুনতে পেল গণেশ মহলা।
এখন মাঝে মাঝে স্বপ্নে আসেন, হরিহর পালা গীতিকার
আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, "ঐ যায় শবযাত্রা আমার!
হরিধ্বণি দাও হে সবে, দু হাতে ওড়াও বিণ্ণী খৈ,
বাঁশের মাচায় শুয়ে চলেছেন, না লিখতে পারা আমার বই।"
ফিরে এলাম দেশের বাড়ি, ঘুরল আবার রেলের চাকা।
সম্বল বলতে গলার পৈতে, মা-র জমানো ছত্রিশ টাকা।
পল্লীবাড়ি একই আছে, ধোঁয়াটে মাঠ, কাশের বন।
নতুন একটা শব্দ শিখলাম, স্যারের কাছে, "অ্যাম্বিশন।"
লিভিংস্টোন পড়ছি তখন, কবে যাব আফ্রিকায়?
দেবতাকে অভুক্ত রেখে, এই পুরুতের ছেলে জল পানি পায়!
মা কে ছেড়ে, পল্লী ছেড়ে, পুরুতের ছেলে দূর পালাল,
দূর বলতে কলকাতা, তেতলা বাড়ি, ইলেক্ট্রিক আলো।
অখিলবাবুর রয়্যাল প্রেসে সারারাত জেগে কাজ করতাম।
নতুন বইয়ের মলাট দেখলেই ইচ্ছে হত, লিখি বাবার নাম।
একদিন একটা চিঠি এল, মায়ের নাম লেখা তাতে,
মা লিখছেন ভাঙা ছন্দে,
মা লিখছেন কবিতাতে।
"অপু, আমার মাথার উপর উড়ছে জানিস, রাতের আকাশ।
কদিন পরেই গণেশ পূজো, তোরা কলেজে ছুটি কি পাস?
চারা গাছটা পুঁতে গেছিলি, কদিন হল দেই নি জল,
গণেশ পুজোয় না এলেও তুই অঘ্রাণ মাসে আসবি বল?
কদিন ধরেই জ্বরটা আসছে, বলা হয় নি কথায় কথায়,
তোর তেতলা জানালা থেকে গ্রামের রাতটা দেখা যায়!
অপু, আমার মাথার উপর আকাশ ভাঙছে, উহ্! কি কালো।
পাঠাবি রে জোনাকি ঘুম, পাঠাবি রে ইলেক্ট্রিক আলো?"
সেই থেকে তো শ্বশানের কাঠ, গারহস্তে আমার হল অক্ষয়।
যারা চলে যায়, কে বলল শুধু তাদেরই শব দাহ হয়?
প্রথমে প্রথমে পুড়ে যেতাম, নতুন বিয়োগ চড়া আঁচে!
দেখ, সন্তাপ কথাটাতেও তাপ কথাটা লুকিয়ে আছে!
একদিন তখন হবিষ্যি চলছে, এঁটো ছিটিয়ে ডাকছি কাক।
হঠাৎ মনে হল, এ কী করছি, আমি না হিমাদ্রী নন্দন মৈণাক!!!
সেই থেকে তো পালানো শুরু, থাকতে দেবে বৃক্ষবন?
তোমার সবুজ পাতার ভিড়ে রাখবে আমায়, রাখবে গোপন?
গাছ দেখলেই ভয় করে যে, চিতা কাঠ বড্ড ভয়!
শরীর জুড়াল হঠাৎ করে, হঠাৎ শরীরে সূর্যোদয়!
মা, অপর্ণা মুছে গেল এদের মুখের টুকিটাকি।
বলেই ফেলল অপর্ণার ছবি, হাঁ করে দেখছ! আমি নতুন নাকি?
পুলু, একটা সত্যি কথা, এবার তবে বলি তোকে,
আমি মরে যাচ্ছি যন্ত্রনাতে
আমি মরে যাচ্ছি বিচ্ছেদ, শোকে!
দিদি, বাবা, মা, অপর্ণা এরা না। কার কথা বলছি জানিস?
একটু ভাল করে মনে করে দেখ, তুইও ওদের খুব কাছ থেকে চিনিস।
মনে পরে সেই খুলনা যাওয়া পদ্মা নদী, ছবির সেট?
হঠাৎ তুই ডাকলি আমায়, হাতটা দে না ইডিয়েট।
হ্যাঁ, ঐ গল্পের পাতা, আমার অপ্রকাশিত প্রথম বই।
গল্পের শুরুটা তুইও জানিস, গল্পের শেষটা গেল কই?
সেদিন গল্পে ঝিঁঝি ডাকছিল, মাথার উপর বৃক্ষছাতা।
সূর্যোদয়কে সামনে পেয়ে উড়িয়েছিলাম গল্পের পাতা।
ওরা কি সব ওখানেই আছে? চালে ডালে পাতা সংসার।
সংসার না বৈরাগ্য? কি জীবন হয় ছেঁড়া পাতার?
এসব আমার জানা দরকার। এসব আমার জানা প্রয়োজন।
ব্যার্থ লেখক অপূর্ব রায়ের ওরাই হলো আত্মা স্বজন।
ওরা আমার সাথে বাসে ওঠে, আমার সাথে অফিস করে।
শুধু পেছন ফিরে দেখতে গেলেই, ওরা বৃক্ষবনে লুকিয়ে পড়ে!
আর যখন ঘুমিয়ে পরি, ওরা স্বপ্নে আসে অহরহ।
আসলে শুধু ছেড়ে এসেছি তো, কখনো ওদের করি নি দাহ।
এখন আমার মায়ের বয়স, সন্ধ্যে হলেই আসে জ্বর।
বাবা বসে জল সেঁক দেয়। বলে অপু, লেখাটা শেষ কর।
পশ্চিমের টিকিট কেটেছি ভোর হলেই রওনা হব।
খেলনা, মুখোশ, কলের গাড়ি; ওদের জন্য কি কি নেব?
গল্পটা যদি জিজ্ঞেস করে, এতদিন পর তুমি এদিকে?
আমি তাহলে সেদিনের সেই অবাক করা সূর্য ডেকে,
সব অধিকার ছেড়ে দেব।
লেখক, পিতা সব...সব...
লেখক শর্ত বিনিময়ে ফিরে পাবে ওরা শৈশব।
গোপন বলতে নিজের কাছে একটা নাম রাখব শুধু,
একটা নাম রাখব শুধু,
পিতা নয় লেখক নয় স্বার্থ নয় শুধু বন্ধু।
চললাম পুলু, জানাব তোকে কি দেখলাম ছেঁড়া পাতায়।
ভাল থাকিস, বইটা ছাপিস।
ইতি,
অপু। অপূর্ব রায়।
রং নাম্বার
********
-হ্যালো
-জি কে বলছেন?
-ভুলে যেতে চাইলেই কি ভোলা যায় সহজে?
-সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু আপনার নামটা বলবেন প্লিজ
-নাম? কত নামেই তো ডাকতে। কোন নামটা বলে স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়া যাবে?
-ইন্টার কম কলিং বেল আর মুঠোফোনের যুগে কড়া নাড়লে কি আর কোন দরজা আজকাল খোলে বলুন?
-ঠাট্টা করার অভ্যেস টা তোমার আগের মতনই আছে, শুধু কন্ঠটা বেশ ভারিক্কি হয়েছে।
-যাক বাবা তা ও ভালো ওটুকু পুরনো মনে হয়নি।
-কিছু কিছু মানুষ কি পুরনো হয়? কখনো!
-আপনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলেন, কবিতা পড়েন বুঝি?
-কবিতা তোমায় দিলেম ছুটি। এত এতদিন পর হঠাৎ তোমার নম্বরটা এভাবে পেয়ে যাবো বুঝিনি। ভেবেছিলাম তোমায় চমকে দিবো৷ হলো না
-চমকাই নি কে বললো? রীতিমতো হার্ট বেচারার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। হরি হর কম্পন যাকে বলে।
- এত এত স্মৃতি সব ভুলে গেলে? তবে যে কবি বলেছেন চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। সবই তবে ভুল ছিল।
- তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রুপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
- জনমে জন্মে যুগে যুগে অনিবার
- আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হলো না। জানলে না হয় মনের পচা ডোবাটাতে ডুব দিয়ে খুঁজতাম। তবে আপনার মতন অমন প্রিয়ভাষিণীকে টলটলে ঝরনার স্ফটিক অবয়বেই মিলবে, তাই না বলুন?
- মায়া,ভাবনা, তৃষনা বৃষ্টি ? যে নামগুলো তলিয়ে গেছে ওরা নাহয় সেখানেই থাকুক, পরম শান্তিতে। রাখি
- না না প্লিজ রাগ করবেন না। যার ওপরে আপনার এত অভিমান তার নামটা তো বলুন?
- (হেসে) অভিমান? সে তো ভালোবাসার মিষ্টি রাজকন্যা। রাখছি, ভালো থেকো। খুব জ্বালালাম।
- আবার কবে জ্বালাতে ফোন করবেন?
- প্রতিশোধ নিচ্ছো? নাও। সে অধিকার তোমার আছে
- না সত্যি জানতে চাইছি। আপনার নাম্বারটা হাইড করা তাই আমার পক্ষে তো ফোন করা সম্ভব নয়।
- যাকে হারিয়েই ফেলেছো তাকে আর মনে করা কেন?
- নতুন করে মনে রাখবো বলে। ভালো কথা আমার নাম সুমন্ত চৌধুরী
- বুঝলাম না?তুমি মানে আপনি রাজ দ্বীপ নন।
- রাজ দ্বীপ? হুম হতে পারলে ভালোই হতো কিন্তু এ জন্মে তো...
- ওমা সে কি? আগে বলবেন না? ছি ছি কত আজেবাজে বকলাম। খুব খুব সরি। কেউ আমাকে রঙ নাম্বার দিয়েছে।
- রঙ নাম্বার বলছেন?কোন নম্বরটা সঠিক বলতে পারেন? প্লিজ কাল এ সময়ে ফোন করবেন? আপনার সব অভিমান চাদরে ঢেকে, ভালোবাসাটুকু বুঝে নিবো।
-- ক্লিক
- হ্যালো, শুনছেন? হ্যালো
-যাক বাবা তা ও ভালো ওটুকু পুরনো মনে হয়নি।
-কিছু কিছু মানুষ কি পুরনো হয়? কখনো!
-আপনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলেন, কবিতা পড়েন বুঝি?
-কবিতা তোমায় দিলেম ছুটি। এত এতদিন পর হঠাৎ তোমার নম্বরটা এভাবে পেয়ে যাবো বুঝিনি। ভেবেছিলাম তোমায় চমকে দিবো৷ হলো না
-চমকাই নি কে বললো? রীতিমতো হার্ট বেচারার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। হরি হর কম্পন যাকে বলে।
- এত এত স্মৃতি সব ভুলে গেলে? তবে যে কবি বলেছেন চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। সবই তবে ভুল ছিল।
- তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রুপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
- জনমে জন্মে যুগে যুগে অনিবার
- আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হলো না। জানলে না হয় মনের পচা ডোবাটাতে ডুব দিয়ে খুঁজতাম। তবে আপনার মতন অমন প্রিয়ভাষিণীকে টলটলে ঝরনার স্ফটিক অবয়বেই মিলবে, তাই না বলুন?
- মায়া,ভাবনা, তৃষনা বৃষ্টি ? যে নামগুলো তলিয়ে গেছে ওরা নাহয় সেখানেই থাকুক, পরম শান্তিতে। রাখি
- না না প্লিজ রাগ করবেন না। যার ওপরে আপনার এত অভিমান তার নামটা তো বলুন?
- (হেসে) অভিমান? সে তো ভালোবাসার মিষ্টি রাজকন্যা। রাখছি, ভালো থেকো। খুব জ্বালালাম।
- আবার কবে জ্বালাতে ফোন করবেন?
- প্রতিশোধ নিচ্ছো? নাও। সে অধিকার তোমার আছে
- না সত্যি জানতে চাইছি। আপনার নাম্বারটা হাইড করা তাই আমার পক্ষে তো ফোন করা সম্ভব নয়।
- যাকে হারিয়েই ফেলেছো তাকে আর মনে করা কেন?
- নতুন করে মনে রাখবো বলে। ভালো কথা আমার নাম সুমন্ত চৌধুরী
- বুঝলাম না?তুমি মানে আপনি রাজ দ্বীপ নন।
- রাজ দ্বীপ? হুম হতে পারলে ভালোই হতো কিন্তু এ জন্মে তো...
- ওমা সে কি? আগে বলবেন না? ছি ছি কত আজেবাজে বকলাম। খুব খুব সরি। কেউ আমাকে রঙ নাম্বার দিয়েছে।
- রঙ নাম্বার বলছেন?কোন নম্বরটা সঠিক বলতে পারেন? প্লিজ কাল এ সময়ে ফোন করবেন? আপনার সব অভিমান চাদরে ঢেকে, ভালোবাসাটুকু বুঝে নিবো।
-- ক্লিক
- হ্যালো, শুনছেন? হ্যালো
বুদ্ধদেব বসুর কবিতা
নদীর স্বপ্ন
কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।
দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল'ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে' শুয়ে' - মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক'রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ'লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমর দু'জন দেখি ব'সে ব'সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ'য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ'য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ'লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ'লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।
চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল'ব মাথা পেতে।
নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।
অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়
শুয়ে' শুয়ে' - মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?
কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।
ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক'রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব।
ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ'লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।
আমর দু'জন দেখি ব'সে ব'সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ'য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ'য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ'লো তার পরে।
সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ'লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা-
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।
তালেব মাস্টার
- আশরাফ সিদ্দিকী
তাল সোনাপুরের তালেব মাস্টার আমি ঃ
আজ থেকে আরম্ভ করে চল্লিশ বছর দিবসযামী
যদিও করেছি লেন নয় শিক্ষার দেন
(মাফ করবেন ! নাম শুনেই চিনবেন)
এমন কথা কেমন করি বলি!
তবুও যখন ঝাড়তে বসি স্মৃতির থলি
মনে পড়ে অনেক কচি মুখ, চপল চোখঃ
শুনুনঃ গর্বের সাথে বলিঃ
তাদের ভেতর অনেকেই এখন বিখ্যাত লোক!
গ্রাম্য পাঠশালার দরিদ্র তালেব মাষ্টারকে
না চিনতে পারেন! কিন্তু তাদেরকে
নাম শুনেই জিনবেন!
(মুনাজাত করি! খোদা তাদের আরও বড় করেন।)
অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে আমার
পিঠ বেঁকে গিয়েছে আর
চোখেও ভাল দেখি না তেমন
তাই ভাবছিঃ সময় থাকতে থাকতে এখন
আত্মকাহিনীটা লিখে যাবো আমার!
রবিবাবু থেকে আরম্ভ করে আজকের তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্রায়
আর কত সাহেব, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়,
রায়...
কত কাহিনীই আপনারা লিখে গেলেন।
কিন্তু মানিকবাবু! আপনি কি এমন একটি
কাহিনী শুনেছেনঃ
কোথাও রোমাঞ্চ নেই! খাঁটি করুণ
বাস্তবতা----
এবং এই বাংলাদেশেরই কথা!
নমস্কার।
আমিই সেই তালসোনাপুরের তালেব মাষ্টার!
আরম্ভটা শুধু সাধারণ। কারণ
রক্তস্নানে শুভ্র হয়ে সত্তর বছর পূর্বে যখন
প্রথম আলো দেখলাম, হাসলাম এবং বাড়লাম
তখন থেকেই ট্রাজিডি চলছে অবিরাম!
লেখাপড়ায় যদিও খুব ভাল ছাত্র ছিলাম
অষ্টম শ্রেণীতে উঠেই বন্ধ করে দিতে হল কারণ
পিতামাতার সংসারে নিদারুণ-অনটন!
জমিদার সাহেবের কৃপায় চাকুরি জুটে গেল
একখানা
ডজন খানেক ছেলেমেয়ে পড়ানো; মাসিক
বেতন
তিন টাকা আট আনা!
(তাদের মধ্যে একজন এখন ব্যারিস্টার!
জানি না তালেব মাষ্টারকে মনে আছে
কিনা তার!)
পাঠশালা খুলেছে তারপর সুদীর্ঘ দিন ধরে বহু
ঝঞ্ঝা ঝড়
বয়ে গেছে। ভলেছি
অক্লান্তভাবেই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলেছি।
পানির মত বছর কেটে গেল
কত ছাত্র গেল, এল-
প্রমোশন পেল
কিন্তু দশ টাকার বেমী প্রমোশন হয়নি আমার!
কপালে করাঘাত করেছিলাম জীবনে প্রথম
সেবার
যখন টাকার অভাবে একটি মাত্র ছেলের পড়া
বন্ধ হল!
আক্রার বাজার। চাল-নুনেই কাবার!
কীই বা করার ছিল আমার!
ঘরে বৃদ্ধ মা-বাপ
পুরাতন জ্বরে ভুগে ভুগে তারাও যখন ছাড়ল শেষ
হাঁফ
দুঃখ করে শুধু খোদাকে বলেছিলাম একবারঃ
এতো দরিদ্র এই তালেব মাষ্টার!
তবু ছাত্রদের বুঝাই প্রাণপণঃ
‘সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন’।
দেশে আসল কংগ্রেস, স্বদেশী আন্দোলন
মহাত্মার অনশন! দেশব্যাপী সে কী আলোড়ন
খিলাফতের ঝড় বইছে এলোমেলো
খড়ো ঘরে ছাত্র পড়াই আর ভাবিঃ এই সুদিন
এল!
মন দিয়ে বুঝাই পলাশীর যুদ্ধ,
জালিয়ানওয়ালার হত্যা
হজরত মোহাম্মদ, রাম-লক্ষণ আর বাদ্.সা
সোলেমানের কথা
গুণ্ গুণ্ করে গান গাই ‘একবার বিদায় দাও
মাগো ঘুরে আসি
অভিরামের হয় দীপান্তর, ক্ষুদিরামের মাগো
হয় ফাঁসি’!
আসল মোসলেম লীগ, কম্যুনিষ্ট বন্ধু
সকলের কথাই ভাল লগেঃ ভাবি এরাও বুঝে
দেশের বন্ধু!
কোথায় শুনি ঝগড়া লেগেছে!
আগুন জ্বলেছে-জ্বলুক! ওরা
তবুত জেগেছে! ভায়ে ভায়ে ঝগড়া কদিন
যাক!
নিভবেই! বলিঃ
লেজে যদি তোদের আগুন লেগেই থাকে তবে
শত্রুর
স্বর্ণ-লঙ্কাই পোড়া।
ছেলেটি কাজ করে মহাজনী দোকানে
মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে! প্রাণে
তবুও বেঁচে আছি। আসল পঞ্চাশ সাল
ঘরে বাইরে হাটে-বাটে আকাল। ঘোর আকাল!
একশো টাকা চালের মণ পঞ্চাশ হায় পঞ্চাশ!
ঘরে বাইরে দিনের পর দিন উপাস হায় উপাস!
গ্রামের পর গ্রাম কাল-কলেরায় উজাড়!
নিরীহ তালেব মাষ্টারের বুকেও বজ্র পড়ল!
কলেরায়
ছেলেটি মারা গেল বিনা পথ্যে বিনা
শুশ্রুষায়!
কাফনের কাপড় জোটেনি তাই বিনা কাফনে
বাইশ বছরের বুকের মানিককে কবরে শুইয়ে
দিয়েছি এখানে!
এই-ই শেষ নয়-- শুনুনঃ বলি
মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম পাশতলী
সেখানেও আকাল! মানুষে মানুষ খায়।
তিন দিনের উপবাসী আর লজ্জা বস্ত্রহীন হয়ে
নিদারুন ব্যখায়
দড়ি কলসী বেঁধে পুকুরের জলে ডুবে মরেছিল
একদিন সন্ধ্যায়
মানিকবাবু আমি জানিঃ প্রাণবান লেখনী
আপনার
তালেব মাষ্টারের সাথে হয়ত আপনিও অশ্রু
ফেলেছেন বেধনার
কিন্তু আশ্চর্য! আজও বেঁচে আছি আমি
এবং অক্লান্তভাবে দিবসযামী
তালসোনাপুরের প্রাইমারী পাঠশালায়
বিলাই জ্ঞানালোকঃ
ছাত্রদের পড়াই ‘ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরে, বাঁধ
বাঁধ বুক
যতদিকে দুঃখ আসুক আসুক.....’।
শুভাকাঙক্ষীরা সকলে আমায় বলে ‘বোকা
মাষ্টার’
কারণ ঘরের খেয়ে যে বনের মোষ তাড়ায় তা
ছাড়া
সে কি আর!
যুদ্ধ থেমে গেছে। আমরা তো স্বাধীন
কিন্তু তালেব মাষ্টারের তবু ফিরল না তো
দিন!
স্ত্রী ছয় মাস অসুস্থা
আমারও সময় হয়ে এসেছেঃ এই তো শরীরের
অবস্থা!
পাঁচ মাস হয়ে গেছে, শিক্ষাবোর্ডের বিল
নাই
হয়ত এবারের টাকা আসতে আসতে শেষ হবে
আয়ু! তাই
শতছিন্ন জামাটা কাঁধে ফেলে এখনো
পাঠশালায় যাই
ক্ষীণ কন্ঠে পড়াইঃ
‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে..’
মনে মনে বলিঃ
যদিই ফোটে একদিন আমার এই সব সূর্যমুখীর কলি।
ইতিহাস সবই লিখে রেখেছে। রাখবে---
কিন্তু এই তালেব মাষ্টারের কথা কি লেখা
থাকবে?
আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা
আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু
নিজের জীবনই অন্ধকারমালা।
মানিকবাবু! অনেক বই পড়েছি আপনার
পদ্মানদীর মাঝির ব্যাথায় আমি কেঁদেছি বহু
বার
খোদার কাছে মুনাজাত করিঃ তিনি
আপনাকে
দীর্ঘজীবী করুন
আমার অনুরোধঃ আপনি আরও একটা বই লিখুন
আপনার সমস্ত দরদ দিয়ে তাকে তুলে ধরুন
আর, আমাকেই তার নায়ক করুন!
কোথাও রোমান্স নেই। খাঁটি করুণ-বাস্তবতা
এবং এই বাংলাদেশরেই কথা।
এই কবিতাটি মূল র্তুকী থেকে ইংরেজিতে, পরে
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
জেলখানার চিঠি
অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়
১
প্রিয়তমা আমার
তোমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছ ;
মাথা আমার ব্যথায় টন্ টন্ করছে
দিশেহারা আমার হৃদয়।
তুমি লিখেছ ;
যদি ওরা তোমাকে ফাঁসী দেয়
তোমাকে যদি হারাই
আমি বাঁচব না।
তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধু আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ূ
বড় জোর এক বছর।
মৃত্যু…
দড়ির এক প্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয় সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাসীর দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে
ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে
ভয়।
অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।
২
বধু আমার
তুমি আমার কোমলপ্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে চায়
বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে ।
ও নিয়ে ভেবনা
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সব সময় ফুর্তি থাকে।
বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরির একই ডাল একই ঝড়ে
দুবার দোলে না।
গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।
আমি তোমাকে চাই ;তোমার মত রমনীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু,আমার প্রিয়তমার মত…..।।।
আমি জানি, দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।
৩
নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে।
মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি প্রিয়তমা।
রাত্রির অন্ধকারে,গ্রামদেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, তোমাকে স্পর্শ করছি।
আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।
৪
রাত এখন ন’টা
ঘন্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলের দরোজা তালা বন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশি দিন কাঁটল
আটটা বছর।
বেঁচে থাকায় অনেক আশা,প্রিয়তমা
তোমাকে ভালবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর কী আশায় রঙ্গীন তোমার স্মৃতি….।
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আমি আর শুনতে চাই না গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইব।
আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের ওপর এলানো
আমরা আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে।
দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে !
৫
যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলি নি।
৬
কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধুসর চোখে তুমি আছো আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মত ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি,
লাঙ্গল-চষা ভূঁইতে
মাটির বুক ফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আদ্র ওষ্ঠোধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।
আশাভঙ্গে অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে।
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাই নি ?
আমি জেলে যাবার পর – নাজিম হিকমত
অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়
জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুণে গুণে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।
পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে –
‘কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল।’
আমি বলব –
‘না , আমার জীবনের দশটা বছর।’
যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হাপ্তাও লাগেনি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে :
‘একটা গোটা জীবন।’
আমি বলব :
‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’
যখন জেলে এলাম
খুনের আসামী ওসমান
কিছুকাল যেতেই ছাড়া পেল
তারপর চোরাই চালানের দায়ে
ঘুরে এসে ছ-মাস কয়েদ খাটল
আবার খালাস হল।
কাল তার চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার
এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে।
আমি জেলে আসবার সময়
যে সন্তানেরা জননীর গর্ভে ছিল
আজ তারা দশ বছরের বালক।
সেদিনকার রোগা ল্যাংপেঙে ঘোড়ার বাচ্চাগুলো
এখন রীতিমত নিতম্বিনী।
কিন্তু জলপাইয়ের জঙ্গল আজও সেই জঙ্গল
আজও তারা তেমনি শিশু।
আমি জেলে যাবার পর
দূরবর্তী আমার শহরে জেগেছে নতুন নতুন পার্ক
আর আমার বাড়ির লোকে
এখন উঠে গেছে অচেনা রাস্তায়
সে বাড়ি আমি চোখেও দেখিনি।
যে বছর আমি জেলে এসেছিলাম
রুটি ছিল তুলোর মত সাদা
তারপর মাথাপিছু বরাদ্দের যুগ
এখানে এই জেলখানায়
লোকগুলো মুঠিভর রুটির জন্যে হন্যে হল
আজ আবার অবাধে কিনতে পারো।
কিন্তু কালো বিস্বাদ সেই রুটি।
যে বছর আমি জেলে এলাম
দ্বিতীয় যুদ্ধের সবে শুরু
দাচাউ-এর শ্মশানচুল্লী তখনও জ্বলেনি
তখনও পারমাণবিক বোমা পড়েনি হিরোশিমায়।
টুঁটি-টিপে-ধরা শিশুর রক্তের মত সময় বয়ে গেল
তারপর সমাপ্ত সেই অধ্যায়।
আজ মার্কিন ডলারে শোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধের বোল।
কিন্তু আমি জেলে যাবার পর
আগের চেয়ে ঢের উজ্জ্বল হয়েছে দিন।
আর অন্ধকারের কিনার থেকে
ফুটপাথে ভারী ভারী হাতের ভর দিয়ে
অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষ।
আমি জেলে যাবার পর
সূর্যকে গুণে গুণে দশ-বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি
জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে
যা লিখেছি
সব তাদেরই জন্যে
যারা মাটির পিঁপড়ের মত
সমুদ্রের মাছের মত
আকাশের পাখির মত
অগণন,
যারা ভীরু, যারা বীর
যারা নিরক্ষর,
যারা শিক্ষিত
যারা শিশুর মত সরল
যারা ধবংস করে
যারা সৃষ্টি করে
কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে।
আর যা কিছু
-ধরো, আমার জেলের দশটা বছর-
ওসব তো কথার কথা ।
“তুমি আসবে বলে” –শিমুল মুস্তাফা
তুমি আজ আসবে বলে-
বহুক্ষণ আমি অবাক হয়েছি!
ঘরের চৌদিকের দেয়ালের ছুল গুলো পরিষ্কার
করেছি
আমার ঘরটাকে আমি নিজেই আপন করে সাজিয়েছি
সেই সারা রাত ধরে!
এটা কদম ফুলের মাস
আমি ভুলিনি, তাই
তোমার প্রত্যাশায় আমি ছিঁড়েছি
এক গোছা কদম ফুল
সুগন্ধি সাবান নিয়ে ছুটে গেছি পুকুর পাড়ে
আমার এক মাত্র সাদা শার্ট টাকে ধোবার জন্য
বিশ্বাস কর, শার্টের কলারে ভীষণ ময়লা ছিল
তবুও আমি ভালো করে ধুইনি,
ছিঁড়ে যাবার ভয়ে?
পরিচ্ছন্নতার ভয়ের চেয়ে, তোমার
প্রতি ভয়টা বেশী বলেই হয়ত!
ধুলো পড়া আয়নার কাছে গিয়েছি বার বার
হেয়ার ইস্টাইল ঠিক করতে করতে-
নিজের প্রতি ঘেন্না জমিয়েছি
তবুও, আমি কত রাত গুলো কম খেয়ে
পয়সা জমাচ্ছি, শুধু প্রত্যাশায়
তুমি আজ আসবে
নিজের জীবনের চেয়ে-
ভালবাসার মূল্য নাকি অনেক বেশী?
অথচ, অথচ জীবনের জন্যে ভালবাসা
নারীর সৌন্দর্যের চেয়ে- পুরুষেরপৌরস্য অনেক
ঊর্ধ্বে
অথচ, আমি আজ ভীষণ অসহায়
তবুও বিশ্বাস কর, হে নারী-
বেঁচে থাকার ইচ্ছা এখন আগের চেয়ে ঢের বেশী..
তোমার চিঠিতে তুমি উল্লেখ করেছ-
শনিবারে তুমি আসছ, তাই
সমস্ত শনিকে কাঁটিয়ে, সেই শনির অপেক্ষায় ছিলাম
আজকের এই দিনে আমি স্বর্গে যেতেও রাজি নই
আজ আমি স্বর্গ কে উৎসর্গ করলাম
আজ আমি হৃদপিণ্ডে নাঙল চালানো বন্ধ করলাম
আমি আমি মুখ দিয়ে চিহ্নের মত-
বিষাক্ত ধোঁয়া বের করা বন্ধ করলাম
আজ আমি বন্ধ করলাম, চরিত্রকে বিক্রি করা
যদি কোনদিন মনে হয়,
আমার হৃদপিণ্ডে দুষিত রক্ত আছে!
যদি কোনদিন মনে হয়,
আমার ফুসফুসে বিষাক্ত ধোঁয়া আছে!
যদি কোনদিন মনে হয়,
আমার চরিত্রে কলঙ্ক আছে!
তবে, তবে সেদিন আমার বিশ্বাসে
তোমার বিষ দাঁত বসিয়ে দিও
আমি সব আসনে থেকে, নির্দ্বিধায়
সেই বিষ-
গ্রহণ করবো, গ্রহণ করবো, গ্রহণ করবো ।
কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড
– আব্দুল মান্নানসৈয়দ
এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।
আমরা এখন কয়েকটি অক্ষর
-আবদুন নুর তুষার
আমরা এখন কয়েকটি অক্ষর
বিদেশী ভাষায় মুঠোফোনের অক্ষরালাপ
আমরা এখন ইনবক্সে পত্রশিল্পী
আমাদের আলিঙ্গন, চুম্বন, আবেগের আতিশয্য
হৃদকম্স্পপন, স্পর্শ , গন্ধ বিবর্জিত এখন ।
আমরা এখন স্মার্টফোনে
ইমোটিকন আর ডুডল
ভাইবার আর হোয়াটসঅ্যাপ এ
কিছু লেনদেন।
আমরা অমানবিক উইন্ডোজ,
আই ও এস আর অ্যান্ড্রয়েড এর দাস।
আমরা কথা বলি না
আমাদের আঙ্গুল কথা বলে।
আমরা অমানবিক প্রেমে ডুবে থাকা
মানব মানবী।
আমার তবু মানুষ হতে ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করে জড়িয়ে থাকি তোমার কোমর,
বৃষ্টিভেজা বিকেল বেলা
এক পেয়ালা চায়ে ছোঁয়াই যুগলওষ্ঠ!
হাতে হাত রেখে হাঁটি
এক রিকশায় জড়োসড়ো বসি শীতের ভোরে
ইচ্ছে করে মুঠোর মধ্যে তোমায় ধরি
আর কিছু নয়!
তোমার নাকফুল বাঁধা দিক আমায়
কানের দুল বিরক্ত করুক
তোমার বেশী কাছে গেলে!
তোমার নুপুর এর শব্দে সচকিত হোক
পাশের ঘরের প্রতিবেশী!
ঘরময় ছড়িয়ে থাকুক
মালা থেকে ঝরে পড়া মুক্তা
আর নুপুরের ঘন্টি।
অমানবিক এই জীবনে
ঘটেনা সেসব কিছুই
আমরা অক্ষর হয়ে থেকে যাই
আর আমাদের বিব্রত করে
চার্জ শেষ হয়ে আসা
মোবাইল ডিভাইস।
আমাদের দারিদ্রসীমা ছুঁয়ে যায়
ইন্টারনেট আর ফোনের বিল।
আমার তবু স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে বন্ধু হতে, মানুষ হতে!
তোমার মানুষ।!!
বেকারের চিঠি
মণিভূষণ ভট্টাচার্য
আমার বয়স যে বছর একুশ পূর্ণ হলো —
ভোট দিলাম।
দ্বিতীয়বার যখন চটের পর্দা-ঢাকা খোপরিতে ঢুকে
প্রগতিশীল প্রতীক চিহ্নে ছাপ মারছি তখন আমি ছাব্বিশ।
ঊনত্রিশ বছর বয়সেও বিশ্বের নিঃস্বতম গণতন্ত্র রক্ষার জন্য
আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছিলো।
কিন্তু এ বছর ভোটের দিন সারাদুপুর তক্তপোষে শুয়ে
বেড়ার ফোকর দিয়ে পতাকা-ওড়ানো রিকসার যাতায়াত দেখেছি
কিন্তু ভোট দিতে যাই নি।
না, আমি ভোট বয়কট করিনি
ভোট আমাকে বয়কট করেছে।
কারণ আমার বয়স একত্রিশ।
তিরিশের পর সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না।
যে সরকার আমাকে চাকরি দেবে না —
সেই সরকার গঠনের জন্য
গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর —
এরকম আশা করা যায় না।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্য বয়স পাঁচ বছর শিথিলযোগ্য,
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ
বিশেষভাবেই অনুপস্থিত।
অগত্যা সরকারি চাকরি পাবার একটাই উপায় আছে
সার্টিফিকেট জাল করে বয়স কমিয়ে ফেলা।
কিন্তু হে নন্দিত নেতৃবৃন্দ, যদিও আমার চোখের উপর
আপনাদের অনির্বচনীয় লীলাময় জীবন খোলা আছে
তবু জালিয়াৎ হতে পারবো না —
আমার বাবা সৎ ছিলেন।
এই গঞ্জের বাজারে, ন্যাড়া ছাতিমতলায়, কাঁচাপাকা চুলে,
পুরু কাচের চশমা চোখে যে বৃদ্ধটি কুঁজো হয়ে
মান্ধাতার আমলের টাইপরাইটারে
আমার এবং আমার মতো শত শত চাকরিপ্রার্থী এবং
ভোটদাতা অর্থাৎ আপনাদের পরমান্নদাতা যুবকের
হাজার হাজার দরখাস্ত টাইপ ক’রে দিতেন —
একদিন ভরদুপুরে তার বুকের বাঁদিকের লজঝড়ে টাইপমেশিনটা
বিগড়ে গেল।
সেই ফাঁকা জায়গায় আমি কলা নিয়ে বসে পড়লাম।
কার্বাইডে পাকানো চালানী মর্তমান কলার রঙ
যদিও বোম্বাই-অভিনেত্রীর চটককেও হার মানায়,
তবু খেতে অতিশয় অখাদ্য, ফলে আমাকে ডাবের সঙ্গে
ভাব জমাতে হোলো।
পা ফাক করে দাঁড়িয়ে ধুতি-পাঞ্জাবী শার্ট-প্যান্ট যখন
সরু নল দিয়ে চোঁ চোঁ করে সুমিষ্ট জল টেনে নিতো,
তাদের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে আমি এই গঞ্জের
ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানুষের মর্মান্তিক মহিমাকে স্পর্শ করতাম।
ডাবের খোলাটি ছুঁড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে, ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে
দেখতাম, অধিকাংশ অমেরুদণ্ডী বুদ্ধিজীবীদের মতোই,
ভিতরে শাঁস আছে কিনা।
তারপর চিরুনী ব্লাউজ ধূপকাঠি তরমুজ চাল
হোসিয়ারী মাল এবং ধূর্ত নেতা পূর্তমন্ত্রী হবার জন্য
যত বড় স্বপ্ন দেখে ঠিক সেই আয়তনের মিষ্টি কুমড়ো
অর্থাৎ একের পর এক বহুমুখী বাণিজ্য বিস্তারে আমি
বিড়লাকেও ছাড়িয়ে গেলাম, কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে
শিকে ছিড়লো না। ফলে প্রায় বিনা চিকিৎসায়
মা মারা গেলেন।
আমাদের এখানে গত কুড়ি বছরে আধখানা হাসপাতাল
হয়েছে, বাকি আধখানা হবে না, কারণ প্রধান রাজনৈতিক
দলের নেতারা অধিকাংশই ডাক্তার এবং তাদের
নার্সিং হোম আছে।
রোজ ভোর চারটেয় উঠে আমি যখন বস্তির
গণতান্ত্রিক খাটা পায়খানায় লাইন দিতাম,
মা নিজের – হাতে - দেওয়া ঘুঁটে জ্বালিয়ে চা করে দিতেন।
সেই স্যাঁতসেতে অন্ধকারে ধোঁয়াটে আগুনের সামনে
বসে-থাকা মা- কে আমার ভারতবর্ষ বলে মনে হোতো।
দিদির মৃতদেহ দড়ি কেটে নামাবার পর থেকে
মা একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।
যার সঙ্গে দিদির বিয়ে হয়েছিলো সে গরীব ছিলো এবং
ভালো ছিলো। কিন্তু দারিদ্র্য তাকে মহানও করেনি বা
খ্রীষ্ট্রের সম্মানও দেয় নি — এক চোরাকারবারি
শ্রমিকনেতার আড়কাঠিতে পরিণত করেছিলো। সে সেই
নেতাকে মহিলা সরবরাহ করতো —
সেই নেতার সঙ্গে মন্ত্রীর যোগাযোগ ছিলো,
মন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রের যোগ ছিলো,
কেন্দ্রের সঙ্গে পরিধির যোগ ছিলো,
পরিধির সঙ্গে ব্যাস এবং ব্যাসের সঙ্গে
ব্যাসার্ধের সংযোগ ছিলো এবং এইসব সূক্ষ্ম যোগাযোগগুলি
একসঙ্গে গিঁট লেগে একটা মোটা নাইলনের দড়ি হয়ে
দিদির গলায় ফাঁস লাগিয়েছিলো।
চাকরি আমার হতো।
জেলার সব ছাত্রদের মধ্যে আমি যদি মাতৃভাষায়
প্রথম না হয়ে আপনাদের পিতৃভাষা অর্থাৎ
ইংরেজিতে প্রথম হতাম, হয়তো আমার বরাত
খুলে যেতো। অথবা আমার বন্ধুরা —
যারা ঠিক ঠিক জায়গায় তেল সরবরাহে
আরব রাষ্ট্রগুলিকেও হার মানিয়েছে —
আমি যদি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
নামতে পারতাম তাহলে আমার গলায়
বাদামের ঝুড়ির বদলে নেকটাই ঝুলতো।
গর্তে-ঢুকে-যাওয়া ফ্যাকাসে হলুদ রঙের দুটো চোখের
শূন্য দৃষ্টি এবং একটা অকেজো টাইপ মেশিন ছাড়া
বাবা আমার জন্য আর কিছু রেখে যেতে পারেন নি।
এ বছর জীবনের সর্বশেষ ভোটটি দিয়ে মা চলে গেলেন। ভারতবর্ষ পড়ে রইলো।
আমার আর কোনো দায় নেই।
যেহেতু আজকের দর্শন আগামীকালের সংস্কার মাত্র
এখন যদি আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাই।
বন্ধুরা বলবে, ‘পালিয়ে গেল’।
বিদেশি টাকায় পুষ্ট যে সব তথাকথিত
জনসেবা প্রতিষ্ঠান আছে — তাতে যদি
ভাতের জন্য ঢুকে পড়ি —
তারা বলবে, ‘ব্যাটা গুপ্তচর’।
যদি আত্মহত্যা করি —
তাহলে, ‘কাপুরুষ’।
আর যদি সোজাসুজি প্রতিবাদ করি —
তাহলে আপনারা, রাজনৈতিক নৈশ প্রহরীরা
কালো টাকার কুমিরদের অন্ধকার পাড়ায় গিয়ে
মাঝরাতে ‘নকশাল’ ‘নকশাল’ ব’লে
ঘেউ ঘেউ করে তাদের জাগিয়ে দেবেন
এমন কি অবস্থা তেমন তেমন বেগতিক দেখলে
আপনাদের সঙ্গে রাশিয়া আমেরিকাও যোগ দেবে।
এতদিন চাকরি খুঁজেছি। পাই নি।
এবার ভাবছি আমরাই আপনাদের চাকরি দেবো।
আমরা যারা বেকার আধাবেকার ভবঘুরে
বাউন্ডুলে ভিখিরি —
যাদের জমি নেই কিন্তু জমিতে খাটে —
বাড়ি বানায় কিন্তু বাড়ি নেই —
যারা শহরে আলো জ্বালে কিন্তু যাদের কুপিতে তেল নেই —
যারা কারখানা বানায়, কিন্তু কারখানা যাদের
আস্তাকুঁড়ে চালান করে দেয়
যারা কোনোদিন একটা ভালো জামা পরেনি,
সরবত খায় নি,
বেড়াতে গিয়ে পর্বতমালার স্তব্ধ নিরাসক্তি ও মহত্ত্বকে
স্পর্শ করেনি,
যারা জন্মায় আর খাটে, খাটে আর মরে,
যারা পিপড়ের মতো পোকামাকড়ের মতো
শীত-রাত্রির ঝরাপাতার মতো —
সেইসব নিরক্ষর নগণ্য কুঁজো অবজ্ঞাত করুণ
যাদের দেখার জন্য এবং ঠকাবার জন্য আপনারা
বিরাট মঞ্চে উঠে দাঁড়ান —
যারা আগামীদিনের ভারতবর্ষের, গোটা পৃথিবীর এবং
সৌরজগতের মালিক — আমি তাদেরই একজন হয়ে
এই জংশনে স্টেশনে বাদাম বেচে যাচ্ছি।
কশাইয়ের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের মতো জীবন আমাদের —
যে-কোনো মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি — আবার
এই আঙুলের কেন্দ্রীভূত চাপে খোলা ফাটিয়ে বের করে আনা যায়
রাজনৈতিক ক্ষমতার পুষ্টিকর তৈলবীজ, আর সমস্ত শুকনো খোসা
বাতাসে উড়ে যায়, বাতাসের সঙ্গে আকাশ স্পর্শ করে
মানুষের অনন্ত ঘৃণার আগুন —
সেই আগুনের পাশে বসে আছেন আমার মা,
আমার দেশজননী।
না, ‘বিপ্লব’ শব্দটি শুনলেই আপনাদের মতো
আমার কম্প দিয়ে জ্বর আসে না।
যন্ত্রবৎ
যশোধরা রায়চৌধুরী
১
যন্ত্রের ন্যায় কর্ম কর।
গুরু বলিয়াছেন মধ্যবয়স খতরনাক জন্তু।
কোনদিকে দেখিবে না।
দেখিলে মন খারাপ।
কর্মচক্র যেই থামিবে, হেমন্তসন্ধ্যার ঝুপ্পুস মনখারাপ
তোমাকে অধিগ্রহণ করিবে।
সুতরাঙ কর্ম কর, কর্ম কর।
কী কর্ম করিবে?
অধুনা কোভিদকালে কর্মের অভাব?
সমস্ত কাপড়ে সাবান ঘষিয়া ফেনা তুলিয়া দাও
সমস্ত উপাধানে চাদরে টেবিলে দরজায় চেয়ারে
তরল পিচ্ছিল ক্ষারসমুহ ঢালিয়া
খরখরে করিয়া ফেল
রাঁধিয়া বাড়িয়া নিজেকে ক্ষয় কর
খর জিহবার ধার তাহাতে বাড়িবে
কিন্ত মনের ধার কমিলে ত চলিবে না
উশুখুশু চুলে সমস্ত দিন উন্মাদের ন্যায়
কর্ম কর কর্ম কর।
যন্ত্রবৎ।
কেননা যন্ত্রের বিষাদযোগ নাই
যন্ত্রের আত্ম অনুসন্ধান নাই
সোজা কথা যন্ত্রের কাব্যি করার রোগ হইবে না
হইলে, তাহারও বিধান আছে।
যন্ত্রবৎ কবিতা লিখিবে।
২
বারান্দা থেকে ঘর
ঘর থেকে দরজা
দরজারের এপাশ থেকে ফিরে
আবার জানালার প্রান্ত
শুধু ঘর মোছার ন্যাতা
যন্ত্রবৎ বুলিয়ে চলেছ
ঘর থেকে বেরুবার বিধান দেন নি গুরু
আকাশ দেখার ও না
তবু কমিউনিটির ছাতে উঠলে একদিন
পাড়ার বউ ঝিদের সবার মুখোশের আড়াল থেকে
বাক্যবিনিময়ের পর ফিরে
যন্ত্রবৎ আবার মুখোশ, জুতো, জামা , মন
সব কেচে ধুয়ে মেলে দিলে বারান্দায়
আবার পরদিন বারান্দা থেকে ঘর, ঘর থেকে দরজা...
৩
সম্পর্ক এখন খুবই যন্ত্রবৎ। লাভে
লাভচিহ্ন দিয়ে তবে সকালটা শুরু।
লাব্বিউ লেখার পর ভুলে যাওয়া মুখ
রাত্রের মেসেজ বক্সে বক্ষদুরুদুরু
একেকটা মেসেজ, হাই, তুমি কি সিংগল?
এসব মানানসই, কেননা ভঙ্গুর
এই এ জীবন, মন এই মনখারাপ
যৌনতা ঈশ্বর তবু, দগ্ধ দিন কালে
"আহা ভালবাসা" বলে যন্ত্র , যন্ত্রকে ভুলে যাবে...
৪
পশুর মতন বাঁচা , আহা, আর সম্ভব হবে না
যন্ত্রের মতন বাঁচা, হয়ত সম্ভব হতে পারে...
মধ্যবর্তী দোলাচলে, পাশব গন্ধের মধ্যে যৌনতাকাতর মানুষেরা
একটু একটু যন্ত্র খুলে দেখে নেয় কটা এল লাভসাইন, হাই , হ্যালো , আর
কবার নিখুঁতভাবে কেটে নিল এসবের জন্য কিছু জি বি
ডেটাপ্যাকে... মহনীয়, আমরা প্রেমজীবী...
৫
পশু ও যন্ত্রের যুদ্ধ আমাদের জাগ্রত সময়
যখন গভীর ঘুমে, তখনই প্রকৃত অর্থে জাগা
কারণ ঘুমেই আছে আমাদের স্বপ্নপরিসর।
স্বপ্ন আর কল্পনাই প্রকৃত প্রস্তাবে শুধু আমি।
বাকিটা যন্ত্র ও পশু। আমাদের নিয়তি এটাই।
আমরা পশুর মত খাই, পুষ্টি লাভ করি, প্রজনন করি, এইসব
প্রকৃতি করেছে।
আমরা যন্ত্রের মত কাজ করতে পারি,
এইসব সভ্যতা করেছে, কার্যকরী ।
পশু ও যন্ত্রের যুদ্ধ আমাদের জাগ্রত সময়।
নাম - সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
চাই চাই আজো চাই তোমারে কেবলি |
জনশূণ্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি
আজো বলি—
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যত বন্ধ অন্ধকার,
কাম্য শুধু স্থবির মরণ |
নিরাশ অসীমে আজো নিরেপক্ষ তব আকর্ষণ
লক্ষ্যহীন কক্ষে মোরে বন্দী ক’রে রেখেছে, প্রেয়সী,
গতি-অবসন্ন চোখে উঠিছে বিকশি’
অতীতের প্রতিভাস জ্যোতিষ্কের নিঃসার নির্মোকে |
আমার জাগর স্বপ্নলোকে
একমাত্র সত্তা তুমি, সত্য শুধু তোমারি স্মরণ ||
তবু মোর মন চাহে নাই মোহের আশ্রয় |
জানি তুমি মরীচিকা ; তোমা সনে প্রাণ বিনিময়
কোনোদিন হবে না আমার |
আমার পাতালমুখী বসুধার ভার,
জানি, কেহ পারিবে না ভাগ ক’রে নিতে ;
আমারে নিঃশেষে পিষে, মিশে যাবে নিশ্চিহ্ন নাস্তিতে
এক দিন স্বরচিত এ পৃথিবী মম ||
জানি ব্যর্থ., ব্যর্থ সেই সন্ধ্যা নিরুপম
যবে মোর আননে নেহারি
অগাধ নয়নে তব ফলদা স্বাতীর পূণ্য বারি
উঠেছিল সহসা উচ্ছলি |
জানি সেই বনপথে, চিরাভ্যস্ত প্রেম নিবেদনে
আপনারে ছলি,
পশিনি তোমার মর্মে, নিজের গহনে
জমিয়েছিলাম শুধু মিথ্যার জঞ্জাল |
জানি, কত তরুণীর গাল
অমনি অধৈর্যভরে শতবার দিয়েছি রাঙায়ে ;
অনুপূর্ব পথিকার পারে
বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত
ক্ষণিক পুষ্পের লোভে | ক্রমাগত
তাদের পদাঙ্ক মুছে গেছে রৌদ্রে, ধারাপাতে, ঝড়ে ;
যুগান্তরে
তোমার স্মৃতিও জানি, সেই মতো হারাবে ধুলায় ||
তবু চায়, প্রাণ মোর তোমারেই চায় |
তবু আজ প্রেতপূর্ণ ঘরে
অদম্য উদ্বেগ মোর অব্যক্তেরে অমর্যাদা করে ;
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম—
নাম—শুধু নাম—শুধু নাম ||
উপাখ্যান – সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
সাবিত্রী ! তোমাকে দেখলাম কাল বহুদিন পরে।
সূর্য সবেমাত্র শেষ, চৌরঙ্গির অন্ধকারে
জীবনবীমার ঘড়ি জ্বলে ওঠেনি তখনও
দেশী মানুষের হাতে অনেক বিদেশ ঘুরে,
ফিরে আসা জাহাজের গোপন সম্ভার, দেখলে মনে হয়
বড় সুসময়! তুমি দুচোখে ভ্রমর নিয়ে
একা, একা নও একাকিনী, অন্যমনস্ক দাঁড়িয়েছিলে।
কিন্তু দেখছিলে না কিছুই । (প্ৰথমে লিখলাম ‘একা’
তারপর ওই নিঃসঙ্গ শব্দকে না-কেটেই-লিখলাম
‘একাকিনী’। কেন না আমার মনে হল তুমি নির্বাসিত, শুধু,
জনকনন্দিনী নও, রাক্ষস শহর তোমাকে প্রকাশ্যে
দাঁড় করিয়ে রেখেছে সূর্যের নিবন্ত অবেলায়!’)
কবে, কতদিন আগে এই চোখ থেমেছিল তোমার দু-চোখে,
হাত ছুঁয়ে ছিল আষাঢ়মেঘের মতো আর্দ্র কেশপাশ, শুধু
শরীর ছোঁয়নি, কেন-না তখন অকালবর্ষণে বড় ভয়
মনে হত শস্য নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি ধাক্কা দিয়েছিলে
যেমন ঝড়ের আগে ধাক্কা মারে ঈশান বাতাস,
বাসাবড়ি কেঁপে ওঠে, দরজা জানালা শান্তিতে সন্ত্রস্ত হয়,
তুমি গোপন মণির মতো আমার অক্ষর নিয়ে তেমনই মাতাল
সহমরণের শাস্তি দিতে চেয়ে খুলে দেখিয়েছিলে তাজমহল
অমন সমাধি উরু, ভাঁজে উড়ে এসে বসেছিল
হাজার মৌমাছি, তুমি দুষ্টু বালিকার ফুল ছেঁড়ার সমান হিংসায়
ওষ্ঠ থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিলে প্রথম পুরুষ ভাষা ;
চিৎকার করে বলেছিলাম, ‘সাবিত্রী ওখানে শরীর নেই
কোন সত্যবান কবিতার সম্ভাব্য শরীর।’
সেইদিন থেকে আমি বন্দী, সেই থেকে আমি অসম্পূর্ণ
যবন মহিষ ছত্রাকার মাংস ধ্বংস করে কেবলই ভেবেছি
মৃত্যু মানেই পুনর্জন্ম, তবু বুকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি ভাষাকে!
সাবিত্রী সব নদী সাগরে যায় না, সব পাথর
আকাশের বিরুদ্ধ উত্থানে হিমালয় হয়ে উঠে
সূর্যকে থামিয়ে শেষ জিজ্ঞাসা করে না
বল, পৃথিবী কেমন দেখলে?
সন্ধ্যার কলকাতা বড় প্রতারক, নক্ষত্রের নিচে সে-সময়
জলে ওঠে চতুর নিয়ন, জীবনবীমার ঘড়ি
নতুন শিশুর মতো নিজস্ব চীৎকার করে জননীসন্ধানা?
সাবিত্রী নিঃশ্বাস একবারই শরীরের দুঃখ থেকে মুক্তি পায়।
তখনি নারী ও পুরুষচিহ্নের হাড়-মাংস পড়ে থাকে, তাই
তোমাকে ভিড়ের মধ্যে ডাকি নি, তোমাকে পুরুষ চিলের মতো
ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে বলি নি এবার শরীরের নিচে এসে
মুক্তি দিয়ে যাও, আমার সমস্ত কবিতার পক্ষপাত
পুঁড়ে ছারখার হয়ে যাক শ্মশান উৎসবে।
সাবিত্ৰী! তোমাকে দেখলাম কাল, একা, একা নও একাকিনী
বহুদিন পর ।
একটা তুমির গল্প
স্বপ্নীল চক্রবর্তী
***************
তুমি বলেছিলে রাতে তোমার ঘুম হয় না,
আমি বুঝেছিলাম সময় চাইছো;
তুমি বলেছিলে "আকাশে কী মেঘ করেছে দেখো?",
আমি বুঝেছিলাম তোমার মন খারাপ।
তুমি বলেছিলে "চুলে জট বেধেছে";
আমি বুঝেছিলাম তুমি স্পর্শ চাইছো।
তুমি বলেছিলে আজ বিকেলে তুমি বারান্দায় থাকবে;
আমি বুঝেছিলাম সাক্ষাত চাও।
তুমি বলেছিলে,অন্ধকারে আমার বড্ড ভয়;
আমি বুঝেছিলাম তোমার আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে;
তুমি বলেছিলে সমুদ্রে যাবে;
আমি বুঝেছিলাম পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটতে চাইছো।
তুমি বলেছিলে নীল প্রিয় রঙ,
আমি বুঝেছিলাম তোমার কষ্ট হচ্ছে;
তুমি বলেছিলে ঠোঁট ফেটেছে,
আমি বুঝেছিলাম চুমু খেতে চাইছো;
তুমি বলেছিলে অংক ভালো লাগে না,
আমি বুঝেছিলাম তুমি কবিতা ভালোবাসো;
তুমি বলেছিলে " আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে",
তুমি বলেছিলে,এই হুটহাট দেখা করা,
অসময়ে ফোন করা আর তোমার ভালো লাগছে না;
আমি বুঝে গিয়েছিলাম,বিচ্ছেদ চাইছো।
তারপর অলিখিত স্বাক্ষরে তুমি যখন ইনভিজিবল কোর্টে
আমার বিরুদ্ধে বিচ্ছেদের মামলা ঠুকে দিলে;
আমি বুঝেছিলাম তুমি মুক্তি চাও।
এরপর সব বুঝে যখন আমি দার্শনিক,
সব মিটিয়ে তুমি যখন অন্য ঘরের শো-পিস,
একদিন আমাদের দেখা হলো তখন;
তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে,"কেমন আছো?"
আমি বুঝে গিয়েছিলাম তুমি ভালো নেই।
No comments:
Post a Comment